মন গহীনের গল্প পর্ব -১৭+১৮

#মন_গহীনের_গল্প
পর্ব-১৭
#রূবাইবা_মেহউইশ
💞

‘হাওয়ায় ভেসে একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছে দেহটা’ এমনই অনুভূতি। রিশাদের বাজু চেপে তারই বুকের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেহউইশ। শার্টের খোলা বোতামটাতেই চোখ থেমে আছে। বোতামখানা লেগে থাকলে কি এমন সমস্যা হতো! এত ফর্সা বুকটা এভাবে উন্মুক্ত রেখে কোন নারীকে এত কাছে থেকে আকর্ষিত করাটা অন্যায়।মনে মনে প্রমাদ গুণছে মেহউইশ। যার কোলে চড়ে সে গন্তব্যে ফিরছে তারই নগ্ন বুকে কু দৃষ্টি! ভাবতেই তো ভয় লাগা উচিত যা ভয়ংকর এই লোকের হাতের একেকটা থাপ্পড়৷ চোয়ালের দাঁত মাড়ি সবই তো নাড়িয়ে দিয়েছিলো এই লোকটা। ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘরে পৌঁছে গেছে তারও খেয়াল নেই। রিশাদ তাকে বিছানায় আধশোয়া করে বসিয়ে দিলো । আনতুং প্রতিবেশী মেয়েটাকে পৌঁছে দিতে মেয়েটার সাথে গেল। রাস্তায় যখন তারা দূর্ঘটনায় পড়ে তখন রাস্তা ফাঁকা ছিলো। দ্বিতীয় গাড়িটা নিচে থেকে শুধু রিশাদেরই আসছিলো তা দেখে আনতুংও হাতে ইশারা করলো গাড়ি থামাতে যেমনটা মেহউইশ করছিলো কিছুক্ষণ আগে। রিশাদ দূর থেকেই খেয়াল করেছে রাস্তায় দু’জন বসে আছে। যতটুকু বোঝা গেল তারা ব্যাথা পেয়েছে। সামনে এসে গাড়ি থামাতেই চোখে পড়লো খয়েরী আর সাদার মিশেলে সেলোয়ার-কামিজ পরা মেহউইশকে। জ্ঞান নেই পরে আছে নিথর দেহটা। পাশেই আছে পাহাড়ি অন্য মেয়েটি সেও পায়ে ব্যথা পেয়েছে মেহউইশের চেয়েও বেশি অথচ মেয়েটির চেতনা আছে। রিশাদ মেহউইশকে টেনে কোলে তুলে নিতেই আনতুংকেও ইশারা করলো মেয়েটিকে ধরে গাড়িতে বসাতে। আনতুংও তাই করলো গাড়ির পেছনের সিটে মেয়েটিকে নিয়ে বসলো। রিশাদ গাড়ি ঘুরিয়ে চেনা হাসপাতালের দিকে এগোলো। সারাপথ সে কোন রা করেনি আনতুংও রিশাদের গম্ভীর মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলার সাহস পায়নি। হাসপাতালে এনে ঘন্টা দুই পার করে তবেই জ্ঞান ফিরলো মেহউইশের অন্যদিকে প্রতিবেশী মেয়েটির ট্রিটমেন্ট শেষে তারা আরো আগেই বাড়ি চলে গেছে।মেহউইশের জ্ঞান ফেরার পরও রিশাদ কথা বলেনি৷ সে চুপচাপ মেহউইশকে কোলে তুলে নিয়ে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে গাড়িতে বসালো। ড্রাইভ করলো, বাড়ি ফিরলো, আবারও কোলে তুলে ঘরে নিয়ে এলো। এত সময়ে মেহউইশ কত কি ভেবে বসলো। রিশাদ হাসপাতালের বিল না দিয়ে এলো কেন? কেউ তাকে আটকালোও না! আবার তাকেই কোন প্রশ্ন করলো না কেন! ধুর মেহউইশ তুই কি চাস এই দানব এখন তোকে পা ভাঙার দায়ে দুটো থাপ্পড় লাগাক! নিজেই নিজেকে বকতে লাগলো মেহউইশ এসব বলে।

-‘পায়ের কি হাড় ভেঙে গেছে?’ ফুপুর কথা শুনে দরজার দিকে তাকালো মেহউইশ। রিশাদ ফুপুর কোল থেকে নির্জনকে নিয়ে দু হাতে বুকে জড়িয়ে ধরেছে।বুকের ভেতরে তোলপাড় যা ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে মুখটাকেই মলিন করে দিয়েছে। এখন আর রিশাদকে দানব কিংবা ভয়ংকর বলে মনে হচ্ছে না তার। দিনভর রাগ আর ক্ষমতার মুখোশ পরে থাকা লোকটাকে এই মুহূর্তে খুব সাধারণ দুঃখী পিতা বলে মনে হচ্ছে । ফুপুর কথার জবাবে রিশাদ বলল, ‘সামান্য ফ্র্যাকচার ঠিক হয়ে যাবে দু একদিন রেস্টে থাকলেই। এক্সিডেন্ট আসলে অন্য মেয়েটির হয়েছে তা দেখেই ইনি জ্ঞান হারিয়ে বেকায়দায় পড়ে মচকেছে।’ রিশাদের কথা শুনে কপাল কুঁচকে এলো মেহউইশের৷ লোকটা কি ব্যঙ্গ করে কথা বলল, আশ্চর্য! যত যাই হোক চোখের সামনে এত বড় দূর্ঘটনা সে তো হাসপাতালে থেকেও কখনও দেখেনি৷ আবার মনে পড়লো হাসপাতালে রোগী আসে এক্সিডেন্ট তো আর হাসপাতালে হয় না।ফুপু এসে পাশে বসলেন, মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন কিছুক্ষণ আবার গরম পানির সেকও দিলেন। কিন্তু রিশাদ আর একবারও ঘরে আসেনি। রাতের খাবার ফুপু ঘরে দিয়ে নির্জনের দরকারি জিনিসপত্র এসে নিয়ে গেলেন। রাতে নাকি রিশাদ নির্জনকে নিয়ে ফুপুর ঘরেই ঘুমাবে আর ফুপু মেহউইশের সাথে। আনতুং আজ আর আসবে না সে তার বাড়িতেই থাকবে।

সকাল সকাল আজকাল খান বাড়িতে কেউ জাগে না৷ আগে রিশাদ উঠতো ভোরে তারপর দৌড়াতো,ব্যায়াম করতে এখন সে নেই৷ জেবুন্নেসানামাজ পড়েন আজকাল নিয়মিত কিন্তু ফজর নামাজের পর আর ঘর থেকে বের হন না৷ একেবারে নাস্তার জন্যই নয়টায় বের হন৷ ততক্ষণে রিহান স্কুলে আর রাইমার ক্লাস থাকলে কলেজে যায়। বাড়ির চেহারা আগের চেয়ে অনেকটাই বদলে গেছে। কাজের লেকগুলো নিজেদের খেয়ালখুশি মত রান্না করে খায়৷ জেবুন্নেসা একন আর কাউকে কড়া কথা শোনান না। আজ সকালে রাইমা রিশাদকে কল দিয়ে কথা বলছিলো জেবুন্নেসা শুনতে পেয়ে দৌড়ে এলেন মেয়ের সামনে।

‘রিশুর সাথে কথা বলছিস?’ খালার বলা কথা ফোনের ওপাশে রিশাদের কানে গেল৷ হঠাৎ একরাশ প্রশান্তি মনজুড়ে আনন্দিত পাখির মত পাখা মেলল। বহুদিন পর সে খালার মুখে সেই আদুরে নাম শুনলো নাকি বহুবছর পর!

-আমাকে ফোন দে কাল সাপের বাচ্চা। আমার সাথে লুকোচুরি শুরু করেছিস চৌদ্দ গুষ্টি মিলে তাই না! প্রত্যেকটাকে দেখে নিবো আমি। জেবুন্নেসা রাইমাকে বকতে বকতে তার হাত থেকে ফোনটা এক প্রকার কেঁড়েই নিলো।

-‘রিশাদ তুই কোথায় আছিস বাবা নির্জন কেমন আছে? তোর ব্যাংক একাউন্ট বা অন্য কোন ওয়ে থাকলে বল আমি এক্ষুনি টাকা পাঠাবো তোকে। আমি সব জানি ওই কালসাপ আবার তোর সাথে কিছু করেছে। সত্যি করে বল বাবা তুই ঠিক আছিস তো?’ জেবুন্নেসা একদমে বলতে লাগলেন। রিশাদ চুপচাপ শুনে গেল সব। বহুদিন পর মনে হলো ইনি তার সৎ মা নয়। খুব কাছের কেউ ; মায়ের বোন খালা যে মা সমান তা যেন খালার এই দুশ্চিন্তা করা দেখেই আজ মনে হচ্ছে। সকল চিন্তা এবার এক নিমেষেই যেন হালকা হয়ে গেল।

– ‘আমার টাকা লাগবে না। রাইমা বলল আপনি ডিভোর্সের জন্য এপ্লাই করেছেন৷ এই বয়সে ব্যাপারটা আপনাদের জন্য ভালো হলেও রাইমা আর রিহানের জন্য ক্ষতিকর। মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, সামাজিকভাবেও বাড়ির বাইরে অস্বস্তিতে পড়বে।’

কথা শেষ করে রিশাদ কল কেটে দিলো৷ জেবুন্নেসা হতাশ হলেন রিশাদ তাকে নির্জনের কথা কিছুই জানায়নি মন খারাপ হয়ে গেল ভাবতেই। রাইমা পাশ থেকে বলল, ‘ তোমার পেটের সন্তান কি আমরা নাকি দাদাভাই?’

-‘কেউ না’ বলেই জেবুন্নেসা ধীর পায়ে নিজের ঘরে চলে গেলেন। রাইমা দাঁড়িয়ে থেকে চেয়ে রইলো মায়ের যাওয়ার পথে। অদ্ভুত লাগে মাকে খুব তার। মা টা তাদের দু ভাইবোনকে সবসময় কালসাপের বাচ্চা বলে বাবাকেও কালসাপ বলে।কিন্তু দাদাভাইকে তিনি কখনোই এমন বলেন না অবশ্য সামনাসামনি কথা হলে বরাবরই বাঁকা কথা শোনাতেন। আর ফুপি! ফুপিকেও মা কাল নাগিনী বলে লুকিয়ে লুকিয়ে বকেন। এমন কেন তাদের মা সবসময়ই উল্টো আচরণ করেন? কই তার আশেপাশের আর কারো মা তো এমন করেন না। সে বোঝে বাবার মায়ের সম্পর্কের মাঝে কোন ঝামেলা আছে কিন্তু সেটা কি! আজকাল ডিভোর্সের জন্যও উঠেপড়ে লেগেছে তারা আর এজন্যই রাইমা দাদাভাইকে ফোন করেছিলো। কিন্তু তার কথা শুনে দাদাভাই কি রিয়াক্ট করলো তা সে জানতেই পারলো না।

আজকে রিশাদ অফিসে যাওয়ার আগেই মেহউইশ ঘুম থেকে উঠেছিলো। রিশাদ বের হওয়ার আগে হাতে একটা বড়সড় বক্স রেখে গেছে। অন্যদিকে মুখ রেখেই বলেছে, ‘পা নিয়ে হাটতে পারলে বিছানা ছেড়ে এগুলো সব ট্রাই করে দেখে নিও। আনফিটেডগুলো আলাদা করে রেখো ফেরত পাঠানো হবে।’ মেহউইশ বক্সে কি আছে তা নিয়ে ভাবার আগে তার ভাবনায় এলো রিশাদের কি কিছু হয়েছে? গতকাল থেকে তার আচরণে এত শীতলতা কেন? এটা কি ঝড়ের পূর্বাভাস নাকি সত্যিই কোন পরিবর্তন! ভাবনা শেষ হওয়ার আগেই তার ফোন বাজলো মা কল দিয়েছে। রিসিভ করতেই কানে এলো মিহাদের উচ্ছ্বসিত কন্ঠ৷ সে আজ নতুন স্কুলে যাবে । তার ভর্তি কনফার্ম হয়েছে সে ওখানকার খুব বড় এক স্কুলে ভর্তি হয়েছে। নতুন ব্যাগ,জুতা,ইউনিফর্মও নাকি রেডি৷ মিহাদ ফোন মায়ের হাতে দিতেই এবার কানে এলো মায়েরও আনন্দিত কন্ঠ৷ রিশাদ সব ব্যবস্থা করে দিয়েছে তাদের জন্য৷ কোন কিছুরই কমতি নেই। মেহউইশের সকল রাগ রিশাদের প্রতি হওয়া ঘৃণা সব উধাও হয়ে গেল একমুহূর্তের জন্য। এখন যা মনে রয়ে গেছে তা শুধু ইভানকে হারানোর যন্ত্রণা৷ এই যন্ত্রণার জন্য হলেও রিশাদকে কখনোই সে পুরোপুরি ক্ষমা করতে পারবে না৷ বক্সটার দিকে তাকিয়ে একটুও ইচ্ছে হলো না খুলে দেখার। পায়ের ব্যথা একটুও অনুভব না হওয়ায় ঘর ছেড়ে বাথরুমে গেল। ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করতে গেলে দেখতে পেল ফুপু নির্জনকে রোদে নিয়ে বসে আছেন৷ মেহউইশকে দেখে হাসিমুখে জানতে চাইলেন পায়ের অবস্থা। তারপরই বললেন রিশাদ যে কাপড় অর্ডার করেছে তা যেন চেক করে। লজ্জায় লাল হয়ে গেল মেহউইশের মুখ। ছিহ, কি নির্লজ্জ লোক ফুপুকেও বলেছে কিসব অর্ডার করেছে! বদলোক, অসভ্যের শেষ এই লোক। বিরক্তি আর লজ্জা নিয়েই খাওয়া শুরু করলো সে। একটা রুটি খেতেই মনে হলো আজকে রিশাদ তার দিকে তাকায়নি একবারও। কেন মনে হলো তা জানে না শুধু মনে হলো লোকটা তাকে একরকম ইগনোর করে গেল!
#মন_গহীনের_গল্প
পর্ব -১৮
#রূবাইবা_মেহউইশ
💞

কুই কু অ কুইউ কত রকম শব্দ করছে নির্জন। আর সেই সব শব্দ গভীর মনযোগে শুনছে রিশাদের ফুপু। পাশে বসে তা লক্ষ্য করছে মেহউইশ। সে খাটে বসে বক্সভর্তি কাপড়ের প্যাকেট খুলে তা চেক করছিলো। কাল থেকে যেই কাপড় নিয়ে তার এত লজ্জা পাওয়া, রিশাদকে ইতর অসভ্য বলে মনে মনে সম্মোধন করা সবটাই জলে গেল। রিশাদ তার জন্য অনেকগুলো ড্রেস অর্ডার করেছে যার সাইজ একেকটা একেকরকম। আর এগুলোই বলেছিলো সে যেন সাইজ চেক করে আর আনফিট হলে তা যেন আলাদা করে রাখে। নিজেই নিজের মনের পাপী ভাবনার উপর লজ্জিতবোধ করছে এখন সে। এখানে শীতের তীব্রতা বেশি বলেই হয়তো গরম কাপড়ও অর্ডার করেছে। সবই প্রায় ফিট হয়েছে কিন্তু রঙচঙে দেখেই মাথা ঘুরাচ্ছে তার। এত ঝকমকে পোশাক পরা তার পছন্দ ছিল না কখনোই। ফুপু এক নজর মেহউইশের মুখ দেখে হেসে বললেন, ‘রিশাদের কালার সিলেকশন খুবই বাজে।এগুলো নিশ্চয়ই তোমাকে না দেখিয়েই অর্ডার করেছে?’ জবাবে মেহউইশ মাথা নাড়লো।

সমুদ্রের নোনাজলে গা ভিজিয়ে আনন্দে মেতে আছে নীলিমা। পাশেই তার প্রিয় মানুষ মুরাদ৷ আজ তার আনন্দ সীমাহীন ঠিক এই সমুদ্রের মত। এ আনন্দের কূলকিনারা কিছুই নেই। মুরাদ তার হাতে হাত রেখে দূর থেকে ফুলেফেঁপে আসা প্রতিটা ঢেউয়ে গা ভাসিয়ে দিচ্ছে বারংবার। আজ রাতটা তারপরই নির্জনকে নিয়ে কাল সকালেই ঢাকা ফিরবে সে। মুরাদ বলেছে কখনোই সে নির্জনের অনাদর করবে না।গতকাল রিশাদের সাথে দারুণ এক চুক্তি হয়েছে। প্রতি মাসে পনেরো দিন করে করেই নির্জন নীলিমা আর তার কাছে থাকবে। রিশাদের মত একগুঁয়ে, জেদি লোকটাও বাধ্য হয়ে রাজী হয়েছে নীলিমার প্রস্তাবে। রিশাদ তার কথা না মানলে দ্বিতীয় বিয়ে নিয়ে পুলিশ কেইস করবে। তার করার সুযোগও আছে কারণ এখনও তাদের ডিভোর্স হয় নি। আবার নীলিমা, মুরাদও বিয়ে করেনি বলছে৷নীলিমা কিছু তো বড়রকম চালাকি করার সুযোগ পেয়েই এসেছে এখানে নির্জনকে নিতে। বাঘের মুখে হাত ঢোকানোর সাহস সে এমনি এমনি করেনি। রিশাদও সুযোগের সদ্ব্যবহার করা জানে তাই অপেক্ষা করবে সে সঠিক সময়ের। আপাতত নীলিমার কথা মেনেই কাল নির্জনকে দিবে সে দেখা যাক কতদিন চলে তার এই রুলস।

সন্ধ্যার পরই আজ রিশাদ বাড়ি ফিরে এসেছে। কারো সাথে কোন কথা না বলে চুপচাপ ছেলেকে বুকে নিয়ে বসে আছে। নিরবতায় তার ঘরটা বড্ড রহস্যময় আর বিষন্ন লাগছে। মেহউইশেরও মন খারাপ ; মায়ের সাথে কথা বলার সময় সে ইভানের কন্ঠস্বর শুনেছিলো। কথা বলতে চাইলে ইভান তাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলেছে, ‘অর্থের কাছে বিক্রি হওয়া মানুষের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই আন্টি বলে দিয়েন৷’

অর্থের কাছে বিক্রি হয়ে গেছে! এমনটা বলতে পারলো ইভান? সে কি সবটা জানে না, নাকি মা বলেনি কিছুই! বিষাদের পাহাড় বুক চিতিয়ে সামনে খাড়া যেন মেহউইশের। রিশাদ,নির্জন কিংবা তাদের নিঃসঙ্গ নীরবতার দিকে তার খেয়াল নেই। রাতও কাটলো সকলের নিশ্চুপ। সকাল হতেই রিশাদ নির্জনের ব্যাগটা গুছিয়ে নিলো। বাইরে কুয়াশা টুপটাপ করে গড়িয়ে পড়ছে গাছের পাতায়, পাতা থেকে সবুজ ঘাসে। ঝিরিঝিরি বাতাস আর বাতাসে ভাসছে জংলী ফুলের মিষ্টি মিষ্টি ঘ্রাণ। মেহউইশের ঘুম ভাঙেনি পাশ থেকে নির্জনকে উঠিয়ে রিশাদ ফ্রেশ করালো। জামা-কাপড় বদলে তাকে পরিপাটি করে নিলো। সকাল যখন নয়টা পার করলো তখন রিশাদের ফুপু তড়িঘড়ি করে এসে দরজায় কড়া নাড়লো। যে ছেলের ঘরের দরজা ভোরে খুলে যায় সে ছেলে আজ এত সময়েও একবার বাইরে এলো না দেখেই ফুপুর মনে ভয় জেগেছে। ফুপুর ডাকে রিশাদ দরজা খোলার আগেই মেহউইশের ঘুম ভাঙলো। সে চোখ মুখ কঁচলানো ভঙ্গিতেই নির্জনের দিকে তাকালো।

-‘ আরেহ বাহ্ মিষ্টার হ্যান্ডসাম সকাল সকালই এত সাজ! মেয়ে পটাতে যাবেন নাকি!’ মজা করছে মেহউইশ নির্জনের হাতে আঙ্গুলে দিয়ে ধরে।

-‘ রিশাদ তুই আজ সকালে উঠিসনি কেন? শরীর ঠিক আছে তো তোর?’ফুপুর কন্ঠে চিন্তা বিদ্যমান।

-আমি ঠিক আছি ফুপু৷ নির্জনের কাপড় গোছাচ্ছিলাম তাই দরজা খুলিনি৷

‘ওহ!’ বলে ঘরের ভেতর তাকাতেই আরও চমকালেন তিনি। ‘লাগেজ গোছানো কেন? তোরা কি ঢাকায় ফিরবি!’

-আমরা না শুধু নির্জন যাবে।

এবার ফুপুর সাথে মেহউইশও তাকালো রিশাদের দিকে।এইটুকুনি বাচ্চা ঢাকা যাবে কি করে? কৌতূহল জাগলেও প্রশ্ন করার সাহস হলো না মেহউইশের কিন্তু ফুপু ঠিকই জানতে চাইলেন এই কথার মানে কি?
রিশাদ এবার জানালো নীলিমা এসেছে নির্জনকে নিতে। মাসের পনেরো দিন নির্জন তার মায়ের সাথে থাকবে পনেরো দিন বাবার সাথে। মেহউইশের এবার মনে পড়লো কাল রিশাদ রাতে নির্জনকে বুকে ধরে কেঁদেছিলো হয়তো তাই তার চোখদুটো ফোলা ফোলা লাগছিলো। সম্পর্কে ভরসা,বিশ্বাস,ভালোবাসা আর সম্মান কোনটাই নেই তাদের মাঝে তবুও একটা সপ্তাহ একই ছাদের নিচে থেকে দেখা হয়েছে কাছ থেকে। না জানতে চাইলেও কিছু কিছু জানাশোনা হয়েই গেছে। রিশাদের মত কঠোর,পাষাণ লোকটারও চোখে পানি আসতে পারে তা কাল রাতে না বুঝলেও এখন উপলব্ধি করতে পারছে। হুমায়ূন আহমেদ স্যার ঠিকই বলেছিলেন তার মেয়েকে পৃথিবীতে খারাপ পুরুষ আছে অনেক কিন্তু খারাপ বাবা একটাও নেই। রিশাদ যেমন একজন পুরুষ তেমন একজন বাবাও৷ তার পরিচয়ে সবচেয়ে বড় পরিচয় সে নির্জনের বাবা। মেহউইশের এখন নিজেরও একটু মন কেমন করলো নির্জন চলে যাবে ভেবে আবার আনন্দও হচ্ছে মনের কোন এক কোণে৷ নির্জন তার মায়ের কাছে চলে গেলে নিশ্চয়ই মেহউইশের আর কোন প্রয়োজন নেই রিশাদের জীবনে! সে ফিরে যাবে ইভানের কাছে।

সময় চলেছে সময়ের মত। সকাল দশটার আগেই রিশাদ বেরিয়ে পড়লো নির্জনকে নিয়ে। মেহউইশকেও নেওয়া হলো তাদের সাথে। নীলিমাদের জন্য রিশাদের নিজের হোটেলেই অপেক্ষা করতে হলো।নীলিমা আর মুরাদ এলো এগারোটা নাগাদ। কোন প্রকার বাক্যলাপ ছাড়াই নির্জনকে কোলে তুলে নিলো নীলিমা।মেহউইশ রিশাদের কেবিনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে সমুদ্রের দিকে অপলক তাকিয়ে ছিলো। সে মনে মনে হিসাব কষছিলো কি হচ্ছে এখানে! এই দুধের বাচ্চাকে নিয়ে এতোটা টানা হেঁচড়া কেন? কেমন মা বাবা তারা, কেন এই অত্যাচার! দুজন একসাথে থাকলে কি এমন হয়ে যেত? বিয়ে হয়ে গেছে একটা সন্তান হয়েছে এরপরও কেন মেয়েটা নিজের প্রাক্তনের কাছে ফিরে গেল? কথাটা ভাবতেই মনে হলো সমুদ্রের ঢেউয়ের সাথে এই কথাটাই ফিরে এসে তার ওপর পড়লো। তারও বিয়ে হয়ে গেছে পরিস্থিতি যেমনই হোক বিয়েটা তারও হয়েছে নীলিমার মতোই। আবার নীলিমার মতোই সে তার প্রাক্তনের কাছে ফিরতে চাইছে৷ কিন্তু এখানে পার্থক্য একটা নীলিমার সন্তান আছে তার নেই,,,,৷ভাবনা শেষ হওয়ার আগেই মনে পড়লো সেই রাতের কথা। রিশাদ তো জোর করেই তার সাথে ইন্টিমেট হয়েছিলো। শরীর অসাড় হয়ে আসছে তার এসব কি ভাবছে সে! নীলিমা যা করেছে তা অন্যায় কিন্তু সে তো কোন অন্যায় করেনি বরং তার সাথে অন্যায় হয়েছে। সে কেন ভুগবে? এখনও সময় আছে সে সুযোগ পেলেই ফিরে যাবে ইভানের কাছে। কেবিনের দিকে ফিরে তাকালো মেহউইশ। নীলিমা,মুরাদ কেউ নেই কেবিনে তারমানে নির্জনকে নিয়ে তারা চলে গেছে। রিশাদ বসে আছে নিজের চেয়ারটায়। ডান হাতটা কনুইতে ভর করে তার কপালে রাখা। তার ভেতরে এখন কি চলছে!

সূর্য যখন ধরনী কালো করে অন্ধকারে লুকিয়ে পড়ার পায়তারা করছে মেহউইশ তখন গাড়ির জানালায় মাথা এলিয়ে ঝিমুচ্ছে। বিষন্ন মনে সামনে দৃষ্টি রেখে ড্রাইভিংয়ে মনযোগ দেওয়া রিশাদের দু চোখে তখন এক সমুদ্র জল আর এক বুক শূণ্যতা। বুকের ভেতরটা সম্পূর্ণ ফাঁকা কোথাও এক টুকরো শান্তির ছিটেফোঁটা নেই। কলিজাটা খালি করেই নির্জনকে নিয়ে গেছে নীলিমা৷ মা মারা গেছে বহু বছর, ফুপু আর খালার এক অঘোষিত লড়াইয়ে দুজনের থেকেই আলাদা রয়েছিলো বহুবছর তবুও কখনও এতোটা হাহাকার এই বুকে ছিলো না তার। চোখের সামনে দিয়ে একঝাঁক পাখি উড়ে গেল নিজ গন্তব্যে অথচ রিশাদেরই কোন নির্দিষ্ট গন্তব্যের কথা মনে পড়লো না তার। কোথায় যাবে সে? কোথায় গেলে নির্জনকে এখনই কোলে তুলে নিতে পারবে! জবাব নেই এসবের। বাড়ির গেইটে এসে মেহউইশকে ডেকে বাড়িতে পাঠিয়ে রিশাদ চলে গেল আবার গাড়ি নিয়ে। সে রাতে সে আর বাড়ি ফিরলো না। পরেরদিন বাড়ি ফিরে চুপচাপ খেয়ে ঘুম দিলো। হোটেলে যাওয়ার কথা জিজ্ঞেস করলে সে ফুপুকে বলল কদিন সে ঘরে থেকেই কাজ করবে। সেই সুযোগও তার আছে৷ ফুপু বারবার মেহউইশকে বললেন সে যেন রিশাদের খাওয়ার খেয়ালটা রাখে। দিনভর কোন কিছুরই প্রয়োজনবোধ করলো না রিশাদ কিন্তু সন্ধ্যা হতেই তার বুক জ্বালাপোড়া করলো নির্জনকে একটা পলক দেখার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলো। এমনকি বাধ্য হয়ে নীলিমাকে ভিডিও কল দিলো৷ বিনিময়ে মুরাদ তাকে নির্জনকে দেখতে দেয় তো নি সাথে কিছু কথা শুনিয়ে ফোন রাখলো। সে রাতও কাটলো মেহউইশের চুপচাপ কিন্তু রিশাদের কাটলো চাপা কষ্ট লুকিয়ে লুকিয়ে সে বারান্দায় দাঁড়িয়ে চোখের জল ফেলল৷ বিছানায় তার চোখ পড়তেই বুকের ভেতরে ছ্যাৎ করে কোথাও একটা কিছু লাগে। কি লাগে! সে জানে না শুধু জানে ছেলেটাকে যতোটা সম্ভব দ্রুত ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা৷ রাত কাটলো এমনি করে দুজনের। সকালে রিশাদ আগের মতোই দৌড়ালো,ব্যায়াম করলো আবার সময়মত নাস্তা করে অফিসে গেল। মেহউইশ বিষ্ময়ে অভিভূত হলো খুব। রাতে যে লোকটা এতোটা কান্নায় ভেঙে পড়লো সে কি করে সকালে উঠে একদম স্বাভাবিক! ফুপুর বেশ মন খারাপ তিনি নির্জনকে মিস করছেন আবার রিশাদের কষ্ট পাওয়া নিয়েও কষ্ট পাচ্ছেন। দেখতে দেখতেই কাটতে লাগলো দিন রিশাদ মেহউইশের খুব স্বাভাবিকভাবেই। প্রতিদিন ভোরে রিশাদ নিজে এক মগ কফি রাখে মেহউইশের মাথার কাছে। এরপর আর সারাদিনে দুজনের দেখা হয় না, রাতে ঘুমুবার সময়ও কেউ কারো সাথে কথা বলে না শুধু রিশাদ যা নিয়ে আসে তা দেবার সময় মাঝেমধ্যে কথা বলে। সকালে কফি, বিকেলে চা আর রাতের খাবার। দমবন্ধ লাগে দুজনেরই কিন্তু করার মত কিছুই নেই।প্রায় সপ্তাহ খানেক পার হবার পর একদিন নীলিমা নিজ থেকেই ফোন দিলো রিশাদকে৷ আর সে সপ্তাহেই নীলিমা বলল সে নির্জনকে নিয়ে আসছে চট্টগ্রামে। রিশাদ ভাগ্যবান বলেই হয়তো মুরাদ অন্যরকম । মুরাদের অবহেলা যদি না শুরু হতো নীলিমা নিশ্চয়ই এত তাড়াতাড়ি নির্জনকে দিতে চাইতো না! কিন্তু আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো যেই এক সপ্তাহ নির্জন নীলিমার কাছে ছিলো সেই এক সপ্তাহ মেহউইশ ঠিকঠাক ঘুমাতে পারেনি। বিছানায় তার গা ঘেঁষে ঘুমানো নির্জনের ছোট্ট হাত পায়ের নাড়াচাড়ার কমতি খুব করে অনুভব করেছে সে। আর রাতভর ঘুমন্ত রিশাদের নিঃশ্বাসের ভারী শব্দও৷ একটা রাতও রিশাদ পুরোপুরি ঘুমায়নি তা মেহউইশ খেয়াল করেছে তার নিজেরও ঘুম হয়নি বলে। যেদিন নির্জনকে দিয়ে গেল নীলিমা ঠিক সেদিনই চট্টগ্রামে আগমন ঘটলো জেবুন্নেসা আর রাইমার। রাইমা রিশাদের বাড়িতে আসলেও জেবুন্নেসা রয়ে গেছেন হোটেলে৷ যে বাড়িতে রেহনুমা মানে রিশাদের ফুপু আছে সে বাড়িতে কখনো জেবুন্নেসা পা রাখবেন না এমনটাই বলেছে রাইমাকে। বাধ্য হয়েই রাইমা একা এসেছে বাড়িতে৷

চলবে
(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here