#মন_গহীনে
#পর্বঃ১০
#দোলন_আফরোজ
কেটে গেছে কয়েক দিন। তিথীর এক্সাম সব শেষ। এতো কিছুর থাকার পর ও তিথীর নিজেকে কেনো জানি খালি খালি লাগে। এক্সাম শেষ কই একটু রিল্যাক্স থাকার কথা, কিন্তু না বুকের বা পাশ টা কেমন যেনো ফাঁকা ফাঁকা লাগে। তার সব ই ঠিক আছে কিন্তু কে যেনো নেয় মনে হয়। হুম সেদিনের পর থেকে কাব্য আর এবাড়িতে আসেনি। কেনো আসেনা সে জানতে চায়নি বাবা মার কাছে। তার জানার প্রয়োজন ও নেই আর কাব্যর ব্যাপারে তার কোনো ইনটারেস্ট ও নেই। লোক টা না থাকলেই শান্তি। হুট করে কোত্থেকে তার জীবনে এসে হাজির হয়ে কয়েকটা দিনে জীবন টাকে তেজপাতা করে দিয়েছে। ভালোই হয়েছে আসেনা। নিজের বাড়িতে শান্তি তে একটু নিশ্বাস তো নেয়া যাচ্ছে।
কিন্তু কই তিথীতো শান্তি পাচ্ছে না। কেনো পাচ্ছে না তাও বুঝতে পারছে না তার ছোট্ট মন টা। ভাবতেই একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো সে।
নাহ এই ছুটির সময় টা তার যে করেই হোক এনজয় করতেই হবে। মায়ের কাছে বলে কোনো লাভ নেই তাই সে তার বাবার কাছে গিয়ে আবদার করে নানু বাড়ি যাবে। মা সাথে সাথে না করে দেয়, কারণ উনি যেতে পারবেন না, তারেক রহমান এর অফিস খোলা আর দুই মেয়েকে তো উনি একা একদম ই ছাড়বেন না।
তমা কয়েকবার করেই কাব্যর কথা জিজ্ঞেস করেছিলো মা কে। তমা কাব্যর তিথীকে নিয়ে পাগলামি গুলোর কথা জানতো।তার মা ই অবশ্য বলেছে তাকে। কারণ সে বড়,যথেষ্ট বুঝ হয়েছে ওর, কাব্য আর তিথীকে নিয়ে ওর মনে প্রশ্ন উঠতেই পারে। তাই আগে থেকেই উনি সবটা বলেছেন তমাকে। আর কড়া ভাবে নিষেধ ও করেছে তিথী জনি এইসব ব্যাপারে না জানে।কারণ সে এখনো যথেষ্ট ছোট। যখন যা হওয়ার তা হবে। তাই তিথীকে এখন কিছু জানানোর প্রয়োজন নেই। তমা ও আর তিথীকে এইসব ব্যাপারে কিছু বলে না।কাব্যর কথা জিজ্ঞেস করাতে প্রথম প্রথম তানিয়া বেগম মেয়েকে ধমক দিয়ে এড়িয়ে গেলেও একটা সময় ভাবে উনার জানতেই হবে সেদিন কি হয়েছিলো। আসলে মেয়ে অপ্রস্তুত হবে বলেই উনি তখন আবিরের সুসাইড এর ব্যাপারে তেমন কিছু জানতে চান নি। উনার মেয়ের উপর উনার যথেষ্ট ভরসা আছে। কারণ তমা খুব লক্ষি মন্ত মেয়ে। তিথী অবশ্য তার উল্টো। খুব জেদি আর বদরাগী। হুট হাট রাগ উঠে যায় তার।
তানিয়া বেগম তারেক রহমান ভেবেছিলেন তমা আবির কে রিফিউজ করেছে বলেই হয়তো আবির সু*সা*ই*ড
করতে গিয়েছিলো। শুনে অবশ্য খুবই খারাপ লাগে উনাদের। কিন্তু তমা এমন ই, খুবই শান্তশিষ্ট মেয়ে।
কিন্তু এখন তমার মুখে সত্যি টা জানার পর উনি পুরাই থ হয়ে যান।উনার মেয়ে এতোটা বদরাগী যে বিনা কারণে ওর থেকেও ৭/৮ বছরের একটা ছেলেকে গিয়ে থাপ্পড় মারলো। এভাবে অপমান করলো।
হুম সেদিনের ঘটনা, আবির তমাকে কোনো রকম বিরক্ত বা অপ্রস্তুত করেনি। দুই এক বার প্রপোজ করেছে, আর তমা যেখানে যেতো জাস্ট চোখ দিয়ে ফলো করতো। এতেই তমা খানিকটা ভয় আর খানিকটা লজ্জায় ভার্সিটি যাওয়া বন্ধ করে দেয়। আসলে সে খুব ভিতু টাইপের মেয়ে। এসবে তার ভিষণ ভয়।
তিথী যখন জিজ্ঞেস করে ভার্সিটি যাও না কেনো আপুটি, তখন তমা বলে ক্যাম্পাস এর বড় ভাই তাকে পছন্দ করে। তাই তার ক্যাম্পাসে যেতে ভয় করে। তিথী জিজ্ঞেস করেছিলো তুমি কি করো?
পাগল হয়েছিস? আমি তো ভয়েই মরে যাই।
তারপর তিথী বলে দাঁড়াও দেখছি ব্যাপার টা, বলেই পরের দিন তমার ক্যাম্পাসে গিয়ে এই কান্ড ঘটায়।
তমা পাশ থেকে বার বার তিথীকে নিষেধ করা সত্বেও তিথী তার বীর গিলি ফলানো তে দমে যায় নি।
আর এতেই আবির অপমানে, লজ্জায় আর তমা যে তাকে একদম ই পছন্দ করে না সব ভেবে সে এতো বড় একটা অঘটন করে বসে।
তানিয়া বেগম শুনে তো মাথায় হাত। কাব্য যতোটা দোষী সে হিসেব করলে তার অবুঝ মেয়ে আরো বেশী দোষী। তার দ্বারাই প্ররোচিত হয়ে একটা মানুষ আত্নহত্যা করতে গিয়েছিলো। এটা কি অপরাধ না?
এখন উনি লজ্জায় মরে যাচ্ছেন। কারণ সেদিন কাব্য যাওয়ার ৩ দিন পর শাহানারা বেগম এসেছিলেন এ বাড়িতে। উনি কাব্যর ব্যাপারে একটা কথাও শুনেননি, বরং কাব্য যা অপরাধ করেছে তাই ইনিয়ে বিনিয়ে বার বার শাহানারা বেগম কে বুঝিয়ে দিয়েছে। তখন উনার মেয়েরা বাইরে ছিলো তাই আর মেয়েদের সাথে দেখা হয়নি শাহানারা বেগম এর। শাহানারা বেগম ও আর কাব্যর ব্যাপারে কোনো কথা তুললেন না। উনার ছেলে যে সত্যিই অন্যায় করছে, অনেক বড় অন্যায়। ছেলেটা যে উনার দ্বিতীয় বারের মতো ভেঙে গেলো। কি হবে এখন এটা ভাবতে ভাবতেই উনি উঠে চলে যান উনার বাসার উদ্দেশ্যে।
তানিয়া বেগম হাজার বার ভেবে তারেক রহমান এর সাথে কথা বলে কাব্যর ফোনে ফোন দেয়। কিন্তু কোনো খবর ই পায় না কাব্যর, কারণ ফোন ই তো বন্ধ দেখাচ্ছে।
উনি শুধু ভাবছেন সেদিন শাহানারা বেগম কে এভাবে অবহেলা করার পর কিভাবে যাবেন আর ও বাড়িতে। হঠাৎ ই মনে পড়লো তিথীর তো রেজাল্ট দিবে পরশু, রেজাল্ট এর বাহানায় যাওয়া যাবে। তখন না হয় ক্ষমা চেয়ে নিবেন শাহানারা বেগম এর থেকে।
আর কাব্য, কাব্য তো উনার ছেলে, উনি ক্ষমা চাইলে নিশ্চয় ক্ষমা করবে।
***************
কাল তিথীর রেজাল্ট দিবে, টেনশন হচ্ছে খুব। তমার রুমে অস্থির হয়ে গিয়ে তমার টেবিলের পাশে বিছানায় বসে পরে সে।
কিরে কি সমস্যা?
-খুব টেনশন হচ্ছে আপুটি।
– কিসের জন্য?
– তিথী অবাক হয়ে, এমা তুমি জানো না!!
-কি?
-কাল তো আমার রেজাল্ট দিবে।
– তো?🙄
-তো আবার কি? রেজাল্ট এর জন্যই তো টেনশন হচ্ছে।
– এতে এতো টেনশন এর কি আছে?যেমন এক্সাম দিয়েছিস তেমন ই তো রেজাল্ট আসবে।
আমি কি তোমার মতো এতো ব্রাইট স্টুডেন্ট যে একবার এক্সাম দিয়ে নিশ্চিন্তে বসে থাকবো।
তো চিন্তা করলে কি রেজাল্ট ভালো হয়ে যাবে?
না, তবে আমি তোমার কিউটসি, সুইটসি ছোট বোন, আমার টেনশন কমানোর দায়িত্ব কি তোমার না?
তো এখন ম্যাডাম এর টেনশন কমানোর জন্য কি করতে হবে? এই না, এখন আবার বলে উঠিস না এই রাতে ফুচকা কিংবা আইসক্রিম খেতে যাবি।
আরেহ নাহ, তাহলে তো আব্বুর কাছেই যেতাম, তোমার কাছে কি তবে আসতাম।
তাহলে কি করতে পারি আপনার জন্য?
চলোনা আপুটি ছাদে যাই।
সময় দেখেছিস? ১১.৩৯ বাজে, আম্মু জানলে ঠ্যাং ভেঙে দিবে।
আব্বু আম্মু ঘুমিয়ে গেছে তো। চলোনা যাই।
তমার ও আর পড়তে ভালো লাগছে না। তাই দুই বোন ছাদে চলে গেলো। তিথী সাথে একটা মাদুর নিলো।
কিরে এটা নিচ্ছিস কেনো?
শুয়ে শুয়ে তারা গুনবো। বেশ হবে আপুটি, বলেই জ্বলজ্বল চোখে চাইলো তমার দিকে।
তমা মুচকি হাসি দিলো আর মনে মনে বল্লো তুই সত্যিই অনেক পিচ্ছিরে বোন।
দুই বোন আকাশে দিকে মুখ করে শুয়ে আছে, এক হাত মাথার নিচে দিয়ে। আজ পূর্নিমা না, অর্ধচন্দ্র আজ। তবু চারদিকে আলোতে ভরপুর। তিথী এক হাত দিয়ে তারা গুনার বৃথা চেষ্টা করছে। তা দেখে তমা হেসে দেয়, বলে কয়টা গুনেছিস?
৫৬ টা। আর গুনতে পারছি না। একটা দুবার হয়ে যাচ্ছে নয়তো ২/১ টা মিস হয়ে যাচ্ছে।
একটা কথা বলি তিথী?
বলোনা!
এইযে কাব্য ভাইয়া আজ প্রায় আড়াই তিন মাস যাবৎ এ বাড়িতে আসে না তোর মনে হয় না উনার কথা?
হুহহ আমার কেনো মনে হতে যাবে উনার কথা? কটা দিন কি টর্চার ই না করলো আমায়। খুব শান্তিতে আছি আমি। আর কোনো দিন জানি না আসে এখানে এই দোয়া ই করি।
আসবে নারে আর। আম্মু তুই না গেলে আসবে না। আমি নিজেও তো ক্যাম্পাসে কতো খোঁজ নেয়ার ট্রাই করেছি। পারিনি তো। দেখেছলাম একদিন তবে খুবই বিদ্ধস্ত অবস্থায়। তবে কথা বলার সুযোগ হয়ে উঠেনি।মনে মনে কথা গুলো বল্লো তমা।
উনাকে তোর পছন্দ না?
ইয়াক🤮 উনাকে আমার কেনো পছন্দ হতে যাবে? আংকেল মার্কা কাবির সিং একটা।
এবার তমার রাগ হলো। কারণ তমা মনে মনে অনেক সম্মান করে ও নিজের ভাই এর মতো ভালোবাসে কাব্য কে।
তুই জানিস ক্যাম্পাসের মাস্টার্স থেকে শুরু করে ফার্স্ট ইয়ারের প্রায় সব মেয়েদের ক্রাশ উনি।
তোর ও?😲
কি বলছিস পাগলের মতো? ভাই হয় উনি আমার। নিজের ভাই।
হুহ আসছে নিজের ভাই।😏😏
মেয়েদের রুচি এতো খারাপ? উনার মতো ভিলেন টাইপের কাবির সিং কে পছন্দ?
উনার উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ গায়ের রঙ, প্রায় ৬ ফিট লম্বা হাইট আর জিম করা বডি আর সবচেয়ে আকর্ষণীয় উনার এটিটিউড, যে কোনো মেয়েই ফিদা হয়ে যায়। জানিস কোনো মেয়েকে এই পর্যন্ত উনি পাত্তা দেয় না। একবার যদি কারো সাথে চোখাচোখি হয়েও যায় দ্বিতীয় বার আর কখনো ফিরে দেখেনি।
তোদের ক্যাম্পাসের মেয়েরা কি সব পাগল নাকি রে?এমন কাবির সিং কেউ কারো পছন্দ হতে পারে আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।
আচ্ছা বুঝলাম তো তোর কেমন ছেলে পছন্দ?
আমার তো রোমান্টিক হিরো পছন্দ রে, আজ লাইক রানবীর কাপুর। নট লাইক দেট কাবির সিং। সারাক্ষণ একটা রাগী লুক নিয়ে থাকে।
তমা হাসে তিথীর কথায়। মনে মনে বলে, তুই তো জানিস ই না তোর জন্য ১৫ বছর ধরে এক সমুদ্র ভালোবাসা নিয়ে বসে আছে ঔ কাবির সিং টাই। কিন্তু পরিস্থিতিতে পরে প্রকাশ করতে পারছে না। তোকে না দেখেই তোর মাত্র ১ বছর বয়সের স্মৃতি আঁকড়ে ধরে উনি বছরের পর বছর অপেক্ষা করে বসে আছেন তোর জন্য। উনার পুতুল বউ এর জন্য। উনার মন গহীনে যে উনার ছোট্ট পুতুল বউকেই এতো বছর যাবৎ লুকিয়ে রেখেছেন যত্ন করে।তমা আবারো হাসলো।
তুমি কি পাগল হয়ে গেছো আপুটি? এভাবে হাসছো কেনো? নাকি তোমায় আবার ভুতে পেলো? আমার কিন্তু ভয় করছে আপুটি। বলেই তমাকে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে ফেলে।চলো চলে যাই আপুটি।
হুম চল, বলে দুজনেই নিচে নেমে এলো।
*********************
কিছুক্ষণ আগেই তিথীর রেজাল্ট দিয়েছে। A+ পেয়েছে তিথী। গোল্ডেন আসেনি। তবুও সে খুব খুশী। তমার অবশ্য এসএসসি এইচএসসি দুইটাতেই গোল্ডেন ছিলো। তিথী দুষ্ট প্রকৃতির, পড়াশোনায় মনোযোগ কম, তাই এই রেজাল্ট ই তার হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো রেজাল্ট।
মেয়ের রেজাল্ট এ তানিয়া বেগম তারেক রহমান দুজনেই খুশী। তিথী তার স্কুলে গিয়েছিলো রেজাল্ট নিতে। এখানে বন্ধু বান্ধব এর সাথে মজা করে বিকেলে ফিরেছে বাসায়।বাসায় আসতেই মা এসে মিষ্টি মুখ করালো তাকে। তারপর একে একে বাবা আর তমা ও।
সবাই খুশী আজ।
তিথী নিজের রুমে চলে গেলো ফ্রেশ হতে। তখন তানিয়া বেগম তারেক রহমান কে বলেন কাল ৩/৪ কেজি ভালো দেখে মিষ্টি কিনে দিয়ো, সেলিম ভাই এর বাসায় যাবো।
তারেক রহমান বলেন, আরেকবার ভেবে দেখো। এই ৩ মাসে ছেলেটার কোনো দেখাই কিন্তু পাইনি আমরা। আসলে আমরা ই অবশ্য চাইনি দেখা করতে। কি অবস্থাতে আছে তাও কিন্তু জানি না।
তাই তো জানার চেষ্টা করছি। এই জন্যই যাবো। আমি নিজে গিয়ে কাব্যর কাছে ক্ষমা চাইবো। আমার বিশ্বাস আমার ছেলে আমাকে ফিরিয়ে দিবে না।
শাহানারা ভাবির কথাও কিন্তু সেদিন শুননি তুমি।
আমি ভাবির ছোট, ভাবি নিশ্চয় আমাকে ক্ষমা করবেন।
তুমি যা ভাবছো তাই যেনো হয়।
আশা করি তেমন ই হবে।
পরের দিন বিকেলের দিকে তানিয়া বেগম বেড়িয়ে গেলেন দুই মেয়ে নিয়ে। তমা অবশ্য কোথাও তেমন যায় না। কাব্যর বাসায় যাওয়ার কথা শুনে সে এক্সাইটেড হয়ে যায়। আর তিথী, তিথীর কেনো জানি মোটেও যেতে ইচ্ছে করছে না।তিথী কিন্তু মনে মনে কাব্য কে ভয় ই পায়। যতই উপরে উপরে ঝগড়া করুক। তাই সে চাইছে না ওখানে যেতে। তানিয়া বেগম খুব রাগ করে এক প্রকার বকা ঝকা করেই নিয়ে গেলেন তিথীকে।
তোমার রেজাল্ট উপলক্ষেই যাচ্ছি আর তুমি ই যাবে না?😡( রেগে গেলে উনি মেয়েদের তুমি ই বলেন)
রিক্সা দিয়ে ৩০ মিনিট লাগে আহমেদ ভিলায় যেতে। তানিয়া বেগম পৌঁছালেন আহমেদ ভিলায়।দারোয়ান ভিতরে ফোন করার পর সাদরে ভিতরে যেতে দেয় উনাদের।
।
।
।
।
চলবে