বাতাসা (২০)
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা
_____________________
— ‘I’m her boyfriend!’
কথাটা কেমন গুঞ্জনের মতো শোনা গেল। দিশা চমকে তাকালো পেছনে। প্যান্টের পকেটে দু’হাত রেখে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে জেন। ফর্সা মুখ লাল হয়ে আছে। শক্ত মুখে লিও-র দিকে তাকিয়ে সে। লিও ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। দিশা দ্রুত বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেল। সামান্য তোতলিয়ে বললো, ‘তুমি এখানে জেন? তোমাদের ক্লাস শেষ?’
জেন জবাব দিল না। লিও-র দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে ধরল। গম্ভীর স্বরে দিশাকে উদ্দেশ্য করে বললো, ‘I called you over ten times! Why didn’t you pick up the phone? Where is your phone?’
দিশা সামান্য অপ্রস্তুত হয়ে গেল। নিচ থেকে দ্রুত ব্যাগ উঠিয়ে ফোন চ্যাক করা শুরু করল। অতঃপর দুঃখী ভাব নিয়ে বললো, ‘ফোন সাইলেন্ট করা ছিল জেন। আমি দেখিনি। সরি!’
জেন এবারো জবাব দিলো না। তার সূক্ষ্ণ দৃষ্টি এখনো লিও-র দিকেই। লিও কেমন ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে দিশার দিকে। জেন এবার সরাসরি প্রশ্ন করল, ‘Hey man, why are you looking at my woman like this? Do you want to say something?’
লিও এবার একটু কেঁশে নিল। দিশার দিকে কেমন দৃষ্টিতে তাকাল যেন। এরপর জিজ্ঞেস করল,
— ‘ছেলেটা কি সত্যি তোমার বয়ফ্রেন্ড? সে তোমাকে তার ওম্যান বলছে! তুমি কিছু বলছো না কেন?’
ইংরেজি ভাষায় তরতর করে বলে ফেলল লিও। বলেই দীর্ঘ লম্বা শ্বাস নিল। দিশা আড়চোখে জেনের দিকে তাকাল। জেনের কড়া, প্রখর দৃষ্টি তার দিকেই। দিশা চোখ ফিরিয়ে নিল। মৃদু স্বরে বলল,
— ‘ও আমার বয়ফ্রেন্ডই লিও।’
লিও-র মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। সে জোড়ে চেঁচিয়ে উঠল,
— ‘কি?’
জেন বাঁকা হেসে তাকাল তার দিকে। কণ্ঠে তাচ্ছিল্য ভাব এঁটে বলল,
— ‘কানে কম শুনো নাকি? ডাক্তার দেখাব?’
অপমানে মুখ থমথমে হয়ে গেল লিও-র। কিছু বলল না। জেন দিশাকে কাঠকাঠ গলায় বলল,
— ‘চলো?’
দিশা পাল্টা প্রশ্ন করল, ‘কোথায়?’
এবং পরপরই জেনের কড়া দৃষ্টিতে চুপ হয়ে গেল। আর একটি শব্দও করলো না।
___________________
জেনকে আজ বড্ড হাসি-খুশি লাগছে। লিও-র ব্যাপারটাতেও তেমন কিছু বলছে না। কোনো এক বিষয়ে ভীষণ আনন্দিত সে। দিশা এক দৃষ্টিতে জেনের মুখপানে তাকিয়ে। তার ভালো লাগছে জেনকে দেখতে। অদ্ভুত প্রশান্তি হচ্ছে। হঠাৎ জেন শীতল চাহনি মেলে ধরল তার দিকে। গম্ভীর স্বরটি আরেকটু প্রগাঢ় করে বলল, ‘আ.. আম্মি টুমাকে বিচন ভালুবাচি দিইইসা।’
‘হ্যাঁ?’ থতমত খেয়ে বলল দিশা।
জেন মিষ্টি করে হাসল। দিশার চোখে চোখ রেখে ভরাট গলায় বলল,
— ‘আমি আবার আমার প্রাণোচ্ছল, চঞ্চল জীবন চাই দিইইসা। আমার সুখ-দুঃখে সর্বদা তোমাকেই চাই। তুমি কি আমার পাশে সবসময় থাকবে না?’
দিশা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে ছিল। জেনের কথায় দ্রুত মাথা উপর-নিচ নাড়ালো। সে থাকবে। জেন এবার বাঁকা হাসলো। চট করে দিশার গালে চুমু খেয়ে নিল৷ অতঃপর কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘টুমি আম্..মার ঝিবন দিইইসা। আই কান্ট লিভ উইদাউট ইউ। আই রেইলি কান্ট!’
বাতাসা
২১.
নিশীথের প্রহর। নভস্থলে ভেসে বেড়াচ্ছে অসংখ্য গুচ্ছ গুচ্ছ তারা। গাড়ির ভেতর এসি চালু করা। বাইরের হীম ঠান্ডার ওপর এসির শীতল বাতাসে ভরাবহ শীতে আড়ষ্ট হয়ে আছে দিশা। হাত, পা কাঁপছে। আড়চোখে একবার জেনকে দেখে নিলো সে। মানুষটা খুব স্বাভাবিক ভাবে গাড়িতে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে। রেডিও-তে একটা ইংরেজী গান বাজছে,
‘ I’d climb every mountain
And swim every ocean
Just to be with you
And fix what I’ve broken
Oh, ‘cause I need you to see
That you are the reason ’
বেদনাময় গান। দিশার ভালো লাগল না।
এই শীতেও নির্বিঘ্নে বসে আছে জেন। দিশা একটু কেঁশে দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করল। তবে এতে বিশেষ কাজ হলো বলে মনে হলো না। জেন সেই একই ভঙ্গিতে নির্বিবাক আছে। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে শুধু প্রশ্ন করল, ‘কি হয়েছে?’
জবাবে দিশা দু’হাতের পাতা ঘঁষতে ঘঁষতে বললো, ‘শীত লাগছে খুব! এসিটা বন্ধ করো না!’
‘আমার ভালো লাগছে।’
‘কিন্তু আমার তো ভালো লাগছে না। শীতে কাঁপছি, দেখছ না?’
‘আমার চোখ বন্ধ। দেখব কিভাবে?’
দিশা রেগে গেল এবার। তেড়ে গিয়ে রেডিওর চলনরত গান বন্ধ করে দিল। এতে বিরক্তিতে চোখ মেললো জেন। ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো, ‘কি হয়েছে?’
‘হোস্টেলে দিয়ে আসো আমাকে। দেড়ি হচ্ছে আমার।’ বিক্ষিপ্ত কণ্ঠ দিশার।
‘না। আজকে এখানেই থাকবে তুমি। সারারাত!’
বলার মাঝেই এসি অফ করে দিলো জেন। দিশা চোখ বড় বড় করে তাকালো। উঁচু গলায় চেঁচিয়ে উঠল, ‘অসম্ভব! এক্ষুণি হোস্টেলে নিয়ে চলো আমায়।’
‘না।’
‘এমন করছ কেন জেন?’
‘আমার ইচ্ছা।’
দিশার ক্রোধের মাত্রা বেড়ে গেল তৎক্ষণাৎ। গাড়ির দরজা খুলতে খুলতে ঝাঁঝালো গলায় বলে উঠল, ‘থাকো তুমি এখানে। আমি একা একাই যেতে পারি।’
কিন্তু একি! গাড়ির লক খুলছে না। একটু জোড় দিয়ে চেষ্টা করার পরও না। দিশা জেনের দিকে তাকালো। তার মুখে অস্পষ্ট বাঁকা হাসি। সে আগের চেয়েও তেজি গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘কি করেছ দরজার? খুলছে না কেন? তাড়াতাড়ি খুলো বলছি! খুলছো না কেন?’
জেন নিরুত্তর। গভীর মায়াময় নেত্রপল্লবে দেখে নিল কিছু সেকেন্ড। তারপর দিশাকে শক্ত হাতে টেনে নিলো নিজের কাছে। বুকের সঙ্গে মিশিয়ে নিলো। অতঃপর দিশার চুলে আলতো ভাবে হাত বুলাতে বুলাতে বললো, ‘হোস্টেলে বলে রেখেছি আমি। কেও কিছু বলবে না।’
‘তাও ছাড়ো! আমি…’
দিশাকে থামিয়ে জেন ক্ষীণ স্বরে বলতে লাগল, ‘আমার আর একা একা ভালো লাগে না দিশা। আমরা জলদি বিয়ে করে নেব। মম রাজী না হলেও। আলাদা ফ্ল্যাট নেব। আমি চাকরি করব। রোজ অফিসে যাওয়ার আগে মন ভরে দেখব তোমায়। কপালে চুমু খাবো। আবার ফেরার পর শক্ত করে জড়িয়ে ধরব। তুমি ব্যাঙালি মেয়েদের মতো শাড়ির আঁচল দিয়ে আমার কপালের ঘাম মুছে দেবে। শরবত বানিয়ে দেবে। আমি সেটা তৃপ্তি সহকারে পান করব।
রোজ রাতে বারান্দায় বসে চন্দ্রবিলাস করব আমরা। তুমি আমার কোলে বসে আমার বুকে মাথা দিয়ে রাখবে। ঠিক এইভাবে। আমি তোমার থেকে প্রতিদিন নিয়ম করে বাংলা শিখব। আমাদের একটা সুন্দর টোনাটুনির সংসার হবে। আমাদের অনেকগুলো বেবি হবে। ইনশাল্লাহ!’
দিশা শান্ত হয়ে গিয়েছিল আরও বহু আগে। রাগ কমে গিয়েছিল। এতক্ষণ খুব মনোযোগ দিয়ে জেনের কথাগুলো শুনলেও, শেষের কথা শুনে খানিক লজ্জা পেল সে। গালে ফুটে উঠল রক্তিম আভা। মিনমিনিয়ে সেও বললো, ‘ইনশাল্লাহ!’
জেন ডাকলো, ‘দিশা?’
‘হু!’
‘ভালুবাসি টুমাকে।’
দিশাও বাংলাতেই বললো, ‘আমিও ভালোবাসি আমার হ্যান্ডসাম বাতাসাকে।’
________________
চলবে…
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা
~ কপি করা নিষিদ্ধ। এবং দুঃখীত😑
_________________
চলবে…
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা
~কপি সম্পূর্ণ নিষেধ। ছোট হচ্ছে তাই দুঃখীত😥