ভালোবাসি প্রিয় ২ পর্ব -১২

#ভালোবাসি_প্রিয়_২ (১২)

#লেখিকা_অপরাজিতা_রহমান

-“সময় বহমান।সময় তার আপন গতিতে ব‌ইতে থাকে।দেখতে দেখতে শীতের দরজায় বসন্ত এসে কড়া নাড়ছে। প্রকৃতি যখন তার দক্ষিন দুয়ার খুলে দেয়,ব‌ইতে শুরু করে দক্ষিণ হাওয়া, মধুর অমৃত বাণী শোনা যায় কোকিলের কণ্ঠে, রঙের উচ্ছ্বাস জাগে অশোক পলাশ শিমুলে, বেড়িয়ে আসে শীতের খোলসে ঢুকে থাকা কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া,আর এসব ফুলে ফুলে ভ্রমর করে খেলা। তখনই যেন প্রবল বিক্রমে আগমন ঘটে রাজাধিরাজের ,ঋতুরাজ বসন্তের।আর তাকে স্বাগত জানাতে প্রকৃতি নেয় এক বর্ণিল সাজ।গাছে গাছে নতুন পাতা নতুন ফুলের সমারোহ। অবশ্য ফুল যদি নাও ফোটে বসন্তের আগমনধ্বনি কে কোনোভাবেই চাপা দেওয়া যায় না।কারণ কবি যে বলেই দিয়েছেন “ফুল ফুটুক আর নাই ফুটুক আজ বসন্ত।”
-“হ্যাঁ আজ বসন্ত। প্রতিবছর নাকি এই দিনে ভার্সিটি তে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।এ বছর ও তার ব্যতিক্রম হয় নি। বসন্ত উৎসব কে কেন্দ্র করে এবার ও ভার্সিটি তে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। পুরো ভার্সিটি সেজে উঠেছে নতুন সাজে।সেই সাথে সেজেছে ভার্সিটির সকল ছাত্র-ছাত্রীরা।আজ তাদের সাজসজ্জায় বাঙালি সাজের কিছু চিরচেনা বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে যা বসন্তের অন্যতম অংশ।এসব বৈশিষ্ট্যের মধ্যে রয়েছে মেয়েদের বাসন্তি রঙের শাড়ি,চোখে গাড়ো কাজল ,হাতে রেশমি চুড়ি, কপালে কালো টিপ আর খোঁপায় গোঁজা রঙ্গিন ফুলের মালা।আর ছেলেরা সেজেছে হলুদ পাঞ্জাবি তে।সেই সাথে রয়েছে গ্ৰাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী পিঠা পুলি উৎসব।সব মিলিয়ে ভার্সিটি তে একটা উৎসব মুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।”

-“দোয়া ভার্সিটি তে প্রবেশ করার সাথে সাথে সব ছাত্র ছাত্রীরা তাকে দেখে হাসাহাসি শুরু করেছে ।কারন দোয়া অন্যদের মতো শাড়ি, চুড়ি পরে আসে নি।সে প্রতিদিনের মতো আজ ও বোরকা পরিধান করে এসেছে।দোয়া কে দেখে ইংলিশ আপা বললো,হ্যাভ ইউ গন ম্যাড দোয়া? তোমাকে আমরা সবাই বারবার করে বললাম, শাড়ি বা থ্রি পিস পরে আসবে । কিন্তু তুমি আজ ও সেই গাইয়া ভুত সেজেই আসলে।একটা দিনের‌ই তো ব্যাপার।একদিন বোরকা ছাড়া আসলে কি এমন ক্ষতি হতো তোমার? আমাদের কথার কোন মূল্য নেই তোমার কাছে দোয়া? আমার মনে হয় কি জানো? তুমি এখনো আমাকে ক্ষমা করতে পারো নি। আমি তোমাকে বোন বলে মেনে নিলেও তুমি আমাকে বোন বলে মানতে পারো নি দোয়া।যদি মানতে তাহলে এই বোনের আবদার টুকু রাখতে।”

-“দোয়া কিছু বলার আগেই পাশ থেকে একটা মেয়ে বলে উঠলো, এই গাইয়া মেয়ের কথা বাদ দাও তো বিন্দু। আমার মনে হয় মেয়েটা কালো কুচকুচে একদম পাতিলের তলার মতো কালো।তাই তো নিজেকে সবসময় এমন কালো বোরকা দিয়ে আড়াল করে রাখে।যাতে ওর এই কালো কুৎসিত চেহারা কারোর সামনে প্রকাশ না পায়।”

-” সাট আপ তুলি। দোয়ার সম্পর্কে আর একটাও বাজে কথা বলবে না তুমি। ইনফ্যাক্ট বলার রাইট ও নেই তোমার। তুমি যে ওকে কালো বলে অপমান করছো, নিজেকে কখনো আয়নায় দেখেছো?নিজে তো আটা ময়দা সুন্দরী।”

-“বাহ্ বিন্দু মাহতাব! এইভাবে নিজের অপমানের কথা ভুলে গেলে?এই মেয়েটা সবার সামনে কিভাবে তোমাকে অপমান করেছিল মনে নেই তোমার? এজন্যই তো বলে ,যার জন্য করলাম চুরি , সেই বলে চোর।”

-“সব‌ই মনে আছে আমার। ভুল আমার ছিলো দোয়ার নয়। দোয়া আমাকে চোখে আঙুল দিয়ে আমার ভুল শুধরে দিয়েছে। দোয়ার প্রতি কোন অভিযোগ নেই আমার। দোয়া তুমি বরং উপরে গিয়ে বিশ্রাম নাও । কিছুক্ষণ পরে তোমাকে ও স্টেজে ডাকা হবে।”

-“আসলে ইংলিশ আপা আমি সিমরানের জন্য অপেক্ষা করছি। এক্ষুনি সিমরান এসে পরবে। সিমরান এলে তারপর যাবো।”

-“ঠিক আছে।আসছি আমি ।বাই‌ ,সি ইউ লেটার।”

-“ইংলিশ আপা যেতেই দোয়া আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করতে লাগলো।কি যে হবে আজকে ভাবতেই দোয়ায় গায়ে কাঁ”টা দিচ্ছে। দোয়া অসুস্থ থাকায় এক দিন ভার্সিটি তে অনুপস্থিত ছিল।সেই সুযোগে দোয়ার অজান্তেই কেউ নাচে দোয়ার নাম লিখিয়েছে।কিন্তু দোয়া ম”রে গেলেও নাচবে না। দোয়া শিওর বৃত্ত ছাড়া এই কাজ কেউ করে নি।”

-“এক এক সপ্তাহ আগে দোয়া ক্লাসে রয়েছে এমন সময় বৃত্ত , বিন্দুসহ আরো কিছু সিনিয়ররা ক্লাসে প্রবেশ করলো।বৃত্ত সবার উদ্দেশ্যে বললো,হ্যালো গাইজ, ইতিমধ্যে হয়তো তোমরা সবাই জেনে গিয়েছো আমাদের ভার্সিটি তে বসন্ত উৎসব কে কেন্দ্র করে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। ইতিমধ্যে অনেকেই নাম লেখিয়েছে।আমরা গতকাল যারা যারা অনুষ্ঠানে নাচ গান করবে তাদের নাম কালেক্ট করেছি। গতকাল অনেকেই উপস্থিত ছিলে না।তাই তোমাদের মধ্যে যারা যারা নাচ গান দিতে ইচ্ছুক কাইন্ডলি নাম বলো।”

-“বৃত্তের কথা শুনে মিম নামের একটা মেয়ে বলো উঠলো ,ভাইয়া ফার্স্ট ইয়ার থেকে কারা কারা নাম দিয়েছে একটু বলবেন প্লিজ?”

-“‌শিওর।বৃত্ত একটা শিট বের করে একে একে সবার নাম বলতে লাগলো।আর সবার শেষে যা বললো তা‌ শোনার জন্য দোয়া মোটেও প্রস্তুত ছিলো না।”

-“বৃত্ত বললো মাইশাতুল দোয়া নাচে নাম লিখিয়েছে। বৃত্তের কথা শুনে মূহুর্তের মধ্যে ক্লাসরুমে হাসির রোল পরে গেল। মেয়েরা বলাবলি করছে,এই গাইয়া মেয়ে নাকি ড্যান্স করবে?ড্যান্স করার জন্য নাম ও লিখিয়েছে।নাইস জোক্সস অফ দ্যা ইয়ার।পাশ থেকে রকি নামের একটা ছেলে বললো,ভালোই তো হয়েছে। আমি নাচের জন্য আমার পার্টনার খুঁজে পাচ্ছিলাম না।এখন দোয়া হবে আমার ড্যান্স পার্টনার‌, আমার নায়িকা।কি দোয়া আমার নায়িকা হবে তো? তুমি বোরকা পরবে আর আমি পরবো শার্ট আর লুঙ্গি। তারপর আমরা দুইজনে ” এই পথে যখন আমি যাই মাঝে মাঝে একটা মেয়ে দেখতে পাই,আলতা রাঙা পায় আবার নূপুর পরেছে একটা বোরকা পরা মেয়ে পাগল করেছে, একটা বোরকা পরা মেয়ে পাগল করেছে”এই গানে নাচ করবো । দারুন হবে কিন্তু ব্যাপার টা বলেই আবার ও হাসাহাসি শুরু করে দিলো।”

-“স্টপ দিস।দোয়া না কারো সাথে ড্যান্স করবে আর না কারোর নায়িকা হবে।ও যেহেতু একক নৃত্যে নাম লেখিয়েছে সেহেতু ও একাই নাচবে।”

-“গতকাল তো আমি ভার্সিটি তে আসি নি।তাহলে আমি কিভাবে নাচে নাম লেখালাম?”

-“সেইটা আমি কিভাবে বলবো? তুমি যদি তোমার নাম না দাও নিশ্চয় ভুতে এসে তোমার নাম দিয়ে যায় নি?”

-“দোয়া আর কোন কথা বাড়িয়ে প্রিন্সিপাল স্যারের রুমে গেল। কিন্তু স্যারের রুমে গিয়ে জানতে পারলো প্রিন্সিপাল স্যার নাকি আরো এক ঘন্টা আগে ভার্সিটি থেকে বেড়িয়ে গেছেন। দোয়া প্রিন্সিপাল স্যারের রুম থেকে বেরিয়ে দেখে বারান্দায় বৃত্ত দাঁড়িয়ে রয়েছে। দোয়া বৃত্ত কে দেখেও না দেখার ভান করে বৃত্ত কে ক্রস করে যাওয়ার আগেই বৃত্ত দোয়া কে ল্যাং মে”রে দেয়।যার ফলস্বরূপ বারান্দার কর্নারে রাখা ফুলের টবের সাথে লেগে‌ দোয়ার মাথা অনেক টা কে”টে হিজাব ভেদ‌ করে র”ক্ত বেরিয়ে আসে।দোয়া আঘাত লাগা স্থানে হাত দিয়ে দেখে হাতে র”ক্ত।র”ক্ত দেখে বৃত্তের প্রতি ঘৃণা আগের তুলনায় শতগুণ বেড়ে যায়।”

-“ব্যাথায় দোয়ার চোখেমুখের প্রতিক্রিয়া দেখে বৃত্ত বললো, ইস্ খুব লেগেছে বুঝি? আমার ও এমন ব্যাথা লেগেছিল যখন তুই সবার সামনে আমাকে থা”প্প”ড় দিয়েছিলি,যখন তোর জন্য প্রিন্সিপাল স্যার আমাকে অপমান করেছিল , পুলিশে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিল। তুই কি ভেবেছিলি আমি এতো দিনে সব ভুলে গিয়েছি।নো মিস দেড় ফুট। আমি চুপ ছিলাম এজন্যই যাতে সবাই মনে করে তোর আর আমার শত্রুতা শেষ হয়ে গিয়েছে।আমি তোর কোন ক্ষতি করলেও যাতে আমাকে কেউ সন্দেহ করতে না পারে।”

-“কথায় আছে, নূন আর চিনি দেখতে এক‌ই রকম হলেও পার্থক্য শুধু স্বাদে। তেমনি মানুষ আর অমানুষ দেখতে এক‌ই হলে তাদের পার্থক্য শুধু ব্যবহারে। অর্থাৎ ব্যবহার দ্বারা অমানুষ চেনে যায়। একটা মানুষ কতোটা খারাপ হতে পারে আপনাকে না দেখলে হয়তো বুঝতেই পারতাম না।এই মুহূর্তে আমার মনে হচ্ছে আপনার মতো অমানুষের মুখে থুথু ছুড়ে দেই। কিন্তু আমি এইটা করবো না।কারন কি জানেন?তাহলে যে মানুষ আর অমানুষের মধ্যে কোন পার্থক্য থাকবে না।এখন আমি বুঝতে পারছি আমার ধারণা সঠিক। নাচে আমার নাম আপনি লিখিয়েছেন। কিন্তু কেন?”আমি তো আপনাকে বলি নি আমি নাচে নাম দিতে চাই।তাহলে আপনি কেন আমার নাম দিলেন?”

-“ইউ আর রাইট মিস দেড় ফুট। প্রথমে ভেবেছিলাম তোর শুধু তেজ বেশি। কিন্তু এখন তো দেখছি তোর চিন্তা শক্তি ও অনেক প্রখর। হ্যাঁ আমি তোর নাম লিখিয়েছি। আমি জানতাম তুই ম”রে যেতে রাজি হলেও নাচতে রাজি হবি না।তাই তো ইচ্ছে করেই নাম দিয়েছি।”

-“নাচে আমার নাম লিখিয়েছেন তো কি হয়েছে? আমি প্রিন্সিপাল স্যার কে বলে নাচ থেকে আমার নাম কে”টে দিবো।”

-“হা‌ হা হা হা। প্রিন্সিপাল স্যার অনুষ্ঠানের সম্পূর্ণ দায়িত্ব আমাকে দিয়েছেন। তাছাড়া স্যার আজকে দেশের বাইরে যাচ্ছেন। ফিরতে ফিরতে চার থেকে পাঁচ দিন লেগে ‌যাবে। হয়তোবা অনুষ্ঠানের দিন ও আসতে পারে। তাহলে এখন তোমার কি হবে মিস দেড় ফুট।নাচতে তো তোমাকে হবেই।”

-“আমি ম”রে গেলেও নাচবো না।”

-“আমি তো তোমাকে ম”র”তে বলছি না মিস দেড় ফুট। তুমি বরং এই ভার্সিটি থেকে চলে যাও। তোমাদের গ্ৰামের কোন কলেজে গিয়ে ভর্তি হ‌ও।সেইটা তোমার জন্য ভালো হবে।এই ভার্সিটি তোমার জন্য নয় মিস দেড় ফুট।”

-“আমি কি করবো কি করবো না সেইটা নিশ্চয় আপনার থেকে জেনে নিবো না। শুধু মাত্র অনুষ্ঠানে নাচ ,গান না করাটা যদি আমার ভার্সিটি থেকে চলে যাওয়ার কারন হয় ,তাহলে আমি বলবো আমি কোথাও যাচ্ছি না। হ্যাঁ নাচ গানের অনুষ্ঠানে আমি ও অংশগ্রহণ করবো।তবে নাচবো না গাইবো সেইটা একান্তই আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার।সেইটা অনুষ্ঠানের ‌দিন‌ই দেখতে পারবেন।একটা কথা রাখবেন মিস্টার আশিয়ান আবরার বৃত্ত দোয়া কখনো অন্যায়ের কাছে মাথা নত করে নি,আর ভবিষ্যতে করবে ও না।তবে আজ আপনি বিনা কারনে আমাকে আঘাত করে যে অন্যায় টা করলেন এর জন্য আপনার নিজেকেই পস্তাতে হবে।কারন আল্লাহ ছাড় দেন ছেড়ে দেন না।মাইন্ড ইট।

চলবে ইনশাআল্লাহ।।।
ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here