#ভালোবাসি_বলেই_তোমাকে_প্রয়োজন
লেখক-এ রহমান
পর্ব ৬
–আমি ঠিক আছি। ছেড়ে দিন আমাকে।
সারিয়ার রাশভারী কণ্ঠ শুনে সীমান্ত নিজেকে সামলে নিলো। মুহূর্তেই ছেড়ে দিয়ে ঠিক হয়ে দাঁড়ালো। মিইয়ে যাওয়া কণ্ঠে বলল
–সরি। আমি না ধরলে আপনি পড়ে যেতেন।
সারিয়া তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। সীমান্তর ভাবভঙ্গি বুঝতে তার একটুও কষ্ট হল না। সীমান্ত না ধরলেও সারিয়া পাশের গাছ ধরে নিজেকে সামলে নিতে পারতো। তাই আগ বাড়িয়ে এভাবে তার সাহায্য করার ব্যাপারটা বেশ বাড়াবাড়ি মনে হল সারিয়ার। গম্ভীর গলায় বলল
–আপনি না ধরলেও আমি পড়ে জেতাম না। নিজেকে সামলে নেয়ার মতো যথেষ্ট ক্ষমতা আমার আছে। আপনাকে এতো ভাবতে হবে না।
কথা শেষ করেই পিছন ফিরে হাঁটা শুরু করে দিলো। হাঁটতে হাঁটতেই বলল
–আমি আমার রুমে যাচ্ছি। ঘুমাব।
সীমান্তর চেহারা গম্ভীর হয়ে গেলো। সারিয়ার করা চাপা অপমানটা তীব্র ভাবেই আঘাত করলো তাকে। জেদ চেপে গেলো তার। যত সহজ ভেবেছিল সে তত সহজ এই মেয়ে নয়। একে বশে আনতে হলে অন্য কোন উপায় অবলম্বন করতে হবে। সীমান্ত হাত মুঠো করে নিজের রাগ দমন করতে চেষ্টা করলো। গভির ভাবে ভাবতে লাগলো একে কিভাবে বশে আনবে। সারিয়া ঘরের কাছে এসে দাড়াতেই অরন্য এসে ঠিক তার সামনে দাঁড়ালো। আচমকা এমন হওয়ায় সারিয়া চমকে উঠে পিছিয়ে গেলো। অরন্য খুব স্বাভাবিক ভাবেই জিজ্ঞেস করলো
–কোথায় গিয়েছিলে এতো রাতে?
সারিয়া রাগী চোখে তাকিয়ে বলল
–জাহান্নামে। তাতে আপনার সমস্যা কোথায়?
অরন্যর কপালে ভাঁজ পড়ে গেলো। ভালো কথা জিজ্ঞেস করলেও এই মেয়ে উলটা উত্তর দেয়। একে কিভাবে বোঝাবে যে পদে পদে বিপদ তার। বেশ কঠিন গলায় বললো
–তোমাকে আমি এনেছি। তাই তুমি এখন আমার দায়িত্ব। তোমার কোন বিপদ হলে আমাকেই জবাব দিতে হবে। কোথায় যাও কি করো সেটা আমার জানতে হবে তো।
সারিয়া কিছুটা স্বাভাবিক হল। কারন অরন্যর কথার কিঞ্চিৎ হলেও যুক্তি আছে। তাই কথা না বাড়িয়ে বলল
–একটু হাঁটতে গিয়েছিলাম।
অরন্য দেয়ালে হেলানি দিয়ে দাঁড়ালো। হাত গুঁজে অত্যন্ত শান্ত কণ্ঠে বলল
–এই জঙ্গলে মানুষের সাথে অনেক বন্য প্রাণীও থাকে। আর ভুত প্রেতের কথাও শুনেছি আমি। স্থানীয় অনেকেই নাকি দেখেছে। কেউ কেউ আবার কথাও বলেছে তাদের সাথে। সেই কথার ভিত্তিতে জানা যায় যে কম বয়সী সুন্দরী মেয়েদের প্রতি আকর্ষণটা তাদের একটু বেশীই।
বলেই থেমে গেলো অরন্য। তার মুখভঙ্গি বেশ স্বাভাবিক। কিন্তু বন্য জন্তুর চেয়ে ভুতের কথা শুনে সারিয়ার ভেতর কেঁপে উঠলো। জঙ্গলে বন্য জন্তু থাকবে সেটাই স্বাভাবিক কিন্তু ভুত প্রেত একটু বেশীই হয়ে গেলো। শুকনো ঢোক গিলে বলল
–সত্যিই কি ভুত প্রেত আছে?
অরন্য খুব স্বাভাবিক ভাবে বলল
–তোমার কি মনে হয় আমি তোমার সাথে মজা করছি? আমি যা শুনেছি তাই বলেছি। বিশ্বাস করা না করা তোমার ব্যাপার। তবে যেহেতু আমি তোমাকে দায়িত্ব করে এনেছি তাই এটাই বলবো যে একটু সাবধানে থাকবে। কারন অন্য কিছুর আক্রমন থেকে তোমাকে বাঁচাতে পারলেও ভুতের আক্রমন থেকে বাঁচানো আমার পক্ষে অসম্ভব। কারন ওই অদৃশ্য ভুত কিভাবে তাড়াতে হয়ে সেটা আমি জানি না।
অরন্যর এসব কথা সারিয়ার মাথায় ঢুকছে না। কারন ভুতের বিষয়টা খুব ভালো করেই মাথায় ঢুকে গেছে। আর সে প্রচণ্ড ভয় পায় এসব বিষয়ে। অরন্য ঠোট চেপে হাসল। দরজার সামনে থেকে সরে দাঁড়ালো। সারিয়া ঘরের দরজা খুলে মাথা ভেতরে দিয়ে এদিক সেদিক ভালো করে তাকিয়ে দেখল। ঘরে কিছু নেই নিশ্চিত হয়েই পা বাড়িয়ে দিলো। কিন্তু ঠিক সেই সময় আবার অরন্যের সেই অদৃশ্য ভুতের কথা মনে পড়তেই আবার দাড়িয়ে গেলো। অরন্য বুঝতে পারল সারিয়া ভয় পেয়েছে। তাই ঠোট চেপে হেসে পেছন থেকে বলল
–ভয় পাচ্ছ নাকি? ওহ! আই এম সো সরি। আমি জানতাম না তুমি ভুতে ভয় পাও। একা থাকতে ভয় পেলে আমি আছি তো। আমাকে বললেই আমি মাঝরাতে তোমার ঘরে চলে আসব।
সারিয়া সরু চোখে তাকাল অরন্যর দিকে। অরন্য মিষ্টি হেসে বলল
–না না তুমি ভুল ভাবছ। আমার কোন উদ্দেশ্য নেই। তুমি ঘুমাবে আর আমি তোমাকে পাহারা দেবো।
সারিয়া রেগে শব্দ করে দরজা বন্ধ করে দিলো। অরন্য প্রশস্ত হেসে নিজের ঘরে চলে গেলো।
———–
ভোর থেকে শুটিং চলছে। এখন সকাল ৯ টা বেজে গেছে কিন্তু এখনও একটা সিন ঠিক মতো শুট করতে পারেনি। বারবার নায়ক নায়িকাকে সংলাপ বুঝিয়ে দেয়ার পরও মন মতো হচ্ছে না। সেজন্যই অরন্য ভীষণ রেগে আছে। রোদের মধ্যে একটা চেয়ারে বসে বিরক্ত নিয়ে সামনে তাকিয়ে আছে। রাগে তার মাথার ভেতরে মগজ সিদ্ধ হয়ে দপদপ করছে যেন। হাতের ইশারায় কিছুক্ষনের জন্য বিরতি নিতে বলেই চোখ বন্ধ করে দুই হাতে মাথাটা চেপে ধরল।
–স্যার আপনার চা।
চোখ খুলেই সামনে একজন কম বয়সী মেয়েকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুচকে নিলো। কৌতূহলী কণ্ঠে বলল
–তুমি কি এখানে থাকো?
মেয়েটি মাথা নাড়ল। অরন্য আবার বলল
–তোমাকে কাল দেখলাম না যে।
মেয়েটি মুচকি হেসে বলল
–আমি কাল ছিলাম না। আজ সকালে এসেছি। আমাকে সারিয়া ম্যাডামের খেয়াল রাখার জন্য আসতে বলা হয়েছে।
অরন্যর কপালে ভাঁজ পড়ে গেলো। বলল
–কে বলেছে?
–সীমান্ত স্যার।
মেয়েটির কথা শুনে অরন্য পিছনে তাকাল। সীমান্ত কার সাথে যেন হেসে হেসে ফোনে কথা বলছে। অরন্যর কেমন অদ্ভুত রকমের অনুভূতি হল। মনে হল সে যেন হুট করেই সীমান্তকে তার জীবনের এক মাত্র প্রতিদন্দি ভেবে বসছে। চোখ বন্ধ করে নিজের ভাবনাকে নিয়ন্ত্রন করার চেষ্টা করলো। চায়ের কাপে চুমুক দিতেই পাশ থেকে ভেসে এলো মিষ্টি একটা হাসি। পাশে তাকাতেই দেখল সারিয়া ওই মেয়েটার সাথে কথা বলছে আর হাসছে। অরন্য স্থির দৃষ্টিতে সেদিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকল। ঠোঁটের কোনে তার ক্ষিন হাসির রেখা। শুভ পিঠে দুম করে একটা মারতেই চমকে তাকাল। রাগী চোখে তাকাতেই শুভ হেসে আঙ্গুল দিয়ে ক্যামেরার দিকে ইশারা করে বলল
–তোর দৃষ্টি তো এদিকে থাকার কথা ছিল ওদিকে থাকার কারণটা ঠিক বুঝলাম না।
অরন্য ওর কথার পাত্তা না দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। হাত থেকে চায়ের কাপটা রেখে বলল
–সেটা বুঝতে গেলে মাথায় ঘিলু থাকতে হয় যা তোর নেই।
সামনে এগিয়ে গিয়ে হাতের ইশারায় আবার শুটিং শুরু করতে বলল। সবাই নিজেদের জায়গায় দাড়িয়ে গেলো। নায়ককে শিখিয়ে দিতে অরন্য নায়িকার সামনে দাড়িয়ে হাতে কাগজ নিয়ে সংলাপ বলছে। কিন্তু কিছুতেই তার নিজেরই পছন্দ হচ্ছে না। কয়েকবার বলার পরেও সঠিক ভাবে বলতে না পারায় নিজের উপরে খুব বিরক্ত হল সে। চোখ মুখ কুচকে নিয়ে পিছন ফিরতেই সারিয়ার হাস্যজ্জল চেহারা দেখে থেমে গেলো। কিছুক্ষনের জন্য ভাবনায় বিভোর হয়ে গেলো সে। মুচকি হেসে বলল
–এই যে লেখিকা ম্যাডাম।
সারিয়া ডাক শুনেই তাকাল। অরন্য হাত ইশারা করে বলল
–এদিকে একটু আসবেন? দরকার ছিল।
সারিয়া একটু ভেবে সেদিকে গেলো। সারিয়া সামনে এসে দাড়াতেই অরন্য শুভর দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচিয়ে ইশারা করলো। শুভ ইশারা বুঝতে পেরেই ক্যামেরা রেডি করে ফেললো। অরন্য সারিয়ার কাছাকাছি এসে দাড়িয়ে ভীষণ আবেগি কণ্ঠে বলল
–এই যে, চারপাশে শত রমণীর ভিড়েও এই অতৃপ্ত চোখ জোড়া এক জায়গাতেই স্থির। কারো সাধ্য নেই তাকে অন্য কোথাও সরিয়ে দেবার। তবুও কি ভালবাসা আমার প্রাপ্য নয়?
সারিয়া পূর্ণ দৃষ্টি মেলে আশে পাশে তাকাল। সত্যিই আশে পাশে অনেক মেয়ে। তার থেকেও শত শত গুন সুন্দরী। দৃষ্টি ফিরিয়ে অরন্যর দিকে স্থির করতেই ভেতরে কেমন নাড়া দিয়ে উঠলো। কি আছে ওই দৃষ্টিতে? কালো মনি দুটো সমস্ত অনুভূতি ছাপিয়ে অন্য এক জগতে নিয়ে যেতে সক্ষম।
–পারফেক্ট!!
শুভর কথা কানে আসতেই অরন্য সেদিকে তাকিয়ে অমায়িক একটা হাসি দিলো। হাতের কাগজ গুলো নায়কের হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে গেলো। সারিয়া স্থির দাড়িয়ে দেখছে সব কিছু। কিছুক্ষনের জন্য সে ভুলেই গিয়েছিল যে এটা তারই লেখা উপন্যাসের একটা উক্তি আর এখানে শুটিং চলছে। তার মনে হয়েছিল অরন্য যেন সত্যি সত্যি তাকে নিজের মনের কথা বলছে। এতো আবেগ মিশিয়ে কেউ অভিনয় করতে পারেনা। এটা অসম্ভব। সারিয়ার মনে হল সে এই আবেগের সাথে পূর্ব পরিচিত। একটা শ্বাস টেনে এগিয়ে গেলো অরন্যর দিকে। অরন্য ভীষণ ব্যস্ত। পাশ ফিরে তাকাল সারিয়ার দিকে। ভ্রু কুচকে বলল
–কিছু বলবে?
সারিয়া মাথা নাড়ল। যার অর্থ সে কিছু বলবে না। কিন্তু তার কেন জানি মনে হচ্ছিল সে কিছু একটা বলতে এসেছিল। কিন্তু কি সেটাই বুঝতে পারছে না। অরন্যর দিকে তাকিয়ে থাকল স্থির দৃষ্টিতে। তার ঠোঁটের কোণের চাপা হাসিটা ভীষণ তৃপ্তির।
চলবে……