#বেলা_শেষে। [০৫]
সুফায় গুটিশুটি মেরে বসে দুহাতে কুশন জড়িয়ে রেখে টেলিভিশন দেখছে ভূমিকা। সাউথ ইন্ডিয়ান মুভির গান দেখছে। ভূমিকার ইচ্ছে করছে গানের তালে তালে ডান্স করার। ছোটবেলার এমন কতই না হতো। টেলিভিশনের ভলিউম বাড়িয়ে দিয়ে একা একা ডান্স করতো সে। ছোট বেলার কথা মনে আসতেই মৃদু হাসলো। এদিকে দিগন্ত এক্কেবারে রেডি হয়ে ড্রয়িংরুমে আসলো। ড্রয়িংরুমে এসে ভূমিকাকে এভাবে টেলিভিশন দেখতে দেখে দিগন্তের মেজাজ বিগড়ে গেলো। এক ঘন্টা আগে ভূমিকাকে রেডি হতে বলেছিলো সে। আজ ভূমিকার কলেজের ফাস্টডে। তাই একটু আগে যেতে চাইছিলো। কিন্তুু ড্রয়িংরুমে এসে দেখলো ভূমিকার রেডি হওয়ার কোন নাম গন্ধই নেই। সে আয়েশ করে বসে টিভি দেখছে আর মিটমিট করে হাসছে। ভূমিকার হাসির কারনটা বুঝতে পারলো না দিগন্ত। তাই সে ভ্রু কুচকিয়ে টেলিভিশনের দিকে তাকালো। সেদিকে তাকাতেই সে কাপলদের রোমান্টিক দৃশ্যবলি দেখতে পেলো। ওও আচ্ছা এই তাহলে হাসির কারন। তারপর ভূমিকার কাছে গিয়ে সুফার উপর থেকে রিমোট নিয়ে টিভি অফ করে দিলো। হঠাৎ করে টিভি অফ হয়ে যেতেই ভূমিকার মন খারাপ হয়ে যায়। আনমনেই বলে ফেলে,
-এখনি কারেন্ট যেতে হলো। কত সুন্দর রোমান্টিক গান হচ্ছিল। বলেই কুশন রেখে উঠে দাঁড়ায় আর তখনি দিগন্তের সাথে ধাক্কা খায়। ঘটনাক্রমে ভূমিকা সুফার উপর পরে যায় আর দিগন্ত সেখানেই ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে।
-জলহস্তীর মতো শরীর নিয়ে এখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?? ও মা আমার কোমড়টা মনে হয় ভেঙে গেলো।
-স্টোপ, আর একটু যদি সাউন্ড করছো তাহলে তোমাকে,,,,,
-কি? কি করবেন আপনি?? জলহস্তী একটা। বলতে বলতে সোজা হয়ে দাঁড়ায় ভূমিকা। দিগন্তের মুখোমুখি দাঁড়াতেই ওর হাতের দিকে চোখ পরে। ভূমিকা কোমড়ে হাত গুজে সেদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে,
-আপনি টিভি অফ করে দিয়েছেন??
-হ্যাঁ দিয়েছি তো??
-কেন? সুফায় বসতে বসতে বলল ভূমিকা।
-তোমাকে কখন বলছি রেডি হতে। আর তুমি এখানে বসে বসে রোমান্টিক গান শুনছো। যাও রেডি হয়ে এসো। ধমক দিয়ে বলল দিগন্ত।
-এই আপনার মাথায় কি আছে বলুন তো? ইচ্ছে করছে আপনার মাথা ফাটিয়ে দেখে নেই। আপনার মাথায় ভেতরে কি আছে। মগজ নাকি গোবরের পোকা। বিরক্তি মাখা মুখ করে দিগন্তের দিকে তাকিয়ে বলল ভূমিকা।
– বড্ড বেশী কথা বলো তুমি। যাও রেডি হয়ে এসো। আমি ওয়েট করছি।
-আমি সিউর আপনার মাথা ভর্তি গোবরের পোকা। আপনি আমাকে কলেজে নিয়ে যাবেন। সেখানে তো আপনার বন্ধুরাও থাকবে তাদের কি বলবেন হুম। আপনি এতটাই উদার মনের মানুষ, যে কাজের মেয়েকে কলেজে নিয়ে এসেছেন পড়াতে। শেষ বাক্যটা ব্যাঙ্গ করেই বলল। ভূমিকার কথা শুনে হাত দিয়ে তার চাপ দাড়িতে স্লাইড করতে করতে সুফায় বসে পড়লো দিগন্ত । এবার সেও বেশ চিন্তিত। পরক্ষনেই একটা আইডিয়া মাথায় এলো দিগন্তের। হাসি মাখা মুখ করে ভূমিকার দিকে তাকিয়ে বলল,
-ঝটপট প্যাকেট হয়ে যাও।
-মানে। ভ্রু কুচকিয়ে বলল ভূমিকা।
-মানে, বোরখা পরে প্যাকেট হয়ে নাও। তাহলে তো তোমাকে আর কেওই চিনতে পারবে না।
-কিন্তুু বোরখা পাবো কোথায়। আমার তো বোরখা নেই। ইনোসেন্ট মুখ করে বলল ভূমিকা। ভূমিকার কথা শুনে উঠে দাঁড়ায় দিগন্ত। টি-শার্ট টেনেটুনে ঠিক করে বলল,
-আজ তোমার কলেজে যেতে হবে না। আমি ফেরার সময় তোমার জন্যে বোরখা নিয়ে আসবো। বলেই সামনের দিকে পা বাড়ায় দিগন্ত। কয়েক পা এগিয়ে যেতেই আবার পিছনের দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলে, দরজাটা লক করে রেখে। আমি ব্যতিত অন্য কেও আসলে দরজা খুলবা না। মনে থাকবে। ভূমিকা উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে দিগন্তের কথার সম্মতি দেয়। অতঃপর দিগন্ত চলে যায়। দিগন্ত চলে যেতেই ভেতর থেকে দরজা লক করে দেয় ভূমিকা।
ক্যাম্পাসে বন্ধুদের সাথে আড্ডাদিচ্ছে দিগন্ত। এমন সময় মিমি আসলো ওদের কাছে। মিমিকে দেখেই দিগন্ত মৃদু হাসলো। যার ফলে মিমি লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে। নওশাদ দিগন্তের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,
-ভাই এটা ক্যাম্পাস। চোখে চোখে কথা বলা বন্ধকর। দিগন্ত নওশাদের পেটে ওর হাতের কুনুই দিয়ে ধাক্কা দিলো। মিমি এসে দিগন্তের পাশে পর হাত জড়িয়ে ধরে বসলো। তারপর আহ্লাদী সুরে বলল,
-তুমি কেমন যেন হয়ে যাচ্ছো দিগন্ত। তিন দিন ধরে আসছো অথচ একবারের জন্যেও আমার সাথে দেখা করো নি।
-সরি ডার্লিং। জানোই সামনে আমার এক্সাম পড়াশুনা নিয়ে ভিষন ব্যাস্ত। তাই চাইলেও এখন আগের মতো করে তোমাকে সময় দিতে পারছি না।
মিমি দিগন্তের কাঁদে মাথা রাখলো। তখন তপু হালকা কাঁশি দিলো। মিমি সাথে সাথে দিগন্তের কাঁদ থেকে তার মাথা সড়িয়ে নিলো। তখন মিমির চোখ পড়লো মাহিনের উপর। ছেলেটা মুখ গুমড়া করে চুপচাপ বসে আছে। মিমি উৎসাহ নিয়ে মাহিনকে জিগ্যেস করলো,
-মাহিন ভাই, আপনার কি মন খারাপ। প্রতিউত্তরে মৃদু হেসে মাথা নাড়ালো মাহিন। না তার মন খারাপ নয়। দিগন্ত তপু আর নওশাদ শক্ত চোখে তাকালো মাহিনের দিকে।
বন্ধুূদের সাথে আড্ডা শেষ করে বাসায় ফিরবে তখনি মিমি দিগন্তকে বলে, সে মার্কেটে যাবে। আর তখনি দিগন্তের মনে পরে ভূমিকার কথা। ভূমিকা তো বাসায় একা আছে। তার আরো আগে বাসায় যাওয়া উচিৎ ছিলো। মিমি বায়না ধরে সে দিগন্তের সাথে যাবে। পরক্ষনেই মনে পড়ে ভূমিকাকে বলা কথা। উহঃ বোরখার কথা একদমই মনে ছিলো না। এখনি শপিংমলে যেতে হবে। মিমির সাথে গেলে সে কিছুতেই বোরখা কিনতে পারবে না। মিমি সন্দেহ করবে। দিগন্ত চায়না মিমি তাকে সন্দেহ করুক। তাই দিগন্ত সিদ্ধান্ত নিলো সে একাই যাবে শপিংমলে। কিন্তুু প্রবলেম হলো দিগন্ত ভূমিকার সাইজ যানে না। কি সাইজের বোরখা নিবে। আচ্ছা মিমিকে বলবে সাহায্য করতে। না থাক, মিমি নানা প্রশ্ন করবে। তাহলে কি ভূমিকাকে কল করে ওর সাইজ জেনে নিবে। হ্যাঁ এটাই বেটার অপশন। তারপর বন্ধুদের সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মিমিকে কোন রকমের বুঝিয়ে সে একাই রওনা দেয় শপিংমলের উদ্দেশ্যে। পথিমধ্যে ভূমিকাকে কয়েকবার কল করে দিগন্ত। কিন্তুু ভূমিকা একবারও কল উঠায় না। বিরক্ত হয়ে দিগন্ত কল কেটে পকেটে পুরে রাখে মোবাইল। কি এমন রাজকার্য করছে। কল রিসিভ করার সময় পাচ্ছেন না মহারানী।
নিজের পছন্দমতো একটা বোরখা কিনে নিলো দিগন্ত। তারপর মনে হল এর সাথে হিজাব টাইপের কিছু লাগবে। দুটো হিজাব আর কতগুলা হিজাব পিন নিলো সাথে। তারপর রওনা দিলো বাসার উদ্দেশ্যে।
দুপুরের রান্না শেষ করে একটু বিশ্রামের জন্যে মাত্রই সুফাতেই গা এলিয়ে দিয়েছে ভূমিকা। আর তখনি কলিংবেল বাঝতে শুরু করলো। একরাশ বিরক্ত নিয়ে দরজার কাছে গিয়ে দরজা খুলে দেয় ভূমিকা। দরজার ওপাশে দিগন্তের হাসি মাখা মুখ দেখে বিরক্তিটা আরো বেড়ে যায়। এই ছেলেটা সব সময়ই ভূমিকার কাজে ব্যাঘাত ঘটায়। কখনো ঘুমে কখনো টিভি দেখায় আবার কখনো কাজে। ভূমিকাকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ওকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে দিগন্ত। সুফার উপর শপিং ব্যাগ রেখে সোজা নিজের রুমে চলে যায়। আর ভূমিকা দরজা লক করে এসে সুফায় ব্যাগ দেখে একবার ভাবলো ভেতরে কি আছে সেটা দেখবে। পরে আবার মনে হলো। না থাক, পারসোনাল জিনিসও থাকতে পারে। পারমিশন ছাড়া কারো জিনিসে হাত দেওয়া ঠিক নয়।
দুপুরে খেতে বসে চুপচাপ খেয়ে নেয় দিগন্ত। ভূমিকাও আগ বাড়িয়ে কোন কথা বলে না। ওদের দুজনের কথা বলা মানেই হলো একজন আরেকজনের সাথে ঝগড়া করা। রাতে দিগন্ত পড়া শেষ করে তবেই খেয়েছে। তাই ভূমিকার সাথে দেখা হওয়ার কোন চাঞ্চই নেই।
পরের দিন সকালবেলা সমস্ত কাজ শেষ করে যখন কলেজে যাওয়ার জন্যে তৈরী হতে যায় ভূমিকা তখন মনে পড়ে দিগন্ত ওর জন্যে বোরখা আনবে বলেছিলো। কিন্তুু দিগন্ত সেটা আনেনি। তাহলে কি আজও কলেজে যাবে না সে। না, ওই লোকটার জন্যে ভূমিকা কেন কলেজে যাওয়া বন্ধকরে দিবে। আর দিগন্ত বোরখাই আনলো না কেন?? এর জবাব তো তাকে দিতেই হবে। রাগে কটমট করতে করতে দিগন্তের রুমে যায় ভূমিকা। দিগন্ত তখনো বইয়ের পাতায় মুখ গুজে ছিলো। ভূমিকা একবার ভাবলো সে এখন দিগন্তকে কিছু বলবে না। কিন্তুু ক্রোধ, তাকে বুঝাবে কি করে?? তাই সে দিগন্তের পড়ার টেবিলের সামনে গিয়ে ওর হাত থেকে বই নিয়ে সেটা অন্য জায়গায় রাখলো। ভূমিকার এমন কাজে বেশ রাগ হলো দিগন্তের। তাই সে ক্রোধান্বিত হয়ে ভূমিকার দিকে তাকিয়ে বলল,
-এই মেয়ে তোমার প্রবলেম কি হ্যাঁ।
-আপনার প্রবলেম কি সেটা বলুন। কাল তো খুব বড় মুখ করে বলেছিলেন আমার জন্যে বোরখা নিয়ে আসবেন। তাহলে কই? আমার বোরখা কই? দেখুন আমি কিন্তুু আজ কলেজ মিছ করবো না বলে দিলাম।
-তোমার বোরখা তো,,, ওহ শিট, তোমাকে তো বলাই হয়নি। এই যে মেডাম ড্রয়িংরুমে সুফার উপর আপনার বোরখা রাখা আছে। এখন যান সেটা নিয়ে আমাকে ধন্য করুন। কথাগুলো বলেই উঠে দাঁড়ালো দিগন্ত। তারপর ভূৃমিকার দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে চলে যায় ওয়াশরুমে। আর ভূমিকা ভেঙচি কেটে সেখান থেকে চলে আসে।
মনের আনন্দে গুনগুনিয়ে গান গায়তে গায়তে শপিং ব্যাগ নিয়ে নিজের রুমে যায় ভূমিকা। তারপর বেশ উৎসাহ নিয়ে বোরখাটা বের করে। ওয়াও কালারটা দারুন হইছে। দিগন্তের পছন্দ আছে বলতে হবে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বোরখাটা নিজের শরীরে জড়াতেই ভূমিজার মেজাজ গেল বিগড়ে। বোরখার সাইজ দেখে সেটা ছুঁড়ে ফেলে দিলো বিছানায়। তারপর কাবার্ড থেকে নতুন থ্রি-পিছ পরে নিলো। অতঃপর বোরখাটা আবার প্যাকিং করে ড্রয়িংরুমে গিয়ে দিগন্তের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলো। এখন শুধু দিগন্তের আসার অপেক্ষা তারপর যে ওর কি অবস্থা হবে সেটাই ভাবছে ভূমিকা।
চলবে,,,,,,
#লেখিকা- মাহফুজা আফরিন শিখা।