বেটারহাফ পর্ব ৯+১০+১১

#বেটারহাফ
#নিশাত_তাসনিম_নিশি
| পর্ব ০৯ |

সাগরের কথা শুনে বৃষ্টি লজ্জা পেলো। সে কী ভাবলো আর কী হলো? হাত বাড়িয়ে ছোঁ মেরে শার্ট নিয়ে নিলো। সাগর উল্টো দিকে ঘুরতেই সে ফটাফট জামা টা পরে নিলো।

শার্টের রং ধবধবে সাদা। বৃষ্টির পরনের টপস গাঢ় লাল। যার ফলে শার্ট পরার পরেও সব স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছিলো। তাড়াহুড়ো করে বোতাম লাগানোর কারনে সঠিকভাবে লাগানো হয়নি। উপরের অংশ টা অনেক ফাকা রয়ে গিয়েছে। ভোজা শরীরের কারণে সবকিছুই দৃশ্যমান।
জানালা দিয়ে বৃষ্টির ঝিরঝিরে ফোটা পানি এসে ভিজিয়ে দিয়েছিলো তাকে। বৃষ্টিকে এতটা মোহনীয় লাগছে যে, যে কোনো পুরুষ ই এক পলক দেখাতেই গায়েল হয়ে যাবে।

সাগর স্বাভাবিকভাবেই বৃষ্টিকে দেখছে। বৃষ্টি মাথা নিচু করে দাড়িয়ে একটু পর পর মুখের সামনে পড়া চুলগুলো কানের পিঠে গুজে দিচ্ছে। সাগর প্যান্টের পকেটে দুই হাত পুরে ভ্রু কুচকে তার কান্ড দেখছে। বৃষ্টির মধ্যে সে অস্বস্তি দেখছে না বরং লজ্জা দেখছে। সে বুঝে উঠছে না বৃষ্টির তার মতো অস্বস্তি কেনো হচ্ছে না? তবে কী বৃষ্টি তার প্রতি দূর্বল? নাকি অন্যকিছু?

নিজের ধারনা সঠিক কি না জানতে সে একটা বুদ্ধি আটলো। ধীরে ধীরে বৃষ্টির দিকে এগুতে লাগলো সে। বৃষ্টিও পিছাতে লাগলো। বৃষ্টির একদম পিছনেই দেওয়াল যার কারণে সে দুকদম যেতেই তার পিঠ দেওয়ালে ঠেকে যায়।

সাগর দুই হাত উঠিয়ে তার দুই পাশে রাখলো। বৃষ্টি চোখ তুলে তাকায় সাগরের দিকে। তার চোখে অন্যরকম মাদকতা! গভীর আকুতি ভরা সেই চাহনী।

সাগর তার মুখটা এগিয়ে নেয় বৃষ্টির দিকে, সে পরম আবেশে চোখ বন্ধ করে নেয়। সাগর কয়েক সেকেন্ড তার দিকে তাকিয়ে দ্রুত সরে গিয়ে উল্টো ঘুরে যায়। সে যা ভেবেছে তাই ঠিক।

সাগরের কোনো সাড়া-শব্দ না পেয়ে বৃষ্টি চোখ খুলে। সে তাকিয়ে দেখে সাগর তারী সামনেই, সে তার থেকে কয়েক ইঞ্চি দূরে দাড়িয়ে আছে।

সাগরের এমন কান্ডে বৃষ্টি প্রচন্ড আহত হয়। বিষয়টা তার ইগো তে লাগলো। চোখে জল চলে এলো। দু-দুবার এমন করার কারণ কী?

সাগর দুই হাত দিয়ে তার মাথা চেপে ধরে বলে,

—“তুমি আমার উপর দূর্বল,বৃষ্টি। কিন্তু এটা তো হওয়ার কথা নয়।”

বৃষ্টি টলমল চোখে বলে, –“কেনো হওয়ার কথা নয়?”

সাগর নিশ্চুপ। তা দেখে বৃষ্টি কিছুটা ক্ষেপে উঠে। সে আওয়াজ করেই বলে, –” আপনি কী পর-পুরুষ? আপনি আমার স্বামী। আপনার উপর দূর্বল হওয়া কি জায়েজ নয়?এটা কী আমার অপরাধ?”

সাগর মাথা তুলে ওর দিকে তাকায়। বৃষ্টির চোখ দিয়ে জল ইতোমধ্যে গড়িয়ে পড়েছে। সে সাগরের একদম সামনে গিয়ে বলে, –“জবাব দেন। এটা আমার কি অপরাধ? ”

সাগরের সাড়া শব্দ না পেয়ে সে ঘুরে দাড়ায়। হাটতে হাটতে জানালার পাশে গিয়ে দাড়ালো। চোখের জল দুই হাত দিয়ে মুছে ফেলে বলে উঠে,–“জানেন। মা যেদিন আমাকে বলেছিলো আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে। সেদিন আমার ভেতর অন্যরকম অনুভূতি হয়ে গিয়েছিলো। নাম না জানা এক অনুভূতি ঘিরে ফেলেছিলো আমায়। সব মেয়ের মতো আমারও স্বপ্ন ছিলো বেশ ঘটা করে আমার বিয়ে হবে। অনেক আয়োজন হবে, খুব আনন্দ করবো। কিন্তু তা একদম হয় নি। আমার বিয়েটা একদম সাধারণভাবে ঘরে কাজি এনে হয়েছিলো। আমি মেনে নিয়েছিলাম। ছোট ঘরের মেয়ে আমি, এমন বিয়েও আমার কপাল জুটেছে এই ঢের। এত বড় ঘর থেকে আমার বিয়ের প্রস্তাব আশায় আমি খুবই বিচলিত হয়েছিলাম। বারবার প্রশ্ন করেছি এত বড় ঘর থেকে আমার মতে সাধারণ মেয়ের কেনো বিয়ের প্রস্তাব এসেছে?কি আছে আমার? মা কে জিজ্ঞেস করতেই তিনি বলেছেন,–“আপনার নাকি আমাকে পছন্দ হয়েছে। আমাকে নাকি আপনি ভালোবেসে ফেলেছেন সেজন্য বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছেন।”
এ কথা শুনে আমার ভেতর দ্বিতীয়বার নাড়া দিয়ে উঠেছিলো আপনার জন্য। মনে মনে সারাক্ষণ আপনাকে নিয়ে ভাবতাম।
বিয়ের প্রথম রাতে যখন আপনি আমায় বলেছিলেন, –” আমার মনে হয় আমাদের কিছু সময় দেয়া দরকার এ সম্পর্ককে।”
সেদিন আবারো আপনার জন্য আমার মনে অনুভূতি তৈরী হয়ে যায়। আগের দুই অনুভূতির থেকে এই অনুভূতির জোর বেশি ছিলো। যা আমাকে আপনাকে ভালোবাসতে বাধ্য করেছিলো। আপনার সুদর্শন চেহারায় আমি প্রথমেই মুগ্ধ ছিলাম। প্রথমদিন ই আপনাকে আমার ভালো লেগে গিয়েছিলো। এরপর আমার সাথে এমন দূরত্ব রেখে চলা, পর্যাপ্ত সময় দেওয়া এসব আমাকে আপনার প্রতি নতুন অনুভূতি সৃষ্টি করিয়ে দেয়। আমার মন সেই অনুভূতির নাম দেয় ভালেবাসা। হ্যা আমি ভালোবেসে ফেলেছিলাম আপনাকে। যা ছিলো আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল।

বিশ্বাস করেন আমি একবারের জন্যেও মনের ধারে কাছে আনি নি যে বাচ্চা পয়দা করার জন্য আমাকে বিয়ে করেছেন আপনি! আমি কখনোই ভাবি নি আমি বাচ্চা জন্ম দেওয়ার মেশিন হিসেবে কারো জীবনে ভূমিকা রাখবো।
এসব শুনে নিজেকে এই পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট প্রাণী মনে হয়েছিলো। সবচেয়ে বেশি কষ্ট লেগেছিলো যখন জেনেছিলাম আমার আপন মা এসবে শামিল ছিলো।

আচ্ছা আমি কি এতটা তুচ্ছ? আমি কি কাউকে ভালেবাসতে পারি না? আমার কি কোনো অনুভূতি নেই? আমি কি রোবট?”

বৃষ্টির কথা শেষ হতেই সাগর ওর দিকে তাকায়। সে দেখে বৃষ্টি কাঁদছে। শেষের কথাগুলো বারবার উচ্চারণ করছে আর চোখের জল ফেলছে। সাগর এখনও নিরব। সে কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। তার নিজের জীবন টাও যে বেড়াজালে আটকানো। সাগর এগিয়ে গেলো তার কাছে। বৃষ্টি তখনও কাঁদছে।

সাগর কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে উঠে,–“চলে যাও। তুমি দূরে চলে যাও ।”

বৃষ্টির কান্না বন্ধ হয়ে গেলো। সে হতবাক হয়ে বলে,–“মানে?”

সাগর দ্রুতগতিতে বলে উঠে,—” তুমি পালিয়ে যাও। এখানে থাকলে তুমি কখনো সুখী হতে পারবে না। আমি কখনো তোমাকে ভালোবাসতে পারবো কী না আদৌ জানি না। আমার কাছে তুমি সুখী থাকবে না সেটা নিশ্চিত। তাই,আমি তোমাকে ডিবোর্স দিয়ে দিবো। আর আমাদের মধ্যে তো কোনো গভীর সম্পর্ক নেই, তাহলে তো কোনে সমস্যা হবে না।
তুমি দূরে কোথাও চলে গিয়ে নতুন জীবন শুরু করো। চিন্তা করো না এদিক আমি সামলিয়ে নিবো। কাউকে তোমার কথা বলবো না। তোমার পরিবারকেও আমি চালাবো। ”

বৃষ্টি চোখ বড় বড় করে তাকায় সাগরের দিকে। মষ্তিষ্ক টা মিনিটখানেকের জন্য অচল হয়ে যায়। সাগরের কথা বার্তা শুনে সে স্পষ্ট বুঝতে পারছে সাগর কতটা সিরিয়াস। বৃষ্টি বুঝে উঠতে পারছে না সাগর এসব কেনো বলছে?

আচমকা সাগর ওর হাত ধরে বলে উঠে, –“চলো। ”

বিষ্ময়ে বৃষ্টি কিংকর্তব্যবিমূঢ়! সে ঝাঁঝালো গলায় বলে উঠে,–” আশ্চর্য! আমি এভাবে কোথায় যাবো? আপনি আমার জামা-কাপড় দেখতেছেন না?এসব পরে এত রাতে কই যাবো?”

সাগর বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়িয়ে বলে–“হ্যা,তাই তো। এগুলো পরে তো তুমি বাহিরে যেতে পারবে না। দাড়াও, আমি মাহিকে ডাকছি। ওর রুমেই তো তোমার জামাকাপড়,তাই না?”

সাগর বৃষ্টির হাত ছেড়ে দিয়ে চলে যেতে নিলো। বৃষ্টি দ্রুত গতিতে ওর হাত চেপে ধরলো। নিজের দিকে সাগরকে ঘুরিয়ে ঝাঁকিয়ে বলে উঠলো,–” আপনি কি পাগল?এখন কয়টা বাজে? এত রাতে আপনি মাহিকে ডাকতে যাচ্ছেন? আর এই ঝড়-বৃষ্টির রাতে আমি কই যাবো? আপনার কানে কি শিলাবৃষ্টির আওয়াজ যাচ্ছে না?”

বৃষ্টির ঝাঁকানিতে সাগরের হুশ ফিরে আসলো। সে আশপাশ তাকিয়ে দেখলো, বাহিরে অনেক ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছে। সত্যিই তো এত রাতে কই আর কীভাবে যাবে?

সাগর মাথা নাড়িয়ে বলে,–“হ্যা,তাই তো।এখন আমি, আমি কী করবো? আচ্ছা, আমি না হয় কাল সকালে তোমাকে দূরে পাঠিয়ে দিবো ঠিক আছে?”

বৃষ্টির রাগ উঠে গেলো। সাগর সেই কখন থেকে উল্টাপাল্টা বলছে।

দাঁতে দাঁত চেপে বৃষ্টি বলে,
—” আমি কী বলেছি আমি চলে যেতে চাই?”

—“না তো।”

—“তাহলে আপনি কেনো এসব বলতেছেন?”

সাগর চুপ করে যায়। বৃষ্টি তার দিকে এখনও চেয়ে আছে। সে বৃষ্টির দিকে হতাশ চাহনি দিয়ে বলে,–“তাহলে কী করবো আমি?”

বৃষ্টি রেগে বলে,–” যা ইচ্ছা তাই করুন।”

সাগর অবাক চোখে তাকায়। বৃষ্টি রাগে গজগজ করতে বিছানায় গিয়ে ধপাস করে শুয়ে পড়ে। সাগর তার দিকে কয়েক সেকেন্ড ছোট ছোট চোখ করে তাকায়। এরপর সে দৃষ্টি সরিয়ে গালে হাত দিয়ে গভীর ভাবনায় ডুব দেয়, সে কী করবে?

১৩.

শাহিনুর বেগমের সাথে শুয়ে আছে রাত্রি। ঘুমের ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে রাত্রিকে জড়িয়ে ধরেন তিনি। রাত্রির চোখে তখনও ঘুমের ছিঁটেফোটাও নেই। গত কয়েকদিন থেকেই তার প্রতিটা রাত নির্ঘুম কাটে। আজকের রাতে তো তার আরো ঘুম আসবে না। স্বামী তার অন্য নারীর সাথে দূরে কোথাও। সে কীভাবে শান্তিতে চোখের পাতা এক করবে? দ্বিতীয় কারন তার বাবা। বাবার সম্পর্কে এসব শুনে তার চোখের ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছে। বাবা-মায়ের বিচ্ছেদের কারণ টা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে তার।
শাহিনুর বেগম জড়িয়ে ধরায় সে কেঁপে উঠে। সে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় উনার দিকে। আলতো হাতে ছুঁয়ে দেয় উনার মুখ। উনার দিকে তাকিয়ে হাসলো এরপর চোখ দুটো জোরপূর্বক বন্ধ করলো ঘুমানোর চেষ্টায়। কখন যে চোখ লেগে যায় সে টেরও পায় নি।

শেষ রাতে হট্টোগোলের আওয়াজ পেয়ে ঘুম ভেঙ্গে যায় রাত্রির। ধড়ফড়িয়ে ওঠে দেখে তার পাশে কেউ নেই।পাশের রুম থেকে চিল্লাপাল্লার আওয়াজ ভেসে আসছে। শাশুড়ি আর্তনাদের সুর তার কানে বাজতে লাগলো। সে দ্রুত উঠে গেলো।

রাত্রি দৌড়ে রুমের বাহিরে যেতেই তার শাশুড়ি তাকে জড়িয়ে কেঁদে উঠলেন।

রাত্রি ভয় পেয়ে যায়। সে অস্থির হয়ে বলে,–“মা কী হয়েছে?”

শাহিনুর কাঁদার জন্য কথা বলতে পারছেন না। তবুও তিনি অস্ফুটসুরে রাত্রির নাম টা উচ্চারণ করলেন।
#বেটারহাফ
#Nishat_Tasnim_Nishi

| পর্ব ১০+১১ |

শাহিনুর বেগম কাঁদার জন্য কথা বলতে পারছেন না। তবুও তিনি অস্ফুটসুরে রাত্রির নাম টা উচ্চারণ করলেন।
রাত্রি উনাকে ধরে সোফায় বসিয়ে দিলো। টেবিলের উপর থেকে এক গ্লাস পানি ঢেলে নিলো। গ্লাস টা শাহিনুর বেগমের দিকে এগিয়ে দিতেই তিনি ঢকঢক করে গিলে ফেললেন।

শাহিনুরের হাত থেকে গ্লাস টা টেবিলের উপর রেখে সে নরম কন্ঠে বললো,–“মা, এবার বলুন কী হয়েছে? ”

শাহিনুর কাঁদতে কাঁদতে রুমের দিকে ইশারা করে বলে উঠলেন,—“শিফা,শিফা!”

রাত্রি কপাল কুচকে তাকায় পেছনে। শাহিনুরকে রেখে সে দ্রুত পায়ে হেটে যায় শিফার রুমের দিকে।

পুরো বিছানা রক্তে ভেসে যাচ্ছে, শিফা বিছানায় শুয়ে কাতরাচ্ছে। রাত্রির চোখ বড়বড় হয়ে যায়। শিফাকে ধরে সে বসিয়ে দেয়। শিফা অঝোরে কাঁদছে, কষ্টের জন্য সে কথাও বলতে পারছে না।

রাত্রি শিফাকে রেখে দৌড়ে যায় বড় ভাবীর রুমের দিকে। জোরে জোরে সোহাগীর রুমের দরজায় কড়াঘাত করতে থাকে রাত্রি। এত রাতে ঠকঠক আওয়াজ শুনে ঘুম ভেঙ্গে যায় সোহেলের। সে হাত বাড়িয়ে সোহাগীকে ডাকে, সোহাগী তার হাত টা উল্টে সরিয়ে বলে,–“উফফ,ঘুমাতে দাও!”

দুবার ডেকেও সোহাগীর কোনো রেসপন্স না পেয়ে সে বিরক্তি নিয়ে উঠে। রাত্রি বিরতিহীন ভাবে তখনও দরজায় কড়াঘাত করে চলছে।

সোহেলের বিরক্তি আর রাগী কন্ঠে বলে,–“আসছি!”

সোহেলের আওয়াজ পেয়ে রাত্রি থেমে যায়।
দরজা খুলে রাত্রিকে দেখে সোহেল অবাক হয়ে যায়। সে ভ্রু কুচকে রাত্রিকে জিজ্ঞেস করে,–“কী হয়েছে?”

রাত্রি হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,–“ভাইয়া,শিফাকে ডাক্তারের কাছে নিতে হবে। ”

সোহেল বড়বড় চোখ করে বলে ” কী?কেনো?”
রাত্রি চুপ করে রইলো। সোহেল রাত্রিকে এড়িয়ে শিফার রুমে ছুট লাগালো। পিছন পিছন রাত্রিও গেলো।

রুমে এসে বোনের অবস্থা দেখে সোহেল পাগল প্রায়।রাত্রি একটা মোটা চাদর দিয়ে শিফাকে পেঁচিয়ে দিলো। সোহেল বোনকে কোলে নিয়ে বাহির হয়ে গেলো। ড্রাইভারকে হাক ছেঁড়ে ডাক দিয়ে হসপিটালের দিকে রওনা দিলো। ওদের পিছন রাত্রি আর শাহিনুর বেগম ও ছুট লাগালো।

★★★
শিফার প্রেগন্যান্সির দুইমাস চলছে। সেদিন শশুড়বাড়ী থেকে শাহিনুর তাকে নিয়ে এসেছেন খবর টা শুনামাত্রই। যেদিন বৃষ্টি চেঁচিয়ে রাত্রির বিষয় বলছিলো সেদিন শিফার জামাই এসেছিলো শিফাকে দেখতে। শিফার জামাই শিফা বলতে পাগল। বউকে অন্ধের মতো ভালোবাসেন তুষার । তাই তো বউ আর বাচ্চার সুস্থ থাকার জন্য শশুড়বাড়ী রেখে গিয়েছেন।

তুষারের মা কড়া আদেশ-নিষেদ দিয়ে বউকে পাঠিয়েছেন। একমাত্র ছেলের একমাত্র বউ। বউয়ের সুস্থতার জন্যই পাঠিয়েছেন।

মেয়ের বাবার বাড়ী থেকে খবর পেয়ে তুষার আর তুষারের মা রওনা দেয় হাসপাতালের দিকে। হাসপাতালে পৌঁছাতে সাড়ে সাত টা বেজে যায় তুষারের।

কিছুক্ষণ আগে ডাক্তার বলেছে বাচ্চা মিসক্যারেজ হয়ে গিয়েছে। কথাটা শুনামাত্রই সবার মাথায় বাজ ভেঙ্গে পড়ে। শিফা তো একদম ভেঙ্গে যায়। শাহিনুর বেগম স্তব্ধ হয়ে বসে আছেন।
তুষারের মা এসে এ খবর শুনে যা নয় তা বলে বেড়াচ্ছেন। আগের বাচ্চা টাও একমাস না হতেই নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো। শাহিনুর বেগম তখন উনাদের বাড়ীতে গিয়ে তুষারের মা কে বাজেভাবে অপমান করে এসেছেন। মিথ্যা অপবাদ দিয়ে বলেছেন যে, “মেয়েকে দিয়ে নাকি ভারী কাজকর্ম করায়। রাতদিন কাজ করায়।” আরো অনেক কথা শুনিয়ে এসেছিলেন।
এবার তুষারের মাও ছাড় দিচ্ছেন না। তিনিও কম কথা শুনাচ্ছেন না সাগরের মা কে। ঘরবর্তী সকল সদস্য প্রায় বিরক্ত তুষারের মায়ের উপর।

রাত্রি তুষারের মায়ের উদ্দেশ্য বলে,–” আন্টি, পরে এসব বলতে পারবেন। শিফা সুস্থ আছে এটাই বেশ। ”

তুষারের মা রাত্রীর কথা শুনে জ্বলে উঠলেন। তেজী গলায় বলেন,–” তুমি আর কথা বইলো না। নিজেই তো বাজা তুমি কী বুঝবা এসবের?”

তুষারের মায়ের কথা শুনে রাত্রি চুপ করে যায়। যা মুখ ফুটে সাহস করে কথা বলেছিলো সেটাও গায়েব হয়ে যায়।

—” তোমার শাশুড়ির তিন পোলা। বড় দুই পোলার দুইটা বাচ্চা আছে। এরপরেও তোমার জামাইরে আবার বিয়ে করাইছে বাচ্চার লাইগা। আর আমার এক পোলা, মাইয়াও নাই আমার। তাইলে আমি আমার পোলারে দ্বিতীয় বিয়া করাইতে পারুম না?”

তুষারের মায়ের কথা শুনে পুরো ঘরবর্তী মানুষ স্তব্ধ হয়ে যায়। শিফা কাতর দৃষ্টিতে তাকায় নিজের মায়ের দিকে। রাত্রি চমকে উঠে,সোহেল তেড়ে যায় তুষারের মায়ের দিকে।

তুষার এগিয়ে এসে থামিয়ে দেয় সোহেলকে।

—“মা,তুমি এসব কী বলছো? শিফার অবস্থার কথা তো একবার ভাবো।”

—“আমি কী বলছি মানে? সত্য কথা কইছি যে এরলাগি গায়ে ফোসকা পড়তাছে,বুচ্ছোস? আর বাচ্চা না হইলে তোরে দ্বিতীয় বিয়া করামু না?”

—“আহা, মা। তুমি থামবে?”

—“তুই চুপ করে বস। ডাক্তার কী বলেছে শুনিস নাই? বলেছে তোর বউয়ের থাইরয়েড, এজন্যই বারবার ভ্রুন নষ্ট হয়ে যায়। ”

—“উনারা তো আর বলে নাই যে বাচ্চা হবে না।”

—“বাচ্চা হবে, এটারও তো নিশ্চিত দেয় নাই।”

তুষার চুপ করে গেলো। সে জানে, মা কে এখন দুনিয়ার সকল মানুষ এসে বুঝালেও তিনি বুঝবেন না। নিজের কথাই উপরে রাখবেন তিনি। তুষার চোখের ইশারায় বউকে চুপ থাকতে বললো। শাহিনুর বেগম চুপচাপ সব শুনছেন, কী বলবেন তার আদৌ জানেন না তিনি। সোহেল সবাইকে শিফার রুম থেকে বের করে নিয়ে গেলো, সে জানে এখানে তারা থাকলে বোনের আরো কষ্ট হবে।

রাত্রি গরম দুধ নিয়ে এসে বসলো শিফার পাশে। শিফার পিঠ বিছানায় ঠেকিয়ে বসিয়ে দিলো।

—“নাও,ফটাফট খেয়ে নাও। কিছুটা আরাম লাগবে। ”

শিফা গ্লাস টা হাতে নিয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রাত্রির দিকে। রাত্রি কিছুটা হেসে বলে,–“কী?”

—“তোমার খুব কষ্ট হয়েছিলো তাই না ভাবী?”

রাত্রি হকচকিয়ে যায়। সে নড়েচড়ে বসে বলে,–“কীসের কথা বলছো তুমি?”

—“তুমি যখন জেনোছো বাচ্চা হবে না তোমার তখন খুব কষ্ট হয়েছিলো তাই না?”

রাত্রি হেসে বলে,—“তোমার এখন যেমন লাগছে আমারও ঠিক তেমন লেগেছে । তবে তোমার তো এখনো আশা আছে,আমার তো সম্ভাবনাই নাই।”

শিফা চুপ করে যায়। তা দেখে রাত্রি বলে,—“এসব বাদ দাও। দুধ খেয়ে নাও, আরাম লাগবে।”

শিফা রাত্রির চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,–” ভাইয়া বিয়ে করেছে যে তোমার কষ্ট হয় না? খারাপ লাগছে না?”

রাত্রি মুচকি হেসে বলে,–” আগে হতো এখন হয় না। আর তোমার ভাইয়া আমার কথাতেই বিয়ে তো রাজি হয়েছিলো। আমার জেদ ছিলো বাচ্চার সেজন্যই রাজি হয়েছে। ”

শিফা আরো কিছু বলতে নিচ্ছিলো রাত্রি তা না শুনে তাকে জোর করিয়ে দুধ খাওয়াতে লেগে যায়। ভাগ্যের কী লীলাখেলা যে ভাবীকে আগে শিফা দেখতে পারতো না আজ তার দুঃখ সে অনুভব করছে।

★★★

সকাল দশটা বেজে গিয়েছে এখনও সাগর আর বৃষ্টির ঘুম থেকে উঠার কোনো খবর নেই।
রেহানা বেগম মাহিকে পাঠালেন তাদের ডেকে তুলার জন্য। মাহি নেচে নেচে ওদের রুমের দিলে পা বাড়ালো। দরজায় হালকা আওয়াজ করে কড়াঘাত করলো।

মাহি হাক দিয়ে বলে উঠে,–” ভাইয়া, আম্মু অপেক্ষা করছে টেবিলে। তাড়াতাড়ি আসো।”

ঘন্টা আধেক পর খেতে আসে সাগর আর বৃষ্টি। রেহানা বেগম তাদের দেখে হাসলেন, হাসিমুখে বাইপো কে আদর-সমাদোর করতে লাগলেন।

খাওয়াদাওয়ার পর্ব শেষ হতেই সাগর মাহিকে বলে,–” মাহি তোমার সাথে আমার কথা আছে। ছাদে আসো। ”

সাগরের কথা শুনে মাহির পেটের ভেতর মুচড়ে উঠে। সে চোখ বড় বড় করে বৃষ্টির দিকে তাকায়। বৃষ্টি মিষ্টি হেসে তাকে অভয় দিয়ে বলে,–“যাও। ”

মাহি মাথা দুলিয়ে না বলে। বৃষ্টি চোখ দিয়ে তাকে শান্ত করে বলে,–“কিছু করবে না যাও।”

মাহি ভয়ে ভয়ে ছাদের দিকে হাটা দেয়। সাগর আগেই চলে গিয়েছে। বৃষ্টি রেহানা বেগমের সাথে প্লেট-ভাসন রান্নাঘরের দিকে নিয়ে যেতে লাগলো। বৃষ্টিকে রেহানা বেগম বারবার বারণ করলো, কিন্তু সে শুনলো না। স্বাচ্ছন্দ্যবোধ নিয়েই সে কাজ করতে লাগলো।

রেহানা বেগম মনে মনে ভারী খুশি হলেন। রেহানা বেগম বৃষ্টিকে তরকারী এগিয়ে দিলেন কাটার জন্য। বৃষ্টি পেয়াজ গোল করে কাটছিলো তখন রেহানা বেগম বলে উঠেন,—“সাগরের মাও কোমড়ে সাড়ী গুজে কাজ করতেন। ”

রেহানার কথায় বৃষ্টি অবাক হয়ে যায়। এভাবে কাটতেন মানে? আর সাগরের মা অর্থাৎ শাশুড়ী মা তো রান্নাঘরের কোনো কাজ করেন না। উনি বলেছিলেন বিয়ের পর থেকেই কাজের মেয়ে সব কাজ করতেন। আর তিনি তো শাড়ী পরে না।

বৃষ্টি কৌতুহল নিয়ে বলে,—“আগে কাটতেন মানে?”

রেহানা বেগম থতমত খেয়ে যায়। তিনি কথা ঘুরিয়ে বলেন,–” তোমার কাটা হয়েছে?বাহ,বেশ সুন্দর হয়েছে তো।”

—“আপনি কথা ঘুরাচ্ছেন কেনো? আমার থেকে কিছু কী লুকাচ্ছেন? ”

—“না,তো।কই, কী লুকাবো?”

বৃষ্টি রেহানা বেগমকে জোর করতে লাগলো।

—“আপনি তখন বলছেন সাগরের মা ও ওভাবে কাটতেন। তাহলে কী এখন যে সাগরের মা তিনি সাগরের মা নন?”

রেহানা বেগম চোখ বড়বড় করে ফেলেন। তিনি বৃষ্টিকে তাড়া দিয়ে বলেন,–” তুমি বড্ড কথা বলো। তাড়াতাড়ি ওগুলো দাও রান্না করতে হবে তো।”

বৃষ্টি আবারো জোর করতেই তিনি বললেন,—“তুমি সাগরকে জিজ্ঞেস করো সে বলবে! ”

বৃষ্টির সন্দেহ এবার আরো গাঢ় হয়ে গেলো। তার মানে সাগরের মা তার আপন মা নন। তাহলে তার আপন মা কে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here