#বাসন্তীগন্ধা
| পর্ব ০২ |
লাবিবা ওয়াহিদ
মাহিম এবং মেহের পড়ার টেবিলে মুখোমুখি বসেছে। মাহিম পড়া বাদ দিয়ে কোণা চোখে মেহেরের দিকে তাকাচ্ছে এবং মুখ-ভঙ্গি নানান রকম বিকৃত করে মেহেরকে ভেঙ্গাচ্ছে। যার ফলে মেহের নাক ফুলিয়ে কোণা চোখে মাহিমের দিকে তাকাচ্ছে এবং মুখ চালিয়ে নীরবে গাল-মন্দ করছে তাকে। সারিম একটি বইয়ে ডুবে আছে বিধায় দুই ভাই-বোনের অকাজ খেয়াল করছে না। একসময় মাহিম মেহেরের পায়ে লাথি দিলো। হালকা করে। মেহের এতে রেগে-মেগে আরও জোরে মাহিমের পায়ে দিলো। অতঃপর টেবিলের নিচেই শুরু হয় পায়ে পায়ে যুদ্ধ। এই যুদ্ধের মাঝে হঠাৎ মেহের ভুলবশত সারিমের পায়ে গিয়ে আঘাত করে। আঘাত জোরালো ছিলো না। বেশ হালকা ছিলো। মেহের পা সারিমের পায়ে লাগতেই সে দ্রুত পা সরিয়ে ফেলে। ভয়ে শুকনো ঢোঁকও গিলে। কারণ, মাহিম শর্ট’স পরে ছিলো আর সারিম ফুল টাউজার। এজন্যে মাহিম এবং সারিমের পায়ের পার্থক্যটা মেহের বেশ ভালো করেই ধরতে পারলো। সারিম বই থেকে চোখ তুলে মেহেরের দিকে তাকালো। কঠোর নজরে। সেই চাহনিতে মেহের আরও কয়েকটা শুকনো ঢোঁক গিললো। ঢোঁক গিলতে গিয়ে আবিষ্কার করলো, তাঁর গলা শুকিয়ে পুরো কাঠকাঠ হয়ে গেছে ভয়ে। মৃদু কম্পিত হাত জোড়া মুঠ করে ধরলো।
ওদের দুজনের ভাব-ভঙ্গি দেখে মাহিম বুঝলো শেষ লাথিটা গিয়ে লেগেছে সারিমের পায়ে। যা বুঝতে পেরে মাহিম পৈশাচিক হাসি দিলো। ভাবলো,
–“বুঝবে এবার ঠ্যালা!”
সারিম এবার মাহিমের দিকে তাকালো। রাগাম্বিত চোখে। মাহিমের হাসি সাথে সাথে মিলিয়ে গেলো। সারিম দাঁতে দাঁত চেপে দুজনের উদ্দেশ্যে বললো,
–“পড়তে আসছিস নাকি মা!রা-মা!রি করতে বসছিস?”
মাহিম বিব্রত হয়ে কিছু বলতে নিলে সারিম এক ধমকে তাকে থামিয়ে দিলো। সেই ধমকের ঝংকারে দুই ভাই-বোনই চমকে উঠলো। তবে মেহেরের চমকানোর সাথে কম্পনও সাড়া দিলো। ভীতু চোখে সামনে থাকা খাতাটার দিকে স্থির নজর ফেললো। সারিম মাহিমের উদ্দেশ্যে বলতে লাগে,
–“বাইরে দুনিয়ার মেয়েদের সাথে প্রেমালাপ আর বাসায় পড়ায় ফাঁকি দেয়া তাই না? পড়িস না দেখেই আজ দেড় মিনিটের ছোট বোনের থেকে এক ক্লাস জুনিয়র হয়ে গেছিস। সামান্য শরম-লজ্জা নেই রে তোর? ফেল্টুশ কোথাকার! সারাদিন অফিস করে ক্লান্ত দেহ নিয়ে বিছানায় না শুয়ে এখানে বসে তোদের পড়াচ্ছি। গায়ে লাগে না এই কষ্ট? কাদের জন্যে করি আমি এসব?”
সারিমের বকাঝকায় মাহিমের চেহারাটা দেখার মতো ছিলো। মেহের তো মাহিমের অবস্থা দেখে খুব মজা পেলো। তখন না সে বুক ফুলিয়ে বলছিলো, মাহিমের চাইতে মেহের বেশি বকা খায়? এখন বুঝো ঠ্যালা। মেহের মুখে হাত চেপে হাসছিলো দেখে সারিম এবার মেহেরের দিকে তাকালো। মেহের সাথে সাথে নীরব হয়ে গেলো। সারিম এবার মেহেরের উদ্দেশ্যে বললো,
–“তোর মাথা তো পুরো গোবরে ভর্তি। এত বড়ো মেয়ে হলি অথচ কোথায় কী বলতে হয় তাই জানিস না। পড়ালেখা না করলে তো এমন হবেই। বে!দ্দপের দল। জমজ তোরা, আল্লাহ্ তোদের যথেষ্ট মেধা দিয়েছে। সেগুলা কাজে না লাগিয়ে সারাদিন ঝিমুলে মেধা কাজে দিবে না বরং এক বস্তা গোবর ময়লা হয়ে বেরুবে। তোদের দুটোর অবণতি দেখে আমি অবাক হচ্ছি। কী করে আমার সামনে দুটো বসে মা!রা-মা!রি করছিস!”
সারিম মাহিম এবং মেহের দুজনকেই সমান তালে বকাঝকা করলো। তাও যেন সারিমের রাগ নিয়ন্ত্রণে আসছে না। ইচ্ছে করছে দুটোকে আস্তাবলে দিয়ে আসতে। অন্তত ঘোড়ার কাজ করে দৌড়ালেও এদের লাভ আছে। কিন্তু পরমুহূর্তেই সারিমের মনে হলো, সে ভুলবশত গাধাকে ঘোড়ার সাথে তুলনা করে ফেলেছে। মানে যা-তা অবস্থা দাঁড়ালো।
————————
সাইয়ান ফ্লাটের চাবি নিয়ে দ্রুত ভঙ্গিতে সিঁড়ি বেয়ে উঠছিলো তখনই অবসাবধানবশত হাত থেকে চাবিটা পরে যায়। চাবির জন্যে হন্তদন্ত হয়ে পিছে ফিরে নামতে নিলে কারো সাথে সজোরে ধাক্কা খেলো সে। সাইয়ান যেখানে ছিলো সেখানেই রইলো তবে তাঁর প্রতিপক্ষ সিঁড়ির রেলিং ধরে বেঁচে যায়। সাইয়ান সামনে তাকাতেই দেখলো এক পরিচিত মুখ। তাঁর অফিসের কর্মচারী। নাম তাঁর রোজা। এইতো কয়েক মাস হলো তাঁর অফিসে জয়েন করেছে। রোজা রেলিং ধরে ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলছে। চোখে-মুখে ভয় গ্রাস করেছে তাঁর। আরেকটু দেরী করলে রেলিং ধরার সময় পেত না। সিঁড়ি দিয়ে গড়াতে গড়াতে কী বিধ্বস্ত অবস্থাই না হতো। ভাবলেও রোজার গা শিউরে ওঠছে। সাইয়ান দ্রুত চাবিটা উঠিয়ে ব্যস্ত কন্ঠে বলে,
–“আপনি ঠিকাছেন মিস রোজা?”
রোজা নিজেকে সামলে নিলো। ধীর গলায় বলে,
–“জ..জি স্যার। ঠিকাছি!”
–“আ’ম এক্সট্রেইমলি সরি, মিস রোজা। আমি আপনাকে খেয়াল করিনি!”
–“ইট’স ওকে স্যার। আপনার দোষ নেই, আমিও অসাবধান ছিলাম। তাই সরি বলে আমায় লজ্জিত করবেন না।”
রোজার এরূপ কথা বলার নম্রতা সাইয়ানের পছন্দ হলো। সে ফিচেল হেসে বলে,
–“তা আপনি এখানে যে?”
–“পাঁচ তলায় থাকছি আমি!”
সাইয়ান অবাক হলো বেশ। যতটুকু জানে রোজার আর্থিক অবস্থা ভালো না। তাহলে সে তাদের এত ব্যয়বহুল এপার্টমেন্টে কী করে থাকছে? মাসে মাসে ভাড়ার খরচ তো তাঁর মাসিক আয়ের কাছাকাছি। এ অবস্থায় সংসার চালায় কী করে মেয়েটা? এরূপ নানান প্রশ্ন সাইয়ানের মস্তিষ্কজুড়ে ঘুরপাক খেলো। রোজা সাইয়ানের চিন্তিত মুখ দেখে কিছু একটা আঁচ করতে পারলো। ধারণা অনুসারে রোজা আবার বললো,
–“এখানে বান্ধুবীর ফ্যামিলির সাথে থাকছি। যেহেতু অফিস এখান থেকে কাছে। আমার বাসা চট্টগ্রাম শহরের বাইরে।”
পুরো বিষয়টি সাইয়ান এবার বুঝতে পারলো। ফিচেল হেসে বলে,
–“তাই বলছেন। তা লিফট ছেড়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠছেন যে?”
এবার রোজা আমতা আমতা করতে লাগলো। আমতা আমতা করে বললো,
–“লিফট সময়মতো পাচ্ছিলাম না। এছাড়া একটু তাড়ার মধ্যে ছিলাম, তাই বাধ্য হয়ে সিঁড়ি বেয়েই যাচ্ছি!”
–“ওহ। তাহলে তো আপনাকে আটকে দেরী করে ফেললাম। সো স্যরি!”
–“না, না। ঠিকাছে!!”
–“চলুন একসাথে যাই। আমার তো তিন তলায় ফ্লাট!”
রোজা নীরবে ইতিবাচক মাথা নাড়িয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠলো লাগলো। পাশাপাশি দুজন। রোজা আড়চোখে সাইয়ানকে দেখতে ভুলছে না। মানুষটা লম্বাটে হলেও এখন আর দেখতে অসুবিধা হয় না। অভ্যাস হয়ে গেছে তাঁর। সাইয়ানের এই মিশুক এবং ভদ্র স্বভাব তাকে ভীষণ মুগ্ধ করে। অফিসের বসেরা বুঝি এত সুন্দর করে কর্মচারীদের সাথে মিশতে পারে? সাইয়ান সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে বলে,
–“বাড়িতে কে কে আছে তোমার?”
রোজা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। শান্ত স্বরে বললো,
–“মা এবং ছোট ভাই!”
সাইয়ান থেমে গেলো। কিছু জিজ্ঞেস করার পূর্বেই হঠাৎ তাঁর মোবাইলের কথা মনে পরলো। হঠাৎ-ই সাইয়ানকে অশান্ত দেখালো। ব্যস্ত হয়ে রোজার উদ্দেশ্যে বলে,
–“আচ্ছা শুভ রাত্রি। আগামীকাল অফিসে দেখা হবে। আসলে ফোনটা ফেলে এসেছি! বাসার সবাই মনে হয় চিন্তা করছে। বাই!”
সাইয়ান রোজার কোনো কথার অপেক্ষা না করে দরজার লক খুলে ভেতরে চলে গেলো। রোজা দীর্ঘশ্বাস ফেলে লিফটের দিকে গেলো। লিফটের বাটন চেপে উঠে পরলো লিফটে। এতক্ষণ তো সাইয়ানের সাথে থাকার ছোটখাটো বাহানা দিয়েছে মাত্র।
———————-
মেহের এবং মাহিম পাশাপাশি কান ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আর সারিম মেহেরের বিছানায় আরাম করে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। চোখ তাঁর বন্ধ। মাহিম একবার কান ছাড়ছে আর কানে হাত দিচ্ছে। চোখে মুখে ফ্যাকাসে ভাব ফুটে এসেছে তাঁর। মেহের মনে মনে আবারও গাল-মন্দ করছে সারিমকে। একেতো কান ধরিয়ে রেখেছে তাঁর উপর মেহেরের বিছানায় সারিম চোখ বুজে শুয়ে আছে। মেহেরের চেহারা দেখার মতো। মাহিম মেহেরকে কনুই দিয়ে খোঁচালে মেহের গরম চোখে চাইলো মাহিমের দিকে। মাহিম চোখ-মুখ কুচকে ফিসফিস করে বলে,
–“আজাইরা ঢং বাদ দে, চল আমরা পালাই।”
তখনই সারিম চোখ মেলে চাইলো। মাহিম প্রথমে ঘাবড়ালেও পরবর্তীতে দাঁত কপাট বের করে বলে,
–“আসলে, খুদা পেয়েছে ভাইয়া। খেতে যাই?”
সারিম কী ভেবে উঠে বসলো। অতঃপর মেহেরের দিকে চেয়ে বলে,
–“গর্ধ!বটার জন্যে খাবার নিয়ে আয় তো!”
মেহের চুপচাপ চলে গেলো। মা জ্যুতিকে খাবার দিতে বলে দ্রুত মায়ের ফোন থেকে সাইয়ানকে কল দিলো। কারণ, এই কান ধরা থেকে একমাত্র সাইয়ান-ই বাঁচাতে পারবে। কয়েকবার রিং হতেই সাইয়ান কল রিসিভ করলো। সাইয়ানের গলা শুনতেই মেহের আবেগী হয়ে গেলো। অভিযোগের সুরে বলে,
–“তোমার ভাইটা একদম ভালো না সাইয়ান ভাই। কয়েক ঘন্টা যাবৎ বকেছে। এখন আবার কান ধরিয়ে রেখেছে। আমি পা এবং হাত ব্যথায় টিকতে পারছি না ভাইয়া। বিচার চাই তোমার কাছে!”
সাইয়ান স্মিত হাসলো। হাসি বজায় রেখেই বলে,
–“নির্ঘাত তোর দেড় মিনিটের বড়ো ভাইটা কিছু করেছে?”
–“ও করলে ওকে শাস্তি দিক, আমায় কেন এর মধ্যে টানছে। আমি কী কিছু করতে পারি?”
সাইয়ান ফিক করে হেসে দিয়ে বলে,
–“আপাতত আমার ডার্লিং দাদীর রুমে গিয়ে বসে থাক। সারিমকে আমি কল করছি!”
মেহেরের মুখে হাসি ফুটে উঠলো। লহু কন্ঠে আওড়ালো,
–“আমার লক্ষী ভাইয়া!”
———————-
সকাল বেলা সকলে রাস্তা সেরে যে যার কাজে বেরিয়ে গেছে। এদিকে মাহিম তো নোট’স এর ছুঁতোয় তাড়াতাড়ি পালিয়েছে। কারণ, গতকাল রাতে কান ধরার শা!স্তি মাফ করলেও সারিম সোজা বলে দিয়েছে যেন আজ মেহেরকে মাহিম নিয়ে যায়। আর এ কাজ করতে মাহিম কখনোই রাজি হয় না। হবেও না। দুজনকে একসাথে দেখলে মাহিমের মুখ ফুটো হয়ে যাবে। কারণ, একই কলেজে বিধায় সকলেই প্রশ্ন ছুঁড়ে কেন তাঁরা এক ক্লাস আগে পিছে? মাহিম এমনিতেই অনেক কষ্টে কয়েকবার বেঁচেছে। বারবার বাঁচা সম্ভব না। ফেল্টুশ শব্দে তাঁর বড্ড এলার্জি!
মেহের রেডি হয়ে নিচে নামতেই দেখলো সারিম ফর্মাল স্যুটে সোফায় বসে ফোনে কথা বলছে। তাঁর অপর সোফাতে দাদী রোকসানা বসে আছে। তাঁর পাশেই বসেছে রোকসানার বড়ো ছেলে। অর্থাৎ সারিমের বাবা। মেহের সারিমকে দেখে পা টিপে টিপে সদর দরজার দিকে যেতে নিলে মেহেরের মা তাকে পিছুডাক দিলো।
–“মেহের, একা কোথায় যাচ্ছিস?”
যাহ্! ধরা খেয়ে গেলো। চো!রের মতোন মেহের পিছে ফিরে দাঁড়ালে দেখলো সারিম কানে ফোন নিয়ে ঘাড় কাত করে তাঁর দিকেই তাকিয়ে। সারিম তৎক্ষনাৎ ওপ্রান্তের মানুষটির থেকে বিদায় নিয়ে কল কাটলো৷ অতঃপর ভ্রু কুচকে তাকালো মেহেরের পানে। যেন মেহেরের উত্তরের অপেক্ষায় আছে। মেহের তখন আমতা আমতা করে বললো,
–“আ..আসলে আম্মু, মাহিমের সাথে কলেজ যাবো..”
মেহেরের পুরো কথা শেষ হবার আগেই সারিম বলে ওঠে,
–“ওটা আগেই তোকে নিয়ে যাওয়ার ভয়ে পালিয়েছে। এখন তুই আমার সাথে যাবি! চল, দেরী হয়ে যাচ্ছে।”
সারিম উঠে দাঁড়ালো। মেহেরের চেহারা তখন ভার। অস্ফুট স্বরে মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো,
–“সর্ব’ নাশ!”
[ক্রমশ]
বিঃদ্রঃ সকলে রেসপন্স করবেন প্লিজ। গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম। ইন-শা-আল্লাহ্ আপনাদের মন্তব্যের রিপ্লাই করার চেষ্টা করবো।