ভালবেসে অবশেষে পর্ব -১৩

#ভালবেসে_অবশেষে
#নুশরাত_জেরিন
পর্ব: ১৩

সিয়াম হাজার তোড়জোড় করা সত্বেও আজ আর এ বাড়ি ছেড়ে বেরোতে পারলো না। আতাউর রহমান বারবার এসে বলে গেছেন, আজ কিছুতেই সিয়ামের যাওয়া চলবে না। তাছাড়া প্রথমবার শশুড়বাড়ি এসেছে সে, দুটো দিন তো থাকতেই হবে। সিয়াম পড়লো মহা বিপদে। তার কোম্পানীর অর্ধেক শেয়ার তার হলেও বাকী অর্ধেক যার নামে সে লোক বেশ ঘাড়তেরা। বিনা কারনে কাজে অবহেলা তার পছন্দ না। এর আগে সিয়ামের সাথে বেশ খানিকটা তর্কাতর্কিও লেগেছিলো। যদিও সিয়াম অফিস কামাই করে না, এমনকি কাজে অবহেলাও করে না। তবু সে চটজলদি ল্যাপটপ নিয়ে বসলো। আজকের মিটিংয়ে তার থাকটা জরুরি। সরাসরি নাহলেও নাহয় ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমেই উপস্থিত হবে। কী আর করার। সৌরভটাতো একদম কোনো কাজের না। কোথায় ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে ভাইয়ের দায়িত্ব কাধে নেবে তা না, নিশ্চয়ই ছেলেটা সিয়ামের অফিস ছুটির কথা শুনে বাড়িতে পরে পরে ঘুম দিচ্ছে। সিয়াম থাকলে তার ভয়েই তো অফিস যেতো সে।

মিলি ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে চুল আচরাচ্ছে। সিয়াম বেশ কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থাকলো। বলল,
“তোমার বাবাকে তুমি বলেছো তাই না,যাতে আমায় জোর করে?”

মিলি পিছু না ঘুরেই বলল,
“আশ্চর্য! আমি কেনো বলতে যাবো? বাবা নিজেই বলেছেন!”

একটু চুপ থেকে আবার বলল,
“কেনো জানেন?”

সিয়াম বলল,
“কেনো?”

“দুপুরে জামাই আদর কম হয়ে গিয়েছিলো তো, আরেকটু ভালো মতো আপ্যায়ন করা উচিত না? হাজার হোক নতুন জামাই বলে কথা!”

মিলির মুখে দুষ্টুমির হাসি দেখে সিয়াম বলল,
“আচ্ছা? তবে তুমিও তো নতুন বউ, তোমাকেও তো বউ আদর করতে হয়?”

মিলি হকচকিয়ে উঠে দাড়ালো। তার চোখে মুখে আতঙ্ক।
সিয়াম হেসে ফেললো।
“আরে উল্টো পালটা চিন্তা কেনো করো? আমি তো তোমায় জম্পেশ খাওয়া দাওয়া করানোর কথা বলছিলাম।”

মিলির মুখখানা এতটুকু হয়ে গিয়েছিল আতংকে। সে কথা ঘুরাতে বলল,
“আপনি আগের চেয়ে অনেকটা বদলে গেছেন জানেন? আগে তো আপনাকে দেখলেই আমার ভয় লাগতো।”

“তাই?”

“হু, আপনার একটা নামও দিয়েছিলাম আমি। গোমড়ামুখো।”

সিয়াম বলল,
“বাহ্ বেশ নাম তো। আমার খুব পছন্দ হয়েছে। তবে আমি তো এখন আর গোমড়ামুখো হয়ে থাকি না বলো?”

মিলি এগিয়ে এসে পাশে বসলো।
“সবসময় থাকেন না ঠিক কিন্তু মাঝে মধ্যে আগেকার মতো গম্ভীর মুখ তো আমি দেখি।”

“কখন? কবে?”

“ঐ যে মিটিং করার সময়! দেখলাম তো।”

সিয়াম হাসলো।
“ধুর, অফিসের ক্লাইন্টদের সাথে হেসে হেসে কী কথা বলবো, আর অত হাসাহাসি করলে তারা আমায় গুরুত্ব দেবে?”

মিলি বলল,
“আচ্ছা? বেশি হাসাহাসি করলে বুঝি অপরপক্ষের কাছে গুরুত্ব কমে যায়? এজন্য বুঝি আমার গুরুত্ব নেই আপনার কাছে?”

কথা শেষ হবার সাথে সাথে সিয়াম মিলির হাত টেনে মুখোমুখি বসালো। চোখে চোখ রেখে বলল,
“তোমার তাই মনে হয়?”

মিলি সাথে সাথে চোখ নামালো। কী গভীর দৃষ্টি সিয়ামের! মিলির লজ্জা রাঙা মুখের দিকে তাকিয়ে সিয়াম উচ্চস্বরে হেসে উঠলো।
মিলি বিরবির করলো, “হাসলে আপনাকে এত ভালো দেখায় কেনো বলুন তো! ”


সারাটাদিন সিয়ামের খুব ভালো কাটলো। মিলির বাবা মায়ের অমায়িক আচরণে সে মুগ্ধ। তার কত সহজে সিয়ামকে আপন করে নিয়েছেন। জড়তা ছাড়া মিলির বদ অভ্যাসগুলো বলে হাসাহাসি করছেন। তাছাড়া বিকেলে তারা একসাথে লুডুও খেলেছে। মিলি আর আতাউর রহমান যদিও জিতে গেছেন। তবে খেলায় হারলেও যে এত ভালো লাগে সিয়াম সেটা কখনও উপলব্ধি করেনি।
তার হুট করে নিজের মায়ের কথা মনে পরে গেলো। একসময় সেও মায়ের সাথে ঘুরতে যেতো, কাজে সাহায্য করতো। অন্য সবার কাছে গম্ভীর হলেও মায়ের কাছে সে ছিল খোলা বইয়ের মতো। তারপর? কী যে হলো। আরিয়া আসার পর মায়ের আশেপাশে বসলেও যেন আরিয়ার সহ্য হতো না। দুজনে নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পরলো। নতুন সম্পর্ককে মজবুত করতে গিয়ে পুরনো সম্পর্কের সুতা গুলো নড়বড়ে হয়ে গেলো।
সিয়াম বড়সড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোন হাতে তুলে নিলো। রিং হলো, একবার, দু’বার…
রেনু বেগম রিসিভ করলেন। তার উতলা স্বর ভেসে এলো,
“কী হয়েছে সিয়াম? হঠাৎ কল দিলি যে? কোনো সমস্যা হয়েছে?”

সিয়াম শান্ত গলায় বলল,
“কেমন আছো মা?”

রেনু বেগম খানিক চমকালেন বোধহয়। কতদিন পর ছেলেটা এভাবে কথা বলছে।
তিনি বললেন,
“হঠাৎ একথা কেনো জিজ্ঞেস করছিস? কিছু হয়েছে?”

“উহু, কী হবে।”

একটু থেমে আবার বলল,
“তুমি আমার উপর রাগ করেছো মা?”

“কেনো বল তো?”

“না মানে ঐভাবে হুট করে এখানে চলে এলাম…”

রেনু বেগমের মুখে ততক্ষণে হাসি ফুটেছে।
“ধুর বোকা ছেলে, এতে রাগের কী আছে? তোর মা কি দজ্জাল শাশুড়ী, যে ছেলের বউয়ের প্রতি হিংসা করবো? বরং আমি কী যে খুশি হয়েছি।”

সিয়াম ইতস্তত ভঙ্গিতে বলল,
“খাওয়াদাওয়া করেছো?”

“হ্যাঁ, তুই করেছিস?”

“হুমমম। আচ্ছা এখন রাখি মা।”

“আচ্ছা। ”

সিয়াম কল কেটে দিলো। বহুদিন ধরে জমে ওঠা সম্পর্কের মরিচা গুলো একদিনে দুর করা সম্ভব না, সময় দরকার। আস্তে আস্তেই না হয় সব ঠিক হোক, ক্ষতি কী!


মিলি আনমনে ছাদের রেলিং ধরে দাড়িয়ে আছে। আর তার মন খুব ভালো। কেনো ভালো, সে বিষয়ে ভাবতে ইচ্ছে করছে না। অকারণেই তার মন মেজাজ আজকাল ভালো হয়ে যায়। যা মনে মনে আশা করতো তারথেকে বেশি পেয়ে যাচ্ছে বলেই হয়তো!
আকাশে মেঘ করেছে, গুমট হয়ে আছে চারিপাশ। সিয়ামকে তার সাথে ছাদে আসতে বলেছিল মিলি, সিয়াম আসেনি৷ মিলিও আর জোর করেনি। তবে এখন মনে হচ্ছে তাকে জোর করে হলেও টেনে আনা উচিত ছিলো। এত সুন্দর পরিবেশ, সিয়াম মিস করে ফেললো।
ভাবনার মাঝে ছাদে ওঠার দরজায় টোকা পরলো। সিয়াম এসেছে।
মিলি বলল,
“আপনার মন আর মুখ দেখি আলাদা কথা বলছে, ব্যপার কী!”

সিয়াম উত্তর না দিয়ে হাসলো। মিলির পাশ ঘেঁষে দাড়িয়ে নিজেও রেলিঙে হাত রাখলো।
চারিপাশে একবার চোখ বুলিয়ে বলল,
“এত ফুল গাছ তুমি লাগিয়েছো?”

“হ্যাঁ।”

“বাহ, বেশ শৌখিন মানুষ তো তুমি!”

মিলি বলল,
“আপনাদের বাড়ির সামনে খালি জায়গাটাতে বাগান করতে পারেন না? কত সুন্দর ফুলের বাগান করার মত জায়গা।”

“আমার ওসবের প্রতি ইন্টারেস্ট নেই, তুমি করতে পারো। আফটার অল ওটা তোমারও তো বাড়ি।”

মিলির মনটা আরও একধাপ ভালো হয়ে গেলো। সিয়াম কী নির্দ্বিধায় বলল, ওটা মিলিরও বাড়ি। সবাই কী এভাবে ভাবে?
মিলি বলল,
“আপনার তো দেখি কোনোকিছুতেই ইন্টারেস্ট নেই, কিসে আছে বলুন তো।”

“তোমাতে।”

মিলি লজ্জা পাবার পরিবর্তে হেসে ফেললো। লোকটা ফ্লাটিংও ঠিকমতো করতে পারে না। এমনভাবে কোনো মেয়ে পটে! যদিও সে আগেভাগেই পটে বসে আছে।

আকাশটা আরও অন্ধকার হয়ে এলো। সিয়াম বলল,
“বৃষ্টি নামবে বোধহয়, ঘরে চলো।”

“উহু।”

“উহু মানে কী?”

“যাবো না।”

সিয়াম কপাল কুঁচকালো,
“কেনো?”

“আজ বৃষ্টিতে ভিজবো।”

“মানে টা কী? তোমার না ঠান্ডার ধাচ আছে ভুলে গেছো? বৃষ্টিতে ভিজলে ঠান্ডা লাগবে না?”

মিলি প্রতুত্তর করলো না। বৃষ্টির ফোঁটা তার গায়ে আছড়ে পড়া শুরু করে দিয়েছে। সে হাত দুটো প্রসারিত করলো। আজ সে শাড়ি পরেছিলো। সিয়াম পূর্ণদৃষ্টিতে তাকালো।
চুলগুলো খোঁপা খুলে ছড়িয়ে পরেছে তার। কোমড়ের কাছে উন্মুক্ত হয়ে আছে। সিয়ামের নজর বারবার সেদিকেই গেলো।
মিলি একহাতে তাকেও টেনে দাড় করালো।
সিয়াম মোহগ্রস্ত হয়ে বলল,
“এভাবে সামনে এলে কেনো? কোনো ভুল চুক যদি করে ফেলি?”

মিলির মুখের কোনায় তখন মিষ্টি হাসি। সে দু’হাতে গলা জড়িয়ে বলল,
“নিষেধ করেছে কে?”

সিয়ামের হাসি বিস্তৃত হলো।

,

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here