#বীরাঙ্গনা_হইতে_বারাঙ্গনা (২য় পরিচ্ছেদ)
#মম_সাহা
পর্বঃ ১১
জীবনে অনেক অপ্রত্যাশিত ঘটনাই ঘটে যায়। কিছুটা ইচ্ছায়, কিছুটা অনিচ্ছায়। তেমনই অপ্রত্যাশিত ভাবে হয় গেলো পদ্মের বিয়েটা। চা বাগানের গুমোট পরিস্থিতি ভেদ করে একটা মধুর লগনে পদ্মের কলঙ্ক ঢেকে দিলো পাশের গ্রামেরই সরল সোজা ছেলেটা। একজন ছেলে যেখানে কলঙ্ক লেপে উধাও হয়ে যায় নারী জীবনে, তেমন আরেকজনই ছেলেই পারে সে কলঙ্ক মুছে একজন নারীকে উজ্জ্বল নক্ষত্রের ন্যায় জীবন দিতে। আজ পদ্মও তেমন সঠিক মানুষ পেয়ে আবারও উজ্জ্বল নক্ষত্রের ন্যায় বাঁচার সুযোগ পেলো। বিয়ে শেষ হলো, ঘনিয়ে এলো বিদায় মুহুর্ত। কান্নাকাটি হলো বোনে বোনে, আত্মীয় স্বজনে, পাড়া প্রতিবেশীতে, কাঁদলেন না কেবল ছায়া। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কেবল শীতল কণ্ঠে বললেন,
“তোমার ভালো টা আমি গুছিয়ে দিলাম। কখনো সুযোগ হলে অন্য কারো ভালো টা গুছিয়ে দিও তুমি।”
পদ্ম মায়ের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকালো। পৃথিবীতে এই মহিলাটার মতন এতো কঠোর বোধহয় কেউ হতে পারবে না কখনো। মা তো এমন হয় না। পত্রও কাঁদলো বোনের বিদায়ে। তবে বিদায় বেলা সবার অগোচরে পদ্ম বোনের দিকে সন্দেহের তীর ছুঁড়ে মেরেছিলো,
“তুই যে পরেশ মামার থেকে স্বর্ণের আংটি নিয়েছিস, মা তো জানেনা তাই না? মাকে জানিয়ে দিস।”
পত্র আমতা-আমতা করে কোনো মতে কথা ঘুরিয়ে দেয়। পদ্মের স্বামী রাতুল বড্ড ভালো ছেলে। স্ত্রীর কান্নায় স্ত্রীকে স্বান্তনা দিয়েছে, বোকা বোকা কণ্ঠে বলেছে,
“কেঁদো না। অনেক কষ্ট হলে তুমি নাহয় আজকের দিনটা থেকে যাও।”
স্বামীর এহেন উদার মনের পরিচয় পেয়ে পদ্ম আরও হাউমাউ করে কেঁদে উঠে। মায়ের প্রতি কৃতজ্ঞতায় তার চোখ স্বজল হয়ে উঠে। মা কেবল ভালো কাউকে না, শ্রেষ্ঠ কাউকে উপহার দিয়েছে তার জীবনে। কান্নাকাটি, আনন্দ অনুষ্ঠান, হৈচৈ এর পর চা বাগানে নামে আরেক দফা নিশ্চুপতা। আবার সব শুনশান, নীরব।
বেশিকিছু দিন পরের কথা। চা বাগানে তখন আধুনিকতার ছোঁয়া লাগা শুরু। প্রজেক্টের কাজ করার জন্য শহর থেকে আধুনিক কতসব মানুষ এসে উপস্থিত। তাদের চাল চলনে তাক লাগে চা বাগানের মানুষদের। তারাও কিছুটা ঐরকম হওয়ার চেষ্টায় মন দেয়। তবে প্রজেক্টটা যে এই বিশাল সুন্দর চা বাগানকে আধুনিকতার সাথে সাথে নিষ্প্রাণতাও দান করবে তাও রটে যায় মানুষের মুখে মুখে। কোমল চা বাগান হয়তো শহুরে ছোঁয়ায় আধুনিক হবে কিন্তু সাথে সাথে তার সজীবতাও হারাবে। তা নিয়ে বৃদ্ধ, যুবক সবাই ই চিন্তিত। প্রজেক্টের কাজ ততদিনে খানিক এগিয়ে গিয়েছে। চা বাগানের একাংশ তখন প্রাণহীনতার আভাস দেওয়া শুরু করেছে।
তেমনই একদিন দুপুরের দিকের ঘটনা, ছায়া রান্নাঘরে রান্না করছেন। পত্র স্কুলে আর পুষ্প অভ্রদা’র বাড়িতে, সমির বাবুও বাড়ি নেই। কেবল পরেশ মামা তার জন্য বরাদ্দকৃত রুমটাতে ঘুমিয়ে আছেন। রান্নাঘর থেকে ছায়ার রান্নার খুটখাট শব্দ ভেসে আসছে। তন্মধ্যেই উঠোনে হুড়মুড় করে প্রবেশ করলো গ্রামেরই পরিচিত একটা বারো-তেরো বছরের ছেলে। উঠোনে এসেই সে বেশ জোরে জোরে ডাকতে শুরু করলো ছায়াকে,
“জেঠিমা, ও জেঠিমা, শুনছো গো। কই তুমি?”
ছায়া তখন কেবল মশলা ছেড়েছ গরম তেলে। এমন হৈচৈ শুনে সে কড়াই না নামিয়েই উঠোনে নেমে আসে। ছেলেটা তখনও হাঁপাচ্ছে। ছায়া পরিচিত মুখ থেকে ভ্রু কুঁচকায়, প্রায় কিছুটা অবাক হয়েই বলে,
“কিরে রামু, এমন ভরদুপুরে চিৎকার দিচ্ছিস কেন! ভর দুপুরে চিৎকার দিলে লক্ষী থাকে নাকি ঘরে! আর হাঁপাচ্ছিসও বা কেন?”
ছেলেটা ততক্ষণে স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়ার কাজে নিবিষ্ট। নিজেকে কিছুটা ধাতস্থ করেই বললো,
“জেঠিমা, তাড়াতাড়ি মাঠে চলো। একটা ভয়ঙ্কর কাণ্ড ঘটে গেছে।”
“কী কাণ্ড?”
জেঠিমার সহজ স্বাভাবিক প্রশ্নে জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভেজালো রামু নামের ছেলেটা। অতঃপর ব্যাথিত কণ্ঠে বললো,
“জেঠা মশাই সেখানে পড়ে আছেন। তার শরীরে র/ক্তে মাখামাখি। তাড়াতাড়ি আসো।”
কথাটা বুঝতেই যেন ছায়ার বেশ কিছুটা সময় লেগে গেলো। কিন্তু যখনেই মস্তিষ্কের নিউরনে ছড়িয়ে গেলো সে আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা করলো না। ছুটে বেরিয়ে গেলো উঠোন পেরিয়ে সদর দরজা খুলে। পিছে পিছে রামুও ছুটলো। চিৎকার চেঁচামেচিতে ততক্ষণে উঠে গেছে পরেশ মামাও।
_
শুকনো খড়খড়ে মাঠটা তে মানুষের জটলা। বিরাট এক ঘোমটা দিয়ে ছায়া হাজির হলো সেই মাঠে। হৈ-চৈ, ভীড় ঠেলে ছায়া উপস্থিত কাঙ্খিত জায়গায়। সমিরবাবু পড়ে আছে মাটিতে। নাক, চোখ, মুখ ফেটে র/ক্তে মাখামাখি মাটি আর সমিরবাবুর শরীর। আশপাশ তাকাতেই দেখলো বিন্নী, বিন্নীর মা, পুষ্প সব হুড়মুড় করে হাজির হয়েছে সেখানে। পুষ্প কাঁদছে হাউমাউ করে, বিন্নীও কাঁদছে। বিন্নীর মা “ঠাকুরপো”, “ঠাকুরপো” করে সমির বাবুর মাথাটা নিজের কোলে উঠিয়ে নিলেন। সাদা থান কাপড়টা তখন র/ক্তে ভরে গেলো। চিৎকার করলো না ছায়া। সে স্বাভাবিক ভাবে বসলো সমির বাবুর পাশে। বেশ গম্ভীর কণ্ঠে ভীড়ে অবস্থানরত একটা মহিলার উদ্দেশ্যে বললো,
“আয়েশা, একটু জল এনে দেও তো বউ।”
অল্প বয়স্ক কালো, ছিমছাম গড়নের বউটা অবাক দৃষ্টিতে তাকালো ছায়ার দিকে, বিস্মিত হয়ে বললো,
“চাচী, আমি দিবো পানি? চাচা সেই পানি খাইবে? ফুফুজি তো আমারে আপনাদের দোরেও দাঁড়াতে দিতেন না।”
“অত কথা বলছো কেন, বউ! তাড়াতাড়ি জল আনো। তোমার চাচার জান বড়ো না কে কী করছে সেটা বড়ো?”
ছায়ার কথার বিপরীতে আর একটাও টু শব্দ করলেন না বউটা। সে ছুটে গিয়ে মুহূর্তের মাঝেই জল নিয়ে হাজির হলো। ছায়া সমিরবাবুর চোখেমুখে সেই জল ছিঁটে মারলো। কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ পেলো না তার বিপরীতে। বিন্নীর মা আরও হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। ছায়া বিরক্ত হলো। বিরক্ত কণ্ঠে বললো,
“কান্না থামান, দিদি। শ্বাস চলছে উনার। আপাতত তাকে সদরে নিতে হবে।”
ছায়ার বদৌলতে সমির বাবুকে ধরাধরি করে একটা মটর চালিত গাড়িতে উঠানো হলো। তন্মধ্যেই পরেশ মামাও ছুটতে ছুটতে চলে এলেন। ছায়া গেলেন না সমিরবাবুর সাথে সদরে, পরেশ মামা গেলেন আর গ্রামের দু একজন গেলেন। পুষ্প যেতে চাইলোও ছায়া যেতে দিলেন না। সবাই অবশ্য কিছুটা বিস্মিত হলেন ছায়ার এমন ভাবলেশহীনতা দেখে। যার স্বামীর এ অবস্থা সে কীভাবে এতটা কঠিন থাকতে পারে! বিন্নীর মা ছায়ার সাথে সাথে পত্রদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। ছায়া পথিমধ্যে কিছু একটা ভেবে দাঁড়ালেন, পুষ্পের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
“তোর দাদাবাবুর নাম্বার জানিস, পুষ্প?”
ক্রন্দনরত পুষ্প উপর-নীচ মাথা নাড়ালো। ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে বললো,
“হ্যাঁ জানি, মা।”
“বিন্নীকে নিয়ে একটু বাজারে যা তো। রাজেশের দোকান থেকে তোর দাদাবাবুকে ফোন দে, আসতে বল তাকে সদরে। তোর বাবা ওর হাতে থাকলে ভালো হয়ে যাবে।”
পুষ্প মাথা নাড়িয়ে বিন্নীকে নিয়ে ধীর পায়ে ছুটলো বাজারের পথে। ছায়া আগের ন্যায়ই শক্ত পায়ে হাঁটা ধরলো বাড়ির পথে। বিন্নীর মাও তার সাথে পায়ে পা মেলালো।
_
বাড়ির কাছে আসতেই ছায়ার চোখ-মুখ আঁধার হয়ে আসে। পত্র চিৎকার করছে বাড়ির ভেতর থেকে আর কালো ধোঁয়ায় চারপাশ আঁধার হয়ে আছে। ছায়া দিশেহারা হয়ে বাড়ির দিকে ছুটে যায়। কালো ধোঁয়ায় ঠাহর করতে পারে না কিছু। কিন্তু ততক্ষণে রান্নাঘর হতে পিসির ঘর, পুষ্পের ঘর পুড়ে গেছে। সেখানে দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন। ছায়াকে এবার উত্তেজিত হতে দেখা গেলো। তার হাত-পায়ে দেখা দিল মৃদু কম্পন। এই বিভীষিকা ময় আঁধারে সে চিৎকার করতে করতে পত্রকে ডাকছে,
“পত্র, ও পত্র, মা তুই কোথায়? আমি আসছি, ভয় পাস না। কোথায় আছিস বল।”
#চলবে
(