#বিবি
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (৯)
অনড়ার চুল টেনে ধরে জোর কদমে হাঁটছেন কুলসুম নাহার। চেহারায় ভীষণ রাগ! অনড়া ভয় পাচ্ছে না একটুও। চুলের গোড়ায় ব্যথা পেলেও সে খিলখিল করে হাসছে। অসহ্য হলেন তিনি। বিরক্তে দাঁড়িয়ে পড়লেন। চুল ছেড়ে মাথায় ধাক্কা দিয়ে বললেন,
” তোর কি ডর-ভয় নাই? পাগলের মতো হাসছ ক্যান? ”
অনড়া হাসতে হাসতে বলল,
” তুমি রাগ করলেই আমার হাসি পায়। মজা লাগে। আরেকটু রাগ করো কুলসুম। ”
কুলসুম নাহার চোখ-মুখ কুঁচকে ফেললেন। মাথার মধ্যে থাপ্পড় দিতে চাইলে অনড়া লাফ দিয়ে সরে যায়। জিভ বের করে ভেংচি কাটে। চুলগুলো সামনে এনে নাড়তে নাড়তে পালিয়ে যেতে চায়। তখনই হাত ধরে ফেললেন তিনি। সন্দেহ চোখে বললেন,
” জামার মধ্যে এগুলা কী লাগাইছস? ”
” কোথায়? ”
অনড়ার জামার পেছনের অংশ সামনে টেনে এনে বললেন,
” এগুলা কী? কন থেইকা ভরাইছস? ”
অনড়ার হাসি হারিয়ে গেল। চিন্তায় জড়িয়ে গেল নিমিষেই। আকাল-পাতাল ভাবতে ভাবতে চোখদুটো বড় হয়ে গেল। আচমকা বলল,
” রক্ত! ”
________________
পড়া শেষে কাগজটা ভাঁজ করল কোমল। ব্যান্ডেজের কাগজ দিয়ে মুড়িয়ে নিল। বাক্সের মধ্যে রাখতে গিয়ে একটি পিতলের বাটি নজরে পড়ল। এটার মধ্যেও একটি কাগজ রাখা। কাগজটির উপরে চিকন সুতো দিয়ে প্যাঁচ দেওয়া। কাগজটি যাতে পড়ে না যায় সেজন্য এমনভাবে বেঁধেছে হয়তো। কোমল এটিও তুলে নিল। আস্তে-ধীরে সুতোর প্যাঁচ খুলে কাগজটি আলগা করল। আগেরটির মতো এটিতেও কিছু লেখা আছে৷ কোমল ধীরেসুস্থে পড়তে শুরু করল,
‘ গল্প শুনে কোমলের জন্য মুগ্ধতা আসলেও তার ঝুটা খাবার খেতে আমি নারাজ। তার বাড়িতে আমার মা কাজ করবে এটা মানতে পারছিলাম না। মা আমাকে অনেক বুঝাল। এই মুহূর্তে একাজ ছেড়ে দিলে কত সমস্যা, বিপদ, অভাব দেখা দিবে সেগুলো শুনাল। আমি গোঁ ধরে সুর তুললাম, মায়ের ঐ বাড়ি যাওয়া চলবে না। ঐ বাড়ির খাবার এবাড়ি আনা যাবে না। আমি বান্দির পোলা হতে পারব না। মা কাঁদেন। আমাকে আদর করেন। তবুও আমার মন গলে না। মোল্লাবাড়ি যাওয়া বন্ধ না হলেও খাবার-দাবার আনা বন্ধ হয়ে গেল। বেলা বেলায় ডাল, ভাত, শাকপাতা, পেঁয়াজ, কাঁচামরিচ চলতে থাকে। এমনভাবে কয়েকদিন চলার পর হঠাৎ একটি পিতলের বাটি হাতে নিয়ে এলো মা। আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘তোর লাইগা কোমল নিজ হাতে রানছে। আর কেউ খাই নাই। ‘ আমি বিশ্বাস করতে চাইলাম না। আমাকে বিশ্বাস করানোর জন্য কায়দা ছুঁয়ে বলল, ‘ এই আরবি হরফের কসম। আমি সত্যি কইতাছি, বাপ। এই তরকারিটা শুধু তোর লাইগা রানছে। তোরে খুব পছন্দ করে, ভালাবাসে, আদর করে। রাগ করছস শুইনা নিজে পাকঘরে গিয়া রানছে। তুই খাইছস শুনলে খুব খুশি হইব। ‘ আমি একটু নরম হলাম। বিশ্বাস করলাম। বাটি কাছে টেনে দেখি, আমার প্রিয় মাছের ডিম বোনা। খেতে খেতে শুনলাম, কোমল একটানা তিন বার ক্লাসে প্রথম হয়েছে। সে উপলক্ষে স্কুলের প্রধান শিক্ষক এটা তাকে উপহার দিয়েছিল। কোমল নাকি গর্ব করে মাকে এই গল্পটা প্রায়ই শুনাত। শুনতে শুনতে তার মুখস্থ হয়ে গেছে। তাই আমাকেও শুনাল। আরও জানাল, এই বাটি কোমল সযত্নে তুলে রাখে। কাউকে ধরতে দেয় না। নিজেও কখনও ব্যবহার করেনি। স্মৃতি হিসেবে নতুন, চকচকে করে রেখেছে। আমার রাগ নামাতেই নাকি এটিতে করে তরকারি দিয়েছে। আমি আরও একবার বিস্মিত হলাম, মুগ্ধ হলাম। বুঝে গেলাম কোমল কোনো সাধারণ মেয়ে নয়। সাধারণ মাটিতে গড়া নয়। অজান্তেই মনের একটি সম্মানীয় আসনে বসিয়ে ফেললাম। মায়ের কাছে আবদার করে বসলাম, এই সোনামুখী কোমলের সাক্ষাত পাওয়ার জন্য। মা প্রথমে রাজি হলেন না। আমার ঘ্যানঘ্যানানিতে বিরক্ত হয়ে বললেন, ঐবাড়ির অনুমতি পেলে নিয়ে যাবে। সেই অনুমতি নেওয়ার সুযোগ হলো না। কোমল নাকি এক্সিডেন্ট করেছে। হাসপাতালে ভর্তি। খবর পেয়ে আমি ভারি দুঃখ পেলাম। কষ্ট পেলাম। অপেক্ষা করতে থাকলাম তার বাড়ি আসার। বেশ কয়েকবার তার বাড়ির আশপাশটা থেকে ঘুরে এলাম। প্রতি বেলায় মাকে জিজ্ঞেস করতাম, কোমল বাড়ি এসেছে নাকি। তার এই বাড়িতে না ফেরা আমাকে আরও অধৈর্য্য করে তুলল। পাগলামি করতে বাধ্য হলো। সেই প্রথম আমি ক্লাস ফাঁকি দিলাম। সাহস করে নৌকার বৈঠা ধরলাম। পরীক্ষার ফিস দিয়ে ভ্যান ভাড়া দিলাম। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য! তার সাথে দেখা হলো না। হাসপাতালে পৌঁছে শুনলাম, কোমলকে বাড়ি নিয়ে গেছি! ‘
” কোমলমা? ”
কুলসুম নাহারের গলা পেয়ে চমকে কেঁপে উঠল কোমল। হাত থেকে পিতলরঙা বাটিটা পড়ে গেল বাক্সের মধ্যে। কাগজখানাও ওভাবেই রেখে বাক্স বন্ধ করল ঝটপট। ততক্ষণে অনড়াকে নিয়ে রুমের ভেতর ঢুকে পড়েছে কুলসুম নাহার। নালিশ দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল,
” এই দেহ, জামাকাপড়ে রক্ত মাইখা সারাবাড়ি ঘুইরা বেড়াইতাছে। ”
অনড়ার কোমরের দিকে তাকাল কোমল। লাল রঙের ছোপ ছোপ দাগ দেখে আতঙ্কিত হলো। উদ্বেগ নিয়ে জিজ্ঞেস করল,
” কিভাবে হলো? ”
অনড়া দুর্বল স্বরে বলল,
” জানি না, বুবু। সকাল থেকেই ব্যথা করছে শরীরটায়। কিন্তু ব্যথার স্থান খুঁজেই পাচ্ছি না। এখন তো রক্তও বের হচ্ছে! ”
অনড়ার চোখে-মুখে ব্যথা, ভয়। চাহনিতে অসহায়ত্ব! কোমলের ভারি মায়া হলো। সহানুভূতি প্রদর্শনে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। অনড়াকে কাছে টেনে নিয়ে সান্ত্বনা দিল,
” ভয় নেই। এই ব্যথা, বড় হওয়ার ব্যথা। ”
অনড়া বুঝতে পারে না। ফ্যালফ্যাল চোখে চেয়ে থাকলে মুচকি হাসে কোমল। কুলসুম নাহারকে বিদায় করে বড় হওয়ার ব্যথার সাথে আরও ভালো করে পরিচয় করিয়ে দেয়। ব্যথাকে যত্ন করার নিয়ম-কানুন শিখিয়ে দেয়।
______________
” তোমার কাপড় ভিজাইয়া রাখছিলাম যে, কই গেল? ”
কোমল ভেজা চুল থেকে তোয়ালে খুল বলল,
” শুকাতে দিয়েছি। ”
” ধুইয়া রাখি নাই তো। ”
” আমি ধুয়েছি। ”
” তুমি ধুইছ ক্যান, এগুলা তো আমার কাম। ”
কোমল সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল না। কাপড়ের পাশে তোয়ালেটা মেলে দিয়ে বলল,
” গোসল করতে ঢুকেছিলাম, তাই ধুয়ে ফেলেছি। আমারই তো কাপড়। ”
কুলসুম নাহার মলিন মুখে বইয়ের তাকের দিকে এগুলো। বইয়ে হাত দিতেই কোমল বলল,
” সব ঠিকঠাক জায়গায় আছে। তোমাকে ধরতে হবে না। ”
কুলসুম নাহার অবাক চোখে তাকিয়ে রইলেন। কোমল বিছানায় এসে বসলে বললেন,
” তুমি সব কাম কইরা রাখলে আমি কী করুম? ”
” গল্প করবেন। এখানে বসেন। ”
কুলসুম নাহারকে টেনে পাশে বসাল কোমল। মুখের দিকে চেয়ে থেকে বলল,
” আপনার কী হয়েছে? ”
” আমার আবার কী হইব? ”
” কিছু একটা তো হয়েছে। কয়েকদিন ধরে খেয়াল করছি, আপনার মন ভালো নেই। সবসময় মনমরা থাকছেন। ”
কুলসুম নাহার চোখ নামিয়ে নিলেন। উদাস দৃষ্টি রাখলেন দূরের দেয়ালটায়।
” কী হয়েছে, কাকিমা? ”
কুলসুম নাহারের চোখদুটো ঝাপসা হলো। একটা গভীর নিশ্বাস টেনে বললেন,
” ক্ষিধা লাগছে না তোমার? খাইবা চলো। ”
কোমলকে তাড়া দিয়ে বেরিয়ে গেলেন তিনি। সে থম মেরে বসে থাকল। একটা গভীর চিন্তা দাগ কেটে গেল মস্তিষ্কে। হয়তো কারণটা সে ধরতে পেরেছে।
______________
খুব প্রয়োজন ছাড়া কোমল বাড়ি থেকে বের হয় না, এ ব্যাপারটি জানেন আনিস মোল্লা। তাই মেয়ে বাইরে বেরুতে চাইলে প্রশ্নও করেন না। কিন্তু রাতের বেলা বের হওয়ার কারণটা জানতে চাইলেন। কোমল নির্ভয়েই বলল,
” ঐবাড়ি যাব, বাবা। একটু দরকার ছিল। ”
আনিস মোল্লা বুঝে গেলেন ‘ ঐবাড়ি ‘ মানে নিবিড়দের বাড়ির কথা বুঝিয়েছে।
” হঠাৎ ঐবাড়ি? ”
” কাকিমার সাথে একটু জরুরি কথা ছিল। ”
” কাল সকালেই তো আসবে। তখন বলিস। ”
কোমল চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে তিনি বললেন,
” আচ্ছা, যা। মাকে সাথে নিবি? ”
” আমি একা যেতে চাচ্ছিলাম। ”
আনিস মোল্লা একটুক্ষণ নীরব থাকলেন। মেয়ের উপর তার অগাধ বিশ্বাস, ভরসা। তার ধারণা, কোমল বিচার-বিবেচনায়ও দারুণ পটু, জ্ঞানী। তাই কোনো ব্যাপারে সন্দেহ করেন না। পাঞ্জাবি কাঁধে নিয়ে বললেন,
” চল, আমি একটু এগিয়ে দিয়ে আসি। ”
_____________
কুলসুম নাহার ভাতের মার গালছিলেন। তখনই আগমন ঘটল কোমলের। তিনি যারপরনাই বিস্মিত হলেন। ভাতের হাড়ি রেখে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন অদ্ভুত ভঙ্গিতে।
” তুমি এইবাড়িতে? ”
তার কণ্ঠে পৃথিবী মাপের বিস্ময়, অবিশ্বাস। কোমল হালকা হাসল। রান্নাঘরে ঢুকে বলল,
” গল্প করতে এলাম। ”
কোমল ভাতের হাড়ির ঢাকনা খুলল। গরম ধোঁয়া বের হলে বলল,
” আপনারা এখনও খাননি? ”
” না, তোমার কাকা গোসলে গেছে। আসলে একলগে খামু। ”
কোমল দুটো থালা নিল। চামচ খুঁজে বের করল। ভাত বাড়তে নিলে কুলসুম নাহার ছুটে এলো কাছে। চামচ কেড়ে নিয়ে বললেন,
” কী করো এইসব? উঠো এহান থেইকা। ঘরে আসো। ”
কোমলকে জোর করে রান্নাঘর থেকে বের করলেন তিনি। শোবার রুমে এনে বসতে দিলেন। সেসময় মতিন মিয়া বাইরে থেকে বললেন,
” কার লগে কথা কও, আমার পোলা আইছে নাকি? ”
বলতে বলতে ভেতরে ঢুকলেন মতিন মিয়া। নিবিড়ের বদলে বোরকা পরিহিতা মেয়ে দেখে হতাশ হোন। আশা ভাঙে। রুম থেকে বেরিয়ে যেতে ধরলে কোমল বলল,
” এজন্যই আপনার মনখারাপ। তাই না, কাকিমা? ”
কুলসুম নাহার এড়িয়ে যেতে পারলেন না। চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বললেন,
” একটা বছর হইয়া গেল, পোলাডারে দেখি না। কথা কই না। আগে তো চিডি পাইতাম। এহন সেটাও পাই না। আল্লাহই জানে বাঁইচা আছে নাকি…”
কথাটুকু শেষ করতে পারে না নিবিড়ের মা। কোমল তার হাতদুটো ধরে বলল,
” তাকে বলেছিলাম কোমলকে ভুলে যেতে, তার সাথে যোগাযোগ না রাখতে। কিন্তু সে! গ্রামের সাথেই যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। ”
একটু থেমে আবার বলল,
” দেখা করতে যাবেন? ”
কুলসুম নাহার ভেজা চোখদুটো মেলে তাকালেন। কোমল নরম স্বরে বলল,
” আমি সব ব্যবস্থা করে এসেছি। আপনারা তৈরি হোন। ”
চলবে#বিবি
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (১০)
” এই ডিমটুকু রান্না করে সঙ্গে নিয়ে যাবেন। ”
কুলসুমের হাতে বাটিটা তুলে দিল ভীষণ আড়ষ্টতায়। সাগর সমান অস্বস্থিতে ডুবে যাচ্ছে যেন! চঞ্চল মনিদুটো এদিক-ঐদিক ঘুরিয়ে বলল,
” আমি রেঁধেই আনতে চাচ্ছিলাম। পরে মনে হলো, আপনার ছেলে যদি খাওয়ার পর বুঝে যায় এটা কোমলের রান্না? তাই এভাবেই আনলাম। ”
” বুঝলে কী হইব? রাগ তো করব না, খুশিই হইব। ”
কুলসুম নাহারের সরল শব্দ বিন্যাসে মনিদুটো স্থির হলো কোমলের। মৃদু হেসে বলল,
” আমি চাই না সে কোমলকে মনে করুক। শর্ত ভাঙুক। ”
কুলসুম নাহারের সরলভাব কাটল। ছায়ার মতো পর্দা পড়ল মুখটায়। মনখারাপ ফিরে এলো ভাবভঙ্গিতে। পরিতাপ উপস্থিত হলো চোখের কোলে, মনের উঠানে।
” আপনারা গুছিয়ে নিন সবকিছু। আমি বাইরে অপেক্ষা করছি। ”
” তুমিও যাইবা আমগো লগে? ”
কোমল কালো রঙের নিকাবটা ঠিকঠাক করতে করতে বলল,
” বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত যাব। ”
কুলসুম নাহার আশাহত হলেন। পরমুহূর্তেই উদ্বেগ নিয়ে বললেন,
” এতদূর যাইবা? কষ্ট হইব তোমার। ”
কোমল খেয়াল করল কুলসুম নাহার তার পায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। ম্লান হেসে বলল,
” আগে হাঁটলে ব্যথা করত। এখন করে না। ”
নিজের পায়ের দিকে এক পলক তাকিয়ে আবার বলল,
” পায়ে সমস্যা হওয়ার পর ঐদিকটায় আর যাওয়া হয়নি। আপনাদের এগিয়ে দেওয়ার বাহানায় ঘুরাও হয়ে যাবে। ”
কোমলের কণ্ঠে অপ্রকাশ্য ব্যথা, পীড়া। কুলসুম নাহারের মনটা মায়ায় ভরে গেল। সহানুভূতির চাহনি ফেলে নীরব থাকলেন কয়েক পল। সহসা বললেন,
” তুমি একলা ফিরবা? ”
” না, আমাদের সাথে মোহন কাকা আর কাকি যাবে। মোহন কাকার সাথে আপনারা বাসে উঠলে আমি কাকিকে নিয়ে ফিরে আসব৷ ”
দীর্ঘ সময় পর ছেলের সাথে দেখা করতে যাচ্ছেন মতিন মিয়া। খুশিতে ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ঝুলে আছে। চারপাশের অন্ধকারটাও তার কাছে অদ্ভুত সুন্দর আর প্রশান্তি ঠেকছে। ঠিক যেমনটা নিবিড় পৃথিবীতে ভুমিষ্ঠ হওয়ার পর লেগেছিল। কৃতজ্ঞতায় তাকালেন একহাত দূরে থাকা কোমলের দিকে। একদিকে বাঁকা হয়ে হাঁটা নরম মনের মেয়েটার জন্য হতাশ হলেন। একরাশ দুঃখরঙা মেঘ ছুঁয়ে দিল মনটায়। মুক্তমনে প্রার্থনা করলেন খোদার নিকট। ‘ মেয়েটা খুশি থাকুক সবসময়। ‘
________________
কুলসুম নাহার আর মতিন মিয়া ঢাকা পথে পৌঁছেলেন ভোরের দিকে। সেই পথ শেষ করে নিবিড়ের মেসে উপস্থিত হতে হতে সে ক্যাম্পাসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েছে। দুলাল হায় হায় করতে করতে তাদের বসতে দিলেন। নাস্তার ব্যবস্থা করলেন ভীষণ ব্যস্তসমস্তে। দুপুরে অতিরিক্ত দুজনের খাবারের কথা বাবুর্চিকে বলেই নিবিড়ের খোঁজে বেরিয়ে পড়লেন।
বাবা-মায়ের খবর শুনে গুরুত্বপূর্ণ ক্লাসগুলো ফেলেই ছুটে আসে নিবিড়। জন্মদাতা ও জন্মদাত্রীর মায়াময় মুখদুটো দৃষ্টি সীমায় আসতেই ভেতরটা নড়ে উঠল। অদ্ভূত আনন্দ ছড়িয়ে পড়ল রক্তকণিকায়। চোখের কোলদুটো টলমল হতে গিয়েও হলো না। সন্তর্পণে সামলে নিল নিজেকে। ভীষণ তৃপ্তি নিয়ে ডাকল,
” মা! ”
” বাব! ”
বাবা-মা দুজনেই ছেলেকে জড়িয়ে ধরলেন। পরম আদরে, স্নেহে ভরিয়ে দিতে চাইলেন সন্তানের হৃদয়, শুকনো বুক। ভালোবাসার অশ্রু বাধহীন বয়ে চলল কপোলজোড়ায়।
ভালোবাসা দেওয়া-নেওয়া শেষে কুলসুম নাহার ছেলেকে বললেন,
” চিডি দেস না ক্যান? চিন্তা হয় না আমাগো? ”
মায়ের কণ্ঠে চাপা অভিমান, মৃদু রাগ। মায়ের একহাত ধরে নরম স্বরে বলল,
” জরুরি কিছু ছিল না, মা। তাই লিখিনি। সেরকম হলে অবশ্যই লিখব৷ রাগ করো না। ”
কুলসুম নাহারের মন গলেনি। ছেলের দিকে তাকাচ্ছে না। নিবিড় হাতটা আরেকটু শক্ত করে ধরে বলল,
” তুমি তো চিঠি লিখছই, মা। এতেই চলবে। ”
নিবিড় মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকলেও দৃষ্টি হারিয়ে গেল অন্য কোথাও। কালো রঙে আবৃত একটা মুখ মনের চার প্রকোষ্ঠে উঁকি মারছে। বড্ড জানতে ইচ্ছে করছে তার কথা। এই জ্বালাতনকে দূরে রাখার জন্যই তো সে চিঠি লিখে না। যদি ভুল করে তার কথা লিখে ফেলে? নিবিড় গভীর নিশ্বাস টানে। মায়ের থেকে সরে আসে বাবার কাছে। অসহায় চাহনি রেখে বলল,
” মাকে বুঝাও না, বাবা। ”
চোখের পলক ফেলে ছেলেকে আশ্বাস দিলেন মতিন মিয়া। তারপর বললেন,
” ডাক্তারি পড়া শেষ হইব কবে? ”
” দেরি আছে, বাবা। আরও চার বছরের মতো সময় লাগবে। ”
” আচ্ছা, তুমি মন দিয়া পড়ালেহা করো। বাকি সব আমি সামলাইয়া নিমু। ”
___________________
দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার পর বাবা-মাকে বাসে তুলে দেয় নিবিড়। তারপর ফিরে যায় ক্যাম্পাসে। সেখানে সময় কাটিয়ে মেসে ফিরে সন্ধ্যার দিকে। হাত-মুখ ধুয়ে পড়তে বসার কিছুক্ষণ পরেই দুলাল আসে। বিছানায় শুয়ে বলেন,
” আন্টির হাতের রান্না কিন্তু খুব টেস্টি। ”
” অনেক দিন পর বাড়ির রান্না খেলে অমন লাগেই। ”
” অনেকদিন পর কোথায়? আমি তো প্রায়ই তুলির হাতের রান্না খাই। পরশুদিনও তো খেলাম। তোর মনে নেই? ”
নিবিড়ের মনে আছে। দুলাল ভাই বিয়ে করার পর মাঝেমাঝে তুলির রান্না করা এটা-সেটা নিয়ে আসে। এক অংশ নিবিড়ের পাতে দিয়ে খোশমেজাজে বলেন, ‘ আমার বউয়ের হাতের রান্না খা। খুব টেস্টি। ‘
” ডিম বোনাটা এত ভালো হয়েছে! স্বাদটা এখনও জিভে লেগে আছে। নদীর মাছ মনে হয়, তাই না? ”
” না, পুকুরের চাষ করা মাছ। ”
” আন্টি বলেছে? ”
” না। ”
” তাহলে বুঝলি কী করে? ”
নিবিড় উত্তর দিল না। টেবিলে রাখা বাটিটা হাতে নিল। মধুর হেসে মনে মনে বলল, ‘ রান্নাটা মায়ের হলেও, খেয়ালটা তোমার। তাই না, কোমল? ‘ নামটা উচ্চারণ করেই জিভে কামড় দিল নিবিড়। ভারি অন্যায় করে ফেলেছে এমনভাবে নিজেকে বকল। তারপর আবার বিড়বিড় করল, ‘ কোমলকে ভুলে যাওয়ার চেয়ে সহজ শর্ত ভাঙা। নতুন শাস্তিটা নাহয় সেদিন নিব যেদিন দুলাল ভাইকে তোমার রান্না খাওয়াতে পারব। প্রাণ খুলে বলতে পারব, ‘ আমার বউয়ের রান্না খান। খুব টেস্টি। ‘
_______________
নিবিড়ের বাবা-মায়ের ফেরার অপেক্ষায় ছিল কোমল। সারাদিন নিজ বাড়িতে থাকলেও সন্ধ্যার দিকে তাদের বাড়িতে এসে ওঠে। শূন্যবাড়ির ছোট্ট উঠানটায় আরও কিছুক্ষণ প্রতিক্ষার পর তাদের আগমন ঘটে। কথাবার্তার একফাঁকে কোমল বলল,
” বাটিটা ফেরত এনেছেন? ”
কুলসুম নাহার অবাক চোখে তাকালেন। কোমলের দয়ার শরীর। কাউকে কিছু দিয়ে ফেরত চাওয়া তার অভ্যাসে নেই। তাহলে সামান্য একটা বাটির জন্য এমন উতলা দেখাচ্ছে কেন?
কোমল অস্থিরচিত্তে বলল,
” আনেননি? ”
” আনছি। ”
কুলসুম নাহার ঢাকায় বয়ে নেওয়া ব্যাগটা হাতিয়ে বলল,
” পাইতাছি না ক্যান? আমার তো ভালা করেই মনে পড়ছে, বাটিডা ব্যাগে ঢুকাইছিলাম। ”
কোমল নিজেও ব্যাগটা ঘাটল। তীব্য হতাশ হয়ে বলল,
” আমারই ভুল হয়েছে। ”
” কী ভুল? ”
কোমল উত্তর দিল না। রাতের আবছা অন্ধকারে দূর রাস্তাটায় হারিয়ে গেল ধীরে ধীরে।
_______________
দুলাল অফিস শেষ করে ক্লান্ত শরীরে মেসে ফিরতেই নিবিড় জিজ্ঞেস করল,
” আপনি কি এখান থেকে কোনো কাগজ ছিঁড়েছেন? ”
নিবিড়ের হাতে একহাত সমান একটি ডায়রী। সেখানে তাকিয়ে থেকে পাল্টা প্রশ্ন করল,
” কেন? কী হয়েছে? ”
নিবিড় ডায়রী খুলল দ্রুত। ভেতরটা দেখিয়ে বলল,
” এখানে একটা পাতা ছেঁড়া। ”
দুলাল খুব একটা পাত্তা দিল না। ঘামে ভেজা শার্ট খুলতে খুলতে বলল,
” হ্যাঁ, ছিঁড়েছিলাম। ”
” কী করেছেন সেটা দিয়ে? ”
” একটা পাতার জন্য এমনভাব করছিস যেন তোর গলা কেটে ফেলেছি। ”
” অনেকটা সেরকমই, দুলাল ভাই। ”
দুলাল একটু মনোযোগী হলো। গুরুত্বে দেখিয়ে বলল,
” আসলেই? ব্যাপার কী? খুলে বলতো। ”
” এটা আমার হিসেবের খাতা। ঐ পাতায় গুরুত্বপূর্ণ কিছু হিসেব ছিল। ”
দুলাল একটু চুপ থেকে বলল,
” কাগজটা তোর মায়ের কাছে আছে। আশা করছি যত্নেই রেখেছে। ”
” মায়ের কাছে? কিভাবে গেল? ”
” আমার ফোন নাম্বার লিখে দিয়েছি। এতদূর থেকে এসেছেন দেখে আমার খুব মায়া হলো। নাম্বার দিয়ে বলেছি, খুব দরকারি কিছু হলে আমাকে কল দিতে। তোর সাথে কথা বলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করব। ”
” বাবা-মা কল দিবে কী করে? মোবাইল নেই তো। ”
” উনাদের কাছে নেই তো কী হয়েছে? বাজারে তো আছে। গ্রামের কারও না কারও কাছেও আছে। প্রয়োজন হলে ঠিক যোগাড় করে নিবে। ”
নিবিড়ের সাথে আরও কিছুক্ষণ কথা বলার পর দুলাল জানতে পারল, ওখানে দেনার টাকার হিসেব ছিল। যেগুলো সে ভবিষ্যতে শোধ দিবে। দুলাল হাত-মুখ ধুতে যাওয়ার সময় বলল,
” চিন্তা করিস না, আন্টি নাম্বারটা যত্ন করেই রাখবে। আর নাম্বার যত্ন করে রাখা মানে কাগজটাও যত্নে থাকা। তারপরও যদি না পাস তাহলে ভাববি, ঋণ দেওয়া সেই মানুষটি হয়তো চান না তুই ঋণ পরিশোধ করিস তাই হিসেব হারিয়ে গেছে। ”
_______________
মোল্লাবাড়ির ফসল তুলতে গিয়ে মাথা ঘুরে পড়ে গেছেন মতিন মিয়া। তাকে ধরাধরি করে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছে। কয়েক ঘণ্টা পেরিয়ে যাওয়ার পরও জ্ঞান না ফেরায় জেলা হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করেন আনিস মোল্লা। স্বামীর এই অবস্থায় কুলসুম নাহার মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন খুব। মনের জোর হারিয়ে ফেলেন। কেঁদেকেটে বুক ভাসিয়ে স্বামীর সাথে হাসপাতালে যাচ্ছিলেন তখন চিৎকার করে বলেন,
” কেউ আমার পোলাডা রে খবর দেও। ”
নিবিড়কে খবর দেওয়ার দায়িত্ব নিতে হলো কোমলকেই। কুলসুম নাহারের যত্নে রাখা নাম্বারটি খুঁজে এনে বাবার হাতে দেয়। তিনি কল করে খবর দেন।
ডাক্তারের চিকিৎসায় মতিন মিয়ার জ্ঞান ফিরে। ওষুধপত্র লিখে দিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়। তারা ফিরে আসলে কোমল দেখতে যায় মাকে নিয়ে। কুলসুম নাহারকে একা রেখে আসতে মন সায় দিচ্ছিল না। তাই আরও কিছুক্ষণ থাকার কথা ভাবে। বাড়ি থেকে কিছু রান্না-বান্না করে পাঠিয়ে দেওয়ার কথা বলে মাকে ফেরত পাঠাচ্ছিল তখনই একটি পরিচিত পুরুষ কণ্ঠস্বর শুনতে পেল,
” বাবা কেমন আছে, কোমল? ”
চলবে