ভালোবাসার অনুভূতি পর্ব -৫৭+৫৮

#ভালোবাসার_অনুভূতি
#লেখিকাঃতানিশা_তিশা_মনি
#পর্বঃ57

সকাল বেলা ব্রেকফাস্ট করার পর ইয়ং যারা আছে তারা সবাই ড্রইং রুমে বসে আড্ডা দিচ্ছিলো।বাড়ির বড়রা সবাই নিজেদের কাজে ব‍্যাস্ত হয়ে গেছে।

মেঘ ঘুম থেকে উঠে ফ্রেস হয়ে নিচে নামলো।কাজ করে অনেক রাত করে ঘুমিয়েছে তাই ওর উঠতে একটু দেরি হয়ে গেলো।মেঘ নিচে নেমে দেখলো ড্রইংরুমে সবাই আড্ডা দিচ্ছে।’ও’ সবাইকে দেখেও,না দেখার ভান করে ডাইনিংয়ের দিকে যাচ্ছিলো ঠিক তখনই সাঈফা এসে মেঘকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ওর হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে জোড় করে সোফায় বসিয়ে দিলো।তারপর নিজেও মেঘের পাশে ধপ করে বসে পড়লো।মেঘ মুখ তুলে একবার সবার দিকে তাকালো।দেখলো আহান ওকে দেখে মুখটা কালো করে বসে আছে।আর আহির মিহির মুখটা পেচার মতো করে রেখেছে।ওদের দেখে মনে হচ্ছে কেউ ওদের করলার জুস খাইয়ে দিয়েছে।মেঘ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বসা থেকে দাড়িয়ে বললো

“সাঈফু আমার খুব খিদে পেয়েছে।ব্রেকফাষ্ট টা করে আসি তারপর তোদের সাথে আড্ডা দেবো।”

মেঘের কথা শেষ হতেই সাঈফা আবার ওর হাত ধরে টেনে বসিয়ে দিয়ে বললো

“আপি প্লিজ যেওনা।এতো গুলো দিন পর তোমাকে দেখলাম।কতো কথা জমে আছে জানো?সেগুলো সব আজকে বলবো।”

মেঘ একটু ইতস্তত করে বললো

“আচ্ছা আপাততো আমি যাচ্ছি।পরে নাহয় তোদের সব কথা শুনবো।”

মেঘের কথা শুনে সাড়িকা অভিমানি কন্ঠে বললো

“আপি তুমি আমাদের আর আগের মতো ভালোবাসো না তাইনা?”

মেঘ মৃদ‍্যু হেসে বললো

“কে বলেছে আমি তোদের ভালোবাসি না।আমি তো তোদের নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসি।”

সাড়িকা তাছিল‍্য হেসে বললো

“হ‍্যা সেই জন‍্যই তো লাষ্ট দুই বছরে একটা বারও আমাদের খোজ নেওয়ার প্রয়োজন মনে করোনি।নিজের সিম কার্ড টা অবদি চেইঞ্জ করে ফেলেছো।”

সাড়িকার কথা শুনে মেঘ কিছু বলতে যাবে তার আগেই আহান পিঞ্চ করে বললো

“আরে সাড়িকা বুঝতে পারছিস না উনি ওনার নিউ হাসবেন্ট কে পেয়ে বাকি সবাইকে ভুলে গেছে।ওনাকে এখন এসব বলে লাভ নেই।কিছু কিছু সার্থপর মানুষ থাকে যাদের লাইফে নতুন কেউ আসলে তারা পুরনো মানুষ গুলোকে ভুলে যায়।”

আহানের কথা শুনে মেঘের বুকটা ভার হয়ে আসলো।কিন্তু বাকিরা সবাই আহানের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে।সাঈফা অবাক কন্ঠে আহানকে উদ্দ‍্যেশ‍্য করে বললো

“ভাইয়া কি বলছো এসব?আপির নিউ হাসবেন্ট মানে?”

সাঈফাকে এমন অবাক কন্ঠে প্রশ্ন করতে দেখে আহান ভ্রু কুচকে বললো

“নিউ হাসবেন্ট মানে যার সাথে ওনার বিয়ে হয়েছে তার কথা বলছি।”

আহানের কথা শুনে সবাই বোকার মতো ওর দিকে তাকিয়ে আছে।সাড়িকা অসহায় কন্ঠে বললো

“কি সব বলছো ভাইয়া?তোমার মাথা ঠিক আছে?”

আহান বিরক্তির স্বরে বললো

“আজব তোরা সবাই এভাবে তাকিয়ে আছিস কেনো?মেঘনা যার সাথে এখন থাকে আমি তার কথা বলছি।”

সাঈফা মুখ বাকিয়ে বললো

“আপি কারো সাথে থাকতে যাবে কোন দুঃখে?আপি তো একাই একটা ফ্লাটে থাকে।”

সাঈফার কথা শুনে আহান অবাক কন্ঠে মৃদ‍্যু চিল্লিয়ে বললো

“হোয়াট?একা একটা ফ্লাটে থাকে মানে?ওর হাসবেন্ট তাহলে কোথায় থাকে?”

আহানের কথাটা শেষ হতেই হিয়ান ধমক দিয়ে বললো

“কি তখন থেকে হাসবেন্ট হাসবেন্ট করে যাচ্ছিস?মেঘের হাসবেন্ট আসবে কোথা থেকে?’ও’ তো দুই বছর ধরে একাই একটা ফ্লাটে থাকে।”

হিয়ানের কথা শুনে আহানের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো।কি হচ্ছে এসব ‘ও’ কিছুই বুঝতে পারছে না।সব কিছু ওর মাথার উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে।মেঘ এখনো বিয়ে করেনি তাহলে ওকে ছেড়ে ছিলো কেনো?আর কালকে রাতেই বা কেনো বলেছিলো ওর হাসবেন্ট অপছন্দ করে এমন কোনো কাজ ‘ও’ একদম করতে চায় না।কথাটা ভাবতে ভাবতে আহান মেঘের দিকে তাকালো।দেখলো মেঘ বসা থেকে উঠে উপরে চলে যাচ্ছে।আহান মেঘের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বিরবির করে বললো

“তোমাকে আমি ছাড়বো না মেঘ।আমাকে মিথ‍্যা বলার ফল তুমি হারে হারে টের পাবে।একবার সব সত‍্যিটা জানতে পারি তারপর দেখবে আমি তোমার কি অবস্থা করি।”
___________________________
ছাদের এক কোনায় দাড়িয়ে শূন‍্য দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে আছে মেঘ।ওর চোখ থেকে অঝর ধারায় পানি পড়ে যাচ্ছে।এতো গুলো কাছের মানুষ থাকতেও ওর কষ্ট টা দেখার মতো কেউ নেই।বড্ড অসহায় লাগছে নিজেকে।ইচ্ছে করছে চিৎকার করে কাদতে আর বলতে শেষ বারের মতো তোমরা আমাকে একটু আদর করে দাও।হয়তো কখনো তোমাদের কারো সাথে আর আমার দেখা হবে না।কিন্তু ‘ও’ চাইলেও এখন কাউকে কিচ্ছু বলতে পারবে না।কারন তাহলে ওর এতো দিনের কষ্ট সব বিফলে চলে যাবে।হঠাৎ পিছন থেকে মেঘের কাধে কেউ হাত রাখলো।মেঘ ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকিয়ে দেখলো হিয়ান দাড়িয়ে আছে।হিয়ান কে দেখে মেঘ আর নিজেকে সামলাতে পারলো না।ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে হাউ মাউ করে কেদে দিলো।কাদতে কাদতে বললো

“আমার সাথে এসব কেনো হলো ভাইয়া?আমি তো কখনো কারো ক্ষতি করিনি তাহলে আল্লাহ কেনো আমাকে এতো বড় শাস্তি দিলেন।”

হিয়ান সোজা হয়ে দাড়িয়ে আছে।মেঘের প্রশ্নের অ‍্যান্সার তো ওর নিজেরও জানা নেই।হিয়ানের চোখ থেকে টুপ করে এক ফোটা পানিয়ে গরিয়ে পড়লো।আর চোখের সামনে ভাষতে লাগলো দুই বছর আগের কথা।

___________ফ্লাসব‍্যাক_________

আহান যেদিন আবির আর জেড়িন কে পুলিশে দিয়ে এসে সবটা ক্লিয়ার করে বলেছিলো।আবির আর জেড়িনের পরিবার সেদিনই সিলেট ফিরে গিয়ে ছিলেন।যাওয়ার আগে ওনারা আহানদের সবার কাছে হাত জোড় করে ক্ষমাও চেয়েছেন।

সব কিছু ঠিকঠাকই চলছিলো।দুই সপ্তাহের মধ‍্যে মেঘ আর সাঈফা আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে উঠে।মোনা খান আর মিড়া রহমানের ট্রিট মেন্টেই ওরা সুস্থ হয়ে গিয়েছিলো।তাই ওদের আলাদা করে আর হসপিটালে নিয়ে গিয়ে কোনো টেষ্ট করানো হয়নি।

সাঈফা যতোদিন অসুস্থ ছিলো মিহির ওর অনেক কেয়ার করেছে।সাঈফা কথা না শুনলে কখনো কখনো সুন্দর ভাবে বুঝিয়ে কথা শুনিয়েছে।আবার কখনো বকে ধমক দিয়ে কথা শুনিয়েছে।মিহিরের কেয়ারিং দেখে ওর প্রতি সাঈফার যে রাগ ছিলো সেটা আস্তে আস্তে কমে গেছে।

আর আহান সে তো মেঘ যতোদিন অসুস্থ ছিলো ততোদিন তার অন‍্য দিকে কোনো খেয়ালই ছিলো না।সব কিছু ভুলে গিয়ে সারাদিন শুধু মেঘের দেখা শোনা করেছে।মেঘকে খাবার খাওয়ানো থেকে শুরু করে ঔষধ খাওয়ানো পর্যন্ত সব কিছু আহান একা হাতে করেছে।বাকিরা মেঘের কেয়ার করবে কি আহানের কান্ড দেখেই হেসে গড়াগড়ি খেতো।কারন আহান মেঘকে এমন ভাবে ট্রিট করতো যেনো মেঘ ছয় মাসের ছোট একটা বাচ্চা।

প্রায় দুই সপ্তাহ পর মেঘ সুস্থ হয়ে নিজেদের বাড়িতে ফিরে আসে।বাড়িতে আসার পর দুই দিন সব কিছু নরমাল ছিলো।কিন্তু তারপর থেকে হঠাৎ করেই মেঘের মাথায় অসহ‍্য যন্ত্রণা শুরু হতে থাকে।মাঝে মাঝে আচ‍ৎমকা ব‍্যাথ‍্যা শুরু হতো আবার এমনি এমনি কমেও যেতো।মেঘ ভেবেছিলো হয়তো মাথায় আঘাত লাগার কারনে এমন টা হচ্ছে তাই ‘ও’ ব‍্যাপ‍্যারটা তেমন একটা পাএা দেয়নি।এভাবে কেটে গেলো আরো পনেরো দিন।এর মধ‍্যে মেঘের অনেক বার মাথা ব‍্যাথ‍্যা উঠেছে।কিন্তু সবাই টেনশন করবে তাই ‘ও’ কাউকে কিচ্ছু বলেনি।আহান রোজ ওকে দশ পনেরো বার করে ফোন দিতো।’ও’ ঠিকঠাক মতো খাবার খেয়েছে কিনা,ঔষধ খেয়েছে কিনা,ঘুমিয়েছে কিনা সেই সব খোজ নিতো।

দীর্ঘ এক মাস পর মেঘ আজকে ভার্ষিটি তে আসলো।প্রথম দুটি ক্লাস করে মেঘ,দিশা,রিজা অফ পিরিয়ডে ক‍্যান্টিনে চলে আসলো।সেখানে কিছুক্ষন থাকার পর মেঘের মাথায় আবার যন্ত্রণা না শুরু হয়।তবে এই বার আগের থেকেও আরো বেশি করে ব‍্যাথ‍্যা শুধু হয়ে গিয়েছিলো।মেঘ ব‍্যাথ‍্যা সহ‍্য করতে না পেরে মাথা চেপে ধরে ফুপিয়ে কেদে দেয়।মেঘকে এভাবে কাদতে দেখে দিশা আর রিজা মিলে ওকে ধরে ভার্ষিটির পাশের একটা প্রাইভেট ক্লিনিকে নিয়ে আসে।সেখানে আসার পর ডাক্তার মেঘের প্রভলেম গুলো শুনে ওকে কিছু টেষ্ট করতে বলে।মেঘ টেষ্ট গুলো করে বাড়িতে চলে আসে।টেষ্টের রিপোর্ট কালকে ছাড়া পাওয়া যাবে না।রিজা আর দিশা মেঘকে বাসায় পৌছে দিয়ে ওরা নিজেদের বাড়িতে চলে যায়।মেঘ বাসায় এসে এতোদিন যে মেডিসিন গুলো খেতো সেখান থেকে একটা পেইন কিলার আর শ্লিপিং পিলস খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।

পরের দিন মেঘ ভার্ষিটি গিয়ে প্রথম ক্লাস টা করে সোজা সেই ক্লিনিকে রিপোর্ট আনতে চলে যায়।দিশা আর রিজাও ওর সাথে আসতে চেয়ে ছিলো কিন্তু ‘ও’ ওদের ক্লাস মিস হবে বলে নিয়ে আসেনি।মেঘ রিপোর্ট গুলো পেয়ে যখন ডাক্তারের চেম্বারে গিয়ে ওই গুলো দেখায়।রিপোর্ট গুলো দেখে ডাক্তার বলে ওর মাথায় আগে থেকেই নাকি ছোট্ট একটা টিউমার ছিলো।মাথায় আঘাত লাগার কারনে ওটাতে এখন ইনফেকশন হয়েছে।যার কারনে মেঘের হঠাৎ করে এমন মাথা ব‍্যাথ‍্যা শুরু হয়েছে।আর যদি এটার ঠিকঠাক মতো ট্রিটমেন্ট করানো না হয় তাহলে মেঘের ক‍্যান্সার অবদি হতে পারে।এসব বলে মেঘকে উনি ভালো একজন নিউরোলজিস্টের কাছে যাওয়ার জন‍্য সাজেশন দেয়।

এসব শোনার পর মেঘের আর কোথাও যাওয়ার শক্তি ছিলো না। ‘ও’ কোনো রকম নিজেকে সামলে বাড়িতে চলে আসে।বাড়িতে এসে রুম আটকে হাউমাউ করে কেদে দেয়।ওর মস্তিষ্ক একদম শূন‍্য হয়ে যায়।কি করবে,কাকে বলবে,কোথায় যাবে কিচ্ছু বুঝতে পারে না।কাদতে কাদতে মাথায় প্রেশার পরে ওর আবার মাথা ব‍্যাথ‍্যা শুরু হয়ে যায়।আস্তে আস্তে ওর চোখের সামনে সব কিছু ঝাপসা হয়ে আসে।আর ‘ও’ সেন্সলেস হয়ে ফ্লোরে পড়ে থাকে।
___________________________

মেঘের যখন হুশ ফেরে তখন সন্ধ‍্যা সাতটা বাজে।’ও’ কোনো রকম নিজেকে সামলে নিয়ে ফ্রেস হয়ে নিচে যায়।নিচে গিয়ে দেখে মিহির,মিড়া রহমান,আজম রহমান কেউই এখনো ফিরে আসেনি।মেঘ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বসে পড়ে।একজন সার্ভেন্ট এসে ওকে খাবার দিয়ে যায়।’ও’ কোনো কথা না বলে কোনো রকম একটু খানি খেয়ে উপরে চলে আসে।এসব শোনার পর মেঘের গলা দিয়ে কিছুতেই খাবার নামছে না।’ও’ উপরে এসে ব‍্যাগ থেকে ফোনটা বের করে হাতে নিলো,উদ্দ‍্যেশ‍্য সবাইকে সবটা জানাবে।কিন্তু ফোনটা ওপেন করতেই মেঘ দেখলো দেড়শো প্লাস মেসেজ আর আশি প্লাস মিসড কল সব গুলো আহানের।নিশ্চয়ই সারাদিন ফোন করে ওকে পায়নি তাই এখন পাগলের মতো করছে।মেঘ ফোনটা বুকের সাথে চেপে ধরে হাউমাউ করে কেদে দিলো।’ও’ নিজের জন‍্য যতোটা না ভয় পাচ্ছে তার থেকে বেশি ভয় পাচ্ছে আহানের জন‍্য।ওর কিছু হয়ে গেলে ছেলেটা পাগল হয়ে যাবে।

এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মেঘ শুনতে পেলো কেউ বারবার বাসার কলিং বেল টিপে যাচ্ছে।মেঘ বুঝতে পারছে না এভাবে পাগলের মতো কে কলিংবেল বাজাচ্ছে।’ও’ চোখের পানি মুছে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে দরজা খুলে রুম থেকে বের হতে যাবে তার আগেই কোথা থেকে আহান দ্রুত পায়ে এসে ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।আকষ্মিক ঘটনায় মেঘ হতবম্ভ হয়ে গেলো।আহান মেঘকে জড়িয়ে ধরে ব‍্যাস্ত গলায় বললো

“মেঘ পরী তুমি কোথায় চলে গেছিলে?জানো আমি তোমাকে কতোবার ফোন করেছি?ফোনটা ধরোনি কেনো?টেনশনে আমার মাথা ফেটে যাচ্ছিলো।ভেবে ছিলাম তোমার আবার কিছু একটা হয়ে গেছে।তাই সব কাজ ফেলে এখানে চলে এসেছি।”

মেঘ স্টাচু হয়ে দাড়িয়ে আছে।’ও’ সামান‍্য একটু ফোন ধরেনি তাই আহান এমন পাগলের মতো করছে,যদি সত‍্যিটা জানতে পারে তাহলে ওর কি অবস্থা হবে।মেঘের হাত পা কাপছে।’ও’ একবার ভাবছে সবটা আহান কে বলে দিবে কিন্তু পরক্ষনেই আবার নিজের মনকে শক্ত করে নিলো।নাহ যাই হয়ে যাক আহান কে এসব কথা কিছুতেই বলা যাবে না।
__________________________
পরের দিন সকালে ভার্ষিটি যাওয়ার নাম করে মেঘ ভালো একজন নিউরোলজিস্টের সাথে দেখা করতে গেলো।ওনার চেম্বারে গিয়ে ওনাকে আগের দিনের রিপোর্ট গুলো দেখালো।উনি প্রথমে ভিষন অবাক হয়েছিলো এটা দেখে যে এই টুকু একটা বাচ্চা মেয়ে নিজের রিপোর্ট নিজেই নিয়ে এসেছে।পরে উনি সব রিপোর্ট গুলো ভালো করে দেখে মেঘকে আরো কিছু টেষ্ট দিলেন।মেঘ টেষ্ট গুলো করিয়ে ভার্ষিটিতে চলে গেলো।সেখান থেকে ক্লাস শেষ করে বাসায় চলে আসলো।প্রতিদিনের মতোই সবার সাথে স্বাভাবিক ব‍্যাবহার করলেও মেঘ ভিতরে ভিতরে ভিষন ভয় পেতে লাগলো।বারবার আল্লাহর কাছে দোয়া করতে লাগলো যাতে রিপোর্ট গুলো ভুল আসে।কিন্তুু সেটা আর হলো না।পরের দিন আবার রিপোর্ট গুলো নিয়ে ডাক্তারের কাছে গিয়ে জানতে পারলো টিউমার টা খুব বাজে ভাবে ইনফেকশন করেছে।ইমিডিয়েট ওটার ট্রিটমেন্ট শুরু না করলে যা তা কিছু হয়ে যেতে পারে।আর ট্রিটমেন্ট করলেও মেঘের পুরোপুরি সুস্থ চান্স খুবই কম।যেকোনো সময় ‘ও’ ব্রেন ষ্টোক করে মারা যেতে পারে অথবা মানষিক ভারসাম‍্য হারিয়ে ফেলতে পারে।
___________________________
সেদিনের পর থেকে মেঘ ধীরে ধীরে বদলে যেতে থাকে।হঠাৎ করেই একদম চুপচাপ হয়ে যায়।সবার সাথে কথা বলা কমিয়ে দেয়।আহান কে ইগনোর করতে শুরু করে।আহান দিনে দশ বার ফোন দিলে ‘ও’ একবার সেটা রিসিভ করে।আর রিসিভ করে এটা সেটা অযুহাত দেখিয়ে ফোনটা কেটে দেয়।একদিকে মেঘের এমন ব‍্যাবহার সহ‍্য করতে না পেরে আহান পাগলের মতো বিহেব করতে শুধু করে।অন‍্যদিকে মেঘের ট্রিটমেন্ট শুরু না করার জন‍্য ওর শারিরীক কন্ডিশন আরো খারাপ হতে থাকে।’ও’ ভার্ষিটিতে যাওয়া কমিয়ে দেয়।কারন একে তো শরীর খারাপ তার উপর আহান রোজ ভার্ষিটির গেটের সামনে এসে দাড়িয়ে থাকে ওর সাথে একবার কথা বলার জন‍্য।আর ‘ও’ বারবার আহান কে ইগনোর করে চলে আসে।
__________

আজকে মেঘ ভার্ষিটিতে এসেছিলো কিছু নোটস নেওয়ার জন‍্য।কয়েকটা ক্লাস করার পর নোটস গুলো নিয়ে মেঘ ভার্ষিটির গেট দিয়ে ভয়ে ভয়ে বের হতে থাকে।কারন যদি আহানের সাথে দেখা হয়ে যায় তাহলে আহান এখানে পাবলিক প্লেসে বসে নিশ্চিত একটা সিনক্রিয়েট করবে।

মেঘ গেট থেকে বের হয়ে খুব সাবধানে আশেপাশে তাকালো।দেখলো আহান কেনো আহানের ছায়াটাও কোথাও নেই।আহান কে না দেখে মেঘ ভীষন অবাক হলো।পরে ভাবলো হয়তো কাজে আটকে গেছে তাই আসতে পারেনি।একদিকে ওর ভালোই হয়েছে।আহানের অসহায় কন্ঠের প্রশ্ন গুলোর থেকে রেহাই পেয়ে গেলো।এসব ভাবতে ভাবতে মেঘ একটা রিকশায় উঠে বাড়ির উদ্দ‍্যেশে রওনা দিলো।
_______________

মেঘ বাড়িতে এসে এমন কিছু দেখতে পাবে স্বপ্নেও ভাবেনি।’ও’ ড্রইংরুমে ঢুকতেই দেখতে পেলো মোনা খান,আহাদ খান,আহান সহ অভির বাবা-মা,হিয়ানের বাবা-মা,সাড়িকা,সাঈফা আর ওদের বাবা-মা,আহির,মিহির,দিশা,রিজা সবাই ওদের বাসার বিশাল ড্রইংরুমে বসে আছে।মেঘ কে বাসার মধ‍্যে ঢুকতে দেখে সবাই এক সাথে চিল্লিয়ে বললো

“সারপ্রাইজ!”

মেঘ অবাক হয়ে প্রশ্নবোধক চাহনিতে মিরা রহমানের দিকে তাকাতেই উনি এসে জানালেন আজকে ঘরোয়া ভাবে আহান আর ওর এ‍্যানগেজমেন্ট।আর খুব তাড়াতাড়ি ওদের বিয়ের ডেটও ফিক্সড করা হবে।এসব শুনে মেঘের মাথায় বাজ পড়লো।আর যাই হোক ‘ও’ কিছুতেই আহান কে বিয়ে করে আহানের লাইফ টা নষ্ট করে দিতে পারবে না।

মিরা রহমান এসে মেঘের হাত ধরে ওকে রেডি করানোর জন‍্য উপরে নিয়ে যেতে লাগলেন।এমন সময় মেঘ ঝাড়া দিয়ে ওনার হাত টা সরিয়ে চিল্লিয়ে বললো

“আমি কোথাও যাবো না।আর এখানে কোনো এ‍্যানগেজমেন্ট হবে না।”

মেঘের কথা শুনে সবাই অবাক চোখে ওর দিকে তাকালো।মিরা রহমান বললেন

“মানে?”

মেঘ ঝাড়ি মেরে বললো

“বুঝতে পারছো না?বাংলাতেই তো বললাম।তোমরা কাকে জিঙ্গেস করে এ‍্যানগেজমেন্ট টা ঠিক করেছো?কোনো কিছু করার আগে কাউকে কিছু জিঙ্গেস করার প্রোয়জন মনে করোনা তাইনা?নিজেদের যা মনে তাই করো সব সময়।”

মেঘের কথা বলার ধরন দেখে ওখানে উপস্থিত সবাই চারশো চল্লিশ বোল্টের শকড খেলো।মেঘ কখনো কারো সাথে আগে এমন বিহেব করেনা।মিড়া রহমান কিছু বলতে যাবেন তার আহান বললো

“মামনির কোনো দোষ নেই মেঘ।এই সব কিছু ওনারা আমার কথায় করেছেন।তুমি যা বলার আমাকে বলো।”

আহানের কথা শেষ হতেই মেঘ বললো

“আমার কাউকে কিছু বলার নেই।আমি এ‍্যানগেজমেন্ট করতে চাই না ব‍্যাস।”

কথাটা বলে মেঘ সিড়ি দিয়ে উপরে উঠতে যাবে তার আগেই আহান এসে মেঘের হাত ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বললো

“কিছু বলার নেই মানে কি?আমরা দুজন দুজনকে যখন ভালোবাসি তাহলে এ‍্যানগেজমেন্ট টা করতে সমস‍্যা কোথায়?”

আহানের কথা শুনে মেঘ না বোঝার ভান করে বললো

“দুজন দুজনকে ভালোবাসি মানে?আপনি আমাকে ভালো বাসতেই পারেন বাট আমি আপনা কে ভালোবাসি না।”

মেঘের কথা শুনে আহান ওর হাত ছেড়ে দিয়ে দু-কদম পিছিয়ে গেলো।তারপর আহত কন্ঠে বললো

“মেঘ তুমিতো আমাকে বলেছিলে যে তুমি আমাকে ভালোবাসো।তাহলে এখন এসব কেনো বলছো?”

মেঘ ডোন্ট কেয়ার একটা ভাব নিয়ে বললো

“তখন আবেগের বশে ভালোবাসি কথাটা বলে ফেলেছি।বাট এখন বুঝতে পারছি ওটা ভালোবাসা না ক্ষনিকের মোহ ছিলো।জানেনই তো এই বয়সে এরকম একটু আধটু হয়েই থাকে।”

মেঘের কথা শুনে সবাই স্তব্দ হয়ে গেলো।আহান কি বলবে আর ভাষা খুজে পেলো না।মেঘ বললো

“আমার যা বলার বলে দিয়েছি এইবার ড্রামা শেষ হয়ে গেলে আপনারা সবাই আসতে পারেন।”

কথাটা বলে মেঘ সিড়ি বেয়ে হনহন করে উপরে চলে গেলো।আর বাকিরা সবাই মেঘের যাওয়ার দিকে স্তব্দ হয়ে তাকিয়ে রইলো।মেঘের এমন পরিবর্তন দেখে সবাই রীতিমতো বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে।আহান আর এক মুহূর্তও ওখানে দাড়ালো না টলতে টলতে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে গেলো।
_____
মেঘ উপরে এসে রুমের দরজা আটকে দিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো।সেখানে গিয়ে হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে হাউমাউ করে কেদে দিলো।’ও’ কতো কষ্টে আহান কে ওই কথা গুলো বলেছে সেটা একমাএ ওই জানে।মেঘ কাদতে কাদতে বললো

“আপনি তো সব সময় আমাকে নিঃসার্থ ভাবে ভালোবেসে গেছেন।তাহলে আমি কিভাবে এতোটা সার্থপর হবো বলুন?কিভাবে আপনাকে আমার অনিশ্চিত জিবনটার সাথে বেধে আপনার জিবনটাকে নষ্ট করবো?আমি জানি,আপনি সত‍্যিটা জানতে পারলে আমাকে কখনো ছেড়ে যাবেন না।তাই আজকে এভাবে আপনাকে হার্ট করতে বাধ‍্য হলাম।আই অ‍্যাম সরি!ভেরি সরি!”
_________________________
আজকে প্রায় দুই দিন আহান বাড়িতে ফেরেনি।ওর ফোনটাও বন্ধ বলছে।সেদিন এখান থেকে বের হয়ে কোথায় গেছে কেউ কিচ্ছু জানে না।সবাই টেনশনে মরে যাচ্ছে।আর মেঘ এমন একটা ভান করছে যেনো আহান মরে গেলেও ওর কিছু যায় আসে না।কিন্তু ভেতরে ভেতরে শেষ হয়ে যাচ্ছে।না পারছে কাউকে বলতে আর না পারছে সহ‍্য করতে।এদিকে যখনই কোনো টেনশন করে তখনই ওর মাথায় অসম্ভব যন্ত্রণা হয়।তার উপর বাসার সবাই ওর সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে।

মেঘ ভার্ষিটির নাম করে বেরিয়েছে আহান কে খুজতে যাওয়ার জন‍্যে।ভাবছে একবার আহানের ফার্ম হাউজে গিয়ে দেখবে সেখানে আহান আছে কিনা।মেঘ ওদের বাসার গেটের বাইরে রিকশার জন‍্য দাড়িয়ে ছিলো ঠিক তখনই একটা কালো গাড়ি এসে একদম ওর সামনে থামলো।আর ‘ও’ কিছু বুঝে ওঠার আগেই গাড়ির এক পাশের দরজা খুলে এক জোড়া হাত এসে ওকে টান দিয়ে গাড়ির ভিতরে তুলে নিলো।তারপর দরজাটা আটকে দিয়ে ওর মুখে ক্লোরোফর্ম স্প্রে করে ওকে অঙ্গান করে ফেললো।ঘটনাটা এতো তাড়াতাড়ি ঘটে গেলো যে মেঘ একটা চিৎকার দেওয়ারও সুযোগ পেলো না।
#ভালোবাসার_অনুভূতি
#লেখিকাঃতানিশা_তিশা_মনি
#পর্বঃ58

একটা রুমের বেডের উপর হাত-পা বাধা অবস্থায় পড়ে আছে মেঘ।কিছুক্ষন আগেই ওর জ্ঞান ফিরে এসেছে।হুশ আসার পর চোখ খুলে তাকিয়ে দেখলো চারপাশের সবকিছু একদম অন্ধকার।’ও’ একটু নড়ার চেষ্টা করতেই অনুভব করলো ওর হাত-পা শক্ত করে বাধা।চিৎকার করতে যাবে তখনই বুঝতে পারলো মুখটাও বেধে রেখেছে।মেঘ ছাড়া পাওয়ার জন‍্য ছটফট করতে লাগলো।ওর দম আটকে আসছে।মাথায় প্রচন্ড পরিমান যন্থনা শুরু হয়েছে।চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে।মেঘ অনেকক্ষন ছটফট করতে করতে ক্লান্ত হয়ে চুপ করে রইলো।ওর চোখ দিয়ে নিশব্দে পানি গরিয়ে পড়ছে।ভয়ে ওর হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।কারা ওকে এখানে এভাবে তুলে আনলো সেটাই ভেবে পাচ্ছে না।আচ্ছা যারা ওকে এখানে এনেছে তাদের কোনো খারাপ উদ্দ‍্যেশ‍্য নেই তো?তারা কি এখন ওকে মেরে ফেলবে?নাকি ওকে আটকে রেখে ওর পরিবার কে ব্লাকমেইল করবে?এসব চিন্তা ভাবনা মেঘের মাথায় ঘুড়পাক খাচ্ছে।

হঠাৎ দরজা খোলার শব্দে মেঘের ভাবনায় ছেদ ঘটে।দরজা খুলতেই বাইরে থেকে আসা লাইটের আলোতে রুমটা মৃদ‍্যু আলোকিত হয়ে যায়।মেঘ পিটপিট করে সামনে তাকিয়ে দেখে একটা অভয়ব রুমের মধ‍্যে প্রবেশ করছে।’ও’ ভয়ে চোখ খিচে বন্ধ করে ফেলে।

অভয়বটি রুমে ঢুকে সুইচ টিপে লাইট অন করে ধীরে ধীরে মেঘের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে।মেঘ চোখ বন্ধ করা অবস্থায়ই বুঝতে পারছে সামনের ব‍্যাক্তিটি ওর দিকে এগিয়ে আসছে।ব‍্যাক্তিটি যতো একপা একপা করে ওর দিকে এগোচ্ছে ততো ‘ও’ নিজেকে ভয়ে গুটিয়ে নিচ্ছে।’ও’ এতোটাই ভয় পেয়ে গেছে যে চোখ খুলে সামনে তাকিয়ে ব‍্যাক্তিটি কে দেখার সাহসও পাচ্ছে না।ব‍্যাক্তিটি গিয়ে মেঘের পাশে বসে আচ‍ৎমকা ওর বাহু ধরে টেনে বসালো।তারপর কোনো কিছু না বলে ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।ঘটনার আকষ্মিকতায় মেঘ হতবম্ভ হয়ে গেলো।’ও’ ঝট করে চোখ খুলে ছটফট করতে লাগলো।হাত পা ছুড়ে নিজেকে লোকটার বাহু বন্ধন থেকে মুক্ত করতে চাইলো।ওর এমন ছটফট দেখে লোকটি বিরক্তির স্বরে বললো

“উফফ মেঘ পরী লাফালাফি টা একটু বন্ধ করবে?আমাকে একটু শান্তিতে থাকতে দাও প্লিজ।”

গলার স্বর টা কানে আসার সাথে সাথে মেঘ শান্ত হয়ে গেলো।কন্ঠস্বর টা চিনতে ওর একটুও ভুল হলো না।এটা আহানের কন্ঠ!তারমানে কি আহান ওকে কিডন‍্যাপ করে নিয়ে এসেছে?মেঘ ভালো করে চারপাশে তাকিয়ে দেখতে পেলো এটা সেই আহানের ফার্ম হাউজের রুমটা।যেখানে ‘ও’ আগেও একবার এসেছিলো।যেদিন আহান আর ওর উপর এ‍্যাট‍্যাক করা হয়েছিলো সেদিন।কিন্তু মেঘের মাথায় এটাই ঢুকছে না যে আহান ওকে কেনো কিডন‍্যাপ করলো?

মেঘ কিছুক্ষন শান্ত হয়ে বসে থেকে আবার ছটফট করতে লাগলো।এবার আহান ওকে ছেড়ে দিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুচকে বললো

“কি সমস‍্যা?লাফাতে না বারন করেছি তার পরেও লাফাচ্ছো কেনো?”

মেঘ কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে।কিন্তু মুখ বাধা থাকা কারনে বলছে পারছে না।আহান মেঘের মুখ থেকে বাধন টা খুলে দিলো।বাধন খুলতেই মেঘ চিল্লিয়ে বললো

“আপনার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?আমাকে এখানে এনে এভাবে বেধে রেখেছেন কেনো?”

মেঘের কথাটা শেষ হতেই আহান হাতের আঙুল দিয়ে কান চেপে ধরে শান্ত গলায় বললো

“উফফ মেঘ পরী এতো জোড়ে চিল্লাচ্ছো কেনো?আমি কানে কালা নই যে তুমি আস্তে কথা বললে আমি শুনতে পাবো না।”

আহানের এমন শান্ত স্বরে কথা বলার ধরন দেখে মেঘ আরো ক্ষেপে গেলো।’ও’ আবার চিল্লিয়ে বললো

“আপনি আমার হাত পায়ের বাধন খুলে দিন নাহলে আমি আরো জোড়ে চেচাবো।”

আহান বিদ্রুপ করে হেসে বললো

“ওকে!যতো পারো চেচাও কোনো সমস‍্যা নেই।তবে তোমার এই চিল্লাচিল্লি শুনে তোমাকে সাহায‍্য করতে আসার মতো এখানে কেউ নেই।”

আহানের কথা শুনে মেঘের কান্না চলে আসলো।নিজেকে বড্ড অসহায় লাগছে।যাকে এতোটা ভালোবাসে সে আজকে ওকে এভাবে আটকে রেখে কষ্ট দিচ্ছে?’ও’ কি বুঝতে পারছে না তাই মেঘ অসহায় কন্ঠে বললো

“হাত পায়ের বাধন গুলো খুলে দিন প্লিজ।আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।হাত পায়ে প্রচন্ড ব‍্যাথ‍্যা পাচ্ছি।”

মেঘের এমন অসহায় কন্ঠ শুনে আহান ওর দিকে তাকালো।দেখলো মেঘ অশ্রুসিক্ত চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।আহান মেঘের দিকে একটু এগিয়ে গিয়ে ওর দু-গালে আলতো করে হাত রেখে বললো

“আমারও খুব কষ্ট হচ্ছে মেঘ।বুকের বাম পাশটায় বড্ড যন্থনা হচ্ছে।জানো তুমি যখন বলেছিলে “আপনি আমাকে ভালোবাসতেই পারেন কিন্তু আমি আপনাকে ভালোবাসি না” তখন আমার মনে হয়েছিলো কেউ আমার কলিজাটা টেনে বেরে করে নিয়েছে।”

মেঘ ঠোট কামরে কান্না আটকে রাখার চেষ্টা করছে।এখন কিছুতেই ‘ও’ আহানের সামনে দূর্বল হতে চায়না।যাই হয়ে যাক নিজের অনিশ্চিত জিবনটাকে কোনো ভাবেই আহানের সাথে জড়াবে না।আহান ভেজা কন্ঠে বললো

“এসব কেনো করছো মেঘ পরী?কেনো আমাকে এভাবে ইগনোর করছো?আমি কি কোনো অন‍্যায় করে ফেলেছি?আচ্ছা যদি অন‍্যায় করে থাকি তাহলে তুমি যা শাস্তি দেবে আমি মাথা পেতে নিবো।তবুও আমাকে নিজের থেকে এভাবে দূরে সরিয়ে দিও না প্লিজ।”

মেঘ কি বলবে বুঝতে পারছে না।কিছু বলতে গেলেই নির্ঘাত এখন কেদে দিবে।আহান মেঘকে এভাবে চুপ থাকতে দেখে ওর গাল থেকে হাত সরিয়ে ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো

“মেঘ পরী আমি তোমাকে ছাড়া কিছুতেই থাকতে পারবো না।মরে যাবো আমি তোমাকে ছাড়া।প্লিজ আমাকে দূরে সরিয়ে দিও না।প্লিজ!”

আহানের কথা শুনে মেঘ আর নিজেকে সামলে রাখতে পারলো না হাউমাউ করে কেদে দিলো।হঠাৎ মেঘ এভাবে কেদে দেওয়ায় আহান একটু হকচকিয়ে উঠলো।আহান ব‍্যাস্ত স্বরে বললো

“কি হয়েছে মেঘ এভাবে কাদছো কেনো?”

মেঘ কাদতে কাদতে বললো

“আমি আপনাকে ভালোবাসি না।বিশ্বাস করুন আমি আপনাকে সত‍্যিই ভালোবাসি না।আমাকে বাড়িতে দিয়ে আসুন প্লিজ।আমি এখানে থাকবো না।”

মেঘের কথা শুনে আহান রেগে গেলো।’ও’ ঝট করে মেঘকে ছেড়ে দিয়ে ধাক্কা দিয়ে ওকে বিছানায় ফেলে দিলো।তারপর বসা থেকে দাড়িয়ে রাগি কন্ঠে বললো

“কেনো ভালোবাসো না হ‍্যা?কিসের কমতি আছে আমার মধ‍্যে?এতো গুলো বছর ধরে নিলজ্জের মতো তোমার পিছনে পড়ে আছি।আমার ভালোবাসার কোনো দাম নেই তোমার কাছে?এতো গুলো বছর ধরে আমি হাজার টা মেয়েকে ইগনোর করেছি শুধুমাত্র তোমার জন‍‍্য।খাওয়া,গোসল,ঘুম সব ভুলে গিয়ে শুধুমাত্র তোমার কথা ভেবেছি।আর তুমি কতো সহজে বলে দিলে তুমি আমাকে কখনো ভালোই বাসোনি।সবকিছু শুধু তোমার ক্ষনিকের মোহ ছিলো।”

কথাটা বলেই আহান বেডের পাশে থাকা ছোট্ট টেবিলটার উপরে একটা লাথি মারলো।লাথি মারার সাথে সাথে টেবিলটা কাৎ হয়ে ফ্লোরে পড়ে গেলো।মেঘ ভয়ে পিছাতে পিছাতে বেডের অন‍্যপাশে গিয়ে নিজেকে একদম গুটিয়ে নিলো।আহান মেঘকে ভয় পেতে দেখে নিজের রাগ টাকে কন্ট্রোল করার চেষ্টা করলো।জোড়ে জোড়ে দুটো দম নিয়ে রুমের এক সাইডে থাকা টি-টেবিলের উপর থেকে এক গ্লাস পানি নিয়ে ঢকঢক করে খেয়ে ফেললো।মেঘ ভয়ার্ত দৃষ্টিতে আহানের দিকে তাকিয়ে ওর কাজ দেখছে।আহান পানি টা খেয়ে জগ থেকে আরেক গ্লাস পানি ঢাললো।তারপর গ্লাস টা হাতে নিয়ে বেডের উপর উঠে মেঘের মুখের সামনে ধরলো।মেঘের ভিষন পানির পিপাসা পেয়েছে তাই ‘ও’ ভীতু দৃষ্টিতে একবার আহানের দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে পুরো পানিটা শেষ করে ফেললো।আহান বেড থেকে নেমে গ্লাস টা রেখে এসে বেডের এক কোনায় আবার বসে পড়লো।তারপর মেঘের দিকে তাকিয়ে নরম কন্ঠে বললো

“মেঘ পরী একটা ষ্টোরি শুনবে?”

আহানের কথা শুনে মেঘ ভ্রু কুচকে ওর দিকে তাকালো।এভাবে হাত-পা বেধে রেখেও যে কেউ ষ্টোরি শোনানোর কথা বলতে পারে সেটা মেঘের জানা ছিলো না।মেঘের কোনো রেসপন্স না পেয়ে আহান আলতো হেসে বললো

“আচ্ছা শোনো তাহলে,আমরা তখন অর্নাস সেকেন্ড ইয়ারের এক্সাম দিয়েছি সবেমাএ।বাসায় বসে আমি হিয়ান,রিয়ান,অভি ভিষন বোর হচ্ছিলাম তাই ভাবলাম বাইরে কোথাও গিয়ে ঘুরে আসবো।কিন্তু কথাটা বাড়ির লোকদের জানাতেই সবাই সাফসাফ মুখের উপরে মানা করে দিয়েছিলো।সবাই এমন ভাবে রিয়‍্যাক্ট করেছিলো যেনো আমরা ঘুরতে যাওয়ার কথা না,বিয়ে করার কথা বলেছি।পরে আমরা চারজন মিলে প্লান করলাম আমরা বাড়ি থেকে পালিয়ে তারপর ঘুড়তে যাবো।প্লান মাফিক রাতের অন্ধকারে আমরা আমাদের বাবাদের আলমারি থেকে টাকা চুড়ি করে পালিয়েও ছিলাম।”

আহানের কথা শুনে মেঘের মুখটা হা হয়ে গেলো।ওর বিশ্বাসই করতে পারছে না যে আহান টাকা চুড়ি করে তারপর বাসা থেকে পালিয়ে ঘুড়তে গিয়েছিলো।মেঘকে ওভাবে হা করে তাকিয়ে থাকতে দেখে আহান মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে আবারও বলা শুরু করলো

“আমরা চারজন মিলে ঘুরতে সিলেট চলে গেলাম।ওটাই আমাদের কোনো গার্ড ছাড়া ফাষ্ট টুর ছিলো।তো ফাষ্ট দিন ট্রেন থেকে নেমে আমরা সোজা রিসোর্টে চলে গিয়ে ছিলাম।সেখানে গিয়ে রুম বুক করলাম।তারপর একটু রেষ্ট নিয়ে দুপুরের লাঞ্চ করে ঘুরতে বের হলাম।তবে আমরা চারজনই হুডি আর মাক্স দিয়ে নিজেদের ফেইজ হাইড করে তারপর বের হয়ে ছিলাম।বিকজ কলেজ আর ভার্ষিটি লাইফে আমরা রাজনীতিতে জড়িয়ে গিয়ে ছিলাম।ঝগরা মারামারি করা আমাদের প্রতিদিনের রুটিং হয়ে গিয়েছিলো।আর শএুরও অভাব ছিলো না।”

মেঘ মনোযোগ সহকারে আহানের কথা গুলো শুনছে।আহান বললো

“আমি সাথে করে ক‍্যামেরা নিয়ে গিয়েছিলাম চারপাশের সুন্দর প্রকৃতির দৃশ‍্য ক‍্যামেরায় ক‍্যাপচার করার জন‍্যে।ফটো তুলতে তুলতে যে কখন হিয়ানদের থেকে আলাদা হয়ে রোডের মাঝে চলে এসেছিলাম টেরই পাইনি।ওরাও ওদের মতো জায়গাটা ঘুরে ঘুরে দেখছিলো তাই আমার দিকে কারোরই খেয়াল ছিলো না।হঠাৎ কেউ একটা এসে আমাকে জোড়ে ধাক্কা দিয়ে রাস্তার সাইডে ফেলে দিলো।সাথে নিজেও আমার গায়ের উপরে পড়লো।আচৎমকা কি হয়ে গেলো আমি বুঝতে না পেরে সামনে তাকাতেই দেখলাম আমি যেখানে দাড়িয়ে ছিলাম সেখান দিয়ে বড় একটা ট্রাক যাচ্ছে।বুঝতে পারলাম আমাকে অ‍্যাক্সিডেন্টের হাত থেকে বাচানোর জন‍্যই ধাক্কাটা দিয়েছে।আমি ধন‍্যবাদ বলার জন‍্য আমার গায়ের উপর পরে থাকা মানুষটার দিকে তাকাতেই ওর দিকে আমার চোখ টা আটকে গেলো।দেখলাম আমার বুকের উপর বাচ্চা একটা মেয়ে পড়ে আছে।মেয়েটার মাথায় কালো রঙের হিজাব,চোখে গোল চশমা পড়া।ভয়ে চোখ খিচে বন্ধ করে আছে।মেয়েটাকে দেখে কয়েক সেকেন্ডের জন‍্যে আমার পৃথিবী থমকে গিয়েছিলো।বলতে পারো লাইফে ফাষ্ট টাইম কারো উপর বড়সড় একটা ক্রাশ খেয়ে ছিলাম।”

ক্রাশ খেয়ে ছিলাম কথাটা শুনে মেঘের মুখটা একদম কালো হয়ে গেলো।’ও’ মাথাটা নিচু করে মনে মনে বললো,ওহ তারমানে আমার আগে আপনার ভালো লাগার মানুষ আরো একজন ছিলো।আহান মেঘের মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো।তারপর আবারও বলতে শুরু করলো

” আমি কোনো রকম নিজেকে সামলে মেয়েটাকে ধন‍্যবাদ দিতে যাবো তার আগেই মেয়েটা আমার বুক থেকে উঠে রেগে বললো”

“এই যে মিষ্টার হুডি ম‍্যান!দিন কানা নাকি আপনি?চোখের সামনে দিয়ে এতো বড় একা ট্রাক আসছিলো আর আপনি বগার মতো ওখানে ঠায় দাড়িয়ে ছিলেন?আমি সময় মতো না আসলে কি হতো বলুন তো?আপনি,আপনার হুডি,মাস্ক আর আপনার ক‍্যামেরা সব এতোক্ষনে ট্রাকের চাকার নিচে পড়ে চ‍্যাপ্ট‍্যা চিড়া হয়ে যেতো।”

আমি ওভাবেই শুয়ে থেকে মেয়েটার কথা হা করে শুনছিলাম।তখনই হিয়ান,অভি আর রিয়ান দৌড়ে এসে আমাকে টেনে তুলে।মেয়েটি আমাদের চার জনের দিকে কিছুক্ষন ড‍্যাব‍ড‍্যাব করে তাকিয়ে থেকে বলে

“এইযে হুডি ওয়ালা হনুমানেরা নিজেদের বন্ধুকে সামলে রাখুন।আরেকটু হলেই তো আপনাদের বন্ধু টাটা বাই হয়ে যেতো।আর এই গরমের মধ‍্যে দিনের বেলা এভাবে হুডি পড়ে ঘুরছেন কেনো?আপনাদের কি হুডির ফ‍্যাক্টরি আছে নাকি?”

মেয়েটার কথা শুনে হিয়ান,অভি,রিয়ান হা করে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো।ওদের এভাবে চুপ করে দাড়িয়ে থাকতে দেখে মেয়েটা একটু বিরক্তির স্বরে বললো

“আরেহ ধুর এতোক্ষন তো এদের শুধু কানা ভেবেছিলাম।এখন দেখি এরা কথাও বলতে পারে না।”

মেয়েটার কথা শেষ হতেই দুজন লোক দৌড়ে এসে মেয়েটার পাশে দাড়িয়ে হাফাতে লাগলো।ওদের মধ‍্যে থেকে একজন চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো

“ছোট মামনী তুমি ঠিক আছো?এভাবে না বলে হুটহাট দৌড়ে কোথায় চলে যাও বলোতো?তোমার কিছু হয়ে গেলে বড় বাবা আমাদের গুলি করে মারবে।”

লোকটার কথা শুনে মেয়েটি ঝাড়ি দিয়ে বললো

“হ‍্যা আমি একদম ঠিক আছি।আমার আবার কি হবে?আর তোমরা আমার পিছে চুইঙ্গামের মতো লেগে না থেকে এদের মতো দিন কানাদের রাস্তা পার করতে হেল্প করো।তাহলে যদি আমাদের দেশে অ‍্যাক্সিডেন্টের সংখ‍্যাটা একটু কমে।আর তোমাদের বড় বাবা কে এতো ভয় পাওয়ার কি আছে?’ও’ বাঘ নাকি ভাল্লুক?উজবুক একটা,ওকে বলে ছিলাম আমার সাথে আসার জন‍্য,কিন্তু উনি তো ওনার বন্ধুদের নিয়ে সব সময় বিজি থাকেন।আমার জন‍্য ওনার টাইম আছে নাকি?আজকে আসুক বাসায় ওর সাথে আমি একদম কথা বলবো না।পচা ছেলে একটা।”

“কথাটা বলতে বলতে মেয়েটা ওখান থেকে চলে গেলো।ওর পিছনে পিছনে লোক দুটোও চলে গেলো।আমি মেয়েটার যাওয়ার দিকে এক ধ‍্যানে তাকিয়ে ছিলাম।”

এই টুকু বলে থামলো আহান।মেঘ আহানের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে।পুরনো কিছু স্মৃতি ওর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।মেঘকে এভাবে তাকাতে দেখে আহান আবারও বলা শুরু করলো

“আমরা সেদিন আর ঘুড়াঘুড়ি করিনি।সোজা রিসোর্টে চলে এসে ছিলাম।চলে তো এসে ছিলাম বাট মেয়েটার চেহারাটা আমার চোখের সামনে থেকে কিছুতেই যাচ্ছিলো।আমি ভাবলেশিল ভাবে এক জায়গায় বসে শুধু মেয়েটার কথা ভাবছিলাম।মেয়েটার কথা বলার ষ্টাইল,হাটার ষ্টাইল সব কিছু চোখের সামনে বারবার ভেষে উঠছিলো।বিকেল গরিয়ে সন্ধ‍্যা,সন্ধ‍্যা গরিয়ে রাত হয়ে গিয়েছিলো কিন্তু আমার কোনো নড়চড় ছিলো না।আমাকে এভাবে শান্ত হয়ে বসে থাকতে দেখে রিয়ান,অভি,হিয়ান বেশ অবাক হয়েছিলো কারন যেই আমি কোথাও একটা সেকেন্ডও চুপচাপ বসে থাকতাম না,সেই আমি কয়েক ঘন্টা এক টানা ওভাবে বসে ছিলাম।অবাকের সাথে সাথে বিরক্তও হয়েছিলো কারন আমার জন‍্য ওরা কোথাও ঘুড়তে যেতে পারছিলো না।রাতে ডিনারের জন‍্য ওরা অনেক ক্ষন আমাকে ডাকাডাকি করেছিলো কিন্তু আমি নিজের জায়গা থেকে এক বিন্দুও নড়াচড়া করিনি।অবশেষে ওরা ডাকতে ডাকতে বিরক্ত হয়ে নিজেরাই না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলো।”

একটু থেমে আহান একটা লম্বা দম নিলো।তারপর আবারও বললো

“রাত বারোটার সময় ক্ষিদেয় অভি ঘুম থেকে উঠে গিয়েছিলো।বেচারা একদম ক্ষিদে সহ‍্য করতে পারতো না।ঘুম থেকে উঠে ‘ও’ সোজা এসে আমার পায়ের সামনে বসে পড়েছিলো।তারপর পা ধরে রীতিমতো কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছিলো।ওর কান্নাকাটি শুনে হিয়ান আর রিয়ানও উঠে গিয়েছিলো।পরে তিনজন আমাকে এক প্রকার জোড় করে টানতে টানতে রিসোর্ট থেকে দূরে রাস্তার পাশের একটা ছোট পাহাড়ি রেষ্টুরেন্টে নিয়ে এসেছিলো।সেখানে এসে আমরা ভিষন অবাক হয়ে ছিলাম।আমি এক প্রকার আকাশের চাদ হাতে পেয়ে গিয়েছিলাম।”

#চলবে,,,,,,
#চলবে,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here