#বিবি
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (১৯)
দুলালের চিঠি পেয়ে দুশ্চিন্তার সম্পূর্ণ ভাগ দূর হয়ে গেল নিবিড়ের। কোমলের আগমন হঠাৎ হলেও ফেরত পাঠানোর মতো সিদ্ধান্ত এক কণাও আসেনি। দুটো পুরুষের সঙ্গে রাখা যেমন অনৈতিক, দুলাল ভাইকে অন্যত্র রাতযাপনের আর্জি করাও পীড়াদায়ক বোধ হচ্ছিল। দুশ্চিন্তা দূর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মনের আধভাগ অশান্তিও দূর হলো। মেজাজ হলো ঠাণ্ডা ও ফুরফুরে। ধ্যান-জ্ঞানে শুধুই কোমলকে ঠাঁই দিতে পারল সহজেই। নিবিড় খোলা বইয়ের মধ্যে পত্রখানা চাপা দিয়ে তাকাল কোমলের দিকে। সে পুরোনো মিষ্টি প্যাকেটের মধ্যে কাঁচামরিচ বেছে রাখছে। ছোট্ট মাথাটার গোটা ধ্যানটুকুই যেন ওখানে আবদ্ধ। তার ভারি অভিমান হলো। বেশ ঠাণ্ডা স্বরে বলল,
” গ্রামে বুঝি কাঁচামরিচের ভীষণ অভাব? সেজন্য শহরে এসেছেন, কাঁচামরিচ বাছতে। বাছা শেষ হলে আমাকে বলবেন, আমি যাদুঘরে সাজিয়ে দিয়ে এসে আপনাকে কৃতার্থ করব। ”
কোমল থতমত খেল। বোকা চোখে চেয়ে থেকে তটস্থ হলো। দুভাগে আলাদা করা কাঁচামরিচগুলো একসাথে করল দ্রুত। রান্নাঘরে রেখে এসে বলল,
” শুধু শুধু বসে থাকতে ভালো লাগছিল না, তাই….”
কথাটুকু শেষ করতে পারল না সে। সংশয়ে ভরা কণ্ঠস্বর থামিয়ে দিল নিজ উদ্যোগে। নিবিড় সেকেন্ডের খণ্ডাংশ সময় চুপ থেকে সুধাল,
” তারমানে আপনি কাঁচামরিচ বাছতে আসেননি? ”
” না। ”
” তাহলে? ”
” তোমার রাগ ভাঙাতে। ”
” তাহলে ভাঙাচ্ছেন না কেন? ”
কোমল অস্বস্থিতে কাদা হয়ে যাচ্ছে যেন। মনিদুটো চঞ্চলতায় এদিক-সেদিক ঘুরছে। দূরের কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা স্ত্রীটিকে দেখে চাপা হাসি উদয় হচ্ছে নিবিড়ের ওষ্ঠদ্বয়ে। একস্থির নির্মল দৃষ্টি জোড়া আবিষ্কার করল, তার স্পষ্টবাদী কোমল অস্পষ্টতার আবরণে ঢাকা পড়ছে ধীরে ধীরে। চাহনিতে দুর্বলতা, আচরণে আড়ষ্টতা প্রমাণ করে দিচ্ছে, নিবিড় তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ কেউ। এই গুরুত্বপূর্ণকে প্রশ্রয় দিতে গিয়ে কোমল হয়ে পড়েছে ভীত, দ্বিধাগ্রস্থ।
কোমল অস্থির চোখদুটোকে জোর করে স্থির করল। নিবিড়কে সপ্রশ্নে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলল,
” চেষ্টা করেছি, কাজ হয়নি। ”
নিবিড় অবাক হওয়ার ভান করে বলল,
” কী এমন চেষ্টা করলেন যে কাজ হলো না? শুনি আপনার চেষ্টাগুলো। ”
কোমল সংকোচভর্তি গলায় বলল,
” সেধে কথা বলেছি, ঘর গুছিয়ে দিয়েছি, রান্না করে খায়িয়েছি, গুরুত্বপূর্ণ একটি কাগজ কুড়িয়ে দিয়েছি। ”
নিবিড় চোখ বড় বড় করে বলল,
” এগুলো রাগ ভাঙানোর চেষ্টা? ”
” আমি এভাবেই রাগ ভাঙাই। ”
” তাই নাকি? কার কার রাগ ভেঙেছেন? ”
” বাবার, মায়ের, অনুর। ”
নিবিড় আর প্রশ্ন করল না। সে নিজ দায়িত্বে বুঝে নিল, কাগজ খুঁজে দিয়ে বাবার রাগ, হাতে হাতে কাজ করে দিয়ে মায়ের রাগ ভাঙায় কোমল। এগুলো স্বাভাবিক ব্যাপার। বাবা-মায়ের রাগ এমনিতেও বেশিক্ষণ টিকে না। তবুও তারা সন্তানকে খুশি করার জন্য রাগ ভেঙেছে এমন অভিনয় করে। বাবা-মায়ের মতো নিবিড়ের রাগও টিকেনি। তবুও সে স্বাভাবিক ব্যাপারগুলো দিয়ে রাগ ভাঙানোর অভিনয় করবে না। বিশেষ কিছু চাই তার। এই সুযোগে নাহয় যাচাই-বাছাই হয়ে যাক স্ত্রীর অদেখা গুণের। নিবিড় চেয়ার ছেড়ে উঠল। বিছানায় শরীরটা মেলে দিয়ে বলল,
” আমি রাগ না করলেও আপনি একাজগুলো করতেন। করতেন না? ”
নিবিড়ের প্রশ্নে কোমল মাথা নেড়ে সম্মতি দিলে সে আবার বলল,
” তাহলে এগুলো রাগ ভাঙার চেষ্টা কী করে হলো? সেজন্যই আমার রাগ ভাঙেনি। ”
” তাহলে কীভাবে ভাঙবে? ”
” খুঁজে বের করুন। মায়ের মুখে শুনেছি, কোমল খুব বুদ্ধিমতি। চট করে সমস্যার সমাধান বের করে ফেলে। আর আমার বেলায় সামান্য রাগ ভাঙতে পারছে না। আমি কি মায়ের চোখে দেখা সেই কোমলের দেখা কখনও পাব না? ”
নিবিড়ের কণ্ঠে বিশাল ওজনের আফসোস। কোমলের খুব ইচ্ছে হলো সেই কোমলকে সামনে এনে নিবিড়ের আফসোস দূর করে দিতে। সেই উদ্যোগ বাস্তবায়নের জন্য খুব তৎপর হলো সে। এযাপত অর্জন করা বিদ্যা, জ্ঞান, অভিজ্ঞতাকে এক করে খুঁজতে লাগল নিবিড়ের রাগ ভাঙানোর উপায়। ভাবনায় ডুবে বহুসময় পার করে ফেলল। নিবিড় অপেক্ষা করতে করতে ধৈর্যচ্যুত হলো। গলা উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল,
” পেলেন কিছু? ”
কোমল ভাবতে ভাবতে রান্নাঘরে দাঁড়িয়েছে কখন খেয়াল নেই। সেখান থেকে ধীরপায়ে এগিয়ে আসল। ব্যর্থ কণ্ঠে বলল,
” না। ”
” তাহলে আর কী, শুয়ে পড়ুন। ”
” রাগ না ভাঙিয়েই? ”
” এছাড়া তো উপায় দেখছি না। চেষ্টাটুকু কালকের জন্য থাক। ”
” আচ্ছা। ”
কোমল মলিন মুখে দাঁড়িয়ে থাকলে নিবিড় আবার বলল,
” আপনি কি দাঁড়িয়ে ঘুমান? ”
” না তো। ”
” তাহলে শুচ্ছেন না কেন? ”
” কোথায় শুব? ”
” এ রুমে তো আমি শুয়েছি। আপনি পাশের রুমে শুয়ে পড়ুন। ”
কোমল এতটাই বিষণ্ণতায় ভুগছিল যে নিবিড়ের কৌতুকপূর্ণ বাক্যটি ধরতে পারল না। বেখেয়ালি হয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর হুঁশ এলো। জিভ কেটে চোখদুটো বুজে ফেলল। লজ্জায় তাকাতে পারল না নিবিড়ের দিকে। নীঃশব্দে পুতুলের মতো হেঁটে গিয়ে বসল নিবিড়ের অন্যপাশে। উল্টো দিকে মুখ করে ভিন্ন বালিশে মাথা রাখল। নিবিড় ঠোঁট টিপে হেসে বলল,
” শুনেছি, বিয়ে হলে নাকি বোকা মেয়েটাও চালাক হয়। গোবর মাথায় বুদ্ধিরা বুদবুদ করে। আর বাস্তবে দেখছি উল্টোটা। আচ্ছা, আমার বেলায় সব উল্টো হচ্ছে কেন? ”
এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারল না কোমল। লজ্জায় কুঁকড়ে গেল যেন আরও। চোখদুটো খিঁচে বন্ধ করে রাখতে রাখতে অনেক কিছু ভেসে আসল চোখের পাতায়। সেই ভেসে আসা মুহূর্তগুলো দর্শন করতে করতে চোখের পাতা আলগা হয়ে গেল। ভীষণ উত্তেজিত গলায় বলল,
” মাথায় হাত বুলিয়ে দিই? ”
কোমলের আকস্মিক বলা কথাটায় নিবিড় চমকাল। অনুরোধ করল নাকি আবদার বুঝতে পারল না। চকিত দৃষ্টিতে চেয়ে থাকল শুধু। কোমল অনুমতির অপেক্ষা করল না। কাছঘেঁষে এসে নিবিড়ের চুলে আঙুল ডুবিয়ে বলল,
” চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করো। ঘুম থেকে উঠলেই দেখবে রাগ নেই। ”
” সত্যি? ”
কোমল সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিতে পারল না। নিবিড়ের বাবা মারা যাওয়ায় সে খুব দুঃখ পেয়েছিল। গোপনে গোপনে রাগ করেছিল। সেই রাগে নাওয়া-খাওয়া ভুলে পাথরের মতো হয়ে গেছিল। সেই পাথরভাব কেটেছিল কোমলের উপস্থিতিতে। কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে গেল কেমন করে! সেই ঘুম ভাঙার পর তো তার মধ্যে কোনো রাগ ছিল না। কী সুন্দর স্বাভাবিক হয়ে গেল! কোমল মনে মনে সন্দেহ করছে, মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়ার জন্যই ঘুমিয়েছে, রাগ ভেঙেছে। সন্দেহ ঠিক থাকলে রাগ ভেঙে যাওয়ার একটা প্রত্যাশা রাখতেই পারে।
কোমলের কাছ থেকে উত্তর না পেয়ে নিবিড় বলল,
” আমার ঘুম পাচ্ছে না। ”
কোমলের ধ্যান ভাঙল। চুলে বিলি কাটা বন্ধ করে হতাশ দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। নিবিড় খানিকটা সহানুভূতি দেখিয়ে বলল,
” আরেকটু চেষ্টা করা যাক। ”
নিবিড় চোখ বন্ধ করে নিলেও কোমল চুলে হাত চালাল না। তার মনে পড়েছে, সেইরাতে নিবিড় কোমর জড়িয়ে ঘুমিয়েছিল। সেজন্যই হয়তো ঘুম এসেছে। এখনও কি তাই করতে বলবে? কোমল মনভর্তি দ্বিধা নিয়ে উঠে দাঁড়াল। বিছানা থেকে নেমে নিবিড়ের পাশে দাঁড়িয়ে সলজ্জায় বলল,
” সেদিনের মতো আমার কোমর জড়িয়ে ধরো, তাহলেই ঘুম আসবে। ”
নিবিড় আরও একদফা অবাক হলো। পরক্ষণেই নিজের চারপাশ দেখে বলল,
” আমার বাসায় একটা চৌকি ছিল। এখানে নেই। বিছানা পাতা হয়েছে মেঝেতে। উচ্চতার দিক দিয়ে দেখলে এখানের বিছানা অনেকটা নিচে। সেই হিসেবে, আপনার কোমর জড়িয়ে ধরলে আমার মাথা আপনার পেটে না পড়ে অন্য কোথাও পড়বে। ”
কোমলের কণ্ঠস্বরের লজ্জা বিদ্যুৎগতিতে ছড়িয়ে পড়ল সারাশরীরে। চোখদুটো পূর্বের চেয়েও অধিক হতাশ দেখালে নিবিড়ের মায়া হলো। সেইরাতের শান্তিটুকু অপ্রত্যাশিত ছিল। অজান্তেই কোমলকে কষ্ট দিয়ে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল অনেক্ষণ। কতটা সময় রাত জেগে ছিল কে জানে! নিবিড় চাচ্ছিল না সেই কষ্টটা সজ্ঞানে, ইচ্ছাকৃত দিতে। তাই অন্যভাবে ব্যাপারটা সামলাতে চাচ্ছিল। বলল,
” কোমর ধরার জন্য আপনাকে দাঁড়িয়েই থাকতে হবে এমন তো নয়। আপনি শুয়ে থাকলেও ধরা যায়। ”
” এতে যদি কাজ না হয়? ”
” চেষ্টা করে দেখলে ক্ষতি কী? ”
কোমল আগের মতো নিবিড়ের অন্যপাশে শুয়ে পড়ে বলল,
” আশা করছি, তোমার ঘুম আসবে। রাগও ভাঙবে। ”
” সত্যিই অনুমতি দিচ্ছেন? ”
” হ্যাঁ। ”
নিবিড় নিঃসংকোচে কোমলের কোমর জড়িয়ে ধরে মাথা রাখল উদরে। মাথায় স্ত্রীর হাতের স্পর্শ পড়তেই চোখ বন্ধ করে ফেলল। কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে সুধাল,
” একটা কথা বলি? ”
” বলো। ”
” বউসাজে আপনাকে একদম অন্যরকম লাগছিল। পুরুষদের স্বপ্নে বিচরণ করা সেই নারীটি, যার সৌন্দর্যে কোনো খুঁত নেই। রূপকথার পরীদের মতো। আমি ঠিকমতো তাকাতে পারছিলাম না। ভয় হচ্ছিল খুব। যদি কোনো কাণ্ড করে বসি আর আপনি রেগে গিয়ে বলেন, আমার ধৈর্য কম। অপ্রাপ্ত ছেলেদের মতো আচরণ। তারপর বিয়ে ভেঙে দিয়ে আমাকে দিশাহারা করে চলে যান! তাই, আমি পরের কাজগুলো আগে করার চেষ্টা করছিলাম। হলো না, উল্টো সব নষ্ট হলো। মা রেগে গেল, আমি বাড়ি ছেড়ে চলে এলাম। ভাবলাম, মন নরম হবে। ঢাকা আসতে রাজি হবে। তা না করে, শুধু আপনাকে পাঠিয়ে দিল। ”
” তারমানে তুমি রাগ করে আসোনি? ”
” না। আমি চাচ্ছিলাম, আমাদের বাড়ি অন্য কেউ দখল করে নিচ্ছে এটা যেন মা দেখতে না পায়। সেজন্যই তো তাড়াহুড়ো করলাম। ”
কোমল চুপ করে গেল। বুঝতে পারল তার আরও একটি ধারণা ভুল, নিবিড় সেইরাতে ঘুমিয়ে পড়লেও সব শুনেছে।
” এখানে তো একটা ঘর, তিনটা মানুষ থাকবে কী করে? সবার খরচ চলত কীভাবে? ”
” আপাতত আমার সম্মানী থেকে। ”
” সম্মানী? ”
” হ্যাঁ। আমি বুঝতে পারছিলাম, আমার মাসিক খরচ, পড়াশোনার খরচ চালাতে বাবার কষ্ট হচ্ছে। তাই আমার ডিপার্টমেন্টে একটি পত্র পাঠিয়েছিলাম। অনেক সময় মেডিকেলের অধ্যাপকদের বিভিন্ন প্রোজেক্ট, লেকটার তৈরী, পরীক্ষা-নিরীক্ষা দর্শনের জন্য লোক প্রয়োজন হয়। সেখানে যদি আমাকে সুযোগ দেওয়া হয়, তাহলে আমি করব। এতে আমার পড়াশুনা ক্ষতি হবে না আবার কিছু অর্থও পাব। তেমনি একটি সুযোগ পেয়েছিলাম। চিঠিতে লিখে জানাব তার আগেই বাবার মৃ’ত্যু সংবাদ পেলাম! ”
নিবিড়ের কণ্ঠে শোকের ছায়া, কান্নাভাব। দীর্ঘ শ্বাস টেনে বলল,
” মাকে মানাতে পারলাম না। আরেকটা দুঃখ সহ্য করতে হবে! চেয়ারম্যান নিশ্চয় বাড়ি দখল নিতে চলে আসবেন শীঘ্রই। ”
কোমলের মধ্যেও একটু চিন্তা উদয় হলো। বাবা এ বিষয়ে কী করেছে জানতে ইচ্ছে হচ্ছে খুব। কিন্তু নিবিড়ের সামনে সম্ভব না। তাই বুদ্ধি করে বলল,
” তুমি সময় চেয়ে বাড়ির মালিককে একটা চিঠি লিখে পাঠাও। এরমধ্যে কাকিমাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে এখানে আনতে পারলে ভালো। নাহয় আমরাই তাকে পুরো ঘটনা খুলে বলব। ততদিনে তিনি অনেকটা শক্ত হবেন। ”
কোমলের বুদ্ধিটা পছন্দ হলো নিবিড়ের। খুশিমনে বলল,
” ঠিক আছে। কালকেই একটা চিঠি লিখে ডাকবাক্সে ফেলে আসব। ”
নিবিড়ের খুশিটুকু কোমলের মুখেও আশ্রয় নিল। নরম গলায় বলল,
” এবার তাহলে ঘুমাও? ”
নিবিড় আর কথা বাড়াল না। চুপটি করে চোখ বুজে থাকল। কোমল যখন ধরেই নিল, নিবিড় ঘুমিয়ে পড়েছে সেই সময় সে মাথা তুলে ভীষণ আদুরে স্বরে বলল,
” আপনাকে একটা চুমু খাই? ”
কোমল বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকল নিবিড়ের অনুরোধময় চোখদুটিতে। আবিষ্কার করল, তার গলায় সুর নেই, শব্দ নেই। ঠোঁটদুটো যেন পাথরের মতো শক্ত হয়ে আছে। কথা বললেই বালির মতো ঝুরঝুরে হয়ে ঝরে যাবে।
নিবিড় কোমলের মুখের দিকে এগিয়ে আসল। কপালে আঙুল রেখে বলল,
” একটাই খাব। এখানে। ”
তারপরেই আঙুল চঞ্চল হয়ে উঠল। স্থান পরিবর্তন করতে করতে বলল,
” না, চোখে খাব। গালেও খেতে ইচ্ছে করছে। উফ, সব বাদ। এই লাল হয়ে উঠা নাকটায় খাব শুধু। ”
কোমল তখনও নীরব, নিষ্ক্রীয়। নিবিড়ের চাঞ্চল্যচিত্ত মিঁইয়ে গেল। মলিন মুখে আগের অবস্থায় ফিরে গেল। ঘুমানোর জন্য চোখ বন্ধ করলে শুনতে পেল,
” আচ্ছা। ”
অনুমতি পেয়ে ঝড়ের গতিতে একটামাত্র চুমুই খেল। কিন্তু নাকে না, ঠোঁটে।
#বিবি
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (২০)
অনুমতি পেয়ে ঝড়ের গতিতে একটামাত্র চুমুই খেল নিবিড়। কিন্তু নাকে না, ঠোঁটে।
নিবিড়ের আকস্মিক কর্মটিতে কোমলের চেয়েও অধিক লজ্জার বাণে বিদ্ধ হলো সে। তুলোর মতো নরম হওয়ার সচেষ্টায় মেতে উঠল। বিশাল শরীরটা ভাঁজ করে আশ্রয় পেতে চাইল কোমলের ছোট্ট পেটে। দুই হাতে মুখের দুইপাশ ঢেকে আড়াল হতে চাইল ধরণীর নিকট।
নিবিড়ের এমন আদুরে আক্রমণে স্তম্ভিত হয়ে পড়েছিল কোমল। সেই ভাব কাটিয়ে উঠল কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে। প্রকৃতিস্থ হয়ে বলল,
” দুলাল ভাই মনে হয়, চোখে কম দেখেন। সেজন্যই তোমার এই কিশোরভাবটা ধরতে পারেননি। আবার খুব বুদ্ধিমানও হতে পারেন। তাই বুদ্ধি করে তোমাকে বোকা বানাতে বলেছে…”
কোমল কথাটা শেষ করতে পারল না। নিবিড় আড়াল হতে বেরিয়ে এলো চট করে। লজ্জার খোলস বদলে ফেলল নিমিষেই। হাত-পা মেলে মাথা তুলে বলল,
” জানতাম, আপনি এমনটাই বলবেন। ”
কোমল কৌতুকের সুর টেনে বলল,
” তাই? ”
নিবিড়ের নিষ্পলক চাহনি অভিমানের দিকে গড়াল। কী একটা বলার জন্য কয়েক মুহূর্ত হাঁসফাঁস করে শান্ত হয়ে গেল হঠাৎ। এতে যেন কোমলের মধ্যে দুষ্টুমির প্রভা স্পষ্ট হলো। মুচকি হাসলে নিবিড় বলল,
” বোকাদের মধ্যে সৃজনশীলতা নেই, নতুন কিছু সৃষ্টিতে আগ্রহ থাকে না। উদ্যমী হয় না। যা থাকে তাই নিয়ে একভাবে কাটিয়ে দেয়। খুব ভীতু হয়।
” তুমি তেমন নও? ”
” একদমই না। আপনি দেখতে পাচ্ছেন না? ”
” কী দেখব? ”
” আমার সৃজনশীলতা, সৃষ্টি, সাহসিকতা। ”
কোমল মুখে উত্তর দিল না। প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকলে নিবিড় বলল,
” সৃজনশীলতার জন্যই আপনাকে দুইবার বিয়ে করতে পেরেছি। মনের মধ্যে স্থায়ী একটা টান সৃষ্টি করছি। ”
” চুমু বুঝি সাহসিকতা? ”
নিবিড়ের মুখের ভাব বদলে গেল। অল্পক্ষণ চুপ থেকে বলল,
” একটু আগেও তো আপনি কিশোরী মেয়েদের মতো ভয় পাচ্ছিলেন, লজ্জা পাচ্ছিলেন। শক্ত কথা বলা তো দূর ঠিকমতো চোখ তুলে তাকাতেও পারছিলেন না। এরমধ্যে পাল্টে গেলেন? ”
কোমল উত্তর দেওয়ার বদলে ভেঙানোর মতো করে বলল,
” একটু আগেও তো তুমি শিক্ষকদের মতো গম্ভীর ছিলে, তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে ছিলে। মনে হচ্ছিল, আমি ভুল বললেই শাস্তি দিবে। এরমধ্যেই পাল্টে গেলে? ”
নিবিড় আবার কথা হারিয়ে হাঁসফাঁস করতে লাগল। কোমল ব্যাপারটাকে উপভোগ করছিল বেশ। সহসা বলল,
” আমি নরম হলে তুমি কঠিন, তুমি নরম হলে আমি কঠিন। মিলটা কিন্তু দারুন। ”
কোমলের এই প্রশংসা নিবিড়কে খুশি করতে পারল না। তার চোখে বুদ্ধিমান হওয়ার জন্য একটা জেদ চেপে বসল মনে। গোঁ ধরে বলল,
” আমি বোকা নই, চালাক এবং সৎ। সেজন্য আপনার শর্ত মানি, অনুমতি নিই। ”
” মাঝেমধ্যে পা ফসকে যায়। শর্ত ভেঙে যায়। ”
কেমলের কাটা কাটা উত্তরে নিবিড় দমে গেল। হার মেনে নিয়ে চুপচাপ মাথা নামিয়ে রাখল। চোখ বন্ধ করে বলল,
” আপনি খুব নিষ্ঠুর। ”
নিবিড়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে কোমল বলল,
” এই নিষ্ঠুরতা তোমাকে অধিক আনন্দ দেয়। ”
নিবিড় মৃদু হাসল। হাতের বাঁধন গাঢ় করে বলল,
” আমাকে এভাবে প্রকাশ করা বন্ধ করুন। লজ্জা হয় তো! ”
_____________
” বিবি? ”
নিবিড়ের এমন আদুরে সম্বোধনে কোমলের ঘুম হালকা হলো। পিটপিট চোখে তাকালে সে বলল,
” চলুন, একসাথে নামাজ পড়ি। ”
নামাজের কথা স্মরণ করে দিতে কোমল হুড়মুড়ে উঠল। বন্ধ জানালার দিকে তাকিয়ে বলল,
” সকাল হয়ে গেছে? ”
” হ্যাঁ। ”
” এদিকে মসজিদ নেই? ”
” আছে, একটু দূরে। ”
” আযান শোনা যায় না? ”
” যায়। ”
” তাহলে শুনলাম না কেন? ”
” গভীর ঘুমে ছিলেন হয়তো। ”
নিবিড়ের উল্লেখ করা কারণটি কোমল মানতে পারল না। মনখারাপ করে বসে থাকলে নিবিড় বলল,
” আরেকটু ঘুমাবেন? ”
কোমল নিরুত্তরে উঠে দাঁড়াল। ওযু করতে করতে ভাবল, এই নিয়ে দুইদিন হলো সে ফযরের আযান শুনেনি। এটা ভালো অভ্যাস নয়। এরপর থেকে আরও সজাগ থাকতে হবে। সে তো আযান শুনে নামাজ পড়ায় অভ্যস্ত।
নিবিড় ও কোমল আগে-পরে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করছিল। নামাজ শেষ করে নিবিড় পেছনে তাকাল। কোমল তখনও মোনাজাতে মগ্ন। সে অবস্থায় উরুতে মাথা ফেলে বলল,
” দুলাল ভাইয়ের জন্য খুব চিন্তা হচ্ছে। আপনি কি তার জন্য একটু দোয়া করবেন? ”
কোমল মোনাজাত শেষ করে তাকাল নিবিড়ের মুখটায়। সে বিমর্ষ গলায় বলল,
” তিনি খুব বিপদে আছেন। ”
কথাটা বলেই কোমলের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। দুলাল ভাইকে বলা হয়নি, সেই দুলকন্যাটির নাম কোমল। তার বিবাহিত স্ত্রী। হয়তো মুখদর্শন করাতে পারত না। কিন্তু উপস্থিতিটুকু তো অনুভব করাতে পারত?
______________
কোমলের হাতে বানানো নাস্তা খেয়ে নিবিড় ক্লাসের জন্য বেরিয়ে গেল। যাওয়ার পূর্বে চিঠি লিখতে ভুলল না। কোমলকে দিয়ে পড়িয়ে, খামের মুখ বন্ধ করে, ঠিকানা লিখল স্পষ্টভাবে।
নিবিড় বেরিয়ে যেতেই বাবাকে কল করল কোমল। টাকার পরিমাণটা দ্বিগুন হলেও চেয়ারম্যানকে রাজি করাতে পেরেছেন আনিস মোল্লা। এতে স্বস্থি মিললেও উদ্বিগ্ন হলো খানিকটা। বাবাকে জানাল, নিবিড়ের লেখা একটি চিঠি যাবে চেয়ারম্যানের বাসায়। সেই চিঠি উদ্ধার করে, নিবিড়ের অনুরোধ গ্রহণ করেছে এমন কিছু লিখে একটা ফেরত চিঠি লেখার ব্যবস্থাও করতে হবে। আনিস মোল্লা পুরো ব্যাপারটা বুঝে নিয়ে বললেন,
” এত গোপনীয়তা কি ঠিক হচ্ছে, মা? নিবিড় যদি জানতে পারে, দুঃখ পাবে। ”
” চিন্তা করো না, বাবা। সময় হলে ঠিক জানতে পারবে। আমি চাই না, আমাদের মধ্যে কোনো গোপনকথা থাকুক। পরিস্থিতি গোপন করতে বাধ্য করছে। ”
বাবার সাথে আরও কিছুক্ষণ কথা বলে কল কেটে দিল কোমল।
_______________
” বুবুর শাশুড়ি, আমি কি দেখতে খুব খারাপ? ”
কুলসুম নাহার চুলা ধরাচ্ছিলেন। হঠাৎ অনড়ার প্রশ্নে মুখ তুলে তাকালেন। খেয়াল করলেন, মুখের মধ্যে সেই দুষ্টুভাবটা নেই। প্রাণখোলা হাসিটা শুনেন না অনেকদিন। তাকে জ্বালাতন করতে ভুলেই গেছে যেন। কোমল ঢাকা যাওয়ার সময় অনড়াকে বলেছিল, কুলসুম নাহারের খেয়াল রাখতে। মেয়েটা সেই দায়িত্ব পালন করতেই দিন-রাত এ বাসায় পড়ে আছে। একবারের জন্য বাহিরমুখো হয়নি।
অনড়া রান্নাঘরের মাটিতে বসে বলল,
” বলবে না? ”
অনড়ার গায়ের রঙ পাকা ধানের মতো। এই গ্রামে এমন রঙ বিরল। কুলসুমের ধারণা, অনড়া দেখতে মায়ের মতো হলেও রঙ আর চোখটা পেয়েছে বাবার। তার বাবার চোখদুটোও এমন ছোট ছোট ও মনিদুটো গাঢ় খয়েরি রঙের ছিল। চুলার আগুন নিভে ধোঁয়া তৈরি হতে কুলসুমের চোখের পলক পড়ল। চুলার মুখে শুকনো পাতা দিয়ে বললেন,
” এত খারাপ না। চলনসই। ”
” পছন্দ করা যায়? ”
” যায়। ”
” আর ব্যবহার? ”
কুলসুম নাহার আবারও তাকালেন অনড়ার দিকে। মেয়েটার চালচলন খুব একটা সুবিধার নয়। কখন, কী করতে চায় বুঝা যায় না একদম। আর কারোরটা না জানলেও সে খুব বিরক্ত। তবুও কোথাও একটা স্নেহ খুঁজে পেলেন কুলসুম নাহার। বুঝতে পারলেন, এর করা অন্যায়গুলোর জন্য শাস্তি দেওয়া যায় কিন্তু দূরে সরিয়ে দেওয়া যায় না। প্রশংসা-নিন্দা কোনোটা না করে বললেন,
” আরেকটু আদবকায়দা শিখতে হবে। তাহলে খুব আদর পাবি। ”
” সত্যি? ”
কুলসুম নাহার মাথা নাড়লে সে ভীষণ উৎসাহী হয়ে বলল,
” তাহলে তুমি শিখিয়ে দেও। ”
_________________
রাতে খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকিয়ে একটু বই মেলে বসেছিল নিবিড়। পড়ার ফাঁকে ফাঁকে চোখ গিয়ে পড়ছিল কোমলের দিকে। সে বিছানায় বসে কী একটা যেন করছে। হঠাৎ চুলের খোঁপা খুলে যাওয়ায় বিরক্ত হয়। কাজ থামিয়ে দিয়ে পুনরায় খোঁপা করার জন্য উদ্যত হতেই নিবিড় বলল,
” আপনার চুল আঁচড়ে দিই? ”
কোমল চমকে তাকাল। জিজ্ঞেস করল,
” তোমার পড়া শেষ? ”
” না, আরেকটু বাকি। ”
” তাহলে পড়া শেষ করো আগে। ”
” মন বসছে না। ”
” কেন? ”
” আপনার চুল আঁচড়ে দিতে ইচ্ছে করছে। ”
কোমল বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়ল। চুলে শক্ত করে খোঁপা বেঁধে ওড়না দিয়ে ঢেকে বলল,
” আমার রান্নাঘরে কাজ আছে, তুমি পড়া শেষ করো। ”
কোমল চলে যেতে নিলে নিবিড় বই বন্ধ করল শব্দ করে। হাত গুটিয়ে বুকে বেঁধে নিয়ে বলল,
” আগে ইচ্ছে পূরণ তারপর বই পড়া। ”
কোমল শক্ত হয়ে থাকতে পারল না। সে এর মধ্যে বুঝে গেছে, নিবিড় যে কাজে জেদ ধরে সে কাজ করেই ছাড়ে। সে চিরুনি হাতে বিছানার মাঝ বরাবর বসলে নিবিড় দৌড়ে এলো। খোঁপা খুলে চুল ছড়িয়ে দিয়ে এমনভাবে চিরুনি চালাল যেন চুলের প্রাণ আছে। একটু এদিক-সেদিক হলে সেই প্রাণ হারিয়ে যাবে। সযত্নে চুল নাড়া-চাড়া করতে করতে নিবিড়ের ইচ্ছে হলো, দুইহাতে বুকে জড়িয়ে নিতে। কিংবা এমনভাবে চিরুনি চালিয়ে সারাজীবন পার করে দিতে।
” তুমি চুল খুব পছন্দ করো? ”
কোমলের প্রশ্নে নিবিড়ের মোহভাব কাটল। চুলের মাঝে ভাগ সৃষ্টি করতে করতে বলল,
” পছন্দ করি নাকি জানি না, কিন্তু আপনারগুলো খুব ভালো লাগে। ”
কোমল চুপ হয়ে গেল। নিবিড়ও চুল বিন্যাসে মনোযোগী হলো। একটার সাথে আরেকটা প্যাঁচানো ব্যতীত আর কিছু করতে পারল না।
” তুমি কিন্তু পড়াশোনায় খুব ফাঁকিবাজি করছ। ”
নিবিড় চুল থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে বলল,
” আপনি কি সারাজীবন আমার নিন্দা-ই করে যাবেন? ”
” নিন্দা করলাম কোথায়? এসে থেকে তো দেখছি, বই নিয়ে একটা ঘণ্টাও বসে থাকছ না। ”
” আবার শিক্ষকনীর মতো আচরণ করছেন? ”
কোমল কপাল কুঁচকাল। সংশয় নিয়ে বলল,
” মেয়েদেরকে শিক্ষিকা বলা যায় জানতাম। শিক্ষকনী তো শুনিনি। এটা কোথা থেকে জন্ম নিল? ”
” আমার মাথা থেকে। ”
কোমল চোখ বড় করলে নিবিড় সরে বসল। খানিক্ষণ ইতস্ততা করে উঠে দাঁড়াল। বই মেলে বসতে বসতে বলল,
” আপনি আমার মন খারাপ করেছেন, এর শাস্তি হিসেবে আপনাকে আজ দুটো চুমু খাব আর কানে কানে একটা কথা বলব। ”
চলব
[ আমি একটু অসুস্থ। ভেবেছিলাম লিখব না, তবুও লিখেছি। যতদূর ভেবেছিলাম ততদূর লিখতে পারিনি বলে মনখারাপ হচ্ছে। ]
চলবে