#ভালোবাসার রংমশাল
#পর্ব-১৯
#সিফাতী সাদিকা সিতু
“তাড়াতাড়ি কাজ শেষ কর সবাই, ম্যাডাম এসে পরবে একটু পরেই।ইভেন্ট ম্যানেজম্যান্টের লোক গুলোকে তৈরী থাকতে বলো,সবকিছু যেন ঠিকঠাক হয়।মনে রেখ ম্যাডাম কিন্তু কাজের ব্যপারে একচুলও ছাড় দেন না।”
কথা গুলো এক নাগাড়ে বলে থামলেন ম্যানেজার করিম মোল্লা।
আজ “বুটিক ফ্যাশান হাউজ”এর অনেক বড় একটা ফ্যাশান শো অর্গানাইজ করা হয়েছে।চট্টগ্রামের এই নামি প্রতিষ্ঠানটি খুব দ্রুতই সাফল্য পেয়েছে। বিদেশেও প্রডাক্টের চাহিদা বাড়ছে।ইউনিক ডিজাইন নিয়ে কাজ করে এ প্রতিষ্ঠানটি।
লাল কার্পেটের সামনে গাড়ীটা এসে থামলো।প্রতিষ্ঠানের মালিক নেমে আসলেন। চারিদিক করতালির শব্দে মুখরিত হলো।
ম্যাডাম, সবকিছু রেড়ি আছে।আপনি শুধু একবার দেখে নেন পুরোটা?
আমাকে তো দেখতেই হবে।জানি আপনারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন, তবুও নিজেই দেখে নিতে চাই একটু।জানেন তো করিম সাহেব, প্রত্যেকটা কাজে যত্নশীল হওয়া প্রয়োজন।
জ্বী ম্যাডাম।
আপনাকে আমি কতবার বলেছি,আপা ডাকতে?
স্যরি ম্যাডাম,না মানে আপা।
হুম,চলুন।
ফ্যাশান শোয়ের হোস্ট অনুষ্ঠান শুরু করার জন্য মালিককে ডেকে নিলেন।ছন্দময় পা ফেলে এগিয়ে গেল “নিঝুম”।জোরে নিশ্বাস নিয়ে শুরু করলো কথা।
সুপ্তি চেঁচিয়ে ডাকলো নাজনীন বেগমকে,
মা, তাড়াতাড়ি আসো,আপু স্টেজে উঠেছে।
নাজনীন বেগম হাতের কাজ ফেলে ছুটে এলেন।নিঝুমের প্রতিটি সাফল্য তাকে গর্বিত করে।পুরোনো ক্ষত ভুলতে সাহায্য করে।নয়ত পাঁচ বছর আগের সেই দগদগে ক্ষত কখনোই ভোলার নয়।
দেখেছিস সুপ্তি,মেয়েটা আমার কত সুন্দর ভাবে কথা বলছে?আগে পারতো এমন ভাবে কথা বলতে?
আপু কি এভাবে কথা বলা কখনো শিখতে চেয়েছিল, মা?
সুপ্তির করা প্রশ্নে থমকে গেলেন নাজনীন বেগম। জবাব দিতে পারলেন না। শুধু চেয়ে থাকলেন টিভি স্ক্রীনের দিকে।
“শুধু নাজনীন বেগম নয়,বহুদূরে থাকা এক জোড়া চোখও চেয়ে আছে ফোনের স্ক্রিনে। চোখ জোড়ায় যেন হাজার ব্যাথা ঝরে পরছে।সেই সাথে কঠিন অভিমানও।”
***
“বাপি,মামনি বকা দিচ্ছে!”
ছেলের এমন কথায় ল্যাপটপ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে মাথা তুলে তাকালো আশফি।ইহানের মুখভার দেখে হেসে ফেললো।চট করে কোলে তুলে নিলো ছেলেকে।
“চলো, তোমার মামনিকে পানিশমেন্ট দেব আজ,আমার ইহান বাবুকে কেন বকা দেয়?”
ইহান হাত তালি দেয়।বাবার গলা জড়িয়ে ধরে ঝুলে থাকে।আশফি হেসে এগোয় কিচেনের দিকে।শান্তা আজ শাড়ী পরেছে।আঁচল কোমড়ে গুঁজে রান্না করছে।আজ তাদের হলিডে। হলিডেতে শান্তা চেষ্টা করে নিজে কিছু রান্না করার এবং সেটা দেশীয় পদ।বিদেশের মাটিতে থাকলেও নিজের দেশের খাবার গুলো একদম ভুলে থাকতে পারে না দুজনেই।
ইহান মায়ের চুল টেনে ধরে খিলখিল করে হেসে উঠলো।আশফি মুচকি হাসলো।
শান্তা চোখ পাঁকিয়ে তাকায় বাপ,ছেলের দিকে।
বাপি,মামনি রেগে গেছে,চলো পালাই।বাবার কানে ফিসফিসিয়ে বলে ইহান।
আশফি ছেলেকে ইশারায় চুপ করে থাকতে বললো।এরপর গম্ভীর কণ্ঠে বললো,”তুমি আমার ছেলেকে বকেছ কেন শান্তা?”
দুজনেই আমার বিচার করতে চলে এসেছেন তাই না। ঠিক আছে,বিরিয়ানি গুলো তাহলে আজ আমি একাই খাবো।আপনারা দুজনেই পাবেন না বলে রাখলাম।সাহস কত আমায় শাসন করে বাপ, বেটা মিলে!
ইহান,আশফি দুজনেই করুন চোখে তাকায় শান্তার দিকে।শান্তা দেখেও না দেখার ভান করে।
আশফি ভয়ে, ভয়ে বলে,”তাহলে কি বেড়াতে যাওয়ার প্লানটাও ক্যান্সেল?”
“নাহ্,ক্যান্সেল নয় তবে কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে।আমি একাই ঘুরতে বেরোবো। তোমাদের যাওয়া চলবে না।”
ইহান লাফ দিয়ে বাবার কোল থেকে নেমে গেল।শান্তার শাড়ী টেনে বললো,মামনি,আই এ্যাম ভেরি স্যরি?বাপির কাছে কখনে তোমার কথা বলবো না।আমায় নিয়ে চলে প্লিজ? আ’ম ওয়েটিং ফর লং ড্রাইভ!
শান্তা হাত দুটো ধুয়ে নিয়ে ছেলেকে কোলে তুললো।দুই গালে আদর দিয়ে বেসমেন্টের দিকে এগোলো, সেই সাথে আশফিকে হুকুম করে গেল সালাদ কাঁটতে।
আশফি নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।মা,ছেলে এক জোট হয়ে তাকেই এভাবে চিপায় ফেলবে বুঝতেই পারেনি।ছেলের ওপর রাগ হলো।ত্যাদড় ছেলে একটা তার,বাবাকেই কেস খাওয়ায়!
নিঝুমের ফিরতে অনেকটা দেরি হয়ে গেল।নাজনীন বেগম প্রতিদিন খাবার নিয়ে বসে থাকেন।নিঝুম অনেক বার মানা করেছে তবুও কথা শোনেননি তিনি।নিঝুম ফ্রেশ হয়ে এসে টেবিলে বসলো।নাজনীন খাবার বেড়ে দিলেন।
“তুমি খেয়েছ মামনি?”
“হ্যাঁ,সুপ্তির সাথে খেয়েছি।”
“তাহলে ঘুমিয়ে পরতে?তোমার কিন্তু নিজের শরীরের প্রতি কোনো খেয়াল নেই।”
“তুই এতো ভাবিস কেন?আমি ঠিক আছি তো।”
“সেটা তো দেখতেই পাচ্ছি। নিঝুম খাবার রেখে উঠে গেল।ফ্রিজ থেকে কিছু ফল বের করে কেটে নিয়ে এসে নাজনীনের সামনে রেখে আবার খাওয়া শুরু করলো।”
নাজনীন বেগম হাসেন।নিঝুমকে পেটে না ধরেও যে নিঝুমের মতো মেয়ের মা হতে পেরেছেন এটা তার সৌভাগ্য, তিনি মনে করেন।
“মামনি, সুপ্তির বিয়ে নিয়ে কিছু ভাবলে?”
“বড় বোনকে রেখে, ছোট বোনের বিয়ে দিতে নেই।”
“মামনি!তুমি কি বলছো এসব?আমি বিবাহিত সেটা তোমার থেকে ভালো কেউ জানে না।”
“জানতে চাইনা আমি। সব ভুলে যেতে চাই।স্বামী নেই,সংসার নেই তুই নিজেকে কি করে বিবাহিত ভাবিস?তোর জীবন কেন থেমে থাকবে? পাঁচ বছর আগের বিয়েটার কোনো মানে নেই আমার কাছে।উকিল নোটিস পাওয়ার পরেও তুই নিজেকে বোঝাতে পারছিস না কেন?কার আশায় বসে আছিস তুই?ভালো ভাবেই জানিস সে কখনো আসবে না।
মামনি!
বল, আমি মিথ্যা বলছি?নিজেকে একই গন্ডির মাঝে আঁটকে রাখলেই সত্যি গুলো মিথ্যা হয়ে যায় না, নিঝুম!
নিঝুম অসহায় হয়ে তাকিয়ে রইলো নাজনীন বেগমের দিকে।জীবনের রং গুলো এভাবে ফ্যাকাশে হয়ে গেল কেন?তার নাহয় কপালে সুখ নেই কিন্তু মামনির জীবনটাও কেন রংহীন হয়ে গেল?
আশফিরা নায়াগ্রার জলপ্রপাতে এসেছে।কানাডার এই স্থানটা হানিমুন গন্তব্য হিসেবে বেশি পরিচিত।শান্তা ইহানের হাত ধরে হাঁটছে একপাশে।আশফি একটু দূরে ওদের থেকে।শান্তা হাত বাড়িয়ে ডাকলো তাকে।আশফি একটু এগোতেই ধাক্কা লেগে তার সাথে একজনের।
“স্যরি!” বলতেই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো আশফি, সামনের মানুষটার দিকে।যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না এই মানুষটাকে বিদেশের মাটিতে কখনো দেখতে পারবে!
সাম্য হেসে হাত বাড়িয়ে দিলো, হ্যান্ডশেকের জন্য।
আশফি নিজেকে ধাতস্থ করে নিলো।বললো,কেমন আছেন?
ভালো আছি!সাম্যও বেশ অবাক হয়েছে।
আপনি কি করে এখানে,হানিমুনে এসেছেন নাকি?
সাম্যর মুখের হাসি বিলীন হয়ে গেল।বললো, নাহ্,হলিডেতে ঘুরতে এসেছি বন্ধুদের সাথে।
ওহ্ মাই গড!আপনি কানাডায় সেটেল্ড নাকি?
হ্যাঁ,মনে হচ্ছে আপনিও তাই!
আমরা পাঁচ বছর হলো এসেছি বাংলাদেশ থেকে।
শান্তা আশফিকে এভাবে দাঁড়িয়ে কথা বলতে দেখে নিজেই এগিয়ে এলো।
তোমায় ডাকছি শুনতে পাচ্ছো না?
চেনা মেয়েলি কন্ঠে সাম্য ঘুরে তাকালো।শান্তাও স্থির হয়ে গেল।সাম্যর চোখেও বিস্ময়!
তুই, এখানে?শান্তা কোনোরকমে কথাটা উচ্চারণ করলো!
আশফি অবাক হয়ে বললো,হেই,তোমরা দুজন, দুজনকে চেনো নাকি?
সাম্য হেসে বললো,শান্তা আমার ক্লোজ ফ্রেন্ড ছিল।
শান্তার চোখ ছলছল করে উঠলো।সাম্যকে এতোদিন পর দেখে খুশিতে কাঁদতে ইচ্ছে করছে।কিন্তু, সাম্য এখানে কেন?
সাম্য ইহানের দিকে তাকিয়ে একবার শান্তা, একবার আশফির দিকে তাকালো।ওদের চাহনীতে বুঝে গেল ইহান কে?সাম্য শান্তার মাথায় হালকা চড় মেরে বললো,তোর মতো তারছেঁড়া মেয়েটা মা হয়ে গেল!সে ইহানকে কোলে তুলে নিলো।ইহান শুধু অবাক চোখে সাম্যকে দেখছে?
হোয়াট’স ইওর নেম, বাবাই?
ইহান আহমেদ।
নাইস নেম।
আশফি কৌতুহল চেপে রাখতে না পেরে বললো,আপনার ওয়াইফ কোথায়, সাম্য?
আশফির কথায় শান্তাও জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো সাম্যর দিকে।সাম্যর চোখেমুখে করুন বেদনা ফুটে উঠলো।যা আশফি,শান্তা দুজনেই লক্ষ্য করলো।
***
সুপ্তি ভার্সিটিতে এসে রিহানের দেখা পেল না।রিহান সুপ্তির বেস্ট ফ্রেন্ড। গতকাল ক্লাসের নোট গুলো নিতে হবে তাকে।অথচ রিহানের দেখা নাই।সুপ্তির রাগ উঠে গেল। কয়েকজন ক্লাসমেটের কাছে জানতে চাইলো রিহান কোথায়?কেউ ঠিকভাবে বলতে পারলো না।
সুপ্তি বাধ্য হয়ে বাসায় ফেরার জন্য বের হলো।রিকশা নিয়ে উঠে পরলো।কিন্তু চলার আগেই কোথা থেকে রিহান দৌড়ে এসে রিকশায় বসে পরলো।সুপ্তির দিকে তাকিয়ে ফিচলে হাসি দিয়ে বললো,তুই নাকি আমারে খুঁজতাছিস?
সুপ্তি কোনো কথা বললো না।এমন ভাব করলো সে যেন রিহানকে চেনেই না।
হইছে, এতো ভাব দেখান লাগবো না?এই নে তোর খাতা।
সুপ্তি খাতাটা হাতে নিয়ে দুমদাম রিহানের মাথায় মারলে।চেঁচিয়ে বলে উঠলো,তুই নিজেকে কি মনে করিস? তোর জন্য আমার ঠেকা?তোরে খুঁজতে, খুঁজতে পা ব্যাথা হয়ে গেছে আমার।
তুই নিজেকে কি মনে করিস,নবাব নন্দিনী? তোর জন্য আমি সব কাজ ফেলে, তোর জন্য দাঁড়িয়ে থাকবো?নিজে ক্লাস করবে না, দোষ হবে আমার!
সুপ্তি রেগে তাকালে রিহান থেমে গেল।বিড়বিড়িয়ে বললো,এভাবে তাকাস না সুপ্তি,আমার হার্টঅ্যাটাক হয়ে যাবে।
কি বললি তুই,জোরে বল?নিশ্চয়ই আমায় গালি দিচ্ছিস?
রিহান কিছু বলার আগেই, সুপ্তি রিহানকে চেঁপে ধরলো।এ্যাই আমায় ঢেকে রাখ,আপুর গাড়ী সামনে,দেখে ফেললে উল্টাপাল্টা কিছু ভেবে বসবে?
রিহান চোখবুঁজে ফেললো।সুপ্তি তাকে চেঁপে ধরেছে।তার সমস্ত শরীরে শিহরণ জাগছে।সুপ্তিকে ঠেলে দিলো দূরে সরানোর জন্য।কিন্তু সুপ্তি তার বাহুতে জোরে চিমটি কেটে দিয়ে বুঝিয়ে দিল নড়াচড়া না করতে।
নাজনীন বেগম ছবির অ্যালবাম হাতে বসে আছেন।নিরবে চোখের জল ঝরছে।কিছুতেই ভুলতে পারেন না সেই রক্তাক্ত লাশ। সাদা কাপড় কেমন লাল হয়ে উঠেছিল।ঠিক যেন নববধূর লাল বেনারশি!স্বামীকে হারানোর শোকে বাকহীন পরেছিলেন।কেউ জানতো না এমন দূর্যোগ ঘটে যাবে সুখী পরিবারটায়।এক লহমায় সবকিছু শেষ হয়ে যাবে।জীবনের সমস্ত রং নিয়ে গেছে সাদা কাফনের কাপড়।শুধু সেখানেই সীমাবদ্ধ থাকলেও হয়ত চলতো।কিন্তু কোহিনূর বেগমের রোষানলে পরে আজ এই অবস্থায় এসে দাঁড়াতে হবে এতটা কল্পনাও করেননি কখনো।এক ভাই মৃত অন্য ভাই পুঙ্গ! সংসারের সমস্ত জোড় ছিঁড়ে গেছে সেদিনেই।
পাঁচ বছর আগের সেই দিনটায় নাজনীন বেগম ছিলেন অসহায়।আজ সবকিছু নতুন করে তৈরী হলেও পুরোনো ভালোবাসা,সংসার, আপনজন গুলো কখনো ফিরে পাবেন না।অবশ্য আল্লাহ তাকে নিঝুমের মতে একটা মেয়ে দিয়েছেন।ঠিক ছোট বেলায় নিঝুমকে যেমন ভাবে নিজের কাছে আগলে রেখেছেন, নিঝুমও তার খারাপ সময় তাকে শক্ত বাঁধানো বেঁধে রেখেছে।
খারাপ সময় গুলো খুব দ্রুত কেটে গেছে।সেটাও তার মৃত স্বামীর বিচক্ষনতার জন্য!
চলবে…