#বিন্দু_থেকে_বৃত্ত
#পার্ট_৪৯
জাওয়াদ জামী
তাহমিদ ওর বড় চাচ্চুকে ফোন করে সবটা জানিয়েছে। সব শুনে তিনি তার এসপি বন্ধুকে ফোন করেছেন। তাকে বলেছেন, পুলিশ যেন খুব তারাতারি এসে, ঠিকমত তদন্ত করে।
শিউলি আক্তার বারবার মূর্ছা যাচ্ছে। আনান তাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেছে।
তাহমিদ দৃষ্টির দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারছেনা। মেয়েটার চোখেমুখে বেদনার ছাপ স্পষ্ট। চোখের কোন দিয়ে পানির শুকনো রেখা বোঝা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে মেয়েটা মৃ’ত্যু’র আগে অনেকক্ষণ যাবৎ কেঁদেছে।
তাহমিদ অনেক কষ্টে দৃষ্টির থেকে চোখ ফেরায়। ধীরেসুস্থে কায়েসের পাশে যেয়ে বসে। হাত রাখে কায়েসের কাঁধে।
কায়েস ঘাড় ঘুড়িয়ে তাহমিদের দিকে তাকিয়ে হুহু করে কেঁদে উঠে।
একজন সন্তানহারা পিতাকে সান্তনা দেয়ার উপায় তাহমিদের জানা নেই। সে কায়েসকে কিছু না বলে শুধু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।
আফরোজা নাজনীন তাহমিদের ফোন পাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই কুহু, তাহমিনা এবং সানাউল রাশেদিনের সাথে ফুলতলার দিকে রওনা দেন।
যাবার পথে তারা শাহনাজ সুলতানা ও তার স্বামীকে নিজেদের সাথে নিবেন।
নাজমা পারভিন তার স্বামীসহ রওনা দিয়েছেন।
তাহমিদ তাদের কিছুই জানায়নি। শুধু খুব তারাতারি ফুলতলা যেতে বলেছে।
কিন্তু আনান ওর মায়ের কাছে ফোন করে সবটা জানিয়েছে। আর শাহনাজ সুলতানা ফোন করে বোনদের জানিয়েছে। তাই তারা সবাই মিলে রওনা দিয়েছেন।
আফরোজা নাজনীন কাঁদছেন। কুহু ঘটনা শোনার পর থেকেই মাঝেমধ্যে কাঁদতে কাঁদতে জ্ঞান হারাচ্ছে।
তাহমিনা আক্তার হিমশিম খাচ্ছেন দুইজনকে সামলাতে।
শাহনাজ সুলতানা বড় বোনের সাথে মিলিত হওয়ার পর তারা একদফা কাঁদলেন। হাজার হোক দৃষ্টি তাদের ভাইয়ের মেয়ে। ছোট মেয়েটা আবেগের বশে ভুল পথে পা বাড়ালেও, তারা দৃষ্টিকে দূরে ঠেলে দেননি।
আজ পথ যেন শেষ হচ্ছেনা। আফরোজা নাজনীন ছটফট করছেন বাপের বাড়ি যাওয়ার জন্য। তিনি অস্থিরচিত্তে শুধু গাড়ির জানালার বাইরে তাকাচ্ছেন। শাহনাজ সুলতানা বারবার ড্রাইভারকে জোরে গাড়ি চালাতে বলছেন।
কুহু নিস্তেজ হয়ে তাহমিনা আক্তারের কাঁধে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে আছে।
তাহমিনা আক্তার ছেলের জন্য চিন্তা করছেন। তার ছেলেটা এই অবস্থায় কিভাবে সবাইকে সামলাচ্ছে!
আনান শিউলিকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে, তার পাশে শিহাবকে রেখে, সে তার নানুর ভাইয়ের বাড়িতে তাদের দুঃসংবাদটা জানাতে যায়।
আনানের কাছ থেকে খবর পেয়ে ওর নানুর ভাইয়ের ছেলেরা, তাদের স্ত্রীরা সবাই ছুটে আসে।
শিউলির সাথে তাদের সম্পর্ক ভালো না হওয়ায় তারা কেউ এ বাড়িতে আসেনা। তবে কায়েসের সাথে তাদের সম্পর্ক খুব ভালো। কিন্তু আজ দুঃসংবাদটা শোনার পর তারা কেউই শিউলির ওপর রাগ করে থাকেনা।
কায়েসের চাচাতো ভাইয়েরা এসে দৃষ্টিকে এই অবস্থায় দেখে শিউরে ওঠে।
তারা দৃষ্টিকে নিচে নামাতে চাইলে তাহমিদ নিষেধ করে। সে সবাইকে বলে, ব্যাপারটা পুলিশ এসেই দেখবে৷
পুলিশ এসে সাথে সাথেই তাদের কাজ শুরু করে দেয়। তারা দৃষ্টিকে নামিয়ে পোষ্ট ম’র্টে’মে’র জন্য পাঠিয়ে দেয়। আর দুই-তিনজন মিলে দৃষ্টির রুম চেক করে। চেকিংয়ের এক পর্যায়ে তারা দুইটা চিঠি পায়। কায়েসকে সেগুলো দেখালে সে নিশ্চিত করে, এটা দৃষ্টির লিখা।
আফরোজা নাজনীনরা যখন ফুলতলা এসে পৌঁছায়, তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়েছে।
পুরো বাড়ি লোকে লোকারন্য। গাড়ি থেকে বেরিয়েই তারা দুই বোন প্রায় দৌড়ে বাড়ির ভেতরে ঢোকেন। কুহুও ফুপুদের পিছুপিছু যায়।
উঠানে পা রাখতেই নজর যায় কায়েসের দিকে। সে কুহুর ঘরের বারান্দায় বসে আছে তার পাশে চাচাতো ভাইয়েরা বসে আছে।
বোনদের দেখে কায়েস ডুকরে কেঁদে ওঠে।
শিউলি সেই অনেকক্ষণ আগেই জ্ঞান হারিয়েছে। তাহমিদ প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়েছে, কিন্তু তার জ্ঞান এখনো আসেনি।
দৃষ্টির লা’শ বিকেলেই গ্রামে পৌঁছে যায়। দা’ফ’নে’র সব ব্যবস্থা আগেই করে রাখা হয়েছে।
মেয়ের লা’শ দাফন হলো, অথচ শিউলি শেষবারের মত মেয়েকে দেখতে পায়না। শেষবারের মত মেয়েকে ছুঁয়ে দেখার সৌভাগ্য হয়নি তার।
সানাউল রাশেদিন তার এসপি বন্ধুর সাথে কথা বলে, দৃষ্টির লিখা চিঠিগুলো বাড়িতে নিয়ে আসেন।
একটা চিঠি দৃষ্টি তার বাবা-মা’ কে লিখেছে। আরেকটা লিখেছে কুহুকে।
সানাউল রাশেদিন একটা চিঠি কায়েসকে আরেকটা কুহুকে দেন। কুহু চিঠিটা হাতে নিয়ে গুম হয়ে বসে থাকে।
কায়েস কাঁপাকাঁপা হাতে চিঠি খোলে। কি লিখেছে তার মেয়ে!
”
প্রিয় আব্বু,
আমি চলে যাচ্ছি। তুমি কষ্ট পেওনা কেমন? তোমার মেয়ে খুব খারাপ। ভুল মানুষকে ভালোবেসে আজ তোমার মেয়ে নিজেকেই শেষ করে দিচ্ছে। আমাকে মাফ করে দিও, আব্বু। আমি তোমার স্বপ্ন পূরন করতে পারিনি। আমার জন্য তোমাকে সমাজের মানুষের কাছে ছোট হতে হয়েছে। বিশ্বাস করো আব্বুু, আমি সত্যি এই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে চেয়েছি। কিন্তু সবুজ সেটা হতে দিলনা।
জানো আব্বু, আজকাল আমার এই অধঃপতনের জন্য আম্মুকে দায়ী করতে মন চায়। আম্মু যদি আমাকে প্রথমেই শাসন করত, তবে আমি ভুল পথে পা বাড়াতামনা। আম্মু আমাকে শাসন না করে, সবুজের দিকে ঠেলে দিয়েছে। আমিও তখন ভেবেছিলাম, এটাই বোধহয় ঠিক। তাই তোমার সাথে দূর্ব্যবহার করতে আমার একটুও বুক কাঁপেনি। কিন্তু বিয়ের কয়েকদিন পর থেকে বুঝতে পেরেছি, আমি ভুল ছিলাম। প্রতিনিয়ত শ্বাশুড়ির কটুকথা, অপমান সহ্য করতে হয়েছে। আর তখনই আমার বোধ হয়েছে, আমি কত বড় ভুল করেছি। আব্বু, তুমি তোমার এই অসহায় মেয়েকে ক্ষমা করে দিও। আজ যদি আমি এই সিদ্ধান্ত না নিতাম, তবে তোমার দিকে সমাজের মানুষেরা আঙুল তুলত। তোমাকে দেখে বলত, ঐ যে দেখ, কলঙ্কিনীর বাবা যাচ্ছে। কোথায় কি আকাম-কুকাম করে আসছে, যেগুলো আমরা দেখছি। আব্বু, সবুজ লিংকটা ভাইরাল করে দিত। আমি তখন সবাইকে মুখ দেখাতাম কেমন করে! সবুজ আমাকে হুমকি দিয়েছে, আমি যদি তার বাড়িতে না যাই, মামলা তুলে না নিই, ওর মা’কে জেল থেকে বের না করি, তবে সে লিংক ভাইরাল করে দিবে। আমার কাছে আর কোন রাস্তা ছিলনা, আব্বু। আমি জীবন দিব, তবুও সবুজের কাছে আর ফিরবনা। তোমরা সবুজকে ছেড়ে দিওনা, আব্বু।
আম্মু,
আমি চলে যাচ্ছি। তোমার কাছে আমার ছোট ভাই, আর আপুকে রেখে গেলাম। তুমি আপুকে আর দুরছাই করোনা। আপুটা আমার ভালোবাসার কাঙাল। তুমি তাকে একটু ভালোবাসা দিও, বিনিময়ে সে তোমাকে এক সমুদ্র সম্মান দিবে। তার সত্যিকারের মা হয়ে দুনিয়াকে দেখিয়ে দিও, সৎমায়েরা সব সময় খারাপ হয়না। তাহমিদ ভাইয়া খুব ভালো মানুষ। তুমি আপুকে ভালোবাসলে, ভাইয়াও তোমাকে মায়ের মতই সম্মান করবে।
আম্মু, শিহাবকে আমার মত করে মানুষ করোনা। তাকে একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলো। দেখবে তোমার ছেলে-মেয়ে তোমাকে নিরাশ করবেনা। তখন হয়তো তুমি ভুলেই যাবে দৃষ্টি নামে তোমার একটা মেয়ে ছিল।
আম্মু, নিজেকে পাল্টাও। মনে হিং’সা, রা’গ পুষে রেখনা। আমার ফুপুদের সম্মান করো। দেখবে তারা তোমাকে মাথায় তুলে রেখেছে।
আমি চলে যাচ্ছি, আম্মু। তোমার এই অযোগ্য মেয়েকে মাফ করে দিও। ”
দৃষ্টির চিঠি পড়ে কায়েস হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। তার মেয়েটা যে কতটা মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে এই চিঠি লিখেছে, সেটা ভাবতেই তার কলিজা ফেটো যাচ্ছে।
আনানের কথায় কুহু তার জন্য লিখা দৃষ্টির চিঠির ভাঁজ খোলে।
”
আপু,
তোমার এই অপরাধী বোন আজ কিছু বলতে চায়৷ আমি আর আম্মু মিলে তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। কিন্তু আমার নিয়তি দেখ, তোমাকে যত কষ্ট দিয়েছি, তার কয়েকগুণ কষ্ট আল্লাহ আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছেন। তুমি মনে কোন কষ্ট রেখনা। আমার আম্মুকে মাফ করে দিও। আমি চলে গেলে তাকে দেখার মত কেউ থাকবেনা। আব্বুও আম্মুর সাথে কথা বলেনা। এমনকি শিহাবও আম্মুর থেকে দূরে থাকে। আমার আম্মু এই বাড়িতে পরবাসীর ন্যায় বাস করে। তুমি আমার আম্মুকে ভালোবাসা দিয়ে আমার শূন্যস্থান পূরন করো।
আপু, আমি যে কারনে আজ নিজেকে শেষ করে দিচ্ছি, সেই ভিডিওর ব্যাপারে কিছুই জানতামনা।
নিজের স্বামীর ঘরে, বাবার বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়া বিছানায় স্বামীর সাথে ঘনিষ্ঠ হয়েছিলাম। কিন্তু আমার জঘন্য স্বামী যে, সেই অন্তরঙ্গ মুহূর্ত গোপনে ধারন করেছে, তা আমার জানা ছিলনা। এই ভিডিওকে সেই তার হাতিয়ার বানিয়েছে তা আমি ঘুনাক্ষরেও টের পাইনি। সকালে যখন ভিডিওটা আমি দেখলাম, লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছিল। বারবার মনে হচ্ছিল, আমার আত্নীয়দের কেউ এসব দেখলে, আমি তাদের সামনে যাব কেমন করে? সবাই আমাকে ছি ছি করবে। আমার সামনেই আমাকে নিয়ে হাসবে। আমাকে ঘৃণা করবে। এসব ভেবেই সিদ্ধান্ত নিলাম, এই দুনিয়ার মেয়াদ আমার শেষ হয়েছে।
আমি যেদিন জেনেছিলাম, সবুজ তোমার সাথেও অসভ্যতা করতে চাইছিল, সেদিন থেকে তাকে আমি মনে প্রানে ঘৃণা করি। সে তার বাবার সাথে মিলে আম্মুর কাছ থেকে শোরুম, জমি লিখে নিয়েছে। আম্মুর গহনা চুরি করেছে। দিনে দিনে আম্মুর কাছ থেকে অনেক টাকা নিয়েছে। তার বাড়িতে আম্মু অনেক কিছু দিয়েছে। তবুও সে আমার এত বড় ক্ষতি করল।
তোমরা ওকে ছেড়ে দিওনা, আপু। ওর কৃতকর্মের শাস্তি ওকে দিও।
আমার ভাইটাকে দেখে রেখ। আব্বু ভিষণ ভেঙে পরবে। তাকে সামলে রেখ।
তোমার সংসারে সুখেরা ভেসে বেড়াক। অনেক আশা ছিল তোমার ছেলে-মেয়ে হলে আমি তাদের নাম রাখব। তা আর হলোনা।
তাহমিদ ভাইয়াকে বলো, তার আসার অপেক্ষা আমি করতে পারলামনা। সবুজ আমাকে অপেক্ষা করতে দিলনা।
তোমাদের থেকে চিরবিদায় নিলাম। তোমরা সবাই ভালো থেক। ”
দৃষ্টির চিঠি পড়ে কুহু নিজেকে ধরে রাখতে পারলনা। চিৎকার করে কেঁদে উঠে। কেউ ওকে থামাতে পারছেনা। একপর্যায়ে জ্ঞান হারায় সে।
তাহমিদ ওকে কোলে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেয়৷
আনান ও তাহমিদের ছেলেরা হন্যে হয়ে সবুজকে খুুঁজছে।
পুলিশও থেমে নেই। কিন্তু সবুজ যেন হঠাৎই হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে।
চলবে…#বিন্দু_থেকে_বৃত্ত
#পার্ট_৫০
জাওয়াদ জামী
দৃষ্টির লিখা চিঠি পড়ে সবাই স্তব্ধ। মেয়েটা কত কষ্ট মনে পুষে রেখেছিল!অথচ চলে যাবার আগে
নিজের দ্বায়িত্ব পালন করতে ভোলেনি। পরিবারের সবার জন্য চিন্তা করেছে মৃ’ত্যু’র আগ পর্যন্ত।
শিউলির কোন হুঁশ নেই। সে একবার হাসছে তো আরেকবার কাঁদছে। কুহু তার কাছে গেলে, সে দৃষ্টি ভেবে কুহুকে জড়িয়ে ধরছে।
কায়েসের চাচাতো ভাই এসে। যিনি এসপি পদে কর্মরত। তিনি সানাউল রাশেদিনের সাথে কথা বলছেন। সানাউল রাশেদিন তার এসপি বন্ধুকে ফোন করে কথা বলেছেন। তিনি জানিয়েছেন, সবুজ লাপাত্তা। পুলিশ ফোর্স তাকে খুঁজে চলেছে।
কায়েসের চাচাতো ভাই থানায় গিয়ে কথা বলে এসেছেন।
তাহমিদ ও আনান চিন্তায় অস্থির, এত তারাতারি সবুজ কোথায় গেল! ওরা দুজন আলোচনা করছে, এখন কি করা যায়।
ভেতর থেকে আফরোজা নাজনীন তাহমিদকে ডাকলে, তাহমিদ ভেতরে যায়
কুহু কেঁদেই চলেছে।
তাহমিদ ভেতরে আসলে আফরোজা নাজনীন ওর হাত ধরে কুহুর কাছে নিয়ে আসেন।
” বাপ, মেয়েটা কিছুতেই থামছেনা। এখন পর্যন্ত ওকে খাওয়াতে পারিনি। তুই একটু চেষ্টা করে দেখ, খাওয়াতে পারিস কি-না। ”
” খাবার নিয়ে আস। আমি খাইয়ে দিচ্ছি। বড়মা, তোমরা সবাই খেয়েছ? ”
” সবাইকে খাওয়ানো শেষ। এখন কুহু খেলেই তবে আমি আর নাজমা খাব। ”
” তারাতারি খাবার নিয়ে আস। দুপুর হতে চলল, এখনও তুমি খাওনি! এভাবে চললে তোমার অসুখ বাঁধতে সময় নিবেনা। ”
আফরোজা নাজনীন একটু হেসে খাবার আনতে যায়।
তাহমিদ এসে কুহুর পাশে বসে। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে।
” বউ, এভাবে ভেঙে পরলে চলবে। আমি জানতাম তুমি অনেক সাহসী মেয়ে। নিজেকে কোন অবস্থায়ই দুর্বল করোনি। আজ কেন তুমি ভেঙে পরছ! এখন যখন তোমাকে সবার পাশে থাকতে হবে, তখনই তুমি এমন অবুঝের মত করছ! এবার ওঠ, আমার সাথে চল, ফ্রেশ হবে। এরপর আমি তোমাকে খাইয়ে দিব। ”
” আমার এখন খেতে ইচ্ছে করছেনা। আপনি খেয়েছেন? আমি আপনার খেয়াল রাখতে পারছিনা। ”
” তোমার এখন কিছুই করতে হবেনা। তুমি এখন উঠে ফ্রেশ হয়ে আসবে, চল। ” তাহমিদ জোর করে কুহুকে বিছানা থেকে নামিয়ে, কলপাড়ে নিয়ে যায়। ওকে ফ্রেশ করিয়ে ঘরে নিয়ে আসে।
আফরোজা নাজনীন প্লেটে করে খাবার নিয়ে আসলে, তাহমিদ কুহুকে জোর করে খাইয়ে দেয়।
এরপর কুহুকে নিয়ে কায়েসের কাছে যায়। বাবার কাছে মেয়েকে বসিয়ে দিয়ে বাইরে চলে যায়। ও চাচ্ছে তারা বাবা-মেয়ে কিছুক্ষন একসাথে কথা বলুক। এতে তারা কিছুটা হালকাবোধ করবে।
দুপুরে খাওয়ার পর আনান আর তাহমিদ কুহুর কাছে বসে এটাসেটা গল্প করছে।
” ভাই, আমি চারদিকে খোঁজ লাগিয়েছি, কিন্তু সবুজের কোন পাত্তা নেই। আমি ভাবতেই পারছিনা, রাতারাতি একটা মানুষ কিভাবে হাওয়ায় মিলাতে পারে! ঐ শা’লা না আছে নিজের বাড়িতে, না আছে বন্ধুর বাড়িতে আর না আছে কোন আত্মীয় স্বজনদের বাড়িতে। কোথায় যেতে পারে জা’নো’য়া’র’টা! ”
” ওর এমন কোন আত্মীয় কিংবা বন্ধু আছে যারা এই বিভাগের বাইরে থাকে? যারা ওকে আড়াল থেকে সাহায্য করছে? আচ্ছা এমন হয়নিতো যে ও বর্ডার ক্রস করে ইন্ডিয়া পালিয়ে গেছে? কিংবা যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে? ” তাহমিদ একসাথে বেশ কয়েকটি প্রশ্ন করে।
তাহমিদের কথা শুনে কুহুর কিছু একটা মনে পরে। ও চঞ্চল চোখে তাহমিদের দিকে তাকায়। এবং অস্থিরভাবে বলে উঠে,
” গতবার আমি এখানে এসে দৃষ্টির সাথে অনেক গল্প করেছি। ও কথায় কথায় একবার সবুজের এক বন্ধুর কথা বলেছিল। যার বাড়ি হিলি। সবুজ নাকি প্রায়শই সেখানে যায়। আর তার বন্ধুর সাথে চুরি করে ইন্ডিয়াও গেছে। দৃষ্টিকে নাকি সে বলেছিল, হিলি বেড়াতে নিয়ে যাবে। ”
কুহুর কথা শুনে আনান ও তাহমিদ সোজা হয়ে বসে।
” কুহু, তুই জানিস সবুজের সেই বন্ধুর নাম কি? দৃষ্টি তোকে সেই বন্ধুর নাম বলেছিল? কিংবা আর কিছু বলেছিল? ”
” নাম তো জানিনা, ভাইয়া। তবে দৃষ্টি বলেছিল সেই ছেলের বাবা নাকি সেখানকার ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার। ”
” আনান, এবার আমাদের কাজ হবে সবুজের এখানকার বন্ধুদের ধরে, তাদের থেকে জেনে নেয়া, তার হিলির বন্ধুটি কে। তুই তোর ছেলেদের ফোন দে। সবুজের ঘনিষ্ঠ বন্ধু রাকিব, ওকে ধরতে হবে। তারপর বাকিটা আমি দেখছি। এরপর আমাদের সেখানে যেতে হবে। ”
আনান তাহমিদের কথা শুনে ফোন নিয়ে বাগানে চলে যায়। যেখানে গিয়ে ও কথা বললে কেউ শুনতে পাবেনা।
তাহমিদও কারো সাথে কথা বলে। কুহু শুধু অবাক হয়ে দেখছে, যে ছেলেটার কয়দিন পর পরীক্ষা, সে আজ পড়াশোনা ছেড়ে এখানে পরে আছে।
” আপনি আর কয়দিন এখানে থাকবেন ? পড়াশোনা তো কিছুই হচ্ছেনা। এভাবে চলতে থাকলে পাশ করতে পারবেন? আপনি বরং ঢাকায় ফিরে যান। ” কুহু মোটেও চাচ্ছেনা তাহমিদ এসবের মধ্যে জড়াক।
” যদি মনে কর, তুমি বললেই আমি ফিরে যাব, তবে তুমি ভুল করবে। যে ছেলের জন্য দৃষ্টি সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গেল, যে ছেলে তোমার সাথে খারাপ কিছু করতে চেয়েছে, তাকে আমি ছেড়ে দিব, এটা তুমি কি করে ভাবলে? ”
” তাকে ধরে পুলিশের কাছে দিয়েন। নিজেরা কিছু করতে যাবেননা, প্লিজ। আইন নিজের হাতে নিবেননা। আমাকে কথা দিন। ”
” আমরা কি করব না করব, সেটা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবেনা। তোমার একটাই কাজ, সেটা হল বাবাকে দেখে রাখা। আর আমরা কোথায় যাচ্ছি, কি করছি এসব কাউকে জানাবেনা। তুমি কোন চিন্তা করবেনা। ”
” আপনারা সেখানে যাবেন? আমার ভিষণ ভয় করছে। সবুজ খুব খারাপ ছেলে, ও যদি আপনাদের কোন ক্ষতি করে? ”
” আমি তোমাকে চিন্তা করতে নিষেধ করেছি না?
বউ, তুমি নিশ্চিন্তে থাক। আমি কাজ শেষ করে তোমার কাছে ফিরে আসব৷ ” কুহুর কপালে ভালোবাসার পরশ আঁকে তাহমিদ।
কিছুক্ষণ পর তাহমিদ আর আনান মিলে কোথাও বের হয়ে যায়। সবাই জিজ্ঞেস করলেও কাউকে কিছু জানায়না।
একটা রাইস মিলের আবদ্ধ ঘরে হাত-পা, মুখ বাঁধা অবস্থায় পরে আছে রাকিব। পাশে লা’ঠি হাতে কয়েকজন ছেলে।
তাহমিদ ধীরেসুস্থে রাকিবের কাছে যেয়ে বসে।
চুলের মু’ঠি ধরে উঁচু করে রাকিবকে।
” শোন রাকিব, আমি তোকে কয়েকটা প্রশ্ন করব। যদি সেগুলোর সঠিক উত্তর দিস, তবে তুই বেঁচে থাকবি এটা আমি হলফ করে বলতে পারি। কিন্তু তুই যদি একটাও মিথ্যা কথা বলিস, তবে তোকে মে’রে টুকরো টুকরো করে কে’টে, সারাদেশে ছড়িয়ে দিব। আই সয়্যার, কেউ তোর কোন খোঁজ পাবেনা। ” তাহমিদ রাকিবের মুখের বাঁধন খুলে দেয়।
রাকিবের শরীরে একবিন্দু শক্তি অবশিষ্ট নেই। ওকে বেদম পি’টি’য়ে’ছে তাহমিদ আর আনানের ছেলেরা।
” আমাকে ছেড়ে দেন, ভাই। আমি যা জানি সব বলব। বর্ডারেই সবুজের বন্ধু সিরাজের বাড়ি। ওর বাবার নাম জামাল বেগ। সবুজ এখন সেখানেই আছে। কাল বিকেলেই সে বর্ডার পাড় হবে। আমাকে সবুজ গতকাল ফোন করেছিল। তখনই এসব বলেছে। ” রাকিব হাঁপাচ্ছে।
” শোন, তোকে যে আমরা এখানে এনেছি, তোকে জামাই আদর করেছি, এসব কথা তুই কি কাউকে বলবি? যদি কখনো তোর কাছে পুলিশ আসে, কিছু জিজ্ঞেস করে, তাদেরকে কিছু বলবি? ”
” না, ভাই, আমি মরে গেলেও কাউকে কিছু বলবনা। আমাকে ছেড়ে দেন, ভাই। তৃষ্ণায় বুক ফেটে যাচ্ছে। ”
” এই তোমরা ওকে পানি দাও। আর আমরা সবুজকে খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত ওকে এখানে রাখ। ওর ফোন অন করে রাখ। সবুজ ফোন দিলে, একে কথা বলতে দিবে। কিন্তু দেখবে এ যেন কিচ্ছু না বলে।
কিরে, সবুজ ফোন করলে, তুই আমাদের কথা বলবি? যদি বলিস, সাথে সাথেই তোকে জবাই করবে আমার ছেলেরা।
শোন, রাকিব, সবুজের ফোন তুই রিসিভ করবি। কিন্তু কিছুই বুঝতে দিবিনা। আগামী তিনদিন তুই এখানে থাক। আমরা এই তিনদিনে সবুজের ব্যবস্থা করে এসে তোকে ছেড়ে দিব। এই কয়দিন সুবোধ বালকের ন্যায় থাকবি, বুঝেছিস? ”
রাকিব তাহমিদের কথায় সায় দেয়।
তাহমিদ, আনান আর সাতজন ছেলে মিলে রওনা দেয় হিলির দিকে।
রাকিবের দেয়া ঠিকানা অনুযায়ী ওরা পৌঁছায় সিরাজের গ্রামে।
ওদের সাথের একজন ছেলের ফুপাতো বোনের বাড়ি সেই গ্রামে। ওরা ছেলেটার বোনের বাড়িতে ওঠে।
তাহমিদ সেই বাড়িতে যাওয়ার আগে অনেক কিছু কিনে। কারন ওর জানা নেই তাদের পারিবারিক অবস্থা কেমন। তাই খালি হাতে একটা নতুন বাড়িতে যেতে তার খারাপ লাগছিল৷ সেজন্য আনানকে সাথে নিয়ে কাঁচা বাজার থেকে শুরু করে ফলমূল অনেক কিছু কিনে।
কারন ওদের এখানে একটা দিন থাকতেই হবে। আগে সবুজের খোঁজ নিতে হবে। এরপর সুযোগ বুঝে ওকে তুলে নিতে হবে।
দুইদিন পর ওরা হিলির সেই গ্রাম থেকে বিদায় নেয়।
লা’ঠি’র বা’রি’র চোটে চিৎকার করছে সবুজ। চিৎকার যখন অধিক মাত্রায় শুরু করে, তখন আনান ওর মুখ বেঁধে দেয়।
তাহমিদ ওকে একাধারে মা’র’ছে।
” তোর জন্য দৃষ্টি আর দুনিয়ায় নেই। তুই ওর মায়ের প্রপার্টি নিজের নামে করেছিস, তুই কুহুকে খারাপ নজরে দেখেছিস। মেয়েটার ঘুম হারাম করেছিলিস তুই। এবার বল তোকে আমি কি করব? তুই কি মনে করেছিলি, লুকিয়ে থাকলেই রক্ষা পাবি? তুই হিলি কেন, পাতালে লুকালেও আমি তোকে ঠিকই খুঁজে বের করতাম। হয়তো কিছুদিন দেরি হত। কিন্তু তুই লুকিয়ে বাঁচতে পারতিনা। ” তাহমিদ আজ যেন হিং’স্র হয়ে গেছে। একের পর এক আ’ঘা’ত করছে সবুজের শরীরে।
আনান তাহমিদের এমন রূপ দেখে ভয় পেয়ে যায়। জোড় করে তাহমিদের হাত থেকে লাঠি কেড়ে নেয়। ওকে টেনে দূরে নিয়ে আসে।
” ভাই, এভাবে মারলে কু’ত্তা’টা ম’রে যাবে। ওকে আর মেরোনা। ওকে আমরা যথেষ্ট কেলিয়েছি। এবার ওকে পুলিশে দেই। ঘটনাকে আর বেশি দূর গড়াতে দেয়া যাবেনা। একে একবার পুলিশে দিলে বড় খালু যা ব্যবস্থা করার করবে। ”
” আমার ইচ্ছে করছে একে এখানেই পুঁতে দিতে। একে পুলিশে দিলে বড়জোর কয়েক বছর জেল হবে। পরে জামিনে ঠিকই বেরিয়ে আসবে। আবার নতুন করে শুরু করবে মেয়েদের জীবন নিয়ে খেলা। এটা কিছুতেই হতে দেয়া যায়না। ”
” ভাই, বুঝতে চেষ্টা কর। প্রশাসন যদি জানতে পারে, তুমি একে মে’রে দিয়েছ, তখন কি হবে বুঝতে পারছ? কুহুর জীবন তোমার সাথে জড়িয়ে আছে। মেয়েটা এমনিতেই অনেক কষ্ট সহ্য করেছে, এখন যদি তোমার কিছু হয়, মেয়েটাকে সামাল দিব কেমন করে? ওর দিকে তাকিয়ে হলেও একে পুলিশে দাও। ”
তাহমিদ এক পলক আনানের দিকে তাকায়।
” ঠিকাছে, একে পুলিশেই দিব। তবে আজ নয়। কয়েকদিন পর। আগে এর থেকে সকল এর সকল কুকর্মের স্বীকারোক্তি নিয়ে, তবেই একে পুলিশে দিব। যাতে কেউ একে কখনো জেল থেকে বের করার সাহস না করে। তার আগে একে ইচ্ছামত বানাব। এর হাত-পা ভেঙ্গে প’ঙ্গু বানাব। আর ঘটনা এমনভাবে সাজাব যাতে সবাই ভাবে এই হা’রা’মি অ্যাকসিডেন্ট করেছে। ”
” ঠিক আছে, ভাই। তুমি যা বলছ তাই হবে। তবে এখন বাসায় চল। গত তিনদিন আমরা বাড়ি ছাড়া। সবাই চিন্তা করছে। ”
তাহমিদ আর কথা বাড়ায়না। আনানের সাথে সোজা বেরিয়ে আসে।
বিঃদ্রঃ রোজা রেখে ইবাদত, সংসারের কাজকর্ম করার পর গল্প লিখার সময় হচ্ছেনা। অনেকেই জিজ্ঞেস করছেন গল্প দিচ্ছিনা কেন। আমি বলব আমি চেষ্টা করছি নিয়মিত দিতে। কিন্তু সংসার নামক মায়াজালে আবদ্ধ থেকে সময় বের করা সত্যিই কঠিন।
চলবে…