মন গহীনের গল্প পর্ব -০৬

#মন_গহীনের_গল্প
পর্ব-৬
#রূবাইবা_মেহউইশ
_________________
বড় বড় শপিংমল গুলোতে কোন একদিন শপিং করবে এমন স্বপ্ন মেহউইশের খুব পুরনো। বাবা বেঁচে থাকতে কত জেদ করতো বাজেট ধরে কেনাকাটা করবে। জামার দাম পাঁচ হাজার জুতো হবে দু হাজার, কসমেটিক হবে তিন হাজার এমন সব বাজেটে ঠিক করতো সে। কিন্তু বাবার সাধ্য অত বেশি ছিলো না। ঈদ এলে দু ভাই বোনের কাপড়,জুতা,চুড়ি,দুল সব মিলিয়ে পাঁচ কি ছয় হাজারেই ঈদ শপিং হতো। অথচ সেই মেহউইশ আজ সতেরো হাজার টাকার একটা শাড়ি কিনলো। শুধু মাত্র হাত রেখেছিলো সে শাড়িটাতে তাতেই তার তিনদিন ধরে হওয়া স্বামী শাড়ি তার নামেই কিনে নিলো৷ এদিকে জুতোও নিলো শখ পূরণ করে পাঁচ হাজার টাকায়। ভাবতেই অবাক লাগে মেহউইশের বাড়িতে পরার জন্য একসাথে আট, দশটা ড্রেস কেনা হয়ে গেছে। অথচ একটা দোকানও ঘোরাঘুরি করতে হয় নি। বিশাল এক দোকানে নিয়ে এলো রিশাদ। দোকানের কাঁচের দরজাটা খুলতেই পারেনি মেহউইশ । অবশ্য সেখানকার গার্ড নিজেই এগিয়ে এসে খুলে দিলো৷ তখন মেহউইশের নিজেকে কোন এক বিশাল প্যালেসের রাণী বলে মনে হচ্ছিলো।স্বপ্ন কি এমন করেই পূরণ হয়! এক স্বপ্নের কাঁধে পা রেখে অন্য স্বপ্ন পূর্ণ হয়? নাকি আগে দেখা স্বপ্নগুলো আগে পূরণ হয়? এতসব বাজেটকরা কেনাকাটার স্বপ্ন তার শৈশবের। কৈশোরে শুধু ভালোভাবে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখতো আর এখন! ভালোবাসার মানুষের সাথে বেঁচে থাকার স্বপ্ন। রিশাদের ভয়ে ভীত,সন্ত্রস্ত থাকা মনটা আনমনেই চঞ্চল হয়ে উঠলো। মন বলল পূরণ হবে স্বপ্ন সব এক এক করে। এখন এটা পূরণ হচ্ছে পরে নিশ্চয়ই ভালোভাবে খেয়ে,পরে বেঁচে থাকার এরপরই ভালোবাসার মানুষের সাথে থাকার। ইভান কি ততদিন অপেক্ষা করবে তার জন্য? আর রিশাদ! সে কি মুক্ত করে দেবে? মেহউইশ ভাবনার অতলে ডুবে যাচ্ছিলো। সেই অতল থেকে টেনে তোলার জন্যই বুঝি নির্জন কেঁদে উঠলো। শপিং শেষ হলে আর এক সেকেন্ডেও দেরি করতে চায়নি রিশাদ তাই দ্রুতই বাড়িতে ফিরতে হলো। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছিলো রাস্তাঘাট ডুবে একাকার। শহরতলীর রাস্তায় নিয়ন বাতির হলদে আলোয় বৃষ্টির ফোঁটা কি দারুণ লাগছিলো। ফুরফুরে মনে এক চাপা কষ্ট তখন মেহউইশের চোখে যন্ত্রণার ছাপ।

কাজকর্ম সব যেন মেহউইশের সাথেই শেষ হয়ে গেছে ইভানের। সকাল-সন্ধ্যা মাইমুনা বেগমের কাছে হাতজোড় করেই তার দিন যাচ্ছে । মিহাদটা পর্যন্ত মুখ খোলেনি। ইভান দিকবিদিকশুন্য মানুষের মত উন্মাদ আচরণ করছে। বারবার শুধু মেহউইশের ঠিকানা চাইছে কিন্তু কিছুতেই মাইমুনা মুখ খোলেননি। মেয়ের নতুন জীবন,গোছানো সংসার সামনে সেটা কিছুতেই তিনি নষ্ট করতে চান না। আজও সন্ধ্যা থেকে ইভান বসে আছে মেহউইশের মায়ের কাছে। তিনি আজ আর কথাও বলছেন না। মিহাদ পড়তে বসবে বলে নিজের ঘরে গিয়ে দোর দিয়েছে। সাতটা,আটটা,নয়টা করে দশটা যখন ঘড়ির কাটায় তখন আর ইভান নিজেকে ঠিক রাখতে পারলো না। চিৎকার, চেঁচামেচি শুরু করলো এক পর্যায়ে মেহউইশের মায়ের ঘরে যেখানে ইভান বসেছিলো সেই খাটের কার্নিশে রাখা মেহউইশের ফটো ফ্রেমটা উঠিয়ে আছাড় মারলো। কাঁচের হওয়ায় মূহুর্তেই ঝনাৎ করে ভেঙে গেল ফ্রেমটা। সেই কাঁচেই ইভান নিজের হাতের শিরা কাটলো। মাইমুনা ফ্রেম ভাঙার শব্দেই রান্নাঘর থেকে বেরিয়েছিলেন৷ ইভানের হাতের দিকে তাকিয়ে ভয় পেয়ে গেলেন। বাইরে বৃষ্টির তেজ কম কিন্তু বাতাস অনেক৷ কি করবেন কি করবেন না ভেবে না পেয়ে ফোন নিয়ে মেহউইশের নতুন নাম্বারে ডায়াল করলেন এবং ওপাশ থেকে রিসিভ হতেই তিনি এক নাগাড়ে বলে গেলেন ইভানের কথা৷ কথা শেষ হতেই ফট করে কল কেটে গেল৷ কিন্তু বিধিবাম, তিনি জানেনই না কথাগুলো কে শুনেছে।যাকে শোনাতে বলছে আদৌও সে শুনেছে কিনা!

রাতে খাবার টেবিলে আসতেই মেহউইশ অবাক হলো বেশ। টেবিল জুড়ে বরাবরের মতোই অনেক পদের খাবার কিন্তু যেটুকু বোঝা গেল বেশিরভাগই মেহউইশের প্রিয় খাবার। চোখ ছানাবড়া একদম এতোগুলো প্রিয় খাবার একসাথে! কিন্তু তার প্রিয় খাবার এভাবে কেন আর এ বাড়িতে কারো জানা নেই তার প্রিয় অপ্রিয় খাবার।নাকি ব্যপারটা কাকতালীয়? তাতে আমার কি! আমি তো পেট পুরে খাবো এখন। মনে মনে এমনটাই ভাবছিলো মেহউইশ। সেই ভাবনার বন্দরে নাও ভিড়িয়ে রিশাদের আগমন৷ আলতো করে কাঁধ ছুয়ে ইশারা করলো বসতে এবং ম্যানারস ফলো করে রিশাদ নিজেই স্ত্রীর জন্য চেয়ার টেনে দিলো নিঃশব্দে। আজ রিশাদের আচরণ মেহউইশের খুবই ভয়ংকর লাগছে। ঝড়ের আগে থম মেরে থাকা আবহাওয়ার স্বরূপ৷ এতোটা পরিবর্তন মেহউইশের দ্বিগুণ ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ালো। তবুও চুপচাপ বসে পড়লো চেয়ারে। পুরো ডাইনিং স্পেসে নজর বুলিয়ে দেখলো একজন কাজের লোক পর্যন্ত নেই এখানে৷ কি আজব! অন্যসময় খেতে এলেই দু জন মহিলা এপাশে ওপাশে উপস্থিত থাকে। একের পর এক অর্ডার ফলো করে অথচ আজ এত সুনশান ঘুমন্তপুরী লাগছে কেন? মেহউইশ খেয়াল করলো বাড়ি ফিরে আসার পর নির্জনকেও আর তার কাছে দেওয়া হয় নি৷ বরং রাইমা আজ বারবার বলছে নির্জন তার কাছেই থাক৷ মেয়েটাও অনেক আদর করে একমাত্র ভাতিজাটাকে৷ আর সেই সৎ শ্বাশুড়ি! উনি কোথায় আজ? রিহানকেও দেখা গেল না৷ রিশাদ প্লেট এগিয়ে দিলো মেহউইশকে পরে আবার সেই প্লেট সরিয়ে বলল, ‘কিছু মনে করো না আমি নিজে হাতে খাইয়ে দেবো তোমায়।’ খালি গলায়ই বিষম খেলো মেহউইশ৷ কাওয়ার আগেই গলায় কিছু আটকে গেল। কি আটকালো? ভয়! বাড়ির গত দু দিন সে আবহাওয়া দেখেছে আজ তার সম্পূর্ণ বিপরীত। কারণ কি! খাবারে কি বিষ আছে? তাকে কি এই দানব আজ মেরে ফেলবে? যে থাপ্পড় সে মেরেছিলো এটাই কি তার প্রতিশোধ । মুভিতে এমন অনেক দেখেছে বড়লোকের ছেলে মেয়েরা প্রতিশোধ নিতে এমন আদর যত্ন করে। সেখানে এমনই বড় বড় ডুপ্লেক্স বাড়ি থাকে৷ এত চাকর বাকর থাকে। অথচ যখন নায়ক বা নায়িকাকে বিষ খাওয়ায় তখন কাউকে পাশে পাওয়া যায় না।

‘হা করো।’ মেহউইশ যখন ভয়ে মুভির কাহিনি নিয়ে ভাবছিলো তখন রিশাদ খাবার মেখে তার মুখের সামনে ধরলো। সাদা ভাত, গরুর কষা মাংস সাথে কাঁচা পেঁয়াজ আর কচি দেখে কাচা মরিচ প্লেটে। না চাইতেও জ্বিভে পানি এলো মেহউইশের। এমন খাবার খেয়ে মরে গেলেও শান্তি। আহ্! এত সুখ সে কই রাখবে৷

ভয় মনে তবুও হা না করে উপায় নেই। রিশাদের চেহারাটা দারুণ। বাপের কোটি কোটি টাকার কারণেই হয়তো এত সুন্দর ফিটনেস। টাকা থাকলে নাকি বাঘেরও চোখ কেনা যায়। রিশাদের এই রুপ সৌন্দর্যও হয়তো টাকার জোরেই। খেতে খেতে হাজারো ভাবনায় ভাসতে থাকে সে। আর রিশাদ চুপচাপ খাইয়ে দিতে লাগলো। মেহউইশের খাওয়া শেষ হতেই রিশাদ তাকে ঘরে যেতে বলল। সে নিজের খাওয়া হলে ঘরে আসবে। মেহউইশ চলে যেতেই খাওয়া ছেড়ে উঠে গেল রিশাদও। পকেট থেকে ফোন বের করে কাউকে কল দিলো। ওপাশ থেকে কিছু বলতেই রিশাদ বলল, ‘ যতটুকু খরচ লাগে দিয়ে দাও। ম্যানেজারকে বলে দিয়েছি। আর কালকের মধ্যে ওদেরও শিফট করো। আর কাকপক্ষীতেও যেন টের না পায় নতুন ঠিকানা।’

রাত যত বাড়ছে বৃষ্টিও তত বাড়ছে। বৃষ্টির ছাঁটে বারান্দা ভিজে চপচপে। বেখেয়ালে পা পড়লেই পিছল খাবে ভাব। তবুও মেহউইশের ইচ্ছে হলো একটু বারান্দায় দাঁড়াতে। নিজের বাড়িতে দু ঘরের এক ফ্ল্যাটে ঠিকঠাক পা ফেলার জায়গাটুকুও নেই। আর এখানে কি বিশাল বারান্দা,বাথরুম আবার বাড়ির নিচেও কত বড় বাগান। ইশ, মা আর মিহাদ যদি থাকতে পারতো এখানে।বৃষ্টিতে গেছে পুরো শরীর । অসময়ের বৃষ্টিতে ভিজতে ভালো লাগছে একটু শীত শীতও লাগছে। মনের যত দুশ্চিন্তাকে এই বৃষ্টির জলে ধুয়েমুছে একাকার করে দেওয়ার এক অসম্ভব ইচ্ছে জাগছে। সে ইচ্ছেকে পূরণ করতেই বুঝি মেহউইশ তার দুটো হাতই বারান্দার বাইরের দিকে বাড়িয়ে দিলো। আর তখনি অনুভব হলো কোমড়জুরে এক জোড়া শক্ত,পুরুষালী উষ্ণ হাতের ছোঁয়া। এই ছোঁয়া বিশ্রী এতে কামনার আভাস স্পষ্ট। দেহের ভেতর আত্মাটা খাঁমচে ধরলো দেহকে যেন এই মূহুর্তেই কেউ টেনে হিঁচড়ে বের করে নিতে চাইছে তাকে।

চলবে

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here