#বিন্দু_থেকে_বৃত্ত
#পার্ট_১৩
জাওয়াদ জামী
” আপু, তুমি কেমন আছো? ”
কারো গলার আওয়াজ শুনে পেছনে তাকায় কুহু।
” শিহাব! তুই এসেছিস! বাবা এসেছে বুঝি? ” আবেগে বাকরুদ্ধ হয়ে যায় কুহুর।
” আব্বু-আম্মু, আপু সবাই এসেছে। আপু তুমি বললেনাতো কেমন আছো? ” মুখ ভার করে বলে শিহাব।
” আমি আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। তুই কেমন আছিস সোনা? বাবা আর ছোটমা কোথায় রে ছটু?” শিহাবের গালে চুমু দিয়ে প্রশ্ন করে কুহু৷
” আব্বু-আম্মু ফুপুদের সাথে কথা বলছে। ”
” ছটু, তুই দিদুনের সাথে কথা বল। আমি বাবার সাথে দেখা করে আসছি। দিদুন আমি যাই? ”
আয়েশা সালেহা মাথা নাড়াতেই কুহু দৌড়ে বাগানে যায় বাবার খোঁজে।
তাহমিদ এতক্ষণ অবাক চোখে এক চপলা মেয়েকে দেখছিল। যে মেয়েকে এত বছরে তাহমিদ এভাবে উচ্ছ্বসিত হতে দেখেনি, এভাবে হাসতে দেখেনি।
তাহমিদ হাত বাড়িয়ে শিহাবকে কাছে ডেকে নেয়।
কুহু বাবাকে বড় ফুপুর পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সেদিকে এগিয়ে যায়।
” বাবা, কেমন আছো তুমি? এত দেরি করে আসলে যে? ছোটমা তুমি ভালো আছো? ”
কায়েস বড় মেয়েকে দেখে ওকে বুকে টেনে নেয়।
শিউলি আক্তার কুহুর প্রশ্নের জবাবে শুধু মাথা
নাড়ায়।
” আমি ভালো আছি। তুই ভালো আছিস তো মা? ” বাবার মুখে এত মধুর স্বরে মা ডাক শুনে আবেগে কেঁদে ফেলে কুহু। দীর্ঘ ছয় মাস পর বাবাকে চোখের সামনে দেখে কুহু কিছুতেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেনা। কেঁদে ভাসাচ্ছে বাবার বুক। কায়েসও পরম মমতায় মেয়ের মাথায় হাত বুলাচ্ছে।
আর এদিকে বাবা-মেয়ের এই ভালোবাসা দেখে মনে মনে বলছে, যত্তসব আদিখ্যেতা। এমন ভাব করতাছে যেন কতকাল ঐ কালীরে দেখেনি৷ এভাবেই মনে মনে হাজারটা গালি দিতে থাকে কুহুকে।
আজকের অনুষ্ঠানের মধ্যমণি তাহমিদ। আফরোজা নাজনীনের দুই বোনের ছেলেমেয়েদের সাথে তাহমিদের খুব ভালো সম্পর্ক। ওরাও তাহমিদকে গুরু মানে। স্টেজের একপাশে সবাই গোল হয়ে বসে আড্ডা দিচ্ছে। আনানের বন্ধু-বান্ধব, আরোশির বন্ধু, তনয়া ও তার ভাই তন্ময়, সুপ্তি, সিক্তা, দৃষ্টি, শিহাব, আনানের ছয়জন চাচাতো ভাই, ফুফাতো ভাইবোন মিলে বিশাল একটা গ্যাং এই মূহুর্তে শোরগোলে মেতেছে বাগানে। সবাই আছে শুধু কুহু বাদে। এদের কেউ গান গাইছে, কেউ নাচছে, কেউ জোকস শোনাচ্ছে।
” গাইজ, আজ কেক কাটার পর একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে। সেখানে তাহমিদ ভাই আমাদের গান শোনাবে। ভাই কিন্তু জবরদস্ত গান গায়। ” আনানের এ্যানাউন্স শুনে সবাই হইহই করে উঠে।
তাহমিদ বুঝল এদের থেকে নিস্তার পাবার উপায় নেই।
তনয়া জোর করে কুহুকে ওদের আড্ডার মাঝে নিয়ে আসে। বরাবরের ইন্ট্রোভার্ট কুহু এসবে কখনোই কমফোর্ট ফিল করেনা। কিন্তু এই কাজিন জাতির কাছে ও সম্পূর্ণভাবে পরাস্ত হয় সব সময়ই। একে একে আনানের সব বন্ধুদের সাথে কুহুকে পরিচয় করিয়ে দেয় আনান। কুহুও হাসিমুখে তাদের সাথে কথা বলে।
” আনান, ভাইয়া কুহুপুও কিন্তু খুব ভালো গান গাইতে পারে। আজ কুহুপুর গান শুনলে মন্দ হয়না কিন্তু। ” তনয়ার এই কথা শুনে কুহুর হাত-পা কাঁপছে। তনয়া এটা কি বলল! আজ এখানে ছোটমা উপস্থিত আছে। আজ এখানে যদি কোন অনর্থ হয় তাহলে ছোটমা নির্ঘাত ওকে মেরে ফে’ল’বে। ও কতদিন এভাবে বাইরে থাকবে! একদিন তো ওকে গ্রামে যেতেই হবে।
কেক কা’টা’র মুহূর্ত আগত। আরোশি কাজিন আর বন্ধুদের সাথে উত্তেজিত হয়ে অপেক্ষা করছে কাঙ্ক্ষিত মূহুর্তের জন্য। কুহু বড় ফুপুর পাশে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে ওদের দেখছে। সুপ্তি অনেক বলেও আরোশির পাশে ওকে নিতে পারেনি।
তাহমিদ আর আনানরা বাগানের মাঝে আড্ডায় মেতেছে। ওরা এসবের আশেপাশে নেই।
করতালি আর বার্থডে গানের সাথে কেক কা’টে আরোশি। একে একে সবাইকে খাইয়ে দেয়।
আজকের এই মুহূর্তে নিজের মাকে প্রবলভাবে অনুভব করছে কুহু। মা বেঁচে থাকলে নিশাচয়ই ওর জীবনটাও এভাবে হাসিখুশিতে ভরপুর থাকত। ওর সকল ছোট-বড় আবদার মা হাসিমুখে মেটাত। বিশেষ দিনে, বিশেষ মুহূর্তে মায়ের সান্নিধ্য পাওয়া যেত। এসব নানান কথা ভাবতে ভাবতে কুহুর চোখে পানি আসে। আবার সেই পানি সকলের অগোচরে মুছেও ফেলে। কেউ ওর চোখের পানি না দেখলেও একজনের চোখ এড়ায়নি। যে পুরো অনুষ্ঠানে ঈগল চোখে চেয়ে আছে কুহুর দিকেই। সেই একজন তার প্রিয়তমার চোখের পানি দেখে ঠিক বুঝে নেয় সে কাঁদছে কেন।
” এখন যত কাঁদার কেঁদে নাও। যেদিন আমার কাছে চিরতরে আসবে, সেদিন থেকে তোমার চোখে এক ফোঁটাও পানি আসতে দিবনা। প্রমিজ করছি। ”
” ভাই একা একা কি কথা বলছ! পাগল হয়ে গেছ নাকি? ” আনানের কথা শুনে তার দিকে চোখ ফেরায় তাহমিদ।
” আমি সেই ছয়-সাত মাস আগেই পাগল হয়েছি। অথচ আজ তোর চোখে পরল! সত্যি তুই উ’জ’বু’ক’ই থেকে গেলি, মানুষ হইলিনা। ”
” ভাই, এভাবে হেয়ালি করবেনা তো। তোমার কথার আগামাথা কিচ্ছু বুঝিনা, ছাই। ”
” গুরুজনের সাথে কেউ কখনও হেয়ালি করে! আর তোর সাথে তো কখোনই নয়। হাজার হোক গুরুজন বলে কথা! ”
” আবারও শুরু করলে! আমি তোমার গুরুজন হলাম কবে, কেমন করে! ” কেঁদে দেয়ার মত অবস্থা আনানের।
” আমি শিওর যেদিন জানতে পারবি তুই কেমন গুরুজন, সেদিন আফসোসে কপাল চাপড়াবি। বাদ দে এসব কথা। এবার বল তোর ভাবিকে দেখতে কেমন? ”
আনানের চোয়াল ঝুলে পড়ে তাহমিদের কথা শুনে।
” কোন ভাবি, কার ভাবি, কিসের ভাবি? আমি কোন ভাবিকে দেখিনি! ”
” এই বুদ্ধি নিয়ে গুরুজনের কাহিনী জানতে চাস! আগে ভাবি কে সেটা খুঁজে বের কর, তবেই জানতে পারবি কিসের গুরুজন তুই। ”
আনান চোখমুখ কুঁচকে তাকায় তাহমিদের দিকে।
” দূরে কোথাও আছি বসে,
হাত দুটো দাও বাড়িয়ে।
বিরহ ছুঁতে চায় মনের দুয়ার,
দু চোখ নির্বাক আসোনা ছুটে।
তুমি এলে রংধনু রং ঢেলে দেয়,
তুমি এলে মেঘেরা বৃষ্টি ঝরায়।
এ মনের আহলাদ আসোনা ছুটে।। ”
তাহমিদের হৃদয়স্পর্শী গানে শ্রোতারা মুহুর্মুহু করতালিতে ভাসিয়ে দেয়। আনানের গিটার হাতে দাঁড়ানো তাহমিদের দৃষ্টি একজনের উপর নিবদ্ধ। কিন্তু সেই একজন অন্যমনস্ক হয়ে তাকিয়ে আছে দেয়ালের ওপাশে।
তনয়ার অ্যানাউন্সমেন্টে হুশ ফিরে তার। তনয়া তাকে গান গাইতে স্টেজে ডাকছে। সাথে সাথেই তার কাজিন সমাজ টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যায় স্টেজে। বাঁধা দেয়ার কোন সুযোগই পায়না সে।
স্টেজে উঠে সামনে তাকাতেই মাথা ঘুরে যায়। এত মানুষজনের সামনে কেমন গাইবে! পাশে থেকে কাজিনরা উৎসাহ দিচ্ছে। চোখ বন্ধ করে জোরে শ্বাস নেয়।
রিনরিনে গলায় এসে জেঁকে বসে নজরুল সংগীত।
” এমনই বরষা ছিল সেদিন,
শিওরে প্রদীপ ছিল মলিন,
তব হাতে ছিল কলসও বীন,
মনে কি পরে প্রিয়। ”
তাহমিদ সুরের মূর্ছনায় হারিয়ে গেছে। এই মেয়ে এত সুন্দর গাইতে পারে!
গান শেষ হলে সবাই কুহুর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়।
এভাবে সবাইকে কুহুর তারিফ করতে দেখে শিউলি আক্তারের ভিষণ রা’গ হয়। কেউ তো একবারও তার এত সুন্দর মেয়ের প্রশংসা করে কিছু বললনা! মনে মনে ভাবে, শুধু একবার কুহুকে একা পাই।
সানাউল রাশেদিন সন্ধ্যায়ই এসেছেন। তিনি এই মুহূর্তে বসে আছেন শাহনাজ সুলতানার ড্রয়িংরুমে। আকরাম হোসেনের ভাইয়ের সাথে কথা বলছেন তিনি। কিছুক্ষণ পর তারা বাসায় যাবেন।
” কুহু, আমাকে এক গ্লা পানি দিওতো মা। ” কুহুকে ড্রয়িংরুমে আসতে দেখে আবদার করলেন সানাউল রাশেদিন। কুহু মাথা নাড়িয়ে পানি আনতে রান্নাঘরে আসে। কিন্তু সেখানে পানি নেই। তাই সে ফুপাকে অপেক্ষা করতে বলে বাগানে আসে পানি নিতে।
পানি নিয়ে ভেতরে আসতেই তাহমিদের সামনে পরে কুহু। তাহমিদ কুহুর হাত থেকে পানির গ্লাস নিয়ে ঢকঢক করে সবটুকু পানি পান করে। কুহু অসহায় চোখে দেখল তাহমিদের কাজ।
” এটা বড় ফুপার জন্য নিয়ে যাচ্ছিলাম আর আপনি… ” বিরক্তিতে মুখে কথা জোগায়না কুহুর৷
” আমার পিপাসা পেয়েছিল তাই খেয়েছি। এতে খোঁ’টা দেয়ার কি হল! দেশে কি পানির অভাব পরেছে? কতজনের চোখেই তো দেখি সাত সাগরের পানি। শুধু একটু দুই চোখ চিপলেই পানির ঝর্ণা বয়। কিন্তু দেখো সে কিনা এই এক গ্লাস পানির জন্য হাপিত্যেশ করছে! আজিব! তবে গান শুনে বোঝা যায়না কেউ এত কাঁদতে পারে। যার চোখে সাত মহাদেশের পানি তার গলায় গান আছে! এ ও সম্ভব! ভাগ্যিস পানির তোড়ে গান ভেসে যায়নি! ”
কথা শেষ করেই স্থান ত্যাগ করে তাহমিদ।
আর কুহু হিসাব মেলাচ্ছে তার কথার উত্তর কি এগুলো ছিল!
আবার ঘুরে বাগানে এসে এক গ্লাস পানি নিয়ে ফুপার কাছে আসে।
রাত এগারোটার দিকে আফরোজা নাজনীন তার পরিবারসহ নিজ বাসায় রওনা দেন। যাবার আগে কায়েসকে তাদের বাসায় যাওয়ার কথা বলে দিয়েছেন। কায়েসও রাজি হয়েছে।
পরদিন সকালে খাবার খেয়ে কুহু হোস্টেলে ফিরে। ওর আজ থেকে ক্লাস শুরু হবে। কায়েস মেয়েকে বলেছেন যে কয়দিন ঢাকায় আছে সে কয়দিন সে প্রত্যেকদিন কুহুর সাথে দেখা করবে। কুহু বাবার কথার প্রত্যুত্তরে শুধু হাসে। ওর খুব আনন্দ লাগছে, বাবা ওর সাথে দেখা করতে হোস্টেলে আসবে। বান্ধবীদের কাছে বলবে ওর বাবা এসেছে। যখন ওদের বাবা-মা মাঝেমধ্যে দেখা করতে আসত তখন কুহুর মন ভিষণ খারাপ হত। আজ কুহু সবাইকে দেখাবে ওর বাবা ও দেখতে এসেছে। আনন্দে নাচতে নাচতে কুহু কলেজে যায়।
সেইদিন বিকেলে নাজমা পারভিন, শাহনাজ সুলতানা, কায়েস শিউলিসহ বাচ্চারা মিলে আফরোজা নাজনীনের বাসায় আসে।
‘ কুঞ্জছায়া ‘ আজ মানুষের পদচারণায় গমগম করছে।
তাহমিদ ওর রুমের বিছানায় শুয়ে পড়ছিল। ঠিক তখনই হুড়মুড় করে সিক্তাসহ ওর কাজিন বাহিনী তাহমিদের রুমে প্রবেশ করে।
” ভাইয়াআআআ, আমরা এসে গেছি। ” তনয়ার চিল-চিৎকারে লাফিয়ে উঠে।
ওর বুকের ভিতর ধুকপুক করছে। দোয়া পাঠ করে বুকে ফুঁ দিয়ে বলে,
” এসেছিস ভালো কথা। কিন্তু এভাবে চিৎকার দিলি ক্যান! আরেকটু হলেই কলিজাটা মুখ দিয়ে টুপ করে লাফ দিত! বে’য়া’দ্দ’ব মেয়ে, দুই দিকের আত্নীয়কে সম্মান দিতে জানিসনা? তোদের কপালে ভালো জামাই নাই বুঝলি। তোদের জন্য সিদ্দিক চোর অপেক্ষা করছে। ”
তনয়া তাহমিদের কথা শুনে মুখ কালো করে।
” ভাইয়া, আর মানুষ পাইলানা, ঐ সিদ্দিক চোরের কথাই মাথায় আসল! আমি স্বপ্ন দেখি আমার জামাই বিজয় দেবারাকোন্ডা’র মত হবে। কিন্তু তুমি তো আমার কপালকে পঁচাইলে! ” তনয়ার কথা শুনে আরোশি হো হো করে হেসে উঠে। ওর সাথে তাল মিলিয়ে বাকি সবাই ঘর কাঁপিয়ে হাসছে।
” তাহমিদ তারাতারি তৈরী হয়ে নে। আমরা সবাই মিলে বাইরে যাব। ” সুপ্তি তাহমিদকে তাড়া দেয়।
” তোরা যাবি যা, এর ভেতর আমাকে টানছিস কেন। আমি একটু ঘুমাব। ”
” ভাই, তুমি এসব কি বলছ! আমরা তোমাকে রেখেই বেড়াতে যাব! এতটা স্বার্থপর বানিয়ে দিলে আমাদের! তুমি এখনই উঠ। আমরা এখনই বের হব। নইলে দেরি হয়ে যাবে। ” আনান টেনে তুলে বসায় তাহমিদকে।
” ভাইয়া, চলোনা। এরপর কুহুর কাছে যেতে হবে। ওকে নিয়েই তবে যাব। ” আরোশির মুখে কুহুর নাম শুনে আর দেরি করেনা তাহমিদ। ঝটপট তৈরী হয়ে বেরিয়ে পরে ওদের সাথে।
এদিকে সুপ্তি ভাবছে যে তাহমিদ কুহুর সাথে বিয়ের কথা শুনেই আগ্নেয়গিরির ন্যায় ফেটে পরেছিল, সেই তাহমিদই এখন কুহু যাবে শুনেও ওদের সাথে বের হল! এটা কিভাবে সম্ভব! কিন্তু আবার এই বলে শান্তনা দেয়, সেই ঘটনার পর তাহমিদ অন্তত কুহুর সাথে নতুন করে খা’রা’প আচরণ করেনি৷
তনয়া কুহুকে ফোন দিয়ে তৈরী হয়ে থাকতে বলেছে৷ কুহুও তৈরী হয়ে হোস্টেলের রুমে পায়চারি করছে। কিন্তু ও এখন পর্যন্ত জানেনা, তাহমিদও আসছে ওদের সাথে। হোস্টেলের গেইটে এসে ওরা কুহুকে ফোন করে সুপ্তি। কুহু ফোন পেয়ে গেইটে এসে দারোয়ান চাচার সাথে কথা বলে পারমিশন নিয়ে বের হয়।
কিন্তু গেইটের বাইরে এসেই তাহমিদকে দেখে থমকে দাঁড়ায়।
তাহমিদ গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অবশ্য ওরা কাজিনরা সবাই গাড়ি থেকে নেমে বাইরে হৈচৈ করছিল। কুহু বাইরে আসলে সবাই হুড়োহুড়ি করে গাড়িতে উঠে। সবাই যে যার জায়গায় বসেছে। দুইটা গাড়ি করে এসেছে ওরা।
একটাতে ড্রাইভারের পাশে শিহাব, পেছনে সুপ্তি, তনয়া, আরোশি, আরোশির তিনজন চাচাতো বোন, দুইজন ফুপাতো বোন। অপর গাড়িতে ড্রাইভারের পাশে আনান, পেছনে সিক্তা, দৃষ্টি তাহমিদ বসেছে। তাহমিদদের গাড়িতে একজনের বসার জায়গা আছে। কুহু বাধ্য হয়েই এই গাড়িতে উঠে। তাহমিদ আসবে জানলে ও কখনোই বেড়াতে যাওয়ার জন্য রাজি হতনা। ওরা কুহুকে বসার জায়গা দেয়। কিন্তু বসতে গিয়ে দেখা গেল তাহমিদের পাশে ওকে বসতে হবে। একই গাড়িতে দৃষ্টি আছে বলে কুহু কোন প্রতিবাদ না করে তাহমিদের পাশে বসে।
তাহমিদ মুচকি হেসে বাইরে তাকায়। ভাগ্যিস বুদ্ধি করে দৃষ্টিকে এই গাড়িতে নিয়েছিল।
চলবে…#বিন্দু_থেকে_বৃত্ত
#পার্ট_১৪
জাওয়াদ জামী
তাহমিদের পাশে জড়সড় হয়ে বসে আছে কুহু।
আর এদিকে তাহমিদের মনে লাড্ডু ফা’ট’ছে।রাজ্যের বিরক্তি এসে কুহুর শরীরে চেপে বসেছে। বিরক্তি কাটাতে ওর অপর পাশে বসা সিক্তার সাথে গল্প করতে শুরু করে। তাহমিদও ফোন বের করে অনলাইনে ঢুঁ মারছে। আপাতত কুহু ওর পাশে বসে আছে এই তার জন্য যথেষ্ট। ঘন্টাখানেক পথ অতিক্রম করে ওরা একটা রিসোর্টে আসে। নদীর ধারে বিশাল রিসোর্ট। একদম প্রকৃতির মাঝে অবস্থিত রিসোর্টে বিনোদনের সকল ব্যবস্থাই আছে। গেইট দিয়ে ঢুকেই দুইপাশে রংবেরঙের গাছের সারি। নানান রংয়ের ফুলের গাছ চারপাশে শোভা পাচ্ছে। গাছ পাগল কুহু এত এত ফুলের গাছ দেখে আনন্দে উতলা হয়ে যায়।
সবাই গাড়ি থেকে নেমে রিসিপশনে এসে একটা রুম বুক করে ফ্রেশ হওয়ার জন্য। সবাই রুমে এসে একে একে ফ্রেশ হয়ে বাইরে আসে। প্রথমেই তারা নদীর ধারে এসে হৈহল্লা করতে শুরু করে দেয়। তাহমিদ আর আনান মিলে সবার জন্য জুসের ক্যান নিয়ে আসে। সবার হাতে একটা করে ক্যান দিয়ে কুহুর কাছে আসলে ও তাহমিদকে দেখে নিতে নিমরাজি হয়।
” এখন কি সবার সামনে জুস নিতে রিকুয়েষ্ট করতে হবে! একটা গান গেয়েই মানুষ যে নিজেকে স্টার ভাবতে শুরু করে তা এই প্রথমবার দেখলাম। কালে কালে যে আরও কতকিছু দেখব তা আল্লাহই জানে। ” তাহমিদের খোঁ’চা মারা কথায় কুহু হাত বাড়ায়৷
” তাহমিদ, এখানে নৌকায় চড়বার ব্যবস্থা আছে বোধহয়। একটু কারো সাথে যোগাযোগ বলে দেখবি। অনেক দিন নৌকায় চড়া হয়না। ” সুপ্তির আবদার পূরণ করে তাহমিদকে।
” সাঁতার জানিস তো? যতজন আছিস নৌকা তোদের ভার নিতে পারবে কিনা সেই চিন্তাই করছি। ”
” তাহমিদের বাচ্চা, তুই যেয়ে নৌকা দেখ। আমাদের চিন্তা করতে হবেনা তোর। ”
সুপ্তি আর তাহমিদ তিন মাসের ছোট-বড় হওয়ায় একে অপরকে তুই বলেই ডাকে।
” আমি কিন্তু নৌকায় থাকবনা। শেষে যদি ডু’বে যাস বাঁ’চা’বে কে? আশেপাশে কোন সুপার হিরো নেই কিন্তু। শেষমেষ ভরসা এই তাহমিদই। ” টি শার্টের কলার উঁচু করে ভাব নিয়ে বলে তাহমিদ।
” এই পোলা, এত কথা বলিসনা বলে দিলাম। ” সুপ্তি তাহমিদকে সামনে ঠেলে দেয়।
নদীর টলটলে পানিতে মাঝির বৈঠা ফেলার ছলাৎ ছলাৎ শব্দ এক অপূর্ব সুরের মূর্ছনা সৃষ্টি করছে। কুহু একটু হেলে দু হাতের আঁজলা ভর্তি করে পানি নিয়ে আবার নদীতে ছুঁড়ে দেয়। তাহমিদ, আনান ওরা নৌকায় না উঠে নদীর ধারে দাঁড়িয়ে নৌকার দিকেই দৃষ্টি নিবন্ধ করে আছে ।
হঠাৎই তাহমিদের চোখ যায় কুহুর দিকে। মেয়েটা দু হাতের আঁজলা ভর্তি করে পানি নিয়ে নদীতে ছুঁড়ছে। নদীর তীর থেকে কুহুর মুখের হাসি স্পষ্টই দেখতে পায় তাহমিদ।
তনয়া আর আরোশি মিলে নাচানাচি শুরু করেছে।
নৌকা থেকে নেমে ওরা রিসোর্টে ফিরে। সেখানে কনসার্ট হচ্ছিল। কিছুক্ষণ কনসার্ট উপভোগ করে আবারও বাইরে আসে। এদিক সেদিক ঘুরাঘুরি করে।
” ফুচকা, চটপটি, বার্গার, স্যান্ডউইচ খাওয়াও ভাইয়া। দেখ কত দোকান আর তুমি কিছু খাওয়াচ্ছোনা। এত কিপ্টা তুমি! ” তনয়া তাহমিদের হাত ধরে বায়না করে।
” আমি কিপ্টা! তাহলে তুই নিজেই কিনে খা। আমার এত শখ জাগেনি তোকে খাওয়ানোর। ” তাহমিদ তনয়ার হাত ছাড়িয়ে দিয়ে বলে।
” ও ভাইয়া, তুমি কিপ্টা নও কিপ্টা তো আনান ভাইয়া। প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ ইট্টু খাওয়াওনা। ”
” চল, সবাইকে নিয়ে আয়। ”
সবাই হুড়মুড়িয়ে সামনের দোকানে গিয়ে দাঁড়ায়। যে যার মত খাবার অর্ডার দেয়। শুধু কুহু দাঁড়িয়ে আছে।
” কি রে কুহু, তুই এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? কিছু খাবিনা? ” সুপ্তি জিজ্ঞেস করে কুহুকে।
” আমি এসব খাইনা আপু। তোমরা খাও। ”
” আনান, তুই ও কি মেয়ে নাকি রে! মেয়েদের সাথে তাল মিলিয়ে ফুচকা খাচ্ছিস। সেইম অন ইউ আনান। ” তাহমিদের কটুক্তি শুনেও আনান নিজের মত খেয়ে যাচ্ছে।
কুহু দোকানের পাশে একটা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে এদিকসেদিক দেখছে।
” ফুচকা, চটপটি খাওনা ঝালমুড়ি নিশ্চয়ই খাও? ” কুহুর সামনে ঝালমুড়ির ঠোঙ্গা বাড়িয়ে ধরে আছে।
” ধন্যবাদ, আমি খাবনা। ” অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলে কুহু।
” যদি তিন সেকেন্ডে এটা না নাও তবে তোমাকে আমি নদীতে আ’ছা’ড় মা’র’ব। ” চোয়াল শক্ত করে বলে তাহমিদ।
” আমি সাঁতার জানি। তাই ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। ” কুহুও ত্যাড়াভাবে উত্তর দেয়।
” ভেজা অবস্থায় এখানেই ফেলে রেখে যাব। আই প্রমিজ তোমার ভাই-বোনদের কারও সাহস হবেনা তোমাকে গাড়িতে নেয়ার। ”
তাহমিদের গলায় এমন কিছু ছিল যা মুহূর্তেই কুহুর সিদ্ধান্ত বদলে ফেলতে বাধ্য করে।
তাহমিদের হাত থেকে ঝালমুড়ির ঠোঙা নিয়ে অন্যদিকে ঘুরে। তাহমিদ মুচকি হেসে সেখান থেকে সরে আসে।
এটা সেটা খেয়ে ওরা আসে ছোট্ট বাজারমত জায়গায়। যেখানে বেশ কয়েকটা দোকান। দোকান ভর্তি চুরি, কানের দুলসহ মেয়েদের নানানরকম সাজের জিনিস।
মেয়েরা হুমড়ি খেয়ে পরে দোকানগুলোতে। সবাই মুঠো ভর্তি করে বিভিন্ন রংয়ের কাঁচের চুরি কিনছে। অবশ্য ওরা পছন্দমত নিচ্ছে, দাম দিবে তাহমিদ।
আরোশি একা একটা দোকানে দাঁড়িয়ে কানের দুর দেখছে।
” আরোশি, তোরা সবাই কতকিছু কিনছিস, কিন্তু ঐ রোবট তো কিছুই নিচ্ছেনা। সে কি কিছুই নিবেনা? ”
আরোশি প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকায় তাহমিদের দিকে।
” না মানে কুহুর কথা বলছিলাম। সেতো কিছুই নিচ্ছেনা। ”
” আপুকে আমি বলেছি, কিন্তু আপু বলল কিছুই নিবেনা। ” আরোশির সরল স্বীকারোক্তি শুনে তাহমিদ কিছু ভেবে একমুঠো লাল, নীল, কালো চুরি কিনে আরোশির কাছে দিয়ে কুহুকে দিতে বলে।
” এগুলো তুই কুহুকে দিস। সেতো আমার আশেপাশে ভিড়েনা আর কথাও বলেনা তাই এগুলো আমি দিয়েছি জানলে ও নিবেনা। কথাটা নিজের মাঝেই রাখিস তুই। আসলে তোরা সবাই কিনছিস কিন্তু ও কিছুই কিনছেনা এটা মানা যায়না। শেষে দেখা যাবে আড়ালে আবডালে ঐ মেয়েটাই আমাকে কিপ্টে ডাকবে। ”
আরোশি চুরিগুলো নিয়ে তাহমিদকে বলে, কেউ জানবেনা চুরিগুলো কে দিয়েছে।
খুশিতে তাহমিদ আরোশিকে আরো অনেকগুলো চুরি, কানের দুল কিনে দেয়।
ওরা রিসোর্টে রাতের খাবার খেয়ে তারপর বাসায় ফেরার জন্য গাড়িতে উঠে। আসার পথে যে যেখানে বসেছিল ফেরার পথেও সেভাবে বসে।
সারাদিন সবাই হৈ হুল্লোড় করে গাড়িতে উঠেই ক্লান্ত হয়ে সিটে শরীর এলিয়ে দিয়েছে।
গাড়ি ছাড়ার কিছুক্ষণ পর মেয়েরা ঘুমিয়ে পরে।
কিন্তু কুহু গাড়িতে উঠলে কখনোই ঘুমাতে পারেনা। এদিকে অন্ধকার গাড়িতে দম বন্ধ হয়ে আসে কুহুর।
” কি হয়েছে? এমন তিড়িংবিড়িং করছ কেন? ”
” কিছুনা। ” আর কিছুই বলেনা কুহু। আসলে ও তাহমিদের সাথে কথা বলতে চায়না৷
” নাও চকলেট খাও। ভালো লাগবে। ”
” সরি, লাগবেনা। ”
” আমাকে ক্ষমা করা যায়না? ” তাহমিদের আবেগে মাখা কথা শুনে চমকে উঠে কুহু। এই লোক হঠাৎ ক্ষমা চাইছে কেন!
” আমার মত সাধারণ মেয়ের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিজের সম্মান ক্ষুণ্ণ করবেননা। আর আপনি এমন কিছুই করেননি যে কারনে আমার কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। ”
কুহুর এমন কথায় কি উত্তর দিবে তাহমিদ। গাড়ির সিটে মাথা ঠেকিয়ে ভেতর থেকে উঠে আসা কান্নাকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যস্ত হয়ে পরে।
কতটা কষ্ট পেলে একটা মেয়ে এভাবে বলতে পারে তা বুঝতে পারছে তাহমিদ।
রাত দশটা বেজে গেছে। তাহমিদ, সুপ্তি, সিক্তা বাদে সবাই আনানদের বাসায় যাবে। কিন্তু সমস্যা হয়েছে কুহুকে নিয়ে। এত রাতে হোস্টেলে যাওয়া যাবেনা। তাই ভেবেচিন্তে কুহু আনানদের সাথে যেতে চায়। আনানের বাসার সামনে এসে কুহু গাড়ি থেকে নেমে আসে। একটিবারও তাহমিদের দিকে তাকায়না কিংবা ওর সাথে কথাও বলেনা৷ তাহমিদ ওকে কিছু একটা বলতে চেয়েছিল কিন্তু কুহু সেই সুযোগ দেয়নি।
চলবে…