#বিবর্ণ_বসন্ত
নুসরাত জাহান লিজা
দ্বাদশ পর্ব
বরাবরের মতো সেরাতেও আর ঘুম নামল না চোখের পাতায়। প্রায় প্রতিদিনই দুঃস্বপ্ন দেখে মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায়, এরপর হাজার সাধাসাধিতেও ঘুমকুমারী আর আবিদের চোখে ভর করে না। একেবারে ভোরের দিকে ঘুমায় ও। সুন্দর সকালটা তাই আর খুব একটা দেখতে পায় না এখন। আজ খুব ইচ্ছে হলো সূর্যাস্ত দেখার। ইশ! কত্তদিন দেখা হয় না! না, ভুল হলো হয়ত, কিছুদিন আগে দেখেছিল, অনেকবছর পর! জার্নালিস্ট মেয়েটার সাথে কথা বলতে বলতে ভোর হয়ে গিয়েছিল প্রায়। কিন্তু সেদিন সেই সৌন্দর্য উপভোগ করার মতো মনের অবস্থা ছিল না। মেয়েটার নামটা যেন কী ছিল? কিছুক্ষণ ভাবতেই মনে পড়ল, অণ্বেষা! কী আশ্চর্য! নামটা মনে করতে এত কষ্ট হলো কেন? বয়স কী তবে বেড়ে যাচ্ছে, বুড়িয়ে যাচ্ছে নাকি? একচল্লিশ বছর তো খুব একটা বেশি বয়স নয়! তবে মেয়েটা দারুণ ইন্টারেস্টিং, খুব নাছোড়বান্দা! কিছুটে ক্ষ্যপাটে ভাব আছে মনে হয়। নিজের মনেই হেসে ফেলল ও। সবসময়কার মেকি হাসি নয়, একেবারে মন থেকে উঠে এলো তা। বহুবছর পর মন থেকে হাসল!
ভাবল ছাদে যাবে কিনা, দোটানা পিছু ফেলে উঠে এল ছাদে। এখনও অন্ধকার কাটেনি ঠিকঠাক, চমৎকার আলো আঁধারী চারপাশে। সোহান বেলা করে ঘুম থেকে উঠে। দারোয়ান, শেফ আর মালি এখনও উঠেনি। কখন উঠে তাও অজানা আবিদের। ভোরের হিমশীতল বাতাস লাগছে গায়ে, কী বিশুদ্ধ ফুরফুরে বাতাস!
‘আউট অফ সাইট, আউট অফ মাইন্ড’ কথাটা আবিদের একেবারে অর্থহীন মনে হয়, অন্তত ওর ক্ষেত্রে। অর্থহীনই তো, নইলে প্রায় পনের বছর ধরে দৃষ্ট সীমায় তো দূর পৃথিবীতেই যে নেই, সে এতগুলো বছর ধরে ওর মনে একেবারে আসন গেড়ে বসে আছে কী করে! আজও সমান দহনে পুড়িয়ে যাচ্ছে ওকে। শেষ বিদায়ের দিন ওকে জড়িয়ে ধরে আকুল হয়ে কেঁদেছিল অতসী, কী ব্যাকুল অনুনয় ছিল বিয়ে করার। ছেলেমানুষি আবেগ ভেবে কেন ও এড়িয়ে গেল? কতটা অসহায় হয়ে ওকে এতটা মরিয়া হয়ে চেয়েছিল। ভাবতেই ভেতরটা হুহু করে উঠে! আবিদকে এতটা স্বার্থপর ভেবেছিল অতসী? যদি নাই ভাবে তবে ওর সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা ওকে জানাল না কেন? আবিদের কাছে ভালোবাসার চাইতে ওর স্বপ্ন নিশ্চয়ই বড় ছিল না। আক্ষেপে ক্ষয়ে যায় ভেতরটা।
সূর্য উঁকিঝুঁকি মারছে তখন, কী সুন্দর সোনালী আভা ফুটে উঠেছে চারপাশে। বিশাল জায়গা জুড়ে এই বাসাটা। যার বেশীরভাগ জুড়েই রয়েছে গাছপালা, নানান প্রজাতির গাছ। চারপাশে সবুজের সমারোহ।
অনেকদিন পর এরকম একটা সুন্দর সকাল এলো ওর জীবনে!
এখনও বসন্ত, বিদায় নেবে অবশ্য দ্রুতই। গ্রীষ্ম আসতে একুশ দিন বাকি। দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি ম্যাগাজিনের বৈশাখী সংখ্যায় ওর লেখা চেয়ে দুদিন পরপরই ফোন করছেন প্রকাশক সাহেব। কিন্তু আবিদ কিছুতেই লিখতে পারছিল না, দু এক লাইন লিখে সেটা নিজেরই ভালো লাগে না। আবার নতুন করে শুরু করে। আগ্রহই হারিয়ে ফেলেছে যেন! রাইটার্স ব্লক? নাহ! সেরকম নয়। আজ আগ্রহ বোধ করছে, হয়তো লিখতে পারবে। দ্রুত পা চালিয়ে লাইব্রেরী ঘরে নেমে আসে। বসে যায় লিখতে। কিছুক্ষণ ভেবে ভেবে এক দুই লাইন লিখতেই বাকিটা দৌড়াতে দৌড়াতে আসতে লাগলো কলমের ডগায়। নিজেকে ভুলে ডুবে গেল লেখায়।
ঊনিশ.
অন্বেষার আজ একটা লাইভ ছিল। সংবাদপত্রগুলোও এখন নিজেদের ফেসবুক পেইজ আর ইউটিউব চ্যানেলে লাইভ শো নিয়ে ব্যাস্ত। আজ একজন সেলিব্রেটির ইন্টারভিউ নিল ও। শুরু হয়েছিল সাড়ে সাতটায়, আটটা পনেরোতে শো শেষ করে বাসায় ফিরতে ফিরতে নয়টা। বাসায় ফিরতেই বাবা হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলেন, “তোকে খুব ক্লান্ত লাগছে। মনে হচ্ছে যুদ্ধ জয় করে ফিরলি?”
“আর বলো না, আজ সারাদিন প্রচন্ড ব্যস্ত ছিলাম। ঘুরে ঘুরে মরেছি শুধু!”
কিছুক্ষণ ইতস্তত করে বললেন, “তোর মা ফোন করেছিল, তুই নাকি ফোন ধরছিস না?”
ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে দেখল এগারোটা মিসড কল! শো’য়ের সময় ওর নিজের ফোন সাইলেন্ট করে রাখে বরাবরই। ওই সময়েই ফোন করেছিলেন উনি। পরে আর ফোন চেক করা হয়নি। কিছু বলল না অন্বেষা, ক্লান্তি ভালোভাবেই পেয়ে বসেছে আজ। বাবা কেমন যেন উসখুস করছেন, আশ্চর্য, বাবা তো কখনো এমন করেন না!
“কিছু বলবে, বাবা?”
এবার যেন কাঁচুমাচু ভঙ্গিটা বেড়ে গেলে, “হ্যাঁ রে। আনিকা বলছিল ও তোকে নিয়ে ঢাকার বাইরে কোথাও যেতে চায়। তোর সাথে কিছুটা টাইম স্পেন্ড করতে চায়। তুই নাকি রাজি হচ্ছিস না?”
অন্বেষা একে ক্লান্ত, তার উপর এই কথা শুনে মেজাজ সপ্তমে চড়েছে, কী ভাবেন উনি নিজেকে!
“উনি চাইলে সারাজীবনই আমাদের সাথে কাটাতে পারতেন। তখন তো উনি সেটা চাননি। চলে গেলেন নিজের সুবিধার কথা চিন্তা করে। এখন কেন পিছে পরেছেন? উনার সঙ্গ যখন আমার সবচেয়ে বেশি দরকার ছিল সেসময় তাকে পাইনি, এখন আর আমার তার সঙ্গ প্রয়োজন নেই।”
মেজাজ না হারিয়ে ভীষণ শীতল গলায় কথাগুলো বলল ও। বাবাও চোখ নামিয়ে নিলেন। নিজের রুমে গিয়ে বাইরের জামা বদলে ফ্রেশ হয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে বের হলো। বাবার মুখ থমথমে, পেপার নাড়াচাড়া করছেন, বোঝাই যাচ্ছে পড়ছেন না উনি। ওকে আসতে দেখেও কোন প্রকার হেলদোল নেই। বুঝতে পারল কষ্ট পেয়েছেন, কিন্তু এখানে ওর দোষটা কোথায়?
বাবার পাশে বসে বলল, “বাবা, তুমি মন খারাপ করেছো আমার কথায়?”
বাবা চোখ তুলে মেয়ের দিকে তাকালেন, মেঘ কিছুটা কমেছে মনে হচ্ছে।
“নাহ! রাগ করিনি। খাবি না?”
অন্বেষা আর কথা বাড়ায় না, খেতে ইচ্ছে করছে না, কিন্তু না খেলে বাবা আরও কষ্ট পাবেন। তাই খাওয়া পর্ব শুরু হলো। খাবার শেষ করে বাবার সাথে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে উঠে এলো। একটা প্রশ্ন উদয় হলো মনে, বাবা কী এখনো মাকে ভালোবাসে? কী জানি, হয়তো বাসে, হয়তো না!
অতসীর ডায়েরিটা নিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিল।
ডায়েরির পাতা থেকে…..
আশফাক নিরুদ্দেশ হবার পর চলে এলাম তোর নানাবাড়িতে। নিজের বাড়ি বলতে আর সাহস হলো না। যে মানুষগুলোকে উপেক্ষা করে চলে গিয়েছিলাম, শেষ পর্যন্ত তাঁদেরকেই ভরসা করলাম। কিন্তু লোকগুলো বদলে গেছে আমূল। বাবা তো আমার সাথে কথা বলাই বন্ধ করে দিয়েছে৷ এসেছি অব্দি কোন কথাই বলেননি। অভিমানের কাঁটা হয়তো বেশিই বিঁধেছে! আমার প্রতি সবার আচরণে মনে হতো আমি ভিনগ্রহের কোন আগন্তুক! কেউ ঠিকঠাক কথা বলত না, এমনকি মা’ও না! এসব নিয়ে ভীষণ কষ্ট হলেও প্রস্তুত ছিলাম এর জন্য। যাই হোক মাথায় উপর ঠাঁই তো পাওয়া গেছে। যার হাত ধরে ঘর ছেড়েছিলাম, সে তো আমাকে মাঝ সমুদ্রে ফেলে চলে গেছে। কয়েক মাস যাবার পর দেখলাম, সবাই বিয়ে নিয়ে কথা বলছে। আমার আবারও বিয়ে দিতে চাইছে। তোকে আঁকড়ে ধরলাম। এ আমি কিছুতেই পারব না। শেষমেশ সরাসরি প্রস্তাব এলো আমার কাছে। বাবা উনার ঘরে আমাকে ডেকে পাঠালেন। যেতেই তার পাশে বসতে বললেন, কতদিন পরে বাবা কথা বলছেন আমার সাথে। মন ঠিকই জানে কঠিন কিছুই হবে।
“শোন, একবার ভুল করেছিস। এবার আমাদের কথাটা শোন। এভাবে থাকা যায় না। সামনে আগানোর চিন্তা কর এবার। ”
ঠান্ডা গলায় কথা বলছেন বাবা।
“কিন্তু আমার তো ডিভোর্স হয়নি।” বিয়ে না করার অজুহাত খুঁজে বললাম। বাবা একটা খাম আমাকে ধরিয়ে দিলেন। খামের উপরে আমার নাম লেখা। মুখ খোলা, বাবা পড়েছেন বুঝলাম। কাঁপা কাঁপা হাতে ভেতরের কাগজটা বের করলাম। ডিভোর্স পেপার! শেষ যে ক্ষীণ আসা ছিল ওর ফিরে আসার তাও শেষ। চোখ থেকে পানি গড়াতে লাগলো গাল বেয়ে। বাবা পরম স্নেহে আমার মাথায় হাত বুলালেন, “দ্যাখ, তোর সামনে পুরো জীবন পরে আছে। নতুন করে শুরু কর।”
“অতসী কে রেখে আমার পক্ষে বিয়ে করা সম্ভব নয়, বাবা!” ভাঙ্গা গলায় বলেছিলাম।
“আমি আর তোর মা বুড়ো হয়ে গেছি। তোর ভাইদের নিজেদের সংসার হয়েছে। তাই ঠিক করেছি কোন নিঃসন্তান দম্পতিকে দত্তক দিয়ে দেব। অতসী ভালো থাকবে।” আমার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠেছিল, অথচ বাবা কী অবলীলায় কথাটা বলে দিলেন! আমি সব ছিন্ন করে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে পালিয়ে গিয়ে যে ভুল করেছিলাম তার জন্য এতবড় শাস্তি! এত কঠিন শাস্তি! পাশে মা বসে ছিলেন পুতুলের মতো, শুধু চোখে পানি ছিল।
“শোন, তুই আমার সন্তান। তোকে পানিতে ফেলে দেব না। রাজি হয়ে যা। আর এটাতে সিগনেচার করে দে।”
আমি সেটা হাতে নিয়ে আঁতিপাঁতি করে খুঁজছিলাম কোন ঠিকানা লেখা আছে কিনা। কিন্তু একটা উকিলের ঠিকানা ছাড়া কিচ্ছু নেই। শুধু একটা চিরকুট, পাঁচটা শব্দ শুধু তাতে,
“সাইন করে দিও। ভালো থেকো।”।
আর কিচ্ছু নেই। এটা ওরই লেখা, আমি খুব ভালো করে চিনি এই লেখা। যেটুকু আবেগ ছিল ওর প্রতি তা নিমেষে উবে গেল। ওর জন্য জন্ম নিল সম্পূর্ণ বিপরীত এক অনুভূতি ঘৃণা। শুনেছিলাম ভালোবাসা আর ঘৃণার বাস নাকি পাশাপাশি হয়। একটা কমে গেলেই অপরটা জায়গা করে নেই। এই কথার সত্যতা সেদিন জানলাম, নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে। বাবা কলম বাড়িয়ে দিলেন, আমি দৃঢ়চিত্তে স্বাক্ষর করলাম তাতে, এবার আর হাত কাঁপলো না, একদমই না! আমার কথা, আমার মেয়ের কথা যার ভাবনায় নেই, যে দ্বায়িত্ব এড়ানোর জন্য কাপুরুষের মতো পালিয়ে যায়, সে ঘৃণারও যোগ্য নয়! শুধু করুণা করা যায় তাকে!
……….