#বিন্দু_থেকে_বৃত্ত
#পার্ট_২১
জাওয়াদ জামী
কিছুক্ষণ আগে সুপ্তি বিদায় নিয়েছে, রওনা দিয়েছে নতুন ঠিকানায়। পেছনে ফেলে রেখে গেছে অস্তিত্বের সাথে মিশে থাকা আপনজনদের।
সানাউল রাশেদিন ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। এই মেয়েটা তার বড় আদরের ছিল। রীতির জন্মের পাঁচ বছর পর যখন সুপ্তির জন্ম হলো তখন অনেকেই অনেক কথা বলেছিল। অনেকেই আক্ষেপ করে বলেছিল, এবারও মেয়ে হলো! একটা ছেলের জন্য তৃতীয় সন্তান নিল, কিন্তু ফলাফল শূন্য। এ জন্মে আর ছেলের মুখ দেখা হলোনা। সেসব কথা শুনে কষ্ট পেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু মেয়ের থেকে মুখ সরিয়ে নেননি। বরং আরও বেশি করে আঁকড়ে ধরেছিলেন এই মেয়েটিকে৷ মেয়েটিও তেমনি বাবার ভালোবাসার প্রতিদান দিতে ভুল করেনি। বাবার বাধ্য মেয়ে হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। বাবার সকল চাওয়াকে নিজের চাওয়া হিসেবে মনে করেছে। বাবার স্বপ্ন পূরনের জন্য ছোটবেলা থেকেই পড়ালেখায় মনযোগী হয়েছে। ঘুচিয়েছে বাবার সকল আক্ষেপ। প্রতিদিন সকালে প্রথমেই এই মেয়ের মুখ না দেখলে তার ভালো লাগতনা। আজ থেকে আর সকালবেলায় মেয়েটার মুখ দেখতে পাবেননা ভেবেই তার ভেতরটা ভেঙ্গেচুরে যাচ্ছে।
তাহমিনা আক্তার হলরুমের এক কোনে বসে কাঁদছেন। তাহমিদের একমাসের ছোট সুপ্তি। ছোটবেলা থেকেই ওদের সম্পর্ক বন্ধুর মত। তাহমিদের যখন জন্ম হয় তখন তিনি অসুস্থ হয়ে পরায়, আফরোজা নাজনীন তাহমিদকে বুকে টেনে নিয়েছিলেন। বড়মার কাছে সন্তানের মত বড় হতে থাকে তাহমিদ। এরপর সুপ্তির জন্ম হলো। দুইজনকেই তখন বুকের দুধ খাইয়ে বড় করতে থাকে আফরোজা নাজনীন। সাত মাস শয্যাশায়ী ছিলেন তাহমিনা। ততদিনে তাহমিদের দুনিয়া জুড়ে বড়মার বাস। এমনকি তাহমিনা আক্তার সুস্থ হওয়ার পরও মায়ের কাছে আসতে চাইতনা। সুপ্তি ছিল ওর খেলার সাথী, বোন, বন্ধু। সুপ্তিও ছোটমার ভক্ত ছিল। তিনি খাওয়ালেই তবে সুপ্তি খেত। বিয়ের আগ পর্যন্তও তিনি সুপ্তিকে মুখে তুলে খাইয়ে দিতেন। নিজের একটা মেয়ে না হওয়ার আক্ষেপ তিনি সুপ্তিকে দিয়ে পূরণ করেছিলেন। আজ সেই মেয়ে তাদের ছেড়ে শ্বশুর বাড়িতে পারি জমালো। কিভাবে থাকবেন তিনি সুপ্তিকে ছাড়া!
সবাই কমিউনিটি সেন্টার ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আফরোজা নাজনীন কাঁদতে কাঁদতে অসুস্থ হয়ে পরেছেন।
কুহু বারান্দায় দাঁড়িয়ে রাতের আকাশ দেখছে। চাঁদের আলোয় বিচ্ছুরিত হচ্ছে চারপাশ। কিন্তু এই বিচ্ছুরণ ওর মনে কোন প্রভাব ফেলছেনা। ও ফুপুর জন্য কষ্ট পাচ্ছে। ফুপু আজ থেকে অনেকটাই একা হয়ে গেল। সুপ্তি আপু সকল বিপদেআপদে ফুপুর পাশে থাকত। ফুপুকে সাপোর্ট দিত। আজ ফুপু অসুস্থ হয়ে গেছে, এই অসুস্থতা থেকে ফুপু বেরিয়ে আসতে পারবেনা তা কুহু বেশ বুঝতে পারছে। নানান চিন্তা কুহুকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে৷
তাহমিদ ভেতরে কুহুকে দেখতে না পেয়ে বাইরে এসে বারান্দায় দেখতে পেল। ও একমনে কিছু ভেবে চলেছে। তাহমিদ আনানকে ডেকে কুহুকে হোস্টেলে পৌঁছে দিতে বলে। অনেক রাত হয়েছে। এরপর যেতে সমস্যা হতে পারে।
আনান তাহমিদের কথা শুনে কুহুর কাছে আসে।
” কুহু,,চল তোকে হোস্টেলে পৌঁছে দিয়ে আসি। অলরেডি এগারোটা বেজে গেছে। ”
” ভাইয়া, আজ হোস্টেলে যাবনা। বড় ফুপুর সাথে যাব। ফুপু খুব কষ্ট পাচ্ছে। এই অবস্থায় তাকে রেখে আমি হোস্টেলে যেতে পারবনা। ” আনান কুহুর কথা শুনে তাহমিদের কাছে আসল।
” ভাই, ও বলল, তোমাদের বাসায় যাবে। খালামনির এই অবস্থায় তাকে রেখে হোস্টেলে যাবেনা ও৷ ” আনানের কথা শোনামাত্র তাহমিদের বুকের ভেতর র’ক্ত ছলকে উঠে। শক্ত করে আনানকে জড়িয়ে ধরে টুপ করে ওর গালে চুমু খায়।
” ছিহ্ ভাই, তুমি এটা কি করলে! প্রেমে পড়ার সাথে সাথে তুমি কি লুচুও হয়েছ! জেন্ডার না মানছনা দেখছি! সমজাতীর প্রতি আজকাল আকর্ষন বোধ করছ নাকি! নাউজুবিল্লাহ, নাউজুবিল্লাহ। ” তাহমিদকে ছাড়িয়ে একট দূরে সরে আসে আমান।
আনানের কথা শুনে তাহমিদ ভ্যাবাচ্যাকা খায়। এই ছেলে বলে কি!
আনানের দিকে তাকিয়ে দেখল বেচারা চোখমুখে ভয় ফুটিয়ে, দই গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
আনানের এহেন আচরণ দেখে তাহমিদ পারলে লজ্জায় মাটিতে মিশে যায়।
পাঞ্জাবীর কলার ঠিক করে, হালকা কেশে গলা পরিষ্কার করে বলে উঠে,
” গর্দভ, আমাকে কি তোর ঐসব মানুষদের মত মনে হয়! আমি শারীরিক এবং মানসিকভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ। বে’য়া’দ’ব ছেলে। বড় ভাইয়ের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় তা জানিসনা? কানের দুই ইঞ্চি নিচে ঠাঁটিয়ে একটা দিলেই তবে সব জেনে যাবি। ” তাহমিদের কাছ থেকে উল্টো ঝাড়ি খেয়ে চুপসে যায় আনান। সুড়সুড় করে ভেতরে চলে যায়।
আনানের চলে যাওয়া দেখে হাঁফ ছাড়ে তাহমিদ। নিজের অজান্তেই আনন্দে, আবেগে ভেসে একটা কেলেঙ্কারি বাঁধিয়ে ফেলছিল!
খুশিমনে হলরুমে মায়ের কাছে ছুটে যায় তাহমিদ৷
এক বছরের বেশি সময় পর কুহু পা রাখে ‘কুঞ্জছায়া’র চৌকাঠে। ওর পা দুটো ভারী হয়ে গেছে। বারবার মনে পরছে সেইদিনের সেই কথাগুলো। শরীরে হালকা কাঁপন টের পায়। হাতের চেটোয় ঘামের অস্তিত্ব বুঝতে পারছে। কিন্তু ফুপুর ভালোবাসার কাছে সব অপমান ফিঁকে হয়ে গেছে। নিজের সাথে অনেক বোঝাপড়া করে, খানিকটা জড়তা, খানিক ইতস্ততা নিয়ে প্রবেশ করে ‘ কুঞ্জছায়া’র ড্রইংরুমে৷ তাহমিনা আক্তারের চোখেমুখে খুশির ঝিলিক। এবার বুঝি সব ঠিক হয়ে যাবে! আফরোজা নাজনীনও ভেতরে ভেতরে খুশিতে ফেটে পরছেন। মেয়েটা যে শুধুমাত্র তার মন ভালো করতেই এ বাড়িতে এসেছে তা তিনি বেশ বুঝতে পারছেন। দিদুনও খুব খুশি। তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কুহুকে রাতে নিজের কাছে রাখবেন।
তাহমিদের আনন্দ কে দেখে। খুশিতে ওর হৃ’দ’পি’ণ্ড বুক ফে’টে বের হয়ে আসতে চাইছে। বুকের ওপর থেকে পাথর নেমে যাওয়ার সুখ অনুভূত হয়৷ একবার যখন তার শ্যামাঙ্গীনি এ বাড়িতে পা রেখেছে, এবার ওকে আর দূরে ঠেলে দিবেনা।
‘ কুহু, বোনু তুই বড় বউমাকে কিছু খাইয়ে দিয়ে আমার কাছে চলে আসিস। আজ আমার কাছে থাকবি তুই। ” দিদুনের কথা শুনে, মাথা নাড়ে কুহু৷
এই বাড়িতে কুহু পা দেয়ার পর থেকে কুহুর প্রতি সবার ভালোবাসা দেখে, সেসব শিউলির কাছে আদিখ্যেতা মনে হচ্ছে। ভেতরে ভেতরে রাগ জমা হতে থাকে। তার মেয়েকে তো কেউই এভাবে চোখে হারায়না! কেউ তো ওকে মাথায় তুলে রাখেনা। শিউলির ভেতরের প’শু মাথাচাড়া দিল। কেন ওর মেয়ে এদের ভালোবাসা পাবেনা? কুহুই কেন সব ভোগ করবে? সব ভালোবাসা পাওয়ার অধিকার একমাত্র তার মেয়ের। ঐ কালীর ভেতর কি এমন আছে, যা আমার মেয়ের মধ্যে নেই! আমার মেয়ে কুহুর থেকে হাজারগুনে সুন্দরী। এবার ঐ কালীর একটা ব্যবস্থা না করলেই নয়। মনে মনে ছক কষে শিউলি। কিভাবে কুহুকে শিক্ষা দিবে। ভেবেচিন্তে সব প্ল্যান ঠিক করে। এবার শুধু সঠিক সময়ের অপেক্ষা এবং পরিকল্পনা প্রনয়নের পালা।
চলবে…#বিন্দু_থেকে_বৃত্ত
#পার্ট_২২
জাওয়াদ জামী
কুহু ফুপুর রুমে খাবার নিয়ে আসে। আফরোজা নাজনীন অসার হয়ে বিছানায় শুয়ে আছেন। গত কয়েকদিনের পরিশ্রম এবং নিয়মিত খাবার না খাওয়ায় তিনি এমনিতেই দুর্বল ছিলেন। তারউপর মেয়ের বিদায়ের কষ্ট তিনি নিতে পারেননি। প্রেশার ফল করেছে ভয়ানকভাবে। ডক্টর এসে চেক-আপ করে ঔষধ লিখে দিয়েছে। তাহমিদ ঔষধ নিয়েও এসেছে।
কুহু ওর ফুপুর পাশে বসে তাকে খাওয়ানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু তিনি খেতে চাইছেননা৷ কুহু বেশ জোরজবরদস্তি করে কয়েক লোকমা খাইয়ে, ঔষধ খাইয়ে দেয়। এরপর ফুপুর মাথার পাশে বসে চুলে বিলি কেটে দেয় যতক্ষণ না ফুপু ঘুমায় একসময় তিনি ঘুমিয়ে পরলে কুহু দিদুনের কাছে আসে। তাহমিদ ড্রয়িংরুমে বসে কুহুর দিদুনের রুমে যাওয়ার অপেক্ষায় ছিল। যখন দেখল কুহু দিদুনের রুমে যেয়ে দরজা লক করে দিয়েছে তখন সে নিজের রুমে আসে। আনান তাহমিদের বিছানার একপাশে টানটান হয়ে শুয়ে আছে। ওর পাশে শিহাব বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। বাসায় আত্মীয় স্বজনরা থাকায় তাহমিদের রুমে কয়েকদিন থেকে শিহাব আর আনান থাকছে।
তাহমিদ ফ্রেশ হয়ে এসে ওর জন্য রাখা ফাঁকা জায়গায় শুয়ে পরে। সারাদিন অনেক পরিশ্রম করায়,শরীর ক্লান্ত হয়ে গেছে। বিছানায় পিঠ ঠেকানোর প্রায় সাথে সাথেই ঘুমিয়ে পরে।
ফজরের আজানের সুমধুর ধ্বনি কানে আসতেই ঘুম ভাঙ্গলো আয়েশা সালেহার। তিনি ধীরে ধীরে বিছানা থেকে উঠে, ফ্রেশ হয়ে অজু করে এসে কুহুকে ডাকেন।
পাশাপাশি নামাজে দাঁড়িয়েছে দুইজন, যাদের প্রজন্মের মাঝে অনেক তফাত। যাদের বয়সের ফারাক বিস্তর। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার সান্নিধ্যে আসার জন্য বয়সের কোন বাঁধা নেই। তাইতো দুই বয়সের দুইজন নারী একমনে সৃষ্টিকর্তাকে ডাকতে ব্যস্ত।
নামাজ শেষে আয়েশা সালেহা তসবিহ পাঠ করছিলেন। কুহু জায়নামাজ গুছিয়ে রেখে বিছানায় উঠে। বাসায় অনেক লোকজন। তাই এখন ওর বাইরে যাওয়ার ইচ্ছে নেই। শুধু ফুপু ঘুম থেকে উঠলে তার কাছে যাবে। তবে ঘুমের ঔষধের প্রভাবে উনি সম্ভবত দেরি করে উঠবেন।
তাহমিনা আক্তার ফজরের নামাজ আদায় করে রান্নাঘরে আসেন। নাজমা পারভিন, শাহনাজ সুলতানাও ততক্ষণে নামাজ আদায় করে রান্নাঘরে এসেছেন। তারা হাতে হাত মিলিয়ে নাস্তা বানাতে শুরু করেন। অনেকক্ষণ পর শিউলি আক্তার এসে তাদের সাথে যোগ দেয়।
আফরোজা নাজনীনের ছোট জা আসেন এরপর। তারা কয়েকজন মিলে সকলের খাবার তৈরি করেন।
একে একে সবাই আসতে শুরু করেছে ডাইনিং রুমে।
একসময় কুহু ধীর পায়ে রান্নাঘরে প্রবেশ করে। তাহমিনা আক্তার কুহুকে দেখেই বিগলিত গলায় কাছে ডাকেন। কুহু উনার কাছে গেলে, তিনি কুহুকে তার পাশে একটা টুলে বসান। তিনি প্লেটে দুইটা পরোটা, ডিম ভাজি এবং একটু মাংসের তরকারি নিয়ে কুহুর পাশে বসেন। পরোটার এককোণা ছিঁড়ে সাথে মাংস নিয়ে কুহুর মুখের সামনে ধরেন। তাহমিনা আক্তারের এহেন কাজে চমকিত কুহু সহসাই মুখ খুলতে পারেনা। আবেগে আপ্লুত হয়ে গেছে সে। নাজমা পারভিন এবং শাহনাজ সুলতানার চোখে পানি আসে। তার ছাড়াও কুহুকে ভালোবাসার কেউ আছে দেখলে আনন্দের অশ্রু বয় তাদের চোখ বেয়ে৷
শিউলি আক্তার চোখের সামনে এসব সহ্য করতে না পেরে ড্রইংরুমে আসে। রা’গে ফুঁ’স’ছে সে। দাঁত কিড়মিড়িয়ে ওঠে তার।
” কিমুন বেহায়া মাইয়া দেখছ! যারে ঐ বেডির পোলায় অপমান করল, এহন তার হাতেই খাবার খাইতাছে! ছি ছি ছি। আমার মাইয়াডা যে না খাইয়া রইছে সেদিকে কারও নজর নাই৷ খালি সকলে ঐ অ’প’য়া’রে নিয়া নাচে। ” আপনমনে গজগজ করছে শিউলি।
” এই যে মেয়ে, এভাবে মুখ বন্ধ রাখলে হবে? খেতে হবেনা? আমি কখন থেকে তোর মুখের সামনে খাবার ধরে আছি, কিন্তু তোর মুখ খোলারই নাম নেই! নাকি আমার হাতে খেতে চাসনা? ”
তাহমিনা আক্তারের কথা শুনে ঝটপট মুখ খোলে কুহু। পরোটা মুখে নিয়ে চিবাতে থাকে।
” তুমি আমাকে খাওয়াচ্ছো আর আমি মুখ খুলবনা এটা কেমন করে হয় আন্টি! ”
” কোন কথা নয়। চুপচাপ খেয়ে নে। খাওয়া হলে তোর দিদুনকে গিয়ে খাওয়াবি। তাকে কষ্ট করে বাইরে আসতে হবেনা। কি রে পারবি তো? ”
” খুব পারব। কিন্তু আমাকে যে সবার আগে খাওয়াচ্ছো এটা কি ঠিক হলো? ”
” এত বেশি ভাবতে হবেনা তোকে। তুই শুধু খেয়ে নে। ”
নাজমা পারভিন এবং শাহনাজ সুলতানা দুই বোন একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছেন। তারা কোন কিছু আঁচ করতে পেরেছেন। বিষয়টা তেমন হলে মন্দ হয়না। দুই বোন মুচকি মুচকি হাসছে।
কুহু ফুপুর রুমে এসে দেখল তিনি এখনও ঘুমাচ্ছেন। তাই সোজা চলে আসে সিক্তার রুমে। সেখানে সিক্তা, তনয়া, আরোশি, দৃষ্টি, সিক্তার চোট চাচার মেয়ে, আরও দুইজন মেয়ে বিছানা, মেঝে মিলে এলোমেলো হয়ে ঘুমাচ্ছে। ওদের অবস্থা দেখে কুহুর হাসি পায়। ভেতরে এসে ডাক দেয় সবাইকে। কিন্তু কেউই ওর ডাক শোনেনা। সবাই ঘুমে বিভোর। কপাল চাপড়ে ফিরে আসে দিদুনের কাছে।
” কুহুমনি, বান্ধবীদের ছেড়ে এই বুড়ির কাছে আবার আসছ। এসো বস, গল্প করি দুজনে। ”
কুহু দিদুনের পাশে বসে।
” বুঝলে কুহুমনি, বাসায় এই যে অনুষ্ঠান হচ্ছে। তোমার দাদু বেঁচে থাকলে খুব খুশি হত। তিনি সুপ্তিকে খুব আদর করতেন। নাতি-নাতনীদের মধ্যে তিনি তাহমিদ আর সুপ্তিকে বেশি ভালোবাসতেন। তাহমিদ তার প্রান ছিল। মেজো বউমা তাহমিদের জন্মের পর অসুস্থ হয়ে যায়, তখন বড় বউমা ওর দ্বায়িত্ব নেয়। এরপর সুপ্তির জন্ম হল। বিশাল এই সংসারের দ্বায়িত্ব আমাকে একা সামলাতে হত। বড় বউমা দুই ছেলে-মেয়েকে সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। তখন তোমার দাদু বড় বউমার চাপ কমাতে তাহমিদ, সুপ্তিকে নিয়ে সময় কাটায়। ওদের এক দোলনায় শুইয়ে দিয়ে তোমার দাদু ওদের পাহারা দেয়। তবে রীতি, দূত্যি, তাওহীদকে যে ভালোবাসতোনা এমনটা নয়। ওরা তার কলিজা ছিল। কিন্তু এই দুটোর সাথে বেশি সময় কাটানোর দরুন এদের প্রতি বেশি মায়া জন্মে যায়। ধীরে ধীরে ওরা বড় হতে থাকে, আর সেই সাথে ওরা দাদুর ন্যাওটা হয়ে যায়। উঠতে, বসতে দাদু দাদু করতে থাকে।
তারপর একদিন উনি সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গেলেন। তখন ওদের বয়স পনের বছর। তাহমিদ দাদুর শোকে অসুস্থ হয়ে যায়। টানা সাতদিন ওকে স্যালাইন দিয়ে রাখতে হয়। সুপ্তি না খেয়ে থাকে কয়েকদিন। কিভাবে যে ওদের স্বাভাবিক করতে হয়েছে, সেসব মনে হলে কষ্ট লাগে৷ আজ সেই সুপ্তি অন্যের ঘর আলো করছে। ” বৃদ্ধা অতীত রোমন্থন করতে করতে যেন সেই অতীতেই চলে গেছেন। সেই সোনালী অতীত কভু ভুলবার নয়।
” দাদু বুঝি খুব ভালো মানুষ ছিল, দিদুন? তোমাকে খুব ভালোবাসত? ”
” তার মত মানুষ আমি আর দ্বিতীয়টি দেখিনি। তবে মাঝেমধ্যে তাহমিদের মাঝে তার ছায়া দেখতে পাই। তার প্রেমিক স্বত্বা, তার ব্যক্তিত্ব, তার কোমল মন সবকিছুই আমি তাহমিদের মাঝে দেখতে পাই। সেকারণেই বোধহয় আমি তাহমিদকে এত ভালোবাসি। ”
কুহু চুপচাপ দিদুনের কথা শুনছে। যেখানে তাহমিদকে নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, সেখানে কুহু কথা বলতে নারাজ। বৃদ্ধা একমনে বলেই চলেছে,
” ভালোকথা, কুহুমনি আমার দাদুভাই তোমার কাছে মাফ চেয়েছে? সেদিনের পর থেকে ও কিন্তু খুব কষ্ট পাচ্ছে। তুমি ক্ষমা না করলে ওর শান্তি নেই। ভুলতো মানুষই করে। কিন্তু পরে যখন সেই মানুষ অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা চায়, তখন তাকে ক্ষমা করা মনুষ্যত্বের পরিচয় বহন করে । কেউ ভুল করে, সেই ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে চাইলে, তাকে সুযোগ দিতে হয়। ভুল এবং ক্ষমা একই মুদ্রার দুই দিকে অবস্থান করে। তাকে একটা সুযোগ দাও কুহুমনি। এরপর সে যদি কোন অন্যায় করে তবে কেউ তোমাকে আর ক্ষমা করতে বলবেনা। ” বৃদ্ধার গলায় আকুলতা লুকানো থাকেনা।
” দিদুন, তিনি কোন অন্যায় করেননি। তিনি আমাকে যা যা বলেছিলেন, তার থেকেও কঠিন কথা ছোটমা আমাকে প্রতিনিয়ত বলে। আমি ছোটমার ওপরও যেমন রা’গ করে থাকিনা, তেমনি উনার ওপরও আমার কোন রা’গ নেই। আমার শুধু কষ্ট হয়। বারবার মনে হয়, মা বেঁচে থাকলে এমনভাবে আমাকে কেউ বলতে পারতনা। মা বেঁচে থাকলে আমাকে এমনভাবে ভেসে বেড়াতে হতনা। আর তখন তাহমিদ ভাইয়া আমাকে সেই কথাগুলো বলার সুযোগও পেতনা। আমার সব রাগ নিজের ওপর, দিদুন। ” কুহু সব সময়ই মন খুলে যেভাবে দিদুনের সাথে কথা বলে, সেভাবে আর কারও সাথে বলতে পারেনা। তেমনই আজও সে মন খুলে দিদুনের সাথে কথা বলছে। কিন্তু ওরা কেউই জানতে পারলনা তাহমিদ দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ওর সব কথা শুনছে।
ড্রয়িংরুমে লোকজনের শোরগোলে টেকা দায়। কুহুর এখানে কোন কাজ নেই। ও দিদুনের সাথে গল্প করে ফিরে আসে ফুপুদের কাছে। বড় ফুপু ততক্ষণে ঘুম থেকে জেগে গেছেন। তাকে খাবার খাইয়ে ঔষধ দিয়েছেন তাহমিনা আক্তার। কুহু বড় ফুপুর রুমে এসে তাকে জানায়, হোস্টেলে যেতে হবে। কমিউনিটি সেন্টার থেকে সোজা এখানে আসায় কোন পোশাক নিয়ে আসতে পারেনি। রাতে সিক্তার পোশাক পরেছিল, এখনও সেই পোশাকেই আছে। পোশাক নিতে হোস্টেলে যেতে হবে। আফরোজা নাজনীন কিছু বলার আগেই তাহমিনা আক্তার কুহুকে না করে দেন। তিনি জানান, তিনি কুহুর পোশাকের ব্যবস্থা করবেন। কুহু আর দ্বিমত করেনা।
তাহমিনা আক্তার তার ছোট ছেলেকে সকলের অগোচরে শপিংয়ে পাঠান, কুহুর পোশাক কিনতে। তাহমিদ মনের মত কয়েকটা রেডিমেড থ্রিপিস কিনে এনে মায়ের কাছে দেয়। তাহমিনা আক্তার সেগুলো তুলে দেন কুহুর কাছে। কুহু প্রথমে নিতে না চাইলেও তাহমিনা আক্তারের জেদের কাছে হার মানতে হয়।
কুহু গোসল সেরে একটা নতুন থ্রিপিস পরে ড্রয়িংরুমে আসতেই, ওর চোখ আটকে যায় সোফায় বসে থাকা বাবার দিকে। সেখানে বাবার কোলে শিহাব আর পাশে দৃষ্টি বসে খুনসুটিতে ব্যস্ত। আশেপাশে কি ঘটছে সেসব দেখার সময় নেই কারও। কুহু লক্ষ্য করেছে এবার বিয়েতে আসার পর থেকে বাবা ওর সাথে খুব একটা কথা বলেনি। শুধু যেটুকু প্রয়োজন সেটুকুই বলেছে। একবারও আদর করে কাছে ডাকেনি, বুকে টেনে নেয়নি কিংবা মমতায় মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়নি। কষ্টে কুহুর চোখে পানি আসে। টুপটুপ করে ঝরে পরতে একটুও সময় নেয়না। ডাইনিং টেবিলে বসে খেতে খেতে তাহমিদ সবটাই লক্ষ্য করে। কুহুর কান্না দেখে ওর ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে। ছুটে যেয়ে ওকে বুকে জরিয়ে নিতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু সেই উপায় ওর নেই। প্লেট রেখে রান্নাঘরে মায়ের কাছে আসে। সংক্ষেপে মা’কে জানায় কুহুর কান্নার কথা। তাহমিনা আক্তার তৎক্ষনাৎ কাজ ফেলে কুহুর কাছে আসেন। কুহুকে বুঝতে না দিয়ে ওকে নিয়ে রান্নাঘরে এসে টুকটাক কাজের ফাঁকে ফাঁকে কুহুর সাথে গল্প করতে থাকেন৷ নিমেষেই কুহুর মনের সকল মেঘ কেটে যায়। ভালোবাসার শক্তি এত বেশি, যেখানে ভালোবাসা থাকে সেখানে কষ্টের কোন লেশমাত্র থাকেনা।
চলবে…