#বেটারহাফ
writer: #Nishat_Tasnim_Nishi
পার্ট:৪
সে অনুতপ্ত তার ব্যবহারের প্রতি আর এজন্য সে মনেমনে ঠিক করেছে অবশ্যই সে ক্ষমা চাইবে বৃষ্টির কাছে। বিনিময়ে বৃষ্টি যদি শাস্তিও দিতে চায় সে মেনে নিবে।
তার ভাবনাচিন্তার সুতো ছিড়ে যায় মায়ের ডাকে। সে মুখ তুলে তাকায় মায়ের দিকে।
শাহিনুর বেগম কঠোর সুরে বললেন,–” তোমার হাতে মাস খানেক সময়, এর মধ্যে যেনো আমি সুসংবাদ শুনতে পারি। আরেকটা জজরুরি বিষয় আজকের পর রাত্রির সাথে তোমার সব যোগাযোগ বন্ধ! নির্দিষ্ট সময়ে যদি আমি খবর না পাই তাহলে রাত্রিকে তুমি সারা-জীবনের জন্য ভুলে যেতে হবে।ওর ছায়াও তুমি খুঁজে পাবে না!”
মায়ের কথা শুনে সাগর চমকে যায়! চোখ দুটো বড় বড় করে ফেলে সে,শ্বাস-প্রশ্বাস অস্বাভাবিক হতে লাগলো! রাত্রিকে সারা জীবনের জন্য হারানোর কথা সে চিন্তাও করতে পারে না। কত কষ্ট,যুদ্ধ আর বিদ্রোহের পর সে রাত্রিকে পেয়েছে। কত রাত নির্ঘুম কাটিয়েছে এই রাত্রির জন্য!কী না করেছে তাকে নিজের করতে!
তার একজীবন শেষ হয়েছিলো রাত্রিকে পাওয়ার জন্য।কতগুলো দিন হাসিখুশিতে কেটেছে তাদের।ইশশ কি মধুমাখা প্রেম ছিলো! কে জানতো সেই খুশি টা মাত্র কয়েকদিনের জন্য উপহার ছিলো তাদের জীবনে।বাচ্চা না হওয়ার খবর রটতেই ঝড়ের মতো তাদের সুখের জীবনগুলো এলোমেলো হয়ে যায়!জীবন এমন কেনো হয়?
মায়ের কঠোর আদেশকে সে মাথা পেতে নিলো,তার যে আর কিছুই করার নেই। সে নিরুপায়, মায়ের কাছে ওয়াদাবদ্ধ সে! বুক ফেটে কান্না আসছে তার, তবুও কাঁদতে পারছে না। ছেলেদের যে কাঁদতে নেই! এটাই তো বর্তমান সমাজের নিয়ম। মাথা নাড়িয়ে চলে আসলো মায়ের কক্ষ থেকে।
৬.
ঘরের দিক সব মিটমাট করে হসপিটালের উদ্দেশ্য রওনা দেয় সাগর। তার প্রচুর টেনশন হচ্ছে বৃষ্টির জন্য, নিজের প্রতি তিক্ত রাগ লাগছে তার। বিয়ের পর আজ অবধি দু দন্ড কথাও বলে নি বৃষ্টির সাথে। সবসময় এড়িয়ে যেতো, মেয়েটাও কিছু বলতো না নিজের মতো থাকতো। কিন্তু আজ হঠাৎ করো সে এমন উগ্র আচরণ করায় হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে সাগর। ক্ষমা চাইতে হবে তাকে নাহলে যে সে নিজের সাথে নজর মিলাতে পারবে না।
হাসপাতালে পৌঁছাতেই দেখলো বৃষ্টি অন্যদিকে শুয়ে আছে। শিফা ছাড়া ঘরের বাকি সদস্য বাড়ীতে চলে গিয়েছে মাত্রই। সব রিপোর্ট সাবমিট করে সে এসেছে বৃষ্টির কাছে। বৃষ্টিকে দেখে প্রচন্ড ঘৃণা আর শরম হচ্ছে নিজের প্রতি।
সে ধীর কন্ঠে ডাক দিলো বৃষ্টিকে। বৃষ্টি হকচকিয়ে তার দিকে তাকালো। বৃষ্টির চোখে দেখা দিয়েছে এক রাশ ভয়, সে নিজেকে গুটিয়ে নিতে লাগলো।
সাগর নিচু সুরে বললো,–“বাড়ী যেতে হবে।ডাক্তার রিলিজ দিয়েছে!”
বৃষ্টি মাথা নাড়িয়ে নিজে নিজে উঠতে লাগলো। সাগর এগিয়ে এসে তার হাত ধরলো উঠতে সাহায্য করার জন্য। বৃষ্টি সাগরের স্পর্শ পেয়ে ছিটকে সরে গেলে,শরীর তার ভয়ে কাঁপছে। বৃষ্টিকে কাঁপতে দেখে সাগর অবাক চোখে তাকালো।
বৃষ্টি কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,–“প্ল্ প্লিজ আমাকে মা্ মারবেন না। আমি কিছু করি নি!”
সাগর সাথে সাথে উল্টো ঘুরে গেলো। সে বুঝলো বৃষ্টি তাকে ভয় পাচ্ছে। মুহূর্তেই সে কেঁপে উঠলো, কত বাজে ভাবে মারলে কেউ এমন বিহেভ করে? নিজের জানোয়ারের মতো ব্যবহারের প্রতি সে তীব্র নিন্দিত হলো। তার খারাপ লাগছে। ক্যানালারে মুষ্টিবদ্ধ করে ঘুষি মারলো সে,রাগ উঠলে কেনো সে নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারে না?হোয়াই?
নিজেকে সামলিয়ে সে বৃষ্টির দিকে ফিরলো। খুব শান্তস্বরে বললো,–” মারবো না।এদিকে আসো!”
বৃষ্টি মাথা নাড়িয়ে বললো না,” আমি জানি আপনি মারবেন।প্লিজ মারবেন না! আপনি যদি বলেন আমি এখনই চলে যাবো,তবুও মারবেন না প্লিজ। ”
সাগর ধৈর্য হারা হয়ে গেলো। সে কঠোর কন্ঠে বললো,–“আর একবার ডাকবো যদি না আসো তাহলে মারবো।তুমি কী মার খেতে চাও?”
বৃষ্টি মাথা নাড়িয়ে বললো না। সাগর বললো তাহলে চলে এসো।বৃষ্টি সুরসুর করে সাগরের কাছে চলে আসলো।তা দেখে বেশ অবাক হলো, সকালে কত তেজ দেখেছিলো মেয়েটার।
বৃষ্টিকে শিফার সাথে গাড়ীতে বসিয়ে ডাক্তারের কাছে গেলো সাগর। ডাক্তার বলেছে যাওয়ার সময় যেনো দেখা করে যায়।
সাগরকে দেখেই ডাক্তার লিনা ইশারায় ওয়ার্ডবয়কে চলে যেতে বললো। ডক্টর লিনা সাগরদের ফ্যামিলি ডক্টর। সাগরের বাবার বন্ধুর বউ হলো ডক্টর রিনা!
সাগর বসতেই ডক্টর লিনা বললো, –“মেয়েটা কে? মেডিকেল ফরমে তুমি ওর হ্যাসবেন্ড কেনো লিখেছো?তোমার বউ তো রাত্রি তাই না?”
–“ও বৃষ্টি! আমার সেকেন্ড ওয়াইফ!”
—“হোয়াটটট??তুমি দ্বিতীয় বিয়ে করেছো? বাট হোয়াই?”
সাগর নিচু সুরে বললো –” পরে বলবো, অনেক কাহিনী!”
লিনা আর কথা বাড়ালো না। সে রেগে আছে সাগরের উপর। কত কষ্ট করে হ্যান্ডেল করেছে বৃষ্টির কেস। অল্পের জন্য নারী নির্যাতন কেস হয়ে যেতো। মূলত সাগরকে ফর্মে হ্যাসবেন্ড লিখতে দেখেই তিনি মিথ্যা বলে সব হ্যান্ডেল করেছেন। তাছাড়া শাহিনুর বেগমও ফোন দিয়ে বলেছিলেন বৃষ্টির সব ট্রিটমেন্ট যেনো তিনি করেন আর এ ব্যাপার টা যেনো লিক না হয়।
সাগর মুখ তুলে বললো,—” আন্টি আপনি না কি যেনো বলবেন।”
–“হু বলবো তো।আগে বলো মেয়েটাকে এমন জানোয়ারের মতো মেরেছে কে?”
লিনার কথায় সাগর লজ্জা পেয়ে গেলো। চোখমুখ খিঁচে বললো যে সে মেরেছে।
কথাটা শুনেই লিনা আরো রেগে যায়।রাগান্বিত কন্ঠে ধিক্কার জানিয়ে বললো,–“সাগর আমার বিশ্বাস হচ্ছে না তুমি এত নিচ! ছিঃ কীভাবে পারলে একটা বাচ্চা মেয়েকে এভাবে মারতে? তোমার কোনে আইডিয়া আছে যে কী কী হতে পারতো মেয়েটার সাথে?জানো, ওর ব্রেইনে প্রচন্ড চাপ পড়েছে।ইভেন, নিউরন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে! বাচ্চা একটা মেয়ে,মাত্র ১৯ বছর চলছে।এই বয়সে এত চাপ নিতে পেরেছে যে এই ঢের! ”
সাগর মাথা নিচু করে চুপ করে রইলো। লিনা দম নিয়ে সাগরকে সতর্ক করে বলতে লাগলো বৃষ্টির অসুস্থতার কথা। তিনি সাফ বলেছেন যে বৃষ্টিকে যেনো কোনে প্রকার মেন্টাল স্ট্রেস দেওয়া না হয়। যেনো একদম টেনশন মুক্ত রাখা হয়। নাহলে মষ্তিষ্কের ভেতর রক্ত ক্ষরণ হয়ে সে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলতে পারে। মাথার পেছনের ঘা শুকানো পর্যন্ত যেনো সে প্রোপার বেড রেস্টে থাকে। তিনি আরোও কিছু নির্দেশ দিলেন বৃষ্টির হেল্থের ব্যাপারে। সাগর সবকিছু মনোযোগ দিয়ে শুনলো এরপর লিনার সাথে আরো কিছুক্ষণ আলাপ করে উঠে চলে আসলো! আলাপের বিষয় ছিলো রাত্রির জ্বরের ব্যাপার!
৭.
সন্ধ্যা নেমেছে মাত্রই, চারপাশে ঝিঁ ঝিঁ পোকারা শব্দ করছে, পাখিরা ফিরে গিয়েছে নিজেদের নীড়ে! চাতক পাখির মতো সাগর ও ফিরে এসেছে ঘরে তার অর্ধাঙ্গিনীকে দেখার জন্য। দুপুরে বাড়ী ফিরে এসেছিলো বৃষ্টিকে নিয়ে।
বৃষ্টিকে ঔষধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছিলো সে। রাত্রিকেও ঔষধ দিতে গিয়েছিলো কিন্তু সে পারে নি। কারন হলো তার মা রাত্রির রুমে শিফ্ট হয়েছেন। দরজা থেকেই তাকে তাড়িয়ে দিয়েছেন তিনি। সে কিছু বলতেও পারছিলো না। তবুও ফিরে আসার সময় মুখ ফুটে বললো, –“মা আমি একবার ওকে দেখি?”
শাহিনুর বেগম মুখের উপর দরজা লাগিয়ে দিলেন আর সাফ জানিয়ে দিলেন যে যতদিন তিনি কাঙ্ক্ষিত খবর না পান ততদিন রাত্রির আশেপাশেও তার ছায়া পড়তে দিবেন না।তাই সে দুপুরে রাগ আর জেদ নিয়ে চলে গিয়েছিলো। বাহিরে আড্ডা দিয়ে মাত্রই ফিরেছে বাড়ীতে। রাত্রির রুমের পাশে যেতেই সাগরের মা তাকে কঠোর কন্ঠে বললেন,–“আমি যদি আর একবার তোমাকে ওর কাছে যেতে দেখি তাহলে এর পরিণতি কতটা ভয়ংকর করবো তুমি ভাবতেও পারবে না!”
সাগর চুপচাপ চলে আসলো সেখান থেকে। তার ভেতরে কি চলছে সেটা আর প্রকাশ করলো না। রুমে আসতেই দেখলো বৃষ্টি বেঘোরে ঘুমুচ্ছে। আর কাঁপছে। বৃষ্টি কপালে হাত রাখতেই সে চমকে গেলো। প্রচন্ড জ্বর!
ডক্টর লিনা বলেছিলো শরীরের ব্যাথায় হয়তো জ্বর আসবে। হয়েছেও তাই। রাত্রির থেকেও বেশি জ্বর হয়েছে বৃষ্টির। থার্মোমিটারে ১০৪ ডিগ্রি দেখাচ্ছে। সাগর দ্রুত বাটিতে পানি নিয়ে এসে তাকে জলপট্টি দিতে লাগলো। সাগর শুনতে পেলো বৃষ্টি বিরবির কিছু বলছে।
বৃষ্টি কী বলছে তার কিছুই স্পষ্ট নয়।
সাগর উঠে আসতে নিতেই বৃষ্টি তার টি-শার্ট খামছে ধরে! সাগর চমকে তাকায় তার দিকে। বৃষ্টি জ্বরের ঘোরে বলতে লাগলো,–“আপনি ওর কাছে যাচ্ছেন,তাই না?”
সাগর মাথা নাড়িয়ে বললো,–“না!”
–“আমি জানি,আপনি ওখানেই যাচ্ছেন। আমি যেতে দিবো না, ওই ডাইনী মেয়ের কাছে একদম যেতে দিবো না।”
–“আচ্ছা যাবো না।এবার তো ছাড়ো,আমি বাটি রেখে আসবো!”
বৃষ্টি জেদ ধরে বললো না, আপনি যাবেন আমি জানি।আজকে আমি কোথাও যেতে দিবো না
সাগর বাধ্য হয়ে ওর পাশে শুয়ে পড়লো। বৃষ্টি ঘুরে তাকে জড়িয়ে ধরলো।এতেই সাগর কেঁপে উঠলো, প্রচন্ড অস্বস্তি হচ্ছে তার! তবুও চুপ করে কপালে এক হাত দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলো সে।
ঘন্টাখানেকের মধ্যেই বৃষ্টির জ্বর ছেড়ে দেয়। সাগর উঠে কাঁথাটা বৃষ্টির শরীরে টেনে দিয়ে বারান্দার দিকে পা বাড়ালো। এখন সিগারেট না খেলে চলবে না তার।
চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার, বারান্দার ড্রিম লাইটের আলোয় তাকে অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে!
খোলা বারান্দায় দাড়িয়ে সিগারেট দ্বারা তৃষ্ণা নিবারণ করছে সে। ! মিনিটখানেকের মধ্যেই চার-পাঁচটা শেষ করে ফেলেছে সে! ঠান্ডা হাওয়ার সাথে তার উস্ক-খুশকু চুল নড়ে ওঠছে!
সিগারেটের আগুনের মতো বুক জ্বলছে তার।
পঁচিশ বছরের জীবনে সে দুটো বিয়ে করেছে। একটা বিয়েও সে নিজ ইচ্ছা বা পছন্দে করে নি। প্রথম বিয়েটা পরিস্থিতি সামলাতে আর দ্বিতীয় টা কথা রাখতে করতে হয়েছে।
জীবনের তেইশ বসন্ত পেরিয়ে রাত্রি এসেছিলো তার জীবনে। বসন্তের রঙ্গিন ফুল আর তাজা হাওয়ার মতো আসেনি তার জীবন রঙ্গিন করত! এসেছিলো কালবৈশাখী ঝড়ের মতো!
রাত্রিকে,,,
.
চলবে?
[ টিটি টিকা দিয়েছি, হাত ব্যাথা করছে।কি লিখতে কী লিখেছি জানি না।তাই, ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করবেন। ]