#বিবি
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (৩)
নিবিড়ের বাবা একজন দিনমজুর। মোল্লাবাড়ির জমিতে হালচাষ করেন। তার একা আয়ে তিনজনের পেট চললেও ঢাকতে পারে না। নিতান্ত বাধ্য হয়ে মোল্লাবাড়ির কর্তা আনিস মোল্লার কাছে স্ত্রীর জন্য একটি কাজের অনুরোধ করেছিলেন। আনিস মোল্লা ভালো মানুষ। অনুরোধ ফিরিয়ে দিলেন না। স্ত্রীলোক বিধায় ক্ষেত-খামারে কাজ না দিয়ে বাড়িতে তার বেগমের কাছে পাঠাতে বলেন। রাবেয়া খাতুন নিজের কাজে না রেখে কোমলের পরিচারিয়া পদে নিযুক্ত দেন। এতে বড়ই খুশি হোন মতিন মিয়া। স্বপ্ন দেখেন, তার ছেলে গ্রাম ছেড়ে শহরে পাড়ি দিচ্ছে। বড় দালানের ভেতর পড়াশোনা করছে। তারপর হুট করে সাদাকোট পরে বলছে, ‘ বাবা, আমি ডাক্তার হয়ে গেছি। তোমার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। ‘
স্বামীর আদেশে কুলসুম নাহার শঙ্কিত হয়। বিপট টের পায়। দ্রুত ছেলের কাছে এগিয়ে বললেন,
” শান্ত হ, বাপ। ভিতরে আইয়া ব। মাথা ঠাণ্ডা হইব। ”
নিবিড় আপত্তি করে বলল,
” আমার কাছে এত সময় নেই। তোমরা আমার সাথে চলো। ”
” কই যামু? ”
” কোমলদের বাড়িতে। বিয়ের কথা বলতে। ”
ছেলের এই উদ্ধত আচরণ মা সহ্য করলেও বাবা সহ্য করতে পারলেন না। স্ত্রীকে একহাতে সরিয়ে অন্যহাতে চড় মেরে বসলেন ছেলের গালে। চিৎকার করে বললেন,
” এহন হাত দিয়া মারছি, আরেকবার কোমলের নাম মুখে নিলে কুঞ্চি দিয়া পিটামু। ভিতরে যা। ”
ধমকের মধ্যেই নিবিড়ের শার্টের কলার চেপে ভেতরের দিকে টান দিলেন। পড়ে যেতে যেতে নিজেকে সামলাল নিবিড়। সেই অবস্থায় দৃঢ় গলায় বলল,
” আমার রক্তে যদি বন্যা বয়ে যায় তবুও সিদ্ধান্ত বদলাবে না। ”
ছেলের এমন মাত্রাতীত সাহস দেখে মতিন মিয়া ভয়ংকর রেগে গেলেন। নিবিড়ের দিকে তেড়ে আসলে কুলসুম নাহার ছেলের একহাত চেপে ধরলেন। জোর করে টেনে আনলেন নিজের রুমে। চৌকিতে বসিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করলেন। বুঝাতে চাইলেন, কোমল উঁচু বংশের মেয়ে। বিশাল সম্পত্তির মালিক। গ্রামের সকলে শ্রদ্ধার চোখে দেখে, সম্মান করে। অন্যদিকে নিবিড়দের ভিটেটুকু ছাড়া কিছু নেই। বাবা-মা দুজনেই কোমলদের নিযুক্ত কর্মচারী। তাদের টাকায় সংসার চলে, নিবিড়ের পড়াশোনার খরচ চলে। কোমলের চেয়ে নিবিড় শুধু বয়সেই ছোট না, সবকিছুতেই ছোট। এমন ছেলের কাছে কোমলকে কেন বিয়ে দিবে? আনিস মোল্লা ভালো মানুষ হতে পারেন কিন্তু বোকা নন।
মায়ের দাঁড় করানো যুক্তিগুলো ধূলোর মতো উড়িয়ে দিল নিবিড়। বলল,
” পরিশ্রমের বিনিময়ে টাকা নেও। এমনি এমনি না। ”
” সুযোগ তো তারাই দিতাছে, তাই না? ”
মায়ের আরও একটি যুক্তিতে বিরক্ত হলো নিবিড়। দাঁড়িয়ে বলল,
” জানি না। ”
” সত্যকে এড়াইয়া গেলে তো হইব না, বাপ। মাথা খাটাইতে হইব। ”
ছেলের দিক থেকে উত্তর না পেয়ে আবার বললেন,
” তোর তো বিয়ার বয়সও অয় নাই। কাম-কাজ কিছু করছ না। পড়ালেখা শিখে ডাক্তার হ। তারপরে তোর জন্য বউ খুঁজমু। পরীর মতো বউ আনমু। দেখবি, পুরা গ্রাম চাইয়া থাকব। ”
নিবিড় এবারও নিরুত্তর থাকলে কুলসুম নাহার উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন,
” থম ধইরা আছস ক্যান? আমি কী কইতাছি বুইঝা ল। ভাইবা দেখ। বড় হইতাছস, দুনিয়া দেখতাছস। সবই বুঝার কথা। ”
নিবিড় মায়ের কাছ থেকে দূরে হেঁটে গেল অস্থিরভাবে। চুপচাপ থাকল কয়েক মুহূর্ত। সহসা পেছন ঘুরে বলল,
” আমি কোমলকে ছাড়া কিছু ভাবতে পারছি না, মা। ক্ষমা করে দেও। ”
এটুকু বলে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে চাইল নিবিড়। কুলসুম নাহার দ্রুত জিজ্ঞেস করলেন,
” কই যাস? ”
” কোমলের কাছে। ”
কুলসুম নাহার দৌড়ে এসে ছেলের পথরোধ করে বললেন,
” তুই কি সত্যি পাগল হইছস? ”
” তোমাদের কাছে যদি সেরকম মনে হয় তাহলে তাই। ”
কুলসুম নাহার পরাজিত মেনে নিলেন না। কান্নার ভাব ধরে বললেন,
” এহন কোমলই তোর সব? আমরা কিছু না? আমগো ভালোবাসার কোনো মূল্য নাই? দাম নাই? ”
” দাম বা মূল্য কোনো নির্দিষ্ট প্রতিপাদ্য বিষয়ের উপর নির্ভর করে না। সময়, পরিস্থিতি আর ব্যক্তির প্রয়োজনের উপর নির্ভর করে। আর এই মুহূর্তে আমার কোমলকে প্রয়োজন। তোমরা কেন বুঝতে পারছ না? ”
নিবিড়ের কণ্ঠে আকুলতা। ভেঙে পড়ার জোয়ার। কাতর কণ্ঠে বলল,
” আমাকে দুর্বল না করে সাহস দাও, মা। আমি হয়তো আমার মনের অবস্থা তোমাদের বুঝাতে পারছি না। ”
ছেলের এমন আকুল প্রার্থনায় মন গলে গেল কুলসুম নাহারের। বললেন,
” কোমল তো তোরে পুরাই পাগল বানাইয়া দিছে। খুব ভালোবাসে তোরে? ”
নিবিড় চোখ তুলে তাকাল মায়ের দিকে। এক মুহূর্ত চুপ থেকে বলল,
” জানি না, মা। ”
” জানিস না মানে? ”
” এ নিয়ে আমাদের মধ্যে কোনো কথা হয়নি। ”
কুলসুম নাহার বিস্ময়াপন্ন হয়ে বললেন,
” তাইলে বিয়ের জন্য পাগল হইছস ক্যান? ”
” পরে যদি সুযোগ না পাই? ”
কুলসুম নাহার কী বলবেন ভেবে পেলেন না। নিবিড় ঘড়ি দেখে বলল,
” সময় নেই, মা। আমার আবার ঢাকায় ফিরতে হবে। আমি এগুলাম। তুমি বাবাকে নিয়ে আসো। ”
নিবিড় সত্যি সত্যি বেরিয়ে গেলে কুলসুম নাহারের চেতন হলো। ছুটে গেলেন স্বামীর নিকট। পায়ে পড়ে বললেন,
” আর অমত কইরো না। আমার লগে লও। ”
মতিন মিয়া বাকরুদ্ধ থেকে ধমকে উঠলেন,
” পোলারে বুঝ দিতে গিয়া নিজেই অবুঝ হইয়া আইছ দেহি। তোমার কী মনে হয়? আমরা বিয়ার প্রস্তাব দিমু আর উনি খুশি হইয়া মিষ্টি বিলাইব? লাত্থি দিয়া বাইর কইরা দিব। গ্রাম ছাড়াও করতে পারে। ”
” তেমন হইলে গ্রাম ছাইড়া দিমু। আমার একটাই পোলা। ওর ভালার লাইগা যদি রক্ত পানি কইরা টাকা কামাইতে পার তাইলে ঝরাতে পারবা না? ”
মতিন মিয়া স্তব্ধ হয়ে গেলেন। স্ত্রীর দিকে ফ্যালফ্যাল চোখে চেয়ে থাকলে কুলসুম নাহার আঁচলখানা কাঁধে টেনে নিয়ে বললেন,
” তুমি না গেলে নাই, আমি যামু। আমি বাঁইচা থাকতে ওরে একা মাইর খাইতে দিমু না। নয় মাস পেটে ধরছি কি একা ছাইড়া দেওয়ার জন্য? মাইর খাইয়া পইড়া থাকার জন্য? ”
কুলসুম নাহার জেদ ধরে ছেলের পিছু ছুটলে মতিন মিয়া বসে থাকতে পারলেন না। কয়েক মিনিট বাদেই বড় বড় কদম ফেলে স্ত্রীর কাছে চলে গেলেন। ফিসফিস করে বললেন,
” আমি যদ্দুর জানি, কোমল পুরুষ মানুষের লগে কথা কয় না। খুব দরকার ছাড়া বাইরে যায় না। বাড়ির ভিতরেও কঠিন পর্দা করে। আমি এত বছর ধইরা মোল্লা সাহেবের লগে আছি, ঐ বাড়ি যাওয়া-আসা করি তাও কোমলের মুখ দেখতে পারি নাই। তোর পোলা ক্যামনে দেখল? ”
কুলসুম নাহার নিচু স্বরে উত্তর দিলেন,
” দেখে নাই। ”
” তাইলে ভালোবাসা-মহব্বত ক্যামনে হইল? ”
” তোমার পোলারে গিয়া জিগাও। আমি ক্যামনে কমু? ”
স্ত্রীর খিটখিট মেজাজে খানিকটা দমে গেলেন মতিন মিয়া। কৌতূহল দমন করতে চেয়েও পারলেন না৷ একটু চুপ থেকে জিজ্ঞেস করলেন,
” এতই যদি মহব্বত তাইলে কোমল বিয়া আটকায় না ক্যান? একের পর এক পোলা তো দেখতে আইতাছে। ”
” সাহস নাই মনে হয়। ”
” তোমার পোলার তো খুব সাহস। বাপ-মাকে গ্রাম ছাড়া করার জন্য উইঠা-পইরা লাগছে! গ্রাম ছাড়া হলেও ভালো, পৃথিবী ছাড়া না হইলেই হয়। ”
কুলসুম নাহার উত্তর দিলেন না। অন্ধকার পথে ছেলের থেকে নিজেদের দূরত্ব কমিয়ে আনছেন কদমে কদমে। মতিন মিয়া একটুক্ষণ চুপ থেকে বললেন,
” কোমলের বিয়ার কথা হইতাছে শুইনাই মনে হয় আমার পোলাডা ছুইটা আইছে। কিন্তু ও শুনল ক্যামনে? ”
কুলসুম নাহার থেমে গেলেন। খুব বেশি পড়াশোনা না থাকলেও বানান করে একটু-আধটু লিখতে পারেন। সে গুণেই ছেলের চিঠির উত্তর দেন মাঝে মাঝে। শেষ চিঠিটায় নিজেদের কথা লিখতে গিয়ে কোমলের কথা লিখে ফেলেছেন। তাকে দেখতে এসে পাত্রপক্ষ কত বড় ঝামেলা করেছিল তা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বর্ণনা করেছিলেন। তাহলে কি এই চিঠিই তাদের কাল হয়ে দাঁড়াল?
” দাঁড়াইয়া পড়লা ক্যান? ”
স্বামীর প্রশ্নে কুলসুম নাহার হালকা ছিটকে উঠলেন। সত্য কথাটা চেপে গিয়ে বললেন,
” কোমলও মনে হয় আমগো মতো চিডি লিখে পাঠায় নিবিড়ের কাছে। সেখান থেইকা জানতে পারছে। ”
” হ, তাই অইব। ”
মতিন মিয়া স্ত্রীর মিথ্যার সাথে মত মিলাইয়া পায়ের গতি বাড়ালেন। তাড়া দিয়ে বললেন,
” তাড়াতাড়ি হাঁটো, পোলারে আগে ঐ বাড়িত ঢুকতে দেওয়া যাইব না। মোল্লা সাহেবের লগে পরথমে আমি কথা কমু। লাত্থি দিলে পরথমে আমিই খামু। ”
#বিবি
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (৪)
কোমল ছোটবেলা থেকেই ডাক্তারি খেলনা দিয়ে খেলত। সাদা জামা, প্লাস্টিকের স্টেথোস্কোপ, হাতে ঘড়ি পরে পুরোবাড়ি উড়ে বেড়াত। বাড়িসুদ্ধ মানুষের চিকিৎসা করার অভিনয় করত গম্ভীরভাবে। খেলা শেষে বিমল হেসে বলত, ‘ বাবা, আমি কিন্তু ডাক্তার হব। ‘ মেয়ের আহ্লাদীপনায় মধুর হাসতেন আনিস মোল্লা। মেয়ের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার সর্ব চেষ্টা করতেন। গ্রামে ভালো উচ্চ বিদ্যালয় না থাকায় জেলা স্কুলে ভর্তি করান। একা যেতে কষ্ট হবে দেখে কোমলের মাকে সাথে পাঠাতেন। মেয়ের সাথে সারাদুপুর বিদ্যালয়ের প্রাঙ্গনেই কাটাতেন রাবেয়া খাতুন। যত্ন-আত্তি হতো বাড়াবাড়ি রকমের। সারাক্ষণ চোখে চোখে রেখেও বিপদ আটকাতে পারলেন না কেউ। একদিন বাড়ি ফেরার পথে দুর্ঘটনার স্বীকার হোন মা-মেয়ে দুজনেই। কোমল ডানপায়ে আঘাত পায়। এক সপ্তাহ হাসপাতালে ভর্তি থেকে ব্যথা সারলেও স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে পারল না। সময়ের সাথে সাথে খুঁড়িয়ে হাঁটায় অভ্যস্ত হয়ে যায়। ঐসময় কোমল দশম শ্রেণির ছাত্রী ছিল। কিছুদিন পরেই এসএসসি পরীক্ষা। শারীরিক ও মানসিকভাবে দুর্বল থাকায় পরীক্ষায় অংশ নেয়নি। তার মনে হয়েছিল পরীক্ষা দিলে ফেল করবে। বাবাকে জানায়, পরের বছর ভালো পড়াশুনা করে পরীক্ষা দিবে। কিন্তু ভাবনার মতো সহজ কাটেনি পরের বছরও। নিজের ত্রুটিতে ভেঙে পড়ে আরও। পড়ালেখায় মন বসাতে পারেনি একদম। একা থাকলেই কেঁদে ফেলত। বাবা সাহস দিতে বলত, ‘ চিন্তা করিস না, মা। তুই মন দিয়ে পড়। আমি কাঁধে করে নিয়ে হলে বসিয়ে দিয়ে আসব। ‘ আশাবাদী বাবাকে দেখলে কোমলের পড়ার গতি আরও কমে যেত। মাকে জড়িয়ে কাঁদত সারারাত। বলত, ‘ আমি ডাক্তার হওয়ার বদলে রোগী হয়ে গেলাম, মা। ‘
বাবার কাঁধে না চড়লেও পাশে বসে পরীক্ষার হলে যেত কোমল। লিখতে পারত না কিছুই। শুধু মনে হতো, ডাক্তার হওয়ার যোগ্যতা হারিয়েছে সে। যদি ডাক্তার হতে না পারে তাহলে পড়ে কী লাভ? ‘ এক বছর পিছিয়ে পরীক্ষা দিয়েও লাভ হলো না। অনুত্তীর্ণ হলো। ফলাফলে একটুও বিচলিত দেখায়নি কোমলকে। সুন্দর করে বাবাকে জানিয়ে দেয়, আর পড়বে না সে। আনিস মোল্লা অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে আরও একবার পরীক্ষার হলে বসিয়েছিলেন মেয়েকে। ভালো ফলাফল না হলেও উত্তীর্ণ হয়েছিল। তিনি চেয়েছিলেন কলেজে ভর্তি করাতে। কিন্তু কোমলের ইচ্ছে ছিল না। আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিল পুরোপুরি। কলেজের পথ অনেক দূরে হওয়ায় আনিস মোল্লাও জোরাজুরি ছেড়ে দিলেন। তারপক্ষে প্রতিদিন যাওয়া-আসা করা সম্ভব নয়। একা ছাড়তেও পারবেন না। দরুন কোমলের পড়ালেখা ওখানেই স্থগিত হলো।
সময়ের সাথে সাথে কোমল সবটা মেনে নিলেও আনিস মোল্লা মনে রাখলেন। সিদ্ধান্ত নিলেন, পেশায় ডাক্তার এমন ছেলেকেই মেয়ের জামাই বানাবেন। তেমন পাত্র খুঁজে পেলেও যুৎসই হচ্ছিল না যেন। সম্পত্তির লোভে প্রস্তাব রাখছিল গ্রামের আশপাশের অনেকেই। আনিস মোল্লা রাজি হচ্ছিলেন না। তিনি নির্লোভ ছেলে চাইতেন। সেরকম ছেলে আবার কোমলকে পছন্দ করছিল না। তারা চায় নিখুঁত আর সুন্দরী বউ। এরকম সময়ে নিবিড়ের বাবার প্রস্তাবে স্থাণু হয়ে পড়লেন। থমথমে কাটিয়ে দিলেন কয়েক মুহূর্ত। দাওয়ার কাছটায় দাঁড়ানো শীর্ণকায় ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বললেন,
” তোদের সাহস দেখে আমি ভাষা হারিয়ে ফেলেছি! এমনটা তো আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারি না, মতিন। ”
মালিকের কণ্ঠস্বরে চাপা রাগের আভাসে তটস্থ হলো মতিন মিয়া। ভীত চোখজোড়া জলে ডুবল। কম্পন পায়ে এগিয়ে এলো আনিস মোল্লার চেয়ারের সামনে। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে হাতজোড় করে বলল,
” মাফ করবেন, মালিক। আমার একটাই পোলা। আপনে তো জানেনই ওর জন্য আমার কইলজা কাইটা দিতেও হাত কাঁপব না আমার। ”
” আমারও কাঁপবে না। ”
আনিস মোল্লার কণ্ঠে স্পষ্ট হুমকি। চোখদুটো জ্বলছে মধ্যাহ্নের সূর্যের মতো। মতিন মিয়া তার পা চেপে ধরলেন। কাতর গলায় আরও একবার ছেলের প্রস্তাব রাখতে চাইলেন, পারলেন না। নিবিড় বিদ্যুগতিতে ছুটে এলো বাবার কাছে। কাঁধে ধরে জোর করে দাঁড় করিয়ে বলল,
” আমরা পাত্রপক্ষ, বাবা। ভিক্ষুক নই। এভাবে সম্মান লুটাচ্ছ কেন? ”
মতিন মিয়া অসহায় দৃষ্টিতে তাকালেন ছেলের দিকে। শাসনের সুরে বললেন,
” তোরে কথা কইতে কইছি? চুপ থাক। তুই চাইছস, আমি দিমু। ক্যামনে দিমু সেটা আমার বিষয়। বাইরে গিয়া দাঁড়া। ”
নিবিড় বাইরে গেল না। কোমলকে চাই সে। যেকোনো মূল্যে। কিন্তু পিতা-মাতার সম্মান ধূলোয় মিশিয়ে নয়। সে দীপ্ত গলায় বলল,
” তোমাদের ভিক্ষে চাওয়ার জন্য সাথে আনিনি। সম্মানের সাথে প্রস্তাব রাখার জন্য এনেছি। রাখা শেষ, এবার যাও। বাকিটা আমি বুঝব। ”
মতিন মিয়াকে কিছু বলার সুযোগ দিল না নিবিড়। তার সামনে এসে দাঁড়াল। আনিস মোল্লার চোখে চোখ রেখে বলল,
” আমার কাছে খবর আছে, আপনি কোমলের জন্য ডাক্তার পাত্র খুঁজছেন। সে হিসেবে আমি আপনার পছন্দ নই, কোমলের যোগ্য নই। কিন্তু আমি কথা দিতে পারি, যোগ্য হয়েই কোমলকে আমার ঘরে উঠাব। আংকেল, আমি কি একটা সুযোগ পেতে পারি না? ”
” কেমন সুযোগ? ”
” কোমল বধূবেশে আমার ঘরেই উঠবে এমন প্রতিজ্ঞা । ”
” কী বলতে চাচ্ছিস, পরিষ্কার করে বল। ”
নিবিড় একটু সময় নিল। নিজের চাওয়াটাকে নিয়ে ভাবল। কিন্তু গোছানো কোনো উত্তর বের করতে পারল না। নিমেষেই অসহায়বোধ হলো অন্তরে। দোষারোপ করতে থাকল ভাগ্যকে। কেন সবকিছুতেই দুর্বল, অযোগ্য হতে হলো?
আনিস মোল্লা খেঁকিয়ে উঠলেন,
” এখনও কথা বলতে শিখলি না, আর বিয়ের জন্য উতলা হয়ে গেছিস। দূর হ চোখের সামনে থেকে। নাহলে কিন্তু…”
নিবিড় কঠিন দৃষ্টি দিলে আনিস মোল্লা মৃদু হাসলেন। বললেন,
” তোর ভেতরটা খুব মজবুত। কঠোর আত্মসম্মানবোধ। কিন্তু জাহির করতে পারছিস না। অভ্যাস নেই তো তাই। যখন অভ্যাস হবে তখন আসিস। আমি কথা বলব। ”
নিবিড় দ্রুত বলল,
” তখন কোমলকে পাব তো? ”
আনিস মোল্লা পুনরায় কঠোর হলেন। অন্তর্নিহিত দৃষ্টি ফেলে নীরব থাকলেন কিছুক্ষণ। সেকেন্ড কয়েক পর বললেন,
” তোর সুযোগ চাই তো? যা, দিলাম। ”
নিবিড় বুঝতে পারল না। অস্থির হয়ে জানতে চাইল,
” কী সুযোগ? ”
” কোমল যদি নিজ থেকে এসে বলে, তোর প্রস্তাবে রাজি। তাহলে আমি মেনে নিব। ”
আনিস মোল্লার হঠাৎ পরিবর্তনে মতিন মিয়া ও কুলসুম নাহার অবাক হয়েছিলেন। এবার তার শর্তে বিস্মিত হলেও খুশি হলেন মতিন মিয়া। তার ধারণা, কোমল আগে থেকেই রাজি। বাবার অনুমতির অপেক্ষায় আছে। গলা এগিয়ে বললেন,
” কইব, এখনই কইব। কোমলমাকে ডাক পাঠান। ”
আনিস মোল্লা আর ভাবনায় গেলেন না। দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা অর্ধাঙ্গিনীর উদ্দেশ্যে বললেন,
” কোমলকে বলো, আমি ডাকছি। ”
স্বামীর আদেশ পেয়েও জায়গা থেকে নড়লেন না রাবেয়া খাতুন। মৃদু স্বরে বললেন,
” কোমল বাইরের কারও সাথে কথা বলে না, তুমি জানো না? ”
” ইচ্ছে না হলে বলবে না। ”
” তাহলে ডাকতে বলছ কেন? ”
আনিস মোল্লা এক পলক তাকালেন নিবিড়ের দিকে। সেদিকে দৃষ্টি ধরে রেখে বললেন,
” একে সুযোগ দিতে। ”
রাবেয়া খাতুন মেয়েকে ডেকে তুললেন। বাবার কাছে পাঠানোর পূর্বে পুরো ঘটনা খুলে বললেন। কেন যেতে বলছেন, সেটাও বাদ রাখলেন না। সবটা শুনে কোমল বরফের মতো জমে গেল যেন। কিছু সময় নিল নিজেকে ধাতস্থ করতে। কয়েক পল পর সহজ গলায় বলল,
” বাবাকে গিয়ে বলো, এত রাতে আমি কারও সাথে কথা বলব না। খুব জরুরি হলে সকালে আসতে। ”
মেয়ের কথায় খুশি হলেন রাবেয়া খাতুন। তুষ্টমনে ফিরে গেলেন স্বামীর নিকট। মেয়ের ইচ্ছের কথা জানাতেই নিবিড় বলল,
” অপেক্ষা করার সময় নেই আমার কাছে। এখনই কথা বলতে হবে। ”
কথাটা উগলে দিয়েই হুড়মুড়ে ভেতরে ঢুকে গেল নিবিড়। কারও বাঁধা মানল না। সোজা হেঁটে গেল কোমলের রুমের সামনে। দরজা খোলা থাকলেও ঢুকল না। বাইরে থেকে বলল,
” আপনার সাথে কথা বলা জরুরি। দয়া করে একটু সময় দিন আমাকে। ”
দরজার কাছে পুরুষ কণ্ঠ পেয়ে চমকে উঠে কোমল। দৌড়ে দরজা ভিজিয়ে দিয়ে দমটা আটকে রাখল। যেন নিশ্বাস ফেললেই তার প্রাণপাখি উড়ে যাবে।
চলবে
[