ফিলোফোবিয়া পর্ব -৪৯

ফিলোফোবিয়া

ঊর্মি প্রেমা ( সাজিয়ানা মুনির )

৪৯.

( কার্টেসী ছাড়া কপি নিষেধ )

জড়সড় ভাবে বসে আছে প্রিয়। চোখমুখ প্রশ্নবিদ্ধ। চাপা উত্তেজনায় হাত কচলাচ্ছে। মৃ*ত মানুষ কি আদৌ ফিরে আসে! মুখোমুখি সামনের চেয়ারটায় বসে আছে আয়শা। কি স্বাভাবিক তার চোখমুখ। এতবছরে চেহারার কি কোন পরিবর্তন এসেছে? হ্যাঁ। এক বড় অংশের পরিবর্তন এসেছে। বয়স্ক রোগা ভাবটা নেই, গায়ের উজ্জ্বলতা আগের থেকে বেড়েছে। কেউ দেখলে বলবেই না, যে প্রিয় উনার মেয়ে। বোন বলবে। শুধু গলায় মোটা কালো জখমের মত দাগটা চোখে বিঁধছে একটু। পিটপিট দৃষ্টিতে মাকে পরখ করছে প্রিয়। নিজের আসল পরিচয় জানার পর। এই প্রথম মানুষটার সাথে তার মেয়ে হয়ে কথা বলবে। মনে হাজারো প্রশ্ন। অনেক কিছু জানার বাকি আছে এখনো! কিন্তু অদ্ভুতভাবে কিছু বলতে পারছেনা। থমকে গেছে। ধাক্কা সামলাতে সময় লাগছে।

কিছুক্ষণ নীরবতায় ডুবে রইল পরিবেশ! নীরবতা গুছিয়ে আয়শা বেগম বললেন,
‘ রাজা অষ্টম হেনরি’র দ্বিতীয় স্ত্রী অ্যান বোলেইন নিজের সর্বস্ব নিয়ে হেনরিকে ভালোবেসেছিল। পরমা সুন্দরী ক্ষমতাবান নারী হয়েও রাজাকে আটকে রাখতে পারেননি। রাজা জেন সিমুরের রূপে আটকে। ষ*ড়যন্ত্র করে মিথ্যা অভিযোগে ফাঁসিয়ে রানিকে মুণ্ডু*পাত আদেশ দেয়। নিষ্পাপ অ্যান বোলেইনকে হ*ত্যা করে। সময় কা*টে, তার অনেক বছর পর ইংল্যান্ডের রানি হয় অ্যান বোলেইনের কন্যা রানি প্রথম এলিজাবেথ। ছোট থেকে অবহেলায় বড় হওয়া এলিজাবেথের রানি হওয়াটাই ছিল অ্যান বোলেইনের নীরব প্রতি*শোধ। প্রকৃতি ঠিক তার প্রতি*শোধ নিয়েছিল। রাজা হেনরি কখনো শান্তি পায়নি। পরবর্তীতে জেন সিমুরের পুত্রসন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মৃ*ত্যু হয়। সবচেয়ে বড় প্র*তিশোধ প্রকৃতি তখন নিলো, যখন সেই পুত্র সন্তানটাও খুব অল্প বয়সে মারা যায়। যেই পুত্র সন্তানের জন্য রাজা হেনরি অ্যান বোলেইনকে দূরে ঠেলে দিলো। সেই পুত্রসন্তান মৃত্যুর পর রাজ্য অ্যান বোলেইনের মেয়ে এলিজাবেথের হলো। প্রকৃতির প্রতি*শোধ কি আশ্চর্য! ‘

প্রিয় নিমিষ তাকিয়ে আছে। চাপা জেদ চেপে বলল,
‘ তো এই হিস্টরিকাল কাহিনীর মাধ্যমে কি বোঝাতে চাইছ? আমি এলিজাবেথের মত তোমার কাছে শুধুই প্রতি*শোধের মাধ্যম?’
‘ আমি প্রতি*শোধ নিতে চাইনি প্রিয়। অ*ন্যায়ের বোজ কাউকে ছাড় দেয়না, কোননা কোন ভাবে প্রকৃতি ঠিক প্রতি*শোধ নেয়। তাই ঘুরেফিরে তোর হাতে এমনটা হলো। তাছাড়া আমি জানতাম বাঘিনীকে জন্ম দিয়েছি। খানিকের জন্য ক্ষান্ত হলেও, দমে যাবে না সে। অন্ধকারে উজ্জ্বল সূর্যের মত নিজের আলো ছড়াবে।’
চোখ জলে ভরে এলো প্রিয়’র । ব্যথাতুর কন্ঠে প্রিয় জিজ্ঞেস করল,
‘ আমার অভিমান তোমার উপরও সমপরিমাণ। আমি কি তোমার এতই অপছন্দ ঘৃ*ণার ছিলাম যে মেয়ে বলে স্বীকার করতে তোমার লজ্জা হতো? কেন নিজের পরিচয় বলোনি আমাকে? নিজের আসল পরিচয় জানার আমার কি অধিকার ছিল না?’
আয়শার সহজ স্বাভাবিক আওয়াজ,
‘ অবশ্যই ছিল। কিন্তু আমি চাইনি তোর উপর কোন কলঙ্কের দাগ পড়ুক। এই উচ্চ সমাজের রীতিনীতি বড্ড অদ্ভুত। পিতৃপরিচয়হীন সন্তানকে অ*বৈধ বলেই গণ্য করা হয়। আর এই পরিচয়ের জন্য ওই মানুষটার কাছে নত হবো, তার অ*ন্যায় মেনে নিবো, আমার বিবেক সেই অনুমতি দেয়নি কখনো। যেই জীবনে আত্মসম্মান নাই, অফুরন্ত সুখ থাকলেও সেই জীবন আমার কখনো চাইনা।’
‘ তাই বলে কি আমারও জানার অধিকার ছিল না?’
‘ জেনে কি হতো? কষ্ট বাড়তো। তোর হাস্যোজ্জ্বল জীবন অন্ধকারে ডেকে যেত। সম্পর্কের ভেতর দ্বিধাদ্বন্ধের বসতি বাড়তো। যেখানে আপন পর নামক ভেদাভেদ হতো। এই অশান্তির কি দরকার ছিল! তারচেয়ে বরং যেভাবে চলছিল। চলুক! থাকনা আমার একাকীত্ব, কিছু অপূর্ণ ইচ্ছা। তুই ভালো ছিলি ওইটুকুই আমার জন্য যথেষ্ট।’
‘ আর তোমার বেঁচে থাকার ব্যাপারটা? আমাকে বলার এইটুকু প্রয়োজনবোধ করলে না? প্রতিটা মুহূর্ত আমি অনুতপ্তায় পু*ড়ছিলাম। দিনের পর দিন নিজেকে দোষারোপ করছিলাম। সবসময় মনে হয়েছিল আমি ইমান্দিপুর না গেলে, শতাব্দের সাথে সম্পর্কে না জড়ালে, এমনটা হতোনা বোধহয়! সব দোষ আমার ছিল।’
বলতে বলতে কয়েক ফোটা জল চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ল প্রিয়। আয়শা বেগম অনুতপ্ত দৃষ্টিতে মেয়ের দিক তাকিয়ে রইল। সত্যি এটা তার অ*ন্যায় ছিল। প্রিয়’র সাথে একবার যোগাযোগ করার দরকার ছিল অন্তত। কিন্তু তার হাতেই বা কি ছিল। প্রিয় ছোট ছিল।ছবি পাগলা কু** মত তার পেছনে পড়েছিল। আয়শা বেঁচে আছে সামান্য টের পেলেও ঝামেলা হতো। আয়শাকে হাতের কাছে না পেয়ে, প্রিয়’র ক্ষ*তি করতো।
মেয়েকে বোঝানোর চেষ্টা করল। বলল,
‘ এতে তোর কোন দোষ নেই প্রিয়। ভাগ্যটাই এমন ছিল।যদি এসব কারো দোষ থাকে তাহলে সব দোষ শোয়েবের। তার জন্যই আজ আমাদের ছন্নছাড়া বেমিল জীবন। এত দূরত্ব এত কষ্ট। ওই মানুষটা আমার জীবনের নিমিষ কালো অভিশাপ। ওর সাথে যা হয়েছে এসব প্রাপ্য ছিল তার। কাউকে ঠকালে, নিজেও ঠকতে হয়। তাও ভীষণ জঘন্যরকম ভাবে।’
খানিক চুপ থেকে। বিহ্বল কন্ঠে আওড়াল প্রিয়,
‘ তুমি বেঁচে আছো কি করে? বাড়িতে তোমার ঝুলন্ত লা*শ উদ্ধার করা,হয়েছিল। তুমি বেঁচে থাকলে, ওই লা*শ কার ছিল!’
আয়শা খানিক চুপ রইল। নীরবতা গুছিয়ে বলল,
‘ নিষ্*ঠুর সমাজ যখন আমাকে ব্যা** উপাধি দিলো। আত্মহ*ত্যা-ই আমার একমাত্র রাস্তা ছিল। নিজের আত্মসম্মান হারিয়ে এই বিষাক্ত সমাজে নিশ্বাস ফেলতে পারছিলাম না একমুহূর্ত। সেই রাতে শতাব্দ তোর হাত চাইতে আমার কাছে ইমান্দিপুর এসেছিল। তখন সে তোর পরিচয় সম্পর্কে সবটা জানতো। সকালে তোকে জাফর ভাইয়ের হাতে ফিরিয়ে দিয়ে ক্ষণেক্ষণে পু*ড়ছিল। আর ওর স্বভাব বরাবরই বেপরোয়া, জেদি অকপট। সময়, ক্ষণ তাকে বাঁধা দিতে পারেনি কখনো। মূলত যেকোন মূল্যেই হোক না কেন! তার প্রিয় চাই। আমার সাথে একপ্রকার দ্বন্দ্ব করতে এসেছিল। কয়েকবার কলিং বেল চেপে কোন প্রতুত্তর না পেয়ে। পেছনের ঘরে জানালায় উঁকি দেয়। আমি তখন দড়িতে ঝুলছিলাম। শেষ নিশ্বাস ফেলছিলাম। তড়িঘড়ি করে ছাদ দিয়ে ভেতর আসে শতাব্দ। দড়ি থেকে কোনরকম নিচে নামায়। আমার শরীর তখন দূর্বল ক্লান্ত। মাথায় আত্মহ*ত্যা কর্তে হবে, ঘুরঘুর করছিল তখনো। শতাব্দ আমাকে থামাল, শান্ত করার চেষ্টা করল। বাড়িতে জেদ করে ঢাকায় চলে যাওয়ায় গ্রামের সাথে ছিল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। এদিকটার কোন কিছু সম্পর্কে অবগত ছিলনা তখনো। ধীরেধীরে আমার থেকে সবটা শুনল। আত্মহ*ত্যা বদলে বিকল্প পথ আত্মগোপন করতে বলল। আমি তখন বরাবরই ভেঙ্গে চূর্ণবিচূর্ণ। এই নি*কৃষ্ট সমাজে বাঁচা আমার জন্য অসম্ভব। এই পরিচয় আমার মান সম্মান সব নোংরা ডুবায় ডুবে গেছে। যতই জায়গা পাল্টাই এই অপ*বাদ মুছা যাবেনা কখনো। আর বেঁচে থাকলেও ছবি আমাকে ছাড় দিবেনা একটুও। হয়তো খু*ন করবে নয়তো ব্যা** বানিয়ে রাখবে। তাই শতাব্দের প্রস্তাবে আমি রাজি হই। সেই রাতে ম*র্গ থেকে লাপাত্তা বিনষ্ট লা*শ জোগাড় করে শতাব্দ। সরকারী মেডিকেলের ছাত্র হওয়ায় সবটা জানতো। আমার বান্ধবী সালেহা ও তার স্বামী মোহসীন দুজনই ওই সরকারী হাসপাতালের ডাক্তার। ওদেরকে তো চিনিস? তুরফার বাবা মা। ওরা ব্যবস্থা করে দেয় সবটা। যেই শহরে জীবন্ত মানুষের কেউ খবর রাখেনা, সেখানে মৃ*ত মানুষের খবর নেয় কয়জন? টাকা দিলেই লা*শ জোগাড় হয়। ভোর রাত অবধি ফোনে সবটা প্লান করি চারজন। ব্যাপারটা অত্যান্ত টপ সিক্রেট ছিল। রাতে্র অপেক্ষা করি। গভীর রাতে ঢাকা থেকে লা*শ আসতেই তা শোয়ার ঘরে ফ্যানে জুলিয়ে দেই। আমি ঢাকায় শতাব্দের এপার্টমেন্টে চলে যাই। এদিকে মৃ*ত্যুর খবর ছড়ায়। চেহারা নষ্ট শরীরের কাঠামো কাছাকাছি হওয়ায় সন্দেহ হয়নি কারো। এমনকি আমার বোনেরও। আমরা জানতাম এটা নিয়ে কেউ পুলিশ কেস হবেনা। যতদ্রুত সম্ভব ধামাচাপা দিবে সবাই। ছবি চাইবেনা এসব ঘেটে তার রাজনীতি ক্যারিয়ারে ধস নামাতে। লাপাত্তা মেডিকেলে এতদিন পড়ে থাকা গরীব পরিবারের লা*শটা দাফন হলো। প্রথম দিন শতাব্দকে দেখে ফেলে কাজের খালা তাই শতাব্দ টাকা পয়সা দিয়ে ভয়ভীতি দেখিয়ে গ্রাম ছাড়া করে। এদিকে আমি ঢাকায় জায়গা পরিবর্তন করি। শতাব্দ সালেহাদের সাহায্যে নিজের পাসপোর্ট তৈরি করি। ডেট সার্টিফিকেট রেজিস্ট্রিকরণ না হওয়ায় তেমন ঝামেলা পোহাতে হয়নি। ব্যাংকে মোটামুটি ভালো অঙ্কের সেভিংস থাকায় দেশ ছাড়তে খুব একটা ঝামেলায় পড়তে হয়নি। এতবছর দেশের বাহিরে ছিলাম। রিসেন্টলি, তোর সুই*সাইটের খবর পেয়ে দেশে ফিরেছি।’
হতভম্ব প্রিয়। কেউ ঠিক বলেছে, শিক্ষিত মানুষ ভীষণ ভ*য়ংকর। বুদ্ধির জোরে এরা সত্যমিথ্যা বাঁচা ম*রার মধ্যে থাকা সুক্ষ্ম সুতা সমান জায়গাতে অবাস্তব একটা গল্প বানাতে পারে। কি বিচক্ষণতার সাথে এমন স্ট্রং প্ল্যানিং করেছিল। যা আজ অবধি ঘুনাক্ষরে টের পায়নি কেউ। অথচ একটু উনিশ বিশ হলেই সবটা ঘেটে যেত। এমন ভাবেও পুর্নজন্ম হয়! বেঁচে থাকার একটা সুন্দর সুযোগ পাওয়া যায়। একেই বুঝি বলে মাস্টার প্ল্যান। আর এই প্ল্যানের মাস্টারমাইন্ড শতাব্দ।
স্বস্তির শ্বাস ফেলল প্রিয়। চোখজোড়া ছলছল। মুখে হাত চেপে কান্নাভেজা আনন্দের সুরে বলল,
‘ আমি জানতাম আমার শতাব্দ কখনো কোন অ*ন্যায় করতে পারেনা।’
‘ এই বিশ্বাসেই বুঝি তাকে ছেড়ে এসেছিস? তোকে কিছু জানাতে শতাব্দকে আমিই নিষেধ করেছিলাম। আমার কাছে সে ওয়াদাবন্ধ ছিল।’
আয়েশার অকপটে গম্ভীর আওয়াজ। মায়ের দিক তাকালো প্রিয়। বলল,
‘ ছেড়ে আসার কারণটা আমার নিজেস্ব।’
‘ কি কারণ?’
‘ তুমি এসব প্রশ্ন কেন করছ? ব্যাপারটা আমার আর শতাব্দের।’
‘ মেয়ের জীবন নিয়ে আমার জানার অধিকার আছে প্রিয়।’
‘ ওহ! বুঝেছি। তুমি তার তদারকি করে বোঝাতে এসেছ? তাহলে আজই এলে কেন। এতদিন সামনে আসনি কেন। আর ঠিকানা-ই বা কে দিলো।’
মেয়ের ব্যবহারে হতাশ আয়শা। মেয়েকে হাড়েহাড়ে চিনে সে।এইযে প্রিয়’র চোখমুখের রাগটা বরাবরই ঠুনকো। কথা এড়ানোর জন্যই একান্ত।
আয়শা মেয়েকে বলল,
‘ঠিকানা কোথায় পেয়েছি তা না জানলেও চলবে তোর।’
একটু চুপ থেকে বুঝানোর স্বরে বলল আবার,

‘একদিন শতাব্দ থেকে আমিই তোকে দূরে থাকতে বলেছিলাম। মূলত তোকে শোয়েব থেকে দূরে রাখা আমার উদ্দেশ্য ছিল। আজ আমিই বলছি শতাব্দের মত ছেলে হয়না প্রিয়। ছোট থেকে দেখেছি ওকে। রাগী, জেদি অবাধ্য! অথচ তোর জন্য শান্ত, ধৈর্যশীল, বাধ্য। শোয়েবের মত ঠগবাজদের দুনিয়ায় শতাব্দের মত মানুষ পাওয়াটা ভাগ্য। তোর জন্য ছেলেটাকে প্রতি মূহুর্ত পু*ড়তে দেখেছি। বিচ্ছেদের ক্ষণে বিরহতে ডুবেছিল ছেলেটা। কথা হলে তোকে নিয়ে অফুরন্ত কথা বলত রোজ। ওর প্রতি কথায় অধিকারবোধ জড়ানো। ভীষণ সুন্দর করে বলত, আমার প্রিয়। কাউকে এতটা ভয়*ঙ্কর ভাবেও ভালোবাসা যায়? আমার জানা ছিলনা অন্তত। আড়ালে থেকেও সবটা সময় তোর উপর-ই নজর ছিল। পৃথিবীতে একজন মা তার সন্তানকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। আমিও ব্যতিক্রম নই। তবে যদি কেউ শতাব্দের ভালোবাসার সামনে তুলনা করে, তাহলে আমি পরাজিত। ‘
প্রিয়’র অধৈর্য আওয়াজ,
‘ যতই ভালোবাসুক। তবুও আমার থেকে তার দূরে থাকাটাই শ্রেয়।’
‘ আত্মসম্মান যখন সীমানা পাড় হয়, সেটা আর আত্মসম্মান রয় না। অহংকারে রূপান্তরিত হয়।’
‘ হ্যাঁ, আমি অহংকারী।’
আয়শা আর শান্ত থাকতে পারল না। রাগী কন্ঠে বলল,
‘ এতো ভালোবাসার পর ছেলেটাকে ছেড়ে দিবি প্রিয়! ধরে নিবো তোর মধ্যেও শোয়েবের নি*কৃষ্ট র*ক্ত। কেন শতাব্দের সাথে থাকতে পারবিনা না তুই। কেন?’
চিৎকার করে উঠল প্রিয়,
‘ কারণ আমার সন্তান জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা নাই। আমি অপূর্ণ!’
থমকে গেল আয়শা। মেয়ের দিক তাকিয়ে রইল নিমিষ। কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে বসে পড়ল প্রিয়। বলল,
‘ একবছর আগে ট্যুরের কথা বলে ইন্ডিয়াতে গিয়ে টিউমারের অপারেশন করেছি। ভাইয়া ভাবি ছাড়া আর কেউ জানেনা এখনো। সন্তান জন্ম দিতে আমি অক্ষম। এই অপূর্ণতা নিয়ে কি করে সংসার সাজাই? সে যে সকল সুখের কাম্য। তোমার কি মনে হয় তাকে ছেড়ে ভালো আছি ভীষণ। উহু, আমি একটু একটু করে ম*রছি রোজ। তাকে আমি কি করে ভুলব। সেযে আমার প্রথম প্রেম। তার থেকে ভালোবাসার হাতেখড়ি। একজন ফিলোফোবিক রোগীকে ভালোবাসতে শিখিয়েছে সে। শতাব্দকে বিয়ে করতে যেয়ে আমি থমকে গেছিলাম। বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আদৌ কি আমি ঠিক করছি? বাবা মাকে নিরাপদ রাখতে সবার সামনে সম্পর্ক ছিন্নের নাটক করেছিলাম। সেদিন আমার সব বিষন্নতা কান্না এই বিয়েটাকে ঘিরে ছিল। এক মূহুর্তের জন্য মনে হয়েছিল আমি বোধহয় ভীষণরকম অ*ন্যায় করছি। নিজ স্বার্থে শতাব্দকে ব্যবহার করছি। বিয়ের পর আমি বরাবর তার থেকে দূরে থাকতে চেয়েছি। আমার তিক্ত বুলিতে আঘা*ত করেছি। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে সে শুধু ভালোবেসেছে আমায়। হাজার দূরে ঠেলে দিলেও আমাকে ভালোবাসাটাই যেন তার জিদ ছিল। তাই সেইরাতে ইমান্দিপুর কেন গিয়েছিল এই বাহানায় ছেড়ে এসেছি। সত্যি বলতে প্রচন্ডরকম যন্ত্রণায় ভুগছিলাম। না পারছিলাম তাকে ছাড়তে, না পারছিলাম কাছে থাকতে। কেউনা জানুক। আমিতো জানি আমার কমতি। এই কমতি দিয়ে সংসার বেঁধে আজীবন তাকে কি করে ঠকাই? সে নিঃস্বার্থ ভালোবেসেছে। আমি কি করে স্বার্থপর হই!’
বলতে বলতে কেঁদে ফেলল প্রিয়। আয়শা মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরল। আজীবন তার মেয়েটাকেই কেন এত কষ্ট পেতে হয়। যা পেয়েছে। তা কি যথেষ্ট ছিলনা? মা না হতে পারার অভিশাপটা কেন তাকেই পোহাতে হলো। ছলছল চোখ, বুকে আক্ষেপ, চাপা জেদ নিয়ে শুধু আকাশ পানে চেয়ে রইল। এটা বিধাতার কেমন নিয়ম!

ধানমন্ডির নামীদামী রেস্টুরেন্টে বসে আছে আয়শা বেগম। সামনে ধোঁয়া উঁড়া কফির মগ, মুখোমুখি চেয়ারে বসে আছে শতাব্দ। ভীষণ অস্থির, অধৈর্য। কফির মগে চুমুক দিতেই, শতাব্দ অকপটে আওয়াজে জিজ্ঞেস করল,
‘ কেমন আছে ও? কি বলল? কিছু কি জানতে পেরেছেন?’
শতাব্দের অধৈর্যতা দেখে স্মিত হাসল আয়শা। বলল,
‘ আমি যতটুকু জানি ডাক্তারা শান্ত স্বভাবের হয়। এমন রগচটা অধৈর্য ডাক্তার এই প্রথম দেখছি।’
বিরক্ত হলো শতাব্দ। বলল,
‘ শান্ত থাকার জন্য শান্তির প্রয়োজন, আপনার ফাজিল মেয়ে আমাকে ওইটুকু শান্তি দিয়েছে?’
আয়শা আবারো হাসল। শতাব্দ রেগে গেল,
‘ আপনি হাসছেন? সিরিয়াসলি!’
ছোট শ্বাস ফেলে আবার জিজ্ঞেস করল,
‘ কেন বাড়ি ছেড়েছে কিছু বলল?’
আয়েশা রহস্যময়ী ভঙ্গিতে বলল,
‘ আমার মেয়ের সাথে কি কথা হয়েছে তা তোমাকে বলব কেন?’
শতাব্দ রাগে কিটকিটা হয়ে বলল,
‘ আমি চাইলেই আপনার মেয়েকে ঘাড়ে ধরে বাড়ি নিয়ে যেতে পারি। এতে অশান্তি বাড়বে। আপনার মেয়ে আবারো পালাতে চাইবে। ঝামেলা চাইছিনা। মূল কারণ জেনে সমাধান করতে চাই। আর আপনার মেয়ে তা আমার সামনে কোনদিন স্বীকার করবে না। শত হোক আপনার মেয়ে, আপনারি মত জেদি।’
‘ তোমার সাহস দেখে অবাক হচ্ছি আমার সামনে আমার মেয়েকে ঘাড়ে ধরে বাড়ি নিয়ে যেতে চাইছ। আবার আমাকে জেদি বলছ!’
‘ কারণ মেয়ে অবধি পৌঁছানোর ঠিকানা আমিই দিয়েছি।তাছাড়া আপনি আগে আমার সহযোগী পরে শাশুড়ী। এখন আমার বউকে চাই।’
‘ তুমি বোধহয় দুনিয়াতে একমাত্র জামাই যে বউ পেতে শ্বশুর শাশুড়ীকে হাত করেছে। প্রথমে জাফর ভাই, আর এখন আমি।’
ফোস করে শ্বাস ফেলল শতাব্দ। বলল,
‘ অনেক লেগপুলিং করেছেন মা, এবার আমাকে সত্যিটা বলুন। আমি জানতে ভীষণ অধৈর্য।’
আয়শা বেগম গম্ভীর হলো এবার। একটু চুপ থেকে গম্ভীরতা এঁটে সবটা শতাব্দকে বলল।
শতাব্দ চুপ, অস্বাভাবিক শান্ত। আয়েশা ডাকল। বলল,
‘এবার সিদ্ধান্ত তোমার। আমার মেয়ের ভালোর জন্য আমি কখনো বলবনা তাকে মেনে নেও। এতে প্রিয়’র অসম্মান।’
রাগে টগবগে উঠলো শতাব্দ। গম্ভীর হয়ে বলল,
‘ এই ওর বিশ্বাস। এই তুচ্ছ কারণে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেল। সাহস দেখেছেন, অসুস্থতার কথা লুকালো। ইন্ডিয়া যেয়ে চিকিৎসা করল। আর ওকে কে বলল সামান্য বাচ্চার জন্য আমি আফসোস করব?’
ব্যাপারটা শতাব্দ যে মেনে নিবে তা নিয়ে শতভাগ নিশ্চিত ছিল। কিন্তু এই রাগের ব্যাপারটা গড়মিল হয়ে গেল। শতাব্দ রাগছে কেন? ভেবেছিল আফসোস করবে। কিন্তু রাগ!
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল শতাব্দ। চোখেমুখে ভয়*ঙ্কর রাগ। আয়শা বিহ্বল সুরে জিজ্ঞেস করল,
‘ কোথায় যাচ্ছ?’
শতাব্দের ঠান্ডা উত্তর,
‘ আপনার মেয়ের সাথে অনেক বোঝাপড়া বাকি।’
আয়শা হতভম্ব। পেছন থেকে আরেকবার ডাকল। বলল,
‘ সত্যি যাচ্ছ। বিলটা দিয়ে যেও।’
সামনে এগোতে এগোতে রুখা আওয়াজে উত্তর দিলো শতাব্দ,
‘ অনেক টাকা আছে আপনার। বিদেশি ডলার কিনা!’
হাসল আয়শা। শতাব্দের সাথে বরাবরই ঠোকাঠুকি সম্পর্ক তার। কফির মগে চুমুক দিলো। যে জানে সুরক্ষিত শক্ত হাতে মেয়ে দিয়েছে। সব ঠিক হবে এইবার। ঘাড়ত্যাড়া শতাব্দ তার জেদি প্রিয়কে ফিরিয়ে আনবে ঠিক।

গভীর হচ্ছে রাত। ঘন বর্ষন। ঢাকার বাহিরে হওয়ায় এই এলাকায় লোডশেডিং হয় প্রচন্ড। বাড়িতে নতুন উঠায় বিদুতের বিকল্প কৃত্রিম আলোর ব্যবস্থা করা হয়নি এখনো। নিভুনিভু মোমবাতি জ্বলছে। চোখে ঘুম নেই। জানালার সামনে দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়। আচমকা দরজার কড়া নড়ল। ঠকঠক। এত রাতে কে আসবে? ভয়ে কেঁপে উঠল প্রিয়। দরজা খুলবে না বলে সিদ্ধান্ত নিলো। সময়ের সাথে সাথে শব্দ বাড়ছে প্রচন্ড। বিরক্ত হলো প্রিয়। এভাবে শব্দ হলে ঝামেলা হবে, বাড়িওয়ালা অবধি নালিশ গড়াবে। কে এসেছে একবার খুলে দেখবে কি? অনেক ভেবেচিন্তে দরজা অবধি গেল। ‘কে এসেছে’ গলা উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল। অপরপাশ থেকে উত্তর এলো না কোন। দরজার পিঠে শব্দ করে যাচ্ছে অনবরত। এবার প্রিয় প্রচন্ডরকম বিরক্ত হলো। রেগে দরজা খুলতেই হতভম্ব। ‘শতাব্দ’ বলেই ভয়ে চমকে গেল প্রিয়। তড়িঘড়ি করে দরজা লাগাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। শতাব্দ আটকালো। জোর খাটিয়ে ভিতরে ঢুকল। প্রিয় ভীতু, বিমূঢ়, হতভম্ব। ছোট ঢোক গিলল।

চলবে……..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here