বিবর্ণ আলোকবর্ষ পর্ব -২৬

#বিবর্ণ_আলোকবর্ষ
#পর্বঃ২৬
#লেখিকাঃদিশা মনি

আলো, জোনাকিকে কিডন্যাপ করে নিয়ে এসেছে এরিক ও তার বন্ধুরা। এরিক নিজের বন্ধুদের উদ্দ্যেশ্যে বলছে,
‘আমি বলেছিলাম না তোদের, যেই মেয়ের উপর নজর দেব তাকে নিজের করেই ছাড়ব। ভাগ্য ভালো যে রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় এদের দেখতে পেলাম। তাই তুলে নিয়ে এলাম। এবার এদের ভো’গ করব।”

আলো, জোনাকি দুজনকে ধরে রেখেছে অনেকগুলো ছেলে মিলে। তাদের মুখ চেপে ধরে রাখায় চিৎকার করতে পারছে না।

জোনাকি আচমকা যেই লোকটা তার মুখ চেপে ধরে ছিল তার হাতে কামড়ে ধরে। যার ফলে লোকটি তার মুখ ছেড়ে দেয়। ছেড়ে দিতেই জোনাকি চিৎকার করে বলতে থাকে,
‘কেউ আছেন, বাচান আমাদের।’

চলন্ত গাড়ি থেকে চিৎকারের আওয়াজ অনেকের কানে পৌছায়। এরিক রেগে গিয়ে বলে,
‘এই মেয়েটাকে ফে’লে দে গাড়ি থেকে। আমার ঐ মেয়েটাকে লাগবে না। এটা তো আছেই।’

আলোর দিকে তাকিয়ে কথাটা বলে। এরিকের এক বন্ধু জোনাকিকে চলন্ত গাড়ি থেকে ফেলে দেয়। সাথে সাথেই অন্য একটি চলন্ত গাড়ি এসে জোনাকির উপর দিয়ে যায়।

৫১.
বর্ণ আর বর্ষ আশেপাশের কিছু প্রত্যক্ষদর্শী মানুষের কথা অনুযায়ী সেই রাস্তা দিয়ে আসতে থাকে, যেদিকে আলো, জোনাকিকে কিডন্যাপ করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। রাস্তা ধরে কিছু দূর এগিয়ে যাওয়ার পর ভীষণ ভীড় চোখে পড়ে। ভীড় ঠেলে এগিয়ে গিয়ে তারা যা দেখে তাতে হতবাক হয়ে যায়। জোনাকি রক্তাক্ত অবস্থায় রাস্তায় পড়ে আছে আর তার পাশে বসে কাদছে আলো।

বর্ণ এই দৃশ্যটা সহ্য করতে না পেরে জোনাকি বলে চিৎকার করে ওঠে। বর্ষও নির্বাক। বর্ণ আলোর পাশে এসে বলে,
‘এটা কিভাবে হলো? কি হয়েছে জোনাকির?’

আলো কাদতে কাদতে নাভিশ্বাস উঠে গেছে।

‘আপনার সাথে যেই মেয়েটার এনগেজমেন্ট ঠিক হয়েছিল তাই ভাই আমাদের কিডন্যাপ করে নিয়ে যাচ্ছিল। গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়ার সময় আপু চিৎকার করলে আপুকে ধা’ক্কা দিয়ে গাড়ি থেকে ফেলে দেয়। তারপরেও একটি গাড়ি এসে,,,,, আশেপাশের কিছু লোক ছুটে এসে গাড়ি থামায়। ওরা সবাই পালিয়ে গেছে। আমার আপুর কিছু হবে নাতো?’

‘কিছু হবে না জোনাকির। জোনাকি তুমি চোখ খোলো। আমি তোমার কিছু হতে দেবো না। এখুনি তোমায় হাসপাতালে নিয়ে যাব।’

জোনাকি চোখ মেলে তাকায়। সে জানে তার হাতে আর বেশি সময় নেই। জোনাকি বর্ণকে উদ্দ্যেশ্য করে বলে,
‘আপনি অনেক ভালো,,,,আপনি জীবনে অনেক ভালো কাউকে পাবেন,,আমি আপনার জন্য তৈরি হইনি,,,বামন হয়ে চাদে হাত আমি দিতে চাইনি,,,,কিন্তু জানেন আমি আপনাকে পছন্দ করি,, আপনার হাসি খুব ভালো লাগে আমার,,,’

এটুকু বলেই জোনাকির নিঃশ্বাস দ্রুত পড়তে থাকে, যন্ত্রণায় তার অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। জোনাকি আলোর দিকে ফিরে তাকায়। আলোকে কাদতে দেখে বলে,
‘কাদিস না আলো,,, আমি হয়তো এখন থেকে আর তোকে আগলে রাখতে পারবো না,,,নিজের খেয়াল রাখিস বোন,,’

‘না তোমার কিছু হবে না।’

❝শেষবারের মতো আমায় একবার আপু বলে ডাকবি আলো❞

আলো ভগ্ন কন্ঠে বলে ❝আপু❞

❝এখন আমি মরেও শান্তি পাবো বোন❞

বর্ণ বলে,
‘জোনাকি তুমি আমাকে পছন্দ করো স্বীকার করলে। এখন আমি যেকোনমূল্যে তোমাকে বাচাবো। তোমার সাথে আজীবন থাকব আমি। তুমি এভাবে মরতে পারো না।’

জোনাকি আর কিছু বলে না। তার শরীর নিস্তেজ হয়ে যায়। জোনাকির নিথর দেহ থেকে তার আত্মা বিদায় নিয়ে নেয়। রেখে যায় একরাশ দুঃখময় স্মৃতি।

আলো দেখে জোনাকির আর নিঃশ্বাস পড়ছে না। পার্লস চেক করে দেখে নেই। আলো চিৎকার করে বলে ওঠে,
‘আপু,,আমাকে এভাবে ছেড়ে যেও না আপু। আমার যে এই পৃথিবীতে আর কেউ রইল না। আমরা দুই বোন তো এসেছিলাম এই শহরে একসাথে থাকব, একসাথে লড়ব বলে। এভাবে আমায় একা রেখে যেও না আপু। আমরা না স্বপ্ন দেখেছিলাম আমাদের খুব সুন্দর একটা জীবন হবে। তুমি আর আমি একটা ছোট বাড়িতে থাকব। এভাবে সব স্বপ্ন তুমি শেষ করে দিতে পার না।’

জোনাকি আর কোন কথা বলে না। আলো আকাশ বাতাস কাপিয়ে আর্তনাদ করে কাদে।

বর্ণ পুরো অনুভূতিহীন হয়ে বসে ছিল। সত্যটা সে মেনে নিতে পারছে না।

‘জোনাকি,,আমাকে পছন্দ করে,,আমার হাসি সুন্দর। জোনাকি তুমি আমাকে হাসতে দেখবে? এই দেখ আমি হাসছি। পুরো পৃথিবী কাদুক তবুও আমি হাসব, তোমার জন্য। তুমি জানো আমি কত কি ভেবে রেখেছিলাম, তোমাকে নিয়ে গোটা দুনিয়া ঘুরে দেখার স্বপ্ন ছিল। এভাবে ঘুমিয়ে থেকোনা জোনাকি। আমাদের একসাথে অনেক পথ চলা বাকি আছে। আমরা একসাথে হেসে খেলে বেড়াবো। আমি তোমাকে বিরক্ত করব, তুমি আমাকে বকাবকি করবে। এভাবে ঘুমিয়ে থাকলে চলবে বল?’

বর্ষ এসে বর্ণকে সামলানোর চেষ্টা করে। বর্ণ বর্ষকে বলে,
‘বর্ষ ভাই তুই দেখ না জোনাকি কিরকম চুপ করে আছে। আমার কোন কথার উত্তর দিচ্ছেনা। তুই শুনলি একটু আগে ও কি বলল,,আমায় পছন্দ করে জোনাকি। আমার হাসি,,জোনাকিকে একবার উঠতে বল আমি সারাজীবন ওর সামনে হাসব।’

‘ভাই তুই সামলা নিজেকে,,ও মারা গেছে।’

‘একদম এরকম কথা বলবি না। আমি জোনাকিকে নিয়ে একটা বর্ণময় জীবনযাপনের স্বপ্ন দেখেছিলাম,,ও আমার জীবনটাকে এভাবে বিবর্ণ করে চলে যেতে পারে না।’

‘সত্যটা তোকে মানতে হবে বর্ণ। এভাবে পাগলামো করে কোন লাভ হবে না।’

বর্ণ অনেক বড় একটা ধা’ক্কা পায়। জোনাকির মৃত্যু কিছুতেই মানতে পারছে না। হঠাৎ তার বুকে অনেক ব্যাথা শুরু হয়। মুহুর্তেই জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে বর্ণ।

৫২.
বর্ণকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। সুমনা,জরিনা,বর্ণ সবাই আইসিইউ এর বাইরে বসে আছে। জোনাকির লাশও এই হাসপাতালের মর্গে আনা হয়েছে। আলো সম্পূর্ণ নিশ্চুপ হয়ে বসে আসে জরিনার কোলে মাথা দিয়ে।

জরিনা নিজেকেই সবকিছুর জন্য দোষী মনে করছে। আলোকে বলছে,
‘সব দোষ আমার আলো। আমি যদি তোমাদের এভাবে চলে যেতে না বলতাম তাহলে এসব কিছুই হতো না। জ্যোতি আমার কত বড় উপকার করেছিল। আজ তার উপকারের এই প্রতিদান দিলাম আমি। জীবনে এই মুখ আর কখনো তাকে দেখাতে পারব না।’

আলো জোনাকির কাছ থেকে সব শুনেছে তার মায়ের ব্যাপারে।

‘আমার আম্মুর সাথে দেখা করার কোন সুযোগও নেই। সে যে অনেক আগেই সেই পথ বন্ধ করে দিয়েছে।’

জরিনা বুঝতে পারে জ্যোতি মা’রা গেছে। এই সত্যটা শুনে সে আর নিজের চোখের জল আটকে রাখতে পারে না। ডুকরে কেদে ওঠে।

সুমনাও সমানে কেদে চলেছে।

‘আমার ছেলেটার কিছু হবে নাতো বর্ষ? ডাক্তার তো বলেছিল ওর হার্টের সমস্যা আছে। বড় কোন ধরণের কষ্ট ও সহ্য করতে পারবে না। আমি যদি আগে জানতাম যে বর্ণ জোনাকিকে পছন্দ করে তাহলে কখনোই এমন হতে দিতাম না। এখন আমার ছেলেটার কিছু হয়ে গেলে আমি নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারবো না কখনো না।’

একজন ডাক্তার বাইরে আসেন।

‘রোগীর অবস্থা খুব ক্রিটিকাল। ওনার পার্লস রেট ওঠানামা করছে। বাচার সম্ভাবনা আর নেই বললেই চলে। ওনার পরিবারের সদস্যদের সাথে দেখা করতে চাইছেন। ওনাকে লাইফ সাপোর্টে রাখতে চেয়েছিলাম কিন্তু কোন লাভ হতো না তাই সাধারণ কেবিনে শিফট করা হয়েছে। আপনারা গিয়ে দেখা করুন।’

ডাক্তারের কথা শুনে সুমনা ডুকরে কাদতে থাকে। বর্ষ নিজের চোখের জল মুছে সুমনাকে সামলায়,
‘আম্মু চলো এভাবে কেদো না। বর্ণ তোমাকে এভাবে কাদতে দেখলে আরো ভেঙে পড়বে।’

বর্ষ সুমনাকে নিয়ে বর্ণর ভেতরে যায়। তাদেরকে দেখে বর্ণ নিজের অক্সিজেন মাক্স খুলে। সুমনা বলে,
‘বর্ণ তোর কিছু হবে না। তুই ফিরে আয় আমার বুকে। জানিস তো এই বর্ষটা আমাকে মম বলে ডাকে সবসময়। তোর কিছু হয়ে গেলে কে আমায় আম্মু বলে ডাকবে। তুই এভাবে চলে যাস না আমায় ছেড়ে বাবা।’

‘বর্ষ ভাই তুই এখন থেকে আম্মুকে আম্মু বলে ডাকবি। আমার অর্বতমানে আম্মুকে সামলাবি। আমার এই বিবর্ণ জীবনে বেচে থাকার আর কোন ইচ্ছা নেই। আমি চলে গেলাম জোনাকির কাছে। আমি আল্লাহর কাছে চাইব আমি সুখী হতে পারিনি তো কি হয়েছে, আমার ভাইটা যেন তার পছন্দের মানুষের সাথে সুখী হতে পারে।’

‘একদম ফালতু কথা বলবি না।’

‘আম্মু আমার একটা অনুরোধ রাখবে?’

সুমনা জিজ্ঞেস করে,
‘কি বর্ণ বল।’

‘আমাকে আর জোনাকিকে পাশাপাশি কবর দেবে প্লিজ। আমি জোনাকির পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত হতে চাই। পৃথিবীতে একসাথে থাকতে পারি নি তো কি কবরে ওর পাশে থাকতে চাই।’

‘বর্ণ,,,’

বর্ণ আর কথা বলে না। তার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। জোনাকি তো তার জীবনটাকে বিবর্ণ করে দিয়ে চলে গেল, যাওয়ার আগে বলেছিল অন্য কাউকে নিয়ে থাকতে। কিন্তু বর্ণ সেটা করল না। জীবনে একজনকেই শুধু ভালোবেসেছে আর এই ভালোবাসাতেই সে বিলীন হয়ে গেল।

বর্ণ-জোনাকির গল্প অসমাপ্তই রয়ে গেল। পৃথিবীতে সবকিছু পূর্ণতা পায়না। কারণ কিছু জিনিস অপূর্ণতেই পূর্ণ হয়।
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here