বিবর্ণ বৈশাখে রংধনু পর্ব -১৩

#বিবর্ণ_বৈশাখে_রংধনু
#নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_১৩
আরহান বাড়ি ফেরার পথে হঠাৎ করে তার খোরগোশটার কথা মনে পড়ায় ছুটে চা বাগানে গিয়েছে। আশেপাশে বেশ কয়েকবার নাম ধরে ডেকেও খোরগোশটার কোনো পদধ্বনি পায় না। আরহান অস্থির হয়ে খুঁজছে তখন তার ফোন বেজে উঠলে পকেট থেকে ফোন বের করে দেখে তার দাদী ফোন করেছে। আরহান রিসিভ করে উৎকণ্ঠিত হয়ে বলে,

“দাদী, আমি একটু পরে কথা বলছি। বনিকে খুঁজে পাচ্ছি না। ওকে যে একা রেখে গিয়েছিলাম। এখন কোথায় যে গেল!”

আয়েশা খানম বলেন,
“ও তো তোর ডাক শুনলেই চলে আসে। ভালো করে খোঁজ।”
“হ্যাঁ খুঁজতেছি। তুমি নাস্তা করে নাও। আমি ওকে খুঁজতে থাকি। বায়।”

আরহান আয়েশা খানমের কল কেটে প্রায় ঘণ্টা দুয়েক খোরগোশটাকে খুঁজে। অতঃপর না পেয়ে সেখানেই বসে থাকে।

_____

রহমত শেখ বাংলোতে ফিরে রেস্ট করে এখন বেলা বারোটা বাজলে নিজের স্ত্রীকে বলেন,
“জাহানারা, রুহানী কি তৈরি হয়েছে?”

“সবে একটু আগে ঘুম থেকে উঠিয়ে এসেছি। রেডি হয়ে যাবে।”

“ওর মা*থাব্যথা কমেছে?”

জাহানারা শেখ জোরপূর্বক হেসে বলেন,
“হ্যাঁ। কমেছে। এখুনি এসে পড়বে।”

জাহানারা শেখ স্বামীকে সকলের ঘটনাটা খুলে বলেননি। তিনি বলেছেন রুহানী মা*থাব্যথার কারণে ঘুমিয়ে আছে।

এদিকে রুহানী ওয়ারড্রব খুলে বেশ চিন্তিত। সে কোন জামাটা পড়বে বুঝে উঠতে পারছে না। অবশেষে নীল গাউন ও কালো থ্রিপিসের মধ্যে কালো থ্রিপিসটাই বেছে নিল। তারপর চুলগুলো খোলা অবস্থায় সেট করে হালকা সাজ বলতে, পাউডার, কাজল ও লিপস্টিক। কানে মাঝারি সাইজের এন্টিক ঝুমকা ও হাতে এন্টিক চুড়ি পড়ে তৈরি হয়ে নিচে গেল। জাহানারা শেখ ওকে দেখে বলেন,

“মাশাআল্লাহ। কারও নজর না লাগুক।”

তিনি রুহানীর কানের কাছে কাজল ছুঁইয়ে দিলেন তাতে রুহানী হালকা হাসে। ছোটো থেকে দেখে আসছে জাহানারা শেখ সবসময় ওদের দুই বোন তৈরি হলে এভাবে কাজল লাগাতেন। এখন রিহা না থাকায় শুধু রুহানীর সাথে করেন। রহমত শেখ হেসে বলেন,

“নজর কা*টানো হলে চলো। আমাদের রুহানী সাজলেও সুন্দর না সাজলেও। চলো তো এবার।”

উনারা রওনা করলেন। বাগানের মাঝের রাস্তা দিয়ে মেইন গেইটের কাছে যাচ্ছে তখন দেখল, দারোয়ান রুষ্ট মনে কিছু একটা হাতে করে নিয়ে আসছেন। রহমত শেখ ড্রাইভারকে গাড়ি বের করতে বলে অপেক্ষা করছেন। এদিকে রুহানী কৌতুহলী হয়ে দারোয়ানের কাছে এগিয়ে গেল। তারপর দেখল দারোয়ানের হাতে একটা বাচ্চা খোরগোশ। রুহানী দারোয়ানকে ইশারায় জিজ্ঞেসা করে,

“কী হয়েছে?”

দারোয়ান রুষ্ট কণ্ঠে জবাব দেয়,
“আপামনি, আমি বাগানের কোনার দিকে বারোমাসি গাজর চাষ করি। এই শ*য়*তা*ন খোরগোশটা আমার বাগানে ঢুকেছে। কই থেকে যে আসলো!”

রুহানী দারোয়ানের কথা শুনে খোরগোশটাকে নিজের কোলে নিল। তারপর ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দারোয়ানকে ইশারায় যেতে বলল। দারোয়ান খোরগোশটাকে ব*কতে ব*কতে চলে গেল। রহমত শেখ রুহানীকে গাড়িতে উঠতে ডাকলে সে খোরগোশটাকে সাথে নিয়ে নিল। দারোয়ানকে দেখে রেগে আছে মনে হচ্ছে। রেগে কোথায় না কোথায় ফেলে দেয়! তাই নিজের সাথেই নিয়ে নিল।

আরহানদের বাড়ির গেইট দিয়ে গাড়ি ঢুকলে প্রথমেই রুহানীর নজর কাড়ে বিশাল বাগানবিলাশের ঝাড়। তিন রঙের বাগানবিলাশের গাছ একসাথে বিধায় গোলাপি, সোনালি ও সাদা এই ত্রিরঙের মিশেলে দারুণ ফুটে ওঠেছে। রুহানীদের গেইটের কাছে গোলাপি বাগানবিলাশটাই শুধু আছে তাও এতো বড়ো ঝাড় না। এতোদিন যত্ন করা হয়নি বলে ওদের বাগানে ফুলের গাছ নিতান্তই কম। কিছু জায়গায় রুহানীরা আসার আগে ফুলসহ গাছ এনে লাগানো হয়েছে।

গাড়ি গিয়ে বাড়ির সামনে থামে। আয়েশা খানম ও আজমল খান ওদের স্বাগতম করতে বাহিরে এসেছে। গাড়ি থেকে সবার নামার পর রুহানী খোরগোশটাকে সাথে নিয়ে নামল। আজমল খান ও আয়েশা খানম সবাইকে উষ্ণ অভ্যর্থনা দেওয়ার পর আয়েশা খানমের নজর খোরগোশটার উপর গেলে তিনি অবাক হয়ে বলে ওঠেন,

“আরে, বনি তোমার কাছে? এদিকে আরহান ওকে লাগাতার খুঁজর না পেয়ে হয়রান।”

কথাটা শুনে রুহানী একবার আয়েশা খানমের দিকে তাকায় তো একবার খোরগোশটার দিকে। জাহানারা শেখ আয়েশা খানমকে জিজ্ঞাসা করেন,

“খোরগোশটা আপনাদের? ওকে দারোয়ান আমাদের বাগানে পেয়েছে। তারপর রুহানী ওকে সাথে করে নিয়ে এসেছে।”

“হ্যাঁ। ও আরহানের বনি। বনির বাবা-মাও এখানে আছে। আরহান সকাল থেকে বনিকে খুঁজে পাচ্ছে না। তোমরা ভেতরে এসো, আমি আরহানকে ফোন করে জানিয়ে দিচ্ছি। ছেলেটা বোধহয় এখনো খুঁজে চলেছে।”

জাহানারা শেখ মুচকি হেসে সম্মতি দিলেন কিন্তু রুহানীর মন খারাপ হয়ে যায়। এটুকু সময়ে খোরগোশ বাচ্চাটা তার বেশ মনে ধরেছে। একে এখন ফিরিয়ে দিতে হবে বলে একটু মন খারাপ করছে। তারপর ওরা বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে। আয়েশা খানম আরহানকে ফোন করে দিলে আরহান দ্রুত বাড়ির পথ ধরে।

খোরগোশটা রুহানীর কোল থেকে নিজেই নেমে গিয়ে নিজের বাবা-মায়ের কাছে চলে যায়। তার পিছু পিছু রুহানীও যায়। আরহানের ঘর! খোরগোশটা আরহানের ব্যালকনিতে থাকে। রুহানী সেখানে গিয়ে দেখল, আরও দুটো খোরগোশ ও বেশ কিছু লাভবার্ড আছে। পাখির মত্ত হয়ে কিচিরমিচির শুনতে শুনতে প্রায় অনেকটা সময় চলে গেছে। হঠাৎ নিজের পেছনে কারও উপস্থিতি বুঝতে পেরে পেছনে ঘুরে দেখে আরহান। আরহানকে নিজের দিকে পলকহীন চেয়ে থাকতে দেখে কিঞ্চিত অস্বস্তিতে পরে যায়। রুহানী পাখির খাঁচাতে মৃদু শব্দ করলে আরহান নিজের দৃষ্টি নিচু করে। অতঃপর বলে,

“থ্যাংকিউ সো মাচ। আমি ভেবেছিলাম বনিকে হারিয়েই ফেলেছি।”

রুহানী বিপরীতে হালকা হাসে। আরহান আবার বলে,
“এখন ঠিক আছ?”

ইশারায় রুহানীর হ্যাঁ বোধক জবাব শুনে আরহানও মৃদু হাসে। রুহানী ঠোঁট নাড়িয়ে বিনা শব্দে বলে,
“আমি যাই তাহলে। ওর খেয়াল রাখবেন। অনেকটা ছোটো।”

“হুম।”

রুহানী সেখান থেকে চলে এসে তার চাচি ও আরহানের দাদীর আড্ডায় বসে। আরহানের দাদী বলছেন,
“ছেলের বউয়ের মৃত্যুর বারো বছর পেরিয়ে গেছে। আমিই এই দুই বাপ-ছেলের সাথে আছি। ছেলেকে প্রথম প্রথম অনেক বলেও আরেকবার বিয়ে করাতে পারিনি। এখন নাতিকে মাঝেমধ্যে বিয়ের কথা বলি কিন্তু সেও কথা উড়িয়ে দেয়। তোমরাই বলো, এই বুড়ো বয়সে কি আমি একা একা পারি? একা একা কাজের লোকদের সাথে থাকি। আর ভালো লাগে না।”

জাহানারা শেখ হেসে বলেন,
“ছেলেরটা শুনেছেন বলে কি নাতিরটাও শুনবেন নাকি? একটা ভালো মেয়ে খুঁজে জোড় করে বিয়ে করিয়ে দিন। আপনার নাতি আবার পাইলট। দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়ায়। আপনি তো সারাদিন একাই থাকেন।”

“আরহানের মাও পাইলট ছিল। কাছে থাকত না কিন্তু ছুটির সময় আমাকে একা ছাড়তেই চাইত না। মেয়েটার অসুস্থতা, মৃত্যু সব এতো দ্রুত হয়েছিল যে কিছু করেও লাভ হয়নি। ওদের তো ছয় মাস অন্তর রুটিন চেকআপ হয়। তখনি ওর ধরা পরে ওর ব্লাড ক্যান্সার। খুব দ্রুত সেটা ছড়িয়ে পরে। আমার ছেলে ওকে সিঙ্গাপুরেও নিয়েছিল। তাও হায়াত না থাকলে কী করা বলো? চলে গেল মেয়েটা। আর আমার হায়াত দেখো!”

কথাগুলো বলে আয়েশা খানম চোখ মোছেন। জাহানারা শেখ নিরবে তাকে স্বান্ত্বনা দিতে থাকেন। ওইযে কথায় আছে না? চোখের জল ছোঁয়াচে! একজনকে দেখে আরেকজনের হৃদয় ব্যথিত হয়। রুহানীর চোখেও অশ্রুকণারা ভীড় জমিয়েছে। যেকোনো সময় গড়িয়ে পরার অপেক্ষা মাত্র।

আরহান নিচে নেমে দেখে তার দাদী চোখ মোছছেন। সে লম্বাশ্বাস ফেলে দাদীর কাছে গিয়ে পেছন থেকে গলা জড়িয়ে ধরে বলে,
“উফ দাদী! এতো কাঁদো কেন তুমি? চোখের পানি বেশি হলে আমাকে ধার দাও। আমার পাখিদের পানির অভাব হবে না!”

“যাহ্ শ*য়*তা*ন!”

দাদীর আলতো মা*রা*র অভিনয়ে আরহান হাসে। ওরা আবার টুকটাক আড্ডায় মেতে উঠলে আরহান গভীর দৃষ্টিতে রুহানীকে দেখতে থাকে। মেয়েটার চোখের কাজল ঈষৎ ছড়িয়ে গেছে। তাতে অবশ্য তাকে আরহানের কাছে অন্যরকম সুন্দর ঠেকছে। আরহানের এই হৃদয়াঙ্গনে বিচরনের মধ্যেই সদর দরজা থেকে এক মেয়েলি স্বর ভেসে আসে।

চলবে ইনশাআল্লাহ,
রিচেক হয়নি। ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here