বিবর্ণ নীলাম্বরী পর্ব -২১+২২

#বিবর্ণ_নীলাম্বরী
#মম_সাহা

পর্বঃ একবিংশ

হসপিটালের করিডোরে দাঁড়িয়ে আছে বর্ণ তার পরিবারের সবাই নীলার বন্ধুবান্ধব এবং শুভ্রম আর তার পরিবার রাজ আর দিয়ার বন্ধুবান্ধব।দিয়াকে সড়িয়ে দেওয়ার পরও কিছুটা এসিড এসে দিয়ার গলার বামদিকে লেগেছে, আর কিছু লেগেছে নীলার ডান হাতের মাঝামাঝি।

তখন তাদের চিৎকারে থমকে গিয়েছিলো সবাই।ঝড়ের বেগে এসিডের কথা শুভ্রমের কাছে গিয়ে পৌঁছায়।সে আসতে আসতে নীলা আর দিয়াকে বর্ণ আর নীলার বন্ধুরা হসপিটালের উদ্দেশ্যে নিয়ে আসে।

দিয়া বেশ শক্তপোক্ত মেয়ে।এসিড মারার পরও সে বেশ শক্ত রয়েছে। ব্যাথায় কাতরিয়েছে একটু। কিন্তু নীলা সাথে সাথে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।

দিয়াকে হসপিটালে রাখা হয়েছে অবজার্ভারবেশনে।তার গলার নরম চামড়া পুড়ে গিয়েছে। এটা তো সময় লাগবেই।আর নীলার হাত ব্যান্ডেজ করে দিয়েছে। জ্ঞান না ফেরার কারণে এখনো সবাই অপেক্ষা করছে।সকাল থেকে না খাওয়া আর হঠাৎ ভয়ের কারণে ব্রেণে চাঁপ পড়ায় জ্ঞান হারিয়েছে সে।

নীলার জ্ঞান ফেরার পর তার বন্ধুবান্ধব দেখা করে চলে গিয়েছে।তারপর নীলার রুমে প্রবেশ করেছে শুভ্রমের পরিবার।বর্ণ ওর মা,ফুফু,ভাই,রঙ সবাই আগে থেকেই সেখানে উপস্থিত ছিলো।

শুভ্রম আর শুভ্রমের পরিবারকে দেখে উঠে বসে নীলা।তার হাতে ক্যানাল লাগানো স্যালাইন চলছে।শুভ্রমের চাচী এসেই নীলার সামনে হাত জোড় করে বসে কেঁদে দিয়ে বলল
-‘ক্ষমা করে দেও মা। তোমার সাথে এত খারাপ আচরণ করার পরও তুমি আজ যা করলে তার সত্যিই কোনো তুলনা হয় না।

নীলার এমনেতেই গলা ব্যাথা অবস্থা খারাপ।তবুও খুব কষ্টে উচ্চারণ করল
-‘আন্টি দয়া করে আমাকে লজ্জা দিবেন না।আপনারা মানেন আর না মানেন আপনাদের কে আমি আপন মানুষ ভাবি।দিয়া আমার ছোট বোন তার বিপদে আমি তাকে বাঁচাবো না তো কে বাঁচাবে? এসব বলে আমাকে ছোট করবেন না।’

দিয়ার মা এমনকি ওদের পরিবারের সবাই মাথা নিচু করে ফেলে। মেয়েটাকে কম কথা তারা শুনায় নি।আজ বড় উপকার করলো মেয়েটা।নাহয় তাদের মেয়ের কি হতো ভেবেই বুক কেঁপে উঠে তাদের।

মৌ নীলার কাছে এসে নীলার মুখের সামনে চুল গুলি কানের পিঠে গুঁজে দিয়ে তার চাচীর উদ্দেশ্যে বলল
-‘সেদিন তো মেয়েটার বাড়ি বয়ে গিয়ে মেয়েটার বাবার শিক্ষার উপর আঙ্গুল তুলে এসে ছিলে।আজ দেখেছো ওর বাবার শিক্ষার প্রখরতা?’

রেহেনা বেগম মানে শুভ্রমের মা মেয়েকে ধমকের স্বরে বলল
-‘যেখানে আমরা নিজেরাই লজ্জিত সেখানে তোমায় অন্য কিছু বলার দরকার নেই।আমরা যা করেছি তার জন্য আমরা এমনেতেও লজ্জিত।’

মৌ তাচ্ছিল্য হেসে বলল
-‘হ্যাঁ আজ তোমাদের মেয়েকে বাঁচিয়েছে বলে তোমরা এত নরম নরম কথা বলছো,লজ্জিত ফিল করছো।কিন্তু আজকের দিনটা না আসলেই বুঝা যেতো তোমরা সত্যি কতটা লজ্জিত।’

মৌয়ের এমন উচিত কথায় নিভে যায় তার মায়ের তেজ।মানুষ বলতেই স্বার্থপর। সে কোনো একটা কাজ করছে তার পিছনে নিশ্চয়ই কোনো না কোনো কারণ থাকবে।

নীলা হালকা হেসে বলল
-‘আপনারা চিন্তা করবেন না।দিয়া ঠিক হয়ে যাবে।আপনারা এখন আসুন।আসলে আমার কথা বলতে অসুবিধা হচ্ছে।’

নীলার কথা শেষ হতেই সবাই রুম থেকে প্রস্থান নিলো।শুভ্রম দাঁড়িয়ে রইল। তার পরিবারের সবাই বের হয়ে যেতেই শুভ্রম নীলার সামনে চেয়ারে বসে।বর্ণ ও তার পরিবারের সবাইকে বাহিরে যেতে বলল।সবাই বাহিরে চলে গেলেও বর্ণ একই অবস্থায় দাঁড়িয়ে রইল।শুভ্রম বর্ণকে কিছু বলতে নিলেই বর্ণ তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল
-‘আমি একজন ডাক্তার আর এজ এ ডাক্তার আমি এখানে থাকতেই পারি। আর নীলাম্বরীর সাথে তার একজন কাছের মানুষ থাকা উচিত সেই হিসেবেই আমি আছি।

শুভ্রম আর কিছু বলে না।নীলার দিকে তাকিয়ে বলল
-‘নীলা বরাবরই তুমি আমাদেরকে ঋণী করে দিয়ে দিলে।’

নীলা মুখটা গম্ভীর করে বলল
-‘আমাকে এসব কথা বলে ছোট করবেন না স্যার।দিয়া আমার বোন।’

শুভ্রম তাচ্ছিল্য হাসলো দিয়ার ডাকে।সেই হাসি মুখে রেখেই বলল
-‘স্যার! এতদিন প্রায় দীর্ঘ চার বছর পর তুমি আমাকে কিছু সম্বোধন করলে।তাও স্যার বলে!’

নীলাও ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসির রেখা টেনে বলল
-‘স্যারকে স্যার বলবো না তো কি বলবো?’

শুভ্রম বিষ্ময়কর কন্ঠে বলল
-‘স্যার আর ছাত্রীর সম্পর্ক ছাড়া আমাদের আর কোনো সম্পর্ক নেই?’

নীলা ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলল
-‘যে সম্পর্ক প্রাণ নেই সেটা সম্পর্ক বলে না।আশা করি বুঝেছেন। এবার আপনি যান।’

শুভ্রম আর কিছু না বলে চলে যায়। বর্ণ এত ক্ষণ চুপ করে ছিলো। শুভ্রম বের হয়ে যেতেই বর্ণ শক্ত চোখে তাকালো নীলার দিকে।এগিয়ে এসে বলল
-‘আপনি সব কিছুতে এত পাকামি কেন করেণ নীলা।একটা খারাপ কিছু হয়ে গেলে কি হতো নীলা?’

নীলা আগের ন্যায় হাসি বজায় রেখে বলল
-‘আমার কিছু হয়ে গেলে কি হতো আমার জানা নেই তবে আমি কিছু না করলে আমার বাবার আদর্শের অপমান হতো এতটুকু জানি।’

বর্ণ আর কিছু বললো না।এর মাঝেই বর্ণের মা শারমিন চৌধুরী তার হাতে মোবাইল টা নীলার দিকে এগিয়ে দিলো।নীলা তার বাবার সাথে কতক্ষণ কথা বললো।অবশেষে ঠিক হলো কালই বর্ণের পরিবার আর নীলা ওদের বাড়ি যাবে।বিয়ের জন্য ওনারা আসতে পারেন নি।মেয়েকে না দেখেও থাকতে পারছে না তাই আগামীকাল তারা সেখানে চলে যাবে। বর্ণ আর তার বাবা বাদে সবাই কাল যাবে।বর্ণ হসপিটাল থেকে ছুটি নিয়ে তারপর যাবে।

________

নীলা নিজের বাড়িতে এসেছে আজ দু’দিন হলো।সবাই তার যত্ন করছে।রাহাতও কোনো রূপ খারাপ আচরণ করে নি।আত্মীয় স্বজনে বাড়ি ভরে গিয়েছে। আগামীকাল গায়ের হলুদ।

বাড়ি ভরা মানুষ থাকতেও নীলার নিজেকে একা মনে হয়।কারো একটা অভাব বেশ করে বোধহয়। মানুষ টা কে সেটা তার জানা নেই।সত্যিই জানা নেই? নাকি সে মানতে চায় না এই অনুভূতিটাকে।

নীলা মন মরা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার রুমের বারান্দায়। সন্ধ্যা নেমেছে বিশাল আকাশের বুকে। নীলা আজ ভীষন মন খারাপের অসুখে ভুগছে।সকালে উঠেই শুনেছে ডাক্তার সাহেব আসতে পারবেন না।সেই থেকে যে মন খারাপের রোগে ধরেছে এখনও সেই রোগেই আক্রান্ত।

নিজের এমন অনুভূতির সাথে অপরিচিত নীলা।এই মানুষটার জন্য এমন অনুভূতির কারণ জানা নেই নীলার।নীলার ভাবনার মাঝেই কেউ একজন পিছনে থেকে এসে বলল
-‘আপনার মন খারাপ?

নীলা আনমনেই উপর নীচ মাথা নাড়ালো। তার পিছে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা আবার জিজ্ঞেস করল
-‘কাউকে মিস করছেন?’

নীলা আবারও আনমনে উপর নীচ মাথা নাড়ালো।এবার পিছনের ব্যাক্তি সামনে এসে বলল
-‘থাক আর মিস করা লাগবে না।এই যে আসি চলে এসেছি।’

অনবরত কানের কাছে কথা শুনে ধ্যান ভাঙলো নীলার।বিরক্ততি নাক মুখ কুঁচকে তাকালো সে।উদ্দেশ্য সামনে থাকা ব্যাক্তি টাকে কত গুলো কড়া কথা শুনানো। কিন্তু সামনের ব্যাক্তিকে দেখে সে আবেগে আপ্লুত হয়ে যায়। তার সামনে তার ডাক্তার সাহেব দাঁড়িয়ে আছে।

নীলা অবাক কন্ঠে বলল
-‘আপনার না কাজ আছে আসবেন না বললেন? তাহলে এখন এখানে?’
-‘ভেবেছিলাম আপনাকে সারপ্রাইজ দিবো।আর আমার কাছে খবর গেছে।কেউ একজন নাকি আমায় বড্ড মিস করছে।তাই চলে আসলাম।’

বর্ণের এমন কথায় মুখ ভেংচি কাটে নীলা।মনে মনে সে বেশ খুশি হয়েছে।তবুও মুখ ভেংচি কেটে বলল
-‘কেউ আপনাকে মিস করে না। যা শুনেছেন ভুল শুনেছেন।কে দিলো আপনাকে ভুল খবর টা?’

বর্ণ মুচকি হেসে বলল
-‘যে দিয়েছে সে কখনোই ভুল খবর দেওয়ার মানুষ না।সে সম্মানিত ব্যক্তি।’

নীলা এবার হেসে বলল
-‘হয়েছে হয়েছে। এখন এখান থেকে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসুন একটু পর ছাদে সব কাজিন মিলে আড্ডা বসবে।ফ্রেশ হয়ে এসে খাবার খাবেন।যান তাড়াতাড়ি।’
-‘তো আড্ডা হলে কী হয়েছে? আপনি তো নাকি যাবেন না বলেছেন? আপনার শরীর ভালো লাগছে না।তাহলে?’

বর্নের কথায় জিব কাটে নীলা।একটু আগে সে ড্রয়িং রুমে বলে এসেছে আড্ডার মাঝে সে থাকবে না শরীর ভালো লাগছে না।আসলে যে মন ভালো না সেটা বলবে কীভাবে।

নীলার ভাবনার মাঝেই বর্ণ হেসে বলল
-‘হয়েছে আর কিছু বলা লাগবে না।আমি ফ্রেশ হয়ে আসি।আপনি আমার খাওয়ার সময় আমার সাথে থাকবেন।’

নীলা হেসে মাথা নাড়াতেই বর্ণ প্রস্থান নিলো রুম থেকে।নীলাও বারান্দা থেকে ঘরে আসতে নিলে বারান্দার মাঝে ঠাস করে কিছু একটা পরার শব্দ হয়।নীলে তাকিয়ে দেখে একটা কাগজ তার পায়ের কাছে।

ভ্রু কুঁচকে কৌতুহল নিয়ে কাগজটা খুলে নীলা।সেখানে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা
-‘বোনের জীবনটা শেষ করে দিবে নীলা?সত্য যতই কঠিন হোক তা প্রকাশই শ্রেয়।’

এমন কথায় ভয় পেয়ে যায় নীলা।কে এমন চিরকুট দিলো তাকে? সে বাদে এসব কথা কে জানে?
#বিবর্ণ_নীলাম্বরী
#মম_সাহা

পর্বঃ দুইবিংশ

হাতের চিরকুটটা নিয়ে বেশকিছু ক্ষণ চিন্তা করেও কূল পায় নি নীলা।কিন্তু হাতের লেখা বেশ পরিচিত মনে হয়েছে তার।কোথাও দেখেছে এমন লেখা।কিন্তু ঠিক কোথায় দেখেছে মনে করতে পারে না নীলা।চিঠিটা ড্রয়ারের ভিতর রেখে বর্ণের জন্য খাবার সার্ভ করতে গেলো।

খাবার টেবিলে বর্ণ বসে খাবার খাচ্ছে।তার পাশের চেয়ারে নীলা বসে আছে। বাড়ি ভর্তি মানুষজন।আসা যাওয়ার পথে অনেকে তাকাচ্ছে বর্ণের দিকে।কেউ বর্ণের প্রশংসা করছে।কেউ ভাবার নীলাকে পাশে দেখে ভ্রু কুঁচকাচ্ছে।নীলা সবার দৃষ্টিই বুঝতে পারছে।সে কয়েকবার উঠে যেতে চেয়েছে কিন্তু পরক্ষণেই বর্ণের চোখ রাঙানি দেখে বসে পড়েছে।

বর্ণের খাওয়া প্রায় শেষের দিকে।বর্ণের খাওয়া শেষ হলেই তারা ছাদে যাবে।কাজিন সবাই সেখানেই আছে।নীলা বর্ণের জন্যই বসে আছে।

হঠাৎ করে এক মহিলার কেমন ঠেস মারা কন্ঠ ভেসে আসলো।মহিলা বলছে
-‘কিরে কালরাত হ্যাবলার মতন বসে আছিস যে এখানে?’

চির পরিচিত বিষাক্ত নামটা দেখে নীলার বুঝতে বাকি রইল না এই ব্যাক্তি কে।পিছে ঘুরে দেখে সে ঠিক ধরেছে।তার ফুফু হাবিবা খানম।নীলা বিরক্তিতে মুখ কুঁচকায়।নীলার মা আফসানা রহমান নিজের ননসের কথা শুনে রান্নাঘর থেকে তাড়াতাড়ি ড্রয়িং রুমে আসে।

বর্ণ ততক্ষণে খাবার খাওয়া থামিয়ে দেয়।মাহিলার কথার ধরণেই বলে দেয় মহিলা কোন ধরনের হবে।

হাবিবা খানম আফসানা রহমানকে দেখে ঠেস মেরে বলল
-‘আফসু তোমার মেয়ে দেখি সব আদব-কায়দা খেয়ে বসেছে। ওর বড় ফুফু আমি কতদিন পর বাড়ি আসলাম আর সে কিনা নবাবের বেটির লাহান চেয়ারে বসে আছে।সালাম কালাম দিতে হয় সেটা জানে না নাকি?’

আফসানা রহমান বাকি মায়েদের মতন না। কিন্তু তার ননসকে সে কিছুই বলতে পারবে না।অন্য কেউ হলে হয়তো কিছু বলা যেতো।তার ননস তিল কে তাল বানানো মহিলা।পরে কি থেকে কি হবে আর বাড়ি মাথায় উঠবে উপরওয়ালা মালুম।

নীলাও কোনো রকম ঝামেলা না করে তার ফুফুকে সালাম করলো সাথে ফুপাকেও সালাম করলো।ফুপা সুন্দর করে সালামের জবাব দিলো কিন্তু হাবিবা খানম মুখ ফিরিয়ে নিলেন।

মুখ ফিরিয়ে বেশ ব্যাঙ্গাত্মক স্বরে বলল
-‘এভাবেই নানা ভাবে আমাদের মুখ পুড়াস সামান্য ভদ্রতা না জানলে তো বংশের মুখটাও পুড়াবি।আজিজ যে কীভাবে তোরে বড় করেছে আমি হলে উঠতে বসতে ঠাঁস ঠাঁস চড় লাগাতাম।’

নীলার ফুপা ফজলুর সাহেব ঠেস মেরে নিজের বউকে বললেন
-‘তোমারও তো ছেলেমেয়ে আদব কায়দা শিখেনি।সামনে মামী দাড়িয়ে আছে কই সালাম টালাম তো দিতে শুনলাম না।আর আজিজুরের বংশের মুখ তুমি জন্মের পরই পুড়েছে।’

হাবিবা খানম পারে না চোখ দিয়ে স্বামী ধ্বংস করে ফেলে।ফজলুর সাহেব আফসানা রহমানকে বলে তাড়াতাড়ি রুমে চলে যায়। এখানে থাকলে তার বদমাশ স্ত্রী অপমান করে বসবে।

বর্ণ হাত ধুঁতে উঠে গেলো।এই মহিলার কথাবার্তা তার মেজাজ খারাপ করে দিচ্ছে।বেশি ক্ষণ থাকলে মেজাজের আরও বারোটা বাজবে।তাড়াতাড়ি হাত ধুঁয়ে নীলাকে সরাতে হবে এখান থেকে।

ততক্ষণে হাবিবা খানম সোফায় সিট দখল করে বসলো।বর্ণের মা আর ফুফু রান্না ঘরের দরজা থেকে সবটা দেখছে।

হাবিবা খানমের এক ছেলে এক মেয়েও মায়ের সাথে এসে বসেছে।মেয়েটা পুরো মায়ের কার্বণ কপি হয়েছে। ছেলেটা বাবার মতন। ছেলে অনার্স শেষ করেছে আর মেয়েটা ইন্টারে।ওদের বড় বোনও আছে যে বিবাহিত একটা বাচ্চাও আছে।সে অবশ্য আসে নি আগামীকাল আসবে হয়তো। হাবিবা খানম সোফায় বসেই নীলাকে উদ্দেশ্য করে বলল
-‘কিরে আন্ধার পানি টানি দে।মেহমানদের সমাদর করতেও জানিস না দেখছি।’

নীলা কিছু বলার আগেই ওর মা তড়িঘড়ি করে বলল
-‘আপা আমি আনছি।নীলা তুই যা।’

হাবিবা খানম চরম বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে বলল
-‘কই যাবে ও?তুমিই তাইলে ওরে এমন বানাইছো? ফুপু এতদিন পর আসলো।এখানে সমাদর করবে তা না মেয়েকে এখন থেকে তাড়াচ্ছো।’

আফসানা রহমান চরম অস্বস্তি অনুভব করছে।এখানে পরিবারের মানুষ ছাড়াও অনেক আত্মীয় স্বজন আছে। সবার সামনে তার এত বড় মেয়েটাকে কত গুলো কথা শুনালো। এখান থেকে না সরালে আরও কথা শুনাবে।

বর্ণ এবার এগিয়ে এসে মুখটা গম্ভীর করে বলল
-‘আসলে ওনার শরীর ভালো না।ওনি এসব কাজ করতে পারবে না।ওনার এখন ওষুধ খাওয়ার সময় হয়েছে।’

বর্নের কথায় পূর্ণদৃষ্টিতে সবাই তাকালো বর্ণের দিকে। হাবিবা খানম বেশ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল
-‘তুমি কে?তোমাকে তো চিনলাম না!’

আফসানা রহমান আগে আগে উত্তর দিলো
-‘আপা ও আপনার ভাইয়ের প্রিয় ছাত্র। নিরুপমার বিয়ের জন্য আসছে ওরা বেড়াতে।’

হাবিবা খানম জিজ্ঞেস করলেন
-‘কি করো তুমি?নাম কি?’

বর্ণের বিরক্ত লাগলো।আফসানা রাহমানের দিকে তাকাতেই তিনি করুন দৃষ্টি ফেললেন।বর্ণ বিরক্তিটা নিজের ভিতরেই দমন করে বলল
-‘আমি ডাক্তার। আমার নাম বর্ণ এহসান।’

ডাক্তার শুনে হাবিবা বেগমের চোখ জ্বলজ্বল করে উঠলো।ন্যাকা ন্যাকা স্বরে গদোগদো হেসে বলল
-‘আরে বাবা তোমার আচার আচরণ কত ভালো একদম আমাদের রিংকুর মতন।এই যে আমার ছোট মেয়েও সবার সাথে এমন মিলেমিশে থাকে।’

বর্ণ মহিলার গদগদ কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। আজব কথাবার্তা। সে কখন ভালো ব্যবহার করলো আর মহিলার মেয়ের ভাব ভঙ্গিমা দেখেও তো এমন ভালো মনে হলো না।

বর্নের ভাবনার মাঝে হবিবার ছেলে দিগন্ত বলে উঠলো
-‘কি বলো মাম্মি?তোমার এই অসভ্য মেয়ে ভালো আচরণ করে?কবে থেকে?’

দিগন্তের কথায় ফিক করে হেসে উঠলো নীলা।তারপর মুখ চেপে ধরলো দু’হাতে।হাবিবা খানম কিছু বলতে উদ্ধত হলেই বর্ণ ওষুধ খাওয়ার নাম করে টেনে নিয়ে আসে সেখান থেকে।আফসানা রহমান কৃতজ্ঞতার হাসি হাসলেন।
________
ছাদে আড্ডার আসর বসেছে।নিরুপমা,নীলা,রাহাত,বর্ণ,রিংকু,দিগন্ত,নীড়,রঙ,অহন,নীলার বান্ধবী পুষ্পা,সিন্গ্ধা,অনন্ত,আবির,নীলার আরো চাচাত ভাই-বোন। বর্ণের পাশে রিংকু বসেছে একটু কিছু হলেই হা হা করে বর্ণের উপর এসে পড়ছে।এতে বেশ বিরক্ত বর্ণ।আর রাহাত অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করছে নীলার সাথে কথা বলার কিন্তু পারছে না।আড্ডার আসর রমরমা।হাসি ঠাট্টা গান হচ্ছে।হঠাৎ দিগন্ত বলে উঠে
-‘সবাই দাঁড়াও রক আপু গান শুনাবে আমাদের কেমন?’

বর্ণ, নীড়,রঙ বাদে সবাই বুঝতে পেরেছে কার কথা বলেছে দিগন্ত। নীড় অবাক কন্ঠে বলল
-‘রক আপু আবার কে ছোট ব্রো?’

দিগন্ত হেসে বলে
-‘আরে ভাইয়া আমাদের নীল নীল নীলাঞ্জনা আপাই তো রক আপু।’

বর্ণ ভ্রু কুঁচকে বলল
-‘নীলা? নীলা রক আপু হলো কীভাবে?’

দিগন্ত হেসে বলল
-‘ভাইয়া নীলাপু হেব্বি গান জানে।লাষ্ট দু তিন বছর আগে শুনেছিলাম নিরু আপার বিয়ের দাওয়াত,,,,

থেমে যায় দিগন্ত। নীলা মুখ তুলে শক্ত চোখে তাকায়। রিংকু তাচ্ছিল্য করে বলে
-‘আর ভাইয়া বাকিটাও কমপ্লিট কর।নিরুপমা আপুর আগের বিয়ের দাওয়াতে এসে শুনেছিলি।’

দিগন্ত ধমক দেয় রিংকুকে।শক্ত কন্ঠে বলল
-‘তুই ছোট চুপ করে থাক।আন্দাজি কথা বলবি না।’

রিংকু কিছু বলতে নিলেই বর্ণ কথা ঘুরানোর জন্য বলল
-‘তাহলে তো আজ নীলাকে গান গাইতেই হবে।নীলা আজ গান গেতেই হবে।’

নীলা না না শুরু করে।কত বছর আগে গান গেয়েছিলো।এমনই উৎসব মুখর পরিবেশ ছিলো সেদিনটা।না না নীলার বুক কেঁপে উঠে। সে গাইবে না।সবাই জোড়াজুড়ি করছে এর মাঝেই নিরুপমা উঠে গেলো।সবাই নিরুপমাকে হঠাৎ উঠে যেতে দেখে অবাক হলো।নীলা বুজেছে তার বোনের আগের কথা মনে পড়ে গেছে।খারাপ লাগে নীলার।বর্ণ বুঝতে পারে নীলার মন খারাপ।দিগন্ত মুখ কালো করে বলে
-‘রক আপু আমি ভুলবশত বলে ফেলেছি। সরি আপু।’

নীলা কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে ‘ইটস ওকে’ বলে।আড্ডার আসর চুপ হয়ে যায়। নীলা উঠতে নিলেই নীড় বলে উঠে
-‘আরে ছোট আপুই কোথায় যাচ্ছো? নিরু আসবে দেখো।বসো তুমি।’

এর মাঝেই পিছন থেকে নিরুপমা বললো
-‘কই যাস নীলু?তোর জন্য কষ্ট করে গিটার আনতে গেলাম আর বাবাকেও নিয়ে আসলাম আর তুই কিনা চলে যাচ্ছিস? এই দুইটা ছাড়া তো তুই গান গাইতে পারিস না তাই নিয়ে আসলাম।বাবা আর গিটার।’

নীলা পারছে না ঠোঁট ফুলিয়ে কেঁদেই দিবে এখন।আজিজুর রহমান ছোট মেয়ের কাছে এসে জাত বুলিয়ে বলল
-‘গাও না মা।আপু এত শখ করে তোমায় বলেছে গাও।’

নীলা কাঁপাকাঁপা কন্ঠে বলল
-‘বাবা সেদিনের মতন যদি,,

আজিজুর রহমান চোখ দিয়ে ইশারা করে বলল
-‘না মা একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে তুমি এসব বলতে পারো না।গাও।’

বর্নও চোখ দিয়ে ইশারা করলো।সবাই চুপ হয়ে গেলো।নীলা গিটারে সুর তুলে গাওয়া শুরু করলো
-‘বাবা মানে হাজার বিকেল আমার ছেলেবেলা,,
বাবা মানে রোজ সকালে পুতুল পুতুল খেলা,,
বাবা মানে যাচ্ছে ভালো কাটছে ভালো দিন,,
বাবা মানে জমিয়ে রাখা আমার অনেক ঋণ।’

গান গাইতে গাইতে নীলা বাবার কাছে গিয়ে হাঁটু মুড়ে বসে বাবার হাতে চুমু খাই। তারপর আবার গায়,,

“বাবা মানে অনেক চাওয়া,
বাবা মানে অনেক পাওয়া,
বাবা মানে ছোট্ট শূণ্যতা,
বাবা মানে অনেক পূর্ণতা।”

তারপর নীলা রাহাতের দিকে তাকায়। কতক্ষণ নিষ্পলক তাকিয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে আবার গায়

“আমি যখন এলোমেলো ভুলের অভিধান
বাবা তুমি সঠিক সময় সহজ সমাধান,,,

নীলার গান শেষ হতেই বাবার হাটুঁতে মুখ গুঁজে কেঁদে দেয় সে।উপস্থিত সবাই চোখে জল নিয়ে হাত তালি দিচ্ছে।নীলার গান শুনে নিচে থেকে ওর মা বর্ণের মা ফুপু আরও মহিলারাও এসেছিলো।

আফসানা রহমান আঁচলে মুখ চেঁপে কেঁদে দেয়।তার দুই রাজকন্যা যে তাদের আত্মা তাদের প্রাণ।

নিরুপমাও বাবার কাছে এসে কেঁদে দেয়।দুই মেয়েকে বুকে গুঁজে নেয় বাবা।জেনো পৃথিবীর সব দুঃখ থেকে এভাবেই আড়াল করছে তার মেয়েদের।বাবার প্রশস্ত বুকেই জেনো মেয়ের স্বর্গ।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here