#বেলা_শেষে। [২৫]
ধোয়া উঠা চায়ের কাপ হাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে অন্ধকারের চাদর গায়ে মুড়ানো শহরটাকে দেখছে ভূমিকা। দিনের আলোতে শহরটাকে যতটা ব্যাস্ত মনে হয় রাতের আধারে ঠিক ততটাই নিস্তব্ধ। দিনের শেষে ক্লান্তিমাখা শহরটাও ঘুমিয়ে পরে। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় আকাশ ছোয়া বিল্ডিং গুলো ঝলঝল করছে।চায়ের কাপে অধরোষ্ঠ ছোঁয়ালো ভূমিকা। এমন একটা নিরব মনোরম পরিবেশে আদা লেবুর সংমিলিত চা খাওয়ার মজাই আলাদা। দু-চোখ বন্ধকরে চায়ের স্বাধ উপভোগ করলো ভূমিকা। তার অধরে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো। পিছনের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখলো নিতু এখনো তার বয়ফ্রেন্ডের সাথে প্রেমালাপ চালিয়ে যাচ্ছে।নয়না এখন আর তাদের সাথে থাকে না। রাকিবের সাথে রাকিবের বাসাতেই ঠাই হয়েছে তার। মনে মনে একটু বিরক্ত হলো ভূমিকা। এই মেয়েটা এত কথা বলতে পারে। ওই ভালো জানে এত কিসের কথা বলে। একটু পর পর মিছ ইউ লাভ ইউ ছাড়া তো আর কিছুই শুনতে পায়না সে। পাহার সমান মিছ করে তাহলে বিয়ে করে নিলেই পারে। ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলে সময় নষ্ট করার কোন মানেই দেখতে পায় না ভূমিকা। যত্তসব নেকামো।
ভূমিকার চা খাওয়া শেষ হলে সে আরো কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর রুমে এসে শুয়ে পরে।
নিতু বিস্ময়ের দৃষ্টিতে ভূমিকার দিকে তাকায়। রাতের বেলা কোন না খেয়েই ঘুমিয়ে পরবে সে। ইভানকে বলে কল কেটে দেয় সে। ভূমিকাকে হালকা ধাক্কা দিয়ে বলে বলে,
-না খেয়েই শুয়ে পরছিস। ক্ষিদে পেয়েছে তো উঠ না??
ভূমিকা উঠে বসলো। উত্পাত দৃষ্টিতে নিতুর পানে তাকালো সে। তারপর কড়া গলায় বলল,
-বস্তা বস্তা মিছ খেয়েও পেট ভরে নি তোর বোন। ভাত খাওয়ার কি দরকার। ইভান ভাইয়ের মিছ খেয়েই তো তোর পেট ভয়ে গেছে মনে হচ্ছে।
নিতুর বুঝতে বাকি রইলো না ভূমিকা তার উপর রেগে গেছে। আসলে তার এত সময় কথা বলাটা ঠিক হয়নি। ওই ইভানও না একবার কল ধরলে আর রাখতে চায়না। নিতু ইনোসেন্ট মুখ করে বলল,
-কি করবো বল। একজন পিউর লাভার তো তাই এমন হচ্ছে। তুই যেদিন কারো প্রেমে পড়বি সেদিন বুঝতে পারবি। নিতুর কথা শুনে চোখ ছোট ছোট হয়ে এলো ভূমিকার। সত্যিই কি তাই, না তা হবে কেন?? আমি তো দিগন্তকে ভালোবেসেছিলাম, আমার তো মনে হয়নি আমি ওর সাথে কথা বলতে না পারলে থাকতে পারবো না। আমি তো ভালো আছি। দিগন্তকে ভুলে গিয়ে নিজের মতো করে সামনে এগিয়ে যাচ্ছি। কই আমার তো কষ্ট হয়না।মাথা নাড়ালো ভূমিকা। এসব কি ভাবছে সে। তারপর অন্যমনস্ক হয়ে বলল,
-সেটা হয়তো কোন দিন সম্ভাব হবে না।
বিছানা ছেড়ে উঠে চলে গেল ভূমিকা। রান্নাঘর থেকে খাবার নিয়ে এসে নিতুর সামনে সাজিয়ে রাখলো। তারপর সেই বসে পড়লো। নিতু বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ভূমিকার মুখশ্রীর দিকে। মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে এই মুখটা আমাবস্যা রাতের মতো অন্ধকারে ছেয়ে গেছে।
-এভাবে হা করে কি দেখছিস? খাওয়া শুরু কর। এক লোকমা ভাত মুখে পুরে প্লেটের দিকে তাকিয়ে বলল ভূমিকা।
-হ্যাঁ হ্যাঁ খাচ্ছি। নিতু ব্যাস্ত হয়ে পরে খাবার খাওয়ায়। কয়েক লোকমা মুখে দেওয়ার পর নিতু বলে উঠে,
-ভূমি তোর মনে হয়না মাহিন ভালো হয়ে গেছে।
-কুকুরের লেজ কখনো সোজা হতে দেখেছিস?
-মানে!!!!
-এটা মাহিনের কোন নতুন প্ল্যান। শহরে আসার পর থেকে চিনি ওকে। অনেক সুযোগ দেওয়ার পরেও নিজেকে শুধরাই নি সে। ঠোঁটে চেপে হাসলো ভূমিকা। অতঃপর বলল,আসলে সেদিনের মার কম হয়েছিল কি-না। তাই সে চাইছে আবারও কিছু উত্তম মাধ্যম পেতে। এটা আবার আমি খুব ভালো পারি। অধর প্রসারিত করে হাসলো ভূমিকা। ভূমিকাকে সঙ্গদিয়ে নিতুর হাসলো। এই মাহিনের কপালে দুঃখ আছে।
বিছানায় বসে আছে আরাভ। আরাভের সামনে বসে আজহার মাওদুদ ওর হাতে ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছে। আরাভের হাত কেটেছে সেই কখন। রক্ত শুকিয়ে হাতেই সাথে লেপ্টে আছে। সেই রক্ত স্যাভলন দিয়ে ধুয়ে পরিষ্কার করে দিলেন আজহার। আজহার হাতে ব্যান্ডেজ লাগাতে লাগাতে বললেন,
– হকি খেলতে গিয়ে হাত কেটেছে, এই বয়সে এসে এটাও দেখতে হলো। সত্যি করে বলতো দাদুভাই, হাত কিভাবে কেটেছে। আজহারের কথার কোন জবাব দিলো না আরাভ। তিনি আবারও বলে উঠলেন,
-হকি স্টিকে ব্লেড লাগানো ছিলো মনে হয়।
-ওহ দাদু রিডিকিউল করছো আমার সাথে। নট ফেয়ার।
-দেখো দাদুভাই, আমার মাথার চুলে পাক ধরেছে। এই চুল কিন্ত এমনি এমনি পাক ধরেনি। অভিঙ্ঘতায় পেকেছে মাথার চুল। আরাভের দিকে ঝুকে বসলেন আজহার। আজ কার অপারেশন করেছো দাদুভাই। ভ্রু নাচিয়ে বললেন আজহার। আজহারের কথায় কিছুটা বিব্রত হয় আরাভ। হাত গুটিয়ে উঠে দাঁড়ায় সে। আরাভের মৌনতা দেখে আজহার উঠে ওর কাদে হাত রাখে। বড় করে শ্বাস ফেলে বলে,
-জোড় করবো না তোমাকে দাদুভাই। আমার হেল্প লাগলে অবশ্যই জানাবে ওকে।
-ইউ আর বেষ্ট দাদুভাই। মৃদু হেসে বলে আরাভ। তারপর আজহারের সাথে আলিঙ্গন করে নেয়।
ক্যান্টিনে বসে গল্প করছিলে তিন বন্ধু। এমনি সময় মাহিন এসে ওদের পাশে বসে। মাহিনকে দেখে অটোমেটিক সবার মুখের রিয়্যাকশন বদলে যায়। রাতুল পানি খেতে খেতে বলে,তোদের ক্লাস নেই?? নিতু আর ভূমিকা ওর কথায় সায় দিয়ে বলে, আছে তো। চল ক্লাসে যাই। সবাই চলে যেতে চাইলে মাহিন ভূমিকাকে থামিয়ে বলে,
-তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে??
-আপনার কথা শুনার মতো সময় আমার কাছে নাই।
-তোমার ভালোর জন্যে বলছি। আমার কথাটা শুনো। নাহলে পরে আফসোস করবে। মাহিনের কথা শুনে ভ্রু কুচকালো ভূমিকা। তারপর বলল,
-কি এমন কথা??
মহিন ও উঠে দাঁড়ালো। দু-হাতের তালু ঘসে বলল,
-আরাভের সাথে তোমার কিসের রিলেশন??
-আমি ওনার অফিসের একজন স্টাফ মাত্র।
-ইউ আর রঙ।
-মানে। কপালে কয়েকটা চিন্তার ভাজ ফেলে বলল ভূমিকা। অতঃপর মাহিন বলল,
-আই থিংক, আরাভ তোমাকে লাভ করে। মাহিনের কথা শুনে চোখ মুখ শক্ত হয়ে এলো ভূমিকার। মাহিনের গালে চড় মারতে চেয়েও মারলো না।শক্ত গলায় বলল,
-নিজের মতো করে সবাইকে কেন ভাবেন বলুন তো। আমার চোখে স্যার একজন আদর্শ মানুষ। আর আপনি এসেছেন তার নামে কুটনিতি করতে। ইচ্ছে করছে ঠাটিয়ে এক চড় মারি।কিন্ত এই মুহূর্তে আমি আমার হাতটাকে নষ্ট করতে চাচ্ছি না। ভূমিকার কথা মাহিনের গায়ে লাগলো বলে তো আমার মনে হলো না। সে আগের মতোই অধরে শয়তানি হাসি ফুটিয়ে দাড়িয়ে আছে। রাগে কটমট করে ভূমিকা চলে যাওয়ার জন্যে সামনে পা বাড়াবে এমনি সময় মাহিন পিছন থেকে বলে উঠলো,
-আর যদি আমার কথাটা সত্যি হয় তাহলে বন্ধুত্ব করবে আমার সাথে।
পিছনের দিকে ঘুরে দাঁড়ায় ভূমিকা। মাহিনের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়ে দাতে দাত চেপে বলে, আসমান যদি জমিনেও নামে তবুও আপনার সাথে আমার বন্ধুত্ব হবে না। আর আরাভ স্যারে নামে কোন কথা বললে আমি কিন্ত আপনাকে ছেড়ে দিব না। বিকজ স্যারকে আমি যতটা সম্মান করি ঠিক ততটাই শ্রদ্ধা করি। তার নামে কোন বাজে কথা শুনা মানেই তো অপরাধ। মাহিন কে আর কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে চলে যায় ভূমিকা। ভূমিকার চলে যাওয়ার পর অধরোষ্ঠ কামড়িয়ে শয়তানি মার্কা হাসি দেয়। আরাভকে থেকে তো দূরে সারাবোই তোমাকে ভূমিপাখি। নাহলে যে আমার কাজ সহজ হবে না। আমার গায়ে হাত তুলেছে তুমি। সেদিন সময় তোমার হাতে ছিলো। একবার, একবার শুধু সুযোগ পাই।তারপর তোমাকে বুঝাবো মাহিন কি জিনিস। মাহিনের গায়ে হাত উঠানোর ফল তোমাকে ভোগ করতেই হবে। আমার খাচায় তোমাকে বন্ধি হতেই হবে ভূমিপাখি। শয়তানি মার্কা হাসি দেয় মাহিন।
কলেজের পিছনের দিকটায় সচরাচর কেও আসেনা ।খুব দরকার না হলে এদিকে কেও আসেই না বললেই চলে। মাঝে মাঝে দু-একজন প্রেমিক প্রেমিকা আসে লুকিয়ে চুরিয়ে প্রেম করতে। তাছাড়া এদিকে কারো সমাগম নেই। এমন একটা নিরিবিলি জায়গায় মাহিন অপেক্ষা করছে আরাভের জন্যে। মাহিন নিজে থেকেই আরাভ কে এখানে ডেকেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আরাভ এখানে উপস্থিত হয়।
মূলত আরাভকে এখানে ডাকার কারন হলো ওর কাছ থেকে সত্যিটা জেনে নেওয়া। ভূমিকা আর আরাভের সম্পর্কের সত্যিটা জেনে নেওয়া। আরাভ তো সেটা এমনি এমনি মাহিনকে বলবে না। আর মাহিনও জানে কি করে সত্যিটা আরাভের পেট থেকে বের করতে হবে। তাই সে শয়তানি মার্কা হাসি দিয়ে বলে,
-ভাই ভূমিকা মালটা কিন্ত হেব্বি হট। ওকে আমার চাই। এক দিনের জন্যেও হলে ওকে চাই আমার। তুমি আমাকে হেল্প করবে এই কাজে। মহিনের কথা শেষ হতে না হতেই আরাভ ঝাপিয়ে পরলো ওর উপর। মাহিনকে এলোপাথাড়ি মারতে লাগলো সে। তোর সাহস হয় কি করে, ভূমিকার দিকে নজর দেওয়া। আজ চোখ উপরে ফেলবো আমি। মাহিনও কম কিসে সেও মারছে আরাভকে। কেন রে ভূমিকা কি তোমার সম্পত্তি নাকি ওর যে নজর দিলে তুমি চোখ উপরে ফেলবে। আরাভের নাক বরাবার ঘুসি দেয় মাহিন।
-হ্যাঁ ভূমিকা আমার সম্পত্তি। ও শুধু মাত্র আমার। ভালোবাসি ওকে আমি। ওর দিকে যে চোখ তুলে তাকাবে তার চোখ আমি উপরে ফেলবো। আরাভের কথা শেষ হতেই মাহিন এত জোড়ে ওকে ধাক্কা দেয় যে টাল সামলাতে না পেরে ছিটকে পরে যায় আরাভ। মাহিন বিজয়ী হাসি দিয়ে সামনে দিকে তাকায়। মাহিনের দৃষ্টি বরাবর আরাভ ও তাকায়। আর যা দেখে তাতে যেন ওর পুরো দুনিয়া থামকে যায়।
#বেলা_শেষে। [২৬]
মাহিনের দৃষ্টি অনুসরণ করে আরাভ তার দৃষ্টি রাখতেই দেখতে পেলো ভূমিকা দাঁড়িয়ে আছে। দু-চোখ থেকে অশ্রু পরছে তার। ভূমিকার চোখের পানি দেখে আরাভের মনে হয় পুরো দুনিয়াটাই থমকে গিয়েছে। আরাভের ইচ্ছে করছে ছুটে গিয়ে ভূমিকার চোখের পানি মুছে দিতে। কোথায় যেন শুনেছে, ভালোবাসার মানুষের চোখের পানি মাটিতে পরতে দিতে নেই। কিন্তুু এই মুহূর্তে সেটা করতে পারবে না। সেই অধীকার তাকে দেওয়া হয়নি। অস্ফুটভাবে বলল আরাভ,
-ভূমিকা আপনি এখানে????
ভূমিকা কিছু বলল না। অশ্রুসিক্ত নয়নে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো আরাভের মুখ পানে।তার পর এক পা দু পা করে পিছিয়ে উল্টোদিকে হাটা শুরু করলো ভূমিকা। পিছন থেকে আরাভ ওকে কয়েক বার ডাকলেও পিছনে ফিরে তাকায়নি ভূমিকা। ভূমিকার চলে যাওয়ার মাহিন পৈশাচিক হাসি হাসলো। তার প্ল্যান সাকসেসফুল। আরাভ ক্রোধান্বিত হয়ে মাহিনের দিকে তাকালো। মনে মনে বলল, তোকে আমি পরে দেখছি। তারপর সেও চলল ভূমিকার পিছন পিছন।
সবাই স্বার্থপর। স্বার্থহীন কেও ভালোবাসে না। কেও কাছেও আসে। স্বার্থের টানে সবাই কি ভালো মানুষের মুখোশ পরে থাকে। আর স্বার্থ শেষ হলেই উপচে পরে মানুষের মুখোশ। আনমনে সামনে হাটছে আর একা একা বকবক করছে ভূমিকা। পিছন থেকে আরাভ ওকে ডাকছে কিন্ত তার কোন ডকাই ভূমিকার কান পর্যন্ত পৌছাচ্ছে না। তার ও পিছনে মাহিন শয়তানি মার্কা হাসি অধরে ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আরাভ বড় বড় পা ফেলে ভূমিকার দিকেই আসছে আর ওকে ডেকে চলেছে। এদিকে দিগন্ত তার স্ত্রী মিমিকে নিয়ে হসপিটাল থেকে ফিরছে।রাস্তার মাঝে ভূমিকাকে এভাবে হাটতে দেখে দুজনেই রিক্সা থেকে নামে ভূমিকার সামনে এসে দাঁড়ায়।
চোখের সামনে প্রাক্তন স্বামি ও তার স্ত্রী কে দেখে থমকে যায় ভূমিকা। অপলক তাকিয়ে থাকে এই নতুন কাপলের দিকে।ততক্ষণে আরাভও এসে ভূমিকার পাশে দাঁড়ায়।
-কি হয়েছে ভূমি? [দিগন্ত]
-আপনি এখানে??
-প্রশ্নটা আমি আগে করেছি। [দিগন্ত]
-আপনার প্রশ্নের এ্যনসার দিতে আমি বাধ্য নই। আমার পথ আটকিয়ে দাঁড়িয়েছেন কেন?? সামনে থেকে সরে দাঁড়ান। ভূমিকার এমন ঝাঁঝালো কথার কর্ণপাত কারলো না দিগন্ত। দিগন্তের কাছে এটা নতুন নয়। ভূমিকা বরাবরই ওর সাথে এমন ভাবে কথা বলেছে।
-কি হয়েছে সেটা তো বলবে?? দিগন্তের কথার প্রতিউত্তরে আরাভ বলে উঠলো,
-আরে দিগন্ত তুমি কোথা থেকে আসলে?
-মিমিকে নিয়ে হসপিটালে গিয়েছিলাম। আসলে কিছুদিন ধরে মিমির শরীরটা খারাপ যাচ্ছে। ক্ষুধামন্দা, বমি মাথা ঘুড়ানো সহ আরো নানা সমস্যায় ভুগছে। তাই ওকে নিয়ে হসপিটালে গিয়েছিলাম।
-ডক্টর কি বলল।
– চিন্তার কোন কারন নেই। রিপোর্ট কাল দিবে বলেছে। দিগন্তের কথা শুনে মৃদু হাসলো ভূমিকা। তারপর মিমি আর দিগন্তের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,
-কনগ্রেচুলেশন মিস্টার এন্ড মিসেস। অধর চেপে হেসে প্রস্থান করলো ভূমিকা। আরাভ ওদের বিদায় জানিয়ে ভূমিকার পিছনে ছুটলো। কি হচ্ছে না হচ্ছে তার কিছুই বুঝতে পারছে না দিগন্ত। সে তাকিয়ে আছে ওদের দুজনের দিকে। কিছুদূর আসতেই আরাভ ভূমিকার হাত ধরে টেনে রাস্তার একপাশে দাঁড় করায়।
-ভূমিকা প্লিজ আমার কথাটা শুনুন।
-আপনার কোন কথাই শুনতে চাইনা আমি। হাত ছাড়ুন আমার। আমাকে যেতেদিন নাহলে আমি চিৎকার করবো।
-যত খুশি চিৎকার করো। বাট আই উইল নট লেট গো অফ দিস হ্যান্ড। আমার কথা আপনাকে শুনতেই হবে।
-আর কি বলবেন আপনি?
-উইল ইউ মেরি মি ভূমিকা। ভূমিকার মুখের দিকে স্থির দৃষ্টি রেখে শান্ত গলায় বলল আরাভ। আরাভের কথা শুনে ভূমিকা আরাভকে সজোরে ধাক্কা দেয়। ঘটনাক্রমে আরাভ কিছুটা দূরে সরে দাঁড়ায়।
-পাগল হয়ে গেছেন আপনি।কি বলছেন আপনি জানেন?
-হ্যাঁ পাগল হয়ে গেছি আমি। তোমাকে প্রথম যেদিন দেখেছি সেদিন থেকেই তোমার প্রেমে পাগল হয়েগেছি। তোমাকে পাগলের মতোই ভালোবেসেছি আমি। তারপর যখন জানতে পারলাম তুমি দিগন্তের ওয়াইফ। শত চেষ্টা করেছি তোমাকে ভুলে যাওয়ার। কিন্তু পারিনি। তারপর তুমি নিজে থেকেই আমার কাছে ধরা দিলে। আমার অফিসে আমার চোখের সামনে। সর্বক্ষণ তোমাকে দেখায় ব্যস্ত আমার দুটি আখি তার কি নাম দিবে তুমি। পাগলামি এটা। হাত বলে দুহাত বাড়িয়ে তোমাকে আলতে করে ছুয়ে দেই এটাই কি পাগলামি। যদি তাই হয় তাহলে পাগল আমি।তোমার এক বিন্দু ভালোবাসা পাওয়ায় জন্যে পাগল আমি। এই পাগলের পাগলামির জন্যে যে তোমাকে চাই। জানো বড্ড ইচ্ছে করে সবার মতো তোমাকে ভূমি বলে ডাকতে। কিন্তু সেই অধীকারটাও নেই আমার। আই লাভ ইউ ভূমিকা। লাভ ইউ সো মাচ।
-আমি আপনাকে কখনো ভালোবাসতে পারবো না। কথাটা বলেই দু কদম এগিয়ে যায় ভূমিকা। ওমনি খপ করে আরাভ ভূৃমিকার হাত ধরে বলে,
-ভালোবাসতে হবে না। তুমি আমাকে নাই ভালোবাসলে, আমাকে একটা সুযোগ দাও আমি তোমাকে আজিবন ভালোবেসে যাব।
পিচনের দিকে ঘুরে তাকায় ভূমিকা। আরাভের মুখের দিকে তাকাতেই দেখতে পায় আরাব অসহায় মুখ করে ভূমিকার দিকে তাকিয়ে আছে। ভূমিকা ওর দৃষ্টি নামিয়ে হাতের দিকে রাখে। যে হাতটা আরাভ ধরে রেখেছে। হাতের দিকে তাকিয়ে শক্তগলায় বলে, হাত ছাড়ুন।
-আগে আমার প্রশ্নের জবাব দাও। বিয়ে করবে আমাকে??
-সরি স্যার। ভূমিকার জবাব শুনে হাত আলগা হয়ে আসে আরাভের। সে ভূমিকার হাত ছেড়ে দেয়। আর যাই হোক জোড় করে কারো কাছ থেকে ভালোবাসা পাওয়ায় যায় না। ভূমিকা চলে যায়। আরাভ তাকিয়ে থাকে হয়তো ভূমিকা এক বার পিছনে ফিরে তাকাবে। কিন্তু ফিছনে ফিরে না ভূমিকা। ভূমিকার চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর। হাতের মুঠি শক্ত করে নেয় আরাভ। চোখ মুখ শক্ত করে কাকে যেন কল করে। কথা বলার পর চোখ দুটো লাল বর্ণ ধারন করে।
তারপর থেকে কয়েকদিন অফিসে যাওয়া হয়নি ভূমিকার। আর না সে কলেজে গিয়েছে। আরাভ সারাদিন কাজের মধ্যে ডুবে থাকলেও বেলা শেষে সে ঠিকই ভূমিকার বাসায় পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ভূমিকাকে এক পলক দেখার জন্যে সে রাতের অন্ধকারে ভূমিকার বাড়ির পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। ভূমিকা যখন বারান্দায় আসতো তখন ওকে দেখে প্রান জুড়াত আরাভের। আজ সকাল সকাল অফিসে যাওয়ার জন্যে রেডি হচ্ছে ভূমিকা। নিতুর ওর পাশে এসে চুলের বেনুনি করতে করতে বলল,
-অফিসে যাচ্ছিস??
-হুম।
-কেন?? আরাভ ভাইকে না দেখে থাকতে পারছিস না বুঝি।
-রিজাইন লেটার জমা দিতে যাচ্ছি।
-এটা ঠিক করছিস না তুই। দেখ আরাভ ভাই তোকে সত্যিই ভালোবাসে না হলে তোকে দেখার জন্যে রাতের পর রাত আমাদের বাসার সামনে দাড়িয়ে থাকতো না।
-আমি কি করবো??
-কি করবি মানে!!! আরাভ ভাইয়ের প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায়।
-সেটা সম্ভব না। ওনার সাথে আমার কোন দিক দিয়েও যায় না। তাছাড়া আমি একজন ডিভোর্সি মেয়ে। আমাকে বিয়ে করলে ওনার এতদিনের গড়া এক্সিমিশন নষ্ট হয়ে যাবে। আর চাইনা আমার কারনে সমাজে কারো সম্মান নষ্ট হোক। আমি আসছি। ভূমিকা বেড়িয়ে যায় অফিসের উদ্দেশ্যে।
অফিসে এসে রিজাইন লেটার আরাভের হাতে দিলে সেটা ছিড়ে ফেলে আরাভ। টুকরো কাজগগুলো ফেলে দিয়ে ভূমিকার হাত ধরে টেনে বাহিরে নিয়ে যেতে থাকে আরাব। ভূমিকা ব্যস্ত ভঙ্গিতে আরাভের থেকে নিজের হাত ছাঁড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্ত আরাভের শক্তির সাথে পেরে উঠছে না ভূমিকা। অফিসের বাকি স্টাফগুলো তাকিয়ে আছে আরাভ আর ভূমিকার দিকে। সেদিকে খেয়াল নেই কারোরই।
ভূমিকাকে নিয়ে আরাভ তার বাড়িতে এসে পৌছায়। আরাভের সাথে ভূমিকাকে দেখতে পেয়ে জুবাইদা যেন হাতে চাদ পেয়েছে। এমন খুশি সে। জুবাইদা ব্যস্ত ভূমিকার আদর আপ্নায়নে। আদনান মাহবুব কলেজে গেছেন। আর আজহারের মওদুদ এতক্ষণ তার রুমে ছিলেন। আরাভের চিৎকার শুনে তার রুম থকে বেড়িয়ে আসে। সবাই যখন ড্রয়িংরুমে বসে পিনপতন নিরবতা অবলম্বন করছে তখন আরাভ আজহারের কাছে গিয়ে বলে,
-দাদু ওকে একটু বুঝিয়ে বলো না ওকে নিয়ে আমাদের মধ্যে কোন প্রবলেম নেই। তাহলে ও কেন এত গিল্টি ফিল করছে।
-ওটা ভূমিকা। আজহারের প্রশ্নে আরাভ ভূমিকার দিকে তাকিয়ে কিৎচিত মাথা নাড়িয়ে বলল, হ্যা এটাই ভূমিকা। আজহার ভূমিকার পাশে গিয়ে বসলো। অতঃপর বলতে লাগলো,
-দেখ ভূমিকা তোমার সম্পর্কে আমরা সবাই সবটা জানি। গত পরশু আরাভ আমাদের সবটা বলেছে। আমরা আমার নাতির পছন্দকে সম্মতি জানিয়েছি। আমরা সবাই চাই তুমি আমাদের আরাভের বউ হয়ে এসে। দেখ অতীত তো অন্দকার বেলুনের মতো। তাকে মনে রেখে নিজের জিবনটা কেন নষ্ট করবে তুমি। তোমার সাথে যা হয়েছে তাতে তো তোমার কোন দোষ নেই। তাহলে তুমিই কেন সেক্রিফাইস করবে। তোমার তো একটা ভবিষ্যৎ আছে। আচ্ছা তোমার লাইফ থেকে তোমার কিছু চাওয়া পাওয়া নেই। আরাভ তোমাকে ভালোবেসে বিয়ে করতে চায়। তোমাকে সম্মানের সাথে বিয়ে করে তোমার দায়িত্ব নিয়ে ভবিষ্যৎ এর পূর্ন নিরাপাত্তা দিতে চায়। তাহলে তুমি কেন ওকে মেনে নিতে পারছো না।
-আমি কখনো ওই ভাবে ভাবিনি স্যার। ভূমিকার জড়ানো গলায় বলা কথা শুনে আজহার আবার বলে উঠলো,
-ভাবোনি তো কি হয়েছে এবার থেকে ভাববে। দেখ তোমার বয়স ই বা কত?? সারাজিবন তো আর এভাবেই কাটাবে না তুমি। কাওকে না কাওকে তো বিয়ে করতেই হবে তাইনা। আজহারের এই কথা শুনে আরাভের দিকে তাকায় ভূমিকা। আরাভ তখনো ভূমিকার দিকেই তাকিয়ে ছিলো। ভূমিকার মুখে কখন বলবে সে বিয়ে করতে রাজি। ভূমিকা তার দৃষ্টি নামিয়ে নিচের দিকে তাকায়। কিছুক্ষণ মৌনতা অবলম্বন করে বলে,
-স্যার আমাকে একটু সময় দিন।
-তোমার যতসময় লাগে ভাবতে পারো। বাট সবশেষে এ্যনসারটা যেন হ্যাঁ হয়। আজহারের কথায় মৃদু হাসলো ভূমিকা। তারপর উঠে দাঁড়ায় চলে যাওয়ার। তখন আজহার আরাভকে বলে,
-ভূমিকাকে তার বাসায় পৌছে দিয়ে এসো দাদুভাই।
-আমি চলে যেতে পারবো। [ভূমিকা]
-তোমার মতামত জানতে চাইনি। দাদুভাই যাও ভূমিকাকে তার বাসায় পৌছে দিয়ে এসো।
-সে কি কথা। কিছু না খেয়েই চলে যাবে নাকি। আমি ওর জন্যে কতকি রান্না করলাম। ইনোসেন্ট মুখ করে বলল জুবাইদা।
-না না আন্টি আমি কিছু খাবো না।
চলে যায় ভূমিকা। আর ভূমিকাকে এগিয়ে দিয়ে আসে আরাভ। গাড়ির কাছে এসে যখন ভূমিকাকে ডাক দেয় তখন ভূমিকা বলে, প্লিজ স্যার আমি আপনার কোন কথাই শুনতে চাচ্চি না এখন। আরাভও কোন কথা বাড়ায় না। ভূমিকাকে পৌছে দেয় তার বাসায়।
-তারপর, তারপর কি হয়েছিলো, আরাভ আর ভূমিকার বিয়েটা হয়েছিল কি?? পাঁ বছরের ছেলে অভির প্রশ্নে বড় করে শ্বাস ত্যাগ করে জুবাইদা। তারপর চেলেটার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, হ্যাঁ। ওদের বিয়েটা হয়েছিলো।
জুবাইদা কোলে মাথা রেখে ছোট্ট অভি গল্প শুনছিলো এতক্ষণ। এখন সে জুবাইদার কোল থেকে মাথা উঠিয়ে জুবাইদার মুখোমুখি হয়ে বসলো। তারপর সে জিগ্যেস করলো,
-তাহলে আরাভ আর ভূমিকা এখন কোথায়?? অভির করা প্রশ্নে জুবাইদার চোখ ছলছল করে উঠলো। সে দু-চোখ বন্ধকরে চোখের পানি লুকিয়ে নিলো।
চলবে,,,,,,,