#ভালোবেসে_তোমায়
Writer: Jannat
পর্ব: ৫+৬
.
হেনা যখন বাইকে বসে শায়নকে আষ্টেপিষ্ঠে জড়িয়ে ধরে আছে ।
সেই মুহূর্তে তিশা লেবার পেইনের যন্ত্রনায় হাসপাতালে বেডটাকে খামচে ধরল….
দাতে দাত চেপে সহ্য করে যাচ্ছে ,মাতৃত্বের ব্যাথা । আর শায়ন তার বউকে নিয়ে ঘুরে বেরাচ্ছে দুনিয়া ।
হাসপাতালের বেডে সুয়ে কাতরাচ্ছে আর আল্লাহকে ডাকতেছে তিশা । আর হেনা আগামীর স্বপ্ন বুনতেছে আর সুখের স্বর্গে ভাসতেছে ।
আল্লাহ তিশার ডাকে সারা দিল এবার ,এই মুহূত্বে তার রহমতের দরজা সম্পূর্ন খুলে দিয়েছে ।
ব্যাথা যখন চরম মাত্রায় ঠিক সেই মুহুর্তে ডেলিভেরি হল । লেবার পেইন সহ্য করতে না পেরে আল্লাহ বলে চিৎকার দিয়ে উঠল এবং জ্ঞান হারালো । তিশার আল্লাহ বলে চিৎকারের শব্দ শুধু হাসপাতালের ভিতরে সীমাবদ্ধ ছিল না । আকাশে বাতাসও কেঁপে উঠছিল ।
ঠিক সেই কম্পনে মুহুর্তেই ট্রাকের সাথে সংঘর্ষ লেগে শায়নের বাইকটা ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে মাটির সাথে পিষে যায় ।
ছিটকে পড়ে গাড়ি থেকে ওরা,মারাত্বক দূর্ঘটনা ঘটে ।
স্থানীয় লোকজনের সহতায় হাতপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় । শায়নের ফোনের নম্বরের শেষ কল ছিল ওর ফ্রেন্ডের ,তাকে ফোন দিয়ে জানানো হয় ।
ওনি যতদ্রুত সম্ভব হাসপাতালে ছুটে আসে । শায়নের জ্ঞান ফিরলেও হেনার অবস্থা খুবই খারাপ । হেনার ফ্যামিলিকে ফোন দিয়ে জানানো হয়েছে ।
__মি. শায়ন । আপনার স্ত্রীকে দ্রুত অপারেশনের ব্যাবস্থা করতে হবে ।
__হেনা ঠিক আছে ডক্তর ? আমার সন্তান ?
__প্লীজ শান্ত হোন । বাচ্চা মিস্ক্যারেজ হয়ে গেছে আর সাথে মায়ের অবস্থা শোচনীয় । এই মুহুত্বে অপারেশন ছাড়া
ওনাকে বাঁচানো সম্ভব না ।
.
এমন একটা পরিস্থিতির জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না শায়ন । এই তো দুপুরেও বেবিটাকে নিয়ে কতটা স্বপ্ন দেখছে , পেটে কান রেখে কথা বলছে । ওরে কথাও দিয়েছে , অনেকগুলো খেলনা নিয়ে আসবে ।
কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে ,ফ্যালফ্যাল হয়ে তাকিয়ে আছে । ডাক্তার ওর কোনো উত্তর না পেয়ে মুখের পানে চেয়ে আছে ।
ঠিক সেই মুহূর্তে হেনার আত্মীয়-স্বজনরা হাসপাতালে এসে পৌছালো ।
__শায়ন ,তুমি ঠিক আছ বাবা ?
আমার হেনা কোথায়,আমার মেয়ের কি অবস্থা ..?
__আপনার মেয়ের দ্রুত অপারেশন প্রয়োজন । নয়ত ,যত টাইম যাবে ওনার জীবন রিস্কের মুখে পড়ে যাবে ।
__আপনি দ্রুত অপারেশনের ব্যাবস্থা করেন ,আমার মেয়েটাকে সুস্থ করে দিন ।
.
সবাই যে যার সন্তান নিয়ে ব্যাস্ত । সন্তান মিস্ক্যারেজ হয়ে গেছে শুনে শায়ন থমকে গেছে। হেনার বাবা-মা তার সন্তানের সুস্থতার জন্য ব্যাস্ত ।তিশার বাবা-মা তারাও তাদের মেয়ের সুস্থতার জন্য দোয়া করতেছে । আর তিশা সে সন্তানের মুখ দেখার আশায় লেবার পেইনের মত নাড়ী ছিড়ে যাওয়া ব্যাথা দাতে দাত চেপে সহ্য করে যাচ্ছে ।
.
ডাক্তর o.t থেকে বের হয়ে আসল ।
__ডক্তর ,আমার মেয়ে (হেনার ফ্যামিলি)
__জী আল্লাহকে ডাকুন । এখনো কিছু বলতে পারতেছিনা ।
ওনার জরায়ুতে প্রচন্ড পরিমান আঘাত লাগছে ,৯৮% ই থেতলে গেছে । ওটা কেটে ফেলা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই ,নয়তো ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে যাবে ।
দ্রুত ডিশিসন জানান ,হাতে সময় খুব কম ।
.
শায়ন তো শকড । বাচ্চা মিস্ক্যারেজ হয়ে গেছে, এখন যদি জরায়ু কেটে ফেলা হয় তাইলে আর সন্তান হওয়া সম্ভব নয়
__ডাক্তার ,আর কোনো উপায় ?
__দেখুন ,আমি আপনার অবস্থা বুঝতে পারতেছি ।
তবে আমরা নিরুপায়
__হাত মুষ্ঠি করে চুপ করে আছে শায়ন
__ডাক্তার যেভাবে সম্ভব আমার মেয়েকে বাঁচান ।যেটা ভালো হবে তাই করেন ।
.
ডাক্তার একবার শায়নের দিকে তাকিয়ে ভিতরে চলে গেল । হেনার জরায়ু কেটে ফেলা হল । আর অন্যদিকে তিশার জ্ঞান ফিরল । চোখ মেলে সামনে তাকালো ,ওর মা ইশারায় পাশে তাকাতে বলল ।
পাশে ফিরে তাকিয়ে মুহুত্বেই এই ৯মাস ১২ দিনের কষ্ট ভুলে গেল ,মুখে তৃপ্তির হাসি ফুঁটে উঠল ।
তার পাশে তার রাজপুত্র আর রাজকন্যা সুয়ে আছে , ছোট ছোট ,পিট পিট করে চোখগুলো চেয়ে আছে ।
হ্যা তিশা টুইন বেবি প্রসব করছে , আজ যেন তার সুখের কমতি নেই । বাচ্চাদের দিকে ফিরে উপর হয়ে ,কোমল হাতগুলো দিয়ে নিজের মুখে ছুঁয়ে দিচ্ছে । এখন বিশ্বাস হচ্ছে না ,সে মা হয়েছে । তাও ২টা চাঁদমুখ , ২সন্তানকে চুমুতে ভরিয়ে দিচ্ছে । ২চোখ দিয়ে সুখের অশ্রু জরতেছে ।
.
ছেলের এক্সিডেন্টের খবর পেয়েও এতক্ষন তিশার পাশেই ছিল ওর শশুড়-শাশুড়ি । এখন যেহেতু তিশা সুস্থ তাই তাদেরকে উঠতে হবে । একবার ভাবল ,শায়নের এক্সিডেন্টের খবরটা জানাবে পরক্ষন্তরে ভাবনা পাল্টে নিল । কি দরকার ,ওর আনন্দের মুহুর্ত্বে বিষাদের ছায়া ফেলানো ।
মেয়েটা হাসতেছে ,হাসুক না এভাবে বাকীটা জীবন । ২ নাতী-নাতনীকে আদর করে কিছুক্ষন তারপর বিদায় নিয়ে চলে গেল ।
.
হেনার অপারেশন কম্পিলিট ,কিছুক্ষন আগে বেডে দেওয়া হয়েছে । ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে , এখনো জ্ঞান ফিরে নাই ।বাবা-মা কে দেখে শায়ন জড়িয়ে ধরল ।
__বাবা,তুই ঠিক আছিস তো ..
__হ্যাঁ মা ,ঠিক আছি মা । মাগো আমাদের বেবিটা নেই , হেনা আর কখনো মা হতে পারবে না ।
__তিশার টুইন বেবি হয়েছে ।(মুখে রহস্যময় হাসি টেনে)
__(মাকে ছেড়ে, অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে )
মা… …
__হ্যাঁ রে ,তুই যখন এক্সিডেন্টের কথা জানালি ঠিক তখন আমরা হাসপাতালে ছিলাম ।
এই ২হাত দিয়ে ছুঁয়ে এসেছি ,আদর করে এসেছি । একদম ২টা চাঁদমুখ ।
.
তিশার যেহেতু নরমাল ডেরিভেরি ছিল ,তাই হাসপাতালে বেশিক্ষন রাখার প্রয়োজন ছিল না । আর তাছাড়া মা,সন্তানরা ৩জনেই সুস্থ । তাই ওদেরকে বাসায় নিয়ে আসা হল । তিশার বাবুদেরকে দেখার জন্য সব আত্মীয়-স্বজনরা আসছে ।
আজকে বাবুদের নাম রাখা হবে ।
তিশার সব কাজিনরা বসে নাম সিলেক্ট করতেছে । কারো নাম কারো পছন্দ হচ্ছে না ,ওদের পাগলামী দেখে তিশা হাসতেছে ।
__আচ্ছা আমরা নাম নিয়ে এভাবে ঝগড়া না করে আগে আপুর কাছে জিজ্ঞেস করে নেই ।
__ওকে..তাও ঠিক ।
.
তিশা বাবুদের খাওয়াচ্ছে ,ওরা সবাই রুমে গিয়ে ঘিরে বসল ।
__ আপু তোমার আর দুলাভাইয়ের কোনো পছন্দ করে নাম রাখা আছে ?
.
তিশা চমকে উঠল,,,
__আহহ..
__এই কি হল তিশুপাখি ?
__তোমার ছেলে লাথি মেরেছে আমাকে । এ্যাআআ
__আরে কোথায় লাথি মেরেছে ,দেখি আদর করে দিচ্ছি ।
__এই একদম না । তুমি একটা খারাপ লোক ,শুধু জ্বালানোর ধান্ধায় থাক । তোমার ছেলেটাও একদম তোমার মত
__এই এক মিনিট , ছেলে মানে ? আমার একটা ছোট তিশুপাখি চাই
__উহু না ,আমার একটা জুনিয়র শায়ন চাই
__বলছি না মেয়ে বাবু
__নাহ,ছেলে বাবু
__ওই কুত্তা ,একদম উল্টা বলবি না । বাবাই আসবে ,বাবাই
__উহু ,মাম্মা আসবে । মাম্মাম
__তিশা রাগ করে ,মুখ ফুলিয়ে অন্য দিকে ফিরে আছে
__শায়ন ,তিশাকে জড়িয়ে ধরল । তিশু পাখিটা রাগ করেছে ? রাগ করে না তিশুপাখিটা আমার ।
দেখ ,আমাদের একটা বাবাই আর একটা মাম্মাম আসবে
__সত্যি .. (বুকে মাথা রেখে)
__হুম গো ।
__এই আমাদের বাবুদের নাম কি গো ?
__উমম … তিশান আর তিশিন
__উহু ,স্বর্গ আর শব্দ
__আচ্ছা তাইলে । মাম্মামের নাম হবে “” তিশিন মাহবুবা স্বর্গ””
আর বাবাইয়ের নাম “” তিশান মাহবুব শব্দ “”
__ইশ তুমি কত্ত ভালো । আমি তো এতক্ষন নাম নিয়ে জগড়া বাধিয়ে ফেলতাম (গলা জড়িয়ে ধরে)
__তুমি ভালো তো তাই আমিও ভালো ।
__হিহিহি
__পাগলী সোনা ।
.
এইই আপু কই হারাইয়া গেলা । ওদের ডাকে চমকে উঠে তিশা ।
__হ্যাঁ ,কি যেন বলছিলি তোরা
__বাবুর নাম
__তিশিন মাহবুবা স্বর্গ আর তিশান মাহবুব শব্দ ।
__ওয়াও ,বাবুদের মতই কিউট নামগুলো ।
.
হেনা কিছুটা সুস্থ এখন,৭দিন হল হাসপাতালে । আজকে রিলেজ করে দিবে । ওর বাবা-মা নিয়ে যেতে চেয়েছে কিন্তু হেনা যায়নি শায়নকে একা রেখে । বাসার যাওয়ার পর থেকেই নিশ্চুপ ২জনেই ।
শায়ন সিগারেট খাচ্ছে আর দাড়িয়ে আছে বারান্দায় ।
অনেক বছর পর আবারও সিগারেট মুখে দিল ।
হতাশ হয়ে গেছে । খুব বেশি অন্যায় করে ফেলেছে তিশার সাথে ।
তিশা হয়ত কখনো ক্ষমা করবে না কিন্তু একবার ইচ্ছা করতেছে বাচ্চাগুলো দেখার । ইশ না জানি কত মিষ্টি হয়েছে । কেন পারলাম না দৈয্য ধরতে । আর আজ যখন হেনার চিরদিনের মত মা হওয়ার ক্ষমতা চলে গেছে ,এখন কিভাবে থাকব ।
হেনা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেটে গিয়ে হাত রাখল পিঠে ,শায়ন চমকে উঠল । পিছে ফিরে হেনাকে দেখল
__তুমি উঠতে গেলে ক্যান ? আমাকে ডাকলেই তো পারতে
__থাক আমি ঠিক আছি ।
__শায়ন হেনাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতেছে । কেন এমন হল কেন? আল্লাহ দিয়েও কেড়ে নেয় ?
__হেনাও কাঁদতেছে ।
__জানো ,যেদিন আমাদের এক্সিডেন্ট হয়েছে সেইদিনই তিশা টুইন বেবি প্রসব করেছে ।
হেনা কিছুক্ষনের জন্য থমকে গেল পরক্ষন্তরেই মুখে হাসি ফুঁটল । যার সংসার ,আল্লাহ তাকে দিয়েই পূর্নতা দিল ।
__তুমি গিয়ে আপুকে নিয়ে আস
__মানে ? তা কি করে সম্ভব ? এই মুখ নিয়ে ওর সামনে যাওয়া পসিবল না
__ওকে,আমি সুস্থ হই তারপর আমিই যাব । আমার বিশ্বাস আমাকে ফিরাবে না ।
.
তিশার এই কয়েকদিনে ওর কষ্টদায়ক অতিতটা ভুলেই গেছে । সে বাঁচতে চায় ,তার সোনামনিদের নিয়ে আরও হাজার বছর । এই নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে কাটিয়ে দিতে পারবে এই জীবনটা ।
তার অতিতের কোনো ছায়া যেন এই নিষ্পাপদের উপর না পড়ে ,বাবা_মা কে বলে দূরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল ।
তারাও চায় তার মেয়ের একটা পরিচয় হোক আর সেই পরিচয়ে সোনামনি ২টো পরিচিত হোক……
.
#ভালোবেসে_তোমায়
Writer: Jannat
পর্ব: ৬
.
তিশার যখন বিয়ে হয় তখন সবেমাত্র অনার্স ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রী । বিয়ের পর আর পড়া হয়ে উঠেনি বা নিজেই তেমন আগ্রহ দেখায়নি । এত বেশি ভালোবাসার ভরপুর ছিল যে লেখাপড়া তার নিচে চাপা পড়ে গেছে ।
তবে এখন খুব বেশি আফসোস হচ্ছে ,লেখাপড়াটা চালিয়ে গেলে এতদিনে কম্পিলিট হয়ে যেত । জেনারেল লাইনে পড়ার ইচ্ছা নেই ।
সামনে নার্সিং এর ভর্তির ডেট পড়েছে ,যদি সরকারিভাবে চান্স হয়ে যায় তাহলে আর জেনারেল লাইনে পড়বে না ।
কোসিং এর ভর্তির টাইম যেহেতু শেষ ,সো বাসায় বসেই লেখাপড়া শুরু করে দিয়েছে । রাতদিন এক করে লেখাপড়ায় মন দিয়েছে যদি আল্লাহ সহায় হয় ।
এই ১মাস ১২দিনে অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে গেছে হেনা আর শায়ন । জোর করে কোনো কিছু অর্জন করার মত বৃথা চেষ্টা আর নেই । আল্লাহ বলেছেন
“ধৈর্য্য ধর “।
নিশ্চই আল্লাহ ধৈর্য্যকারীর সাথেই আছেন ”
ধৈর্য্যর পরীক্ষায় আমি বিফল হইছি ,তাই আল্লাহ এত বড় শাস্তি দিল ।
হয়ত পরিস্থিতি স্বাভাবিক, শান্ত হয়ে আসছে কিন্তু মনের ভিতরে যে অশান্তির আগুন জ্বলতেছে তা নিভাবে কি করে ।
অনেক বড় অন্যায় করে ফেলেছে তিশার সাথে ,যার শাস্তি ইহকাল,পরকাল ২কালেই পেতে হবে ।
তিশা তার বাচ্চা আর লেখাপড়া নিয়ে এতটাই ব্যাস্ত যে ভুলেও পিছু ফিরার অবকাশ পায় না ।
তিশা আদৌ কখনো
শায়ন বা হেনা কাউকেই অভিশাপ দেয় নি ।
কিন্তু তিশার বুকের ভিতর যে মেঘ সৃষ্টি করে দিয়েছে শায়ন , দিনের শেষে বৃষ্টির ন্যায় অভিশাপসরূপ ঝড়ে পড়ে চোখের জল ।
চোখের জলের চেয়ে বড় অভিশাপ ২য় কিছু আর হয়না ।
দুনিয়াতে সেই বড় অপরাধী যার দেওয়া কষ্টের কথা মনে করে জায়নামাযে/মোনাজাতে ২ফোঁটা চোখের জল গড়িয়ে পড়েছে ।
.
বাচ্চাদের খাইয়ে মায়ের কাছে দিয়ে রুমে এসে বই নিয়ে বসল তিশা । কাল এক্সাম আজকে আর কোনো রকম বিরতি দেওয়া যাবেনা । ফজরের নামায পড়ে ৮টার এলার্ম দিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিল । এখন একটু না ঘুমালে পরীক্ষার হলে ঘুমাতে হবে ।
সকালে এলার্ম বাজার আগেই বাচ্চাদের কান্নার শব্দে ঝটপট উঠে বসল তিশা ।
দৌড়ে মায়ের রুমে গেল ,ওর আম্মু গরুর দুধ চামচ দিয়ে খাওয়ানোর চেষ্টা করতেছে ।
__আরে রে কি করছ । ইশ আমার কলিজাগুলোকে কষ্ট দিচ্ছ ক্যান ?
__কাল রাতে খাইয়েছিস ,এইটুকু বাচ্চার গলা শুকিয়ে যাবে তো ।
__তুমি আমাকে ডাকনি ক্যান
__তুই তো ঘুমাচ্ছিলি তাই । আর তাছাড়া না ঘুমালে এক্সামের টেবিলে ঘুমিয়ে পড়বি
__সব কিছুর উর্ধ্বে আমার বাবুরা । অন্যসব গোল্লায় যাক ।
তিশার আম্মু মেয়ের এমন পাগলামী দেখে হাসতেছে । তার সেই পিচ্চি রাজকন্যাটাও আজকে কত্ত বড় হয়ে গেছে । তার বাচ্চাটাও আজকে বাচ্চা সামলাচ্ছে ।
সবকিছু কতটা দ্রুত পাড় হয়ে যাচ্ছে । তিশা রেডি হয়ে ২বাচ্চাকে বুকে কিছুক্ষন জড়িয়ে রাখল , চোখে-মুখে আদর দিয়ে বাবার সাথে পরীক্ষার উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়ল ।
বিসমিল্লাহ বলে প্রশ্নপত্র হাতে নিল তিশা । ধীরে ধীরে প্রশ্নের আন্সার দিচ্ছে । অধিকাংশ প্রশ্নই তার জানা । নির্ধারিত সময়ের আগেই সকল প্রশ্নের উত্তর করা শেষ ।
তবুও বারবার উত্তর সীটে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে । ঘন্টা বাজার পর পরীক্ষার হল ত্যাগ করল । মনে মনে একটা আত্মবিশ্বাস জন্মে গেছে , তার মন বলতেছে সরাকারি ভাবে চান্স হয়ে যাবে ।
বাসায় গিয়ে খুশিতে জড়িয়ে ধরল মাকে । মেয়ের মুখ দেখেই বুঝে গেছেন খুব ভালো হয়েছে এক্সাম ।
সেই ছোটবেলার মত এক্সাম ভালো হলে বাসায় এসেই জড়িয়ে ধরত আর যদি কখনো সামান্য পরিমান খারাপ হত রুম লক করে কান্না করত ।
.
বাচ্চাদের নিয়ে দুষ্টমিতে লেগে গেছে , নিখুঁতভাবে বাচ্চাদের পর্যবেক্ষন করতেছে । নাহ,ভাবছিল শায়নের মত হবে বাট একদম ওর নিজের কার্বন কপি মনে হচ্ছে ।
আর হবেই না ক্যান পেটে আসার পর থেকে তো মা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল ।
কখনো বাবার সংস্পর্শ তো দূরের কথা দেখাই মিলে নাই ।
মামুনির উপর রাগ করিস না সোনারা । বাবার থেকে আলাদা বলে কষ্ট পাসনে । তোদের মামুনি ২জনের ভালোবাসা একাই পোষাইয়া দিবে ।
বাচ্চাদের সাথে অনাবরত কথা বলেই যাচ্ছে । আর বাচ্চা ২দুটো ছোট ছোট হাত পা নড়াচড়া করে মামুনিকে ছুঁয়ে দিচ্ছে । কিছুক্ষনপর ঘুমিয়ে গেল ,তিশা মন খারাপ করে গাল ফুলিয়ে বসে আছে ।
এই কয়েকদিনে মেয়েকে মন খারাপ করতে দেখেনি তিশার মা ।
আজকে হঠাৎ এভাবে দেখে চমকে উঠলেন ,তিনি চান না তার মেয়ে আর বিন্দু পরিমান কষ্ট পাক ।
__কিরে মা ,কি হল তোর ? এভাবে বসে আছিস ক্যান ?
(মা-বাবা ২জনেই তিশার রুমে প্রবেশ করল)
__দেখ না মা । আমি কতটা ফিলিংস নিয়ে ওদের সাথে কথা বলতেছি আর ওরা কিনা আমাকে ইগনোর করে ঘুমিয়ে পড়ল । আমার ফিলিংস এর কোনো দাম নেই ।
.
মেয়ের এমন কথা শুনে ২জনেই হেসে উঠল । কে বলবে এই বাচ্চাটাও ২টো ছোট্র সোনার মামুনি । এই বাচ্চাদের সাথেও কেউ অভিমান করে । ওর বাবা-মায়ের হাসি দেখে তিশা আরো গাল ফুলিয়ে ফেলছে । তিশার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেছে ,পাগলি মেয়ে এই জন্য কেউ এভাবে অভিমান করে । ওরা এখনো ফিলিংস বুঝতে শিখে নি । ওদের কাছে আগুন পানি ২টোই সমান । তুই যদি সারাদিনও এভাবে অভিমান করে থাকিস তবুও কি ওদের আদৌ তোর অভিমান ভাঙানো সম্ভব ।
তাই তো ,এতক্ষন তো ভেবেই দেখে নাই । ইশ আমার বাবুরা না আমাকে বোকা ভাবা শুরু করবে । ফিক করে হেসে দিল তিশা । সাথে ওর বাবা-মা যোগ দিল ।
__যাহ ফ্রেস হয়ে আয় তারপর কিছু খেয়ে নে । নিজের অবস্থা কি করেছিস একবার আয়নায় দেখেছিস ..?
মায়ের কথা শুনে চুপ হয়ে গেল তিশা । তাই তো শেষ কবে আয়নায় নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে তাও মনে করা দায় । আগে তো সকাল টু সন্ধ্যা নিজকে পরিপাটি করে রাখত শায়নের জন্য । কিন্তু সেই মানুষটার যখন ফিরে তাকানোর সময় নেই সেদিন থেকে কখনো আয়নার সামনে দাড়ানো হয়নি বা নিজেকে সজ্জিত করেনি ।
মেয়েকে মন খারাপ করতে দেখে নিজের কাছে খারাপ লাগা শুরু করে দিয়েছে । কবে যে মেয়েটা সম্পূর্ন স্বাভাবিক হবে ।
__এভাবে হুতুম পেঁচার মত বসে থাকিস না তো ।
.
মায়ের কথায় চমকে উঠল তিশা
__কিক কি বললে তুমি । আমি হুতুম পেঁচা । বাবা ,তুমি কিছু বলবে না ? বের হও রুম থেকে (জোর করে ২জনকেই বের করে দিল )
.
আজকে অনেক টাইম নিয়ে সাওয়ার নিল । টাওয়াল পেঁচিয়ে বের হয়ে আয়নার সামনে দাড়ালো । যাক ,এখন কিছুটা হলেও মানুষের মত দেখা যায় । এখন একটা ঘুমের প্রয়োজন তাইলে পুরোপুরি মানুষের রুপটা ফিরে আসবে ।
তার আগে কিছু খেয়ে নেওয়া দরকার ।
খেয়ে এসে ২দুটো কলিজার টুকরোকে ২পাশে রেখে মাঝখানে নিজে সুয়ে পড়ল । ৫টা নাগাদ ঘুম ভাঙলো ।চোখ মেলে বাবুদেরকে দেখতে পেল না ,মা নিয়ে গেছে ।
উফফ অনেক ঘুমালাম নিজেকে যথেষ্ঠ সুস্থ,স্বাভাবিক আর ফুরফুরে লাগতেছে । চোখে মুখে পানি দিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাড়ালো । বাবা আর মা তিশিন ,তিশানকে নিয়ে বাগানে হাটতেছে ।
বারান্দায় আর দাড়িয়ে না থেকে নিজেও বাহিরে চলে গেল । অনেকদিন ফটোশেসন করে না । আজকে মনটা ফুরফুরে আর ওয়েদারটাও খুব চমৎকার । অনেকগুলো পিকচার তুলল ।
.
শায়ন সকল সংকোচ পায়ে ঠেলে তিশার নম্বরে ডায়েল করে যাচ্ছে বাট প্রতিবারই বন্ধ । এই পযন্ত অগনিত ফোন দেওয়া হয়েছে ,তবে বিশেষ লাভ হচ্ছে না ।
.
তিশার এক্সামের রেজাল্ট দিছে । সরাকরি ভাবে রাজশাহী নাসিং কলেজে চান্স পেয়েছে ।
সকল খুশির যেন বাধ ভেঙে গেছে আজ । তিশার ইচ্ছা অনুযায়ী এখনকার বাসা বিক্রি করে দিয়ে পুরো ফ্যামিলি পাড়ি জমালো রাজশাহী ।
.
হেনা এখন সম্পূর্ন সুস্থ । হেনা, শায়ন আর শায়নের বাবা-মা তিশাদের বাড়িতে আসল । কলিং বেল বাজানোর শব্দে এক অপরিচিত মহিলা এসে দরজা খুলে দিল ।
__কাকে চাই ?
__আমরা তিশার শশুড় বাড়ি থেকে এসেছি । ওনারা কি বাসায় আছে ..?
__জী না ,ওনারা এক সপ্তাহ হল এই বাড়ি বিক্রি করে দিয়েছে ।
__বিক্রি মানে ? তাইলে ওনারা কোথায় থাকে এখন ?
__সরি সেটা তো আমরা জানি না ।
এতবুক আশা নিয়ে এসেছিল কিন্তু ভাগ্য এতই খারাপ যে দেখাটুকুএ কপালে জুটল না ।
ওর সকল আত্মীয়-স্বজন কারো কাছ থেকেই সঠিক কোনো তথ্য বের করতে পারেনি ।
হন্য হয়ে খুঁজতেছে ……
.
.
চলবে…