#বাসন্তীগন্ধা
| পর্ব ০৩ |
লাবিবা ওয়াহিদ
জ্যুতিকে রোকসানা বেগম খুব একটা পছন্দ করেন না। পছন্দ না করার কারণ হয়তো ছোট ছেলে তাঁর পছন্দে জ্যুতিকে বিয়ে করে এনেছে। জ্যুতি বিয়ে হয়ে আসার পরপর রোকসানা জ্যুতির সাথে একদম-ই কথা বলেননি। অথচ মাহিম এবং মেহের রোকসানার প্রাণ। তাদের সাথে ঠিকই হেসে খেলে বেড়ান। ওরা জম্ম নেয়ার পরপর রোকসানার রাগ কিছুটা কমে আসে। দুই একটা প্রয়োজনীয় কথাবার্তা ছাড়া তিনি অতিরিক্ত কোনো কথা বলেন না। জ্যুতি সেই বিয়ের পর থেকে শ্বাশুড়ির মন জয় করার প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন। এখনো তাঁর চেষ্টা চলছে। কে জানে কবে রোকসানার মন জুড়ে জ্যুতি জায়গা করতে পারবে? কিংবা রোকসানা জায়গা দিয়েছেন কী না কে জানেন? বড্ড চাপা স্বভাবের কী না। এদিকে রোকসানার খুবই আদরের ছিলো সারিম এবং সাইয়ানের মা রুমানা। কিন্তু তিনি প্রায় সাত বছর আগে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মূর্ছা যায়। সারিমরা তিন ভাই-বোন। সাইয়ান, সারিম এবং তাদের ছোট বোন সামিরা। মা হারানোর পর দিনগুলো ভাই-বোনদের জন্যে বেশ কঠিন ছিলো। আইয়ুব সাহেব অর্থাৎ সারিমদের বাবার জন্যেও দিনগুলো সহজ ছিলো না। এমন এক দুর্দিনে পরিবারকে পাশে না পেলে তাঁরা হয়তো আজীবন ঘোরের মাঝেই থেকে যেত। পুরো পরিবার প্রিয়জন হারানোর দুঃখে জর্জরিত হলেও তাঁরা বাহিক্য দিক দিয়ে শক্ত থেকে তাদের সঙ্গ দিয়েছে, পাশে থেকেছে। সবচেয়ে কঠিন ছিলো সামিরাকে সামলানো। সামিরা বেশ কয়েকবার হাসপাতালে ভর্তি পর্যন্ত হয়েছিলো।
জ্যুতি নিজ হাতে শ্বাশুড়ি এবং ভাশুরকে চা দিয়ে এলেন। জ্যুতির স্বামী অফিসে গিয়েছে। সারিম বছরখানেক হলো অফিস যাচ্ছে। তবে পুরোপুরি সব বিষয়ে অভিজ্ঞ নয়। অভিজ্ঞতা না থাকায় পুরো শাখা সামলানো সারিমের পক্ষে সম্ভব না। এ কারণে তাঁর চাচা সোহেল সাহেবও অফিস আসা-যাওয়া করছে। আইয়ুব সাহেব স্ত্রী হারানোর পর অফিস যাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলো। ভেবেছিলো এখন তাকে সন্তানদের সাথে সময় কাটাতে হবে। কিন্তু সারিম এবং সাইয়ান নিজেদের সামলে নিয়েছিলো। তাই বছর দুয়েক ছোট মেয়েটাকে সামলে দিয়ে সকলের জোরাজুরিতে আবারও ছোট ভাইয়ের সাথে অফিসের হাল ধরে।
জ্যুতি চা দিলে রোকসানা থমথমে মুখে চাটা হাতে তুলে নিলো। রুমানা মা! রা যাওয়ার পর সংসারের সমস্ত ভার এসে পরেছে জ্যুতির কাঁধে। একা হাতে এতগুলা দিন ধরে সকলের খেয়াল রাখছে। নিশ্চয়ই এই দিকটি প্রসংশনীয়। রোকসানা চায়ে চুমুক দিতেই জ্যুতি বলে ওঠে,
–“দুপুরের জন্যে কী রান্না করবো মা?”
রোকসানা আড়চোখে তাকালেন ছোট বউয়ের দিকে। জ্যুতি উৎসুক হয়ে চেয়ে আছে রোকসানার দিকে। এটা প্রতিদিনের অভ্যাস জ্যুতির। শ্বাশুড়িকে জিজ্ঞেস করে খাবার রান্না করতে যায় সে। রোকসানা হালকা গলা খাঁকারি দিয়ে কয়েক পদের তরকারির কথা বললেন। এছাড়া অতিরিক্ত কোনো কথা বললেন না। জ্যুতি তপ্তশ্বাস ফেলে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালো। জ্যুতি চলে যেতেই পাশ থেকে আইয়ুব সাহেব মায়ের উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,
–“এভাবে আর কতদিন মা? ছেলে-মেয়েরা বড়ো হয়ে গেলো অথচ আপনি আজও জ্যুতির সাথে ঠিক ভাবে কথা বলেন না। বিষয়টি বড্ড দৃষ্টিকটু লাগে!”
রোকসানা বেগম চুপ করে চায়ে চুমুক দিচ্ছে। আইয়ুব সাহেবের কোনো কথাই যেন কানে তুললেন না। নীরব থেকে কিছুক্ষণ পর বললো,
–“সব কথা কইতে হয় না বাজান। বেশি কইতাম দেখে বড়ো বউরে হারাইছি। এহন ছোট বউরে হারানোর মতো সাহস এই কলিজায় নাই!”
–“না হারাতে চাইলে কথা বলুন মা, মিশুন। জ্যুতি এখনো হতাশায় ভুগছে এই ভেবে যে আপনি জ্যুতিকে মেনে নেননি।”
এবার রোকসানা একদম চুপ হয়ে গেলো। কোনো কথাই বললো না।
—————-
সারিমের গাড়ি কলেজের গেট অবধি পৌঁছাতেই দেখা গেলো সোহা গেটের সামনে দাঁড়িয়ে মেহেরের অপেক্ষা করছে। সোহাকে দেখে মেহেরের অধরে এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে। সে দ্রুত ভঙ্গিতে সিটবেল্ট খুলতে নিলে সারিম তাকে আটকে দেয়। মেহের হাসতে ভুলে পিটপিট করে চাইলো সারিমের দিকে। সারিম গম্ভীর গলায় বলে,
–“তোর হাঁ-দারাম ভাইটাকে বলিস বেশি উড়লে সে বাইক হারা হবে!”
মেহেরের তখন বলতে ইচ্ছে করলো, “হাঁ-দারাম ভাই তো আপনিও হতে পারেন সারিম ভাই!”
কিন্তু সেই সাহস মেহেরের হলো না। মেহেরকে অন্যমনস্ক দেখে সারিম মেহেরের চোখের সামনে চুটকি বাজালো! ভ্রু কিঞ্চিৎ কুচকে বললো,
–“শুনেছিস?”
মেহের দ্রুত মাথা নিচে উপরে নাড়িয়ে বললো, “হ্যাঁ!”
সারিম সিটবেল্ট ছেড়ে দিলো। গলার টাই ঠিক করতে করতে বলে,
–“সাইয়ান ভাইয়ের কারণে দুটো বেঁচে গেছিস। নয়তো তোদের বাঁকা থেকে সোজা করার সুযোগ ছিলো হাতে!”
মেহের কোনো কথা না বলে সিটবেল্ট খুলে দরজা খুলে বেরোলো। সোহা মেহেরকে দেখতে পেতেই হাসি-মুখে এগিয়ে এলো। সারিম জানালার কাঁচ নামিয়ে মেহেরকে ডাকলো, “মেরু” সম্বোধন করে। মেহের ঘুরে তাকালে সারিম বললো,
–“সাবধানে থাকবি। কেউ বিরক্ত করলে অবশ্যই জানাবি!”
বলেই সারিম জানালার কাঁচ উঠিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চলে যায়। সোহা সারিমের চলে যাওয়া দেখলো। হা করে। মেহের সোহাকে নিয়ে গেট দিয়ে কলেজে প্রবেশ করলো। হাঁটতে হাঁটতে সোহা অস্ফুট স্বরে বললো,
–“মেরু?”
মেহের চমকে সোহার দিকে চাইলো। সোহা মেহেরের দিকে জিজ্ঞাসু চোখে চাইলো। মেহেরের চমকানো দেখে সোহা ভ্রু কুচকে বলে,
–“মেরু বলে ডাকা মালিকটি কে শুনি?”
মেহের হালকা ঢোঁক গিলে এগোতে নিলে সোহা হাত ধরে আটকালো। হালকা হেসে ব্যঙ্গ করে বললো,
–“কোথায় পালাচ্ছো মেরু?”
–“খবরদার আমায় এই নামে ডাকবি না?”
–“কেন? এই নামে ডাকা আইনত অ\ পরাধ নাকি?”
মেহের কিছু বললো না। চলে যেতে নিলে সোহা আবার আটকালো। এক গাল হেসে বলে,
–“বললি না তো মেরু সম্বোধন করা মালিকের নাম?”
–“কাজিন হয় ভাইয়া!” মেহেরের সহজ স্বীকারোক্তি!
–“ও আচ্ছা। এজন্যে বুঝি মুখটা পেঁচার মতো করে রেখেছিস?”
–“আমি স্বাভাবিক আছি।”
–“আমিও তা ভালোভাবে দেখতে পাচ্ছি। কেমন ভাই রে এটা? এতো সুইট করে ডাকলো। আর আমার কাজিন গুলাকে দেখ, পেত্নি, বিলাই, গাভী ছাড়া ভালো নামে ডাকে না। যদিও সবগুলা ম্যারিড। তা তোর এই ভাই কী সিঙ্গেল নাকি? না তোর সাথে কোনো প্রেমঘটিত কিছু..?”
–“চুপ কর তো। কিসের সাথে কী মিলাচ্ছিস? সারিম ভাইয়ের সাথে আবার কিসের প্রেম?”
–“বাহ, কী কিউট নাম। তবে আমার কাছে ঘাপলা লাগছে জানিস। যেভাবে সুইট করে তোকে ডাকলো না, এখনো কানে এসে বাজছে। আর…”
মেহেরের কোনো কথা বলার ইচ্ছে হলো না। সোহার হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে কলেজের ভেতরে চলে গেলো। গিয়ে দেখলো সিঁড়ির দিকে মাহিম একা দাঁড়িয়ে একটি মেয়ের সাথে ভাব জমাচ্ছে। মেয়েটির চেহারা দেখে মনে হচ্ছে পটবে পটবে ভাব। এমতাবস্থায় মেহেরের মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেলো। নীরবে হেসে মুখে মাস্ক পরে মাথায় ওড়না পেচালো। অতঃপর গলাটা পরিষ্কার করে সেদিকে এগিয়ে গেলো। হঠাৎ করে আগমন ঘটিয়ে মাহিমের বুকে জোরে কিল দিয়ে বলে,
–“শ* তান, লু**চ্চা ছেলে। তোর সাহস তো কম না আমার সাথে সম্পর্কে জড়ানোর পরে আরেকজনকে পটাচ্ছিস? এই বেশরম? কয়ডা লাগে তোর?”
এরকম কথা শুনে তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠে মেয়েটি। সবকিছু এত দ্রুত-ই ঘটলো যে মাহিমের মস্তিষ্কে সবকিছু গোলমাল পাকিয়ে গেলো। হঠাৎ যখনই কন্ঠটি চিনতে পারলো তখনই বাম গালটায় চ! ড় পরলো। সেই মেয়েটাই দিয়েছে। মেয়েটি মাহিমকে মে*রেই চলে গেছে। মাহিম গালে হাত দিয়ে বেক্কলের মতো চেয়ে রইলো মেয়েটির যাওয়ার পানে। হঠাৎ মেহের ফিক করে হেসে উঠলো। হাসির শব্দ শুনে গরম চোখে চাইলো মাহিম। চিৎকার করে বলে ওঠে,
–“মেহেরের বাচ্চা!”
———————–
–“সাইয়ান ভাইয়া? আপনি কবে বিয়ে করছেন?”
ইলিরার এরকম বাক্য শুনে সাইয়ান ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললো। থমথমে সুরে বললো,
–“আমার বিয়ে নিয়ে কাজ কী?”
–“আপনার বিয়ের জন্যেই তো আমার সবকিছু আটকে আছে। একেতো আমি সারিমকে ভালোবাসি, বিয়ের জন্যে বাসা থেকে চাপ দিচ্ছে। ওদিকে সারিম হচ্ছে মেজো ছেলে। আপনাকে বিয়ে না দিয়ে কিছুতেই সারিমকে বিয়ে দেবে না আপনার পরিবার। প্লিজ ভাইয়া বিয়ে করুন, সারিমকে ছাড়া আমি আর টিকতে পারছি না। প্লিজ, ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড!”
[ক্রমশ]