মনের উঠোন জুড়ে পর্ব -২৯+৩০

#মনের_উঠোন_জুড়ে

#পর্ব_২৯

#লেখনীতে_নূন_মাহবুব

-” তুমি এইখান থেকে চলে যাও উষ্ণতা।দেখছো তো আমাদের কাছে বোমা লাগানো রয়েছে। যেকোনো সময় ব্লাস্ট হয়ে যেতে পারে।আমরা সবাই মা’রা যাবো। তুমি চলে যাও মা।চলো যাও। শিক্ষার যেন বিশ্বাস ই হচ্ছে তার পাপা মম বেঁচে আছে। এতো গুলো বছর পরে নিজের মম পাপা কে দেখে নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারে না শিক্ষা। ছুটে আসে তাদের কাছে। নিজের পাপা মমের মুখে অজস্র চুমু তে ভরিয়ে দেয়। পরক্ষণেই চোখের পানি মুছে বলে,এ কি হাল হয়েছে তোমাদের? জীবিত রেখেও মে’রে ফেলেছে তোমাদের। কে করেছে এইসব বলো আমাকে?বলো না পাপা কে করেছে এইসব?”

-” তুমি চলে যাও এইখান থেকে উষ্ণতা।এটা তোমার পাপার অর্ডার। আমাদের নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না। তুমি তো এতো দিন জানতে তোমার পাপা মম বেঁচে নেই।ধরে নাও আমরা মৃত। আমি আবারো বলছি চলে যাও।”

-” তুমি আমাকে হেরে যাওয়ার শিক্ষা দিয়ে বড় করো নি। যুদ্ধের ময়দান থেকে লেজ গুটিয়ে পালিয়ে যাওয়ার শিক্ষা পাই নি আমি। এতো গুলো বছর আমি তোমাদের আদর স্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়েছি। কিন্তু আর নয়।আমি এইখান থেকে তোমাদের না নিয়ে কোথাও যাবো না।”

-” জেদ করো না উষ্ণতা।এটা জেদ করার সময় নয়।”

-” তুমি কি তোমার দায়িত্ব কর্তব্য ভুলে গিয়েছো পাপা? তুমি চাও না এসব কিছুর পেছনের আসল মাস্টারমাইন্ড সবার সামনে আসুক। তাদের কর্মফল ভোগ করুক। তোমাদের সাথে যে অন্যায় হয়েছে তার শাস্তি পাক ।এটা চাও না তুমি?”

-” বিশ টা বছর সততার সাথে আমি আমার দায়িত্ব কর্তব্য পালন করেছি। সেগুলো এতো তাড়াতাড়ি ভুলে যাই কিভাবে ? কিন্তু আমি চাই না আমাদের জন্য তোকে সাদ্দাম হারিয়ে ফেলুক।আমি তোকে কতোটুকুই বা আদর ভালোবাসা দিতে পেরেছিলাম।সবটা তো করেছে সাদ্দাম।তোর কিছু হয়ে গেলে সাদ্দামের কি হবে?”

-” কি আর হবে?যদি আসল অপরাধী কে ধরে বড় আব্বু কে নির্দোষ প্রমাণ করতে না পারি ,তাহলে হয়তোবা বড় আব্বুর ফাঁ’সি হবে।শুধু মাত্র তোমাদের কে বাঁচানোর জন্য বড় আব্বু কোনো অপরাধ না করেও মিথ্যা অপবাদ নিজের ঘাড়ে নিয়েছে। নিজের এতো বছরের ক্যারিয়ার এক নিমিষেই শেষ হয়ে গিয়েছে মানুষ টার। মিডিয়ার লোকেরা ছিঃ ছিঃ করছে। তুমি চাও না পাপা আসল অপরাধী শাস্তি পেয়ে বড় আব্বুর মুক্তি হোক ?”

-” সাদ্দাম আমার জন্য যা করছে , পৃথিবীতে এরকম হয়তো কোনো বন্ধু তার বন্ধুর জন্য করে না। আমার গাঁয়ের চামড়া দিয়েও যদি আমি সাদ্দাম কে জুতা বানিয়ে দেই, তবু ও সাদ্দামের ঋণ আমি শোধ করতে পারবো না। আমার কলিজার টুকরো টা ও মানুষের মতো মানুষ করছে। একটা বাবার কাছে এর থেকে বড় পাওয়া আর কি হতে পারে।আমি অবশ্যই চাই সাদ্দামের মুক্তি হোক। আসল অপরাধী শাস্তি পাক। কিন্তু এর জন্য তোদের বেঁচে থাকতে হবে।তোরা চলে যা এইখান থেকে। আসল অপরাধী খুঁজে বের কর। যেকোনো সময় বোম ব্লাস্ট হয়ে আমরা সবাই মা’রা যেতে পারি।”

-” এতোক্ষণ দূরে দাঁড়িয়ে বাবা মেয়ের ভালোবাসা দেখছিলো সাহিত্য। রায়হান মীরের কথা শুনে সাহিত্য এসে বললো, ডোন্ট প্যানিক রায়হান শ্বশুর স্যার।আপনি খুব ভালো করে জানেন বোম ডিফিউজ করে দেওয়া যায়। তৎক্ষণাৎ পেছন থেকে একটা মেয়ের কণ্ঠে ভেসে আসে, হ্যাঁ বোম ডিফিউজ করে দেওয়া যায়।তবে তার জন্য সময়ের প্রয়োজন হয়। কিন্তু তুমি সেই সময়টা পাবে না অফিসার।মেয়েলী একটা কণ্ঠে সবাই পিছনে তাকিয়ে দেখলো, মুখে মাস্ক পরা একটা মহিলা দাঁড়িয়ে রয়েছে।যার হাতে রিমোট জাতীয় কিছু একটা রয়েছে।যা দেখে শিক্ষা বললো, ওহ্! তুই তাহলে আসল মাস্টারমাইন্ড।ফাইনালি তোর দর্শন পেলাম। কিন্তু তুই মুখ লুকিয়ে রেখেছিস কেন? মাস্ক খোল,দেখা সবাইকে তোর চাঁদ মুখ খানা বলে শিক্ষা মহিলা টার দিকে এগিয়ে যাওয়ার আগেই সে বললো,এক পাও আগানোর চেষ্টা করবি না উষ্ণতা। মূলত তোর সাথে আমার কোনো শত্রুতা নেই। তুই রায়সা আর রায়হানের মেয়ে এটাই তোর অপরাধ।তোর পাপা মমের করা অপরাধের শাস্তি তুই ও ভোগ করবি।”

-” আমার পাপা মম তোমার সাথে কি করছে না করেছে এটা আমি জানি না।তবে এখন আমি তোমার যে হাল করবো, তুমি হয়তো সেটা ভাবতেও পারবে না।”

-“বাহ্ বাহ্। বলতেই হয় বাপ কা বেটি। বাঘের বাচ্চা বাঘ ই হয়েছিস।তবে আমার সামনে একদম ওভারস্মার্ট হতে আসবি না।তোর মম পাপার কাছে যে বোম রয়েছে সেই বোমের ট্রিগার আমার কাছে।তাই কেউ কোনো প্রকার চালাকি করার চেষ্টা করবি না।অবশ্য আমি চাইলেই এতো দিনে এসিপি আর তার প্রেয়ারের ব‌উ কে মে’রে দিতে পারতাম। কিন্তু মা’রি নি। ভেবেছিলাম এসিপির মেয়ে উষ্ণতা কে ওদের সামনে কে’টে টুকরো টুকরো করে ওর কলিজা টা খাবো। কিন্তু পরে আমার ডিসিশন চেঞ্জ করলাম। ভাবলাম এসিপির পুরো পরিবার একসাথে মা’র বো। আমার সাথে করা প্রত্যেক টা অন্যায়ের শাস্তি দিবো। কিন্তু তুমি বেচারা অফিসার এদের মাঝখানে এসে ফেঁসে গেলে।কি আর করার? হয়তো তোমার মৃ’ত্যু ও আমার হাতে ছিলো। মৃ’ত্যু’র জন্য প্রস্তুত হ‌ও সবাই। আমি কথা দিচ্ছি এদের কে মে’রে আমার প্রতিশোধ সম্পূর্ণ করার পর আমি নিজে সিআইডির কাছে আত্মসমর্পণ করবো। আমার সব অপরাধ স্বীকার করে নিবো। ”

-” কষ্ট করে তোমার সিআইডির কাছে যেতে হবে না।আমরা নিজেরাই চলে এসেছি‌ , মেয়েটার মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে বললো এসিপি সাইফুজ্জামান। অনেক নাকানিচোবানি খাইয়েছো আমাদের। কতো গুলো মেয়েকে তার বাবা মায়ের থেকে কেড়ে নিয়েছো। তাদের রাতের ঘুম হারাম করে দিয়েছো। এবার তোমার খেলা শেষ।আমরা তোমার খোঁজে অনেক আগেই পেয়েছিলাম। কিন্তু আমরা চেয়েছিলাম তোমাকে হাতেনাতে ধরবো। অপরাধী যতো চালাকি হোক না কেন কোনো না কোনো ভুল ঠিক করে। তুমি ও এর ব্যতিক্রম ন‌ও। যেদিন তুমি সাদ্দাম শিকদার কে রায়হান স্যারের ছবি আর ভিডিও পাঠাও সেদিন ভুলবশত তোমার নিজের নাম্বার থেকে ও একটা ছবি আসে। কিন্তু তখন তোমার নাম্বার বন্ধ পাই। তুমি ভেবেছিলে হয়তো সাদ্দাম শিকদার কে জেলে পাঠিয়ে দিয়েছি, এখন সিআইডি এই কেসের সমাপ্তি টেনে দিবে। বোকা ছিলে তুমি।আমরা ইচ্ছা করে সাদ্দাম কে ধরেছিলাম।যাতে করে তোমার উদ্দেশ্যে সফল হয়।আর তুমি খোলস ছেড়ে বাইরে বেড়িয়ে আসো।আর হলো ও তাই। তুমি তোমার ফোন নাম্বার এক্টিভ করলে।ব্যাস এরপর আমরা তোমার লোকেশন ট্র্যাক করি। তোমার সমস্ত ডিলেইলস বের করি। তুমি কখন কোথায় যাও ,কি করো , সবকিছুর উপর নজর ছিলো আমাদের।আর এতোক্ষণ তুমি এইখানে যা যা করছো আমরা সবটা দেখেছি সাহিত্যের কাছে থাকা ক্যামেরার মাধ্যমে। বাইরে আমাদের পুরো সিআইডি টিম রয়েছে।তোমার পালানোর সব রাস্তা বন্ধ। তাই তোমার জন্যে এটাই ভালো হবে যে নিজে মুখে সবটা স্বীকার করো। নিজের আসল চেহারা দেখাও রায়হান স্যার আর রায়সা ভাবী কে।তারাও দেখুক তাদের শুভাকাঙ্ক্ষী কে।”

-” মহিলা কে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে শিক্ষা বললো, ও এইভাবে কথা শুনবে না স্যার। আমি ওর মাস্ক খুলে দিচ্ছি বলে শিক্ষা এসে মহিলাটার মুখ থেকে মাস্ক খুলে নিলো। শিক্ষার সামনে থাকা মহিলা টি কে দেখে যেন শিক্ষার পরিচিত মনে হলো। শিক্ষার মনে হচ্ছে যেন তার নিজের কেউ। অথচ সে তাকে চিনে না। শিক্ষা একবার তার মায়ের দিকে তাকাচ্ছে আর একবার তার সামনে থাকা মহিলা টার দিকে। শিক্ষা তার হিসাব মেলাতে না পেরে নিজে মহিলা টির সামনে থেকে সরে গিয়ে তার মম কে উদ্দেশ্য করে বললো, এই মহিলা টা কে মম?”

-” রায়হান মীর , রায়সা মীর দুজনে মহিলা টার দিকে তাকিয়ে যেন চমকে উঠলো। রায়সা চিৎকার করে বলে উঠলো, তুমি??”

চলবে ইনশাআল্লাহ।।#মনের_উঠোন_জুড়ে

#পর্ব_৩০ [ রহস্যের উন্মোচন]

#লেখনীতে_নূন_মাহবুব

-” রাবিহা তুমি?”

-” আমাকে এইখানে এই অবস্থায় দেখে খুব অবাক হয়েছো তাই না এসিপি?আরো বেশি অবাক হবে এটা শুনে যে আমি রাবিহা ন‌ই।আমি রায়সা।যাকে তুমি ভালোবেসেছিলে। তোমার মনের উঠোন জুড়ে যার ছবি এঁকেছিলে, আমি সেই রায়সা। ”

-” কি বলছো কি তুমি? তুমি যদি রায়সা হ‌ও , তাহলে আমি যার সাথে এতো গুলো বছর সংসার করেছি সে কে ছিলো?”

-” এখনো বুঝতে পারছো না? নাকি বুঝেও না বোঝার ভান করছো এসিপি? ও রাবিহা । আমার দুই মিনিটের ছোট জমজ বোন।যে তার বড় বোনের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।তাকে ঠকিয়ে তার ভালোবাসার মানুষকে কেড়ে নিয়ে নিজে সংসার পেতেছে। তুমি ও ধোঁয়া তুলসী পাতা ন‌ও এসিপি? আমাদের তিন বছরের সম্পর্ক ছিলো।এই ছিলো তোমার ভালোবাসা? হ্যাঁ মানছি আমরা দুই বোন জমজ। হুবহু দেখতে এক‌ই রকম। কিন্তু তুমি তো আমাকে ভালোবাসতে তাই না? কেমন ভালোবাসা ছিলো তোমার যে নিজের ভালোবাসার মানুষ কে চিনতে পারলে না?তোমরা দুজনেই বিশ্বাসঘাতক,প্রতারক। তোমাদের বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই।আমি ভুল করেছি এতো দিন তোমাদের না মে’রে। এর‌ই মধ্যে শিক্ষা বললো, মা’রো নি ।তবে মৃ’ত্যু’র থেকে বেশি যন্ত্রণা দিয়েছো।”

-” এটা ওদের প্রাপ্য।”

-” শুধু মাত্র এইটুকু একটা বিষয় কে কেন্দ্র করে তুমি এতো গুলো মানুষ কে খু’ন করলে?”

-” না উষ্ণতা। একটা বিড়াল কখন চুরি করে খায় বল তো? যখন সে খাবার পায় না। পেটের দায়ে বাধ্য হয় চুরি করে খেতে। তেমনি একটা মানুষ ও খু’নী হয়ে মায়ের পেট থেকে জন্ম নেয় না।এই সমাজের মানুষ তাকে বাধ্য করে বা পরিস্থিতির চাপে পড়ে বাধ্য হয় খু’নী হতে। তেমনি আমি ও বাধ্য হয়েছিলাম এই পথ বেছে নিতে। রায়হানের সাথে আমার তিন বছরের রিলেশন ছিলো।আমরা দুজন দুজনকে খুব ভালোবাসতাম।যা রাবিহা সহ্য করতে পারতো না।রাবিহা ও রায়হান কে ভালোবাসতো।যেটা আমি পরে বুঝতে পেরেছিলাম। আমি রায়হান কে যতোটা ভালোবাসতাম তার থেকে বেশি ভালোবাসতাম তোর মম রাবিহা কে। রাবিহার জন্য সব করতে পারতাম।ও যদি একবার আমাকে মুখ ফুটে বলতো,সে রায়হান কে ভালোবাসে ,তাকে বিয়ে করতে চায়।আমি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে ওদের বিয়ে দিতাম। কিন্তু ও সেটা করে নি। আমার সব প্রিয় জিনিসের প্রতি ওর লোভ ছিলো। কিন্তু কখনো ভাবিনি আমার সবথেকে প্রিয় মানুষ টাকে ও কেড়ে নিবে।আর আমাকে বানিয়ে দিবে মানসিক ভারসাম্যহীন পাগল একজন সাইকো কিলার।”

-” এসিপির যেন বিশ্বাস হলো মহিলা টার কথা ।তিনি তার স্ত্রীর উদ্দেশ্যে বললেন,ও যা বলছে সব কি সত্যি? তুমি রাবিহা?”

-” তুমি বিশ্বাস করো ও মিথ্যা বলছে।নিজের কুকর্ম ফাঁস হয়ে গিয়েছে তো তার জন্য এখন আমাকে ফাঁসাতে চায়ছে। তুমি বিশ্বাস করো আমিই রায়সা বলার সাথে সাথে রায়হান তার গালে থা’প্প’ড় দিয়ে বললো , আমার তোমার প্রতি সেই বাসর রাত থেকেই সন্দেহ ছিলো। কেন জানি আমার বারবার মনে হচ্ছিলো তুমি আমার রায়সা ন‌ও। তুমি আমার কাছে একটা অপরিচিত ব্যক্তি মনে হচ্ছিলে। কিন্তু তুমি অনেক চালাক চতুর ছিলে। বিয়ের আগে আমি আর রায়সা যে কয়বার মিট করেছি , আমাদের মধ্যে তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে তুমি উপস্থিত হতে।তাই রায়সা যেভাবে আমার সাথে কথা বলতো,ওর যে ভাব ভঙ্গি তুমি সবটা রপ্ত করে নিয়েছিলে। এজন্যই আমি প্রথম প্রথম তোমাকে সন্দেহ করলেও পরে সেটা আমার মনের ভুল ভেবে উড়িয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু আজ বুঝতে পারছি তোমাকে বিশ্বাস করে আমি কতো বড় ভুল করেছি। কেন করলে এমন টা তুমি? কেন আমার আর রায়সার বিশ্বাস নিয়ে খেললে রাবিহা?”

-” কি করতাম আমি? বড্ড ভালোবাসতাম যে তোমাকে।আর ভালোবাসার জন্য মানুষ সব করতে পারে। এজন্যই বলা হয়েছে এভরিথিং ইজ ফেয়ার ইন লাভ এন্ড ওয়ার।আমি আর আপু জমজ ছিলাম। দুজনে সেম এক রকম দেখতে। তবু ও তুমি কখনো আমার দিকে তাকিয়ে ও দেখতে না।যা আমার ইগোতে লাগতো।নিজে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে বলতাম, আপুর মধ্যে কি এমন আছে যা আমার মধ্যে নেই? এমনকি বাবা মাও আপুকে বেশি ভালোবাসতো। সবকিছু মিলে দিন দিন আপুর প্রতি আমার হিংসা বাড়তে থাকে।তোমাকে আপুর সাথে দেখলে মনে হতো আমি আপুকে খু’ ন করে ফেলি। আমি ভাবতে থাকি কিভাবে আপুকে তোমার জীবন থেকে সরিয়ে দেওয়া যায়। ঠিক তখনই আমার মাথায় একটা ‌বুদ্ধি আসে।আমি ভাবলাম আমার এই বুদ্ধি টা যদি লাগাতে পারি তাহলে বাবার সব সম্পত্তি আমার হবে আর সাথে তুমি ও। আপুর মাথায় একটু সমস্যা ছিলো। যা শুধু মাত্র আমি জানতাম। মা বাবা টেনশন করবে দেখে আপু এই ব্যাপার টা কাউকে বলে না। এমনকি তোমাকে ও না‌। আমি এই সুযোগ টা কাজে লাগিয়ে দিলাম।আপুকে মাথার ঔষধের নাম করে ভুল ঔষধ দিতাম। অনেক বেশি পরিমাণে ইনজেকশন পুশ করতাম। ভুল ঔষধ প্রয়োগের এক পর্যায়ে আপু মনোব্যাধি বা সাইকোসিসে আক্রান্ত হয়।যার কারণে আপুর বিচার বোধ , ইচ্ছাশক্তি, কর্মক্ষমতার গুরুতর গোলযোগ ঘটে থাকে। আমি সবার কাছে নিজেকে রায়সা প্রমাণ করতাম। সবাই কে এটাই বোঝাতাম যে রাবিহা মনোব্যাধি তে আক্রান্ত হয়েছে।দিন দিন আপুর পাগলামি বাড়তে থাকে।আপু গরু ছাগলের তাজা কলিজা খেতে শুরু করে।এক পর্যায়ে আপুকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হয় উন্নত চিকিৎসার জন্য।আর সেই সুযোগে আমি রায়সা হয়ে তোমাকে বিয়ে করে ফেলি। তুমি সিআইডি মানুষ , অনেক বুদ্ধি, বিচক্ষণতা দিয়ে কাজ করতে। অনেক সময় আমাকে সন্দেহ ও করতে। কিন্তু আমি তোমাকে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে সেই সন্দেহ দূর করে দিতাম। আমি ভেবেছিলাম আপু হয়তো কখনো আর ফিরবে না। কিন্তু আমার কপাল পোড়াতে আবার ঠিক ফিরে এসেছে।”

-” ছিঃ রাবিহা ছিঃ। আমি তোকে কতো ভালোবাসতাম। আমার সেই ভালোবাসার এই প্রতিদান দিলি তুই? আমার জীবন থেকে সাত আট টা বছর কেড়ে নিলি? বঞ্চিত করলি শেষ বারের ‌মতো বাবা মায়ের মুখ টা দেখা থেকে। আমি সুস্থ্য হয়ে দেশে ফিরেছিলাম ছদ্মবেশ ধারণ করে। ভেবেছিলাম সবাই কে সারপ্রাইজ দিবো। কিন্তু দেশে এসে আমি সবকিছু শুনে নিজেই বাকরুদ্ধ হয়ে যাই। তখন সবটা আমার কাছে স্বচ্ছ কাঁচের মত পরিস্কার মতো যাই। আমি বুঝতে পারি কেউ ইচ্ছা করে আমাকে মানসিক রোগী বানিয়েছিলো। কিন্তু কে করেছিলো সেটা শিওর ছিলাম না। হঠাৎ করে তোর কথা আমার মাথায় আসে।তোর প্রতি আমার সন্দেহ হয়। আমি জানতাম তোর একটা অভ্যাস ছিলো তুই প্রতিদিন যা কিছু করতি সেটা একটা ডায়েরী তে লিখে রাখতি। আমি সারা বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজে তোর ডায়েরী বের করি।আর সেইখান থেকে তোর আসল চেহারা আমার সামনে আসে। প্রতিশোধের আগুন জ্বলে উঠে আমার বুকে।আমি বসে বসে মাস্টারপ্ল্যান সাজাতে লাগলাম কিভাবে তোদের কে মা’রা যায়। আমার প্ল্যান অনুযায়ী আমার লোক দিয়ে তোদের কে কিডন্যাপ করলাম। কিন্তু এসিপি চালাকি করে উষ্ণতা কে লুকিয়ে রেখে আমাকে মিথ্যা কথা বললো যে উষ্ণতা গাড়ি এক্সিডেন্ট করে মা’রা গিয়েছে। যেহেতু আমার লোকেরা উষ্ণতা কে গাড়ির সাথে ধাক্কা লাগতে দেখেছিলো ,তাই আমি ও বিশ্বাস করি যে উষ্ণতা মা’রা গিয়েছে। প্রথম প্রথম আমি চেয়েছিলাম তোদের কে মে’রে ফেলতে।পরে তোদের কষ্ট পেতে দেখে, প্রতিনিয়ত মৃ’ত্যু,র যন্ত্রণায় ছটফট করতে দেখে আমার আনন্দ হতো। আমি আমার দুঃখ ভুলতে পারতাম।তাই আর তোদের কে মা’রি নি‌। তোদের কে যেইখানে আটকে রাখা হয়েছিলো সেইখানে সিসি ক্যামেরা লাগানো ছিলো।আমি সবসময় তোদের সব কথা শুনতাম।আর একদিন তোরা বললি যে তোদের মেয়ে বেঁচে আছে। কিন্তু কোথায় আছে ,কার কাছে আছে এটা তোরা বলিস নি। উষ্ণতার জন্মের সময় আমি যেহেতু দেশের বাইরে ছিলাম যার কারণে উষ্ণতা কে কখনো দেখা হয় নি।তাই আমি ওকে চিনতে পারি নি। প্রতিশোধের আগুনে পুড়ে ওর জায়গায় চার টা নিরাপরাধ মেয়েকে খু’ন করি বলে কাঁদতে লাগলো রায়সা।রায়সা কে কাঁদতে দেখে এসিপি সাইফুজ্জামান এগিয়ে এসে বললো,

-” হ্যাঁ মানছি তোমার সাথে যা হয়েছে ভুল হয়েছে। কিন্তু তুমি প্রতিশোধ নিতে গিয়ে চার চার টা মেয়েকে খু’ন করেছো।চার জন মায়ের কোল খালি করছো। এসিপি আর তার ওয়াইফ কে দিনের পর দিন আটকে রেখে তাদের কে মা’রা’র চেষ্টা করেছো। আদালত তোমাকে ক্ষমা করবে না। ফাঁ’সি’র উপরে যদি আরো কোনো বড় শাস্তি থাকতো , আদালত হয়তো সেই শাস্তি টায় তোমাকে দিতো। সাইফুজ্জামানের কথা শুনে উষ্ণতার মম রাবিহা বললো, হ্যাঁ স্যার ঠিক বলেছেন। ও যা করেছে ওর ফাঁ’সি হ‌ওয়া উচিত। আমাদেরকে দিনের পর দিন কষ্ট দিয়েছে।প্রতিটা ক্ষণ ,প্রতিটা মূহুর্তে মৃ’ত্যু’র যন্ত্রণায় ছটফট করেছি।ওর মুখ দেখতে ও আমার ঘৃণা লাগছে।ওকে আমার সামনে থেকে নিয়ে যান স্যার।”

-” আপনি ও ধোঁয়া তুলসী পাতা নন ভাবী। আপনার জন্যেই রায়সা খু’নী হয়েছে।আপনি কিভাবে পারলেন নিজের বোনের সাথে এমন টা করতে? আপনাকে ও আমাদের সাথে যেতে হবে।এই কেসে আপনারা দুজন ই অপরাধী।”

-” আমি একজন এসিপির ওয়াইফ এটা জানার পরেও আপনি আমাকে এসব কথা বলছেন?আর রায়হান আপনি কিছু বলছেন না কেন?”

-“তুই যা করেছিস এটা তোর প্রাপ্য।তোকে আমার স্ত্রী বলে পরিচয় দিতেও ঘৃণা লাগছে আমার।”

-” আমার ভুল হয়েছে। আমাকে প্লিজ ক্ষমা করে দিন।আমি যা করেছি আপনাকে পাওয়ার জন্য করেছি।”

-” আমি তোর মতো বিশ্বাসঘাতক কে ক্ষমা করলেও আইন তোকে ক্ষমা করবে না।আইন সম্পর্ক চিনে না। আইনের চোখে সবাই সমান অপরাধী। এখন যা বাকি জীবন জেলে বসে বসে নতুন নতুন বুদ্ধি বের কর।”

-” রাবিহা রায়হানের থেকে আশানুরূপ ফল না পেয়ে শিক্ষা কে জড়িয়ে ধরে বললো, তুই কিছু বলবি না মা? আমি তোর নিজের মম।তোকে দশ মাস দশ দিন আমার গর্ভে ধারণ করেছিলাম।”

-” শিক্ষা চোখের পানি মুছে বললো, কারো মা এতোটা নিকৃষ্ট হয় আমার জানা ছিলো না মম। ভেবেছিলাম এতো গুলো বছর তোমার মাতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত ছিলাম। এখন প্রাণ ভরে তোমার আদর ভালোবাসা নিতে পারবো।আগের মতো হাসিখুশি থাকবো আমরা সবাই। কিন্তু সব জানার পর এখন নিজেকে তোমার গর্ভের কলঙ্ক মনে হচ্ছে। তোমার জন্য কতো গুলো জীবন নষ্ট হয়ে গেলে। অপরাধ যখন করছো তখন শাস্তি তো পেতেই হবে। এখন যাও গিয়ে নিজের কর্মফল ভোগ করো বলে শিক্ষা নিজেকে তার মমের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললো, এসিপি স্যার নিয়ে যান আমার মম নামের নিকৃষ্ট মহিলা কে।”

-” সাইফুজ্জামান তাদের দুই বোনকে হাতকড়া পরিয়ে রুমের বাইরে পা রাখবে এমন সময় শিক্ষা কিছু একটা ভেবে বললো,

-“এক মিনিট এসিপি স্যার। আমার কিছু বলার ছিলো।”

-” বলো মা কি বলতে চাও?”

-” অন্যায় যে করে তার শাস্তি হয় এটা আমরা সবাই জানি। কিন্তু যে এই অন্যায় করতে সাহায্য করে বা যারা এ কাজের সাথে যুক্ত তাদের কি শাস্তি হ‌ওয়া উচিত?

-” অবশ্যই। অপরাধী কে অপরাধ করতে সাহায্য করা,তার অপরাধ লুকিয়ে রাখা ও এক ধরনের ক্রাইম।তার ও শাস্তি হবে।”

-” তাহলে আসামীর সংখ্যা তো আরো একটা বেড়ে গেলো এসিপি স্যার।জেলে এখন দুজন নয় , বরং তিন জন যাবে।”

-” আরো একজন? কিন্তু কে সে?”

-” সে এইখানে আমাদের মধ্যেই উপস্থিত আছে।সে বাইরের কেউ নয় বরং সিআইডি অফিসারদের মধ্যেই একজন।এক কথায় যাকে বলে ঘরের শত্রু বিভীষণ।”

চলবে ইনশাআল্লাহ।।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here