মন গহীনের গল্প পর্ব -৩৩+৩৪

#মন_গহীনের_গল্প
পর্ব-৩৩
#রূবাইবা_মেহউইশ
💞

সন্ধ্যার ব্যস্তময় ঢাকা শহরে গাড়ির হেডলাইটের আলোগুলো জোনাকির আলোর মত মনে হচ্ছে। গাড়ির সিটে মাথা এলিয়ে চোখ বন্ধ করলো মেহউইশ। সারাটাদিন তার রিশাদদের বাড়িতে কেটেছে নির্জনকে নিয়ে। একটু আগেই রিশাদ ফোন করে তাকে ধমকেছে খুব৷ কেন সে ওই বাড়িতে গেল সেই অপরাধে তাকে এই মুহূর্তে হাসপাতালে পৌঁছানোর হুকুম দিয়েছে রিশাদ। নির্জনটা ঘুমিয়ে পড়েছে বলে রাইমার কাছে রেখে এসেছে তাকে। হাতে কিছু টাকা থাকায় রিশাদদের বাড়ির সামনে থেকে ক্যাবে উঠেছে। অসুস্থ মানুষ অর্ধেক দিন নিথর পড়ে থেকেও এখন কি তেজী স্বরে ধমকালো তাকে। ম্যানেজারের কারণে দ্রুতই প্লেনে করে ঢাকায় এসেছে তারা। তারপরই জেবুন্নেসা রিশাদকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে ইমারজেন্সি সকল টেস্ট করিয়ে নিয়েছে। আধঘন্টার মত হলো রিশাদকে কেবিনে দিয়েছে। আর তাতেই লোকটা দুনিয়া উল্টেপাল্টে ফেলার চেষ্টা করছে।

গাড়ি এসে হাসপাতালে থামলে মেহউইশ ভাড়া মিটিয়ে নেমে পড়লো। হাতে থাকা পার্সটাতে তার ফোন কিন্তু কাকে ফোন করবে বুঝে আসছে না। হাসপাতালে রিশাদের সাথে বড় মামা আর জেবুন্নেসা আছে এমনটাই বলেছে রেহনুমা৷ জেবুন্নেসার ফোন নম্বরও দিয়েছে কিন্তু কল করবে কি করবে না ভেবে রিশাদকেই ফোন দিলো। ওপাশ থেকে গলা শোনা গেল, ‘ এখনও এলে না কেন? ‘

-এসেছি। কোন ফ্লোরে আছেন?

– ‘তিন তলার প্রথম কেবিন।’ বলেই কল কেটে দিলো রিশাদ। মেজাজ খারাপ হলো মেহউইশের । যেখানে কল সে কাটবে সেখানে লোকটা নিজেই কেটে দিলো। যাচ্ছেতাই সব স্বভাব এই লোকের এমনটাই মনে হলো মেহউইশের । সে লিফটে ঢুকে তিন তলায় যাওয়ার জন্য সুইচ টিপতেই চোখে পড়লো ইভান দাঁড়িয়ে আছে সামনে। নাহ, সে লিফটের ভেতরে নয় বাইরে দাঁড়ানো। বুকের ভেতর কিছু একটা ছ্যাৎ করে উঠলো। কয়েক সেকেন্ডের পলকহীন চাহনি তারপরই লিফট থেকে বেরিয়ে আসার আগেই দরজা বন্ধ হয়ে গেল। দ্রুত লিফট অফ করতে গিয়ে পঞ্চম তলার সুইচে চাপ লাগলো। দম বন্ধ হয়ে আসছে মেহউইশের, দুনিয়া উলটপালট হয়ে যাচ্ছে কয়েক সেকেন্ডেই। একি হলো! ইভান এখানে কি করছে৷কান্না পাচ্ছে তার দরজাটা ভেঙে ফেলতে ইচ্ছে করছে৷ লিফট পঞ্চম তলায় থামতেই মেহউইশ বেরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে আবার নিচ তলায় যাচ্ছে। উপর, নিচ করে করে প্রায় আধঘন্টা যাবৎ সে পাঁচ তলা বিল্ডিংটাকে তন্ন তন্ন করে খুঁজেছে। ইভানের ছায়াটারও দেখা পায়নি সে আর। কান্নার দমক এতক্ষণ যাবৎ গলায় কাঁটার মত আটকে ছিলো। তা হঠাৎ করেই জেবুন্নেসার ডাক শুনে ছিটকে বেরিয়ে এলো। প্রথম তলায় সিঁড়ির গোড়ায় পা ছড়িয়ে বসে কান্না করতে লাগলো সে। প্রিয় মানুষ, হারিয়ে ফেলা প্রিয় মানুষটাকে আজ কতদিন পর আজ চোখের সামনে দেখতে পেল অথচ তাকে ছুঁয়ে দেখার ক্ষমতা হলো না। তার গলার স্বর, তার চোখে চোখ রাখা সবই দুঃস্বপ্নের মত হয়ে গেল।

-‘কি হয়েছে তোমার, এভাবে কাঁদছো কেন?’ জেবুন্নেসা পাশে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলো কিন্তু মেহউইশের কান্না থামলো না। জেবুন্নেসা কি করবে ভেবে না পেয়ে একটু কুঁজো হয়ে বাহু ধরলো মেহউইশের।

-‘কি হয়েছে তোমার? তুমি নাকি অনেকক্ষণ আগে এসেছো রিশাদ বলল।’ জেবুন্নেসার বলা কথা শুনতেই যেন মেহউইশের হুঁশ এলো। সে বসা থেকে উঠে সোজা দাঁড়ালো। ওড়না টেনেটুনে জামাটাকে ঝেড়ে ঠিক করে দাঁড়ালো। বা হাতে দু গালের পানি মুছে নিজেকে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু ফোঁপানো তখনও পুরোপুরি তার বন্ধ হয়নি। মেহউইশের আচরণে আশ্চর্য হলো জেবুন্নেসা। মেয়েটা এমন করছে কেন আচানক তার বোধগম্য হচ্ছে না। এদিকে মেহউইশের মস্তিষ্ক বলছে তার ফোন কি এতক্ষণ বাজছিলো! সত্যিই বেজেছিলো ফোনটা তার। জেবুন্নেসা সামনে আসার আগেও সে পার্থিব সবকিছু ভুলে যেন অন্য জগতে চলে গিয়েছিলো। কি হয়েছে একটু আগে মনে নেই শুধু মনে পড়ছে রিশাদ তাকে যেতে বলেছে উপরে। কোন ফ্লোর যেন বলেছিলো!

-‘আন্টি উনি কোন ফ্লোরে?’

জেবুন্নেসা তীক্ষ্ণ নজরে দেখছে মেহউইশকে। মেয়েটার কি মাথায় গন্ডগোল আছে কোন প্রকার! পাগল টাগল নয়তো আবার? কে জানে রিশাদ একেই কেন ধরে এনেছিলো! বিয়ের জন্য দুনিয়ায় মেয়ের এতোই কি অভাব ছিলো নাকি? তবুও যদি মেয়েটার অন্য কোথাও এ্যাফেয়ার না থাকতো, এসব ভাবতেই লাগলো জেবুন্নেসা ।

-‘ আন্টি!’ মেহউইশ আবার ডাকলো।

‘তিন তলায়।’ জেবুন্নেসা আরও কিছু বলবে তার আগেই মেহউইশ সিঁড়ি বেয়ে যেতে লাগল।

-‘হাফ সাইকো মেয়ে একটা!’ বিড়বিড় করতে করতে জেবুন্নেসাও চলে গেল।

কেবিনের দরজায় মুখটা কাঁচুমাচু করে দাঁড়িয়ে আছে মেহউইশ।আবারও ধমক খেয়েছে সে রিশাদের কাছে উপরে আসতেই। আধঘন্টা আগে ফোন করে ফ্লোর জেনেও লাপাত্তা তাতেই রিশাদ চিন্তিত হয়েছিলো। লাগাতার ফোন করেও যখন মেহউইশের হদিশ পেলো না তখনই সে জেবুন্নেসা বলেছিলো, ‘ মেবিশ ফোন করেছিলো অনেক আগে। কত নম্বর ফ্লোরে আছি তা জেনেও এখনও সে পৌঁছায়নি। আপনি কি একটু দেখবেন সে হাসপাতালেই আছে কিনা?’ জেবুন্নেসা অবাক হয়েছিলো তখন রিশাদের কথা শুনে কিন্তু এখন তার মনে হচ্ছে মেয়েটা পাগল তা রিশাদ জানে। তাই ওরকম চিন্তিত ভঙ্গিতে কথাগুলো বলেছিলো।

-‘নির্জনকে নিয়ে আসোনি কেন?’ রিশাদ প্রশ্ন করলো মেহউইশকে।

-‘আহ্ রিশু, কি শুরু করেছো? মেয়েটা এই ভর সন্ধ্যায় এসেছে আবার বলছো বাচ্চাটাকেও আনার কথা? এই চেন্জিং ওয়েদারে অসুস্থ হয়ে পড়বে তো।’ রিশাদের মামা কথাটা বলে তাকালেন জেবুন্নেসার দিকে৷ তিনি এসেছেন রিশাদকে হাসপাতালে আনার পরপরই। সেই থেকে এক পাও নড়েননি সাথে জেবুন্নেসাও। কিন্তু এবার মামা সিঙ্গেল সোফাটা থেকে উঠে দাঁড়ালেন।

‘রিশাদের বউ তুমি তো রাতে এখানেই থাকবে। খেয়াল রেখো তার আর কোন প্রয়োজন পড়লেই তৎক্ষনাৎ আমাকে অথবা জেবুকে ফোন দিবে।’ মেহউইশের উদ্দেশ্যে কথা বলেই মামা জেবুন্নেসাকে বললেন, ‘চল আমরা বাসায় যাই এখন।’

-‘আমি এখানেই থাকবো ভাইয়া।’ বাচ্চাদের মত জেদি কন্ঠে বলল জেবুন্নেসা। রিশাদ আর তার মামা দুজনেই বিষ্মিত হলেন। রিশাদ বোঝে তার খালা মুখে যতোই কটুবাক্য বলুক না কেন মনে মনে সে রিশাদের ব্যপারে খুবই পজেসিভ। কিন্তু রাতে এখানে মেহউইশ ছাড়া অন্যকারো থাকাটা অপ্রত্যাশিত। মামা অবুঝ নন তিনি জোর করেই জেবুন্নেসাকে সাথে করে নিয়ে গেলেন। রিশাদের মামা,খালা যেতেই মেহউইশের অস্বস্তি বেড়ে গেল৷ এতদিন একঘরে, একসাথে থেকেও এতোটা অপ্রস্তুত সে কখনো হয়নি। রিশাদের হাতে ক্যানোলা, ড্রিপ লাগানো। একজন নার্স এসে রিপোর্টস হাতে দিয়ে গেল মেহউইশের । রিশাদকে যে ডক্টর দেখেছেন তিনি আপাতত হাসপাতালে নেই। কাল সকালে আসবেন তিনি তাই রিশাদ বলল আজ আর রিপোর্টও দেখাবে অন্য কোন ডাক্তার। মেহউইশের অত সাহস কই সে কিছু বলবে তাই চুপই রইলো। মাইমুনা ফোন করেছিলেন মেয়ের সাথে কথা বলতে তখনি জানতে পারেন মেহউইশরা ঢাকায়। তিনি আর ধৈর্য্য রাখতে পারেননি মেয়েকে না দেখে থাকার। মিহাদকে নিয়ে হাজির হন হাসপাতালে। অনেকটা সময় মা, মেয়ে কেবিনের বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বলে যখন কেবিনে ফিরলো তখন রিশাদ প্রথমেই বলল, ‘ গোপন কথা এখনও কিছু বাকি থাকলে শেষ করে এসো। এখানে কোন কাজ নেই তোমাদের। ‘

মেহউইশ কিছু বলবে তার আগেই মাইমুনা বলল, ‘ গোপন কথা না বাবা।তুমি অসুস্থ তাই তোমার যেন ডিস্টার্ব না হয় সেজন্য বাইরে,,,’

-হয়েছে থাক, আর বলতে হবে না। আরো কথা থাকলে বলো আসেন আমার সমস্যা নেই। আর তোমাকে বলছি, কাল সকালেই নির্জনকে দিয়ে গেলে তোমার বাড়িতে যাবে। খান বাড়ির ত্রিসীমানয়ও যেন ছায়া না পড়ে তোমার কিংবা আমার ছেলের।

রিশাদের কথায় মা,মেয়ে দুজনেই ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেছে।মিহাদ চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলো কেবিনেই। রিশাদের কথা শেষ হতেই মাকে বলল, ‘যাওয়া যাক।’ মেহউইশ তার ভাইকে ধরেও টুকটাক কথা বলল । তারা চলে যেতেই রিশাদ ডাকলো, ‘এদিকে এসো।’

-জ্বী!

-বাংলা বোঝো না?

-জ্বী।

-ডোর লক করে এদিকে এসো।

মেহউইশ ভেবে পায় না একজন অসুস্থ মানুষ এভাবে কেন ডাকবে! ডাকার ধরণ এত ভিন্ন কেন? ভয়ে ভয়ে সত্যিই সে দরজাটা লক করে রিশাদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। ক্যানোলা লাগানো হাতটা দিয়েই মেহউইশের একটা হাত চেপে ধরলো রিশাদ। রাগে তার চোখ মুখের রঙ বদলে গেছে। অসুস্থ, দূর্বল মানুষের গায়ের জোর এত বেশি হয় কি করে! মেহউইশের মনে হলো তার হাতের হাড়টা ভেতর থেকে ভেঙে টুকরো হয়ে যাচ্ছে ।

-‘আমাকে নিয়ে এত ভাবার সাহস হয় কি করে? আমার বাবাকে ফোন করার তুই কে! আমি বলেছি আমার বাবাকে খবর দে? আমার চৌদ্দগুষ্টিকে ডেকে আমার চিকিৎসা করা? কোন ভয়ে সবাইকে জানিয়েছিস! আমি অসুস্থ হয়ে মরে গেলেইবা কি তোর বিয়ের দেনমোহর আমি আগেই পরিশোধ করে দিয়েছি৷ আমি মরলেও তুই শুধু দেনমোহর না আমার ভাগের সম্পত্তি যা আছে তা থেকেও ভাগ পাবি। আর কোনদিনও আমার অসুস্থতা কিংবা অসহায়ত্ব দেখে খান বাড়ির কোন কাকপক্ষীকেও খবর দিবি না অন্যথা তোর ঘাড়ে বিপদ ছাড়া আর কিছুই জুটবে না।’ কথা শেষ করে তবেই রিশাদ হাত ছাড়লো মেহউইশের৷ চমকপ্রদ জীবনটা আরো এক চমক দেখালো মেহউইশকে৷ কারো উপকার করতে গেলেও যে এমন ব্যথা পেতে হয়, অপমানিত হতে হয় তা শুধু রিশাদের কাছে জানলো সে৷ লোকটার কি কোনরকম মানসিক সমস্যা আছে কিনা তা জানতে ইচ্ছে করছে না। হাতটা চেপে ধরায় যতোটা ব্যথা লেগেছে তার চেয়ে দ্বিগুণ সে মনে মনে কষ্ট পেয়েছে। সন্ধ্যায় ইভানকে দেখে মনে ভেতর যে ক্ষত তাজা হয়েছিলো সেই ক্ষতের ব্যথাও এখন অনুভব হচ্ছে না তার।

তিশমা মন খারাপ করে বসে আছে হোটেলের তিন তলায়। বিলিয়ার্ড খেলার বোর্ডের পাশেই একটা চেয়ার এনে বসেছে৷ এখানে আজকে খেলছে না কেউই তাই জায়গাটা নীরব৷ মন খারাপের সময় নীরবতার চেয়ে ভালো কোন ঔষধ আর নেই৷ সমুদ্র তীরে হাটলে সমুদ্রের হাওয়া আর লাল কাঁকড়ার পালিয়ে বেড়ানো দেখলেও মনটা ভালো হয় কিন্তু এখন তার হাঁটার ইচ্ছেটাই নেই৷ রিশাদকে সে বন্ধুর মত ভালোবাসে। রিশাদের অসুস্থতা সত্যিই তাকে কষ্ট দিচ্ছে খুব। কিন্তু এ কথা মুখে বলে প্রকাশ করার মত নয়। ম্যানেজার সাহেব এখনও ফেরেনি ঢাকা থেকে তাই রিশাদের খোঁজটাও সে ঠিকঠাক নিতে পারছে না। রিশাদকে ফোন করবে করবে করেও মনে হলো করা উচিত হবে না। #মন_গহীনের_গল্প
পর্ব ৩৪
#রূবাইবা_মেহউইশ
💞

হাসপাতালের নিস্তব্ধতা কতখানি ভূতুড়ে লাগতে পারে তা যেন মেহউইশ আজই জানলো। হতে পারে তারা ভি আই পি এরিয়া বলেই এতোটা শান্ত পরিবেশ পেয়েছে। রিশাদকে রাতের খাবারে স্যুপ ছাড়া কিছুই দেওয়া হয়নি৷ মেহউইশ নিজ হাতে খাইয়ে দিয়েছে তাকে কিন্তু নিজে না খেয়ে থাকার ইচ্ছে ছিলো, রিশাদ তা হতে দেয়নি। সে নিজে একজন নার্সকে ডেকে খাবার আনিয়েছে এবং ধমকের সাথেই মেহউইশকে খেতে বলেছে। প্রথম প্রথম যেই ধমকগুলো মেহউইশের খুব বিশ্রী অপমান বলে মনে হতো আজকাল সেই ধমকই তার কাছে শাষণ মনে হয়। মনে হয় রিশাদের আচরণই এমন রুক্ষ।সে কোমল সুরে কাউকে কিছু বোঝাতে পারে না। ধমক খেয়ে প্রথমে খারাপ লাগলেও পরে হাসি পায় মেহউইশের। লোকটা রাগ আর জেদের ভান্ডার স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে খুলতে পারলেও ভালোবাসার ভান্ডার তার জেদের আড়ালে লুকানো আছে। রাতের খাওয়া শেষ হলে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করেছে মেহউইশ আর রিশাদ বসে ফোনকলে তার কাজের খবরা-খবর নিয়েছে৷ ম্যানেজার সাহেবকে বলা হলো সে দু দিনের মধ্যেই কক্সবাজার ফিরছে। কথাটা শুনে চকিতে তাকালো মেহউইশ । সে সবেমাত্র করিডোর থেকে কেবিনে ঢুকেছিলো।

-‘ডাক্তার এখনও রিপোর্ট দেখেনি। কবে হাসপাতাল থেকে ছাড়বে তাও জানা নেই’ রিশাদের উদ্দেশ্যে কথাটা বলল মেহউইশ । কান থেকে ফোনটা নিচে নামিয়ে নিলো রিশাদ।

-‘কবে ছাড়বে, কতদিন রাখবে সেটা আমি ঠিক করে নেবো। ‘

-‘বেয়াদব লোক’ বিড়বিড় করলো মেহউইশ।

-কিছু কি বললে?

-নাহ

-‘গুড, এদিকে এসো।’

ভালো বিপদে পড়া গেল। লোকটা যখন তখন বলে বসে কাছে আসার কথা। মেহউইশ ভাবে অন্যকিছু। রিশাদ তাকে আবারও ডাকতেই সে বেডের কাছে যায়। তাকে অবাক করে দিয়ে রিশাদ তার হাত ধরে টেনে বসায় বিছানায়। কোমর জড়িয়ে ধরে ইশারা করে শুয়ে থাকতে। কাপড় ভেদ করেও যেন সেই স্পর্শ কাঁপিয়ে তুলল মেহউইশের ভেতরটা৷ তিরতিরে হাওয়ার বেগ পা হতে মাথা অব্দি ঝড় তুলে দিলো। নিঃশব্দে গা এলিয়ে দিলো মেহউইশ রিশাদের বেডে। গা ঘেঁষে রিশাদও শুয়ে পড়লো চুপচাপ তার পাশে। আলোয় চারপাশ দিনের মত আলোকিত কেবিনটাতে ঝুপ করে নেমে এলো একরাশ নীরবতা। এই নীরবতা দুটি মানুষের নিঃশ্বাস ছন্দ তুলে ঘরময় পায়চারী করছে যেন৷ সারাদিনের অবিশ্রান্ত চিন্তা,দুঃখ আর আতঙ্ক সব নিমিষেই ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে ফেলল নিজেদের। মাঝরাতে গোঙানির শব্দে ঘুম ছুটে গেল মেহউইশের । নড়েচড়ে উঠে বসতেই দেখলো রিশাদের মুখটা লাল হয়ে আছে। শরীরের উত্তাপও স্পর্শ করার মত নয়। ঘুমানোর সময় রিশাদ তাকি জড়িয়ে রাখলেও জ্বরের তাপেই হয়তো নাকাল হয়ে তাকে ছেড়ে দিয়েছিলো। মেহউইশ খেয়াল করলো রিশাদ বেডের একদম কিনারায় হয়তো আরেকটু হলে গড়িয়েই পড়বে। কপাল,গা ছুঁয়ে দেখে তাড়াতাড়ি রিশাদকে টেনে বেডের মাঝামাঝি শুইয়ে দিলো। ফোন হাতে নিয়ে দেখলো রাত তখন দুইটা পেরিয়েছে। সারা রাতই নার্স, আয়া থাকে হাসপাতালে কিন্তু ডাক্তার পাবে কি না পাবে ভেবে নিজেই মেডিসিনস চেক করলো। ঔষধের নামগুলো অচেনা তার কাছে তাই অন্য পন্থা অনুসরণ করলো। মগ ভর্তি পানি আর রিশাদেরই পকেট থেকে তার রুমাল বের করলো। জলপট্টি দিলো অনেকটা সময় কাজ হলো না। বোকার মত কেবিনে বসে থেকে জলপট্টি দেওয়া সমাধান নয় মনে হতেই কেবিন ছেড়ে বের হলো সে। একজন ডক্টর একটু আগেই নাকি চতুর্থ তলায় রাউন্ডে ছিলেন। এই মধ্যরাতেও ডক্টর আছে শুনে মেহউইশ আর দেরি করেনি৷ সে গেল ডাক্তারের খোঁজে এবং পেয়েও গেল ডাক্তারকে। কিন্তু তিনি শিশু বিশেষজ্ঞ তবুও মেহউইশের জোরাজুরিতে এসে রিশাদের চেকাপ করলেন। অবস্থা ঠিক নেই বুঝতে পেরে এই মাঝরাতেই অন্য এক ডাক্তারকে কল দিলেন। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী মেডিসিন দিয়ে রিশাদের কিছুটা পরিবর্তন দেখে তবেই গেলেন তিনি। যেতে যেতে এও বলে গেলেন, ‘ নতুন বিবাহিত মনে হচ্ছে । ছেলেটা ভাগ্যবান এত যত্নশীল একটা বউ পেয়েছে। ভয় পেয়ো না তোমার স্বামী সুস্থ হয়ে যাবেন।’

বাইশ বছরের জীবনে মেহউইশের আজই প্রথম মনে হলো সে বিবাহিত। সত্যিই সে তার অপ্রিয় মানুষ অপছন্দের স্বামীর চিন্তায় আজ চিন্তিত ছিলো খুব। এখনও আছে কিছুটা চিন্তা তবে খানিকটা কম। লোকটার প্রতি মায়া পড়েছে কিনা জানে না সে তবে অভ্যাসে জড়িয়ে গেছে এটা বোঝে। ক্লান্তি আর ঘুমভরা চোখ নিয়ে রিশাদের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো সে কিছুক্ষণ। কয়েকঘন্টা আগেও এই লোক তাকে বকেছে,ধমকেছে আর এখনই সে লোকটার সেবা করছে। ‘বিয়ে’ সত্যিই পবিত্র বন্ধন যদিও তাদের জোরজবরদস্তির বিয়েটা কতেটা পবিত্র তা সে জানেনা, তবে এটা বৈধ। বৈধ,হালাল খাবারে যেমন বরকত থাকে রহমত থাকে তেমনি বৈধ সম্পর্কেও। যেই বিয়েটাকে সে মানতেই চায়নি সেই বিয়েটার মাত্র দু মাসের মাথায় সে মেনে নিয়েছে। আবার এই বৈধ সম্পর্কেও মানুষ একসাথে থাকতে পারে না। ভাবনায় বিভোর হয়ে রাতটা কখন ভোর হয়েছে বোঝা গেল না। হাসপাতালের পাশেই হয়তো মসজিদ তাই আজানের ধ্বনি স্পষ্টই শোনা গেল। বাড়তি কাপড়, ওড়না থাকা সত্বেও ওজু করে নামাজ আদায় করলে আর মনে মনে বলল কবুল করার মালিক আল্লাহ্। ফজরের পরপরই রেহনুমা ফেন করলো সে কান বাড়িতেই আছে রাইমা, নির্জনের সাথে। তার কিছুক্ষণ বাদেই ফোন করলো জেবুন্নেসা , করলেন মাইমুনাও। মেহউইশ শুধু অবাক হলো এই ভেবে, রিশাদের অবস্থা সম্পর্কে সবাই অবগত। রিশাদের বাবা কি জানেন না কিছু? না জানার তো কথা নয় তার পুরো পরিবার যেখানে সব জানে৷ নাকি বাবার সাথে তার কোন সম্পর্কই নেই।সে একবার শুনেছিলো বাবা ছেলের মধ্যে মনোমালিন্যতা আর সেকারণেই রিশাদ চট্টগ্রামে চলে গেছে কিন্তু এতোটা দূরত্ব! রিশাদের পরিবারের ভেতরকার বন্ধন কেমন তা মেহউইশের জানার কথা নয়৷ বলা যায় জানার মত সুযোগ কখনো হয়নি আর না সে আগ্রহী ছিলো।

রিহান স্কুলে যাওয়ার পথে এসে রিশাদকে দেখে গেছে। রিশাদের পুরো শরীরে দানাদার কিছু বেরিয়েছে আর তার সকল প্রকার টেস্ট রিপোর্ট চেক করে জানা গেল ডেঙ্গু হয়েছে। হাসপাতালে থাকার পরামর্শ দিয়েছে ডাক্তাররা কিন্তু রিশাদ জেদ ধরে বসে রইলো কালকেই সে চলে যাবে। তার জেদে কথা বলার সাহস দেখালো মেহউইশ। সেও জোর গলায় বলল, ‘ আমি কোন রোগীর সাথে ফিরতে চাই না। হয় হাসপাতালে থাকবে না হয় আমি নির্জনকে নিয়ে মায়ের বাসায় থাকবো।’ কথাটা বলেই আবার তার মনে হলো এই জেদ সে কেন দেখালো! তার তো বাবার বাড়ি বলতে রিশাদের দেওয়া বাড়িটি ছাড়া কিছুই নেই। কিন্তু কাজ হয়েছে তার কথায়। রিশাদ কিছু সময় চুপ থেকে বলেছে, ‘হাসপাতালে থাকলে ছোটবেলা থেকেই আমার দমবন্ধ লাগে। আমার সব ট্রিটমেন্ট বরাবরই বাড়িতে থেকে হয়েছে।’ কথাটা বলার সময় তার আওয়াজ ক্ষীণ হয়ে এসেছিলো। মেহউইশ বুঝেও বুঝলো না তার সমস্যাটা কিন্তু জেবুন্নেসাও কেবিনে থাকায় বুঝলো সমস্যাটা কোথায়। রিশাদ এখন বাবার ছায়াতলে নেই বাবার অর্থের সাগরেও সে থাকছে না। বাড়িতে সব জোগাড় যন্ত্র করতে লাখের উপর খরচ যা হয়তো রিশাদ করতে পারবে না অথবা করতে চাচ্ছে না। রিশাদ যে তার মতোই আর খান বাড়িতে যেতে চায় না তা জেবুন্নেসা শুনেছে রাইমার কাছে।

-‘আচ্ছা বাবা তুমি তিন কি চারদিন থাকো শুধু । শরীরটা একটু ব্যাটার হলেই আমরা ডাক্তারকে বলবে বাসায় নেওয়ার কথা। এখন তো দেখছোই হুটহাট অবস্থা খারাপ হচ্ছে । তোমার তো অন্তত নির্জনের কথা ভেবে সুস্থ হওয়া লাগবে।’ কাজে দিয়েছে কথাগুলো। রিশাদ চুপ মেরে গেছে ; সত্যিই তাকে ছেলের কথা ভাবতে হবে। মাথার উপর আরো কিছু দ্বায় আছে রিহান,রাইমা আর মেহউইশের ভবিষ্যৎ নিয়ে। দেহের ক্ষয় হলেই তার দুনিয়া অন্ধকার ভেবেই সে আর কথা বাড়ালো না। জেবুন্নেসা যাওয়ার সময় হাজার বিশেক টাকা দিলো মেহউইশের হাতে। রিশাদের অভিভাবকের জায়গা এখন শূন্য। কখন কি লাগবে না লাগবে তা মেহউইশের পক্ষে ঠিকঠাক দেখা সম্ভব নয় এটা ভেবেই জেবুন্নেসা নগদ টাকাটা দিয়ে গেল। সে বাড়ি ফিরে নিজের একাউন্ট থেকে টাকা উঠিয়ে কাল নিয়ে আসবে আরো কিছু। বড় হাসপাতালের বড় খরচ আজ ঠিক গায়ে লাগার মত বেশ অনুভব করলো জেবুন্নেসা। সামান্য একটু স্বর্দি জ্বরেও হাজার হাজার টাকা খরচ করে প্রাইভেট হাসপাতালে চিকিৎসা করে অভ্যস্ত আজ তাদের হিসেব করতে হচ্ছে দুদিনে কতোটা টাকা খরচ হলো। এই মুহূর্তে মনে হলো রাশেদ খান মানুষটা সত্যিই জঘন্য । তার কারণেই এই টাকার সমুদ্রের ভাসার অভ্যেস তাদের হয়েছে। জেবুন্নেসা ওবাইদুলকে ভালোবেসে এই অর্থের পাহাড় ছেড়ে জীবনযাপন করে শিখেছিলো কিন্তু এই জঘন্য লোকটাকে শেষ করার জেদ তাকে আবারও অর্থ আর প্রতিপত্তির অহমিকা শিখিয়ে দিয়েছে। জেবুন্নেসা চলে গেছে রেহনুমাও এসে দেখে গেছে রিশাদকে। নির্জনকে রেখে গেছে দিনের জন্য রাইমা কিংবা রেহনুমা এসে আবার নিয়ে যাবে রাতে। দিন কাটছে বন্দী হয়ে মেহউইশের । মেহউইশ অবশ্য সুযোগ পেলেই বাইরে থেকে হেঁটে আসছে নির্জনকে নিয়ে।বারবার মনে হচ্ছে ইভানকে সে আবার দেখতে পাবে। কিছু কথা বলা জরুরি সামনাসামনি,মুখোমুখি। যতোই সে রিশাদের সাথে সংসার সাজাক মনের ভেতর ইভানকে হারানোর ক্ষত সারাজীবন রয়ে যাবে। অস্তমিত সূর্যের পানে চেয়েও তার প্রথমে ইভানেরই কথা মনে হবে।প্রথম প্রেম,প্রথম ভালোবাসা তার জীবনে ইভানই নিয়ে এসেছিলো। বেরঙ,অসচ্ছল জীবনের প্রথম স্বচ্ছলতা ইভানের হাত ছুঁয়েই এসেছিলো তার। নির্জনের বয়স পাঁচ মাস শেষের দিকে৷ ইদানীং তাকে দুধের পাশাপাশি কলা,খিচুড়ি এটা সেটা দেয় রেহনুমা। আজ সারাটাদিন হাসপাতালে রাখবে ভেবে মেহউইশ একটু কলা দিলো তার মুখে। রিশাদ ঘুমের ঔষধের কারণে ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখে তাকিয়ে দেখছে তাদের আর বিড়বিড় করছে, তুমিই কেন তার মা হলে না?’

তিনদিন থাকার পর রিশাদের শরীরের অবস্থার অনেকটাই উন্নতি হয়েছে। এই তিনদিনে মেহউইশকে নতুন করে সংসার পাততে হয়েছে হাসপাতালের কেবিনেই। বাইরের জীবন তো সে আরও আগেই ভুলে গিয়েছিলো এবার অভ্যস্থ হয়েছে পুরোপুরি বন্দী জীবনে। চতুর্থ দিন সকালেই ডাক্তার জানালো রিশাদ বাড়ি ফিরতে পারবে তবে প্রতিদিন একবার করে আসতেই হবে। কিছু ইনজেকশনস আর চেকআপ রয়ে গেছে। রিশাদ রাজী হলো তবুও সে হাসপাতাল থেকে বের হতে চায়। হাসপাতাল নাম ডিসচার্জ করতেই তারা উঠলো মেহউইশদের বাড়িতে। রিশাদের আচরণে কিছুটা নম্রতা এলো এবার। বাড়ি পৌঁছেই সে সালাম দিয়েছে এমনকি হাল তবিয়তও জিজ্ঞেস করেছে। পুলকিত হয়েছে মাইমুনা মনে মনে আরো প্রার্থনা করলেন রিশাদের সাথে মেহউইশের সংসারটা যেন সুখের হয়। রিশাদের অসুখ ভালো করে গেল তার সংসার জীবনে। একধাপ এগিয়ে গেল মেহউইশের সাথে তার সম্পর্ক। অস্বাভাবিক আচরণগুলো বদলে গিয়ে অতি সাধারণ স্বামী স্ত্রীর মত হয়ে উঠেছে।রিশাদের আমূল পরিবর্তন খুশি করলো সবাইকে। তবুও একটা রহস্য মেহউইশের জীবনে রয়ে গেল তা হলো রিশাদের বাবার নিখোঁজ হওয়া।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here