ভালোবাসার রংমশাল পর্ব-০১

মানুষের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ বিয়ে।অথচ এই বিয়েই অভিশাপ হয়ে দাঁড়ালো নিঝুমের জীবনে।যে মানুষটাকে মনে প্রাণে ঘৃণা করে এসেছে এতোদিন আজ তাকেই কবুল বলে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করতে হলো।ভাগ্য বুঝি একেই বলে!খুব জানতে করছে আর কত ধরনের নির্মম পরিহাস তার ভাগ্যে আছে।বউ সেজে অপেক্ষা করছিলো কাঙ্খিত মানুষটার জন্য অথচ বিয়ে হয়ে গেলো “সাম্যর” সাথে। বরযাত্রী আসার পথে দূর্ঘটনায় পরেছিলো।ট্রাকের সাথে বরের গাড়ির ধাক্কা লেগে গাড়ি খাদে পরে গিয়েছিলো।বরের খুব একটা ক্ষয়ক্ষতি না হলেও নিঝুমের ব্যাপক ক্ষতি হয়ে গেছে।এক লহমায় জীবনের পাতা গুলো দমকা হাওয়ায় লন্ডভন্ড হয়ে গেছে।এই বিয়ে অশুভ ভেবে বরযাত্রী ফিরে গেছে সে পথেই। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে এ কথা হাস্যকর হলেও নিঝুমের জীবনে এই উড়ে আসা পরিনতি আরো বেশি হাস্যকর হয়ে দাড়িয়েছে।আশ্রয়দাতা মানুষ গুলোর মুখ চেয়ে বলতে পারেনি, আমি পারবো না সাম্যকে বিয়ে করতে।ম্যাট্রিক পরিক্ষার ফলাফল পেয়ে যখন খুশিতে আত্মাহারা হয়ে বাড়ি ফিরছিলো বাড়িতে পথে শুনতে পায় তাদের বাড়িতে আগুন লেগেছে। দিশেহারা হয়ে ছুটে এসেছিলো বাড়িতে। ততোক্ষণে সব শেষ হয়ে গেছে। বাবা মা নামক পবিত্র সত্বা গুলো পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। অর্ধগলিত লাশের সামনে নির্বাক হয়ে দাড়িয়ে ছিলো।অনুভূতি শূন্য হয়ে গিয়েছিলো। একটানা সাতদিন কেউ তাকে কোনো কথা বলাতে পারেনি।সে যখন শোকে স্তব্ধ তখন চাচা ফুফুদের মাঝে চলেছে তুমুল বির্তক।অনেক প্রতিকূলতা পেরিয়ে খালার হাত ধরে চলে এসেছিলো শহরে। সেই থেকে তার বাবা মায়ের অভাব পূরন করে চলেছেন সামির-নাজনীন দম্পতি। তাদের দুটো ছেলে মেয়ে থাকা সত্বেও নিঝুমকে দিয়েছেন আরেক সন্তানের জায়গা। এ দুটো মানুষ না থাকলে এতোদিনে সে ঝরে পরা ফুলের ন্যায় মাটিতে নিষ্পেষিত হতো।যারা এতোদিন ধরে তার সম্মান রক্ষা করে আসছেন আজ তাদের সম্মান কিরে সে নষ্ট করতো।জীবনের হিসেব নিকেশ তো কবেই ফুরিয়ে গেছে নতুন করে হিসেব কষে কি হবে?কিন্তু যা ভবিতব্য তা করে মানতে পারবে সে?সাম্য নামক ভয়ংকর গ্রহণ তাকে গ্রাস করে নিয়েছে যা তিলে তিলে তাকে শেষ করে দিবে।

কোহিনূর বেগম অস্থিরতায় ছটফট করছেন। প্রেশার বেড়ে গেছে তার। কিছুতেই তিনি মানতে পারছেন না নিঝুম তার ছেলের বউ!এমন মেয়েকে মানবতার খাতিরে দয়া দেখিয়ে বাড়ির মেয়ে বানানো যায় বউ নয়!কষ্ট হচ্ছে ভীষণ, তার একমাত্র আদরের ছেলের বউ হলো কিনা নিঝুম! তার স্বামীর অতি ভালোমানুষির ফল তাকে ভোগ করতে হবে। কি দরকার ছিলো আগ বাড়িয়ে বড় ভাইকে গিয়ে সাম্যর কথাটা বলার।রাগে,দুঃখে তিনি পাগলপ্রায় অবস্থায় পৌঁছে গেছেন।

সাম্য ঘরে ঢুকে কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে মাকে দেখলো।এরপর টেবিলের কাছে গিয়ে ঔষধের বাক্স থেকে প্রেশারের ঔষধ বের করলো।মায়ের হাতে পানির গ্লাস ধরিয়ে দিয়ে বললো, শান্ত হও আগে,তারপর ঔষধটা খাও।

কোহিনূর বেগম ফোঁপানো স্বরে বললেন, খাবো না আমি ঔষধ। তোরা বাপ ছেলে মিলে আমায় মেরে ফ্যাল তবুও এই বিয়ে আমি মেনে নিবো না।
সাম্য মাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে বললো,তোমাকে মানতেও হবে না মা।আমাকে একটু সময় দাও সবকিছু ঠিক করে ফেলবো। ঠিক করার জন্যই তো এতসব আয়োজন।
কোহিনূর বেগম বুঝতে না পেরে ছেলের মুখ পানে তাকালেন। সাম্যর মুখের প্রতিটি রেখায় ফুটে উঠেছে অচেনা অভিব্যক্তি যার কোনো ব্যাখা খুজে পেলেন না।

রাত বাড়ছে সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নিঝুমের চোখের পানি। কষ্ট গুলো দলা পাকিয়ে উঠছে। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। নিয়ম মতো আজ ফুলে সজ্জিত বিছানায় জীবনের নতুন দিগন্তের পথ উন্মোচন হওয়ার কথা ছিলো। যে রাত একরাশ নতুন অনুভূতি নিয়ে জীবন বইয়ে আরেকটি অধ্যায় হিসেবে যোগ হতো তা আজ বিভীষিকাময়।ছোট থেকেই বিয়ে নিয়ে কতো স্বপ্ন ছিলো।রান্নাবাটি খেলার সেই বর -বউ খেলা তার মনে দাগ কেটেছিলো।মা বলতো,”প্রত্যেকটা মেয়ে জন্মগতভাবে সংসার করার গুন অর্জন করে যার জন্য কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার দরকার হয় না।”একটা মেয়ে তার সকল আশা,স্বপ্ন নিয়ে অপেক্ষায় থাকে একটি সুন্দর সংসারের অথচ সেই মেয়ের কপালে জোটে কন্টাকীর্ন সংসার,সারাজীবন সে সংসারে ক্ষত বিক্ষত হয়।অথচ যে মেয়ে বিয়ের সঠিক মানে বোঝে না।সংসারের গুরুত্ব যাদের কাছে রঙিন ফানুস তারা পাঁচ সাতটা বয়ফ্রেন্ড, প্রেমিক বানায়।কিন্তু দিন শেষে তারা সবকিছুর সমাপ্তি টেনে পরিবারের পছন্দের বিলেত ফেরত পাত্রকে বিয়ে করে সুখে সংসার করে।তারাই ভালো ঘর পায়,ভালো বর পায়।সম্পর্কের জোড় বন্ধন বিধাতার এক বিষ্ময়কর সৃষ্টি। নিঝুম ঘুমিয়ে পরেছে।ঘুমের মাঝে কেঁপে উঠছে।জেগে থাকলে কি জানতে পারতো এক জোড়া চোখ তারই মুখ পানে খুজে চলছিলো ভবিতব্য নিয়তি। রাতের শেষ প্রহরে সবাই ঘুমের রাজ্যে বিচরণ করলেও ঘুম নেই এক জোড়া চোখের। আঁধো আলোতে ভেসে থাকা মুখটার দিকে তাকিয়ে জ্বলছে,পুড়ছে, রক্তাক্ত হচ্ছে সেই সাথে প্রবল আবেগের দোলুনীতে দুলছে।

সাম্যদের যৌথ পরিবার। পরিবারের সবাইকে সকালের নাস্তাটা এক সাথেই খেতে হয়।এ নিয়ে পরিবারের ছোট সদস্যদের বিরক্তের সীমা নেই।আটটার মধ্যে সকলকে টেবিলে হাজির হতে হয়।সামির রহমান এ বাড়ির বড় কর্তা।তিন ভাই দুবোনের মধ্যে তিনি সবার বড়।তার বাবার তৈরী করা ব্যবসা তিনি পেশা হিসেবে নিয়েছেন। দুটো কাগজ তৈরীর কারখানা আছে তাদের। মেজো ভাই আমির রহমান বড় ভাইয়ের সাথেই ব্যবসা সামলায়।ছোট ভাই জামির রহমান চাকুরী করেন।সাম্য জামির শেখের একমাত্র ছেলে। চাটার্ট অ্যাকাউন্টিংয়ে এ পড়াশোনা করেছে।এ বছরই তার পড়াশোনা শেষ হয়েছে। গতকাল এ বাড়িতে যে কান্ড ঘটে গেছে তার রেশ বাড়ির সব জায়গায় বিরাজমান। নাজনীন বেগম রান্নাঘরের দিকে এগোলেন। সাতটা পার হয়ে গেছে সেই কখন। যদিও গতকাল থেকে সামির রহমানের মানসিকতা ভালো নেই তবু তিনি নিয়মের বাইরে যাবেন না।তাই দ্রুত নাস্তা বানানোর কাজে লেগে পরলেন। খুব ইচ্ছে হলো নিঝুমের কাছে যেতে।মেয়েটার ওপর, দিয়ে যা সব ধকল গেলো নিশ্চয়ই খুব ভেঙে পরেছে। রাতে থাকতে চেয়েছিলেন নিঝুমের কাছে।সামির রহমান বাঁধা দিয়েছেন। তিনি মনে করেন,কিছুটা সময় নিঝুমকে একা থাকতে দেয়া উচিত।তাই রাতে আর খোঁজ নিতে পারেন নি।তাছাড়া সাম্যকে কিছুকথা বলতে হবে।
বাড়ির মেজো বউ শামসুন্নাহার রান্নাঘরে আসলে তাকে বললেন,আমি আটা মেখে রেখেছি, তুই সবজি গুলো কেটে রাখ আমি একটু আসছি।

কোথায় যাও বড় ভাবী?

নিঝুমের ঘরে।মেয়েটার একটু খোঁজ নিয়ে আসি।
ওহ,তা যাও।আমি সকাল থেকে ভাবছি ওর একটু খোঁজ নিবো,গতকাল যা হলো কি আর বলবো,নিঝুমের কপালটাই খারাপ।

শামসুন্নাহারের বলা শেষ কথাটা শেলের মতো বুকে বিধলো।কথা না বাড়িয়ে বের হলেন রান্নাঘর থেকে। সবাই এমন ভাবে কথা বলছে কেন?আশ্চর্য! মনে হচ্ছে নিঝুম বিধবা হয়েছে। একটা বিয়ে ভেঙে গেছে তাই আরেকজনের সাথে বিয়ে হলো।এতে খারাপটা কি হলো!সবাই এমন ভাব করছে যেন এটা শোকের বাড়ি। যা হয়েছে বেশ হয়েছে। মেয়েটা তার কাছেই থাকবে।এতোদিন এ বাড়ির মেয়ে ছিল এখন বউ হয়েছে তফাৎ শুধু এটুকুই।সাম্য অনেক ভালো ছেলে।তিনি দুহাতে বড় করেছেন সাম্যকে।খারাপ দিক বলতে সাম্যর রাগ খুব বেশি।ছেলেটা যে কবে এতো রাগী হয়েছে কে যানে!

ফোনের কর্কশ আওয়াজে সাম্য বালিশ থেকে মাথা তুললো।ফোনটা কানে ঠেকাতেই তীক্ষ্ণ রিনরিনে স্বরে শান্তার কথা ভেসে আসলো,এসব কি শুনছি,তুই নাকি নিঝুমকে বিয়ে করেছিস?

সাম্য ঘুম জড়ানো কন্ঠে বললো,ঠিক শুনেছিস।

কিহ্!তুই পাগল হয়েছিস।এমনটা কি করে করতে পারলি তুই।মারুফের কথা একটা বার মনে হলো না!
আমার যেটা সঠিক মনে হয়েছে করেছি।শুনলে বুঝতে পারবি।এতো চেতিস না।

চুপ কর তুই।নিঝুমকে বিয়ে করাটা তোর সঠিক মনে হয়েছে তাই না।ছি!তোকে বন্ধু বলতে লজ্জা হচ্ছে।

আরে, মাথা ঠান্ডা কর।

আজকের দিনটা ভুলে গেছিস তাইনা।মনে থাকবেই বা কেন বউয়ের আঁচলে তলায় ঢুকেছিস যে!গতরাতে তোর ফুলসজ্জা ছিলো সারারাত জেগে ছিলি নিশ্চয়ই। এখন আরাম করে ঘুমা,তোর মুখটা আর কোনদিন আমাকে দেখাবি না।
সাম্য নিরবে সব কথা শুনলো।শান্তা ফোন কেটে দিকে দিয়েছে।আজ পনেরো তারিখ!দ্রুত তাকে বের হতে হবে।
প্রতিদিনের মতো আজও সবাইকে নাস্তার টেবিলে আসতে হয়েছে। সবাই চুপচাপ খাচ্ছে। কোহিনূর বেগমের ইচ্ছে হচ্ছে টেবিলটাকে ভেঙে গুড়িয়ে দিতে।নিঝুমকে দেখলেই প্রচন্ড পরিমানে রাগ হচ্ছে অন্যদিকে নিঝুমের গলা দিয়ে খাবার নামছে না।চোখ তুলে কারো দিকে তাকাতে পারছে না যেন সে খুব বড় অপরাধ করে ফেলেছে। সাম্য বাইরে যাবার জন্য তৈরী হয়ে আসলো।নির্বিকার ভাবে নিঝুমের পাশের চেয়ারটা টেনে বসলো।নিঝুম একটু পর অনুভব করলো তার পা ব্যাথায় জ্বলে যাচ্ছে। সাম্যর জুতো তার পায়ের কনিষ্ঠ আঙুলে সজোড়ে চেপে আছে।

চলবে..

#ভালোবাসার রংমশাল
#পর্ব-১
#সিফাতী সাদিকা সিতু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here