প্রেয়সী পর্ব শেষ

প্রেয়সী – ৩১

সুমনার বিয়ে ঠিক হয়েছে। পাত্রের বয়স ৩৮। ডিভোর্সি। এক বাচ্চা আছে। কিন্তু ভিষণ বড়লোক। বলতে গেলে আমাদের থেকেও উচ্চবিত্ত পরিবার। লোকের দু’চারটে শোরুম ঢাকায় এভেইলেভেল। নিজেদের গাড়ির বিজনেস রয়েছে। আমার মন প্রচন্ড খারাপ হয়ে গেলো। সুমনাকে কী মামা জোর করে বিয়ে দিচ্ছে? এমন একটা লোকের কাছে কেন বিয়ে দিচ্ছে? ডিভোর্স হয়েছে আবার একজন বাচ্চাও আছে। লোকটা কী ভালো হবে? বড়লোক দেখলেই তো হবেনা। লোকটা কেমন সেটাও দেখা প্রয়োজন। সুমনা এখনও বাচ্চা। ওর বাচ্চামি এখনও যায়নি। সম্পুর্ন জেদ মেয়েটার মাঝে।
এমন এক পরিবারে গিয়ে কী ও ভালো থাকবে? কলেজ পৌঁছে
ওর সাথে কথা বলতে চাইলাম। ও বলল না। আমাকে দেখেও চলে যাচ্ছে। দ্রুত সামনে গিয়ে ওর হাত ধরলাম,
– সুমনা? শোন, না।
ঝাটকা মেরে হাত সরিয়ে ফেলল। রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
– হিংসা হচ্ছে? ভাবছিস, ইশ সুমনার ফিউচার হাসবেন্ড তো ভিষণ বড়লোক।
– সুমনা আমার কথা শোন। প্লিজ।
একপ্রকার জোর করে ওকে বারান্দায় নিয়ে আসলাম। ওর হাত দুটো ধরলাম। বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করলাম,
– তোকে কী জোর করে বিয়ে দিচ্ছে?
ও হাসলো। আমার দিক বাকা চোখে তাকাল।
– কী ভাবছিস? আমি ছেছড়া? এখনও তন্ময় ভাইয়ের পিছু ঘুরবো? আমারও প্রেস্টিজ আছে। ছেলেরা হাজার পিছু ঘুরে। যার সাথে বিয়ে হতে যাচ্ছে, সে নিজেই প্রস্তাব পাঠিয়েছেন। পরিবার সহ আমি রাজি হয়েছি৷ হবনা কেনো? এমন সুযোগ কেউ হাতছাড়া করে?
আমিতো জানতাম এই খবর শুনে তুই লাফিয়ে আসবি। কারণ তুই তো লোভী। আমার পছন্দের সব কাড়তে চলে আসিস।
– ট্রাস্ট মি। আমি তোর ভালো চাই সুমনা। তুই যদি সেখানে ভালো থাকিস। অবশ্যই আমি খুসি হব। ভিষণ।
– তোর ঢং আমার সামনে দেখাস না। যত্তসব নোংরা।
চলে গেলো। এতো জেদ দিয়ে কি হবে? শুধু নিজের সর্বনাশ। আর কিচ্ছু না। মেয়েটা কি বুঝতে পারছে না? অবুঝ?

কলেজের পেছন দরজায় তন্ময় ভাই দাঁড়িয়ে। ভিষণ রেগে। আজকে আমাদের গায়ে হলুদ। আর আমি কলেজ এসেছি। তারউপর তাকে বড্ড জ্বালিয়েছি। নিশ্চয়ই তিনি রেগে। আমাকে দেখে চোখ রাঙালেন। কিন্তু সেগুলোর উপর নজর দিলাম না। আমার ভিষণ মন খারাপ আজ। সুমনা’কে নিয়ে। জেদের বসে কী মেয়েটা তার জীবন নষ্ট করে ফেলবে? তন্ময় ভাইয়ের সামনে যেতেই তার বুকে মাথা রাখলাম। তাকে কি বলব সুমনার কথা? যেই লোকের সাথে সুমনার বিয়ে তাকে কী তন্ময় ভাই চিনেন? নিশ্চয়ই চিনেন। তাহলে অবশ্যই তিনি জানবেন লোকটা কেমন? তার হাত ধীরে মাথায় স্পর্শ করলেন। প্রশ্ন করলেন,
– কী হয়েছে?
আনমনে বলতে লাগলাম,
– সুমনা কি খুশি হবে সেখানে? যাকে বিয়ে করবে, লোকটা কী ভালো হবে?
তন্ময় ভাই পিঠে থাপ্পড় দিলেন খুব ধীরে।
– তুই তোর নিজেরটা নিয়ে ভাব। বিয়ের পর তোকে আমি মেরে হাড়গোড় ভেঙে ফেলব।
তাও তার বুকে মাথা দিয়ে রাখলাম। তিনি আমাকে নিয়ে হাঁটা ধরলেন।
– আজ নেহাতি বেঁচে গেলি। নাহলে খেতিস এক থাপ্পড়।
জবাব দিলাম না। কিছুটা যেতেই দ্রুত সোজা হলাম। বাজারের দিক চলে আসছি। তন্ময় ভাই হাসলেন। আমাকে ধরতে আসলে আরেকটু দূরত্ব বজায় রাখলাম। কাল তিনি একা আসেননি। বন্ধুদের নিয়ে এসেছেন। চারজন এসেছে। তাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিয়ের আয়োজন শেষ করে যাবেন। ওইতো দাঁড়িয়ে। আমাকে দেখেই সালাম দিলেন,
– কি অবস্থা ভাবী?
– আলহামদুলিল্লাহ। আপনারা ভালো আছেন?
– জ্বি, আলহামদুলিল্লাহ।

বাড়িতে ফিরে মন খারাপ চলে গেলো। তন্ময় ভাইয়ের মামাতো কাজিন সবগুলি এসেছে। আজ আর কারও মাঝে মন কসাকসি নেই। সকলে বেশ মিলে কাজে নেমে পড়েছে। তন্ময় ভাইয়ের রুম গোছানো হচ্ছে। আমাদের জন্য নতুন ভাবে রুম তৈরি করছে। তেমনই বাড়ি সাজানোর কাজ চলছে। আমাদের বাড়ির মাথাটা সম্পুর্ন লাইটিং দ্বারা ঝলমলে। পাশের চারপাঁচ বাড়ির আন্টি’রা সারা সকাল থেকে এখানেই। তাদের অদ্ভুত কথাবার্তা শুনে আমি উপর থেকে নামলাম না। অথচ তন্ময় ভাই বেশ সোফায় বসে তাদের এইসব কথা শুনে যাচ্ছেন। অবশ্য এটা বললে ভুল হবে। তাকে চেপে ধরে শোনানো হচ্ছে।
বড় চাচ্চু, বড় মা, ছোট চাচী মাত্র ফিরলেন। তারা মাসখানেক যাবত শপিং করে যাচ্ছেন। কাল পর্যন্ত এই শপিং চলতে থাকবে।
দুপুর দিকে আপুর পাশাপাশি আমার গায়ে হলুদ হলো। সে কী কান্ড। বড় ছোট নেই। এদের নাচানাচি দিয়ে মহল্লায় চেঁচামেচি দিয়ে ভরপুর। গায়ে হলদু শেষ হতে, বড় মা আমায় তার রুমে নিয়ে গেলেন। নিজে আমাকে কাপড় পরাতে সাহায্য করলেন। চুলের পানি মুছে দিচ্ছেন। নিমিষেই মায়ের অভাব টা কমে এলো।
মন খারাপ টা দ্রুত গায়ের হয়ে গেলো।

রাতে ছাঁদে আয়োজন করা হয়েছে। হৈহল্লা দিয়ে ভরপুর। আমাকে বড় মা বলে গিয়েছেন সেখানে না যেতে। রুমে থাকতে। বিয়ের আগপর্যন্ত তন্ময় ভাইয়ের সাথে দেখা না করাটা স্রেয়। হাসি পেলো।
একই বাড়িতে আমরা। খেতে গেলে, বসতে গেলে দেখা ত হবেই।
দেখা গেলো তন্ময় ভাই নিজে হাজির। হলুদ পাঞ্জাবি পড়েছেন।
তার গালে হলুদ। নিশ্চয়ই তাকে আবারও লাগিয়েছে।
বাহ। হঠাৎ মনে এলো বড় মা’র আদেশ। দেখাসাক্ষাৎ বন্ধ।
দ্রুত বললাম,
– দেখাসাক্ষাৎ করা যাবেনা।
তন্ময় ভাই শুনেও শুনলেন না। ভ্রু কুঁচকে বিছানায় বসলেন। হুকুম দিলেন,
– আজ এই রুমে ঘুমাব। পাঞ্জাবি টা খুলে দে ত।
পড়লাম আকাশ হতে। আমার রুমে ঘুমাবে?
– বেরোন। এক্ষুনি।
সে আমাকে অবাক করে দিয়ে পাঞ্জাবি খুললেন। তারপর হাত পা মেলে বিছানায় শুয়ে পরলেন। সম্পুর্ন বিছানা নিজে নিয়ে ফেললেন। ভয়ে আমি দরজার দিক তাকালাম। কেউ নেই। যদি কেউ দেখে ফেলে? তাকে বললাম,
– আপনি নিজের রুমে যান।
তার জবাব নেই। ঘুমিয়ে পরেছেন কী? কিছুটা এগোলাম।
হঠাৎ টানে বেখেয়ালি ভাবে তার উপরে পড়লাম। চিৎকার দিতে গিয়েও মুখ চেপে ধরলাম। সে একধ্যানে আমার দিক তাকিয়ে। সামনে থাকা চুলগুলো সরালেন। ঘাড়ে ঠোঁট ছোঁয়াতেই ভুমিকম্পের মতো কাঁপতে লাগলাম। কিছুটা চেপে ধরলেন।
– হলুদের গন্ধ।
– ছাড়ুন।
ভয়ে আমার জান যাচ্ছে। দরজা খোলা। যদি কেউ, ভাবতে ভাবতে আইরিনের আওয়াজ। আমি দ্রুত লাফ দিয়ে উঠলাম। ততক্ষণে আইরিন চোখ বড়সড় করে বলল,
– কিচ্ছু দেখিনি।
লজ্জায় আর নেই আমি। তাকে চোখ রাঙালাম। অথচ তিনি উল্টো হয়ে ঘুমাতে চলে যাচ্ছেন। শ্বাস ফেলে আইরিনের পিছু গেলাম। ঝামেলা উফ।
রাতে ঘুমাতে হলো আপুর সঙ্গে। তন্ময় ভাই ঠিক আমার রুমে ঘুমালেন।

বিয়ের দিন সকালে খবর পেলাম , কাল রাত্রে সুমনার বিয়ে হয়েছে। নিজেরা নিজেরা মিলে। যেহেতু লোকটার এটা দ্বিতীয় বিয়ে, তাই অনুষ্ঠান করবে না। কবুল বলে তুলে নিবে। বোঝা গেল সুমনার শ্বশুর বাড়ির বড্ড তাড়া। মনটা বিষাক্ত হয়ে এলো। মামারা কী হিংসে করে এমন করছে? বিয়ে কি হিংসে করে করার জিনিস? তারা আর কতটা অবাস্তবিক হতে পারে? কিছুক্ষণ পড়ে বাবা হতে জানলাম। সুমনা নিজে বিয়ে করার জন্য পাগল হয়েছিল।
ও আমাকে দেখাতে চাচ্ছিল। যে এর থেকেও বড় ঘরে ও বিয়ে করতে সক্ষম। দীর্ঘনিশ্বাস ফেললাম। মেয়েটা সুখী হোক।
বিয়ের দিনটা গেল আমার নিজের রুমে।
শুধু কার্টুনের মতো বসে ছিলাম। বিউটিশিয়ান তার নিজের মতো সাজাতে ব্যস্ত। মাঝে কয়েকবার তন্ময় ভাইয়ের সাথে মেসেজেস হলো। তিনি মনে হচ্ছে আমায় দেখার জন্য অস্থির।
আমাদের বিয়েতে কান্নাকাটি কিছুই হলো না। কবুল বলার সময় কিছুটা সময় নিয়ে কবুল বলে ফেললাম। তন্ময় ভাই ত একেবারে কবুল তিনবার বলে ফেললেন। সেটা শুনে আমার নিজেরও হাসি থামাতে অক্ষম। অথচ রুবি আপুর বিদায়র সময় আমি কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান। তখন আপুর অবস্থাও নাজেহাল। মেক-আপ প্রায় হিমশিমের মুখে। ইব্রাহিম ভাই আপুকে গাড়িতে তুলতে অক্ষম। জোরপূর্বক তুলতে গিয়েও সে আপুর কিল-ঘুষি খেয়েছেন হাজার।
তাও তুলতে পারেনি। শুধু তন্ময় ভাই আপুকে গাড়িতে বসাতে সক্ষম। তখন তিনি আদুরে কন্ঠে আপুকে তুলে দিয়েছেন। আপুর কাঁদার গতি বেড়ে গিয়েছে আরও। বলা যায় আমার আর তন্ময় ভাইয়ের বিয়েটা ছিল শান্ত। তেমনই আপুর বিয়ে ছিল অশান্ত।

বিদায় হতে বাড়ি শান্ত। কান্নাকাটি শেষ। বাবা আমাকে জড়িয়ে ধরে। মাথায় কয়েকটা চুমু খেয়েছেন। আমিও তাকে জড়িয়ে সোফায় বসে রইলাম। ক্লান্ত লাগছে। নির্ঘাত ঘুমিয়ে যাব। হলোও সেটা। বাবার কোলে ঘুমিয়ে পড়লাম বউ রূপে। ঘুম কেটেছে ছোট চাচীর আওয়াজে। বাড়িতে কেউ নেই। দীপ্ত আইরিন সবগুলো আপুর সাথে গিয়েছে। চাচী ধমকে বললেন,
– তন্ময় রুমে। রাত হয়েছে। তুই এখনও শুয়ে আছিস যে?
বাবা হাসছেন। সে উঠে চাচ্চুদের সাথে বাহিরে চলে গেলেন। তাদের অনেক কাজ রয়েছে। বড় মা এসেছেন সকল কাজ ফেলে। মাথার কাপড় ঠিক করে দিলেন। বললেন,
– যা রুমে।
অভ্যাস বসত আমি নিজের রুমে চলে গিয়েছিলাম। ফিরে চললাম তন্ময় ভাইয়ের রুমের দিক। উঁকি দিলাম। বুক কাঁপছে। ভয়ে গলা শুঁকিয়ে আসছে। জীবনের সমাপ্তি ঘটতে যাচ্ছে আমার। এমন অনুভূতিতে শ্বাস আটকে আসছে।
তন্ময় ভাই ফুলের সাজানো বিছানায় তাকিয়ে। কয়েকবার ঘড়ির দিক ও নজর বোলালেন। বউয়ের আগে জামাই বসে। হাসিও পেল কিছুটা। সে আমাকে দেখতেই ধমকালেন,
– ড্রয়িংরুমে ঘুমানোর যায়গায়?
চোখ নিচে নামালাম। স্রোতের তীব্র অনুভূতি পেরিয়ে রুমে প্রবেশ করলাম। আজ হতে এই রুম আমারও। আমাদের দুজনের।
জবাব না পেয়ে তন্ময় ভাই সামনে আসলেন। মুখ উঁচু করে ধরলেন।
শব্দ করে চুমু খেলেন পুরো মুখজুড়ে। চোখ বন্ধ করে নেওয়া আমার তীব্র নিশ্বাস জানান দিচ্ছে, আজ আমি নির্ঘাত শ্বাসকষ্টে মারা যাব।
শক্ত করে চেপে নিলেন নিজের সাথে। তার বুক কাঁপছে। বিড়বিড় করে বলা তার,
– আমার প্রেয়সী।
তার মুখের ভালবাসা শোনার আকাঙ্খা নিমিষেই চলে গেলো।

সমাপ্তি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here