ভালোবাসার রংমহল পর্ব -০৫

#ভালোবাসার_রংমহল
#জাহানারা_রিমা
পর্বঃ ৫

কুহু আর প্রিয়ম দুজন চুপচাপ বসে আছে। কারো মুখে কোন কথা নেই। নিস্তব্ধতাই যেন আজ ওদের ভেতরকার সব না বলা অনুভূতিগুলো ব্যক্ত করে দিচ্ছে। ওদের ঘোর ভাঙে নিচ থেকে কারো উঁচুস্বরে কথা বলার আওয়াজ শুনে। কারণ এ বাসায় কেউই উঁচু আওয়াজে কথা বলেনা। চটজলদি নিচে নেমে এলো ওরা।
কুহুর খালামনি রেশমা এসেছেন। মহিলা এসেই হুলস্থুল কাণ্ড বাধিয়েছেন। ড্রয়িংরুমে বসে তখন দীপ্তি আর রাফসান সাহেব টুকটাক কথাবার্তা বলছিলেন কুহু আর প্রিয়মের বিয়ের ব্যাপারে। অমন সময়েই এই মহিলার আগমন।
“আপনাদের মতো লোভী মানুষ তো আমি আর দুটো দেখিনি। কুহুর নামে ওর বাবা মায়ের রেখে যাওয়া সম্পত্তি হাতাতেই তো নিজের ছেলের সাথে ওর বিয়ে দিতে চাইছেন, তাইনা? আমরা কিছু বুঝিনা ভেবেছেন! আপনারা তো দেখি বহুত চালাক। ভাবলেন এক ঢিলে দুইপাখি মারা যাবে, রাজ্য আর রাজকন্যা দুটোই আপনাদের দখলে থাকবে। কিন্তু এই রেশমা বেঁচে থাকতে সেটা কোনদিন হবেনা।”
কুহু নিচে নেমে ওর খালামনি রেশমাকে দেখে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওর বাবা, মা মারা যাওয়ার পর এই প্রথম মহিলা দেশে এসেছেন। কিন্তু দেশে এসেই এখানে কেন এসেছেন সেটাই ওর বোধগম্য হচ্ছেনা। এতগুলো দিনে কখনো ওর খোঁজটাও রাখেননি তারা। তবে রেশমার বলা কথাটা শুনে কুহু যেন নিজের বাকশক্তিই হারিয়ে ফেলেছে। এতগুলো বছর যে নিজের বোনের মেয়েটা বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে সেই খোঁজটা রাখার প্রয়োজন মনে করেনি। সে আজ কোন মুখে এসেছে অন্য কারোর উপর আঙ্গুল তুলতে।
কুহু ওর খালামনিকে থামিয়ে বলে, “খালামনি, তুমি এসব কি উল্টাপাল্টা বলছো?”
রেশমি কুহুকে দেখে বিগলিত স্বরে বললেন, “আমার মা-টাকে আজ কতদিন পর দেখলাম। তুই ভাবিস না কুহু। এদের উদ্দেশ্য আমি কোনদিন সফল হতে দেবোনা। তোকে আমি আমার সাথে নিয়ে যাবো।” কুহুর গালে হাত রেখে কথাটা বলতেই কুহু সাথে সাথেই ওর গালের উপর থেকে হাতটা সরিয়ে নিলো। রেশমা আবারো কুহুকে ধরতে আসলেই কুহু দূরে সরে দাঁড়িয়ে বলে, “একদম আমাকে ধরতে আসবেনা। এতদিন তোমার এই দরদ কোথায় ছিলো? যখন বাবা মাকে হারিয়ে আমি এতিম হয়ে গিয়েছিলাম, তখন কোথায় ছিলে তুমি? কাছেদূরের কম আত্মীয় স্বজন তো ছিলোনা আমার। কই কেউতো একটাবারের জন্যেও আমার খোঁজ রাখেনি। অথচ যেই মানুষদুটো আমাকে এতগুলো বছর নিজেদের সবটুকো দিয়ে আমার পাশে ছিলো আমাকে আগলে আগলে রেখেছে আজ তুমি তাদের দিকে আঙ্গুল তুলছো? তাদেরকে অপমান করার অধিকার তোমাকে কে দিয়েছে। আন্সার মি?”
শেষের কথাটা চেঁচিয়েই বলে কুহু। নিজের বড়বাবা আর মামনির অপমান ও কিছুতেই মেনে নিতে পারছেনা। কুহুর এমন আচরণে খানিকটা ভড়কে যায় রেশমা। তাও মনে সাহস নিয়ে কুহুকে বোঝাতে যায়। একবার বুঝিয়ে শুনিয়ে সাথে নিয়ে যেতে পারলেই আর কোনো চিন্তা নেই। বাকিটা জীবন বসে বসেই খেতে পারবেন। এমনিতেই নিজেদের ব্যবসায় বিরাট লস খেয়ে পথে বসার উপক্রম। কে জানতো এই মেয়ের নামে এতকিছু আছে তাহলে হয়তো কয়েকবছর কষ্টেসৃষ্টে নিজেদের কাছে রেখে সবটা হাতিয়ে নিতে পারতেন।
কুহু আবার বলল, “আচ্ছা, আমি বলছি খালামনি তুমি এখানে কেন এসেছো। তোমাকে আর কষ্ট করে বলতে হবেনা। আসলে আমার বাবা আমার নামে কিছু জমি কিনে রেখেছিলো তখনকার বাজারে সেগুলোর দাম খুব বেশি না হলেও এখন এগুলোর দাম প্রায় আকাশছোঁয়া। এখন কোনভাবে সেটা জানতে পেরেছো আর আমার আঠারো বছরও পূর্ণ হয়ে গেছে এখন আমি চাইলেই সেগুলো কাউকে হ্যান্ডওভার করতে পারবো। সেই লোভেই আজ তুমি এখানে এসেছো। কি ঠিক বলছি তো?”
রেশমা বেগম আমতাআমতা করে বললেন, “এসব তুই কি বলছিস কুহু? আমি তোর খালামনি হই।”
কুহু হাসলো। বলল, “ওহ আচ্ছা তুমিতো আমার খালামনি হও। সরি আমিতো ভুলেই গিয়েছিলাম। আচ্ছা বলো তো, খালামনি হওয়ার ঠিক কোন দায়িত্বটা তুমি পালন করেছো?”
রেশমা আর জবাব দেওয়ার মতো কিছু খুঁজে পেলেন না।
কুহু বলল, “নিজেরা এখন পথে বসেছো বলে আমার কথা মনে পড়লো, তাইনা? এতগুলো বছর তোমরা আমার কোন খোঁজ না রাখলেও আমার কাছে তোমাদের সব খবরাখবরই ছিলো।” কুহু ওর বড়বাবার কাছে গিয়ে বলল, “এই মানুষটা আমাকে আমার সব আত্মীয় পরিজনদের খোঁজ এনে দিতো। এসব করার কিন্তু কোনো প্রয়োজন ছিলোনা। তাও তিনি করেছেন। কারণ এটাকে উনি নিজের দায়িত্ব মনে করতেন।”
রেশমা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কুহু দরজার দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বলল, “আর কখনো এ বাড়িতে আসবেনা। এই মানুষগুলোকে নিয়ে আমি খুব ভালো আছি। প্লিজ এই সুখটুকু আমার থেকে কেড়ে নিতে আর কখনো এখানে এসোনা।”
দীপ্তি এসে থামাতে চাইলেন কুহুকে। কুহু শুনলোনা কারো কথা। নীলিমা আজ বড্ড অবাক হয়েছেন কুহুর প্রতিবাদ দেখে। আজ তারও মনে হচ্ছে তার ভাই ভাবী কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নেননি। আজ মন থেকেই দোয়া করলেন কুহুকে।

_________________
আজ সকাল থেকেই মাইশা মুখ ভার করে আছে। মাইশাকে মনমরা বসে থাকতে দেখে প্রিয়ম বলল, “কিরে আপু মুখটাকে এরকম বাংলার পাঁচ করে রেখেছিস কেন?”
রাফসান সাহেব পত্রিকায় চোখ বুলাচ্ছিলেন। প্রিয়মের কথাশুনে মেয়ের দিকে চোখ তুলে তাকালেন। কোন কারণে মেয়ের মন খারাপ বুঝতে পেরে ওকে নিজের কাছে ডাকলেন। মাইশা এসে বসতেই তিনি মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে জানতে চাইলেন, “কি হয়েছে?”
মাইশা কিছু না বলে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করে। নাদিম বলল, “আসলে বাবা। আমাদের যাওয়ার টিকেট কনফার্ম হয়ে গেছে। আর এক সপ্তাহ পরেই চলে যেতে হবে। যখন থেকে এটা জেনেছে তখন থেকেই মন খারাপ করে বসে আছে। কাল রাত থেকেই কান্নাকাটি করছে।
নাদিমের কথায় ফুঁসে উঠলো মাইশা। নাক টানতে টানতে বলল, “তুমি বুঝবে কি? আমার একটামাত্র ভাই তার বিয়েতেও তো আমি থাকতে পারবোনা।”
রাফসান সাহেব সমস্যার সমাধান করে দিলেন। প্রিয়ম আর কুহুর বিয়ের তারিখ ঠিক হয়েছিলো একমাস পর। এখন ঠিক হলো পাঁচদিন পরেই বিয়ে হবে। মাইশা কান্না ভুলে গেলো। চোখ মুছে বলল, “সত্যি!”
প্রিয়ম হেসে বলল, “তোকে কে বলবে তুই এক বাচ্চার মা? নিজের বাচ্চামোই তো এখনো গেলোনা তোর।”
মাইশা মুখ ভেঙচি কাটলো।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here