মন গহীনের গল্প পর্ব -৩৫+৩৬

#মন_গহীনের_গল্প
পর্ব-৩৫
#রূবাইবা_মেহউইশ
💞

সাগরের ঢেউয়ের সাথে বাতাসের শো শো শব্দে গর্জন কানে তালা লাগিয়ে দিয়েছে। নির্জনটা এখন আর আগের মত চুপটি করে থাকার বাচ্চা নয়। বয়সের সাথে সাথে তার চঞ্চলতা বেড়ে গেছে অনেক। সারা ঘরে জিনিসপত্রের ছড়াছড়ি করে খেলাটাই তার বেশি প্রিয়। হোটেল ছেড়ে আবারও মেহউইশরা তাদের পাহাড়ি বাড়িতে চলে গেছে। কালকে নির্জনের প্রথম জন্মদিন আর সে কারণেই আজকে আবার হোটেলে আসা তাদের। রিশাদ ছোটখাটো একটা পার্টির আয়োজন করেছে ছেলের জন্মদিন উপলক্ষে। আজ নির্জনের এক বছর পূর্ণ হলো আর মেহউইশের বিয়ের ন’মাস। রিশাদ যখন ডেঙ্গুজ্বর সেরে আবার চট্টগ্রামে ফিরলো তখন মেহউইশ নিজে থেকেই রিশাদের সাথে কিছু কথা বলেছিলো। কথাগুলো ছিলো এমন, ‘ বিয়েটাকে আমি অস্বীকার করবো না কখনো করার মত অবস্থাও নেই৷ শুধু একটা অনুরোধ রইলো আমার। ‘

রিশাদ মনযোগসহকারে শুনতে চাইলো মেহউইশের অনুরোধ।

‘জোর খাটিয়ে,বকে ধমকে শাষণ করা যায় কিন্তু সুন্দর একটা সম্পর্ক তৈরি করার প্রথম শর্ত সম্মান দ্বিতীয় শর্ত ভরসা। ভালোবাসা না থাকলেও সম্মান আর ভরসার জোরে সুন্দরভাবে অপছন্দের ব্যক্তির সাথেও সংসার করা যায়। তাই আমার অনুরোধ আমাকে আমার যোগ্য সম্মান আর ভরসাটুকু দেবেন। আমি পালিয়ে যাবো না আর না আপনার সন্তানকে কখনো অবহেলা করবো।’ সেদিন রিশাদ চুপচাপ মেহউইশের মুখের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো শুনেছিলো। জবাবে কিছু বলেনি তবে কাজে দেখিয়েছে সবটা। সে তার উগ্র মেজাজকে মেহউইশের সামনে যতোটা সম্ভব শান্ত রেখেছে। হাসিখুশি সংসার চলছে তাদের আর রেহনুমাও প্রচণ্ড সুখী জীবন কাটাচ্ছে। কেউ নেই নেই করেও তার সংসারে এখন ছেলে,বউ, নাতি সব আছে। পাহাড়ের বুকে বুনো সুগন্ধি ফুলের মত রেহনুমা মন কাড়া এক সংসার পেতেছে মেহউইশ আর রিশাদের সহযোগিতায়। অনেক সমস্যা,বাঁধা পার করেই জেবুন্নেসা আর রিহানের বিদেশ যাত্রার ব্যবস্থা করেছে রিশাদ। অর্থ সংকট তার যথেষ্ট তাই ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও মামা,আর মামাতো ভাইবোনদের হেল্প নিয়েই সব করেছে সে। তবুও ছোট্ট রিহানকে আর কোন প্রকার মানসিক যন্ত্রণাতে রাখতে চায়নি সে। নিজে যেই একাকীত্বের ভার বুকে নিয়ে বড় হয়েছে, বাবার পাপের শাস্তি সে নিজে ভোগ করেছে তা তার ভাইবোন দুটোকে আর সহ্য করতে দেয়নি। রাইমা হোস্টেলে উঠেছে জোর করেই। বাবার প্রতি যে ঘৃণা তার মনে তা এ জীবনে কখনো ঘুচবে না হয়তো। রিশাদের ইনকাম যা হয় তা দিয়ে সে রাইমার খরচ অনায়েসেই তুলতে পারে। খান বাড়ির সব বদলে গেছে। বাড়ির আসল উত্তরাধিকার সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বাড়ি থেকে দূরে। পাঁচ ভূতে গিলছে সকল সম্পদ তাতে কারো কোন মাথাব্যথা নেই। রাশেদ খান তার অন্যায়ের শাস্তি ছেলে,মেয়ে কিংবা জেবুন্নেসা থেকে না পেলেও প্রকৃতি তাকে ছাড় দিচ্ছে না। ভয়ংকর রকম একা পড়ে আছে লোকটা। সবাই সম্পর্ক ত্যাগ করেছে বলেই হয়তো একাকীত্বের ভারী কষ্টটা এতদিনে উপলব্ধি করতে পারছে। রিশাদ খোঁজ নেয় না, রাইমা কষ্ট পায় বাবার জন্য কাঁদেও খুব কিন্তু সেও খোঁজ নেয় না। রাশেদ খান প্রায়ই হোস্টেলের গেইটে এসে দাঁড়িয়ে থাকেন মেয়েকে একটিবার দেখবেন বলে কিন্তু রাইমা আসে না। রিশাদ প্রায় প্রতি মাসেই ঢাকায় আসে রাইমাকে দেখতে। গত ছ’মাসে রাইমা নিজেও দু’বার চট্টগ্রামে থেকে এসেছে। জীবনের পরিবর্তন প্রতিটি মানুষের মন গহীনের গল্প গুলোকেও পরিবর্তন করেছে। গতানুগতিক পথ বদলে গল্পগুলো উল্টোপথে চলছে হয়তো। এই উল্টোটাই তাদের জীবনের সঠিক গল্প।

‘তিশমা চলে এসেছে, আন্টি আর মিহাদও চলে এসেছে। চলো হোটেলে ফিরি।’ বলতে বলতেই রিশাদ হোটেলের দিকে এগিয়ে গেল। বাতাসে এলোমেলো হওয়া চুলগুলো দু হাত উঁচিয়ে খোঁপা বেঁধে সেও রিশাদের পিছু পিছু এগোলো আর ফিসফিস শব্দে উচ্চারণ করলো, ‘সুন্দরী ডাইনি ঠিক হাজির হয়ে গেছে। বিয়া করে না কে বা*’ ।তিশমার উপস্থিতি তাকে অসহ্যবোধ করায়। প্রথমদিন দেখে সে অবাক হয়েছিলো এই ভেবে, দেশের একজন নামকরা মডেল তিশমাকে সে সামনাসামনি দেখতে পারছে। কিন্তু রিশাদের আশেপাশে ঘুরতে দেখার পর থেকেই মেজাজ বিগড়ে উঠে মেহউইশের। কেন এমন হয় তা অবিবরণীয়। শুধু বোঝে অন্যের বরের পাশে ঘুরঘুর করা মেয়ে একদম বাজে হয়। আবার এও খেয়াল করেছে তিশমা ঘনঘন কক্সবাজার আসে এবং তার সবচেয়ে বেশি সময় কাটে হোটেলের ম্যানেজারকে জ্বালিয়ে।

হোটেলে ফিরে রিশাদ প্রথমে শ্বাশুড়ির সাথে দেখা করলো। টুকটাক হালতবিয়ত জেনে আবার গেল তৃতীয় তলায় তিশমার খোঁজে। নির্জন আজকাল কয়েক পা হাঁটে তাই রেহনুমা তাকে নিয়ে নিচে লনেই রইলো। মেহউইশ আর মাইমুনাও সেখানেই চেয়ার পেতে বসে কথা বলছে। রিশাদের ডেঙ্গুজ্বর সেরে উঠার পর সেই যে মেহউইশ এখানে এসেছে আর যায়নি৷ এতদিন পর মা’কে পেয়ে রাজ্যের সকল কথা একসাথেই বলতে চাইছে যেন৷ রেহনুমার মনে হলো তাদের স্পেস দেওয়া দরকার তাই সে মেহউইশকে বলল, ‘ তোমার মা’কে নিয়ে তোমার রুমে যাও মেহউইশ। তোমার ভাইটাকেও কিছু খেতে দাও ছেলেটা ছোট মানুষ কখন থেকে ঘুরাঘুরি করছে।’

মেহউইশ বুঝলো ফুপু তাদের একান্ত সময় দিতে চাইছেন। সে মাকে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। এবারও রিশাদ তাদের আগেরবার থাকার রুমটাতেই থাকছে। পারসোনালি করে রাখা সে রুম দুটো আর কখনো ট্যুরিস্ট রুম করা হবে না বলেই সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাই যখন তখন এসে এখানেই থাকতে পারে৷ মেহউইশ ঘরে এলেই মাইমুনা মেয়ের হাত ধরেন, ‘ কেমন আছিস রে মা?’

রাতের আধারে গুমোট থাকা কাঁচপোকার মত হঠাৎ গুটিয়ে গেল মেহউইশ। ঋতুতে এখন শীতের আভাস নেই তবুও গায়ে শীতের কামড় লাগলো মনে হলো। শিউরে উঠলো পশম, নিভু নিভু অন্তরদহন দপ করে জ্বলে উঠলো যেন মায়ের করা প্রশ্নটাতে। কতদিন হয়ে গেল সে জানে না কেমন আছে। স্বাভাবিক আছে ব্যস এইটুকুই জানে। শিরশিরে এক হাওয়ার প্রবেশ ঘটলো ঘরে বেলকোনির গ্রিল টপকে। মেহউইশের মনে হলো সে কান্না করবে, কান্নারা উইপোকার মত তিরতির করে বুক ছাপিয়ে গলায় উঠে আসছে। শুধু কি টাকা-পয়সা,আর অভাবমুক্ত থাকলেই মানুষ ভালো থাকে! আগে অভাব ছিলো অভাব ঘুচানোর পরিশ্রম ছিলো। এখন অভাব নেই একাকীত্ব তৈরি হয়েছে। আপন, খুব কাছের কারো কমতি তাকে সবার মাঝেও একা করে রাখে। ইভান ছিলো তার ব্যক্তিগত একাকীত্ব ঘুচানোর একমাত্র মাধ্যম যা অনেক আগেই রিশাদের কারণে হারিয়ে গেছে। কিন্তু রিশাদ চাইলেই তো পারে সেই মাধ্যম হয়ে আবার মেহউইশের একাকীত্ব দূর করতে। নিজের একাকীত্বে মেহউইশকে শামিল করলেও তো পারে। কিন্তু নাহ, মেহউইশ বলেছে সম্মান দিতে সংসার করতে রিশাদও তাই করছে। কেন বিয়ের দু রাত না পেরুতেই দেহের চাহিদা জোর করেই তো মিটিয়েছিলো এখন কি পারে না একলা সময়ে জোর করে একটু আপন হতে? পারে না একটু সুখ,দুঃখের কথাগুলোর ভাগ নিতে? লোকটা বদরাগী,জেদী কিন্তু বোকাও খুব৷ মেহউইশ তার মায়ের প্রশ্নের জবাব দিতে পারলো না। হাসি হাসি মুখ করে জানতে চাইলো তার মায়ের কাপড়ের ব্যবসা কেমন চলছে? মাইমুনা জানালো ভালো চলছে কিন্তু রিশাদ এখনও তাদের খরচ পাঠায়। মাইমুনা কাপড়ের ব্যবসার জন্য ছোট একটা দেকান নিয়েছে নিজের জমা পুঞ্জি দিয়ে। উদ্দেশ্য ছিলো জমানো টাকা পয়সা মেহউইশের বিয়ে দিলে লাগবে কিন্তু বিয়ে তো আর সেভাবে হয়নি তাদের তাই রয়ে গেছে টাকাগুলো। সেই টাকা সাথে মেহউইশের বাবার দেওয়া মাইমুনার শেষ স্মৃতি চিহ্ন দুটো সোনার বালা আর নাকফুল সেগুলোও বিক্রি করে দোকান কিনেছে। খুব ছোট হলেও দোকানটা থেকে যতটুকু লাভ আসে তা চলে যেত মা ছেলের খরচ থাকার জন্য মাথার উপর ছাঁদ তো রিশাদেরই দেওয়া। কিন্তু তবুও নিজের দ্বায়িত্ব ভেবেই প্রতিমাসে সাধ্যমত খরচ পাঠায় সে। মেহউইশ মন থেকে শুকরিয়া আদায় করে আল্লাহ তা’আলার। যা কিছু ঘটে মানুষের জীবনে তার পেছনে আল্লাহ্ কিছু তো ভালো রাখেনই তা মেহউইশ আবারও বুঝলো। মা মেয়ের কথার মাঝেই দরজায় নক করার শব্দ হলো। মেহউইশ দরজা খুলে দেখলো একজন বেয়ারা ট্রে হাতে দাঁড়িয়ে আছে।

-‘আমরা কিছু অর্ডার করিনি।’

-‘ ম্যাম, রিশাদ স্যার পাঠিয়েছেন।’

-‘ ওহ আচ্ছা দিন।’ বলে মেহউইশ ট্রে টা হাতে নিলো। গরম গরম হালিম আর স্যান্ডউইচ পাঠিয়েছে রিশাদ। মুচকি হেসে মায়ের সামনে রাখলো ট্রে টা। পরমুহূর্তেই আবার দরজায় নক পড়লো। উঠে গিয়ে দরজা খুলতেই মিহাদ এসে ঢুকলো।

-কি রে, তুই এতক্ষণ কোথায় ছিলি?

-‘ সুইমিংপুলটা দেখছিলাম ঘুরে ঘুরে। আপু জানো ওখানে কত্তো লাইটিং করা।জোনাকির মত গাছের মাথায়ও জ্বলছে বাতিগুলো।’ উচ্ছ্বসিত শোনালো মিহাদের কন্ঠ৷ সে আরও বলল, ‘ রিশাদ ভাইয়া আমাকে একটা ফোন সিলেক্ট করতে বলেছে। কালই কিনে দেবে বলেছে।’

-‘সেকি! তুই মানা করিসনি কেন? ফোন তো আছেই আমাদের।’ মাইমুনা ছেলেকে বোঝাতে চাইলেন ফোন না নেওয়ার কথা।

-‘ওটা তো তুমিও ব্যবহার করো৷ আমাকে পারসোনাল ফোন গিফট করবে৷ আমারও একটা ফোন কেনার খুব ইচ্ছে ছিলো অনেকদিন ধরে।’ কন্ঠস্বর নিচু হয়ে এলো মিহাদের। মেহউইশের ভালো লাগলো মিহাদের কথা শুনে। বিয়ের পর প্রথমবার রিশাদ যেদিন তাকে নিয়ে গেল মায়ের কাছে সেদিন মিহাদ ভীষণ ক্ষুব্ধ ছিলো রিশাদের প্রতি। এমনকি তাকে খুন করতে চেয়েছিলো আজ সেই রিশাদকেই সে ভাইয়া বলে সম্মোধন করছে। পরিবর্তন এখানেও এসেছে। সময় সকল রোগের ঔষধ তাই তাদের প্রত্যেকের মনের জখমে টান ধরেছে। মিলেমিশে থাকাটা আর কষ্টকর নয়।

গরম গরম হালিম খেয়ে মিহাদ আবার বেরিয়ে গেছে। মাইমুনা কথায় কথায় মেহউইশের নাকের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘নাক ফুরাবি মেহউইশ?’

দরজা খোলাই ছিলো মিহাদ যাওয়ার পর। রিশাদ মাত্রই ঘরে ঢুকেছিলো তারও কানে গেল কথাটা। দরজায় দাঁড়িয়েই মেহউইশের নাকের দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলো৷ আর তার এভাবে চোখ নামিয়ে নেওয়াটা মেহউইশেরও চোখে পড়লো। কি বুঝলো সে কে জানে, মনে মনে শিহরিত হলো। রিশাদকে ঘর ঢুকতে দেখে মাইমুনা বলল সে রেহনুমার কাছে যাচ্ছে।

মেহউইশ মায়ের বেরিয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই দরজা আটকে দিলো৷ রিশাদ চুপচাপ ক্লজেট থেকে কালো একটা স্কিনি টি শার্ট নামালো। প্যান্ট না বদলে শুধু শার্টটাই বদলে নিলো। চুলগুলো একহাতে পরিপাটি করতে করতে অন্যহাতে ফোন নিয়ে ম্যানেজারকে কল দিলো। জানতে চাইলো আশেপাশে ভালো কোন পার্লার আছে কিনা। মেহউইশ খাটে বসে নিজের জন্য চুড়ি গুছিয়ে নিচ্ছিলো কিছু। কালকের অনুষ্ঠানে শাড়ি পরার প্ল্যান করেছে তাই সে অনুযায়ী কিছু চুড়ি আর একজোড়া দুল আলাদা করছিলো৷ রিশাদের কথা শুনে চোখ তুলে আয়নায় তাকালো। রিশাদ আয়নার থেকে তাকেই দেখছে, চোখাচোখি হলো দুজনের। স্বাভাবিকভাবেই মেহউইশ বলল, ‘ আমি নাক ফুরাবো তবে সেটা পার্লারে নয়।’

তাকিয়ে থাকা দৃষ্টি রিশাদের ছোট হলো,ভ্রুজোড়া বক্র হয়ে গেল।

-‘কোথায় ফুরাবে?’

-‘বাড়িতেই।’

-‘ তবুও তো লোক লাগবেই।’

-‘আমার মা’ই যথেষ্ট’ বলেই মেহউইশ নিজের কাজে মনযোগ দিলো। রিশাদ কল না কেটেই আবারও কিছু বলতে যাচ্ছিলো কিন্তু তার আগেই তিশমার গলা শোনা গেল ফেনের ওপাশেই। ম্যানেজারের ফোন তিশমার কব্জায় আর ম্যানেজার সাহেবের অপরাধ সে তিশমাকে কফির জায়গায় চা অফার করেছে।

রাইমা এসে উপস্থিত মধ্যরাতে। তার সাথে এসেছে তার বন্ধুমহলের দশ বারোজন বন্ধু। মাত্রই ঘুমে চোখ লেগে এসেছিলো মেহউইশের কিন্তু রিশাদের ফোনের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। রাইমা নাম দেখে কল রিসিভ করতেই রাইমা বলল, ‘ সে হোটেলে এসে গেছে থাকার ব্যবস্থা করা লাগবে।’ রিশাদ ঘুমে অচেতন তাকে ডাকবে কি ডাকবে না করে নিজেই উঠে গেল। রাইমার সাথে দেখা হলো রিসেপশনে । মেহউইশ খেয়াল করলো রাইমার সাথে অনেকগুলো মেয়ে সাথে ছেলেও আছে। তখনি পেছন থেকে কারো কন্ঠস্বর শোনা গেল,

‘আপনি এখানে!’ #মন_গহীনের_গল্প
পর্ব-৩৬
#রূবাইবা_মেহউইশ
💞
মেহউইশ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে রাইমার দিকে। মধ্যরাতে কোলাহলমুক্ত হোটেলের চারপাশে ভাসছে শুধু সমুদ্রের গর্জন। মোজাইক করা ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে ডান পায়ের জুতোর চিকচিক করা পাথরটাকে দেখছে রাইমা। রিসেপশনের একপাশে কিছু সোফা আছে যেখানে বসে অপেক্ষা করছে রাইমার বন্ধু- বান্ধবীরা। রুমের জোগাড় কাল দুপুর বারোটার আগে হবে না এমনটাই বলল রিসেপশনিস্ট ছেলেটা। আগে থেকে বুক না করলে রুম পাওয়া কষ্টকর এই ঋতুতে। শীত নামবে নামবে করছে এখন থেকেই পর্যটকদের ভীড় বেড়েছে। রিশাদ ভেবেছিলো রাইমার বন্ধুরা সব অনুষ্ঠানের দিন সকালে আসবে সেই হিসেবে রুম কাল থেকে রিজার্ভ রাখবে। ভুল তারও হয়েছে সাথে রাইমারও। একটাবার ফোন করলেও এমন নাজেহাল অবস্থায় পড়তে হতো না। কিন্তু এই মুহূর্তে ঘুমন্ত রিশাদ বড়ই চিন্তামুক্ত কিন্তু চিন্তার সাগরে পড়েছে মেহউইশ। একটু আগেই সে এখানে এসে রাইমার সাথে কথা বলতেই পেছন থেকে তানভীর বলল, ‘ আপনি এখানে!’ চমকেছে তানভীর মেহউইশকে দেখে চমকেছে মেহউইশও। অনাকাঙ্খিত এই দেখা বড্ড গোলমেলে করে দিলো সবটা। রাইমা কিছু বলার আগেই তানভীর আবার বলল, ‘ ভালো হয়েছে আপনাকে পেয়ে। এই হোটেলে আছেন আপনি তাই না৷আমার একটু হেল্প লাগবে।’

-‘তানভীর থামো’ রাইমা ভয়ে ভয়ে তানভীরকে থামাতে চাইলো৷ তানভীর থামলো না বরং রাইমাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘ দেখুন না এই হলো আমার গার্লফ্রেন্ড৷ এটা তারই ভাইয়ের হোটেল আর কাল তার ভাতিজার বার্থডে৷ আমি তার ফ্রেন্ডসদের সাথে এসেছি কিন্তু আপাতত তার ভাইয়ের সামনে পড়তে চাচ্ছি না। আপনি কি,,,’

-‘তানভীর তুমি আমার ভাইয়ের কাছে লুকাতে চেয়ে ভাবীকেই সব বলে দিচ্ছো!’ অসহায়ের মত কথাটা বলল রাইমা। তানভীর বিষ্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে৷ রাইমার কথায় যেন তার মাথার উপরই বজ্রপাত হলো৷ মেহউইশ তার ভাবী এটাই যেন বজ্রপাতের প্রধান কারণ। রাইমার কথা শুনে সেই যে স্তব্ধ হয়েছে তানভীর আর কোন কথা বলেনি। রাতের আঁধার হালকা হতে শুরু করেছে। ভোর হতে বেশি দেরি নেই আর রিশাদের এলার্ম ঠিক পাঁচটায় বাজবে। রাইমার বন্ধুরা সবাই সোফায় গা এলিয়েই পড়ে রইলো। দুপুরের বাসে রওনা দিয়েছিলো তারা । জ্যামে আটকে দিনের অর্ধেক সেই সাথে রাতেরও অর্ধেক তারা বাসেই বসে ক্লান্ত এখন৷ ফোন না করার বোকামির খেসারত দিতে হচ্ছে৷ রাইমাও এবার ক্লান্তিমাখা পায়ে একটা সোফায় গিয়ে বসলো৷ ঠিক তখনই তানভীর এসে আবার মেহউইশের সামনে দাঁড়ালো।

-‘আমার কিছু জানার ছিলো যদি একটু সময় দেন।’ তানভীর বলতেই মেহউইশ দূর্বল চোখে চেয়ে রইলো তার দিকে। সে জানে তানভীরের কৌতূহলী মন কি জানতে চায়।

– ‘যা ভাবছো তাই সত্যি। ইভানের সাথে আমার বিয়ে হয়নি বিয়েটা হয়েছে রাইমার ভাইয়ের সাথে আর বিয়েটা স্বাভাবিকভাবেও হয়নি। আর কোন কিছু জানতে চেয়ো না।’

-কিন্তু ইভান ভাইয়ারও তো বিয়ে হয়েছে শুনেছি সেটা কার সাথে!

-আমার জানার কথা নয়।

মেহউইশ আর কথা বাড়াতে চাইলো না। সে রাইমাকে বলল ছেলে তো মাত্র চারজন তাদের রুমের সমস্যা হবে না। মিহাদ এসেছে কাল তার জন্য যে রুম সেটাতে ছেলেরা ঘুমাতে পারবে৷ ভোর হয়েই এসেছে তাই মিহাদকে উঠিয়ে নিজের রুমে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মেয়ে আটজন রাইমাকে নিয়ে৷ চাইলেও ফুপুর ঘরে থাকা সম্ভব হবে না। তানভীর কথাটা শুনলো একটু ভেবে বলল সেই রুমে না হয় মেয়েরা রেস্ট নিক আমরা একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসছি । মেহউইশও কিছু বলতে চাইলো তখনি তার হাতের ফোনটা বেজে উঠলো। খেয়াল হলো সে রিশাদের ফোনটাই নিয়ে এসেছে আর স্ক্রীণে তার নিজের নামটাই জ্বলজ্বল করছে। তারমানে রিশাদ জেগে গেছে।

-তানভীর তুমি চাইলে এখন একটু সৈকত থেকে ঘুরে আসতে পারো। একটু পর এসো তখন বলা যাবে রুম চাই তোমার। ওর ভাইয়া
জেগে গেছে।

-ঠিক আছে আমি না হয় একটু ঘুরে আসছি।

-‘মেবিশ তুমি এখানে কি করছো’ দোতলা থেকে সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে রিশাদ প্রশ্ন করলো৷ সোফায় বসা রাইমা সটান দাঁড়িয়ে গেল রিশাদের গলা শুনে। কক্সবাজারে আসার আগ পর্যন্ত তার এবং তানভীরের প্ল্যান ছিলো তারা একসাথে কক্সবাজারে ঘুরবে৷ হোটেলে বন্ধুদের সাথে তানভীরকেও বন্ধু পরিচয়ে রাখবে । কিন্তু মেহউইশ যা বলল তাতে ভয় হচ্ছে । দাদাভাই অতি চালাক লোক সত্যিই বুঝে যাবে আসল ব্যপার।

রিশাদ ঘুমঘুম চোখে উসকোখুসকো অবস্থায়ই নিচতলায় এসেছে। গায়ে তার পাতলা টি শার্ট আর ট্রাউজার হাতে মেহউইশের ফোন। রাইমা এগিয়ে এসে কথা বলল৷ কেমন আছে, কখন এসেছে এই কথার পাট চুকিয়ে বলল রুম দরকার। রিসেপশনিস্টের দিকে তাকাতেই সে হড়বড় করে জানাতে লাগলো কোন ফ্লোরেই রুম খালি নেই৷ কাল বারোটার মধ্যে তিনতলায় খালি হবে দুটো, দোতলায় হবে। এক পলক সবার দিকে তাকিয়ে রিশাদ একটু বিরক্তই হলো। এত লম্বা জার্নি করে আসবে আগেই জানানো উচিত ছিলো। এই ভোরে রুম খালি করা সম্ভব নয়। রিশাদ নিজেই বুকিংয়ে রেখেছিলো দুটো রুম কাল বারোটা থেকে কিন্তু এখন! অনেক ভাবনা চিন্তার পর ঠিক হলো মিহাদের রুমে ছেলেরা থাকবে আর রিশাদের রুমটা সাইজে অনেক বড় সেই সাথে বেলকোনিটাও অনেকটা রুমের মত। পর্দা,ম্যাট্রেস ইভেন কাঁচঘেরা হওয়ায় বাইরের আলো বাতাস নিয়ে টেনশন নেই। তাই মেয়েরা ঘরে এবং বেলকোনি মিলিয়ে থাকার জায়গা পেয়ে যাবে। রিশাদ মেহউইশকে বলল তুমিও তাদের সাথেই ঘুমাও। মিহাদ আর নির্জনকে ফুপির ঘরে দিয়ে এসো।

– আর আপনি? মেহউইশ জানতে চাইলো।

-‘আমার আর ঘুম হবে না। এমনিতেও ফজরের আজান হবে একটু পর তারপর এমনিতেই উঠে পরতাম। আমার ফোনটা দাও বাইরে থেকে হাটাহাটি করে আসি৷’ মেহউইশ বুঝলো সে এখন তাদের জন্য জায়গা ছাড়তে চাচ্ছে। রিসেপশন থেকে বাইরের গেটে যতটুকু চোখ যায় অন্ধকার এখন হালকা হয়ে গেছে। মেঘাচ্ছন্ন কালচে রঙটা বড্ড ফিকে করে দিয়েছে রাতটাকে। গাঢ় অন্ধকার নেই আকাশে নিশ্চয়ই এখন শুকতারা আছে! ভেবেই কেমন শিহরণ জাগলো মনে। ঝট করে বলে ফেলল, ‘ একটু ওয়েট করবেন? ‘

প্রশ্নবোধক চাহনি রিশাদের তা দেখে মেহউইশ বলল, ‘ আমিও একটু হাটতে বেরুতাম৷ ওদের রুম গুছিয়ে দিয়ে এক্ষুনি আসবো আর নির্জনকে মা আর ফুপির কাছে দিয়ে আসবো।’ সম্মতিসূচক চোখের পলক ফেলে মাথা নেড়ে সায় দিলো রিশাদ। খুশি হলো মেহউইশ সে দ্রুত আবার ফিরে গেল নিজের কামরায়। নির্জনকে কোলে তুলে ফুপির রুমে নক করলো৷ ফুপি দরজা খুলে অবাক হলেন এসময় নির্জনকে সাথে নিয়ে মেহউইশকে দেখে। ভয়ও হলো রিশাদের সাথে ঝগড়া হলো নাতো আবার! কিন্তু মেহউইশ কোন ঘোরে আছে কে জানে! সে গড়গড় করে বলতে লাগলো রাইমা এসেছে তারা ঘুমাবে এখন তাই দুটো রুম দরকার। নির্জনকে আর মিহাদকে এখানে তাদের খাটেই একটু জায়গা দিতে৷ দরজার শব্দ শুনে রেহনুমার পেছন পেছন মাইমুনাও উঠে এসেছেন। তিনি মেয়ের মুখে এত কথা এভাবে শুনে মুচকি হাসলেন। যেন এ ধরায় সবচেয়ে বড় সুখটাই সে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছেন। হাসির রেখা ঠোঁটে রেখেই তিনি বললেন, ‘দে নির্জনকে শুইয়ে দিচ্ছি। তুই গেস্টদের ব্যবস্থা করে বেরিয়ে যা।’ রেহনুমা তখনও হতবাক হয়তো ঘুমের রেশ এখনও কাটেনি। মেহউইশ চলে গেল নির্জনকে দিয়ে। মিহাদের দরজায় নক করতে সেও ঘুম ঘুম চোখ ঢলে দরজা খুলল। একদমে তাকেও কতকটা বলে তার ব্যাগসহ নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। রিশাদ নিচে অপেক্ষা করছে তাই তাকেই ফোন করে বলল রাইমাদের উপরে পাঠান রুম গোছানো হয়ে গেছে। ফোন রেখে নির্জনের প্রয়োজনীয় কয়েকটা কাপড় আর খাবারের টুকটাক জিনিসপত্র ফুপির কাছে দিয়ে রিশাদের একটা জ্যাকেট হাতে নেমে গেল সে৷ রাইমারা ঘর লক করে ঘুমাবে বলেই মেহউইশ নিজের বুঝমত সবটা করে এসেছে৷ সিঁড়ি বেয়ে নামার সময় দেখতে পেল রিশাদ তানভীরের সাথে কথা বলছে৷ ভয় হলো খুব কি কথা হচ্ছে তাদের মধ্যে! নিচে নামতেই রাইমাকে বলল যাও তোমরা। রুম নাম্বার বলে দিতেই সবাই নিজের ব্যাগপত্র নিয়ে চলে গেল। হাফ ছেড়ে বাঁচলো মেহউইশ৷ রিশাদ বাইরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই জ্যাকেটটা এগিয়ে দিলো মেহউইশ৷ এতক্ষণ খেয়ালই করেনি রিশাদ এই জ্যাকেটটা।

-‘এটা আনলে কেন? ‘

-‘ বাইরে ঠান্ডা হাওয়া থাকবে এখন। বাতাসটা বুকে লাগলেই স্বর্দি হতে পারে।’ রিশাদ আর কথা না বাড়িয়ে জ্যাকেটটা নিলো। সত্যিই তার একটু একটু শীত লাগছিলো।

রাত নিঃশেষের পথে ভোর আসবে আসবে করছে। পুব আকাশে মিটিমিটি শুকতারার জ্বলজ্বলে রূপ সেই সাথে নোনা হাওয়ার খুনসুটি৷ পাশাপাশি মেহউইশ রিশাদ নিঃশ্চুপ পথিকের মত পায়ে পায়ে এগিয়ে চলছে সমুদ্রের তীর ঘেঁষে। কেউ কারো মুখের দিকে দেখছে না তবুও চোখের তারায় দুজনের মুখচ্ছবি দেখতে পাচ্ছে। অবাধ হাওয়ার তোড় শরীরে কাঁপন তুলে আবেশে জড়িয়ে ধরছে সারা অঙ্গ। আহা! এত সুখ সুখ লাগছে এ হাওয়ার শীতল ছোঁয়া তা কি দুজনই বুঝতে পারছে না! পারছে তো দুজনই শুধু মুখ ফুটে বলতে পারছে না, একটু জড়িয়ে নাও আমায়। একটু ছুঁয়ে দাও উষ্ণ আদরে। হাতের পিঠে হাতের ছোঁয়া, চোখের প’রে চোখ রাখা। ওষ্ঠযুগলে আলতো চুম্বন আর উন্মাদ হাওয়ায় হেঁটে বেড়ানো। কত না চমৎকার হতো এই ভোর! সবই কল্পনা কল্পনা কল্পনা।মেহউইশ হাসে তার কল্পনার স্পর্ধা দেখে।

চলবে

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here