প্রেয়সী – ২৫
ঘুম থেকে উঠে আমি বাড়ি তন্নতন্ন করে মা’কে খুঁজছি। মনের ভেতরে কু ডাকছে। সৃষ্টিকর্তার কাছে অপরিসীম অনুরোধ করে যাচ্ছি, সবকিছু স্বপ্নের পাতায় লুকিয়ে থাকুক। এই জঘন্যরকম
শাস্তি সৃষ্টিকর্তা আমাকে না দেন যেন। আমার পাগলামো দেখে, আবারও ডাক্তার ডাকা হলো। সকলে আমাকে বোঝাতে অক্ষম, যে আমার মা আর বেঁচে নেই। তিনি কখনও ফিরবেন না। তাকে আমি কখনও ছুঁতে পারবো না, দেখতে পারবো না।
শরীরের ক্লান্তি’কে রেহাই দিল, ঘুমের ইঞ্জেকশন। এই অসীম পাগলামি’র খেলায় আমি আমার তন্ময় ভাইয়ের শুকনো চেহারা দেখতে পেলাম। তাকে বলতে চাইলাম, মা’কে এনে দিন।
কিন্তু বলতে পারলাম না। শুধু তার চেহারা দেখেই চোখ বুঝে ফেললাম। চোখের জল, ঘুমের ইঞ্জেকশনও থামাতে পারলো না।
ঘুমে তলিয়ে গেলেও, চোখের জল ফুরোয় নি।
স্পষ্ট অনুভব করছি কারও ভালবাসার স্পর্শ। তার ঠোঁটের ছোঁয়া আমার কপালে। হাতে হাত চেপে রয়েছে। পরপর শুধু মাথায় হাত বোলাচ্ছে। দ্রুততম নেওয়া তার নিশ্বাস গুলো শুনতে পাচ্ছি। তার অতি ধীর আওয়াজ। যেই আওয়াজে বিরাজমান অপরিসীম অনুভূতি।
– অরু?
পাপড়ি কাঁপছে। ঘুমের তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিচ্ছে। ঘুম ভেঙে আসছে। অনেক সময় অতিবাহিত হয়েছে হয়তো। মাথা শক্ত হয়ে আছে। নড়ানো যাচ্ছে না। তন্ময় ভাইয়ের শুকনো চেহারা। তার এমতাবস্থা দেখতে অভ্যস্ত নই আমি। তিনি দ্রুত স্যালাইন খুলে দিলেন। গালে স্পর্শ করলেন,
– অরু?
তার কন্ঠ। তার আবেদনময়ী কন্ঠে আজ বিচলিত অনুভূতি। একধ্যানে তার চোখে তাকিয়ে। কেমন শুকিয়ে তার চেহারা। প্রতিদিনের মতো জ্বলজ্বল করছেনা। ক্লান্ত হয়ে আছেন। নিশ্চয়ই ঘুমাননি। অথচ, আমি ঘুমিয়ে নিলাম পরপর। কোনো শব্দ করতে পারছিনা। না পারছি তাকে ছুঁয়ে দিতে। কষ্ট হচ্ছে তীব্র। বুকের সেই আর্তনাদ আবারও ভেসে আসছে। চোখের জল আবারও ভিড় করছে।
তন্ময় ভাই আমাকে উঠিয়ে বসালেন। তাকে সামনে পেয়ে বাঁধ ভাঙতে ইচ্ছে হচ্ছে। কান্নার বাঁধ। তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে। কেঁদে ফেললাম। ঘেষে পড়লাম তার বুকে। তিনি আমাকে শক্ত করে ধরলেন। অভিযোগ গুলো বেরিয়ে আসতে চাইছে। বারবার আমার বলাতে ‘ মা এনে দিন, আমার মা এনে দিন। ‘ তিনি নেতিয়ে উঠলেন। তার লালচে চোখ গুলো দেখে মনে হচ্ছে, এই কেঁদে দিবেন। আমার অস্থির কান্নার আওয়াজে তিনি আরও কিছুটা শক্ত করে ধরলেন। মুখের সামনে থেকে চুল সরিয়ে দিলেন।
ভাঙা কন্ঠে বলতে লাগলেন,
– এভাবে করলে হবে? আমরা সবাই কী সারাজীবন থাকব? হু? যেতে তো হবে। একদিন আগে বা পরে। আর চাচী ছিলেন সৎ মনের। ভালো মানুষদের সৃষ্টিকর্তা দ্রুত নিয়ে যান। তারা সৃষ্টিকর্তার প্রিয়। তুই এভাবে কাঁদলে, চাচী কতটা কষ্ট পাবেন। কাঁদে না।
– হতে হবেনা তাকে সৎ। সৎের পরিনাম এই হলে , লাগবে না। এনে দিন মা’কে। আমি মা’র কাছে যাব।
– লক্ষি না তুই আমার? হু? কথা শোন, এখন খেতে হবে।
খাবার খাওয়া আমার দ্বারা সম্ভব না। একদম না। গলা দিয়ে যাবে না। বাবা কোথায়? তার কী অবস্থা? তন্ময় ভাইয়াকে প্রশ্ন করলাম আকুলতা নিয়ে,
– বাবা?
– প্রেসার বেড়েছে প্রচন্ড। বাবা নিজে গিয়ে খাইয়েছে। ঘুমের টেবলেট দিয়েছে। আপাতত ঘুমাচ্ছে। এখন তুই খাবি।
বড় মা এসেছে খাবার নিয়ে। আমাকে দেখতেই কিছুক্ষণের মাঝে তার শুকনো চেহারা আবারও ভিজে আসছে চোখের জলে। কোনভাবে চোখের জল মুছে তন্ময় ভাইকে বললেন,
– আব্বা, এখন গোসল নে। যা। কিচ্ছু খাস নাই। যা, আমি আসতেছি।
তিনি আবারও আমার দিক তাকালেন। শক্ত হাতে চোখের পানি মুছিয়ে দিলেন,
– খেয়ে নে। আমি আসছি।
খাবনা, খাবনা করেও জোরপূর্বক খাওয়ালেন বড় মা। খেতে গিয়েও পারছিনা। চোখের জল বেয়েই যাচ্ছে। খাওয়াতে খাওয়াতে বড় মা’ও কেমন কাঁদছে। এক হাতে আমাকে জড়িয়ে রেখেছেন। মা’য়ের চেহেরা ভাসতেই খাবার আর গিলতে পারছিনা।
এইযে বড় কষ্ট। তীব্র কষ্ট।
এহসান আর মারজি এসেছে। সাথে ওদের মা-বাবা। ওরা কাল ও এসেছিল। অজ্ঞান ছিলাম বিদায় চলে যেতে হয়েছিল। মারজির আম্মু আমার পাশে বসলেন। আমাকে বোঝালেন। মাথায় হাত রাখলেন। বললেন,
– সব ঠিক হয়ে যাবে মা। ভেঙে পড়িও না। এখন তোমার বাবাকে তোমার সামলাতে হবে। তার তো আর সন্তান নেই। তুমি তার একমাত্র রাজকন্যা। তুমি এভাবে ভেঙে পড়লে, তাকে কে দেখবে?
শক্ত হতে হবে, এখন যে আছে তাকে আগলে রাখতে হবে।
সত্যি তো। আমিই তো তার সম্বল। কে আছে আর বাবার? আমাকেই তো তাকে দেখতে হবে।
বড়দের সাথে কথা বলার জন্য তারা চলে যাচ্ছেন।
মারজি দ্রুত এসে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। আদুরে কন্ঠে বলল,
– কাঁদলে হবে? এখন অনেক অনেক দোয়া করতে হবে আন্টির জন্য। তুই কাঁদলে আন্টি আরও কষ্ট পাবেন। কাঁদে না।
বাচ্চাদের মতো আমাকে বোঝাচ্ছে। অথচ আমি বুঝতে নারাজ। একদম নারাজ।
রাতের দিক বাবা আসলো। উঠে বসলাম। একধ্যানে তার দিক তাকিয়ে রইলাম। শুকনো চেহারা। দেখেই বোঝা যাচ্ছে তিনি ভালো নেই। বড্ড কষ্টে। হাঁটতেও কষ্ট হচ্ছে হয়তো। পাশে বসলেন। বাবাকে জড়িয়ে ধরতেই, বাবা কেমন ভেঙে পড়লেন। বাচ্চাদের মতো কেঁদে দিলেন। মাথার ক্রমাগত হাত বোলাতে বললেন,
– আমি আছি তো। আমার জন্য তুমি আর তোমাত জন্য আমি। থাকবে না বাবার সাথে?
– হু।
– এইতো। আর কাঁদে না।
বাবা বসেই রইলেন। তার পায়ে মাথা রাখলাম। মাথাটা ভাড় হয়ে আছে। মাথা তুলতে কষ্ট হচ্ছে। হঠাৎ সব পরিবর্তন হয়ে গেলো।
বাড়িটা নিস্তব্ধতায় ঘিরে। এইযে আমাদের বাড়ি না। ভিন্ন বাড়িতে রুপান্তরিত হয়ে আছে।
পরপর দিনগুলো নিস্তব্ধতায় গেল। কয়েকদিনের মাঝে তন্ময় ভাই অনেকবার চেষ্টা করলেন, বাহিরে নেওয়ার। তিনি আমাকে নিতে অক্ষম। আজ ঢাকা থেকে এলেন মাত্র। এসেই শক্ত গলায় বললেন,
– তৈরি হ।
বসেই রইলাম। তিনি হাতে টান মেরে ওঠালেন। গাল টেনে ধরলেন,
– এক্ষুনি যা।
ধীরে বললাম,
– যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না।
– হবে। যা তৈরি হ। নাকি,
তিনি আমাকে মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখে নিলেন,
– আমি যাব সাথে?
চোরা চোখে তাকালাম। গাল গরম হয়ে উঠছে। উনার সাথে পেরে উঠব না। তাই আপোষে চলে গেলাম। তৈরি হওয়ার মতো ইচ্ছে নেই।
ড্রয়িংরুমে সেই আগের মতো সকলে। বড় মা রান্নাঘরে। ছোট চাচী ডাইনিং গোছাচ্ছে। শুধু মা আর নেই। এখন থাকলে, হয়তো সোফা, টিভি পরিষ্কার করা শুরু করতেন। সিঁড়ি ঝাড়ু দিতেন, মুছতেন।
আমাকে ধমক দিতেন। এটা করবি না, ওটা করবি না। চোখ বুঝে ফেললাম। বড় চাচ্চু নিউজ পেপার পড়ছেন। আমাকে দেখে ইশারা করলেন যেতে। আমি তার পাশের সোফায় বসলাম। নিউজপেপার পাশে রেখে, মাথায় হাত রাখলেন। শান্ত কন্ঠে বললেন,
– তন্ময়ের সাথে ঘুরে আস। ভালো লাগবে। মাইন্ড ফ্রেস হবে।
মাথা দোলালাম। তন্ময় ভাই হাজির। বাইকের চাবি সাথে বাইক নিয়ে বেরোবে বুঝি? আমাকে পিছু আসতে বললেন। বড় মা হাত ধরে, সাবধানে যাবার পরামর্শ দিলেন। জবাবে ‘ হ্যাঁ ‘ বললাম।
দারোয়ান নানা, কেমন আমাকে দেখে চুপসে গেলেন। কিছু বলতে চাচ্ছেন। তন্ময় ভাইয়ের দিক তাকিয়ে আর ভাবা কথাটা বললেন না। বরং চমৎকার হেসে ঘুরিয়ে বললেন,
– মহামুনি, ঘুরে দ্রুত আসবা। নতুন রুপে ফিরবা। সকলে মিলে একত্রে খেলব।
হাসলাম। আসলেই কিছু মানুষের মন খুবই সরল হয়। একদম পানির মতো। তন্ময় ভাই বাইক বের করেছেন। ধীর কন্ঠে আওয়াজ দিলেন,
– উঠ।
আমি উঠলাম। বললেন,
– ভালভাবে বস। ওড়না গলায় পেঁচা।
– পারব না। এভাবেই থাকুক। কিছু হবেনা।
পেছনে ঘুরে চোখ রাঙালেন।
– দ্রুত, কর।
উপায় না পেয়ে ঠিকঠাক হলাম। বাইকে উঠলে কত কিছু সামলাতে হয়।
প্রেয়সী – ২৬
সোনালী আলোয় পরিবেশ মন মুগ্ধকর। আশেপাশে নির্জনতা নেই।
মানুষের কোলাহল চলছে। তন্ময় ভাই আর আমি হাঁটছি। বড়বড় গাছগুলো ফেলে চলে যাচ্ছি। তার ডান হাত আমার কাঁধ পেরিয়ে পিঠের দিক পেঁচিয়ে। আরেক হাতে ফোন নিয়ে, দিব্বি কথা বলছেন আর হাঁটছেন আমাকে নিয়ে। এক প্রকার তার সুরক্ষার মাঝে আঁটকে। কয়েকবার ছাড়ার জন্য বললাম। তার কোনো রিয়েকশন নেই। ছাড়বে বলে মনে হয়না, তাই মাথা এলিয়ে চললাম। বাতাস এসে তার কালো ঘন ছোট চুলগুলো আউলে দিচ্ছে। আঁড়চোখে তাকে দেখতে বেশ লাগছে। পৃথিবীর সোনালী আলোয় তাকে আরও ভয়ংকর সুন্দর দেখাচ্ছে। তার চোখ গুলো আমার দিক। অথচ আশেপাশে আমার থেকেও সুন্দর মেয়েরা আছে। কিন্তু তিনি আমাতে বিভোর।
কথা শেষ হতেই, ফোন রেখে বললেন,
– ফুচকা খাবি?
– উঁহু।
– কেন? আমিতো দেখতাম, স্কুল-কলেজ বরং বাড়িতেও এই হাবিজাবি খেতিস।
– আজ ইচ্ছে করছে না।
– করছে না? চল খাবি।
আঁড়চোখে তাকে দেখে নিলাম,
– আপনি খাবেন সাথে? তাহলে খাব।
তিনি এগুলো একদম খেতে পারেন না। নিশ্চয়ই না করবেন। তার দ্বারা টক-ঝাল খাওয়া অসম্ভব। তার উত্তর ও একই ছিলো,
– এগুলো খাওয়া ইমপসিবল। তুই খা।
– উঁহু। আপনি খেলে খাব।
– আচ্ছা, তুই খাওয়াই দিবি।
হাসলাম, বললাম,
– তাহলে খাব না।
তিনি কথা বাড়ালেন না। টেনে নিয়ে গেলেন সেদিকে। অর্ডার ও করলেন। আমি বললাম,
– ঝাল-টক বেশি।
তন্ময় ভাই চোখ রাঙালেন।
– পেট খারাপ হবে।
– তাহলে বললেন কেন খেতে?
– তুই কীভাবে তাকিয়ে ছিলি, তাই না বললাম।
– ইশ, মিথ্যুক।
দেখা গেলো তন্ময় ভাইকে খাওয়াতে গিয়ে, আমায় কামড় খেতে হয়েছে কয়েক। তিনি হাসছেন। অথচ তার নাক লাল হয়ে আছে ঝালে। খাওয়া শেষে আমার নিজেরও প্রচন্ড ঝাল লাগছে।
কিছু পুঁচকে ছেলেরা পানি বিক্রি করছে, ডেকে ডেকে। বোতলে সুরক্ষা নেই কোনো । আমি সেখান থেকে নিতে চাচ্ছিলাম। তিনি দিলেন এক ধমক,
– এভাবেই এই হাবিজাবি খেয়েছিস। এখন এই পানি খেয়ে ডাইরিয়া বাধানোর ধান্দা।
টেনে সামনে নিতে লাগলেন। সামনে বড় দোকান। পৌঁছে প্রশ্ন করলেন,
– পানি নিবি না আইসক্রিম?
অথচ, আমার জবাব শুনলেন না। আইসক্রিম, পানি দুটোই নিলেন। আগে বোতলের মাথা খুলে দিলেন। পানি খেয়ে শান্ত হলাম।
ঝাল-টক খেতে তো ভালো লাগে। কিন্তু, তারপরের মুখ জ্বলে যাওয়াটা অস্বাভাবিক কষ্ট। পরপর আইসক্রিম ও খেতে দিলেন।
সামনে ফ্যামিলি ঘুরতে এসেছে হয়তো। গাড়ির সামনে ছোট-ছোট বাচ্চারা বেলুন হাতে দাঁড়িয়ে। নিশ্চয়ই ওই দম্পতির সন্তান। আমার তাকিয়ে থাকা দেখে সেও তাকালেন। দুষ্টু স্বরে বললেন,
– আমাদের ও হবে।
কী লজ্জা।
– ইশ, সরুন।
তিনি হাসছেন।
– সরুন কী? ভবিষ্যৎ আসছে, তখন আমাদের ও হবে।
ছাঁই। লজ্জায় আমি দ্রুত হাঁটা ধরলাম। পেছনে তাকালাম। তিনি এখনও দাঁড়িয়ে। আমি গিয়ে তার হাত টেনে আনতে চাইলাম। কিন্তু, একটুও নড়াতে সক্ষম হলাম না। তার হাসির শব্দ। শক্তি বাড়িয়ে আবারও চেষ্টা করলাম। হচ্ছে না। তিনি কী পাথর? তিনি কী মানুষ নন? পরপর নিজেই আসলেন স্বেচ্ছায়। গাল টেনে দিলেন,
– লিলিপুট। তোর শরীরে শক্তি আছে আমাকে নড়ানোর?
ভেঙালাম,
– এহ। এখন একটা উইক আছি। ঠিক হতে দিন। আঙুল দিয়ে উঠিয়ে ছুড়ে মারব ওপারে।
এবার তার প্রচন্ড শব্দের হাসি। হাসতে হাসতে আমাকে তার বাহুতে চেপে ধরলেন।
– নিজেকে দেখেছিস? এক কেজি মাংস ও তো নেই শরীরে।
জবাব দিলাম না। অথচ আমার দিক তাকিয়ে তিনি হেসেই যাচ্ছেন।
উহ। লোকটা হাসলে, তাকে মারাত্মক সুন্দর দেখায়।
যখন বাড়ি ফিরেছি তখন সন্ধ্যা। মাগরিবের আজান দিচ্ছে। ড্রয়িংরুম থেকে শোরগোল আসছে। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে, নানু বাড়ির সকলে এসেছে। সামনের সোফায় চাচ্চুরা বসে। বাবা শক্ত চোখে তাকিয়ে। তাকে এতটা শক্ত হয়ে থাকতে আমি আগে দেখিনি। চোখ গেলো সুমনার দিক। আমাকে দেখতেই দাঁড়ালো। সকলের উদ্দেশ্যে বলল,
– ওইতো অরু এসেছে।
উফ। এখন মায়া-মমতা আমার নিতে ইচ্ছে হচ্ছে না। যাও একটু মাইন্ড ফ্রেস হয়েছিল, তা এদের দেখে চলে গেলো। মামা ডাকলেন।
বাবা এবার শক্ত গলায় বললেন,
– আমার মেয়ে হতে দূরে।
মামাও আওয়াজ তুললেন,
– এমন কথা কীভাবে বলেন? অরু আমাদেরও মেয়ে।
বাবা হাসছেন,
– তাই?
কিছু বুঝছিনা। সকলেই থতমত হয়ে আছে। তখনই তন্ময় ভাই আসলেন। আমাকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, প্রশ্ন করলেন,
– এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?
তারপর তিনি সামনে তাকালেন। মানুষজন দেখে, রুবি আপুকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
– রুবি, অরুকে নিয়ে যা উপরে।
বাবা থামালেন। বললেন,
– না, ও থাকুক। জানুক, ওর নানু বাড়ির মানুষদের আসল রুপ। কতটা লজ্জাহীন এরা।
ছোট মামা হুংকার করে উঠলেন,
– সাবধানে কথা বলুন।
বড় চাচ্চু বাবা’কে চুপ থাকতে বললেন। বাবা চুপ হলেন না। তিনি এসে আমার হাত ধরলেন। সামনে নিয়ে গিয়ে আঙুল তুলে মামা’কে দেখালেন। শক্ত গলায় বলতে শুরু করলেন,
– এই হচ্ছে, তোর মায়ের আপন ভাই। তোর আপন মামা।
সেই মামা যে তার মেয়েকে এই বাড়িতে বিয়ে দেওয়ার জন্য, তোর মা’কে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে। তোর মা’কে সোজাসাপটা বলে দিয়েছে, সুমনার বিয়ে তন্ময়ের সাথে নাহলে তারা তোর মায়ের সাথে কোনো যোগাযোগ রাখবে না। তোর এই আপন মামাদের প্রেশারে আজ তোর মা নেই। এখন আবার আসছে আরেক কাহিনি নিয়ে।
তোর মায়ের ও নাকি ইচ্ছে ছিলো, সুমনা’কে এ বাড়ির বউ করার। তন্ময়ের জন্য নাকি সুমনা’কে বেছে রেখেছিল। এক মৃত মানুষকে নিয়ে আজগুবি কথা বানানোর ক্ষেত্রেও এরা থেমে নেই।
এখন, তুই কী বলিস? এদের সাথে সম্পর্ক রাখতে চাস? বল আমায়?
মামা আমার দিক তাকালেন।
– অরু? আম্মু আমার। তুই এগুলো বিশ্বাস করছিস? আমি আমার বোনের সাথে এমনটা করব তোর মনে হয়? আমি শুধু, সুমনার জন্য প্রস্তাব দিয়েছিলাম। তুই নাকি জানিস যে, সুমনা কতটা ভালবাসে তন্ময়কে? ও তো সুইসাইড ও করতে গিয়েছিল, নির্ঘাত সময় মতো বাঁচাতে পেরেছি। আর তোর মা নিজে বলেছিল, সুমনা কতটা গুনি মেয়ে। ও তন্ময়ের জন্য সুমনাকে চেয়েছিল। বিশ্বাস না হলে, তোর ছোট মামা’কে জিজ্ঞেস কর।
বাবা থামিয়ে দিলেন,
– আপনাকে আমি নিজে জানিয়েছিলাম, তন্ময় আর অরুর বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। আপনাকে শান্ত গলায় বুঝিয়েছি, ওরা দুজন দুজনকে পছন্দ করে। সেখানে আপনি কীভাবে এতটা নির্লজ্জ হতে পারেন?
আমার চোখ গেল সুমনার দিক। মেয়েটা কেমন হিংস্র চাহনি নিয়ে আমার দিক তাকিয়ে। দিনদিন মেয়েটাকে একদম অচেনা লাগছে। একদম অচেনা। এক ভিন্ন সুমনা। যে সবচেয়ে নিচে নামতে পারবে।
তন্ময় ভাই বেশ বিরক্ত হয়ে উঠছেন। ধীরে ধীরে বিরক্ততা রাগে পরিনত হচ্ছে। কতক্ষণ চুপ ছিলেন। এবার বেশ শক্ত
কন্ঠে বললেন,
– কিসব আজব কথাবার্তা। মা-বাবা আছে আমার। অনাথ নই যে চাচী আমার জন্য বউ খুঁজে বেড়াবে। এসব আজগুবিকথা না বলেন প্লিজ। আর ভাবেন কীভাবে আপনাদের সাথে আমাদের যায়? নির্ঘাত আমার চাচ্চু ভালবেসে বিয়ে করেছিলো। নাহলে আপনাদের মতো পরিবার থেকে আমরা হাজারগুন দূরে থাকি।
দেখুন, আমাদের অবস্থা তো জানেন? আপনাদের পুরো পরিবার হাজতে সারাজীবনের জন্য আটকে রাখতে সক্ষম। তাই অযথা সিনক্রিয়েট না করে, সোজা সারাজীবনের জন্য বেরিয়ে যান। আল্লাহ হাফিজ।
পরপর রুবি আপুকে ডাকল,
– রুবি, অরুকে নিয়ে যা।
বাবার ঘাড়ে হাত রাখলেন। ধীর কন্ঠে বললেন,
– কথা বাড়ানোর প্রয়োজন নেই।
তারপর দ্রুত পায়ে চলে গেলেন বাড়ি থেকে। মামা বেশ কয়েকবার ডাকলেন। শুনলাম না। আমি জানি, আমার বাবার কথা সত্য। জিনিসটা এতদিন বুঝতে না পারলেও, এখন সম্পুর্ণ ক্লিয়ার। বাবা আরও শক্ত গলায় তাদের সাথে কথা বলছেন। এক প্রকার দু পরিবারের চিল্লাচিল্লি চলছে। দীপ্ত নাক কুঁচকালো,
– ভাইরে ভাই, তোমাদের নানু বাড়ির লোক তো বড্ড নির্লজ্জ। এমন কেন তোমার মামারা? আর এই সুমনা আপু?
জবাব দিলাম না। রুবি আপু, দীপ্তর মাথায় টোকা মারল,
– চুপ। শুধু পাকাপাকা কথা।
আমি জানি চাচ্চুরা, বাবা তারা ভয়ংকর স্টেপ নিতো মামাদের ক্ষেত্রে। শুধু আমার আর মায়ের কথা ভেবে কিছু করছেনা। আমার মা যে অনেক ভালবাসে তার ভাইদের। পাগলের মতো ভালবাসত। সেই ভাইদের কিছু করার মনোবল সয়ং বাবারও নেই। আর তারা তো আমার মামা। ছোট বেলায় কোলে নিয়ে বেড়াতো। থাক না সব।
যার জন্য এতকিছু। সেই তো নেই।
চলবে
চলবে