মন গহীনের গল্প পর্ব -২৯+৩০

#মন_গহীনের_গল্প
পর্ব-২৯
#রূবাইবা_মেহউইশ
💞

স্বাভাবিক ভাবেই দিনটা শুরু হয় মেহউইশ, রিশাদের। নতুন স্থানে, নতুন ঘরে সংসারটাকেই মোটেই নতুন মনে হয়নি। প্রতিদিনকার নিয়মে রেহনুমাই প্রথমে কিচেনে ঢুকেছে। তবে কিচেনটা রিশাদের ঘরে লাগোয়া তাই রেহনুমাকে অপেক্ষা করতে হয় রিশাদের দরজা খোলার। আজ রিশাদের ঘুম ভেঙেছে দেরি করে আর তারপরই ঘরের দরজা খোলা হয়েছে আর তাই চা, নাস্তাও দেরি করেই হয়েছে। রিশাদ খেয়াল করেছে ফুপির এ ঘরে আসতে এবং রান্নাঘর থেকে নিজের ঘরে আসতে যেতে করিডোর পেরুতে হয়। আর তাদের ঘরের বিপরীত পাশের ঘরগুলো ট্যুরিস্টদের তাই হয়তো চলাফেরায়ও সহজ হবে না। নাস্তার পর রিশাদ আজ প্রথম কাজ করলো মিস্ত্রী ডাকা এবং রান্নাঘরের ভেতরের দিকে দেয়াল ভেঙে আরও একটি দরজা তৈরি করা৷ কাজটা এক দু দিনে হবে না বুঝতে পেরে আগে লোক ডেকে জায়গাটা দেখালো এবং ফুপির ঘরে বদলের ব্যবস্থাও করা হলো। রেহনুমা বারবার করে বোঝাতে চাইলো কদিনের জন্য আবার ভাঙচুর করার কোন দরকার নেই এতে হোটেলে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হবে। রিশাদ বরাবরই একগুঁয়ে সে কোন কথায় কর্ণপাত করলো বলে মনে হলো না। আজকেও আর রান্না করা হবে না তাদের হোটেলের রেস্টুরেন্টে আপাতত খাবে যে কদিন রান্নাঘর কমপ্লিট না হচ্ছে৷ রিশাদ আসলে এপাশটা সম্পূর্ণ আলাদা একটা ফ্ল্যাট হিসেবে আলাদা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সারাদিনে আর রান্নার বাইরে নিজেদের তেমন কাজ না থাকায় রেহনুমা নির্জনকে নিয়ে বের হলো। সে একটু লনে হাঁটবে আর পায়ে কুলোলে সৈকতেও যাবে। মেহউইশের আর প্রেগন্যান্সি টেস্ট করার প্রয়োজন না হওয়ায় সে কিট’টা আলমারির ছোট্ট এক ড্রয়ারে রেখে নিজের কাপড় গুছিয়ে রাখতে লাগলো। রিশাদ সকাল থেকেই তার সাথে কোন কথা বলেনি। এখন রুমে এসে নিজের লাগেজ থেকে একটা কালো টি শার্ট আর কালো ক্যাপ নিয়ে কাপড় পাল্টে পরে নিলো৷ ক্যাপটা মাথায় দিয়ে একবার আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে নিলো৷ পকেট থেকে ওয়ালেট এবং হাতের ঘড়িটা খুলে আবার আলমারির সামনে এসে দাঁড়ালো। মেহউইশ তাকে দেখে সরতে গিয়ে ধাক্কা খেলো রিশাদেরই বুকে। বোকার মত আলমারির দুইটি কপাটই একসাথে খুলতে গিয়েই মেহউইশ ধাক্কা খেয়েছে। নিঃশব্দে রিশাদ মেহউইশের বাহু ধরে তাকে সোজা করে দাঁড় করালো। কয়েক সেকেন্ড তাকিয়েই হাতের ঘড়ি আর ওয়ালেট একটা ড্রয়ারে রেখে সরে গেল। তার আপাতত ঘরে কোন কাজ নেই।

ছাঁদের দক্ষিণে চন্দ্রমল্লিকার টব গুলোর পাশে বসে আছে রাইমা। তার সামনে হাঁটু ভেঙে বসে পান চিবুচ্ছে মালা কাকী।রাইমা তাকে নাস্তার পরই জোর করে নিয়ে এসেছে এখানে। আব্বু সকাল সকালই আজ কোথাও বেরিয়ে গেছেন। যাওয়ার আগে মালা কাকীকেই বলে গেছেন রাইমার খেয়াল রাখতে দুপুরে যেন খাবারের খেয়ালও তিনিই রাখেন। এতে রাইমা কনফার্ম হলো দুপুরের আগে তার আব্বু বাড়ি ফিরবে না। আর এটাই সুযোগ তার সব কথা জানার।

‘কাকী আমার অনেক কিছু জানার আছে আপনার কাছে। প্লিজ কিছু লুকাবেন না দয়া করে। দেখুন আমার মা -বাবা সবাই অসুখী।’

-তুমি আবারও কাকী কইতাছো মাইয়া

-স্যরি কাকী, না দাদী আর ভুল হবে না। আপনি প্লিজ আমাকে বলেন কিছু জানা থাকলে।

-থামো মাইয়া, দম লও আগে। আমিও দেখতাছি জেবু ইদানীং বহুত রাগ দেহায়। এইবার তো বাড়ি ছাইড়া গিয়া বহুতই খারাপ কাম করছে। আফসোসের সুরে বললেন বৃদ্ধা।রাইমার এই কথায় মন ভরলো না। সে উদগ্রীব আরেকটু গভীর কোন কথা জানতে যা তাকে ফুপি আর মায়ের সম্পর্কের মধ্যকার অবস্থা জানাবে।

-‘আমার একটা ফুপি আছে তা কি আপনি জানেন?’ প্রশ্নটা করেই রাইমা তাকিয়ে রইলো বৃদ্ধার দিকে আর তাতেই বুঝতে পারলো বৃদ্ধা চমকেছেন খুব। এই চমকানোর অর্থ কি!

-তোমারে কে কইছে তোমার ফুপু আছে?

-আপনি উত্তর দিন দাদী। ফুপি আছে তা কি করে জানি পরে বলছি।

-নাহ, তার আগে কও তোমারে কে কইছে?

-আমি মায়ের সাথে চট্টগ্রামে গিয়েছিলাম দাদাভাইয়ের খোঁজে। হোটেল থেকে ভাইয়ার বাড়িতে গিয়েই দেখেছি আমাদের একমাত্র ফুপুকে এবং থেকেছিও একসাথে। কিন্তু,

‘ রেনুমার কাছে জেবু গেছিলো!’ এবার যেন বৃদ্ধা আরেকটু বেশিই অবাক হলেন। ভালো করে রেহনুমা উচ্চারণ করতে না পারলেও বোঝা গেল তিনি রেহনুমাকে খুব ভালো করেই চেনেন। রাইমার মাথায় জট পাকিয়ে যাওয়া ভাবনাগুলো এবার অস্থির হতে থাকলো সবটা জানার জন্য। সে বৃদ্ধার সামনে আকুতির সুরে বারবার বলল তাকে যেন সবটা জানায়। সে তার মা-বাবাকে একসাথে দেখতে চায় এমনকি দাদাভাই আর ফুপুকেও পাশে চায়। বৃদ্ধা যেন নিজেও এমন কিছু আশা করেন তাই নিজের জানা কথাগুলোই বলতে শুরু করলেন, ‘ বছর পঁচিশ কি ছাব্বিশ আগের ঘটনা। তখন রেবুন্নেসা মানে রিশাদের মায়ের মৃত্যুর পর থেকে রিশাদকে তার বাবা নিজের বাড়িতেই রেখেছিলেন। তার নানা-নানি মানে রাইমারও নানা নানী রিশাদকে নিজেদের কাছে নিতে চাইলে রাশেদ খান রাজী হননি। তখনও রিশাদের দাদা জীবীত ছিলেন। বাড়িতে একমাত্র মেয়ে তখন শুধু রেহনুমা ছিলো। রেহনুমা সদ্য কলেজে ভর্তি হয়েছে আর জেবুন্নেসা তার চেয়েও বছর পাঁচেকের বড়। রেহনুমার পক্ষে পড়াশোনা সামলে রিশাদকে রাখা ততবেশি একটা হয়ে উঠতো না। বাড়িতে আয়া থাকলেও জেবুন্নেসা আর তার মা প্রায় সপ্তাহ করে এসে থাকতেন এ বাড়িতে। এতে করে রেহনুমার জন্য সুবিধা হলো। মালা কাকী রান্নাঘর সামলাতেন আরো একজন কাজের লোক নিয়ে আর রেহনুমা তখন পুরোপুরি পড়ায় মনযোগী। তার পড়ার জন্য একদিন তার বাবা মানে রাশেদের চাচা একজন লজিং মাস্টার ঠিক করলেন।রেহনুমা আর জেবুন্নেসার মাঝে সম্পর্কের দ্বন্দ্ব সেই মাস্টারকে দিয়েই হয়। ঘটনাটা এমন রেহনুমার কিশোরী মনে তারই গৃহশিক্ষক ওবাইদুল এর প্রতি ভালোলাগার সৃষ্টি হয়। মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে ওবাইদুল ঢাকা শহরে নিজের থাকার জায়গা নেই বলে রেহনুমার ভালোলাগার কথা জানতে পেরেও চুপ ছিলো। এদিকে আবার রিশাদের জন্যই এ বাড়িতে আসা জেবুন্নেসাও কোন এক বর্ষায় নিজের মনেও ওবাইদুলের প্রতি ভালোলাগা অনুভব করে। রোজ রোজ আসা যাওয়ার পথে দু একবার দেখা হওয়া সেই দেখাতেই কোন এক সময় ওবাইদুলও দূর্বল হয় জেবুন্নেসার প্রতি। সেই সম্পর্ক আরো গভীর হয় সবার অগোচরে। জেবুন্নেসার রোজকার এ বাড়িতে আসা যাওয়া একসময় স্থায়ী থাকার মতোই হয়ে যায়। সময়ের গতিতে তাল মিলিয়ে রিশাদও একটু একটু বড় হয় কিন্তু ততদিনেও রাশেদের জীবনে খরা আরো কঠিন রুপ নেয়। বাড়িতে বুজুর্গ বলতে রাশেদের চাচা ছাড়া কেউ ছিলেন না। তিনিই বছর তিনেক বাদে অনেকটা জোর করেই রাজী করান রাশেদকে বিয়ের জন্য৷ ততদিনে জেবুন্নেসা খান বাড়িতে শুধু রাশেদের মৃত বউয়ের বোনই নয় পরিবারের পারমানেন্ট সদস্যই হয়ে গেছে। যা দেখে রেহনুমার বাবা নিজের মনে এক সিদ্ধান্ত নেন। এবং তা জেবুন্নেসার বাবা-মা’কেও জানান। জেবুন্নেসার বাড়িতেও তার বিয়ে নিয়ে সবাই অস্থির কিন্তু জেবুন্নেসা রাজী হয় না বলেই তারা আগাতে পারেননি। রেহনুমার বাবার পক্ষ থেকে রাশেদের জন্যই জেবুন্নেসার বিয়ের প্রস্তাব দিলে সাথে সাথেই রাজী হয়ে যায় জেবুন্নেসার বাবা। রেহনুমা তার গৃহশিক্ষককে পছন্দ করে সে কথাটাও জেনে যাওয়ায় রেহনুমার বাবা প্রস্তাব দেন ওবাইদুলকেও। ওবাইদুল অর্থহীন বেকার ছেলে যার মাথার ওপর ছাঁদ বলতে খান বাড়ির চিলেকোঠা ছাড়া কিছুই নেই। রেহনুমা যেমন খুশি হয় ওবাইদুলের সাথে তার বিয়ের সংবাদে তেমনি জেবুন্নেসাও ভেঙে পড়ে ওবাইদুলের বিয়ের খবর পেয়ে। ভাগ্যের ওপর কারো জোর নেই। ওবাইদুল বিয়ের প্রস্তাব পেয়ে রাজী না হয়ে রেহনুমার বাবার কাছে ক্ষমা চেয়ে তাদের বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। ওবাইদুল গ্রামের হলেও শিক্ষিত ছেলে । অর্থাভাবে ভালো শিক্ষার জন্য শহরে এসে চাকরীর খোঁজ করলেও ভাগ্য,সুপ্রসন্ন ছিলো না বলেই হয়তো তার চাকরিটা জোটেনি প্রথমে। ওবাইদুলের এক পরিচিতের মাধ্যমেই সে রেহনুমাদের বাসায় মাস্টারির সুযোগ পেয়েছিলো। মাস্টারি আর সততার গুণেই রেহনুমার বাবা তাকে নিজের ব্যবসায়েই একটা চাকরি দিলেও পাশাপাশি তার মেয়েকে পড়ানোর দ্বায়িত্বও বহাল রাখেন। ওবাইদুল তার দ্বায়িত্ব টানা তিন বছর খুব ভালো করেই পালন করেছিলো সেই সাথে জেবুন্নেসার সাথে প্রেমটাও। কিন্তু রেহনুমার অনুভূতির মূল্য এতোই চড়া যে ওবাইদুল আর জেবুন্নেসার সম্পর্কের মাঝে ফাঁক খুঁজে ঢুকে পড়ে৷ রেহনুমার বাবা ওবাইদুলের জন্য তিন বছরে অনেক করেছেন আর সেই কারণেই সে তার কথা রাখতে পারবে না বলেই বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিলো।যেতে যেতে জেবুন্নেসাকে একটি চিঠি দিয়েছিলো ওবাইদুল। সে চিঠি জেবুন্নেসার হাতে যাওয়ার আগে আরো দুটি হাত বদল হয়। প্রথমজন রেহনুমা আর দ্বিতীয় ব্যক্তি রাশেদ। রেহনুমা সেই চিঠি পড়েই জানতে পারে তার ভালোবাসার মানুষটি তারই ভাইয়ের একমাত্র শালি জেবুন্নেসাকে ভালোবাসে। রেহনুমা কষ্ট পায়, দীর্ঘ দিনের মনের ভেতর লালিত প্রেম তার পূর্ণতা পাওয়া তো দূর মনের মানুষটিকে জানানোর সুযোগটুকুও পায় নি। প্রথম প্রথম সে চেষ্টা করে ভুলে যেতে তার পছন্দের মানুষটিকে ভুলে যেতে। কিন্তু নিয়তি তা হতে দেয় নি৷ বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষার জন্য বাড়ি থেকে বের হয়েই সে ওবাইদুলকে দেখতে পায়। রেহনুমার পরীক্ষা বলেই সেদিন তার বাবা সাথে যান৷ হঠাৎ করে ওবাইদুলের দেখা পেয়ে তিনি কিছু বলতে যাবেন তার আগে ওবাইদুল নিজেই এসে ক্ষমা চায় রেহনুমার বাবার কাছে। কোন কিছু বুঝে উঠার আগেই সে রেহনুমার বাবার পায়ে পড়ে রেহনুমাকে বিয়ে করতে চায় বলে মিনতি করে।’ এ পর্যন্ত কথা শেষ করেই বৃদ্ধা রাইমার দিকে তাকান৷ রাইমার চোখে মুখে করুণ ছায়া। ভর দুপুরে জ্বলজ্বলে সূর্যটাও যেন মেয়েটার মুখ আলোকিত করতে পারছে না। বৃদ্ধা পুরনো দিনে অনেক নিয়ম কানুন মেনে চলতেন এখনও তার ব্যতিক্রম নয়। তাই রাইমার হাত ধরে বললেন, ‘ চলো নিচে যাইগা দুইফর বেলায় এনে থাহন বালা না।’

রাইমার চোখ ঝাপসা; সে ভাবছে তারপর কি হলো? ফুপির কি তারপর ওই টিচারের সাথে বিয়ে হয়েছিলো! আর সেজন্যই কি মা ফুপিকে সহ্য করতে পারে না! তার এখনও অনেক জানা বাকি কিন্তু বৃদ্ধা তাড়া দিলেন নিচে যেতে। অগ্যতা তাকে নিচেই যেতে হলো৷ এখনও অনেক জানার বাকি৷রহস্য তো কিছুই খোলাসা হলো না। আব্বুর সাথে মায়ের বিয়ে আর মায়ের বলা কথা আব্বু ধর্ষক,প্রতারক! নাহ, আমার আব্বু দুনিয়ার বেস্ট আব্বু তিনি কখনও কোন ভুল করতেই পারে না। যা শুনেছি সব ভুল, সব মিথ্যে। সে যেন নিজেই নিজেকে বোঝাতে লাগলো কথাগুলো।

দুপুরের খাবারের সময় রিশাদ হোটেলের রেস্তোরাঁ থেকেই খাবার কিনে আনলো। এখানে তাদের আলাদা কোন ডাইনিংরুম নেই। তবে সোফা থাকায় তারা সেখানে বসেই খাবার খাচ্ছে। রেহনুমা লক্ষ্য করছে সকাল থেকে আজ রিশাদ চুপচাপ। মেহউইশ পেটে ব্যথা হচ্ছে বলে আর খেতে বসেনি৷ সে পরে খাবে তাই আপাতত চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে বিছানায় তার পাশেই নির্জন খেলছে। রিশাদ নিজেই আজ গোসল করিয়েছে নির্জনকে। অবাক হয় রেহনুমা তার সেই ছোট্ট ভাতিজা আজ কত বড় হয়ে গেছে৷ নিজের সন্তানের খাওয়া,গোসল, ঘুম সব একা হাতেই সামলে নেয়। বিছানায় থাকা মেহউইশের দিকে দৃষ্টি পরতেই আবার ভাবে এই মেয়েটা কি রিশাদের আপন হবে না! রিশাদ বদমেজাজি, অর্থের জোর দেখায় কিন্তু সে জেনে বুঝে কারো ক্ষতি করে না এটাই তার মন বলে৷ আর যদি কারো ক্ষতি করেও থাকে তা যেন রিশাদ বুঝতে পারে অনুতপ্ত হয় আর সব শেষে যেন নিজেকে শুধরে নিয়ে নতুন এক জীবন তৈরি করতে পারে। মেহউইশটা নিজের করে নিক রিশাদকে এটাই যেন এখন রেহনুমার একমাত্র চাওয়া।

-‘খাচ্ছো না কেন ফুপি? তোমার কি এই তরকারি ভালো লাগছে না? অন্যকিছু খাবে?’ অস্থির হয়ে প্রশ্ন করতে লাগলো রিশাদ।

-‘ নাহ রে বাবা। আমার আর কিছু লাগবে না। ভাবছি মেহউইশটা কিচ্ছু খেল না। এভাবে পেটের ব্যথায় পড়ে থাকলে কি করে হবে!’ কপালে চিন্তার রেখা স্পষ্ট রেহনুমার। রিশাদ কোন জবাব দিলো না সে তার খাওয়া শেষ করে উঠে গেল। রেহনুমা নিজের খাওয়া শেষ করে থালাবাটি ধুয়ে পরিষ্কার করে নিজের ঘরে চলে গেল। রিশাদ নির্জনকে কোলে নিয়ে কিছুক্ষণ বেলকোনিতে হাটতেই নির্জন ঘুমিয়ে পড়লো। ছেলেকে বিছানায় শুইয়ে পাশে তাকাতেই খেয়াল করলো মেহউইশের ফ্যাকাশে মুখ। চোখের কোণ যেন দেবে গেছে অনেকটা। হয়তো ব্যথা আর খালি পেটে পড়ে থাকায় এমন লাগছে তাকে। আর কিছু না ভেবে রিশাদ বেরিয়ে গেল রুম ছেড়ে। বিগত দিনগুলো তার বড্ড পরিশ্রম আর চিন্তায় কাটছে। বাবার এ বয়সে ডিভোর্সটা ছোট ভাই বোন দুটোর ভবিষ্যত সব মিলিয়ে মাথার ওপর এক আকাশ পেরেশানি। দিনশেষে তার কেউ নেই এই কষ্ট, অস্থিরতা ভাগ করার মত। হোটেল ছেড়ে বেরিয়ে সে হাটতে লাগলো চুপচাপ । অনেকটা সময় সমুদ্রের নোনা জল থেকে উঠে আসা হালকা তপ্ত হাওয়া গায়ে লেগে যেন মস্তিষ্কে পরিবর্তন এলো তার৷ একাকী জীবনে সে অনেক আপন মানুষকেই আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চেয়েছিলো। বাবা,ফুপি,খালা, ভার্সিটিতে প্রথমবার ভালো লাগা সেই মেয়ে এবং সর্বশেষ নীলিমা। কেউই শেষ অব্দি পাশে থাকার প্রতিজ্ঞা করেনি। কোন না কোন কারণে সবাই দূরে চলে গেছে৷ সেই ছোট্ট বেলায় অবুঝ বয়সে মাকে হারিয়ে সে একা একাই এত বড় হয়ে গেল। নিজেকে দেখেই সন্তানের জন্য মা খুঁজলো সেই সাথে রাইমার সুখের কথা ভেবেই সে মেহউইশকে জোর করে বিয়ে করলো। কি লাভ হলো! শেষ পর্যন্ত কতোটা ভালো সে কজনের করতে পারলো? ইভান তো মেহউইশকে হারিয়ে অন্য একজনের হয়ে গেল। নির্জনও সত্যিকার অর্থে মেহউইশকে মা হিসেবে পেলো না। তাহলে তার এত অন্যায় করে কি লাভ হলো! দমকা হাওয়ার ঝাপটার সাথে বালিকণাও উড়ে এসে চোখে পড়লো রিশাদের। বুকের ভেতর চিনচিনে এক সুক্ষ্ম ব্যথার ধারালো দাঁত কামড় বসাচ্ছে।
#মন_গহীনের_গল্প
পর্ব-৩০
#রূবাইবা_মেহউইশ
💞

হোটেল থেকে বের হওয়ার সময় ফোনটাও রুমেই রেখে এসেছে রিশাদ। ম্যানেজার সাহেব প্রায় আধঘন্টা যাবৎ রিশাদকে কল করেও যখন পেলো না তখন বাধ্য হয়েই রিশাদের রুমের দরজায় নক করে। মেহউইশের সবে আলমারী গোছানো শেষ হয়েছে। দরজায় নক শুনে লুকিং গ্লাসে চোখ রেখে দেখলো দরজায় কে আছে। ফুপু হলে নিশ্চিত নাম ধরেও ডাকতো দু একবার। বাইরে দাঁড়ানো ম্যানেজারকে মেহউইশ চেনে না। তাই দরজা খুলবো কি খুলবো না ভেবে রিশাদের ফোনটা নিয়ে দেখলো তাতে পচাত্তরটা মিসড কল। সাইলেন্ট থাকায় সে কোন আওয়াজই শোনেনি৷ হয়তো ফোন করা ব্যক্তিটিই দরজায় কিন্তু সে কি করবে ভাবতে ভাবতেই দরজা খুলল৷

– ম্যাম, রিশাদ স্যার কি রুমে আছেন? ম্যানেজার জিজ্ঞেস করলো।

-নাহ, তিনি অনেকক্ষণ আগেই ঘর থেকে বেরিয়েছেন।

-ফোনেও পাচ্ছিলাম না তাই এখানে আসতে হলো। ডিস্টার্ব করার জন্য দুঃখিত ম্যাম৷

-ইট’স ওকে। উনি ফোনটা ঘরেই ফেলে গেছেন।

মেহউইশ কথা শেষ করতেই ম্যানেজার ফিরে যাচ্ছিলো তখনি পেছনে রিশাদকে দেখা গেল। মেহউইশ তখনও দরজায় দাঁড়িয়ে। ম্যানেজার এগিয়ে গিয়ে রিশাদকে কিছু বলতে চাইলে সে থামিয়ে দিলো, ‘আপনি যান আমি কিছুক্ষণ পর এসে কথা বলছি আপনার সাথে।’

ম্যানেজার আর অপেক্ষা করেনি। মেহউইশ একবার খেয়াল করলো রিশাদের চোখ,মুখের অবস্থা ভালো নয়। ভয় হলো এখন কি রিশাদ তাকে আবারও কিছু বলবে এভাবে গেইট খুলে ম্যানেজারের সাথে কথা বলায়! এই লোকের তো মতি গতির ঠিক নেই। অবচেতন মনে অন্যরকম ভয় জেঁকে বসলো কিন্তু তার ধারণা ভুল করে দিয়ে চুপচাপ ঘরে ঢুকলো রিশাদ। জামা কাপড় পাল্টে আবার বেরিয়ে গেল তার ফোন আর অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে। মেহউইশও স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়ে নির্জনের জন্য দুধ বানাতে লাগলো৷

জেবুন্নেসা তার বড় ভাইকে জানালো সে আর রাশেদের সাথে থাকবে না। ডিভোর্স এর জন্য এপ্লাই করতে চায়। শুধু বয়স না ছেলে মেয়ের ভবিষ্যতের কথা বলেও তার ভাই তাকে বোঝালো এখন এটা কোন সমাধান নয়।ডিভোর্স সত্যিই কোন সমস্যার সমাধান হতে পারে না তা জেবুন্নেসাও মানে। সে তো এতবছর সংসারও করে আসছিলো চুপচাপ। কিন্তু এখন যা করছে রিশাদের সাথে ভবিষ্যতে রিহানকেও নিয়ে তা করতে পিছপা হবে না এই লোক। আর মেয়েটারও ভবিষ্যত ভাবতে হবে এখন থেকেই।

রাইমা স্তব্ধ হয়ে বসে আছে ফ্লোরে তার পাশেই তার কাঁধে হাত রেখে বসে আছে বৃদ্ধা। দরজার আড়াল থেকে সরে গেছে রিহান। কিশোর বয়সী ছেলেটার গরম মস্তিষ্ক তার মায়ের অতীত শুনে আচমকাই বরফ শীতল হয়ে গেছে। রক্তশূন্য মনে হচ্ছে তার নিজেকে আর ঘৃণায় শক্ত হয়ে আসছে মন। এত বছর ধরে আব্বু বলে জানা লোকটাকে শুধু একজন ধর্ষক ছাড়া কিছুই মনে হচ্ছে না এখন তার। একটু আগেই বৃদ্ধা বলেছে, ওবাইদুল যখন রাস্তায় সবার সামনেই রেহনুমার বাবার পা জড়িয়ে ধরে, ক্ষমা চায় এবং রেহনুমাকে বিয়ে করতে চায় তখনি রেহনুমার বাবা রাজী হয়ে যান৷ সেদিনই পরীক্ষা শেষে কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ে দেন তাদের। তারপর দিন জেবুন্নেসাকে বিয়ে করে বাড়ি ফেরেন রিশাদের বাবা। বাড়িতে কোন প্রকার প্রশ্ন করার কেউ ছিলো না তখন। রেহনুমার বাবা জেবুন্নেসার পরিবার আর ওবাইদুল এর পরিবারকে ডেকে আনুষ্ঠানিকতার কথা জানান। জেবুন্নেসার পরিবার খান বাড়িতে উপস্থিত হলেও অনুপস্থিত থাকে ওবাইদুল আর তার পরিবার। ওবাইদুল কাজী অফিস থেকে বাবা মাকে আনতে যাওয়ার কথা বলেই বিয়ের কাজ শেষ করে চলে যায়। সেই যাওয়াই থাকে তার শেষ যাওয়া। গ্রামে গিয়ে নিজের ঘরেই গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করে সে। জেবুন্নেসাকে ধর্ষনের হুমকি দিয়েই ওবাইদুলকে বিয়েতে রাজী করিয়েছে রাশেদ। শুধু হুমকিই নয় সে প্রতারণাও করেছে । ওবাইদুল তার কথা রেখেছে রেহনুমাকে বিয়ে করেছে কিন্তু রাশেদ তার কথা রাখেনি। ওবাইদুলের নামে চিঠি দিয়ে জেবুন্নেসাকে বাড়ি থেকে বের করিয়েছিলো সে। আটকে রেখে তাকে সত্যিই ধর্ষণ করেছে। যা জেবুন্নেসার পরিবার কিংবা রাশেদের পরিবারের সবার অজানা। আর বিয়েটাও জেবুন্নেসা রাশেদের মিথ্যে হুমকিতেই করেছিলো। তখন তার এতোটা সাহস ছিলো না রাশেদের বিরোধিতা করার। নিজের সম্ভ্রম হারিয়েও রাশেদের কথায় ভয় পেয়েছিলো। ধরেই নিয়েছিলো সে যে ব্যক্তি তাকে ধর্ষণ করতে পারে সে দুনিয়ায় পারে না এমন কোন কাজ নেই। ওবাইদুলকে খুন করতেও সে একবারও ভাববে না। আর সেই ভয়েই ইজ্জত হারিয়েও রাশেদকে বিয়ে করেছিলো। নিয়তি তো আগেই লেখা ছিলো যা জেবুন্নেসার অজানা। খান বাড়িতে পা রেখেই জানতে হলো ওবাইদুল আর রেহনুমার বিয়ে হয়েছে কাল এবং আজ ওবাইদুল মৃত। ভালোবাসার মানুষের পরিণতি জানার পর অনেক অনেক দিন পাগলের মত ছিলো জেবুন্নেসা। রেহনুমাও অর্ধমৃত লাশের মতোই পড়েছিলো বাড়িতে। সময় কারো জন্যই অপেক্ষা করে না। সময়ের সাথে সাথে জেবুন্নেসা অনেকটা স্বাভাবিক হলেও রেহনুমা আর রাশেদের প্রতি জন্ম নিলো তার মনে বিষাক্ত ক্ষোভ৷ রেহনুমাকে একদমই সহ্য করতে পারতো না সে। এরই মাঝে বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠ রেহনুমার বাবার মৃত্যু হলে রেহনুমা আরও ভেঙে পড়ে। সে জেবুন্নেসার ক্রুদ্ধ দৃষ্টির সামনে টিকে থাকার সাহস হারিয়ে একসময় দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেয়। রাশেদও নিজের কৃতকর্মের ফল ভালো কিছু না পেয়েই হার মেনে বোনকে বিদেশে পাঠিয়ে দেন। তার প্রয়োজনের সবটা খেয়াল রেখেই সে দেশে জেবুন্নেসার সাথে নতুন সংসারে মনযোগী হতে চান। ততদিনে রিশাদ বুঝতে শিখে গেছে তার খালা তার সৎ মা। যে কিনা তাকে একসময় আদর করলেও এখন বিনাকারণেই দূরছাই করে। এতে করে সে খালা থেকে দূর আর বাড়ির আয়া, কাজের লোকদের সাথেই বেশি ঘনিষ্ঠ হয়। তবে রক্তের ধারা থেকেই হয়তো অর্জিত জঘন্যতম রাগটাও তার মধ্যে বিস্তৃতি লাভ করে। রিশাদ দূর হতে থাকে বাবার সঙ্গ, মা নামক খালার সঙ্গ থেকে ; তার সময় কেটেছে নিতান্ত একাকীত্বে অথবা উশৃঙ্খল বন্ধু-বান্ধবের সাথে ঘুরে ফিরে। তবে দুটো জিনিস তার মধ্যে কখনো আসেনি একটা নারীঘটিত কোন বাজে দিক আর দ্বিতীয়টি তার পড়াশোনায় অবহেলা। এ দুটি ব্যাপার কখনোই ঢুকতে পারেনি তার মনে কিন্তু ভালোলাগাটা এসেছিলো একজনের প্রতি৷ বাবার অর্থ নিয়ে অহংকারে হারাতে হয়েছে প্রিয় মানুষটিকে। সময়ের ধার অনেক কিছুই বদলে দিয়েছে খান বাড়ির প্রতিটি মানুষকে শুধু বদলায়নি জেবুন্নেসার মনের ক্ষত আর রাশেদ খানের প্রতি জমে থাকা ক্ষোভ। লোকটাকে খুন করতে পারলেই হয়তো সে মন থেকে সুখ পেত৷

বৃদ্ধা তার কথা শেষ করে আঁচল টেনে চোখ মুছলো। সব কাহিনি বলতে বলতে কখন যে তারও চোখে জল এসে উপচে পড়েছে টের পায়নি। রিহান বাড়ি ছেড়ে কোথায়, কোন পথে হাঁটছে নিজেও জানে না। শুধু জানে কথাগুলো বুঝি তার আড়াল থেকে না শুনলেই ভালো হতো। মায়ের জীবনের বিশ্রী ঘটনাগুলো না জানলেই হয়তো স্বস্তিতে জীবন পার করা যেত। এই বয়সের ভয়ংকর রাগগুলো এখন তার নিজের বাবাকেই খুন করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে৷ কি হতো এখন এই মুহূর্তে যদি আব্বু সামনে থাকতো! পায়ের কাছে ভাঙা একটা পাথর চোখে পরতেই মনে হলো এটা উঠিয়ে ঠিক বাবার মাথায় আঘাত করতো সে অথবা কোন ধারালো তীক্ষ্ণ ছুরি থাকলে! রাগ যেন তার শরীরের প্রতিটি স্নায়ুকোষকে উত্তপ্ত করে তুলছে। কি করতো সে? কি করবে সে! বাবাকে খুন করবে নাকি মাকে নিয়ে চলে যাবে বহুদূর। এতোটা দূর যেখানে তার মায়ের গায়ে কোন দুঃখের আঁচ পড়বে না।

স্রোতের বিপরীতে চলার জন্য শক্তি সর্বদাই অধিক প্রয়োজন। মেহউইশের জীবনও তার বিপরীতে চলছে। রিশাদকে সে যতোই চাইছে এড়িয়ে যেতে, সুযোগ পেলে পালিয়ে যেতে ততোই সে দূর্বল হয়ে পড়ছে এ সম্পর্ক থেকে পালিয়ে যেতে। নির্জনের ওপর মায়া পড়ে গেছে ভীষণ। রাত বিরাতে ঘুমের ঘোরে রিশাদের জড়িয়ে রাখাটাও আজকাল আর খারাপ লাগে না। জাগ্রত রিশাদকে সে যতোটা তুচ্ছ করে ততোটাই সে ঘুমন্ত রিশাদকে পছন্দ করে। ইভানের ভালোবাসা স্মৃতি হয়ে একের পর এক দিন করে পেছনে চলে যাচ্ছে। দেখতে দেখতে হোটেলে আসার তাদের একমাস পূর্ণ হয়ে গেছে। নিয়ম করে রোজ সকালে হাঁটতে বের হয় মেহউইশ সাথে থাকে রেহনুমা আর কোলে থাকে নির্জন। ভোরের হাওয়ায় গায়ে রোদ মেখে এই হাঁটতে বেরুনোটা বেশি উপভোগ করে মেহউইশ। তার পেছনে কয়েকটা কারণ। প্রথমত রিশাদ তাদের থেকেও আগে উঠে সৈকতে এসে দৌঁড়ায়। লক্ষ্য করেছে মেহউইশ গত দু মাসে রিশাদের এই একটা নিয়মে কখনো ব্যতিক্রম হয়নি। ঢাকায় থাকতেও বাড়ির বাইরে দৌঁড়ে বেরিয়েছে। পাহাড়ি বাড়িতে থাকতে পাহাড়ি আঁকাবাকা পথেও সে দৌঁড়েছে আবার এখানে এসে বিচেও তাই করে৷ তার রুটিনে এই একটা জিনিস বোধহয় কখনো বদলায়নি। আর দৌড়ে থাকা রিশাদকে দেখে তার সবসময় মনে হয় এই লোকটা খারাপ নয়। ভালো হয়ে যাবে একদিন। দ্বিতীয়ত, ভোরে উঠে তার শরীর ও মন দুটোই দিনভর চাঙ্গা আর ফুরফুরে থাকে আর তৃতীয়ত, তার ঘরের কাজকর্ম সে সকাল সকালই শেষ করে বিকেলে দারুণ অবসর কাটাতে পারে। এখানে এসেই রিশাদ বলে দিয়েছে নিজেদের সকল কাজ নিজেরাই করতে হবে। কাজের লোক দেওয়া হবে না একজনও এমনকি অতি প্রয়োজন ছাড়া হোটেল স্টাফদের সহায়তাও নেওয়া যাবে না। এই একটা ব্যাপারেই মেহউইশের মনে হয়েছে লোকটা খুব কৃপণ।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here