#বিন্দু_থেকে_বৃত্ত
#পার্ট_৩৩
জাওয়াদ জামী
তাহমিদের এমন আচরণ দেখে কুহু অবাক হয়ে গেছে। যে ছেলেটা কিছুদিন আগেও কুহুর জন্য পা’গ’লা’মি করত, আজ সে একবারও ওর দিকে তাকাচ্ছেনা!
সারা রাস্তা নানান চিন্তা করতে করতে ওরা পৌঁছায় ‘ কুঞ্জছায়া ‘ য়। তাহমিদ গাড়ি থেকে নেমে দরজা খুলে দিলে কুহু বেরিয়ে আসে।
ওরা ভেতরে আসলে তাহমিনা আক্তার দুজনকে ফ্রেশ হয়ে আসতে বলেন। তিনিও টেবিলে খাবার দিয়ে, ওদের অপেক্ষা করতে থাকেন।
দু’জন ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং রুমে আসে। যে যার মত চেয়ারে বসে। তাহমিনা ওদের প্লেটে খাবার বেরে দেন। দুজনেই চুপচাপ খেতে থাকে।
তাহমিনা আক্তার দুজনের নিরবতা দেখে চিন্তায় পরে যান। আর যাই হোক তার ছেলে এমন চুপচাপ থাকার বান্দা নয়। তারপর ওর পছন্দের মেয়ের সাথেই বিয়েও ঠিক হয়েছে, তবুও ছেলেটা এত নীরব কেন!
” তাহমিদ, তোর কি হয়েছে, বাবু? তুই এমন চুপচাপ আছিস কেন? শরীর খারাপ লাগছে? ”
মায়ের কথায় মাথা তুলে তাকায় তাহমিদ।
” কই, আমার তো কিছু হয়নি, মা। নিজেকে মানুষের কাছে সস্তা করতে চাইনা আজকাল। তাই একটু বদলানোর চেষ্টায় আছি। আমি দেখেছি, ব্যক্তিত্ব না থাকলে কেউ দাম দেয়না। ”
” কে বলেছে তোর ব্যক্তিত্ব নেই! আমার ছেলে হীরার টুকরা। তাকে হেয় করার দুঃসাহস কার আছে! ”
” নিজের ছেলে বলে এমন সার্টিফিকেট দিচ্ছ, মা। ছেলের শত অন্যায়ও মায়ের চোখে পরবেনা এটাই স্বাভাবিক। ”
” কুহু, তুই বলতো মা, আমার ছেলের কি ব্যক্তিত্ব নেই? ও কি খা’রা’প ছেলে? ” তাহমিনা আক্তার হাল না ছেড়ে কুহুকে জিজ্ঞেস করেন৷
কুহু তাহমিনা আক্তারের প্রশ্ন শুনে বিষম খায়। উত্তর দেয়ার মত কথা খুঁজে পায়না।
” বাদ দাওনা, মা। সে আর কি বলবে। মেয়েদের কাছে ছেলেরা সব সময়ই খা’রা’প। কিন্তু তুমি তো মা। মায়ের আলাদা কোন জাত হয়না। আলাদা কোন সংজ্ঞা হয়না। মায়ের রূপ মমতাময়ীতেই প্রকাশ পায়। তাই তোমার প্রশ্নের উত্তর তার কাছে নেই। ” কুহু কিছু বলার আগেই তাহমিদ উত্তর দেয়।
কুহু বেশ বুঝতে পারছে তাহমিদ ওকে পরোক্ষভাবে কথা শোনাচ্ছে। তবে কি সেদিনের ঘটনার জন্য সে কুহুর উপর নারাজ! তবে তাহমিদ যে ওকে লে’জে’গো’ব’রে খেলাবে তা বুঝতে বাকি থাকেনা।
কুহু সিদ্ধান্ত নেয় ঘটনা বেশিদূর এগোতে দেয়া যাবেনা। তার আগেই সব ঠিক করে নিতে হবে। দূরত্ব এমন পরিমাণে বাড়তে দেয়া ঠিক নয়, যে দূরত্ব সব ত’ছ’ন’ছ করে দেয়।
কায়েস বারান্দায় ছেলেকে নিয়ে বসে আছে। সে বাড়িতে থেকেই ব্যবসা পরিচালনা করছে। শিহাব স্কুল থেকে ফিরে বাবার কাছে বসেছে। বাবার সাথে নানান গল্প করছে। শিউলি আক্তার রান্নাঘরে এসে স্বামী- সন্তানের জন্য নাস্তা তৈরি করছে। তবে এখনও কায়েস স্ত্রীর সাথে কথা বলেনা। স্ত্রীর প্রতি মন বি’ষি’য়ে গেছে। হয়তোবা আর কখনোই সে শিউলির সাথে কথা বলবেনা।
সন্ধ্যার কিছুক্ষণ আগে দৃষ্টি স্বামীসহ হঠাৎই বাবার বাড়িতে আসল। দৃষ্টিকে দেখেই কায়েসের মুখের ভেতর তিতা হয়ে যায়। যে মেয়ে বাবা-মা’র মুখে চু’ন’কা’লি মাখাতে একটুও দ্বিধা করেনা, আর যাইহোক সেই মেয়ের থেকে কখনোই ভালো কিছু আশা করা যায়না।
কায়েস মেয়েকে দেখে নিশ্চুপ থাকে। কিন্তু সবুজ তাকে চুপচাপ থাকতে দিলনা। সে বারান্দায় এসে কায়েসকে সালাম দিলে, কায়েস সালামের জবাব দিয়ে নিজের ঘরে চলে আসে।
শিউলি আক্তার মেয়ে-জামাইকে দেখে আহলাদে গদগদ হয়ে যায়। হরেকরকম নাস্তা দিয়ে আপ্যায়ন করে তাদের। রাতের খাবারের জন্য তিন রকমের মাছ, দেশি মুরগীর মাংস, হাঁসের মাংস, ডিম ভুনা, বেগুনভাজা, করলা ভাজা রান্না করে।
রাতের খাবার কব্জি ডুবিয়ে খায় সবুজ। একটিবারও শ্বশুর অথবা শিহাবকে ডাকার প্রয়োজনবোধ করেনা।
কায়েস সেই বিকেলে নিজের ঘরে ঢুকেছে, এখন পর্যন্ত বের হয়নি৷
তার মোটেও ইচ্ছে নেই এমন বে’য়া’দ’ব মেয়ের মুখ দেখার। নিজের ঘরেই রাতের খাবার সাড়ে কায়েস।
রাত দশটা। কায়েস তার ছেলেকে অংক করাচ্ছে। এমন সময় ঘরে আসে দৃষ্টি। সোজা এসে বাবার পায়ের কাছে বসে। দৃষ্টিকে দেখে চোখ-মুখ কোঁচকায় কায়েস।
” আব্বু, সন্তান হাজার কোন ভুল করলেও বাবা-মা মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারেনা। আমি ভুল করেছি। আমাকে ক্ষমা করা যায়না, আব্বু। ”
” অনিচ্ছায় ভুল করলে, ক্ষমা করা যায়। কিন্তু যে ইচ্ছা করে ভুল করে,অন্যায় করে তার কোন ক্ষমা হয়না৷ ভুল করবার আগে আমি সেটা শুধরে দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তুই সেসব মানিসনি৷ তাই আমার কোন ইচ্ছেই নেই, তোকে মেনে নেয়ার। আমি ভুলে গেছি, দৃষ্টি নামে আমার কোন মেয়ে আছে। ” কায়েসের সোজাসাপটা উত্তর শুনে, দৃষ্টি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে।
” বাবা, তুমি এভাবে আমাকে অস্বীকার করোনা। তোমরা ছাড়া আমার কেউই নেই। ”
” কেন, যার জন্য আমার সম্মান মাটিতে মেশাতো তোর একটুও বুক কাঁ’পে’নি, এখন তো সেই তোর আপনজন, সবকিছু। আমার সময় নষ্ট করিসনা। তোকে মানুষ করতে পারিনি বলে এখন আর আফসোস হয়না। এখন আমার ছেলের দিকে নজর দেয়ার সময় এসেছে। আমার বিশ্বাস এই ছেলে সমাজের সামনে কখনো আমার নাক কা’ট’বে’না। ” কায়েস ঘৃণাভরে দৃষ্টির থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। কিন্তু দৃষ্টি একচুলও নড়েনা। ও কায়েসের পা চেপে ধরে। বারবার অনুরোধ করে ক্ষমা করে দিতে।
সন্তান পৃথিবীর নিকৃষ্টতর ব্যাক্তি হলেও বাবা-মা কখনোই তাদের দূরে ঠেলে দিতে পারেনা। হয়তো তাদের জন্য মনে সাময়িক রাগ, ঘৃণা কিংবা অভিমানের সৃষ্টি হয়। কিন্তু এগুলো কখনোই চিরস্থায়ী হয়না। তাই মেয়ের এমন আকুতি কায়েসের মনও গলিয়ে দেয়। কায়েস সকল অভিমান ভুলে মেয়েকে বুকে টেনে নেয়।
সকাল থেকেই শিউলি আক্তার ব্যস্ত সময় পার করছে। তার একমাত্র মেয়ের জামাই এসেছে। সে সকাল সাতটা বাজতে বাজতেই, চার ধরনের পিঠা বানিয়েছে। এছাড়াও পরোটা সেমাই, পায়েস তৈরি করেছে।
সবুজ ঘুম থেকে উঠে বেলা দশটায়। এরপর সে নবাবি চালে বাইরে এসে বাড়ির চতুষ্কোণ পর্যবেক্ষন করছে। দৃষ্টি কোথাও থেকে ছুটে এনে ব্রাশে টুথপেষ্ট লাগিয়ে সবুজের হাতে দেয়। সবুজ ব্রাশ নিয়ে কলপাড়ে যায়। যা ঘরের জানালা দিয়ে দৃষ্টিগোচর হয় কায়েসের৷
শ্বশুর বাড়ির ভুঁড়ি ভোজ মন্দ লাগছেনা সবুজের। এভাবে দিনাতিপাত করলে খুব একটা খারাপ লাগবেনা। সবুজ মনে মনে ফ’ন্দি আঁটে এই বাড়িতে খুঁটি গাড়ার।
সকালে খাবার পর সবুজ কোথাও বেরিয়ে যায়। যাওয়ার আগে দৃষ্টিকে ইশারায় কিছু বলে যায়।
কায়েস ধীরে ধীরে বাগানের ভেতর হাঁটছে। এমন সময় দৃষ্টি তার পাশে এসে দাঁড়ায়।
” আব্বু, তোমার সাথে কিছু কথা ছিল। ”
” বল, কি বলবি। ”
” আব্বু, আমি এই তিনমাসেই বুঝতে পেরেছি তুমি সবসময়ই সঠিক ছিলে। সেদিন তোমার কথা না শুনে অনেক বড় ভুল করেছি। আজ তার খেসারত দিচ্ছি। ”
” দৃষ্টি, তোর কি হয়েছে? আমার কাছে কিছু লুকাসনা মা। তুই কি ভালো আছিস? ”
” আব্বু, আমার শ্বশুর-শ্বাশুড়ি উঠতে-বসতে আমাকে খোঁটা দেয়। তাদের ছেলে বেকার। আমার ব্যায়ভারও তাদেরই বহন করতে হচ্ছে। তারউপর বাবার বাড়ি থেকে কোন টাকা-পয়সা নিয়ে যাইনি। এসব নিয়ে আমাকে দিনরাত কথা শোনায়। বাড়ির সব কাজ আমাকেই করতে হয়। তিনজন কাজের মেয়ে ছিল। তাদের দুইজনকে বিদায় করে দিয়েছে। ঐ দুইজন মেয়ের কাজ আমার করতে হয়। কাজ করলেই তবে খেতে পাই। ” দৃষ্টি ডুকরে কেঁদে উঠে।
কায়েস অবাক হয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে।
যেই মেয়ে কখনো এক গ্লাম পানি ঢেলে খায়নি, আজ তাকে কাজের মেয়ের মত খাটতে হয়! একজন বাবা হিসেবে নিজেকে ব্যর্থ মনে হচ্ছে আজ। সে সন্তানকে মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারেনি। তাই তার সন্তানের আজ এই দশা।
” আমি তোকে চেয়ারম্যান বাড়িতে আর পাঠাবনা, মা। তুই আবার স্কুলে যাবি। এসএসসি পাশ করে, ঢাকায় ভর্তি হবি। তোকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে, দৃষ্টি। ”
” না আব্বু, এটা হয়না। আমি এখানে একবারে চলে আসলে, আরেকবার চারদিকে ছিহ্ ছিহ্ রব পরে যাবে। আবারও তোমাকে অনেক অপমান সইতে হবে। আর আমি চাইলেও স্বাভাবিকভাবে জীবনযাপন করতে পারবনা। তাছাড়া আমি চাইনা আমার জন্য তোমরা আবার অ’প’মা’নি’ত হও। এছাড়াও আরও কিছু সমস্যা আছে। ”
” আর কি সমস্যা আছে! আমাকে সব খুলে বল, দৃষ্টি। আমি বাবা হয়ে, তোকে অনুরোধ করছি। ”
দৃষ্টি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর মুখ খোলে।
” আব্বু, আমি চলে আসলে ওরা খুব রে’গে যাবে। তুমি ওদেরকে জানোনা। আমার শ্বশুর নিজের সম্মান বাঁচাতে যতদূর প্রয়োজন যেতে পারে। ”
” মানছি তোর শ্বশুরের লা’ঠি’র জোর আছে। তবে তোর বাবারও জোর কিছু কম নেই। তুই চাইলে আমি ওদের ব্যবস্থা নিতে পারি। আমি চাইনা আমার মেয়ে চেয়ারম্যান বাড়িতে পঁ’চে ম’রু’ক। ” কায়েস রে’গে গেছে।
” আব্বু, তুমি একটু বোঝার চেষ্টা কর। আমি আম্মুর সাথে এসব আলোচনা করিনি। কারন আমি ভালো করেই জানি আম্মু সব শুনলে তুলকালাম কান্ড বাঁধাবে৷ তুমিই একমাত্র আমাকে বাঁচাতে পার। ” দৃষ্টি অনুনয় করছে কায়েসকে৷
“তুই যখন আমার কথা শুনবিইনা, তখন আর কি করার। আমাকে কি করতে হবে বল। মেয়ের বিপদে তার পাশে থাকবনা, এমন বাবা আমি নই। ”
” বাবা, তোমার জামাই একটা ব্যবসা শুরু করতে চাচ্ছে। আমার শ্বশুরের একটা স মিল আছে। তোমার জামাই সেখানে কিছু টাকা খাটিয়ে, ব্যবসাটা নিজের নামে দাঁড় করাতে চাচ্ছে৷ কিন্তু আমার শ্বশুর কোন টাকা দিবেনা। তুমি যদি টাকাটা দিতে, তাহলে ও ব্যবসাটা শুরু করতে পারত। আর আমাকেও ঐ বাড়িতে কোন ক’টু কথা শুনতে হতনা। ”
কায়েস অবাক হয়ে মেয়ের দিকে তাকায়। তার এই ছোট মেয়েটাও সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখতে শিখে গেছে! সংসারে নিজের প্রাধান্য রাখতে গিয়ে বাবার কাছে হাত পাততে একটুও লজ্জা পাচ্ছেনা! নাকি ভেতরে ভেতরে লজ্জা পাচ্ছে! যা প্রকাশ করতে চাইছেনা।
” কত টাকা লাগবে? ” স্তিমিত গলায় জিজ্ঞেস করে কায়েস।
” ছয় লাখ হলেই চলবে। ”
” ছয় লাখ! এত টাকা আমাকে দিতে হবে! ”
” আব্বু, তোমার দো’হা’ই লাগে। আমার সংসারটা ভে’ঙে যেতে দিওনা৷ আর কখনোই তোমার কাছে কিছু চাইবনা। এটাই প্রথম, আর এটাই শেষ। ” দৃষ্টি কিছুতেই কান্না থামাতে পারছেনা।
” কাঁদিসনা, মা। আমি তোর ফুপুর সাথে কথা বলে দেখি। দেখছি কতটুকু কি করতে পারি। ”
” প্লিজ আব্বু, তুমি ফুপুকে কিছু বলোনা। ফুপু জানলে কিছুতেই টাকা দিতে দিবেনা। ”
” আচ্ছা, তুই বাড়ির ভেতর যা। আমি দেখছি। ”
দৃষ্টি বাড়ির ভেতর প্রবেশ করলে, কায়েস চিন্তায় অস্থির হয়ে যায়। এতটুকু বয়সেই তার মেয়েটাকে সংসারের রাজনীতির মাঝে জড়িয়ে পরতে হয়েছে।
অনেক ভেবেচিন্তে কায়েস ফোন করে বড় বোনকে৷ আফরোজা নাজনীন ফোন রিসিভ করলে, তাকে সালাম দেয় কায়েস। এরপর ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করে৷ দুই ভাই-বোন কিছুক্ষণ কথা বলার পর, কায়েস সুযোগ বুঝে দৃষ্টির বিষয়ে আলোচনা করে। আফরোজা নাজনীন সেসব শুনে শিউরে ওঠেন।
” কায়েস, একবার যদি সবুজকে টাকা দিস, পরে ওর মনে লোভ জন্মাবে। আর বারবার এমন করতেই থাকবে। কিন্তু আবার দৃষ্টির দিকটাও দেখা দরকার। মেয়েটা কষ্টে আছে শুনে বুকের ভিতর দু’ম’ড়ে মু’চ’ড়ে যাচ্ছে। কত আদরের মেয়ে আমাদের। ”
” আমি কি করব, আপা? মেয়েটার মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছেনা। গায়ের রং কালো হয়ে গেছে। শুকিয়ে গেছে অনেকটা। ”
” আচ্ছা শোন। এত চিন্তা করিসনা। এখন টাকাটা দিয়ে দে। তবে দেয়ার সময় ঐ ছেলেকে বলবি, ভবিষ্যতে তুই আর একটা টাকাও ওকে দিবিনা। আর দৃষ্টিকে বলবি, এরপর ওরা দৃষ্টির সাথে কোন অন্যায় করলে তুই ব্যবস্থা নিবি। ওদের ছেড়ে কথা বলবিনা। এটা ঐ ছেলেকেও জানাবি। আর তুই কখনোই ওদের কাছে নিজেকে দূর্বল হিসেবে ধরা দিবিনা৷ এরপর থেকে আমাদের সবসময়ই দৃষ্টির খোঁজখবর রাখতে হবে। মেয়ে ভুল করেছে তাই বলে তাকে দূরে ঠেলে দিব এটা হতে পারেনা। ”
কায়েস বোনের সাথে কথা বলে স্বস্তিবোধ করে৷
পরদিন সকালে কায়েস শিহাবকে নিয়ে ব্যাংকে যায়। ছয় লাখ টাকা তুলে নিয়ে আসে।
দুপুরের খাবার পর সবুজের সামনে দৃষ্টিকে ডেকে ওর হাতে টাকা তুলে দেয় কায়েস। আর দৃষ্টিকে সাবধান করে দেয়, যাতে ঐ বাড়ির কেউ কোন ক’টু কথা বললে সাথে সাথে যেন তাকে জানায়। প্রয়োজনে সে ব্যবস্থা নিবে। কায়েসের কথা শুনে সবুজ ভেতরে ভেতরে ভরকে যায়। ও ভালোই বুঝতে পারছে, সামনের যা ঘটবে তার কিছুই সহজ হবেনা।
টাকা হাতে পেয়েই সবুজ আর দেরি করেনা। দৃষ্টিকে নিয়ে চলে নিজের বাড়ি।
চলবে…#বিন্দু_থেকে_বৃত্ত
#পার্ট_৩৪
জাওয়াদ জামী
ফোনের শব্দে ঘুম ভাঙ্গলো কুহুর। ঘুমঘুম চোখে রিসিভ করে ফোন। অপরপ্রান্তে কে রয়েছে তা দেখলনা।
” আসসালামু আলাইকুম। ”
” ওয়ালাইকুমুসসালাম। এখনো ঘুমিয়ে আছিস, মা? ”
বাবার আওয়াজ পেয়ে সজাগ হয়ে গেছে কুহু।
” বাবা, তুমি! কেমন আছো, বাবা? তোমার শরীর ঠিক আছে? ” একসাথে প্রশ্নগুলো করে কুহু৷
” আমি ঠিক আছি, মা। তোকে কতদিন দেখিনা। সেইযে আমাকে রেখে গেলি, আর আসলিনা। তোকে দেখবার জন্য মনটা ছ’ট’ফ’ট করছে। ”
” আমি বাড়িতে কয়েকদিনের মধ্যেই যেতে চাচ্ছিলাম। পরীক্ষা শুরু হলে, আর যেতে পারবনা। তাই ভেবেছি পরীক্ষার আগেই তোমাকে দেখে আসব। শিহাবকে কতদিন দেখিনি। ও ভালো আছে, বাবা? ”
” হ্যাঁ, মা, ও ভালো আছে। তুই কবে আসবি? কার সাথে আসবি? ”
” সিক্তা বারবার যেতে চাচ্ছিল। এবার ওকে নিয়েই যাব। কালকে ক্লাস করেই, বুধবার রওনা দিব। ”
” তুই এই কয়টা দিন ফুপুর কাছেই থাকতি। পড়াশোনাও ভালো হত। তিনবেলা নিয়মিত খেতে পারতি। ”
” ফুপু, খাবার রান্না করে দিয়েছে। বুধবার পর্যন্ত অনায়াসে চলে যাবে। তাই খাওয়ার সমস্যা হয়না। ”
” বুধবার সকাল সকাল রওনা দিস, মা। আর এসেই যাওয়ার কথা বলবিনা। কয়েকটা দিন থাকবি। আসার সময় বই নিয়ে আসবি। ”
” আচ্ছা, বাবা। এবার গিয়ে কয়েকদিন থাকব৷ তুমি সাবধানে থেক। নিয়ম করে ঔষধ খেও। এখন রাখছি, বাবা। ”
” আচ্ছা, মা। তুই ঠিকমত খাওয়া-দাওয়া করিস। ”
বাবার সাথে কথা বলে কুহুর মন প্রশান্তিতে ছেয়ে যায়। গ্রামে যাওয়ার জন্য অপেক্ষার প্রহর গুণতে থাকে।
তাহমিদ সেই কখন থেকে কুহুর কোচিংয়ের পাশের দোকানে বসে আছে। তবুও মেয়েটার দেখা নেই। গত চারদিন সে ঢাকায় ছিলনা। মেয়েটাকে চারদিন ধরে দেখেনি। ওকে একনজর দেখার জন্য তাহমিদের বুকের ভিতর হা’হা’কা’র করছে। কিন্তু সেই মেয়ের আসার নামই নেই।
” এই মেয়েটাও না। এতক্ষণ কেন আসছেনা। ” নিজের সাথে কথা বলছে তাহমিদ। তখনই ওর চোখ যায় রাস্তার ওপাশে।
হালকা গোলাপি রঙের থ্রি পিস আর মাথায় হিজাব বাঁধা কুহুকে অপলক নয়নে দেখছে তাহমিদ। কুহু কোনদিকে না তাকিয়ে সোজা রাস্তা পার হয়ে কোচিং-এর দিকে হাঁটছে।
তাহমিদ কুহুকে দেখেই উঠে, এক দৌড়ে এসে দাঁড়ায় কুহুর সামনে।
এভাবে হঠাৎ নিজের সামনে কাউকে দেখে ঘাবড়ে যায় কুহু। সামনের আগন্তুকের দিকে তাকাতেই তাহমিদকে দেখল। কিন্তু কুহুর দাঁড়াবার উপায় নেই। অলরেডি দশ মিনিট লেট হয়েছে। তাই কুহু কিছু না বলে কোচিং-এর গেইটের দিকে পা বাড়ায়। কিন্তু তখনই ওর হাত ধরে ফেলে তাহমিদ।
” একটু দাঁড়ালে কি হয়! কিছুক্ষণ পর যাও। আগে ভালো করে দেখে নেই। চারদিন ধরে এই মুখটা দেখিনি। আমার বুকের বাঁ পাশ এই চারদিন থেকে থমকে আছে। আগে তাকে স্বাভাবিক হতে দাও। একদিন দেরি হলে ক্ষতি কি? যে দেরিতে একজন প্রেমিকের ব্যাকুল হৃদয় জুড়ায়, তাকে দেরি বলেনা, তাকে বলে প্রেম প্রস্ফুটিত ক্ষন। যে ক্ষনে শুধু ঝাঁক বেঁধে প্রেমেরা প্রষ্ফুটিত হয়। যে প্রেমের কোন তল নেই। এই অতল প্রেমের প্রস্ফুটনে আমি গর্বিত হতে চাই৷ ”
তাহমিদের কথা শুনে কুহুর শরীর জুড়ে উতলা হাওয়া দোল দেয়। যে হাওয়ার প্রতিটি কনায় শুধু তাহমিদের নাম। সেই নাম যেন ছুঁয়ে দেয় কুহুর শ্যামলা শরীরের আনাচকানাচে। সেই সাথে হাওয়া যেন জানান দিচ্ছে, সামনে দাঁড়ানো এই পুরুষ একান্তই তোর। তোর মনের এমনি শরীরের অধিপতিও একমাত্র সে-ই। সময় যেন থমকে গেছে আজকের এই ক্ষনে।
কুহুর বুক শু’কি’য়ে চৌ’চি’র। আজব তো, একটু আগেই মেয়েটা প্রানভরে পানি পান করেই এসেছে। তবুও এখন কেন এত পিপাসা পেয়েছে! কেন যেন মনে হচ্ছে দুনিয়ার সমস্ত সরোবরের পানিতেও এই পিপাসা মিটবেনা। ফুলতলার পদ্ম বিলের পানিও এই পিপাসার কাছে নস্যি।
” পানি খাব। ” ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলে কুহু। ও হাঁপাচ্ছে। বড্ড ক্লান্ত লাগছে শরীর। দাঁড়িয়ে থাকা দায় হয়ে গেছে।
তাহমিদ কুহুর কথা শুনেই দৌড়ে দোকান থেকে মিনারেল ওয়াটারের বোতল নিয়ে আসে। ছিপি খুলে এগিয়ে দেয় কুহুর দিকে। কুহু তাহমিদের হাত থেকে বোতল নিয়ে এক চুমুকেই অর্ধেক পানি শেষ করে।
তাহমিদ ঠোঁট কামড়ে চিন্তা করছে এই মেয়ের হলোটা কি! এমন অস্থির লাগছে কেন?
কুহু বোতল এগিয়ে দিলে তাহমিদ সেটা নিয়ে, ছিপি লাগিয়ে পুনরায় কুহুকে দেয়৷
” এখন ক্লাসে যাও। আজকের মত আপাতত এতটুকু দেখাতেই সন্তুষ্ট থাকি। পরে মন ভরে দেখব। ” কথা বলতে বলতে কুহুর হাতে একটা প্যাকেট ধরিয়ে দেয় তাহমিদ।
কুহু মুখ ফুলিয়ে নিশ্বাস নেয়। হনহন করে ঢুকে যায় কোচিং-এ। মনে মনে হাজারটা গা’লি দিচ্ছে তাহমিদকে।
” ব’দ লোক। তার দেখা শেষ, এবার কুহু তোর প্রয়োজনও শেষ। সে সবসময়ই বলবে কিন্তু আমার থেকে কিছু শোনার প্রয়োজন তার নেই। ” গোপন গালির মাঝেই কুহুর চোখ যায় প্যাকেটের দিকে। কি আছে এতে?
তাহমিদ বাসায় আসলে তাহমিনা আক্তার ওকে জানান, কুহু আর সিক্তা ফুলতলা যাবে বুধবার। তাহমিদ ভালোমন্দ কিছুই বলেনা।
রাতে তাহমিদ আনানের কাছে ফোন দেয়।
আনান ফোন রিসিভ করে। সে কোন কথা বলার আগেই তাহমিদ কথা বলে।
” তুই কি জানিস, তোর দুই বোন ফুলতলা যাচ্ছে? ”
” তোমার প্রশ্নের উত্তর পরে দিব। তার আগে বল, তুমি আমাকে কেন সালাম দিলেনা? বউয়ের বড় ভাই হিসেবে এ্যাটলিষ্ট এতটুকু সম্মান পেতেই পারি। এবার আসি তোমার প্রশ্নের উত্তরে। আর সেটা হল, আমি জানিনা। কে বা কারা ফুলতলা যাচ্ছে। ”
” কানের নিচে একটা দিলেই, সব ত্যা’ড়া’মি হাওয়ায় মিশবে। বউয়ের বড় ভাই সম্পর্ক হয়েছে পরে, তার আগে তুই আমার জুনিয়র কাজিন বুঝলি? এখন ভালো করে শুনে রাখ। বুধবার কুহু আর সিক্তা ফুলতলা যাচ্ছে। আমি চাইনা দুইজন মেয়ে এভাবে এতটা রাস্তা একা যাক। তুই আগামীকাল বিকেলে হোক কিংবা সন্ধ্যায় হোক, এখানে চলে আসবি। ওদের নিয়ে ফুলতলা তুই যাবি। আর হ্যাঁ কিছুতেই বড়দের বলবিনা যে আমি তোকে যেতে বলেছি। তুই বলবি, অনেকদিন যাসনি তাই যাচ্ছিস। তার আগে তোর বোনকে ফোন দিয়ে কথা বল। ”
” বাহ্ বাহ্ কি সুন্দর সলিউশন দিলে! একবারও জানতে চাইলেনা আমি যেতে চাই কি না! ”
” তোর মতামত জানার কি আছে? বড় ভাই হিসেবে বোনদের প্রটেকশনের দ্বায়িত্ব তোরই পালন করতে হবে, এটাই নিয়ম। অবশ্য বউটা আমার হয়ে গেলে, তোকে তেল মা’রা’র প্রয়োজন পরতনা। ”
” আচ্ছা, আমি কাল সন্ধ্যায় আসব। ” আনানের মুখ কালো হয়ে গেছে তাহমিদের কথা শুনে।
” এজন্য তোর একটা ট্রিট পাওনা রইল। চলে আসিস কাল। ”
তাহমিদ ফোন রাখলে আনান কিছুক্ষণ অবাক হয়ে ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকে।
” আজিব মানুষ! একটাবারও জিজ্ঞেস করলনা আমি কেমন আছি! সব সময়ই তার মন খালি বউ বউ করে! বিয়ে না হতেই এমন অবস্থা! ”
কুহু হোস্টেলে ফিরে কিছুক্ষণ মটকা মেরে শুয়ে থাকে। ওর কানে শুধু তাহমিদের বলা কথাগুলোই ভাসছে। প্যাকেটের কথা মনে হতেই উঠে বসে। প্যাকেটটা হাতে নিয়ে ভালোভাবে পর্যবেক্ষন করে। র্যাপিং পেপারে মোড়ানো থাকায় বোঝা যায়না ভেতরে কি আছে। এরপর আগ্রহ নিয়ে খুলতে থাকে।
প্যাকেটের ভেতরটা উন্মুক্ত হতেই কুহুর চোখদুটো রসগোল্লার আকার ধারণ করে।
তিনটা মনিপুরী হ্যান্ডলুম শাড়ি, মনিপুরী হ্যান্ডলুম থ্রী পিস, মনিপুরী শাল, মনিপুরীদের তৈরি পার্স, হাতব্যাগ, হিজাব । শাড়ি থ্রী পিসের কালারের সাথে মিলিয়ে কানের দুল, চুরি, কয়েক জোড়া জুতা। এ যেন ছোটখাট দোকান! কুহু ভাবছে, মানুষটা এতটাই শৌখিন!
শাড়ি, থ্রী পিসগুলোর ভাঁজ ভেঙ্গে দেখছে কুহু। প্রত্যেকটাই অসম্ভব সুন্দর। কি সুন্দর কম্বিনেশন করা কালার! মানুষটার পছন্দ আছে স্বীকার করতে হবে।
দৃষ্টির বাবার বাড়ি থেকে আসার পর থেকেই সবুজের কোন খোঁজ নেই। টাকাগুলো নিয়ে কাঠ কেনার নাম করে সেইযে গেছে, আজ ছয়দিন হয়ে গেছে, বাড়িতে আসার নামগন্ধ নেই। দৃষ্টি ফোন করলে বলে, মিলের কাজে ব্যস্ত তাই আসতে দেরি হচ্ছে। এদিকে দৃষ্টির খুব চিন্তা হচ্ছে। এতগুলো টাকা নিয়ে গেছে, কিছু যদি হয়ে যায়! এদিকে যখন ওর শ্বশুর-শ্বাশুড়ি জেনেছে দৃষ্টির বাবা ছয় লাখ টাকা দিয়েছে, সেদিন থেকে তারা দৃষ্টির প্রতি একটু নমনীয় হয়েছে। আগেরমত কাজ এখন দৃষ্টিকে করতে হয়না।
আটদিন পর রাতে বাড়ি ফিরে সবুজ। এসেই দৃষ্টিকে জানায় মিল চালু করতে যা যা প্রয়োজন সব ঠিক করে এসেছে। দৃষ্টি সবুজের কথা শুনে খুব খুশি হয়। অবশেষে এই বাড়িতে নিজের অধিকারবলেই থাকতে পারবে।
কিন্তু দৃষ্টি জানেনা, তার জন্য নিয়তি অন্য খেলা সাজিয়ে রেখেছে। যে খেলার নিয়ন্ত্রক শুধুমাত্রই সবুজ।
চলবে…