#বৃষ্টি_ভেজা_গোলাপ
#পর্ব_৪২
#নবনী_নীলা।
রুহির বুকের ভিতরে দ্রিম দ্রিম শব্দটা সময়ের সাথে সাথে যেনো আরো দ্রুত গতিতে বাড়ছে। আর আগেও তো বিয়ে হয়েছিলো তার এই মানুষতার সাথে কিন্তু এমন অনুভুতি আর কখনো হয়নি। লজ্জা, ভয়, ভালোলাগা সব মিলিয়ে অন্যরকম এই অনুভুতি। ফুল দিয়ে সাজানো বিছানায় বধূ বেশে বসে আছে রুহি। এমন একটা দিন জীবনে আবার আসবে কে জানতো?
দরজা বন্ধ করার শব্দে যেনো রুহি থমকে গেলো। নীচে তাকিয়ে থেকেও রুহি ঠিক বুঝতে পারছে আহান দরজায় হেলান দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। মাথার ঘোমটাটা খুলেলে ফেলা খুব ভুল হয়েছে, এবার না পারছে কোনদিকে তাকাতে না পারছে চোখ বন্ধ করতে। লোকটা আসার আগে একবার নক করে আসতে পারে না।
আহান রুহিকে কিছুক্ষণ ভালো করে তাকিয়ে রইল তারপর বললো,” আমি এইখানে দাড়িয়ে আছি। তুমি ওদিকে কি দেখছো?” আহানের কণ্ঠ শুনতেই রুহির শরীর শিউরে উঠলো। রুহি মাথা নিচু করে ফেললো। গাল দুটো একেবারে লাল হয়ে গেছে। আহান রুহিকে এভাবে নিচে তাকিয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে এসে রুহির কোলে মাথা রাখতেই রুহি হকচকিয়ে উঠলো। আহানের চোখে চোখ রাখতেই রুহির বুকের ভিতরের দ্রিম দ্রিম শব্দটা দশগুণ জোড়ে শুরু হয়েছে। রুহি সঙ্গে সঙ্গে চোখ সরিয়ে নিলো।
” বউ সাজে কি প্রথমবারও তোমাকে এতো সুন্দর লেগেছিলো? এতো সুন্দর লাগলে তো প্রথমবারই তোমার প্রেমে পরার কথা। নাহ্ প্রথমবার তোমার চেহারায় একটা জিনিষ মিসিং ছিলো?”, বলেই রুহিকে ভালো করে দেখতে লাগলো। রুহি আড় চোখে একবার তাকিয়ে আবার চোখ সরিয়ে নিলো। তারপর বললো,” কি মিসিং ছিলো?”
আহান কিছুক্ষণ দেখে বললো,” প্রথমবার তোমার চেহারায় লজ্জা মিসিং ছিলো।”
রুহি কথাটায় গাল ফুলিয়ে তাকালো। তারপর বললো,” হুংকার দিয়ে আমাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে দিয়েছিলেন আবার আমি আপনার লজ্জা নিয়ে তাকাতে যাবো?আপনাকে দেখে লজ্জা পাওয়ার কি ছিলো?”
” তখন লজ্জা পাওনি তাহলে এখন কেনো পাচ্ছো?”, দুষ্টু হাসি দিয়ে বললো আহান।
” তখন তো আর আপনি আমার কোলে এসে মাথা রাখেন নি।”, নিচু স্বরে বললো রুহি।
” কি করবো? আমার বউকে আমি দেখবো না? আর লজ্জা পাওয়া ভালো, খারাপ না। লজ্জা পেলে তোমায় এতো সুন্দর লাগলে প্রথমরাতে হুংকার দিয়ে না, আদর করেই ঘুম ভাঙ্গাতাম।” ঠোট এলিয়ে বললো আহান।
রুহি চোখ পিট পিট করে তাকালো আহানের দিকে। তারপর বললো,” আপনি উঠুন তো আমার কোল থেকে।”
” কেনো?”, একটা ভ্রু তুলে বললো আহান। রুহি চোখ সরিয়ে বললো,” জানি না। আপনি উঠুন।”
” আর ইউ সিওর?”, বলে প্রশ্ন করতেই রুহি আহানের মাথা তুলে উঠিয়ে দিতেই আহান রুহির সামনে বসে পড়লো তারপর এক টান মেরে রুহিকে পিছন ফিরিয়ে জড়িয়ে ধরলো। রুহি মাথাটা আহানের বুকে রাখতেই আহানের হার্টবিট শুনতে পেলো। রুহির কাছাকাছি আসলে আহানেরও হার্টবিট বেড়ে যায় ভেবেই ভালো লাগছে রুহির, ঠোঁট চেপে হাসলো সে। তারপর আহানের মুষ্টি বন্ধ হাতের উপর নিজের হাত রেখে বললো,” আপনি আমায় এতো ভালোবাসেন কেনো?” প্রশ্নটা অনেক সাহস নিয়ে করলো রুহি বুকের ভিতরটা ক্রমাগত ধুক ধুক করছে। আহান রুহির প্রশ্ন শুনে নিরবে হেসে ফেললো। আহানের এমন নিরবতা রুহিকে আরো অস্থির করে তুলেছে।
” আমার সবচেয়ে অপছন্দের রং কি জানো?”, রুহি ঘাড় ঘুরিয়ে ভ্রূ কুচকে তাকালো আহানের দিকে তাকালো।জিজ্ঞেস করলো কি আর উনি বলছে কি!
আহান রুহির দিকে ঝুকে বললো,” হলুদ, যেটা তোমার খুব পছন্দের। কিন্তু হলুদ রঙটা যে এতো সুন্দর সেটা তুমি আমার জীবনে না আসলে হয়তো আমি বুঝতাম না।তোমাকে ঘিরে থাকা সবকিছুই কেনো জানি আমার ভালোলাগে! আমার সব কিছু তোমাতেই শুরু আর তোমাতেই শেষ। কাউকে আমি এতটা ভালোবাসবো আমি নিজেও ভাবিনি। ” আহানের প্রতিটা কথা রুহিকে শিউরে তুলছে। অন্যরকম এক ভালোলাগা ঘিরে ধরেছে রুহিকে। এক চিলতে হাসি নিয়ে রুহি আহানের বুকে মুখ গুজে ফেললো। তারপর আহানের দিকে মুখ তুলে আহানের দিকে তাকিয়ে বললো,” আপনি কি মিষ্টি খেয়ে এসেছেন?”
আহান ভ্রু কুচকে বললো,” মিষ্টি! মিষ্টি কেনো খাবো?”
” না, মানে এতো মিষ্টি মিষ্টি কথা বের হচ্ছে আপনার মুখ থেকে। ভাবাই যায় না।”,উপহাস করে বললো রুহি।
আহান রুহির চুলের খোপাটা হুট করে খুলে দিলো, হুট করে আহানের এমন কাজে রুহি চমকে গেলো। আহান ঠোঁটের কোণে হাসি নিয়ে বলল,” তুমি থাকতে আমার অন্যকোনো মিষ্টির কি প্রয়োজন?”
আহানের ঠোঁটের হাসি দেখে রুহি একটা ঢোক গিললো। আহানের মতলব রুহির কাছে একদম ভালো লাগছে না। রুহি কায়দা করে একটু সরে যেতেই আহান এগিয়ে আসতে লাগলো। আহান রুহির দুই হাত ধরে বিছানার সাথে আস্তে করে চেপে রেখে বললো,” ভালো করেছো, মিষ্টির কথা মনে করিয়ে। আমি তো ভুলেই গেছিলাম।”
” আমি মোটেও সেটা বুঝাই নি আপনি উল্টা পাল্টা বুঝেছেন। শুধূ শুধূ এখন আমাকে…”, বলেই মুখ ঘুরিয়ে ফেললো রুহি।
” আমি তো মিষ্টি কথা বলতে পারি না। জীবনে কোনদিন বলিনি। ঠিক আজ বলছি, এই যে তুমি বউ সেজে বসে আছো না। তোমার এই সাজটা আমার খুব নষ্ট করে দিতে ইচ্ছে করছে। তোমার ঠোঁটের লিপস্টিকটা ইচ্ছে করছে.” এতটুকু শুনেই রুহি চেঁচিয়ে বললো,” হয়েছে, হয়েছে।আমি আর শুনতে চাই না। থামুন আপনি।”
” নাহ্ আজ কেনো থামবো? মিষ্টি খেয়ে নাকি মিষ্টি কথা বলি। আরো যেনো কি কি বলতে? হ্যা কুম্ভকর্ণ! রাইট?”, রুহির একদম কাছে গিয়ে বললো আহান।
কুম্ভকর্ণ কথাটা শুনে রুহি হেসে ফেললো। তারপর বললো,”সে আপনি যাই বলুন, নামটা কিন্তু সেই। কুম্ভকর্ণ!”
” আমায় যে কুম্ভকর্ণ বলছো,তুমি জানো কুম্ভকর্ণ কি করে?”,
” দিন,রাত নাক ডেকে ঘুমায় আপনার মতন।”, বলেই হাসতে লাগলো তারপর নিজের হাত ছাড়াতে চাইলো।
” আমি দিন রাত ঘুমাই? আচ্ছা ঠিক আছে তোমার ধারণা আমি আজই ভুল প্রমাণ করছি।”, বলেই রুহির এক হাত ছেড়ে দিয়ে আস্তে করে রুহির ব্লাউজের ফিতাটা টান দিয়ে খুলে ফেলতেই রুহির মুখের হাসি গায়েব হয়ে গেলো। আহান ফিতাটা রুহিকে দেখিয়ে আস্তে করে মেঝেতে ছুড়ে ফেলে বললো,” আজ তোমার ঘুম আমি হারাম করছি।”ঠোঁট এলিয়ে বললো আহান। রুহি চোখ পিট পিট করে তাকালো। আহান রুহির কাছে এগিয়ে আসতেই রুহি মুখ ঘুরিয়ে বাচ্চা কন্ঠে বললো,” আমি তো এমনেই বলেছি। আর কোনো দিন বলবো না।”
আহান ঠোঁট চেপে হাসি আটকিয়ে রুহির চেহারাটা হাত দিয়ে নিজের দিকে ঘুরিয়ে রুহির ঠোঁটে অধর ছুয়ে দিলো। স্পর্শের গভীরতায় দুজনের হারিয়ে গেলো।
সকালে পর্দার ফাঁক দিয়ে মিষ্টি রোদ রুহির মুখে আদর খেয়ে,রুহির ঘুম ভাঙিয়ে দিল। চোখ দুটো আস্তে আস্তে খুতেই বাম দিকের খালি গায়ে তার সুদর্শন বরের দিকে চোখ গেল রুহির। মিষ্টি রোদের হালকা আভা এসে পড়েছে আহানের মুখেও। আহান রুহির মাথার কাছে হাত রেখে রুহির দিকে তাকিয়ে আছে। রুহি চটজলদি গায়ের চাদরটা দিয়ে শরীর ভালো করে মুড়িয়ে নিলো। তারপর আড় চোখে আহানের তাকিয়ে আবার সরিয়ে নিলো।
” ঘুম হয়েছে মিসেস কুম্ভকর্ণ?”, বলেই নিচের ঠোঁট কামড়ে হাসলো আহান।
রুহি আড় চোখে তাকিয়ে রইলো। মিসেস কুম্ভকর্ণ আবার কি কথা? যা ইচ্ছে বলুক, এই কুম্ভকর্ণ শব্দটা সে আর জীবনেও মুখে আনবে না। রুহি আহানের দিকে তাকাতেই রুহির মুখটা লাল আভায় ঢেকে গেলো। সঙ্গে সঙ্গে রুহি চোখ সরিয়ে নিলো। আহান আস্তে করে চাদরের ভেতর থেকে রুহির হাত বের করে আনলো। তারপর রুহির ডান হাতের অনামিকায় সুন্দর একটা আংটি পড়িয়ে দিতেই রুহি অবাক হয়ে আহানের দিকে তাকালো। আহান রুহির হাতে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে রুহিকে জড়িয়ে ধরলো।
রুহি হাতের আংটির দিকে তাকিয়ে বললো,” আংটি কেনো?”
” আমি চাই এটা তুমি সবসময় পড়বে।”, বলেই রুহির ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে দিলো। আহানের শীতল স্পর্শে শিউরে উঠলো রুহি।
রুহি আংটির দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখলো আংটির ডিজাইনটা ইংরেজি শব্দ এ দিয়ে শুরু। রুহি সঙ্গে সঙ্গে আহানের ডান হাতটা দেখলো আহানের আংটির ডিজাইনটা ইংরেজি শব্দ আর দিয়ে শুরু তার উপর ডায়মন্ডের কাজ করা দেখেই যেনো রুহির মনটা ভালো হয়ে গেলো। আহান রুহির কানের কাছে মুখ এনে বললো,” পছন্দ হয়েছে?”
” হুম, খুব।”, বলেই দুজনের হাত একসাথে ধরে দেখতে লাগলো রুহি। এই গিফটা রুহির খুব পছন্দ হয়েছে। রুহির চেহারায় হাসি ফুটে উঠলো। আহান রুহির গলায় আস্তে করে একটা কামড় বসাতেই রুহি উফ করে শব্দ করে উঠলো। তারপর সরে এসে বললো,” কি করলেন এটা?”
আহান হাত বাড়িয়ে রুহিকে কাছে আনতে যাবে রুহি চাদর জড়িয়ে উঠে গিয়ে বির করে বলে ” অসভ্য “, ওয়াশরুমের দরজা লাগিয়ে দিল। আহান রুহির রাগ দেখে হেসে ফেললো।
গোসল সেরে নীল রঙের একটা শাড়ী পরে চুলের পানি নিতে নিতে বের হলো রুহি। চুলের পানি ঝরাতে গিয়ে রুহি করিডোরে গিয়ে দেখলো একগুচ্ছ হলুদ গোলাপ রাখা কাল রাতের বৃষ্টিতে ভিজে আছে সেগুলো। রুহি তোয়ালেটা একপাশে রেখে #বৃষ্টি_ভেজা_গোলাপ গুচ্ছ হাতে নিয়ে দেখতে লাগলো। আহান রুম থেকে বেরিয়ে এসে রুহিকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরতেই রুহি বললো,” এগুলো আপনি এনেছেন?”
আহান গোলাপের দিকে তাকিয়ে বললো,” হুম্ কিন্তু ভিজে গেছে।”
” তাও কি সুন্দর লাগছে।”, বলেই আহানের দিকে তাকালো আহান চেয়ারের ওপর থেকে তোয়ালে নিয়ে রুহির চুলের পানি মুছে দিতে দিতে বলল,” হুম, তোমার মতোন কিন্তু পার্থক্য হলো ওটা #বৃষ্টি_ভেজা_গোলাপ আর তুমি পানিতে ভেজা বিড়াল।” রুহি বাচ্চাদের মতন ঠোঁট উল্টে তাকালো আহানের দিকে। তারপর আহানের মুখে হাত দিয়ে খামচি দেওয়ার ভান করে” মিয়াও” শব্দ করলো। আহান রুহির বাচ্চামি দেখে হেসে ফেললো, এমন সময় দরজায় নক পড়তেই রুহির দৃষ্টিতে সেদিকে গেলো।
ভেতর থেকে কোনো শব্দ না পেয়ে তন্বী আরো জোড়ে নক করতে লাগলো। আহান বিরক্তি সুরে বললো,” শুরু হয়ে গেছে, চলে এসেছে ডিস্টার্ব করতে।” রুহি ফুলটা টেবিলে রেখে দরজা খুলতে এগিয়ে যেতে নিতেই আহান রুহির কোমড় জড়িয়ে ধরলো তারপর বললো,” কোথায় যাচ্ছো? হুম?”
” আরে কি আজব! দরজায় নক করছে তো ছাড়ুন।”,
” ছাড়বো কিন্তু বদলে আমি কি পাবো?”, একটা ভ্রু তুলে বললো আহান।
” বদলে কি চান?”, তাড়া দিয়ে বললো রুহি। ওদিকে তন্বী দরজায় টোকা দিতেই থাকলো।
থামলো না।
আহান নিজের গালটা রুহির সামনে এগিয়ে দিতেই রুহি চোখ বড় বড় করে তাকালো। এর মাঝে টোকা দিতে দিতে বিরক্ত হয়ে তন্বী বললো,” দ্বিতীয়বার বিয়ে করেছিস তবুও প্রেম কমে না তোদের। আমি নীচে গেলাম, তাড়াতাড়ি আয় দাদু অপেক্ষা করছে নাস্তার টেবিলে।”
কথাটা শুনেই রুহি আহানকে ঠেলতে লাগলো। তারপর বললো,” কি শুরু করেছেন ছাড়ুন তো। সবাই কি ভাববে আমাকে যেতে দিন।”
“আমি যা চাই সেটা না পাওয়া পর্যন্ত ছাড়ছি না। সো ডু ইট ফাস্ট। দাদু অপেক্ষা করছে।”, রুহি গাল ফুলিয়ে এগিয়ে এসে আহানের গালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো। আহান রুহির মাথার পানি মুছে দিয়ে রুহির হাত ধরে সেদিনের মত নীচে নামলো। কিন্তু সেদিন রুহি রাগে ফুলতে ফুলতে নীচে নেমেছিলো আর আজ লজ্জায় লাল হয়ে।
[ #সমাপ্ত ]