#ভালোবাসার_অনুভূতি
#লেখিকাঃতানিশা_তিশা_মনি
#পর্বঃ49
কথাটা বলতে বলতে মিহির সাঈফাকে ওদের রুমে নিয়ে আসলো।ভিতরে ঢুকে সাঈফাকে বেডের উপর শুইয়ে দিয়ে ও গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিলো।দরজা বন্ধ করতে দেখে ভয়ে সাঈফার কলিজার পানি শুকিয়ে গেলো।ওর মনে হচ্ছে মিহির ওকে মারার জন্য দরজা বন্ধ করেছে।মিহির সাঈফার দিকে এগিয়ে আসতেই ও ভয়ে একদম নিজেকে গুটিয়ে নিলো।সাঈফাকে এভাবে ভয় পেতে দেখে মিহির মৃদ্যু হাসলো।তারপর মিহির সাঈফার দিকে একটু ঝুকে ওর কপালে নিজের হাতের উল্টোপিঠ ছুইয়ে বললো
“টেম্পারেচার তো ঠিকঠাকই আছে।ফিবার তো নেই তাহলে তোকে এরকম দেখাচ্ছে কেনো?কি হয়েছে তোর?”
সাঈফা মিহিরের হাতটা কপাল থেকে সরিয়ে গম্ভীর স্বরে বললো
“কি আবার হবে?কিছুই হয়নি আমার।”
মিহির ভ্রু কুচকে বললো
“কিছুই যখন হয়নি তখন চোখ মুখ এমন শুকনো শুকনো কেনো লাগছে।কিছু তো একটা অবশ্যই হয়েছে?”
সাঈফা খানিক কর্কশ গলায় বললো
“বললাম তো কিছুই হয়নি।”
মিহির বললো
“কিছুই যখন হয়নি তাহলে রুম আটকে বসে আছিস কেনো?কাজ করার ভয়ে?সবাই কাজ করে মরবে আর তুই অসুস্থতার অজুহাত দেখিয়ে রুমের মধ্যে বসে থাকবি তাইতো?”
মিহিরের কথাটা শেষ হতেই সাঈফা মিহিরের দিকে শক্ত চোখে তাকালো।ওর চোখে মুখে কাঠিন্য ভাব।আজকে ওর নিজেরই নিজের উপর ভীষন দয়া হচ্ছে।মনে হচ্ছে এই পৃথিবীতে ওর মতো দূর্ভাগ্য আর কারোর নেই।নাহলে যাকে ভালোবাসে তার মুখ থেকেই আজকে এরকম কথা শুনতে হতো না।ভালোবাসার মানুষেরা নাকি কিছু বলার আগেই সবটা বুঝে যায়।আর ওর ভালোবাসার মানুষটা কিনা ওকে এতো কষ্ট পেতে দেখেও এই কথা বলছে?একতর্ফা ভালোবাসার পরিনতি হয়তো এরকমই হয়।সাঈফা শক্ত কন্ঠে বললো
“হ্যা,একদম ঠিকই ধরেছেন।আমি কাজ করবো না বলেই সারাদিন রুম আটকে বসে অসুস্থতার নাটক করেছি।আমি একদম ঠিক আছি।এবার আপনি আমার রুম থেকে যেতে পারেন।”
“যাবো তো অবশ্যই।কিন্তু সাথে করে তোকে নিয়ে তবে যাবো।সবাই নিচে বসে কাজ করে মরবে আর তুমি এখানে বসে আরাম করবে?সেটা তো কিছুতেই হবে না।তুই এক্ষুনি আমার সাথে নিচে গিয়ে সবাইকে কাজে হেল্প করবি।”
কথাটা বলেই মিহির সাঈফার হাত ধরে টান দিয়ে এক ঝটকায় দাড় করিয়ে ফেললো।তারপর ওকে টেনে দরজার দিকে নিয়ে যেতে লাগলো।কিন্তু দু-পা যেতেই সাঈফা আবার মাথা ঘুড়িয়ে পড়ে যেতে নিলেই দ্রুত মিহিরের হাত শক্ত করে ঝাপটে ধরলো।এইবার মিহির ভিষন রেগে গেলো।ও সাঈফা কে ধাক্কা দিয়ে বেডের উপর ফেলে দিলো,তারপর সাঈফার দুই হাত বেডের সাথে চেপে ধরে রাগি কন্ঠে বললো
“এতো জিদ কিসের তোর?আমি কখন থেকে তোকে একই প্রশ্ন করে যাচ্ছি আর তুই আমাকে তোর ওই সো কল্ড ইগো দেখাচ্ছিস?”
সাঈফা ভীতু দৃষ্টিতে মিহিরের দিকে তাকিয়ে বললো
“কি করছো ভাইয়া?প্লিজ ছাড়ো আমাকে।”
মিহির বিদ্রুপের স্বরে বললো
“আরেহ বাহ একটু আগেই তো আপনি করে বলছিলি।এখন আপনি থেকে সোজা তুমি?ভালোই তো রং পাল্টাথে শিখে গেছিস দেখছি।”
সাঈফা মাথাটা নিচু করে ছটফট করতে লাগলো মিহিরের হাত থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য।সাঈফা কে ছটফট করতে দেখে মিহির ওর হাতটা আরো জোড়ে চেপে ধরে বললো
“ছটফট করে লাভ নেই সাঈফা।যতোক্ষন পযর্ন্ত না আমি আমার প্রশ্নের অ্যান্সার পাচ্ছি ততোক্ষন পযর্ন্ত তোকে ছাড়বো না।তাই নিজের ভালো চাস তো আমাকে বল তোর কি হয়েছে।নাহলে কিন্তু আমি তোকে হার্ট করতে বাধ্য হবো।”
সাঈফা কাদো কাদো কন্ঠে বললো
“আমার কি হয়েছে সেটা আমি তোমাকে বলতে পারবো না।”
সাঈফার কথা শুনে মিহিরের মাথায় ধপ করে আগুন জ্বলে উঠলো।ও দাতে দাত চেপে বললো
“লাষ্ট বারের মতো বলছি সাঈফা সত্যিটা বল। নাহলে কিন্তু উল্টাপাল্টা কিছু করতে আমার বেশি সময় লাগবে না।এমনিতেই এখন এই রুমে শুধুমাএ আমরা দুজন আছি।আর আমার রাগ উঠলে মাথার ঠিক থাকেনা।তাই আমাকে বেশি রাগাস না,তাহলে যখন তখন যা খুশী হয়ে যেতে পারে।উল্টাপাল্টা কিছু হয়ে গেলে পরে আবার আমাকে দোষ দিতে পারবি না।”
মিহিরের কথা শুনে সাঈফার বুকের মধ্যে ধক করে উঠলো।ও শুকনো একটা ঢোক গিলে বললো
“কি হয়েছে সেটা বলতে পারলে তো এতোক্ষনে বলেই দিতাম।”
সাঈফার কথা শুনে মিহির ওর দুই হাত নিজের এক হাতের মুঠোয় বন্ধি করে, অন্য হাত দিয়ে সাঈফার গাল চেপে ধরে বললো
“তুই সত্যিটা বলবি নাকি আমি সত্যি সত্যি উল্টাপাল্টা কিছু একটা ঘটিয়ে ফেলবো?”
সাঈফা বুঝলো এখন সত্যিটা না বললে কিছুতেই মিহিরের হাত থেকে ওর নিস্তার নেই।মিহির যা রাগি আর জেদি তাতে নিজের ইগো বজায় রাখতে যা খুশী তাই করতে পারে।তাই ও চোখ খিচে বন্ধ করে কাপাকাপা কন্ঠে বললো
“ল-লেডিস প-প্রভলেম!ত-তলপেটে প-পেইন হচ্ছে ভিষন।”
কথাটা বলেই সাঈফা পিটপিট করে চোখ খুলে মিহিরের দিকে তাকালো।দেখলো মিহির এক ভ্রু উচু করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।’ও’ মিহিরের এভাবে তাকানোর কোনো কারন খুজে পেলো না।মিহির কিছুক্ষন ওভাবে তাকিয়ে থেকে ওর উপর থেকে সরে উঠে দাড়ালো।মিহির সরে যেতেই সাঈফা যেনো হাফ ছেড়ে বাচলো।ও নিজেও শোয়া থেকে উঠে বসলো। মিহির শান্ত স্বরে বললো
“এই সামান্য ব্যাপ্যারটা নিয়ে এতো ড্রামা করার তো কোনো দরকার ছিলো না?আগে বলে দিলেই পারতি।”
মিহিরের কথা শুনে সাঈফা বেশ অবাক হলো।মিহির ছেলে হয়েও ব্যাপ্যারটা এতোটা স্বাভাবিক ভাবে নিলো?সাঈফাকে আরেক ধাপ অবাক করে দিয়ে মিহির বললো
“পেইন কিলার নিয়েছিস?”
সাঈফা একটু ইতস্ততো করে বললো
“না অনেক খুজেছিলাম কিন্তু পাইনি তাই ঘুমের ঔষধ খেয়েছি।”
সাঈফার কথা শেষ হতেই মিহির চেচিয়ে বললো
“হোয়াট?শ্লিপিং পিলস খেয়েছিস,সিরিয়াসলি?পেইন কমানোর জন্য পেইন কিলার না খেয়ে শ্লিপিং পিলস খায় কোন গর্দপে?বাসায় এতো লোক আছে,মেডিসিন খুজে না পেলে তাদের কাউকে বলতে পারতি,তারা ফার্মেসি থেকে এনে দিতো।কোন আক্কেলে শ্লিপিং পিলস খেতে গেলি আমাকে একটু বুজা?”
“সবাই অনেক ব্যাস্ত ছিলো তাই আর কাউকে বিরক্ত করিনি।আমি নিজের প্রভলেম নিজেই সলভ করতে পারি।আই ডোন্ট নিড এ্যানিঅন।”
সাঈফার কথা শুনে মিহির বিদ্রুপের স্বরে বললো
“হ্যা কতোটা সলভ করতে পারেন সেটা তো দেখতেই পেলাম।পিরিয়ড টাইমে পেইন কমানোর জন্য ঘুমের ঔষধ খেয়ে বার বার উল্টে পাল্টে চিৎ পটাৎ হয়ে পড়ে যাচ্ছেন।ঠিকঠাক মতো সোজা হয়ে দাড়াতে অবদি পারছেন না,সে যে কিভাবে নিজের প্রভলেম সলভ করতে পারে ভালোই বুঝতে পারছি।”
মিহিরের কথার প্রতিউওরে সাঈফা কিছুই বললো না।চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে রইলো।মিহির মুখ থেকে বিরক্তকর একটা চ শব্দ উচ্চারন করে পকেট থেকে ফোনটা বের করে ব্যালকনিতে চলে গেলো।তারপর কিছুক্ষন পর রুমে এসে ফাষ্ট এইড বক্স খুলে মেডিসিন গুলো উল্টৈ পাল্টে কিছু একটা খুজতে লাগলো।কিছুক্ষন খোজার পর পেয়েও গেলো।তারপর ঔষধ টা টি-টেবিলে উপরে রেখে বললো
“সকালে তো ব্রেকফাস্ট টেবিলে দেখলাম না।তারমানে সকাল থেকে নিশ্চয়ই কিছু খাওয়া হয়নি।মেঘের কাছে কল করে খাবার টা উপরে পাঠিয়ে দিতে বলেছি।খাবার টা নিয়ে এলে সেগুলো খেয়ে এখান থেকে একটা মেডিসিন খেয়ে নিস।একজন গাইনাকলজিষ্টের সাথে কথা বলেছি। ওনি বলেছে এগুলো খেলেই ঠিক হয়ে যাবে।আমি এখন যাচ্ছি,আমার ভিষন ঘুম পেয়েছে।”
কথাটা বলেই মিহির ব্যাস্ত পায়ে রুমের দরজা খুলে বেরিয়ে যেতে নিলো,ঠিক তখনই পিছন থেকে সাঈফা নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলে উঠলো
“থ্যাংক ইউ সো মাচ।আপনার মূল্যবান সময় আমার মতো একটা ছ্যাচড়া মেয়ের পিছনে দেওয়ার জন্য।আমার উপরে আপনি এতো দয়া না দেখালেও পারতেন।”
সাঈফার কথাটা কানে আসতেই মিহির দাড়িয়ে গেলো।সাঈফার কথাটা যেনো মিহিরের ভীষন গায়ে লাগলো।ও পিছনে ঘুড়ে সাঈফার দিকে কিছুক্ষন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে গটগট করে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো।
____________________________
আজকে হিয়ান আর আলিশার মেহেন্দি অনুষ্ঠান।সবাই মিলে ডিসিশন নিয়েছে দুই পরিবার একসাথে মিলে অনুষ্ঠান টা এক জায়গায় বসে করবে।সন্ধ্যায় আলিশারা সবাই হিয়ানদের বাড়িতে আসবে।তারপর এখানে বসে মেহেন্দি হওয়ার পর ডিনার করে সবাই আবার রাতেই চলে যাবে।দুই পরিবারের লোকেরাই ছেলে মেয়েদের বিয়ে নিয়ে বেশ উৎফুল্ল আছে।শুধু এক জনের মুখেই কোনো হাসি নেই। সে হলো আহান।আহান ঘোমরা মুখ করে ছাদের এক কোনায় দাড়িয়ে আছে।রাগে ওর শরীর জ্বলে যাচ্ছে।ইচ্ছে করছে এই বিয়ে এতো সাজ সজ্জা সব কিছু ভেঙে গুড়িয়ে দিতে।তার কারন হচ্ছে মেঘ।মেঘ আজকে সকালেই বায়না ধরেছে ও সাড়িকা,সাঈফা কনে পক্ষের হয়ে বিয়েটা এ্যাটেন্ড করবে।তাই ওরা বিয়ের কয়দিন আলিশাদের বাড়িতে গিয়ে থাকবে।কথাটা শোনা মাএই আহান ডিরেক্ট ওদের মানা করে দিয়েছে।কিন্তু ওরা তো থামবার পাএি না।তিনজন মিলে এক প্রকার ন্যাক্যা কান্না করে বাসার সবাইকে রাজি করিয়েছে।সবাই মিলে আহানকে বুঝিয়েছে কিন্তু তাতেও যখন কোনো কাজ হলো না,তখন ওরা অভিকে ফোন করে ভ্যা ভ্যা করে কেদে দিয়েছে আর বলেছে আহান ওদের অভিদের বাসায় যেতে দিচ্ছে না।সেটা শুনে অভি আহানের কাছে ফোন করে বলে
“আহান তুই কি আমাকে এতোটাই পর ভাবিস?তোর কি মনে হয় মেঘ আমাদের বাড়িতে আসলে আমি ওর খেয়াল রাখতে পারবোনা?এই তোর আমার উপর বিশ্বাস?আরে আমি আলিশাকে যতোটা ভালোবাসি মেঘ,সাড়িকা,সাঈফাকেও ততোটাই ভালোবাসি।এই বাড়িতে ওদের কোনো অসুবিধা হবে না।তুই যদি আমাকে নিজের বেষ্ট ফ্রেন্ড মনে করিস আর আমাকে একটুও বিশ্বাস করিস তাহলে ওদের এখানে আসতে দে।কথা দিচ্ছি ওদের কারো গায়ে আমি এক চুল পরিমানও আচড়ও লাগতে দেবো না।”
অভির কথা টা শোনার পর আহানের আর মানা করার সাহস হয়নি।এরপরেও যদি ও মেঘদের যেতে না দিতো তাহলে অভি ভিষন কষ্ট পেতো।আর আহান কিছুতেই অভিকে কষ্ট দিতে চায় না।অভি ওর ফ্রেন্ড হলেও,ও অভিকে নিজের ভাইয়ের থেকেও বেশি ভালোবাসে।অভির কোনো আবদার কখনো ও ফেলতে পারে না।
আহানের এই মুহুর্তে রাগটা লাগছে মেঘের উপর।কারন যতো নষ্টের গোড়া হচ্ছে এই মেঘ।এই সব কিছু ওরই প্লান ছিলো।নিজে তো গেছেই সাথে সাড়িকা সাঈফাকেও নিয়ে গেছে।তার উপর এখন দিশাও ওই বাড়িতেই আছে।এই চার বজ্জাত একসাথে মিলে কি যে খিচুরি পাকাবে সেটা ভেবেই আহানের টেনশনে মাথা ফেটে যাচ্ছে।আহান হাতের দুই আঙুল কপালে ঠেকিয়ে শ্লাইড করতে করতে বিরবির করে বললো
“সুইটহার্ট খুব শখ না তোমার কনেপক্ষ হওয়ার?আজকে তোমার এমন অবস্থা করবো কনেক্পক্ষ হওয়া তো দূরের কথা জিবনে কোনোদিন আর বিয়েতেই যেতে চাইবে না।একবার এখানে আসো জান তারপর তোমাকে দেখাবো কতো ধানে কতো চাল।”
কথাটা বলেই আহান একটা বাকা হাসি দিলো।
_____________________________
মেঘ অভির রুমের ওয়াশরুম থেকে ফ্রেস হয়ে বের হয়ে দেখে অভি নিজের বেডের উপরে বসে আছে।আসলে বিয়ে বাড়িতে অনেক গেষ্ট থাকায় সব রুমই অলমোষ্ট লোকজনে ভর্তি।কিন্তু অভির রুম একদম খালি।ও ওর রুমে কাউকেই এলাউ করে না।লোক জনের ঝামেলা ওর একদম পছন্দ নয়।তাই অন্যান্য গেষ্টরা ওর রুমের চারপাশেও কেউ আশে না।অভি কিছুতেই চায় না এই বাড়িতে মেঘদের থাকতে কোনো সমস্যা হোক। এজন্য ও নিজের রুম মেঘদের জন্য ছেড়ে দিয়ে কাজিনদের সাথে গেষ্ট রুমে চলে গেছে।
অভিকে দেখে মেঘ মিষ্টি হেসে অভির দিকে এগিয়ে এসে বললো
“ভাইয়া আপনার কিছু লাগবে?”
অভিও বসা থেকে দাড়িয়ে মুচকি হেসে বললো
“না আমার কিছু লাগবে না।আর সরি পারমিশন না নিয়েই চলে আসলাম।আসলে তোমাদের কোনো অসুবিধা হচ্ছে কিনা সেটা দেখতে এসেছি।”
“আরেহ না ভাইয়া আমাদের কোনো অসুবিধা হচ্ছে না।বরং আমরাই এসে আপনাকে অসুবিধায় ফেলে দিলাম।আমাদের জন্য আপনাকে আপনার আপনার রুম থেকে চলে যেতে হলো।আর পারমিশন নিয়ে কেনো আসবেন?বোনদের রুমে ঢুকলে ভাইকে পারমিশন নিয়ে ঢুকতে হয় নাকি?”
মেঘের কথা শুনে অভি মেঘের গাল টেনে দিয়ে বললো
“সেই ছোট্ট মেঘ দেখতে দেখতে কতোটা বড় হয়ে গেছে।কি সুন্দর বড়দের মতো সাজিয়ে গুছিয়ে কথা বলতে পারে।যাই হোক ওদের সাথে থাকতে আমার কোনো অসুবিধা হবে না।তোমার যদি কিছুর দরকার হয় রুমের বাইরে বের হবে না,আমাকে কল করবে আমি সব ব্যাবস্থা করে দিবো।”
অভির কথা শুনে মেঘ ঘোমরা মুখে বললো
“ভাইয়া আপনিও আহান ভাইয়ার মতো কথা বলছেন?যদি সারাক্ষন রুমেই থাকতে হয় তাহলে আমাদের এখানে এসে কি লাভ হলো।জানেন এতো দিন আহান ভাইয়া আমাদের রুম থেকেই বের হতে দেয়নি।সব সময় চোখে চোখে রেখেছে।যদি দেখেছে দাদু বাড়ির কারো সাথে কথা বলেছি তাহলে ইচ্ছা মতো বকা দিয়েছে।এতোদিন মনে হয়েছে কোনো বিয়েতে না জেলখানায় বসে আছি।তাইতো এই বাড়িতে চলে আসলাম যাতে একটু আনন্দ করতে পারি।কিন্তু আপনিও ওনার মতো শুরু করে দিলেন।”
কথাটা বলেই মেঘ ঠোট ফুলিয়ে বেডের উপরে বসে পড়লো।মেঘের অবস্থা দেখে অভি হেসে দিয়ে বললো
“আচ্ছা তোমার যা খুশী করো।তবে ছেলেদের সাথে কথা বলবে না।আমার কাজিনরা কোনো কিছু জিঙ্গেস করলে অথবা কোনো রকম ফাজলামি করলে টোট্যালি ইগনোর করবে।যদিও আমি ওদের বারন করে দিয়েছি কিন্তু কয়েকটা আছে অতিরিক্ত ফাজিল।যদি তোমাকে উল্টাপাল্টা কিছু বলে বসে তাহলে ওদের বাচানোর সাধ্য আমারও নেই।আমার বিশ্বাস আহান তোমাকে একদম একা ছাড়েনি, নিশ্চয়ই কাউকে পাঠিয়েছে তোমার উপর নজর রাখার জন্য।তাই যাই করো প্লিজ বি কেয়ার ফুল,যদি শুনেছে তুমি কোনো ছেলেদের সাথে কথা বলেছো তাহলে তোমাকে তো ধোলাই দিবেই সাথে আমাকেও দিবে।আমি কিন্তু এখনো সিঙ্গেল মেঘ।বউ বাচ্চার মুখ না দেখে এতো তাড়াতাড়ি নিজের প্রানটা হারাতে চাই না।”
অভির কথা শুনে মেঘ ফিক করে হেসে দিলো।অভি গিয়ে ওর কাবার্ড খুলে একটা প্যাকেট বের করে মেঘের হাতে দিয়ে বললো
“মেঘ এইটা দিশাকে দিয়ে দিও।আর বলবে আজকে যেনো এইটাই পড়ে।ও তো এখন আলিশার রুমে।আর ওখানে এখন অনেকে আছে।আমি গিয়ে এটা দিশাকে দিলে সবাই হাজারটা প্রশ্ন করবে।তার থেকে তুমি নিয়ে গিয়ে চুপিচুপি দিয়ে দিও ওকে?”
মেঘ ভ্রু কুচকে কিছুক্ষন প্যাকেটার দিকে তাকিয়ে থেকে বললো
“এটা তো সেই দোকানের প্যাকেট যেখান থেকে আহান ভাইয়া আমার জন্য আর নিজের জন্য কেনাকাটা করেছে।তারমানে আপনিও সেদিন ওনার সাথে কেনাকাটা করার জন্যই গিয়েছিলেন?”
মেঘের প্রশ্ন শুনে অভি উপর নিচ করে হ্যা সূচক মাথা নাড়ালো।মেঘ একটু সন্দীহান কন্ঠে বললো
“দিশার জন্য আপনি কেনো শপিং করেছেন?ওর নিজেই সেদিন বিয়ে উপলক্ষ্যে শপিং করেছিলো।তাহলে এখন এসবের আবার কি দরকার।”
অভি মেঘের নাক টেনে দিয়ে বললো
“তোমাকে এতো কিছু জানতে হবে না।যেটা বলেছি চুপচাপ ভালো মেয়ের মতো সেটা গিয়ে করে এসো।সময় আসলে আস্তে আস্তে সব জানতে পারবে।”
কথাটা বলেই অভি চলে গেলো।মেঘ ছোট ছোট চোখ করে অভির তাকিয়ে বললো
“জানতে হবে না মানে?আলবাদ জানতে হবে।নিশ্চয়ই ডালমে কুচ কালা হে।নাহলে এতোদিন যাকে দুচোখে সহ্য করতে পারেনি আজকে তার জন্য সোজা গিফট কিনে নিয়ে এসেছে?খবর নিতে হবে অবশ্যই এর মধ্যে কোনো কাহিনি আছে।”
#ভালোবাসার_অনুভূতি
#লেখিকাঃতানিশা_তিশা_মনি
#পর্বঃ50
সন্ধ্যা 06:00
চৌধুরী বাড়ির গার্ডেন এরিয়াটা বিভিন্ন ধরনের লাইটস,ফুল,রিবোর্ন দিয়ে সজ্জিত করা হয়েছে।একপাশে একটা ষ্টেজ করা হয়েছে।ষ্টেজের সামনে কিছুটা জায়গা খালি রেখে প্রথম সাড়িতে বর কনের বসার জন্য ব্যাবস্থা করা হয়েছে।আর তার পাশে এবং পিছনের সাড়িতে বাকি গেষ্টদের জন্য ব্যাবস্থা করা আছে।ষ্টেজ টা করা হয়েছে যাতে সবাই সেখানে পার্ফরমেন্স করতে পারে।আর বাকিরা যাতে পিছন থেকে সেটা ভালো করে দেখতে পারে।
আহির,মিহির,আহান,রিয়ান ওরা চারজন গেটের সামনে দাড়িয়ে গেষ্টদের ওয়েলকাম করছে।বাকিরা সবাই ভিতরে যার যার কাজে ব্যাস্ত।হিয়ান নিজের বসার জায়গায় বিরক্ত মুখ করে বসে আছে।গেষ্টরা একেক জন এসেই প্রথমে হিয়ানের কাছে যাচ্ছে ওর সাথে কথা বলার জন্য।যেহেতু হিয়ান পাএ তাই বেচারার বাধ্য হয়ে বএিশ টা বের করে সবার সাথে হেসে হেসে কথা বলতে হচ্ছে।এই মুহুর্তে যেটা ওর কাছে চরম বিরক্তের কারন হয়ে দাড়িয়েছে।
আহান বারবার হাতের ঘড়িতে সময় দেখছে।কনে পক্ষের লোকেরা অলমোষ্ট সবাই এসে পড়েছে।শুধু আলিশা,অভি,দিশা,মেঘ, সাড়িকা, সাঈফা ওরা এখনো এসে পৌছায়নি।সবাই এখন ওদের আসারই অপেক্ষা করছে।ওরা এখানে এসে পৌছালেই অনুষ্ঠান শুরু করা হবে।আহির,মিহির,আহান,রিয়ান কিছুক্ষন গেটের সামনে অপেক্ষা করার পরেও যখন দেখলো ওদের আসার কোনো খবর নেই।তখন ওরা বিরক্ত হয়ে ভিতরে ষ্টেজের দিকে চলে গেলো।তার কিছুক্ষন পর সবার অপেক্ষার অবশান ঘটিয়ে গেটের সামনে দুটো গাড়ি এসে থামলো।প্রথম গাড়িটা থেকে সাড়িকা,সাঈফা আর আলিশা নামলো।আলিশা হালকা নীল রঙের লেহেঙ্গা পড়েছে।সাড়িকা,সাঈফা দুজনেই গাড় গোলাপি রঙের গাউন লেহেঙ্গা পড়েছে।ওরা গাড়ি থেকে নেমে দুজন আলিশার দুপাশে দাড়ালো।পিছনের গাড়ি থেকে প্রথমে ড্রাইবারের পাশের সিট থেকে অভি নামলো তারপর পিছনের সিট থেকে দিশা আর মেঘ নামলো।অভির পড়নে ব্লু রঙের পাঞ্জবি।দিশা সিলভার কালারের লেহেঙ্গা পড়েছে আর মেঘ গোন্ডেন কালারের লেহেঙ্গা পড়েছে সাথে মাথায় গোন্ডেন রঙের হিজাব বেধেছে।শুধু মেঘ না,দিশা,আলিশা,সাড়িকা, সাঈফাও নিজেদের ড্রেসের সাথে ম্যাচিং করে মাথায় হিজাব বেধেছে।
পাএী এসে গেছে কথাটা কানে আসতেই গেষ্টদের সবার দৃষ্টি গেলো গেটের দিকে।সেদিকে দৃষ্টি যেতেই কয়েক সেকেন্ডের জন্য যেনো সবার নজর সেখানেই আটকে রইলো।কোলাহল যুক্ত পরিবেশটা কিছু সময়ের একদম শান্ত হয়ে গেলো।গেটের সামনের লাইটিংয়ের আবছা আলোতে মনে হচ্ছে ওখান থেকে পাচটা পরী হেটে আসছে।পাচ জনেরই একদম সিম্পল মার্জিত সাজ।এতো অল্প সাজেই যেনো সবার সৌন্দর্য উপচে পড়ছে।সাড়িকা সাঈফা আলিশাকে ধরে নিয়ে এসে হিয়ানের পাশে বসিয়ে দিলো।তারপর নিজেরাও গিয়ে সামনের সাড়িতে বসে পড়লো।মেঘ আর দিশাও এসে ওদের পাশে বসে পড়লো।কিছুক্ষনের মধ্যেই এক এক করে সবাই পার্রফমেন্স করতে লাগলো।
মেঘ বসে বসে নাচ গান দেখছিলো তখনই ওর মনে হলো কেউ ওর পাশে এসে বসেছে।মেঘ ঘাড় ঘুড়িয়ে পাশে তাকিয়ে দেখলো এটা আর কেউ না আহান।তবে আহান এক বারের জন্যও মেঘের দিকে তাকাচ্ছে না।আর না আশে পাশের কারো দিকে তাকাচ্ছে।ওর দৃষ্টি একদম ফোনের দিকে স্থির।ওকে দেখে মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে এখানে ঝড়, তুফান,সুনামি এসে গেলেও ‘ও’ কিছুই টের পাবে না।আহানের এমন ডোন্ট কেয়ার ভাব দেখে মেঘের মনে অভিমানের পাহাড় এসে জমা হলো।’ও’ কিছুক্ষন আহানের দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে রইলো,ভেবেছিলো হয়তো একবার হলেও আহান ওর দিকে তাকাবে।কিন্তু ওর আশায় এক বালতি পানি ঢেলে দিয়ে আহান পকেট থেকে ব্লুটুথ বের করে গান শুনতে লাগলো।আহানের এমন ব্যাবহারে এইবার মেঘের কান্না চলে এলো।’ও’ কিছুক্ষন আহানের দিকে ঠোট ফুলিয়ে তাকিয়ে থেকে সামনের দিকে তাকিয়ে পার্ফমেন্স দেখায় মনোযোগ দিলো।হঠাৎ মেঘের মনে পড়লো কনের বাড়ির থেকে যে মেহেন্দীর ডালা আনার কথা ছিলো সেটা মেঘ গাড়িতেই ফেলে চলে এসেছে।ওরা ওটা রাস্তা থেকে আসার সময় ডালা আর মেহেদি কিনে নিয়ে এসেছে তারপর গাড়ির ভিতরে বসে দিশা আর ‘ও’ মিলে ডেকারেশন করেছে।মেঘ বসা থেকে উঠে দ্রুত পায়ে ওখান থেকে চলে গেলো।
_____________________________
মেঘ ড্রাইবারকে ডেকে এনে গাড়ি খুলিয়ে মেহেদীর ডালাটা বের করে ভিতরের দিকে আসতে লাগলো।ডালাটা একদম লাভ শেপের।ওটার মধ্যে প্রথমে সাদা আর লাল গোলাপের পাপড়ি দিয়ে ডেকারেশন করা।তার উপরে তিনপাশে তিনটা পদীপ রাখা।আর একদম মিডেল পয়েন্টে বারোটা টিউব মেহেদী রাখা।মেঘ ওইগুলো হাতে নিয়ে আনমনে হাটছিলো তখনই কেউ এসে ওকে ল্যাং মারলো।ল্যাং মারার সাথে সাথে মেঘের হাত থেকে ডালাটা ছিটকে মাটিতে পড়ে গেলো।মেঘও হুমরি খেয়ে উপুর হয়ে পড়ে যেতে নিবে, ঠিক তখনই একটা বলিষ্ঠ হাত এসে ওর সামনে থেকে ওর কোমর পেচিয়ে ধরে ওকে পড়ে যাওয়া থেকে আটকে দেয়।মেঘ এখনো সামনের দিকে ঝুকে আছে।লোকটা হাত সরিয়ে ফেললেই ও ধপাৎ করে উপুর হয়ে পড়ে যাবে।মেঘ ভয়ে লোকটার হাতের কাছের পাঞ্জাবির অংশ জোড়ে খামচে ধরে, ঘাড় ঘুড়িয়ে লোকটার মুখের দিকে তাকাতেই বেশ অবাক হলো।দেখলো আহান ঠোটের কোনে বাকা হাসি ঝুলিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।মেঘের আর বুঝতে বাকি রইলো না আহান নিজেই ওকে ল্যাং মেরে আবার নিজেই ওকে বাচিয়েছে।মেঘ রাগে কটমট করতে করতে আহানের দিকে তাকালো।আহান ওকে সোজা হয়ে দাড় করিয়ে দিয়ে ব্যাঙ্গ করে বললো
“আরে বেয়াইন সাহেবা একটু ঠিক করে হাটবেন তো?এখন আমি যদি না ধরতাম তাহলেই তো উল্টে রাস্তায় পড়ে যেতেন।তখন কি হতো বলুনতো?কনে পক্ষের মান সম্মান তো সব চলে যেতো।এতো বড় হয়ে গেছেন অথচ এখনো সামান্য কয়েকটা মেহেদির টিউব নিয়েও ঠিকঠাক মতো হাটতে শিখেন নি?আচ্ছা কোনো ব্যাপ্যার না,আমি তো আছি আপনাকে কোলে করে ভিতরে নিয়ে যাওয়ার জন্যে।”
আহানের কথা শুনে মেঘ ভ্যাবাচ্যাগা খেয়ে গেলো।আহান ওকে এভাবে হঠাৎ করে আপনি করে বলছে আবার বেয়াইন সাহেবা ডাকছে?আহানের কি মাথা টাথা খারাপ হয়ে গেলো নাকি?মেঘ ভ্রু কুচকে বললো
“আপনি আমানার বেয়াইন হলাম কবে থেকে?
“যবে থেকে আপনি কনে পক্ষের হয়ে বিয়েটা এটেন্ড করবেন বলে এখান থেকে চলে গেছেন সেই থেকে।ভাইয়ের বউয়ের বোন তো বেয়াইন’ই হয় তাইনা?উপস সরি এখনো তো বিয়েটা হয়নি তাই আপনি এখনো সম্পর্কে আমার হাফ বেয়াইন হন।”
আহানের কথা শুনে মেঘ দাত কটমট করে আহানের দিকে তাকালো।’ও’ ভালো করেই বুঝতে পারছে আলিশাদের বাড়িতে চলে যাওয়ার জন্য আহান ওকে খোচা মেরে কথা বলছে।মেঘ দাতে দাত চেপে বললো
“আপনি আমাকে ল্যাং মারলেন কেনো?আমি যদি পড়ে গিয়ে ব্যাথ্যা পেতাম তখন কি হতো?”
মেঘের কথা শেষ হতেই আহান একপা একপা করে মেঘের দিকে এগিয়ে এসে ওর কোমরে হাত দিয়ে হেচকা টান দিয়ে ওকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো।তারপর ঘোড় লাগা দৃষ্টিতে মেঘের দিকে তাকিয়ে বললো
“কি বলছেন বেয়াইন সাহেবা?আমি আপনাকে কখন ল্যাং মারলাম?উল্টে আমি তো আপনাকে পড়ে যাওয়া থেকে বাচালাম।আমি কি আপনাকে ল্যাং মারতে পারি বলুন?আপনাকে দেখলেই তো আমার শুধু প্রেম প্রেম পায়।”
আহান এভাবে মেঘকে ধরায় ওর চোখ দুটো রসগোল্লার মতো হয়ে গেলো।’ও’ভীতু চোখে আশে পাশে তাকিয়ে দেখতে লাগলো কেউ আসছে কিনা।কিন্তু না দেখলো এখানটা একদম নিড়িবিলি।আসলে সবাই ষ্টেজের ওখানে বসে পার্ফমেন্স দেখছে।মেঘ কাপাকাপা কন্ঠে বললো
“আ-আমি স্পষ্ট দেখেছি আ-আপনি ইচ্ছে করে আমাকে ল্যাং মেরেছেন।একদম মিথ্যা কথা বলবেন না।আমার দেখায় কোনো ভুল হতেই পারে না।”
আহান মেঘের আরেকটু কাছাকাছি গিয়ে হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে মেঘের গালে শ্লাইড করতে করতে বললো
“তুমি যখন দেখেছো তাহলে হয়তো সত্যিই মেরে ছিলাম।আসলে তোমাকে দেখার পর থেকে আমার সবকিছু কেমন এলোমেলো হয়ে গেছে।হার্ট বেচারা এমন ভাবে লাফাচ্ছে যেনো মনে হচ্ছে এখনি বাইরে বের হয়ে আসবে।কি করছি,না করছি নিজেও জানি না।তখন ওখানে বসে তোমার দিকে তাকাইনি কেনো জানো?”
মেঘ কিছু না বলে চোখ বন্ধ করে না সূচক মাথা নাড়ালো।আহান এতোটা কাছে আসায় ওর ঠোট মৃদ্যু কাপছে।শরীরের রক্ত চাপ উঠানামা করছে।হার্ট জোড়ে জোড়ে বিট করছে।নিশ্বাস ঘন হয়ে আসছে।সাড়া শরীরে অদ্ভুত শিহরন বয়ে যাচ্ছে।আহান মেঘের দিকে আরেকটু এগিয়ে গিয়ে ওর গালের সাথে নিজের গাল মিশিয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে লো ভয়েজে বললো
“তোমাকে গেটের সামনে দেখার পর থেকে যে তোমার দিক থেকে আমার চোখ ফিরানো মুশকিল হয়ে গিয়েছিলো।মনে হচ্ছিলো ওটা কোনো মানুষ না সত্যি সত্যিই একটা পরী হেটে আসছে।কয়েক সেকেন্ডের জন্য আমার হার্টবিট মিস হয়ে গিয়েছিলো।ভেবে ছিলাম হয়তো তখনই আমার হার্ট টা ফেল করবে।অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে তোমার পাশে গিয়ে বসে ছিলাম।কিন্তু দ্বীতিয় বার আর তোমার দিকে তাকানোর সাহস হয়নি।তাকালে হয়তো নিশ্চিত আজকে আমি সবার সামনে আপওি কর কিছু একটা করে ফেলতাম।”
আহানের বলা প্রত্যেকটা কথা যেনো মেঘকে একটা ঘোড়ের মধ্যে নিয়ে যাচ্ছে।ওর নিশ্বাস দ্রুত উঠানামা করছে।মেঘ আহানের শার্টের কলার শক্ত করে খামচে ধরে আছে।দুজনেই একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেছে।
“উহুম!উহুম!”
কারো গলা খ্যাক্যানির শব্দ কানে আসতেই আহান আর মেঘ ঘোড় থেকে বেড়িয়ে এসে একে অপরকে ছেড়ে দিয়ে দূরে ছিটকে গেলো।তারপর ঘাড় ঘুড়িয়ে পাশে তাকিয়ে দেখলো ওদের থেকে কিছুটা দূরে দাড়িয়ে মিটিমিটি করে হাসছে অভি।অভিকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে মেঘ লজ্জায় মাথাটা নিচু করে ফেললো।ওর কান দিয়ে রীতিমতো ধোয়া বের হচ্ছে।আহান অভির দিকে তাকিয়ে দাতে দাত চেপে বললো
“তুই আসার আর সময় পেলি না?ভুল সময়ে এন্ট্রি নেওয়া তোর একটা স্বভাব হয়ে দাড়িয়েছে।”
আহানের কথা শুনে অভি প্যান্টের পকেটে দুহাত ঢুকিয়ে ফুল এ্যাটিটিউট নিয়ে ওদের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বললো
“তোর ভাগ্য ভালো এখানে আমি এসেছি।এখন যদি আমার জায়গায় অন্য কেউ থাকতো তাহলে তো বিনা টিকিটে পুরো ফিল্ম দেখে ফেলতো।আর পুরো বিয়ে বাড়িরসুদ্ধ মানুষকেও ডেকে সেটা দেখাতো।তখন কি হতো?”
আহান একটা ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বললো
“দেখালে দেখাতো হু কেয়ারস!আমার বৌ,আমার যখন যা ইচ্ছে আমি তাই করবো তাতে কার বাপের কি?”
অভি একটা টেডি স্মাইল দিয়ে বললো
“ভাই এই বাড়িতে এতো গুলো রুম আছে।ইনফ্যাক্ট পুরো বাড়িটাই এখন খালি পড়ে আছে।বউয়ের সাথে বেশি রোমান্স করতে ইচ্ছে করলে বাড়ির ভিতরে গিয়েই তো করতে পারিস।শুধু শুধু এখানে বসে সিঙ্গেল ছেলে গুলোর ব্লাড প্রেসার কেনো বাড়াচ্ছিস ভাই?আর মেঘ এখনো তোর বউ হয়নি।তাই ওকে বউ বলাটা বন্ধ কর।”
অভির কথা শুনে মেঘ আর এক মুহূর্তও ওখানে দাড়াতে পারলো না।লজ্জায় ওখান থেকে এক দৌড়ে দ্রুত বাড়ির ভিতরে চলে গেলো।মেঘকে এভাবে যেতে দেখে আহান অভিকে উদ্দ্যেশে করে ধমক দিয়ে বললো
“শালা দিলি তো আমার পিচ্চি বউটাকে লজ্জা পাইয়ে।”
অভি চোখ দুটো বড় বড় করে বললো
“যাহ বাবা!আমি আবার কি করলাম”
“তোকে এই সময়ে এখানে কে আসতে বলেছে?আর ওই সব বলতেই বা কে বলেছে?সব দোষ তোর।তুই বাচ্চা মেয়েটাকে কিভাবে লজ্জায় ফেলে দিলি দেখলি?তোকে তো আমি পরে দেখে নেবো।”
কথাটা বলেই আহান হনহন করে ওখান থেকে ষ্টেজের দিকে চলে গেলো।আর অভি বোকার মতো আহানের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো।
_____________________________
মেঘ বাসার ভিতরে এসে সাঈফাদের রুমে চলে এলো।লজ্জায় ওর মরে যেতে ইচ্ছে করছে।ভাগ্যিস ওটা অভি ছিলো নাহলে বাড়ির বড়রা কেউ হলে এতোক্ষনে কি একটা বিশ্রি সিচুয়েশনে পড়ে যেতো।অন্য কেউ দেখলে হয়তো বিষয়টা এতোক্ষনে সবার কানে পৌছে যেতো।তখন মেঘ’ কিভাবে সবাইকে ফেইস করতো?আহানের উপরে প্রচন্ড রাগ লাগছে ওর।এই ছেলে যখন তখন যেখানে সেখানে অসভ্যতা শুধু করে দেয়।নিলজ্জ ছেলে একটা।কথাটা মনে মনে ভেবে মেঘ একটা লজ্জা মিশ্রিত হাসি দিলো।তারপর খেয়াল করলো ওর হিজাবের পিনটা একটু ঢিলে হয়ে গেছে।সাথে ওর ওড়নাটাও কেমন এলোমেলো হয়ে গেছে।তাই মেঘ ওয়াশ রুমে ঢুকে হিজার আর লেহেঙ্গার ওরনাটা খুলে চোখে মুখে হালকা পানির ছিটা দিয়ে পুনরায় আবার ওই গুলো পড়ে নিলো।
ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে সামনে তাকাতেই মেঘ বড় সড় একটা ঝটকা খেলো।কারন ওর থেকে কিছুটা দূরে বেডের উপর আবির বসে আছে।আবির মুগ্ধ দৃষ্টিতে পলকহীন চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।আবির কে এখানে দেখে মেঘের কলিজার পানি শুকিয়ে গেলো।তবে ভয়টা নিজের জন্য না,আবিরের জন্য।ভুলেও যদি আহান জানতে পারে আবির এখানে আছে তাহলে আজকে ওর কি অবস্থা হবে সেটা একমাএ আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না।মেঘ দ্রুত পায়ে দরজার দিকে এগিয়ে যেতে নিলেই আবির বসা থেকে উঠে এসে মেঘের পথ আটকে দাড়ালো।তারপর মেঘের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো
“আরে কোথায় যাচ্ছো?আমি তোমার সাথে কথা বলবো বলে এখানে এলাম আর তুমি কথা না বলে এভাবে এখান থেকে পালিয়ে যাচ্ছো?”
মেঘ শক্ত কন্ঠে বললো
“আপনার সাথে আমার কোনো কথা নেই।সরুন আমার সামনে থেকে।যেতে দিন আমাকে।”
আবির একপা একপা করে মেঘের দিকে এগোতে এগোতে বললো
“যেতে তো দিবোই তার আগে আমি যেটা বলবো সেটা তোমাকে শুনে তারপর যেতে হবে।”
মেঘ পিছাতে পিছাতে বললো
“দেখুন আমি আপনার কোনো কথা শুনতে বা বলতে ইচ্ছুক নই।আপনার জন্য ভালো এটাই হবে আপনি আমার থেকে দূরে থাকুন।নাহলে আপনার সাথে যেটা হবে সেটার জন্য কেউ দায়ি থাকবে না।”
মেঘের কথা শুনে আবির একটা বিদ্রুপের হাসি দিয়ে বললো
“আরেহ বাহ যে মেয়ে আগে ঠিক করে কথা বলতে পারতো না।আমাকে দেখলে ভয়ে একশো হাত দূরে গিয়ে লুকিয়ে পড়তো সে আজকে আমাকে হুমকি দিচ্ছে?নট ব্যাড!আসলে আমারই মস্ত বড় একটা ভূল হয়ে গেছে।কেনো যে সেদিন তোমাকে না বিয়ে করে ওই জেড়িন কে বিয়ে করতে গেলাম?সেদিন যদি ওই ভুলটা না করতাম তাহলে আজকে তুমি শুধুমাত্র আমার থাকতে।তোমার সব কিছু আমার অধীনে থাকতো।”
মেঘ পেছাতে পেছাতে একদম দেয়ালের সাথে মিশে গেলো।আবির এসে মেঘের দুপাশে দেয়ালের সাথে হাত রেখে ওর দিকে একটু ঝুকে দাড়ালো।তারপর ধীর কন্ঠে বললো
“চার বছর আগে আমি যে ভুলটা করে ছিলাম এখন সেটা সুধরে নিতে চাই।খুব তাড়াতাড়ি জেড়িনকে ডিবোর্স দিয়ে আমি তোমাকে পুরোপুরি আমার করে নিবো।তোমার আর আমার মধ্যে আর কখনো কেউ আসতে পারবে না।”
আবিরের কথাটা শোনার সাথে সাথে মেঘের মাথায় আগুন জ্বলে উঠলো। ও পারলে এক্ষুনি আবিরকে চিবিয়ে খেয়ে ফেলতো।রাগে মেঘের শরীর থরথর করে কাপছে।চোখ জোড়া রক্তিম বর্ন ধারন করেছে।মেঘকে রেগে যেতে দেখে আবীর ওর দিকে আরেকটু ঝুকে নেশাতুর কন্ঠে বললো
“তুমি জানো,রেগে গেলে তোমাকে কতোটা হট আর কিউট লাগে?ইচ্ছে করে টুপ করে আদর করে দেই।আচ্ছা কয়েকদিন পর তো তোমার আর আর বিয়ে এনিতেই হবে।তাহলে আমি কি তোমাকে এখন একটা কিস করতে পারি প্লিজ?”
কথাটা মেঘের কানে আসতে দেড়ি হয়েছে কিন্তু ওর গালে থাপ্পর পড়তে দেড়ি হয়নি।মেঘ নিজের গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে কশিয়ে আবিরকে পরপর চারটা থাপ্পর দিয়েছে।থাপ্পর খেয়ে আবিরের মনে হচ্ছে ওর চারপাশের সব কিছু অন্ধকার হয়ে গেছে।গাল দুটো ভিষন ভাবে জ্বলে যাচ্ছে।মেঘ রেগে চিল্লিয়ে বললো
“তোর সাহস হয় কি করে আমাকে এসব কথা বলার?কথা গুলো মুখ দিয়ে উচ্চারন করার আগে এক বারও লজ্জা করলো না?সবাইকে কি তোর বউয়ের মতো আর নিজের মতো ক্যারেক্টারলেস মনে হয়?আরে ঘরে একটা বউ থাকতেও অন্য একটা মেয়েকে এই সব কথা বলতে তোর রুচিতে বাধে না?অবশ্য তোদের মতো ছেলেদের রুচি থাকলে তো বাধবে?অসভ্য জানোয়ার ছেলে একটা।”
আবির গালে হাত দিয়ে হাত দিয়ে অগ্নি দৃষ্টিতে মেঘের দিকে তাকিয়ে আছে।মেঘ গিয়ে আবিরের কলার ধরে চেচিয়ে বললো
“ওভাবে তাকিয়ে কি দেখছিস?তোর কি মনে হয় ওভাবে আমার দিকে তাকালে আমি তোকে ভয় পেয়ে যাবো?এটা তোর বাড়ি নয়,আমার মামুর বাড়ি।যদি এখানে উপস্থিত একটা ব্যাক্তির কানেও যায় তুই আমাকে কি বলেছিস তাহলে পায়ে হেটে আর এই বাড়ি থেকে বেড় হতে পাড়বি না।”
আবীর অবাক হয়ে মেঘের দিকে তাকিয়ে আছে।মেঘের এই রুপটা ও কখনো দেখেনি।ছোট বেলা থেকেই সব সময় দেখে এসেছে মেঘ শান্ত,শিষ্ট,ভদ্র একটা মেয়ে।এভাবে কথা বলা তো দূরে থাক, কখনো কারো সাথে উচু গলায়ও কথা বলেনি।মেঘ আবিরের কলারটা ঝাড়া মেরে ছেড়ে দিয়ে বললো
“তুই কি দিয়ে তৈরি আমাকে একটু বলবি প্লিজ?চার বছর আগে তোর মনে হয়েছিলো আমি ক্যারেক্টার লেস একটা মেয়ে তাই তুই আমাকে বিয়ে বাড়ির সবার সামনে অপমান করে জেড়িনকে বিয়ে করেছিলি।আর আজকে তোর মনে হচ্ছে জেড়িন খারাপ মেয়ে তাই তুই জেড়িনকে ডির্বোস দিয়ে আবার আমাকে বিয়ে করতে চাইছিস?আবার কোনো একদিন তোর মনে হবে আমি খারাপ মেয়ে,সেদিন গিয়ে তুই আরেকটা মেয়েকে বিয়ে করতে চাইবি তাইনা?আসলে তোদের মতো ছেলেদের একটা মেয়ে দিয়ে হয়না।একসাথে হাজারটা মেয়ে লাগে।জানিস এই প্রথম বার জেড়িনের জন্য আমার খুব দয়া হচ্ছে।কারন ও তোর মতো একটা মেরুদন্ড হীন ছাগল কে পাওয়ার জন্য এতোটা পাগলামি করেছে।আরে তোর মতো ছেলেদের ভালোবাসার থেকে তো বিষ খেয়ে মরে যাওয়াও অনেক ভালো।”
মেঘের কথা শুনে আবির রেগে মেঘের দিকে তেড়ে আসতে নিলেই মেঘ দু কদম পিছিয়ে গিয়ে বললো
“আমার কাছে আসার ভুল দ্বীতিয় বার আর করিস না।আমি তো শুধু তোকে থাপ্পর মেরেছি অন্য একজনের কানে এই কথা গুলো গেলে তোর জন্য পৃথিবীর অক্সিজেন নিসিদ্ধ হয়ে যাবে।এমনিতেই আগে থেকেই তোর অপরাধের বিশাল একটা পাহাড় জমে আছে।সেধে সেধে আর নিজের অপরাধটা বাড়াস না।এখানে যতোদিন আছিস ভালো ছেলেদের মতো চুপচাপ বিয়েটা খেয়ে সুস্থ সবল ভাবে এখান থেকে চলে যা।নাহলে তোর বাবার সারা জিবন পুএহীন হয়ে থাকতে হবে।”
কথাটা বলে মেঘ আর এক মুহুর্তও দাড়ালো না।রুমের দরজা খুলে হনহন করে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো।বাইরে এসে দ্রুত পায়ে হাটতে হাটতে হঠাৎ কারো সাথে ধাক্কা খেলো।মেঘ মাথা উঠিয়ে সামনে তাকাতেই ওর ভয়ে হাত পা কাপতে লাগলো।এতোক্ষন যে ভয়টা পাচ্ছিলো সেটাই হলো।এখন কি হবে?
চলবে……….
#চলবে,,,,,,,