#বেলা_শেষে। [১১]
বেশ উৎসুক নিয়ে খাবার মুখে তুলতেই দিগন্তের মুখের রিয়্যাকশন বদলে গেলো। সে খাবার গিলতেও পারছে না আবার সেটা ফেলতেও পারছে না। ওই কথায় আছে না অল্প সুখে কারত অধীক সুখে পাথর। দিগন্তের এখন হয়েছে সেই অবস্থা। খাবারে যদি শুধু লবন কিংবা শুধু মরিচ থাকতো তাহলে সেটা তাড়াতাড়ি ফেলে দিতে পারতো। কিন্তু এখানে তো লবন মরিচের সংমিশ্রণ পাচ্ছে সে। কোন রকমে খাবারটা মুখ থেকে ফেলে দিলো সে। তারপর ঢগ ঢগ করে পুরো এক গ্লাস পানি খেয়ে নিলো। এদিকে দিগন্তের মুখের রিয়্যাকশন দেখে মুখ টিপে টিপে হাসছে ভূমিকা। তার প্ল্যান সাকসেসফুল হয়েছে সেই খুশিতে আজ রাতটা সেলিব্রেট করতে ইচ্ছে করছে তার।গালে হাত রেখে তাকিয়ে আছে সে দিগন্তের মুখের দিকে।ভূমিকার বিজয়ী হাসি দেখে দিগন্তের বুঝতে অসুবিধা হলো না এটা ভূমিকার কাজ। বেশ রাগী লুকেই ভূমিকার দিকে তাকালো সে। সে দিকে ভূমিকা ভ্রুক্ষেপ হলো না। দিগন্ত প্লেটে পানি ঢালবে এমন সময় ভূমিকা ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
-এই এই এটা কি করছেন আপনি?? খাবার কেন নষ্ট করছেন?? খাবার নষ্ট করতে নেই। খেয়ে নিন।
-হয়েছে, শেষ । বিরক্তি মুখে বলল দিগন্ত।
-কি??
-তোমার ঞ্জান দেওয়া। নিজেই খাবারটা নষ্ট করে এখানে নাকট করছে। ড্রামা কুইন। বিরবির করে বলল।
-আমি আবার আপনাকে কখন ঞ্জান দিলাম। ভালো কথা বললেই সেটাকে ঞ্জান দেওয়া মনে হয়। শুনুন, এই যে আপনি খাবারটা নষ্ট করছেন। আপনার মতো আরো অনেকে রোজরোজ খাবার নষ্ট করে। এতে করে কত খাবার নষ্ট হয় জানেন আপনি?? আপনি কি জানেন বিশ্বে প্রতিবছর কত খাবার নষ্ট হয়? এর পরিমাণ প্রায় ১৪০ কোটি টন। এই হিসাব জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা বা এফএওর। সংস্থাটি বলছে, এই নষ্ট হওয়া খাবার বিশ্বে মোট খাদ্য জোগানের এক-তৃতীয়াংশ, যা দিয়ে প্রতিবছর ২০০ কোটি মানুষকে পেট ভরে খাওয়ানো সম্ভব। ভূমিকার কথায় দিগন্ত ওর মুখের দিকে তাকালো। এই মেয়েটা মাঝে মাঝে ঞ্জানের ঝুড়ি খুলে বসে। অতঃপর ভূমিকা আবারও বলতে লাগলো,
-আমরা যখন খাবার নষ্ট করি যখন যদি একবার, একবাট পথ শিশুর কথা মনে করি তাহলে আমরা কিছুতেই খাবার নষ্ট করতাম না। বাংলাদেশে অনেক পথ শিশু আছে যারা খাবারের অভাবে রাস্তায় পরে থাকা উচ্ছিষ্ট খাবার খায়। খাবারের অভাবে যে শিশুটি রাতে না খেয়ে ঘুমাচ্ছে? তার অসহায় বাবা-মা নীরবে চোখের পানি মুছছেন। পৃথিবীর কত মানুষ পেটপুরে দু’বেলা খেতে পায় না, সে হিসাব কয়েক কোটি ছাড়িয়ে যাবে, আর তাই খাবার নষ্ট করার আগে একবার ছোট একটি ক্ষুধার্থ শিশুর মুখ ভাবি, যে হয়ত আমাদের দিকেই তাকিয়ে রয়েছে, একটু খাবারের জন্য। ভূমিকার কথা শুনে নিরবে তাকিয়ে রইলো দিগন্ত। তার এখন না খেয়ে উঠতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু এই খাবার সে খেতেও পারবে না। তাই সে খাবারে পানি ঢেলে তার লবনের পরিমান কমিয়ে নিলো। হালকা তরকারি মিশিয়ে খাবারটা খেয়ে নিলো। দিগন্তের খাওয়া শেষে ভুমিকা দু-হাত ঝেড়ে বলল, এটা হলো রাতে লেট করে বাসায় ফেরার শাস্তি।
ড্রয়িংরুমে বসে খবরের কাগজ পড়ছে আর চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছেন খন্দকার আদনান মাহবুব। রোজ সকালে তা খবরের কগজ না পড়লেই নয়। সকলে ঘুম থেকে উঠে খবরের কগজ পড়বেন তবেই তিনি শান্ত হবেন। আর সারাদিন হাতে বই নিয়ে বসে থাকবেন। পেশায় তিনি একজন প্রফেসর। যদিও তাদের ফ্যামিলি বিজনেস আছে, তাতে কোন দিনও তার ইন্টারেস্ট ছিলো না। তিনি কখনোও তাদের ফ্যামিলি বিজনেসে জয়েন করেন নি। আগে আদনান মাহবুবের বাবা আজহার এই বিজনেস সামলাতেন। আর এখন তাদের একমাত্র উত্তরাধিকারী খন্দকার জুহায়িন আরাভ তাদের এই বিজনেস দেখাশুনা না। আদনান মাহবুবের বই পড়া নিয়ে জুবাইদার সাথে কম কথাকাটিও হয়নি তার। তবুও তিনি বই পড়া অভ্যাস ত্যাগ করতে পারেন নি। বিয়ের পর পর যখন জুবাইদার কোন জিনিসের প্রয়োজন হতো সে নিজে কিনে নিতো। সখের বসেও আদনানের হাত থেকে তিনি কিছুই পান নি। এই নিয়ে জুবাইদার দুঃখের শেষ নেই।
আদনানের খবরের কাগজ পড়ার মাঝেই আজহার নিচে এসে আদনানের পাশে বসলো। হাতে একটা খবরের কাগজ নিয়ে জুবাইদাকে ডেকে বলল,
-বৌমা এক কাপ চা দাও তো।
-জ্বি বাবা আসছি। রান্নাঘর থেকে জবাব দিলো জুবাইদা।
জুবাইদা আজহারকে এক কাপ চা দিয়ে তার পাশে দাঁড়ালেন। আজহার চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন,
-কিছু বলবে বৌ-মা।
-বাবা আপনার নাতিকে একটু বুঝাননা। কালকেও মেয়েটাকে রিজেক্ট করেছে। এই নিয়ে প্রায় শ খানেক মেয়ে রিজেক্ট করলো। কি চায়ছে ও। ওর বিয়ে করার ইচ্ছে নাই থাকতে পারে। তাই বলেকি আমাদের কোন শখ আহ্লাদ নাই না-কি।
-তুমি এত ব্যস্ত হচ্ছো কেন বৌ-মা। দাদুভাই তো বলেনি সে বিয়ে করবে না। ও একটু সময় চাইছে। ওকে একটু সময় দাও। দেখবে, অপেক্ষার শেষটা সুন্দর হয়। আবারও চায়ের কাপে চুমুক দিলেন আজহার। জুবাইদা চলে গেলো রান্নাঘরে। আদনান এখনো খবরের কাগজে মুখ গুজে আছে। আজহার আদনাকে বললেন,
-তোমার কলেজের কি অবস্থা এখন। সব কিছু ঠিকঠাক চলছে তো?
-আর বলোনা বাবা।খবরের কাগজ পাশে রাখলেন আদনান। তারপর বললেন, তোমার নাতি এবার কি করেছে জানো। আমাদের কলেজে নাকি নবীন বরণ হবে। আদনানের কথা শুনেই চোখমুখ শক্ত হয়ে এলো আজহারের। শক্তকরে খবরের কাগজ চেপে ধরলেন তিনি। আচ্ছা বাবা তুমিই বলো এতদিনের রিচুয়াল ব্রেক করার কি দরকার ছিলো। আমাদের কলেজে নবীন বরণ হতো না এটাই তো ভালো ছিলো। এখন আবার বাড়তি ঝামেলা।
আজহার কিছু বলবে এমন সময় খেয়াল করলো আরাভ আসছে। সে যতটা সম্ভব নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করলো। নাহলে এই ছেলেটা আবার হাজার প্রশ্ন শুরু করবে। তিনি খবরের কাগজে মুখ লুকিয়ে ভাঙা গলায় বললেন,
-দাদুভাই যখন উদ্দোগ নিয়েছে তাহলে এর পিছনে নিশ্চয় কোন কারন আছে। আজহারের এই ভাঙা গলাকে কেও বুঝতে পাড়লো না। আরাভ এসে সবাইকে গুডমর্নিং বলে সোজা ড্রাইনিং এ বসলো। তারপর তার মাকে ডেকে বলল,
-আম্মু জলধি ব্রেকফাস্ট দেও। আমাকে একটু কলেজে যেতে হবে।
-নিজে নিয়ে খা। আমি কেন শুধু তোর ফাইফরমাশ খাটতে যাব। আমার ও তো কারো সাহায্যের প্রয়োজন হয়। সারাটা জিবন আমি কেন একা একা সব কিছু করতে যাব।
-আব্বুকে বলোনা আরেকটা বিয়ে করে তোমার জন্যে একটা সঙ্গী নিয়ে আসতে। তারপর দুই সতীন মিলে রান্নাবান্না করবা গল্প করবা ঝগড়া করবা মারামারি করবা। দিস ইজ দ্যা বেষ্ট ওয়ে টু ওভারকাম ইউর লোনলেস। কি বলো দাদু। আরাভের কথা শুনে আজহার উঠে এসে আরাভের কান মুলে দিলো। তারপর বলল,
-তুমি থাকতে আমার বুড়ো ছেলেটা কেন বিয়ে করবে শুনি।
-বিকজ, আমার এখনো বিয়ের বয়স হয়নি। এখন প্রেমের বয়স, আই হ্যাভনট মেইড লাভ বিফোর, দ্যেন আই ওইল থিংক এবাউট মেরেজ।
-কাওকে মনে ধরেছে বুঝি? আরাভের কান ছেড়ে দিয়ে বলল আজহার। আজহারের কথার কোন উত্তর দিলো না আরাভ। বিনিময়ে মৃদু হাসলো। আজহার তার জবাব পেয়ে গেছেন। তিনি একজন সাকসেসফুল বিজনেসম্যান কিনা। মানুষের মুখ দেখলেই বুঝতে পারেন। শুধু বুঝতে পারেন নি নিজের,,, বড় করে শ্বাস ছেড়ে আবার আগের জায়গায় বসলেন তিনি। আরাভ ব্রেকফাস্ট করে তার মাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
-আজ আবার কোন মেয়ের সাথে দেখা করতে যেতে হবে সেটা এসএমএস করে জানিয়ে দিও। আগেই বলে রাখালাম এটাও রিজেক্ট হবে। তারপর মায়ের গালে একখান চুমু দিয়ে বেড়িয়ে যায় সে।
হলরুমের এক সাইডে দাঁড়িয়ে সবার ডান্স পারফরমেন্স দেখছে ভূমিকা। ওদের সামনেই দাঁড়িয়ে আছে দিগন্তের বন্ধুরা। যারা সবাইকে নাচের স্টেপ দেখিয়ে দিচ্ছে। দিগন্ত এখানে নেই। হয়তো মিমির সাথে একাকি টাইম স্পেন্ড করতে গেছে। দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো ভূমিকা। হঠাৎ নওশাদের চোখ পরে ভূমিকার উপর। ভূমিকা কেমন মন মরা হয়ে একাকি দাঁড়িয়ে আছে। নওশাদ ভূমিকার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। তারপর বলে,
-তুমি পারফরমেন্স করবে না।
-না। কাটকাট জবাব দিলো ভূমিকা।
-ওহ। আচ্ছা তুমি থাকো কোথায়?? নওশাদের কথায় ভ্রু কুচকিয়ে তাকালো ভূমিকা তারপর বলল,
-যেখানে থাকার কথা।
-কোথায় থাকার কথা। ভ্রু নাচিয়ে বলল নওশাদ।
-যেখানে থাকি। ভূমিকাকে আর কোন প্রশ্ন করলো না নওশাদ। কারন ভূমিকা যে তাকে সঠিক প্রশ্নের জবাব দিবে না সেটা ভালো করেই বুঝে গেছে সে। কিছু একটা মনে পড়তেই ভূমিকা বলল,
-আপনার হাতের কাগজটাতে কি সকলের নাম দেওয়া আছে।
-না, শুধু যে যে ডান্স করবে তাদের লিষ্ট এটা।
-ওহ আচ্ছা। আমি কি একটু লিষ্টটা দেখতে পারি। অতঃপর নওশাদ ভূমিকার হাতে লিষ্ট ধরিয়ে দিলো। ভূমিকা এক এক করে সকলের নাম দেখছে। এদের মধ্যে আবার অনেকে আছে যা কাপল ডান্স করবে। কিংবা দলীয় নাচ করবে। সকলের নাম দেখছে ভূমিকা। হঠাৎ একটা নামে এসে তার চোখ আটকিয়ে যায়। দিগন্ত ডান্স করবে। তার পাশেই দেখতে পায় মিমির আর তাদের কয়েকজন বন্ধুর নাম। দিগন্ত ওর বন্ধুদের নিয়ে দলীয় নাচ করবে। তবে প্রত্যেকের একজন করে পার্টনার থাকবে। যেমন দিগন্তের পার্টনার মিমি, তপুর পার্টনার জ্যোতি।দিগন্ত মিমির সাথে ডান্স করবে। ভূমিকার মনে হলো দিগন্তের পাশে মিমির নামটা ঠিক মানাচ্ছে না। দিগন্তের নামের পাশে ভূমি নামটাই মানায়। কথাটা ভাবতেই ভূমিকার কেমন জানি অস্বস্তি হচ্ছে। সে লিষ্টটা নওশাদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে দৌড়ে চলে আসলো ক্যাম্পাসে। সেখানে অনেক খুজার পর রাতুলকে পেল সে। তারপর রাতুলের কাছে গিয়ে জিগ্যেস করলো,
-তুই নাচতে পারিস।
হঠাৎ ভূমিকার এমন প্রশ্নে কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খায় রাতুল। তারপর বলে, কিসের নাচ।
-বাদুর নাচ।গাধা কোথাকার, আমারা একসাথে নাচবো পারিস তুই।
-ওই একটু একটু আরকি।
-তাতেই চলবে। বলেই রাতুলের হাত ধরে টেনে হলরুমে নিয়ে যায় আর ডান্স পারফরমেন্সে ওদের নাম লেখায়। রাতুল আর ভূমিকা দু-জনেই ডান্স করবে।
রাতুলের সাথে ভূমিকা ডান্স করছে। হলরুমের সকলে ওদের নাচের স্টেপ গুলো দেখছে। সাধারণ কাপলদের মতো ডান্স করছে না। একে অপরকে না ছুঁয়ে দুটো দুটো মোট চারটি কাঠির মাধ্যমে ডান্স করছে। দরজার পাশে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ দৃষ্টিতে ভূমিকার ডান্স দেখছে আরাভ। আরাভ পাশ কাটিয়ে যাচ্ছিলো অফিসরুমে, ভূমিকার ডান্স পারফরমেন্স দেখে সেখানেই দাঁড়িয়ে যায় সে। এদিকে ভূমিকাকে দেখে রাগে ফুসছে মাহিন। সে মনে মনে ফন্দি আটে ভূমিকাকে কি করে কষ্ট দেওয়া যায়। পানি খাওয়ার নাম করে টেবিলের উপর থেকে বোতল হাতে নেয় সে। তারপর ওদের পাশ কাটিয়ে যাওয়ার নাম করে কিছুটা পানি ফ্লোরে ফেলে। যাতে ওরা দু জনেই পানিতে পা পিছলে নিচে পড়ে যায়। দুর্ভাগ্যবশত সেটাই হলো। তবে দুজনে না ভূমিকা একা সেই পানিতে পা রাখলো।
দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থেকে আরাভ যখন লক্ষ করলো ভূমিকার পা পিছলে পড়ে যাচ্ছে। ওমনি আরাভ দৌড়ে এসে ভূমিকার হাত ধরে টান দিয়ে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো। ঘটনার আকস্মিকতায় ভূমিকা ভয় পেয়ে আরাভের টি শার্ট খামছে ধরলো।
চলবে,,,,
#লেখিকা- মাহফুজা আফরিন শিখা।