#বৃষ্টি থামার শেষে
#পর্ব-১
অনিক হাপুসহুপুস করে রুটি আর আলুভাজি গিলছে। সুরাইয়া বললেন,
“একটু আস্তে আস্তে খা না অনি”।
অনিক মায়ের দিকে এক পলক তাকিয়ে ঘড়ি দেখে বলল,
“একটু তাড়াতাড়ি যেতে হবে মা। ইশা আর তুর্য অপেক্ষা করে থাকবে”
“ওদের বাড়ি কেন আসতে বললি না”
অনিক হাসলো। এই হাসির অর্থ সুরাইয়া বেশ ভালো করেই জানে। কলোনীতে দুটো ঘুপচি ঘরে চাপাচাপি করে পাঁচজন মানুষ থাকে। সেখানে বাইরের মানুষ কে আপ্যায়ন করে আনার যে মুখ নেই!
অনিক যেন মায়ের মন পড়তে পারলো। বলল,
“তুমি ভুল ভাবছ মা! ইশা আর তুর্য আমার কাছের মানুষ। কলোনীর বাসায় ওদের আনতে সমস্যা নেই। সমস্যা হলো আজ মাসের পঁচিশ তারিখ। চায়ের কৌটো, চিনির কৌটো প্রায় খালি, আর আপার হাতেও টাকা নেই।
সুরাইয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলল। অনিকের কথা মিথ্যে না। সত্যিই যে ঘরে সবকিছু শেষ হয়েছে সেটা কাল রাতে রান্নার সময় টের পেয়েছে। প্রতি মাসেই এমন ঘটনা ঘটে। অথচ রুপা মাস হিসেবে টাকা দেয়। কোথায় যে টাকাগুলো যায় সেটা বুঝে উঠতে পারেন না। দেখা যায় বেশীর ভাগ সময় ই অভি কে এটা ওটা কেনার জন্য টাকা দিতে গিয়ে সব শেষ হয়ে যায়।
অনিক খাওয়া শেষ করে বলল, মা আমি আসছি।
সুরাইয়া দরজা পর্যন্ত এগিয়ে গেলেন। অনিক জুতো পরতে পরতে বলল, মা রাতে বাজার নিয়ে ফিরবো। তুমি আবার টাকা চাইতে যেও না ওর কাছে।
সুরাইয়া বেগম অবাক গলায় বলল, তুই টাকা কই পাবি?
“টিউশনির টাকাটা হাতে পাব আজ”।
অনিক চলে গেল। খুব দ্রুত হেটে যাচ্ছে। সুরাইয়া বেগম তাকিয়ে ছেলের যাওয়া দেখছে। এই ছেলেটা এতো ভালো কেন সেটা ভেবে সুরাইয়ার চোখে প্রায় ই পানি এসে যায়। অভাবের সংসারে তার তিনটে ছেলেমের মধ্যে অনিক ই সবচেয়ে বুদ্ধিমান, বিচক্ষণ আর ঠান্ডা মেজাজের ছেলে। সবসময়ই বলে, মা তুমি আর আপা আর ক’টা দিন একটু কষ্ট করো। পরীক্ষা টা শেষ করেই একটা ফুলটাইম জব খুঁজে বের করবো। সুরাইয়ার চোখ তখন ঝাপসা হয়ে যায় স্বপ্নবাজ ছেলের কথা শুনে। অনিক তখন স্মিত হেসে বলে, মা তোমার চোখে যেন কী গেল।
সুরাইয়া ঘরে ঢুকে রান্নাঘরের দিকে গেল। আজ দুপুরে পেপে আর ডাল ছাড়া আর কিছু রান্না হবে না। কলোনির সবচেয়ে ভালো বাসাটায় ওরা থাকে তাই রান্নাঘর বাথরুম ভাগাভাগির দরকার হয় না। সেজন্যই প্রতিমাসে ভাড়া বেশী দিতে হয়। অবশ্য উপায় ও নেই। অনিক ইউনিভার্সিটি তে পড়ে, রুপা সোমত্ত মেয়ে। এদের নিয়ে একসাথে চাপাচাপি করে থাকাও যায় না।
রুপা ঘুম থেকে উঠে রান্নাঘরের দিকে আসতে আসতে বলল, একটু বেশী করে দুধ, চিনি দিয়ে চা করো তো মা!
সুরাইয়ার হাত পা কাঁপতে শুরু করলো। ঘরে চা, চিনি অল্প থাকলেও দুধ নেই। হাতে টাকাও আছে অল্প। একমাত্র উপায় হলো দোকান থেকে বাকী তে নিয়ে আসা। সুরাইয়া মেয়েকে বলল, তুই একটু বস আমি দোকান থেকে দুধ আনি চা করে দেব।
রুপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, থাক লাগবে না। খেতে দাও।
ছয়তলার মেয়েটার সাথে আজও ঝগড়া করে বেরিয়েছে ইশা। ঝগড়ার কারন ওই একই জিনিস চুলা! ইশা ভাত টা রান্না করে চারতলায় এসে মাছ রান্নার জন্য জিনিসপত্র নিয়ে ছয়তলায় গিয়ে দেখলো চুলা খালি নেই। মেয়েটাকে ঠান্ডা গলায় চুলা ছাড়তে বললেও শুনলো না। তারপর নিজেই হাড়ি নামিয়ে মাছ ভাজতে শুরু করলো। এরপর শুরু হলো ঝগড়া। অন্যান্য সময় ইশা পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করলেও আজ ঠিক করেছে চুপচাপ থাকবে।
এরপর ভাত খেতে বসে ইশার মেজাজ চড়ে গেল ইশার। ঝগড়ার তালে মাছে লবন দিতে ভুল করেছে।
আধপেটা থেকেই বেরিয়ে গেল। আজকের সকাল টা শুরু ই হয়েছে ওর খারাপ ভাবে। ঘুম থেকে উঠেই শুনলো রুমমেট মৌ’র সতেরশ টাকা চুরি গেছে। সাসপেক্ট হিসেবে যে তিনজন আছে তার মধ্যে একজন ও। এখন নাকি কী চাল পড়া খাওয়াবে। কোন এক পীরের কাছ থেকে আনা চাল পড়া খেলে নাকি যে চোর তার গলায় চাল আটকে রক্তবমি হবে। ইশার টেনশন হলো, ও এমনিতেই কাচা চাল খেতে পারে না। দেখা গেল চাল চিবুতে গিয়ে বমি করে ফেলল। আর তাতে যদি ওকে চোর ভেবে নেয়!
ফুটপাতে হাটার সময় হঠাৎই একটা গাড়ী এসে কাদাপানি ছিটিয়ে দিলো ইশার গায়ে। ইচ্ছে করলো ওখানে বসেই করে কাঁদে। কিন্তু সেটা করা যাবে না কিছুতেই। আজ অনির জন্মদিন। আজকের দিন টা কোনোভাবেই মাটি করা যাবে না।
অনির সকালে আসার কথা থাকলেও আসতে পারলো না। তিনজনের দেখা হলো সন্ধ্যেবেলা। ইশা রেগে লাল হয়ে গেলেও তূর্য সব টা ঠান্ডা করে ফেলল। অনি এসে বলল, স্যরি দোস্ত তোরা রাগিস না প্লিজ।
ইশা কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল। তূর্য মিনমিনে গলায় বলল,
“স্যরি তো তোর কাছে আমার বলা উচিত”।
অনিক বুঝতে না পেরে বলল, কেন?
তূর্য কাচুমাচু করে বলল, তোর জন্য কেক এনেছিলাম কিন্তু একটু একটু করে খেতে খেতে অনেক টা খেয়ে ফেলেছি।
ইশা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বলল, একটু একটু! সিরিয়াসলি!
এই শোন ও প্রতিবারে খাবলা মেরে খেয়েছে আর বলছে একটু।
তূর্য নিজের হয়ে সাফাই গাইতে গেলে অনিক থামিয়ে দিয়ে বলল, থাক থাক প্লিজ তোরা ঝগড়া করিস না। আমার কেক লাগবে না।
ব্যাগ থেকে একটা কাগজ বের করে ইশা বলল, এই নে এইটুকু তোর জন্য বাকী ছিলো।
অনিক স্মিত হেসে কেকের টুকরো টা কাগজসহ নিলো। হাতের আঙুল কে ছুড়ি বানিয়ে কেটে বাকী দুজন কে খাইয়ে দিলো।
তূর্য কেক খেতে খেতে বলল, দোস্ত রাগিস না। মাসের শেষ তো! আর বাপ টা হলো আস্ত হারামি। এতোবার টাকা চাইলাম, পায়ে ধরলাম তাও দুটো টাকা দিলো না! এরচেয়ে গুলিস্তানের ফুটওভার ব্রিজে বসলেও একটা মান থাকতো। খুচরো খাচরা মিলিয়ে কাচ্চির টাকা তো জুটে যাবে।
ইশা আর অনিক দুজনেই একসাথে হেসে ফেলল। ইশা বলল,
“আচ্ছা চল তোদের আজ আমি বিরিয়ানি খাওয়াবো”।
তূর্য খুশিতে লাফিয়ে উঠলো। অনিক অনুনয় করে বলল, ইশু আজ না রে। আজ বাসায় মা অনেক রান্না, বান্না করে বসে আছে।
তূর্যর মুখ টা চুপসে গেল। ইশার ও মন খারাপ হলো। দুজনের মন খারাপ দেখে অনিক বলল,
“দোস্ত তোরা প্লিজ মন খারাপ করিস না। আমরা কাল কিংবা পরশু একসাথে খাই?”
তূর্য হঠাৎই লাফিয়ে উঠে বলল, এই ইশু চল আমরা অনির বাসায় যাই। আন্টির হাতের রান্না খেয়ে আসি। জন্মদিন উপলক্ষ্যে নিশ্চয়ই ভালো মন্দ রান্না হয়েছে।
অনিকের পাংশুটে মুখ দেখে ইশার বুঝতে বাকী রইলো না যে অনিক কেন খেতে চায় না।
কপট রাগ দেখিয়ে ইশা বলল, হ্যাঁ এখন বনানী গিয়ে তারপর আবার আজিমপুর ফিরবো তাই না! তারচেয়ে চল এক কাজ করি, কাচ্চি কিনে অনির বাসার সবার জন্য পাঠিয়ে দেই আর তুই আর আমি এখানে বসেই খাই।
অনিক নতমস্তকে সব টা মেনে নিলো। আর কিছু বললে এই নাটকটুকু হয়তো তূর্য ও বুঝে যাবে। ঘরে চাল, ডাল তেমন কিছুই নেই। যা ছিলো তা দিয়ে দুপুরে অভির কয়েকজন বন্ধুদের খাওয়ানো হয়েছে, টিউশনির টাকা টাও পাওয়া যায় নি। এখন বাজার না নিয়ে গেলে মানুষগুলো না খেয়ে থাকবে।
বিরিয়ানির প্যাকেটগুলো হাতে নিয়ে অনিক কিছু বলতে যাবে তখনই ইশা ফিসফিস করে বলল, উঁহু বন্ধুদের কাছে কোনো লজ্জা নেই। এরপর যদি এরকম নাটক আর দেখি তাহলে চড়িয়ে দাঁত ফেলে দেব।
অনিক মাথানিচু করে হাসলো। ইশা আবারও বলল, আমার সামনে মাথা উচু করে হাসবি গাধা।
সুরাইয়া বেগমের বুক ধরফড় করছে। অনিটা এখনো কেন আসছে না! বার বার ঘড়ি দেখছে আর মোবাইল হাতে নিচ্ছে। নয়টা বেজে গেছে। রহমান সাহেব সাধারণত ভাত খায় ১০ টার মধ্যে। আজ এখনো রান্না বসাতে পারলো না। তার উপর রুপাটা দুপুরে ভাত খেয়েছে শুধু কাচামরিচ দিয়ে। পেপে আর ডিমের তরকারি যেটা করেছিল সেটা অভি আর তার বন্ধুরা’ই খেয়ে নিয়েছে। খেতে গিয়ে ডাল ছাড়া আর কিছুই পাওয়া গেল না। এখন যদি রাতে ফিরেও এই অবস্থা দেখে তাহলে কুরুক্ষেত্র বাধিয়ে ফেলবে।
অনিকের ফিরতে সাড়ে নয়টা বেজে গেল। সুরাইয়া যেন প্রান ফিরে পেল। ছুটে এসে বলল, এতো দেরি করলি কেন?
“দেরি করিনি মা। রাস্তায় জ্যাম ছিলো”।
“বাজার এনেছিস?”
খাবারের প্যাকেট টা মায়ের হাতে দিয়ে হাত মুখ ধুতে গেল অনিক। সুরাইয়ার মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠলো। প্যাকেট খুলতেই পাঁচশ টাকার চকচকে দুটো নোট পেয়ে সুরাইয়ার মন ভালো হয়ে গেল। রান্নাঘর থেকে বেরোতেই অনিক কে বলল, খুব বাঁচান বাঁচালি রে বাবা। এই এক হাজার টাকা হাতে পেয়ে সারাদিনের সব টেনশন দূর হলো।
অনিক মুহুর্তেই বুঝে যায় এই কাজ ইশার। প্রতি মাসে যে সময় অনি অর্থসংকটে পড়ে তখন ইশা এসে বাঁচায়। এ নতুন কিছু নয়! সারাদিনের অভুক্ত অনিক এক লোকমা বিরিয়ানি মুখে তুলে ঝাপসা চোখে ভাবে, একদিন পুরো শহরে মাইক দিয়ে সারাদিন বলবে ইশা তুই এতো ভালো কেন!
তূর্য রাতের শেষ সিগারেট টা খেল না। পকেটে আছে কেবল মাত্র চৌত্রিশ টাকা। সেটা খোয়ানো যাবে না। মালিবাগ থেকে আজিমপুর যেতে এই টাকা টা কাল লাগবে। সকালে বাবার কাছ থেকে আনা এক হাজার টাকা লুকিয়ে অনির বিরিয়ানির প্যাকেটে কৌশলে ঢুকিয়ে দিয়েছে। অনি হয়তো কনফিউজড হয়ে যাবে যে কে দিলো টাকাটা। হয়ে গেলে যাক। ভালোবাসা ব্যাপার টা আড়ালে থাকাই ভালো। এই এক হাজার টাকা যদি সামনাসামনি অনিকে দেয়া হতো তাহলে হয়তো সেটা ও দয়া ভেবে নিতো, কিংবা নিজেকে ছোট ভাবতো। তারচেয়ে বরং এখন সেটাকে ভালোবাসা ভেবে তৃপ্তি পাক।
চলবে…..