#মন_গহীনের_গল্প
পর্ব-২২
#রূবাইবা_মেহউইশ
💞
সন্ধ্যের মুখে শীত জড়িয়ে পাহাড় যখন কুয়াশায় লুকিয়ে গেল তখনই রিশাদ বাড়ির কোর্টইয়ার্ডে আগুন জ্বালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। রাইমা বেছে বেছে বড় বড় কাঠগুলো রেহনুমার দেখিয়ে দেওয়া জায়গা থেকে এনে জড়ো করছে রিশাদের সামনে। শীত এখানে এত বেশি হবে তা বুঝতে পারেনি জেবুন্নেসা। কক্সবাজারে এতোটাও কাঁপুনি লাগেনি তার এখানে এসে শারীরিক অবস্থা করুণ। রেহনুমা ঘরে ঢুকেই জেবুন্নেসাকে ওরকম কাঁপতে দেখে চুপচাপ নিজের আলমারি থেকে ভারী একটা উলের সুয়েটার আর মোজা বের করে দিলো হাত আর পায়ের। জেবুন্নেসা প্রথমে সেদিকে ফিরেও তাকায়নি আর রেহনুমা ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই ঝটপট সুয়েটার গায়ে দিলো সে। না চাইতেও মনে মনে ধন্যবাদ বলে দিলো আনমনেই। এই শীতের সন্ধ্যায় সবাই বাইরে বসে বার বি কিউ খাবে আয়োজন করেছে। জেবুন্নেসা মনটা ভালো লাগছে না একদমই। এখন দুজনকে কাছে পেয়ে স্বস্তি লাগলেও রিহানের জন্য খারাপ লাগছে। ছেলেটা একা বাড়িতে আছে তার বাবা বাড়িতে এসেছেই কিনা কে জানে! ছেলেটা বার বি কিউ পার্টি খুব পছন্দ করে আর এজন্যই হয়তো কষ্টটা বেশি লাগছে তার। ছোট ছেলেটাকে রেখে এসব তার গলা দিয়ে নামবে না। রাগের মাথায় বাড়ি ছেড়ে গিয়েছিলো মেয়েটা লেজের মত পিছন পিছন সেখানেও চলে গেছে কাল আবার আঠার মত এখানেও চলে এসেছে। রিহানটা কেন এলো না? সেও তো দেখেছে মা রাগ করে চলে যাচ্ছে জেদ ধরে সেও আসতো! চোখ ঝাপসা হয়ে এলো ঘরে বসে।
মেহউইশ নির্জনকে আজ প্রতিদিনকার চেয়ে দ্বিগুন কাপড়ে মুড়ে নিচ্ছে। মুখটা ছাড়া তার একটা নখও দেখার উপায় নেই। রিশাদ ঘর থেকে বের হওয়ার আগে বলো গেছে নির্জনকে যেন একদম প্যাকেটমোড়া করে নেওয়া হয়। বাইরের ঠান্ডা লেগে তার যেন জ্বর,ঠান্ডা না লাগে কিছুতেই। মেহউইশও নিজের বুঝমত তৈরি করলো বাচ্চাটাকে। হিম শীতল পরিবেশে নিজেরও কাপড়ে মুড়িয়ে যেতে হবে ভেবেই কাপড় খুঁজছে সে।এদিক ওদিক খুঁজে যে কাপড় চোখে পড়লো তাতে কোনটা এখন পড়া ঠিক হবে বুঝতে না পেরে বিছানায় বসলো। রাইমা ড্রেসের ওপর মোটা একটা লং স্লিভ গেন্জি পরেছে আবার তার ওপর হুডি। হাত মোজা,পা মোজা সবই পরেছে৷ মধ্যবয়স্ক শ্বাশুড়ি দুজনও কি চমৎকার সব সুয়েটার পরেছে৷ সে কি পরলে ভালো লাগবে বুঝতেই পারছে না। এখানে এতো শীত না পড়লেই হতো! নির্জনকে মোটা মোটা গরম কাপড়ে আবৃত করায় ছেলেটাকে ভালোই বড় লাগছে দেখতে৷ মেহউইশ নিজে তৈরি হওয়া বাদ দিয়ে নির্জনের হাতের মোজা খুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে খেলছে। কখনও আঙ্গুলে চুমু খাচ্ছে কখনওবা নিজের গালে তার আঙ্গুল ছুঁইয়ে দিচ্ছে।মেহউইশ এখনও নির্জনকে নিয়ে বের হচ্ছে না বলেই রেহনুমা বলল, ‘রিশাদ দেখে আয় তো মেহউইশ এখনও আসছে না কেন?’
রাইমা বসা থেকে উঠতেই যাচ্ছিলো কি রেহনুমা তার হাত টেনে ইশারা করলো, সে চাইছে রিশাদই যাক। রিশাদই উঠে ঘরে গেল আর যেতেই দেখলো মেহউইশ খিলখিলিয়ে আসছে নির্জনের আঙ্গুল ছুঁয়ে ছুঁয়ে৷মন ভালো করার মত এক দৃশ্য যা রিশাদের শূন্য হৃদয়ের মরুভূমিতে এক পশলা বৃষ্টির মত লাগছে। হাসি মুখে মেহউইশ নির্জনকে আদর করছে। রিশাদের উপস্থিতি টের পেয়েই পেছনে ফিরে একপলক দেখলো সে। রিশাদ চুপচাপ দাঁড়িয়ে তাদের দেখছে, ঠোঁটের কোণে তার এক চিলতে হাসিও ফুটে উঠেছে।
‘তোমরা এখনও বাইরে এলে না?’ বলতে বলতেই রিশাদ খাটের কাছে এগিয়ে এলো। মেহউইশ বসা থেকে উঠে সরে যাচ্ছিলো তার আগেই রিশাদ হাত টেনে ধরলো মেহউইশের। চমকে যাওয়া দৃষ্টি নিয়ে ফিরে তাকালো মেহউইশ । রিশাদের চোখ তার চোখে আবদ্ধ হলো। দু জোড়া চোখে জড়তা আর অস্বাভাবিকতার বাস তা আজই প্রথম উপলব্ধি হলো দুজনের।
‘হাত ছাড়ুন।’
‘একটু বসো এখানে। ‘
‘আমার শীত লাগছে শাল নেবো।’
‘তুমি বসো আমি দিচ্ছি ‘ বলেই রিশাদ মেহউইশকে খাটে বসিয়ে আলমারি থেকে একটা লং জ্যাকেট বের করলো৷ জ্যাকেটটা রিশাদের এবং পুরনো আর সেটাই মেহউইশকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘এটা পরো।’ সাথে নিজেরই মোজাও দিলো। মেহউইশের নিজেরই অনেকগুলো শীতের কাপড় কেনা হয়ে গেছে এখানে আসার পর থেকে। সব রিশাদ নিজেই কিনে এনেছিলো এবং সাইজেও পারফেক্ট তবুও কেন নিজের গুলো বের করে দিলো তা মেহউইশের মাথায় ঢুকলো না। রিশাদ বিছানা থেকে নির্জনকে কোলে তুলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। মেহউইশের রাগ হলো এসব বড় বড় জ্যাকেট আর মোজা দেখে। সে এগুলো পরবে না নিজের থাকতে অন্যের ব্যবহৃত জিনিস কেন পরবে? কিন্তু নাহ, রিশাদ তার মনে যতোটা তিক্ত ব্যক্তি ঠিক ততোটাই ভয়ংকর তার কি সাধ্য রিশাদের কথার বিপরীত করে! মুখ ফুলিয়ে সেই জ্যাকেটটাই গায়ে দিলো। প্রথমে পায়ের মোজা তারপর হাতের মোজা পরে রিশাদের খুব সুন্দর একটা মাফলার ছিলো যা রিশাদের ড্রয়ার থেকে ইচ্ছে করেই নামিয়ে গলায় পেঁচিয়ে নিলো। এটা যেন রিশাদকে তার কথার জবাব না দিতে পেরে এভাবেই মনের ক্ষোভ ঝাড়লো।বাইরে থেকে রাইমার গলা শোনা যাচ্ছে সে ‘ভাবী ভাবী’ বলে ডাকছে। তড়িঘড়ি মাফলারটা ভালো করে গলায় বেঁধে বের হলো মেহউইশ। কর্টইয়ার্ডে আগুনের শিখা বাড়ির পুরো দক্ষিণ অংশই কমলাভ রঙে রাঙিয়ে দিয়েছে। আগুনের চারপাশে গোল হয়ে বসে আছে এ বাড়িতে বর্তমানে উপস্থিত থাকা প্রত্যেকটা মানুষ। মেহউইশ বসেছে রাইমার পাশে তার পাশেই বসে আছে রেহনুমা আর রিশাদ , রিশাদের পাশেই নির্জনকে কোলে নিয়ে বসে আছে জেবুন্নেসা তার থেকে আবার একটু দূরত্ব রেখে আনতুং, গেইটের দারোয়ান আর আনতুংয়ের ছোট্ট মেয়েটি। আজ বারবিকিউ করবে বলেই রেহনুমা মেয়েটাকে আনতে বলেছে৷ এমনিতেও মেয়েটা এ বাড়িতে আসতে পছন্দ করে খুব৷ রাতের বেলায় আনতুং এখানে থাকে বলে প্রায়ই মেয়েটা মন খারাপ করে৷ অথচ তাকেও এসে থাকতে বললে সে রাজী হয় না। তার নানীকে ছাড়া নাকি ঘুম আসে না। হতে পারে জন্মের পর মাকে ছাড়া থাকলেও নানীকে ছাড়া কখনও থাকেনি বলেই এই সমস্যা৷ কিন্তু আজ খাওয়ার কথা বলায় মেয়েটা খুব খুশি হয়েই এসেছে। কাঠ পুড়ছে ফট ফট শব্দ হচ্ছে কাঠ জ্বলার। বাতাসে ভেসে আসছে মৃদু সৌরভ জংলী ফুলের। মেহউইশ হাত পা মুড়িয়ে বসায় নাকের কাছে জ্যাকেটের হাতটা থেকেও একটা ঘ্রাণ আসছে। অচেনা সে ঘ্রাণে মনটা চঞ্চল হয়ে উঠছে। কিসের ঘ্রাণ এটা? কোন পারফিউম এর ঘ্রাণ এমন! পরিচিত নয় তবে ঘ্রাণটা বেশ লাগলো। এমন ঘ্রাণ আগেও কোথাও পেয়েছিলো সে। তবে তা শুধু একবারই পেয়েছিলো বলে মনে হলো। নাক টেনে সে ঘ্রাণ নিতে চোখ বুঁজে রইলো। রাইমা তার কথার ফুলঝুরি নিয়ে বসেছে। একের পর এক গল্প সে তার ঝুলি থেকে বের করছেই। রিশাদ চারপাশে তাকিয়ে যখন মেহউইশের দিকে তাকালো, চোখদুটি তার যেন ঝলসে গেল মুহূর্তেই৷আগুনের আলোয় মেহউইশের মুখের রঙ বদলে দিয়েছে। বদলটা এতেটাই প্রখর তেজদীপ্ত যা অলৌকিক শক্তিতে ভস্ম করছে রিশাদকে। আজ এই প্রথম মনে হলো সে আবার নতুন কোন মোহে আটকা পড়ছে। এতগুলো দিনে কখনও এই মোহ তাকে ছুঁতে পারেনি অথবা তার মনের ওপর পড়া শয়তানী রাগের প্রলেপ ছুঁতে দেয়নি।রিশাদের তাকানো,তার নরম সুরে কথা বলা সব কিছুই মেহউইশের চক্ষুগোচর। তাই মনে মনে ভয় জাগছে অন্যরকম আজ। লোকটার মতিগতি ঠিক নেই আর একটা পুরুষ তার ঠিক কি কি প্রয়োজনে এমন আচরণ করে তা তার ধারণাতেই একটাই আছে কারণ। ‘দৈহিক আনন্দ’ ঠিক এই একটাই প্রয়োজনেই রিশাদের আচরণ সেই রাতে এমন নরম হয়েছিলো। আজও কি তবে এমন কিছু হতে চলেছে! শিউরে উঠলো গা বুকের ভেতর আত্মাটাও কাঁপছে তার।
বার বি কিউ পার্টি বলতে খাওয়া ছাড়া তেমন একটা আনন্দ কারোই হলো না। ঘুমানোর সময় বাঁধলো বিপত্তি দু’ঘরেই। রেহনুমার ঘরে এক খাটে ঘুমাতে হবে জেবুন্নেসা আর রেহনুমাকে। রেহনুমার মধ্যে আড়ষ্টতা আর জেবুন্নেসার ভেতর ক্ষোভ।অথচ তৃতীয় ঘরটিতে থাকার মত বাড়তি কম্বল নেই একজনকে আলাদা থাকতে দেওয়ার মত৷ রিশাদ অবশ্য সন্ধ্যায় শুনেই যেতে চেয়েছিলো কক্সবাজারে। হোটেলে এখনও অনেক নতুন আসবাব, কম্বল,বিছানাপত্র অনেক কিছুই আছে যা সে তার নতুন ফ্লোরের জন্য কিনেছিলো। কিন্তু জেবু কিংবা রেহনুমা কেউই চায়নি রাত করে তাকে বাইরে যেতে দিতে। বাধ্য হয়ে আজ রাত তাদের এক বিছানায় এক কম্বলে কাটাতে হবে।
রিশাদ আজ বিছানা নিজেই গুছিয়েছে। নির্জনকে শুইয়ে নিজেও বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছে। কিন্তু একি! মেহউইশ তো সেই যে রান্নাঘরে ঢুকলো আর বের হয়নি৷ আজ কি সে রাতটা ওই রান্নাঘরেই কাটাবে! #মন_গহীনের_গল্প
পর্ব-২৩
#রূবাইবা_মেহউইশ
💞
মনের ভেতর জমে থাকা অস্বস্তিটা এবার কাঁটার মত বিঁধছে বুকে। চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি খুবলে নিতে চাইছে মেহউইশের দেহের সকল শক্তি৷ এক মগের জায়গায় তিন মগ কফি বানিয়ে দিয়েছে সে রিশাদকে তবুও লোকটা কেমন নেশাতুর চোখে চেয়ে আছে যেন আরো চাই তার। এত শীতে বারবার খোলামেলা করিডোর পেরিয়ে রান্নাঘর থেকে শোবার ঘরে আসা যাওয়া সত্যিই কষ্টদায়ক৷ কিন্তু লোকটার মুখের ওপর না করার সাহস তার হচ্ছে না। পাশের ঘরে ফুপু, খালা সব ঘুমিয়ে পড়েছে অথচ তার ঘুমানোর প্রস্তুতিটুকু নেওয়ার সুযোগ হচ্ছে না।
‘দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এত কি ভাবছো?’ গলা খাঁকড়ি দিয়ে রিশাদ প্রশ্ন করলো৷
‘কিছু না।’
‘শিওর!’
জবাবে মাথা নাড়লো মেহউইশ। কিন্তু রিশাদের পছন্দ হয়নি এমন নিঃশ্চুপ জবাব। সে জানতে চাইলো ঘুম পেয়েছে কিনা? মেহউইশ এ ার আর কোন জবাবই দিলো না তা দেখে রিশাদ বলল, ‘বিছানায় আসো।’
নির্জন আজ এ ঘরে নেই জেবুন্নেসা জেদ ধরে নিয়ে গেছে। রেহনুমারও ব্যাপারটা ভালো লেগেছে কিন্তু সমস্যা খাটটা অনেক বড় হলেও কম্বলগুলো চারজনের জন্য যথেষ্ট নয়। নির্জনের ছোট কম্বল আছে কিন্তু সেগুলো থাকবে খাটের মাঝামাঝি এতে করে কম্বলে টানাটানি থাকবেই। রিশাদ নিজেই জিনিসটা খেয়াল করে তার আর মেহউইশের জন্য রাখা আলাদা কম্বল থেকে দুটো দিয়ে দিলো রেহনুমার ঘরে। এখানে অবশ্য অনেকটা চালাকিই করেছে সে। ইচ্ছে করেই মেহউইশ ব্যবহার করতো সেগুলোই দিয়েছে আর নিজের গুলো রেখে দিয়েছে। মেহউইশকে ঘুমোতে ডাকলে সে বিছানায় উঠে বসে রইলো পা গোঁজ করে। পরনে তার এখনও রিশাদের জ্যাকেট, মোজাগুলো। রিশাদ হাত বাড়িয়ে মেহউইশের হাত ধরতে চাইলো। ঘরের মৃদু আলো আজও জ্বলবে আগের মতোই। জড়তা কাটছে না মেহউইশের ঘৃণা জমা মনে রিশাদের স্পর্শ তার কাছে কাঁটার মত। রিশাদ দেখলো মেহউইশ হাত এগিয়ে দিচ্ছে না কারণ তারও জানা। কিন্তু সে তো চাইছে সম্পর্কটা বদলাক, স্বাভাবিক হোক। প্রেম হওয়াটা হয়তো অসম্ভব তবুও অভ্যাসটা হোক৷ ভালোবাসা নাই’বা থাকলো মায়াটা অন্তত জন্মাক। একটা জীবন পার করতে একটুখানি যত্ন তো তারও দরকার। মেহউইশের স্থির হয়ে বসে থাকা দেখেই এবার নিজেই টেনে হাতটা ধরলো। শুধু কি হাতটা ধরা! জাপটে টেনে নিজের বুকের নিচে ফেলল এক হাতে আর অন্য হাতে কম্বলটা জড়িয়ে নিলো গায়ে। আকস্মিক ঘটনায় হাতে ব্যথাও পেলো বোধহয়। আহ্ করে শব্দ করতেই রিশাদ একটু নিজেকে সরালো। মেহউইশের মুখে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো ব্যথাটা কি বেশিই পেল? চোখ বন্ধ , মুখ স্বাভাবিক চোখের উপর ভ্রু দুটো ইষৎ কুঁচকে আছে। শীতের রাত, মুখের উপর কারো উষ্ণ নিঃশ্বাস আর হাতের নিষিদ্ধ বিচরণ শক্ত হয়ে থাকা মনটাকেও নরম করে উন্মাদ করে দেয় বুঝি! মেহউইশ তো হচ্ছে উন্মত্ততা সাময়িকভাবে তাকে অস্থির করে তুলছে রিশাদ কি ইচ্ছে করেই এমন আক্রমণ করলো আজ! মেহউইশ যখন পুরোপুরি নিজের ইচ্ছের বাইরে রিশাদকে আঁকড়ে ধরতে চাইলো ঠিক তখনি রিশাদ নিজেকে থামিয়ে ঘুমের রাজ্যে পাড়ি দিলো। রাগে,লজ্জায়,সংকোচে মেহউইশের চোখের কোণে জলের ঢেউ আছড়ে পড়লো গাল বেয়ে। ছিহ, কি হচ্ছিলো তার সাথে এখনই? কম্বলের নিচে থেকেই রিশাদ তার গায়ের জ্যাকেট আর মোজা খুলে নিয়েছিলো।তখনও মনে রাগ ছিলো।পরপর যখন তপ্ত অধরের আদুরে বর্ষণ করলো তখনি যেন খেই হারিয়ে ফেলেছিলো মেহউইশ। ঘোর লেগেছিলো অকাতর মন গহীনের ক্ষোভ দ্রবীভূত হয়ে মিশে গিয়েছিলো কুয়াশায় মোড়ানো পাহাড়ে। এ অনাকাঙ্ক্ষিত রাত্রীপ্রেম মানব মানবীর দেহ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ তবুও মেহউইশ ভুলে যেতে চেষ্টা করেছিলো একটুক্ষণ নিজের ঘৃণা। রিশাদ ফায়দা লুটেনি আজ বরং অকূল তৃষ্ণার সাগরে তৃষিত করে ছেড়ে দিয়েছে মেহউইশকে।
ভোরের নরম আলোয় ডগমগিয়ে নতুন গুল্মলতার মত করে মাথা উঁচু করতে আপ্রাণ চেষ্টা করছে নির্জন৷ছোট ছোট হাত পা ভারী আবরণে আবৃত শুধু তার ছোট্ট গোল মুখখানিই দেখা যাচ্ছে। বাড়ির কর্টইয়ার্ডের এক পাশে দারুণ সব ফুলে সজ্জিত জায়গায় চেয়ার পেতে বসেছিলেন রেহনুমা। তার কোলেই পূর্ব দিকে মুখ করে নির্জন। রোদের আলো পাহাড় ছুঁয়ে তাদেরকেও ছুঁয়ে দিচ্ছিলো। হয়তো সেই রোদের পরশে উম পেতেই ছেলেটা অমন কোল থেকেই মাথা উঁচু করছে বারবার।জেবুন্নেসা রাতে ঠিকঠাক ঘুমাতে পারেনি৷ রিহানের চিন্তায় অস্থির পরশু তবুও একটু ফোনে কথা হয়েছিলো কিন্তু কাল থেকে সেটাও আর সম্ভব হচ্ছে না। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই তাই তৈরি হচ্ছে ঢাকায় ফিরবে বলে।এমনিতেও হোটেলে তেমন কিছু নেই। রাইমাও জলদি জলদি তৈরি হওয়ায় রিশাদের সাথেই বেরিয়ে পড়েছে তারা। মেহউইশ ঘুম ভাঙতেই কোনদিকে না তাকিয়ে ঘর ছেড়ে বাইরে এলো। ঘড়িতে সময় কত ঠাওর করা মুশকিল রোদ দেখে। হাসি হাসি মুখ করে নির্জন আর রেহনুমাকে দেখছিলো সে। এলোমেলো চুল , চোখের কোণে জলের ছাপ স্পষ্ট।
‘আজ এত তাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙে গেল তোমারও?’
‘আমারও মানে!’ অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো।
‘ রাইমা আর তার মা তো ভোরেই উঠে রিশাদের সাথে চলে গেছে।’
‘রিশাদ চলে গেছে’ আর সে কিনা বিছানায় রিশাদ আছে ভেবে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে! নিজেই নিজের ওপর বিরক্ত, একটা মানুষ পাশে আছে কি নেই সেইটুকু বোঝার মত বুদ্ধি তার নেই। ইয়া মাবুদ! আবার দ্রুত পায়ে ঘরে ঢুকলো মেহউইশ। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়ে নিলো। গা থেকে রিশাদের জ্যাকেটটা খুলতে গিয়ে মনে হলো সেই ঘ্রাণটা আবারও নাকে লাগছে। এটা রিশাদের গায়ের ঘ্রাণ সে আজ জানে। কাল রাতেই পেয়েছিলো ঘ্রাণটা তীব্রভাবে যখন রিশাদ তাকে বাহুবন্ধনীতে জবরদস্তি বন্দী করে রেখেছিলো। জোরে নিঃশ্বাসে আবারও ঘ্রাণটা টেনে নিতেই মনে পড়লো রাতের সেই ছেড়ে দেওয়া। নির্লিপ্ত আচরণের মুহূর্তটুকু মনে পড়তেই জ্যাকেটটা ছুঁড়ে মারলো সে। তড়িঘড়ি বিছানার কম্বল গুছাতে লাগলো৷ বালিশ গুলো গুছিয়ে রাখতে গিয়েই চোখে পড়লো সাদা একটা চিরকুট। মেহউইশের বালিশের তলায় ছিলো চিরকুটটা।
‘আলমারির তৃতীয় ড্রয়ারে নির্জনের নতুন কিছু কাপড় আছে। আজকে পুরনো গুলো ফেলে দিয়ে সেগুলোই ব্যবহার করবে। প্রথম ড্রয়ারে আমার মেরুন রঙের শার্টের নিচে হাজার পাঁচেক টাকা আছে তোমার হাত খরচার।’
ছোট্ট চিরকুটখানি পড়েই তা বারান্দা থেকে মুচড়ে ফেলে দিলো। এই কাগজের টুকরো হাওয়ায় ভেসে উড়ে গেল হয়তো দূর থেকে দূরান্তে৷ সেই সাথে ভেসে গেল মেহউইশের মনের ঘৃণার কিছু অংশ কিছুটা রাগের।
দিনভর নির্জন আর নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত কেটেছে মেহউইশের। রিশাদের দেওয়া মোবাইল ফোনটাতে প্রতিদিন একবার কল আসে মাইমুনার। তিনি মেয়েকে সারাদিনই কল করতে থাকেন। কখনো নেটওয়ার্ক থাকলে মেহউইশ সেই কল পায় কখনো পায় না। তবে কথা বলো যখন মায়ের সুখী সুখী গলাটা শুনতে পায় তখন সে ভুলে যায় ইভানের কমতি। যখন জানে মিহাদের শখের কোন জিনিস আজ কেনা হয়েছে কিংবা খুব দামী কোন খাবার সে খেয়েছে তখন সে নিজেও তৃপ্তির ঢেকুর তুলে শুকরিয়া জানায় আল্লাহর আর ভালোবাসা জাগে নির্জনের প্রতি। নির্জনের মাতৃহারা হওয়ার কারণেই আজ সে এখানে আর তার দ্বায়িত্ব সব রিশাদ নিজের কাঁধে নিয়েছে। এতকিছুর পরও তার রিশাদের প্রতি সম্মান আসেনা কেন সে নিজেও জানে না৷
হোটেল ম্যানেজমেন্টে প্রচুর ভুল হঠাৎ করেই চোখে পড়েছে আজ রিশাদের। ইচ্ছে ছিলো দ্রুত সকল কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরবে। ফেরার পথে রাতের খাবার সব এখান থেকেই নিয়ে যাবে সে। গত বছরও এই সিজনে তাকে কক্সবাজার থাকতে হয়েছে। তখন নির্জন ছিলো না নীলিমা ছিলো। বিয়ের চার মাস পূর্ণ হয়েছিলো বলে নিজের হোটেলেই স্পেশাল একটা সন্ধ্যা তৈরি করেছিলো সে। ভালোবাসাহীন বৈবাহিক সম্পর্ককে দুনিয়ার চোখে পরম সুখী প্রমাণ করারই মিথ্যে চেষ্টা ছিলো সেটা। হোটেলের সামনের লনে ফুলের বাগান তার পাশেই মাঝারি আকারের সুইমিংপুল। আলোয় আলোয় ঝলমল করে তুলেছিলো পুলের চারপাশ। ছোট ছোট ক্যান্ডেলে সজ্জিত হয়েছিলো পুলের পানি। আইডিয়াটা অবশ্য নীলিমারই ছিলো। সে হিন্দি সিরিয়ালে আসক্ত ছিলো খুব আর তাই বলেছিলো এতসব আয়োজনের কথা। অভিনয়টা দারুণ ছিলো নীলিমার তাই রিশাদের মত ছেলেকেও হার মানিয়ে বাড়ি থেকে পালাতে পেরেছিলো। শুধু মাত্র ছেলের কারণেই রিশাদ তাকে আটকে রাখার সকল কৌশল প্রয়োগ করেছিলো। হাসি পায় এখন তা ভাবতেই।
‘স্যার, স্পেশাল কাপল স্যুইট সব গুলোই ডেকোরেট হয়ে গেছে।যদি একটু চেক করতেন?’
হাতে থাকা পেপারওয়েটটা ঘুরাতে ঘুরাতে ম্যানেজারের দিকে তাকালো রিশাদ৷ তার মুড আজ ঠিক থেকেও যেন নেই। বিশ্রীরকম কোন গালি বের হয়ে আসতে চাইছে মুখ থেকে কিন্তু সে তা করবে না। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে মুখ খুলল, ‘ ডেকোরেশন গুলো যদি আমিই ঘুরে ঘুরে গিয়ে চেক করবো তবে লাখ টাকা বেতন দিয়ে অরগানাইজার, প্ল্যানার কোন বা* ফেলার জন্য রাখা হয়েছে!’ কথার শুরু আস্তে ছিলো প্রথমে এবং শেষে এসে তা লাউড হলো। রিশাদের এমন আচরণে ভড়কে গেল ম্যানেজার সাহেব। কিন্তু কিছু বলার চেষ্টা করতেই পেছন থেকে ডাক এলো যা শুনে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো রিশাদ। দ্রুত হাতে শার্ট,টাই সব ঠিক করায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো সে তৎক্ষনাৎ।
চলবে
(গেস করেন তো কে ডাকলো তাকে?)
চলবে