#মন_তুমি_ছুঁয়ে_দেখো_না
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ১২
রুদ্রিকের মুখে আকদ করিয়ে রাখার কথা শুনে মির্জা বাড়ির সকলেই বেশ অবাক হয়েছিলেন।পরক্ষণে সবাই অবাকের রেশ কাটিয়ে উঠতেই খুশিতে আত্মহারা হয়ে যান।যাক রুদ্রিক রাজি হয়ে গিয়েছে।আর আকদ করিয়ে রাখার কথা নিজেই বলছে।আতিক মাহাবুব কথাটা আজিজুর সাহেবের কাছে প্রস্তাব সরূপ রাখতেই তারাও রাজি হয়ে যান।পবিত্র একটা বন্ধনে তারা আবদ্ধ থাকবে এর থেকে ভালো আর কি হবে? আরিয়ান,রোজা,ইহান,রুদ্রিক তারা চলে যায় বিয়ের সকল ব্যবস্থা করতে।এদিকে মিনহা মেয়ের কাছে যান ব্যাপারটা জানানোর জন্যে।তিনি অথৈয়ের রুমে গিয়ে দেখেন।মেয়ে তার পরনের শাড়ি টারি খুলে গোসল দিয়ে বিছানায় সুয়ে সুয়ে ফোন স্ক্রোল করছে।তিনি অথৈকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
‘ এ কি করেছিস?শাড়ি খুলেছিস কেন?আর একটু পরে থাকতি।তারা না যাওয়া পর্যন্ত।’
অথৈ উঠে বসল।মায়ের কথায় বিরক্ত হয়ে বলে,
‘ উফফো মা।আর ভালো লাগছিল না এইসব শাড়ি টারি পরে থাকতে।সেই কখন থেকে পরে আছি।’
মিনহা বেগম কথা বাড়ালেন নাহ।অথৈয়ের কাছে গিয়ে অথৈয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেন,
‘ বিয়েতে যেহেতু তুই মত দিয়েই ফেলেছিস।তাই উনাদের পরিবার চাচ্ছেন আজকেই তোর আর রুদ্রিকের আকদ করিয়ে রাখতে।যেহেতু তুই রাজি।এইজন্যে আমরাও আর মানা করিনি।কি বলিস তুই?’
অথৈ বিষ্ময়ে হা করে রইল।সে সবে মাত্র হ্যা বলেছে।আর এরা ফোরজি স্পীডে এগিয়ে গিয়ে বিয়েও করিয়ে ফেলবে।এটার পিছনে যে রুদ্রিকের হাত তা বুঝতে বিন্দু মাত্র অনুবিধে হলো না অথৈয়ের।কিন্তু এই লোক এমন হাত ধুয়ে পরেছে কেন ওর পিছনে?ভালো তো ওকে বাসে না সেটা নিশ্চিত।তবে কি সেদিনের ওর করা ব্যবহারের প্রতিশোধ নিতে চায়?না এমনটা রুদ্রিক করতে পারবে না।রুদ্রিক এমন না।তা এই কয়েকদিনে সেটা বুঝতে পেরেছে অথৈ।তবে কেন করছে সে এমন?অথৈয়ের ভাবনায় ছেদে হয় ওর মায়ের কণ্ঠে,
‘ কিরে? কি বলিস?আকদটা করিয়ে রাখলেই ভালো।তাই নাহ?’
অথৈ মাথা দুলালো।যেহেতু ও রুদ্রিককে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে।সেখানে আজ আকদ করিয়ে রাখবে।এখানে দ্বিমত প্রকাশ করে লাভ নেই।তাছাড়া ওর বাবা মা মত দিয়ে দিয়েছেন।তাই আর কথা বাড়ালো না অথৈ।তবে মন খারাপ হচ্ছে বেশ।ওর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন আজকে।আর আজকের এই দিনেই ওর বন্ধুরা ওর পাশে নেই। বন্ধুদের শূন্যতা কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে অথৈকে।আজ ওর বন্ধুরা ওর সাথে থাকলে ওর এতো দ্বিধাদ্বন্দে ভুগতে হতো না। ভীষণ মিস করছে তাদের।
————–
ঘন্টাখানিকের মধ্যে বিয়ের সকল ব্যবস্থা করে ফেলা হলো।কাজি আনা হলো,হুজুর আনা হলো।রুদ্রিক অথৈর জন্যে শোপিং ও করে এনেছে।একটা মেয়ের বউ সাঁজতে যা যা লাগে সব এনেছে।এবং তা রোজার হাতে দিয়ে বলেছে।অথৈকে এইগুলো দিয়ে তৈরি করে আনতে।রোজা ক্ষণে ক্ষণে দেবরের পাগলামি দেখে অবাক হচ্ছে।তবে বেশি কথা বাড়ালো না।রুদ্রিকের দেওয়া সবকিছু নিয়ে অথৈয়ের কাছে চলে গেল।
এদিকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে অথৈ। মন খারাপ করে আকাশপাণে তাকিয়ে আছে।এইতো আর কিছুক্ষণ এরপরেই ওর জীবনের মোড় পাল্টে যাবে।বদলে যাবে ওর পরিচয়।ওর জীবনটা এমন কি গোটা ও পুরোটাই আজ অন্যকারো নামে দলিল হয়ে যাবে।আচ্ছা?বিয়ের পর ও এইভাবেই জীবনটা কাটাতে পারবে?যেমনটা গত কয়েকবছর যাবত কাটিয়ে আসছে।নাকি সম্পর্কের মারপ্যাচে ওকে বন্ধি হতে হবে অন্যকারো খাঁচায়?ভবিষ্যতটা ওর কেমন হবে?ও কি আজীবন চঞ্চল আর সাহসী আর স্বাধিন অথৈ হয়েই কাটাতে পারবে?নাকি রুদ্রিক তাকে সম্পর্কের জোড়ে ওকে আজীবনের জন্যে অন্ধকারে ঠেলে দিবে?কিন্তু অথৈ তো এমন সম্পর্ক চায় না।ও তো মুক্ত পাখির মতো বাঁচতে চায়।নাহলে যে দম বন্ধ হয়ে মা’রা যাবে।ওর ভাবনার মাঝে দরজায় টোকা পরে।অথৈ নিজেকে সামলে নিয়ে দরজা খুলতে চলে যায়।দরজা খুলে দেখে রোজা হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে।অথৈকে দেখে হেসেই বলে,
‘ ডিস্টার্ব করলাম বুঝি?’
অথৈয়ের মন অল্প হলেও ভালো হয়ে গেল রোজাকে দেখে।মেয়েটার মায়াভরা মুখটা দেখলে যে কারোরই মন ভালো হয়ে যাবে।অথৈ হাসিমুখে বলে,
‘ আরে আসুন না আপু।ভীতরে আসুন।’
রোজা অথৈয়ের রুমে প্রবেশ করে হাতের জিনিসপত্রগুলো বিছানার উপর রাখল।তারপর বলল,
‘ দেখি যাও হাত মুখটা ধুঁয়ে আস।রুদ্রিক তোমার জন্যে বিয়ের সব শোপিং করে নিয়ে এসেছে।এইগুলো দিয়ে তোমাকে তৈরি করে নিচে নিয়ে যেতে। তার আগে এসো।দেখে যাও তোমার বিয়ের শাড়িটা।দেবরের আমার পছন্দ আছে বলতে হবে।’
অথৈ কথাটা শুনে অবাক হলো।তারপর রোজার কথামতো শাড়িটা দেখার জন্যে এগিয়ে যায়।রোজা শাড়িটা খুলে মেলে ধরতেই অথৈয়ের চোখ জুড়িয়ে যায়।টকটকে সিঁদূর লাল রঙের স্টোন ওয়ার্ক করা কাতান শাড়ি।অসম্ভব সুন্দর শাড়িটা।অথৈয়ের চোখ ধাধিয়ে যাচ্ছে।আনমনে অথৈ শাড়িটায় হাত স্পর্শ করে। সাথে সাথে ওর হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়।এই শাড়িটা ও গায়ে জড়াবে।আজ বউ সাঁজবে ও রুদ্রিকের জন্যে।কেমন যেন অস্থির লাগছে অথৈর দ্রুত হাত সরিয়ে নিল শাড়ি থেকে। অথৈয়ের এমন হাশফাশ অবস্থা দেখে রোজা বুঝল অথৈ নার্ভাস।তাই অথৈয়ের কাধে রাখল।কাধে স্পর্শ পেয়ে অথৈ রোজা দিকে তাকায়।রোজা অথৈকে বলে,
‘ এতো অস্থির হবার কিছু নেই।নিজেকে হালকা রাখো।কোনো চিন্তার বিষয় নেই।জানো আমার বিয়ের সময়েও আমি এমন নার্ভাস ছিলাম।বলতে গেলে তোমার থেকেও বেশি।তোমার তো মা, বাবা, ভাই আছে।তোমার ভরসার যোগ্য কতোগুলো মানুষ আছে।কিন্তু আমার তো কেউ-ই ছিলো না।দুদন্ড মনের কথা কাউকে বলব সেরকম কেউ আমার ছিলো না।আরিয়ান আমাকে পছন্দ করেছে তাই ওর পরিবার যখন আমার জন্যে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসে।বিশ্বাস করো কিযে ভয় লাগছিলো।কেমন হবে পরিবার?আমাকে কিভাবে রাখবে?এখন তো রূপের মোহে পরে হয়তো আমাকে ছেলে আমাকে বিয়ে করবে।যখন মোহ কেটে যাবে। বাস্তবতা বুঝবে।আমি অনাত এটার কারনে তারা যখন সবার কাছ থেকে কটুক্তি শুনবে।তখন আমার প্রতি যদি তারা বিরক্ত হয়ে পরে?পরে যদি আমাকে বের করে দেয় তাদের জীবন থেকে?আরও নানান চিন্তায় আমি অসুস্থ হয়ে পরেছিলাম।ঠিক মতো খেতাম না ঘুমোতাম নাহ।কিন্তু বিশ্বাস করো বিয়ের পর আমার সব ধারনা পালটে যায়।আমাদের বৌভাতের দিন আমি অনাত এটা নিয়ে তাদের এক সুসম্পর্কের ফুপু আমায় কটু কথা শোনায়।এটা শোনার সাথে সাথে রুদ্রিক রেগেমেগে অস্থির। চিল্লাপাল্লা করে বাড়ি মাথায় উঠিয়ে ফেলেছিল।সে কি রাগ তার।সাথে বাকিরাও তো আছেই।সেই ফুপুর সাথে সব সম্পর্ক তারা ভেঙে দেয়।আমি যে তাদের কাছে এতোটা স্পেশাল তা বুঝতে পারেনি আমি।যেদিন বুঝলাম বাধ ভাঙা কান্নায় ঢলে পরলাম।আমার সব ভয় নিমিষেই গায়েব হয়ে গেল।আমিও পরিবার পেলাম।যারা আমাকে এতোটা ভালোবাসে।জানো যেদিন বিয়ে করে আরিয়ান আমায় প্রথম সেই বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল।দাদু সবার আগে আমায় বাড়ির চাবিকাঠি আমার হাতে দিয়ে বলেছিলেন।ঘরের লক্ষী ঘরে এসেছে।আজ থেকে তার ঘর সে নিজেই দেখে শুনে রাখুক।সেদিনের পর বাড়ির সব দ্বায়িত্ব আমায় দিয়ে দেন।আমাকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করেন।জব করার জন্যেও বলেছিলেন।কিন্তু আমিই করিনি।কারন জব করে যেই সময়টুকু আমি ব্যয় করব।সেই সময়টুকু আমি আমার পরিবারকে দিব।আমি তো অনাত ছিলাম বলো?পরিবার আসলে আমার কাছে কতোটা মূল্যবান তা বলে বোঝানো যাবে না।তাই আমার জীবনে যেই কয়দিনই বাঁচব। পরিবারেত সাথে হাসিখুশি থেকে উপভোগ করে বাঁচব সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।আজ আমি এতোটা সুখি যে।আজ নিজের সুখ দেখে নিজেই মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যাই।ভাবি এতো সুখ আমার মতো অনাতের কপালে উপরওয়ালা লিখে রেখেছেন কল্পনাও করেনি।এখন তারাই আমার সব।তাদের ছাড়া আমার একটা মুহুর্তও চলে নাহ।’
রোজার চোখজোড়া ছলছল করছে।কিন্তু ঠোঁটের কোণে তৃপ্তির হাসি।অথৈ মুগ্ধ হয়ে সেই হাসি দেখে।তবে ও নিজেও কি রোজার মতো অহেতুক চিন্তা করছে?এতো ভালো একটা পরিবার পাচ্ছে সে। অথৈ মাথা ঝাড়া দিয়ে চিন্তাটুক ঝেড়ে ফেলে দিল।তা হবে তা পরে দেখা যাবে।উপরওয়ালা যা করেন ভালোর জন্যেই করেন।তাই সবটা তার হাতেই ছেড়ে দিল।অথৈ মুঁচকি হেসে বলে,
‘ ধন্যবাদ আপু।আপনার থেকে এতোটা সাপোর্টিভ কথা শুনে আমার চিন্তাগুলো নিমিষেই গায়েব হয়ে গিয়েছে।’
‘ যাক শুনে খুশি হলাম।এখন যাও ফ্রেস হয়ে আসো।তোমাকে তৈরি করতে হবে।নিচে কাজি আর হুজুর বসে আছেন।’
অথৈও আর কথা বাড়ালো না।চুপচাপ ফ্রেস হতে চলে গেল।কিছুক্ষণ পর ফ্রেস হয়ে আসতেই।রোজা ওকে তৈরি করিয়ে দিতে লাগল।রুদ্রিকের দেওয়া শাড়ি,গহনা সব পরানো হলো অথৈকে।অথৈ রোজাকে বলে দিয়েছি।মেক-আপ যেন খুব হালকা হয়। একেবারেই ন্যাচারাল লাগে যেন ওকে।রোজা তাই করেছে।শুধু লিপস্টিকটা লাল টকটকে দিয়েছে।অথৈ দিতে চায়নি।রোজা জোড় করায়।আর রোজার কথা ফেলতে পারেনি।অথৈয়ের সাঁজ সসম্পূর্ণ হতেই।রোজা অথৈয়ের চিবুক স্পর্শ করে বলে,
‘ মাশা-আল্লাহ। একদম পুতুলের মতো লাগছে দেখতে।দাদুভাইয়ের পছন্দ একেবারে ফার্স্টক্লাস বলতে হবে।আমার দেবর তোমাকে দেখলেই একদম লাট্টু হয়ে যাবে।’
অথৈ আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকালো।নিজেকে বউ সাঁজে দেখে অথৈ কি বলবে বুঝতে পারল না।কেমন যেন একটা অনুভূতি কাজ করছে ওর মাঝে।যেই অনুভূতির ব্যাখ্যা ও কাউকে দিতে পারবে না।
হঠাৎ দরজায় টোকা পরল।মিনিহা বেগম ডাকছেন,
‘ কি হলো তোমাদের?সবাই অপেক্ষা করছে।’
রোজা বলল,
‘ এইতো আন্টি হয়ে গিয়েছে।আমি নিয়ে আসছি অথৈকে।’
‘জলদি এসো।’
মিনহা চলে গেলেন।তার অনেক কাজ বাকি।রান্না বান্না এখনও চুলায়।একা হাতে সব সামলানো কঠিন হয়ে পরেছে।কাজের মেয়েটাকেও এমন সময় ছুটি নিয়ে গ্রামে যেতে হলো।বিরবির করতে করতে মিনহা বেগম চলে গেলেন।
____________
অস্থির মন নিয়ে সোফায় টানটান হয়ে বসে আছে রুদ্রিক।বার বার দৃষ্টি চলে যাচ্ছে সিড়ির দিকে।মেয়েটা আসছে না কেন?এতোক্ষণ লাগে না-কি তৈরি হতে?তার যে আর অপেক্ষা ভালো লাগছে না।পাশেই বসে ইহান বন্ধুর পাগলামি দেখছে।রুদ্রিকের বউ যদি ওর বোন না হতো।তাহলে রুদ্রিককে এতোক্ষণে কতো কথা বলে যে ক্ষ্যাপাতো তা আর বলতে?এখন বোনের বড় ভাই হয়ে সেসব হাতছাড়া করতে হচ্ছে।ভেবেই দীর্ঘশ্বাস ফেলল ইহান।এদিকে অথৈয়ের দেরি দেখে রুদ্রিক ইহানের কানে ফিসফিস করে বলে,
‘ এতোক্ষণ লাগছে কেন আসতে?সেই কখন গিয়েছে ভাবি।তোর বোন কি সত্যিই বিয়েতে রাজি হয়েছে?বলবি?নাহলে আসছে না কেন?’
রুদ্রিকের একেরপর এক প্রশ্নে ইহানের হাসি পেলেও হাসলো না ও।মুখটা গম্ভীর করে বলল,
‘ লজ্জা রাখ কিছু।কাকে কি বলছিস?ভুলে যাস না সম্পর্কে এখন আমি তোর সম্বন্ধি হবো।’
ইহানের কথায় ভ্রু-কুচকে আসে রুদ্রিকের।বলল,
‘ ফাইজলামি করছিস আমার সাথে?কিসের সম্বন্ধি?হ্যা কি বলিস এগুলো?সব বাদ বুঝেছিস।তুই আমার বেষ্টফ্রেন্ড কম ভাই বেশি।এই সম্পর্কটাই থাকবে আমাদের। আর হ্যা উল্টাপাল্টা কথা বলে আমাকে রাগাবি না।এমনিতেই মেজাজ খা’রাপ হয়ে আছে।’
দুহাতে পিছনের চুল খামছে ধরে চোখ বুঝে নিল রুদ্রিক।
‘ ওইতো অথৈ এসে পরেছে।আয় মা বাবার কাছে এসে বোস।’
আজিজুর সাহেবের কথাটা কানে আসতেই তড়িৎ বেগে সামনের দিকে তাকায় রুদ্রিক। তাকাতেই স্তব্ধ হয়ে যায় ও।হৃস্পন্দনের গতি হু হু করে বেড়ে যায়।হাত পা ক্রমশ শিথিল হয়ে আসল।লাল টুকটুকে কাতান শাড়ি গায়ে জড়িয়ে,মাথায় সোনালি রঙের ওড়না দেওয়া,গহনা পড়া,সেই সাথে হালকা সাঁজ পুরো পুতুল বউ সেঁজেছে অথৈ। যেমনটা ও স্বপ্ন দেখতো প্রতিরাত।মেয়েটার ওই কাজল কালো চোখদুটোর গভীর মায়ায় তলিয়ে গেল রুদ্রিক আরেকবার।এভাবে যে কতোবার নিজেকে হারিয়েছে হিসেব ছাড়া।যতোবার ওই চোখের দিকে তাকিয়েছে।নাকে নোসপিন পরেছে ওর দেওয়া ডায়মন্ডের।সেখানে একটা চুমু খাওয়ার ইচ্ছে জাগলো রুদ্রিকের মনে।দৃষ্টি গিয়ে আটকালো অথৈয়ের লাল টুকটুকে ঠোঁটের উপর।সাথে সাথে নিষিদ্ধ ইচ্ছে মনের কোঠায় উঁকি ঝুকি দিতে লাগল।একবার যদি ছুঁয়ে দিতে পারত ওই অধরজোড়া।শুকনো ঢোক গিলল রুদ্রিক।মাথা ঝাকিয়ে ভাবনাগুলো ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করল।এসির মধ্যে বসেও সমানে ঘামছে রুদ্রিক।গলা শুকিয়ে চৌচির হয়ে গিয়েছে।জলদি টেবিল থেকে একগ্লাস পানি নিয়ে পাণ করে নিলো।যতোই নজর সরাতে চাইছে। কিন্তু বেহায়া নজরজোড়া ঘুরেফিরে অথৈয়ের মাঝে গিয়েই আটকে যায়।চোখ সরাতে পারছে না ও।মেয়েটা এতো সুন্দর লাগছে।যা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।রোজা দূর থেকে রুদ্রিকের অবস্থা দেখে মিটিমিটি হাসছে।তার দেবর যে অথৈয়ের রূপে কুপোকাত হয়ে পরেছে তা বেশ বুঝতে পারছে।কিন্তু এগুলোর মাঝে রুদ্রিক যে কিছু লুকাচ্ছে সেটা আন্দাজ করতে পেরেছে ও।এখন সময় মতো রুদ্রিককে ধরে সব কথা পেটের থেকে বের করার অপেক্ষায় আছে ও।সব ভেবে রোজা অথৈ নিয়ে আজিজুর সাহেবের পাশে বসালো।তারপর নিজে গিয়ে আরিয়ানের পাশে বসে পরল। আতিক মাহাবুব বললেন,
‘ এইবার বিয়ের কার্যক্রম শুরু করা যাক?’
‘ জি!’
আজিজুর সাহেবের অনুমতি পেতেই বিয়ের কার্যক্রম শুরু হয়ে গেল।প্রথমে ধর্মীয় নীতিতে বিয়ে পরানো হলো।রুদ্রিক আর অথৈ তিন কবুল বলে একে-অপরের হয়ে গেল।রুদ্রিককে কবুল বলতে বললে ও ফটাফট বলে দিয়েছে। কিন্তু অথৈয়ের বেলায় ও একটু সময় নিয়েছে।মেয়ের মনের অবস্থা আজিজুর সাহেব হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন।তিনি আদুরে হাতে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছেন।মিনহা বেগম চোখের ইশারায় কবুল বলতে বলেন।আরাবী অশ্রুভেজা চোখে বাবা মাকে দেখে।তারপর ভাইয়ের দিকে তাকায়।ইহানও চোখের ইশারায় সম্মতি দেয়।সবার ভরসায় অথৈ ভেজা কণ্ঠে ধীরে ধীরে কবুল বলে দেয়।সবাই আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠে।এরপর আইনের নীতিতে ম্যারিজ রেজিস্ট্রি পেপারে দুজনে সই করে দেয়।ধর্মীয়ভাবে আর আইনতভাবে রুদ্রিক আর অথৈ স্বামি স্ত্রীর পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যায়।বিয়ের কার্যক্রম শেষ হলে তার কিছুক্ষণ পর মির্জা বাড়ির সকলে চলে যাওয়ার কথা বললে মিনহা বেগম,আজিজুর সাহেব আর ইহান নারাজ হয়ে যায়।তাদের এক কথা রাতে খাওয়া দাওয়া না করে কোথায় যাওয়া হবে না।মির্জা বাড়ির কেউ আর তাদের আবদার ফেলতে পারলেন নাহ।তাই রাতের ডিনার এখানেই করেন।খাবার সময় রুদ্রিক আর অথৈকে রোজা একসাথে বসিয়েছে।পাশে রুদ্রিক বসায় যেন অথৈয়ের গলা দিয়ে খাবার নামছিলোই নাহ।কোনোরকম পানি দিয়ে একটুখানি খাবার খেয়ে উঠে গিয়েছে।খাবার দাবার শেষে মির্জা বাড়ির সকলে বিদায় নেন চলে যাবার জন্যে। আতিক মাহাবুব অথৈয়ের কাছে গিয়ে অথৈয়ের হাতে দুজোড়া বালা পরিয়ে দেন। অথৈ অবাক হয়ে তাকালে তিনি বলেন,
‘ এগুলো রুদ্রিকের মা বানিয়ে রেখেছিল তার পুত্রবধুদের জন্যে।রোজারটা রোজাকে দিয়ে দিয়েছি।আর আজ তোমারটা তোমাকে দিলাম।রুদ্রিকের দাদি বা মা থাকলে তারা দিত।কিন্তু তারা তো নেই।তাই আমিই দিলাম।সামলে রেখো।’
অথৈ বালা দুটোয় হাত ছোঁয়ালো।ধীর আওয়াজে বলল,
‘ সামলে রাখব।’
আরহাম সাহেব অথৈয়ের সাহেব এগিয়ে আসলেন।পুত্রবধুর মাথায় হাত রেখে দোয়া দিলেন।তারপর অথৈয়ের হাতে দশ হাজার টাকা গুজে দিলেন।অথৈ তা দেখে দ্রুত বলে,
‘ আংকেল এসব লাগবে না।কি করছেন।’
আরহাম সাহেব হেসে বলেন,
‘ আংকেল না।আজ থেকে আমি তোবার বাবা।ঠিক বেয়াই সাহেবের মতো।আর এইগুলো আমার পক্ষ থেকে উপহার। মানা করো না।আসলে হুট করেই যে আজ তোমাদের বিয়েটা হয়ে যাবে প্লান ছিলো না।তাই কিছু কিনে আনতে পারিনি।তাই এইগুলোই গ্রহণ করো মা।তুমি মন খারাপ করো না।’
‘ আরে না না আংকে…আব বাবা।আমি মন খারাপ করব কেন?আপনারা আমাকে খুশি হয়ে যা দেবেন। আমি তাতেই খুশি।’
‘ এইতো গুড গার্ল।’
আরিয়ান আর রোজা একসাথেই আসল।রোজা অথৈকে একটা স্বর্ণের লকেটসহ চেইন উপহার দিলো।আরিয়ান বলল,
‘ এটা আমার আর রোজার তরফ থেকে উপহার।’
এই চেইনটা তখন বিয়ের কেনাকাটা করার সময় কিনে এনেছে আরিয়ান।রোজা বলে দিয়েছিল।আরিয়ান উপহার অথৈয়ের হাতে দিয়ে বলে,
‘ ভালো থেকো।’
‘ আপনিও ভালো থাকবেন ভাইয়া।’
আরিয়ান হেসে মাথা দুলিয়ে সরে গিয়ে দাদু আর বাবার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়।রোজা মুচঁকি হেসে ফিসফিস করে অথৈকে বলে,
‘ কি সবার সাথে তো কথা বললে।এখন আমার দেবরটার সাথে একটু কথা বলবে নাহ?কবে না কবে আবার দেখা হয়।’
‘ তার সাথে তো আমার প্রতিদিনই দেখা হয় আপু।এ আর নতুন কি!’ বিরবির করে কথাটা বলল অথৈ।
বুঝতে না পেরে রোজা বলে,
‘ কিছু বললে?’
‘ আব.. না কি বলব।’
রোজা সোজা হয়ে দাঁড়ালো। তারপর স্বাভাবিক স্বরে বলে,
‘ রুদ্রিক আমরা গাড়িতে গিয়ে বসছি।আর অথৈ রুদ্রিক নিয়ে তোমার রুমে যাও বোন।একটু একা কথা বলে নেও।যাও।’
সবার সামনে এভাবে বলায় লজ্জা পেলো অথৈ। রোজা চোখ টিপে দিল রুদ্রিককে।রুদ্রিক ঠোঁট কামড়ে হাসল ওর ভাবির কান্ডকারখানা দেখে।অথৈ আলগোছে রুমের দিকে চলে গেল।পেছন পেছন গেল রুদ্রিক।রুদ্রিক রুমের দরজা চাপিয়ে দিল।অথৈ উল্টোদিকে ঘুরে আছে।বুকটা ধ্বুকপুক করছে।অন্যরকম এক অনুভূতি হচ্ছে।যা আগে কখনও হয়নি।ভাবতেই অবাক লাগছে।যাকে বিয়ে করবে না বলে বলে বলে হয়রান হয়ে গিয়েছিল।আর কিছুক্ষণের ব্যবধানেই সে এখন তার স্বামি।যে এই মুহুর্ত তার কাছেই দাঁড়িয়ে আছে।মনের ভীতর যে একটা অজানা ক্ষোভ ছিলো তা যেন কবুল বলার সাথে সাথেই গায়েব হয়ে গিয়েছে।একেই বলে বুঝি পবিত্র সম্পর্কের জোড়? ভাবনার ছেদ ঘটে নিজের খুব নিকটে কারও উপস্থিতি টের পেয়ে।আর লোকটা যে রুদ্রিক তা বেশ ভালোভাবে জানে অথৈ।ধীরে ধীরে রুদ্রিকের দিকে ফিরল অথৈ।পলক ঝাপ্টে তাকালো রুদ্রিকের দিকে।রুদ্রিক ঘোরলাগা দৃষ্টিতে অথৈয়ের দিকে তাকিয়ে আছে।ওই চোখে চোখ রাখতে পারল না অথৈ।দ্রুত মাথা নিচু করে নিলো।রুদ্রিক বাঁকা হাসল।তারপর মাথা নিচু করে মুখটা অথৈয়ের কানের কাছে নিলো।ভয় পেয়ে অথৈ চোখ বন্ধ করে নিলো।রুদ্রিক ধীর কণ্ঠে বলল,
‘ তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে অথৈ।অনেক সুন্দর। ‘
সরে আসল রুদ্রিক।চোখ বন্ধ করা থাকা অথৈয়ের দিকে দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি আটকালো ওই নোসপিনটার দিকে।মোলায়েম কণ্ঠে বলে,
‘ নোসপিনটায় পরায় একদম আমার বউ লাগছে।’
রুদ্রিকের মুখে ‘ আমার বউ ‘ কথা শুনে সর্বাঙ্গে বিদ্যুৎ বয়ে গেল অথৈয়ের।তড়িৎ গতিতে তাকালো রুদ্রিকের দিকে।চোখে মুখে তার অবাকের রেশ।রুদ্রিকের এই ব্যবহার যে হজম করতে পারছে না।অথৈকে আরও একশ ধাপ অবাকের চূড়ায় নিয়ে পৌছে দিতে।রুদ্রিক এক অবিশ্বাস্য কান্ড করে বসল। অথৈয়ের নাকে ঠিক নোসপিন পরা জায়গাটায় চট করে নিজের অধরের স্পর্শ দিয়ে দিলো।এরপর কোনো কথা না বলে।এদিক ওদিক না তাকিয়ে সোজা রুম থেকে বেড়িয়ে গেল।আর রেখে গেল স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা অথৈকে।যে হা করে রুদ্রিকের যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে আছে।যার হৃদস্পন্দন থেমে গিয়েছে।আর পুরো শরীর থরথরিয়ে কাঁপছে।রুদ্রিকের দেওয়া সেই অনাকাঙ্ক্ষিত একটুখানি অধর স্পর্শের জন্যে।
#চলবে_____________
ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।কেমন হয়েছে জানাবেন।বানান ভুল হলে তা ধরিয়ে দেওয়ার অনুরোধ।আজ বিশাল বড় পর্ব দিয়েছি। ২২০০+ শব্দের পর্ব এটা। আপনারা যদি সুন্দর সুন্দর মন্তব্য করেন।তাহলে আমিও এইরকম বড়ো বড়ো পর্ব দিব।#মন_তুমি_ছুুয়ে_দেখো_না
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ১৩
চিন্তায় অস্থির অথৈ।চিন্তা করতে করতে আজ সারাপথ হেটে হেটে এসেছে ভার্সিটিতে।অবশ্য ভার্সিটি ওদের বাড়ি থেকে বেশি দূরে নাহ।হেটে যেতে পনেরো মিনিট সময় লাগে।অথৈ দাঁত দিয়ে নখ কাটতে কাটতে ভার্সিটিতে ঢুকল।প্রবেশ করতেই সবার সবার আগে নজর গেল বাইকে বসে থাকা আড্ডারত রুদ্রিকের দিকে।রুদ্রিক আজ সম্পূর্ণ কালো রূপে নিজেকে রাঙিয়ে এসেছে।ব্লাক টিশার্ট, তার উপর ব্লাক শার্ট পরেছে,সাথে ব্লাক ডেনিম প্যান্ট।অনেক আকর্ষনীয় লাগছে রুদ্রিককে।কথার তালে তালে যখন হুট করে হাত দ্বারা ব্রাশ করে চুলে।ওই দৃশ্যটুকু দেখে গলা শুকিয়ে যায় অথৈয়ের।আচমকা রুদ্রিক ওর দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসি দিলো।এরপর ওকে চোখ টিপে দিল।অথৈ যেন হার্ড এট্যাক করে বসল এটা দেখে।দ্রুত চোখ সরিয়ে হুরমুর করে দৌড় দিয়ে তৎক্ষনাত সেই স্থান ত্যাগ করল।চরম অস’ভ্য লোকটা।কাল কি এক কান্ড ঘটিয়ে চলে গেল।অথৈয়ের স্বাভাবিক হতে কয়েক ঘন্টা লেগেছে।তারপরেও রাতে ঘুমোতে পারেনি।চোখ বন্ধ করলেই শুধু রুদ্রিকের দেওয়া চুমুর দৃশ্যটুক বার বার চোখের পাতায় ভেসে উঠছিল।এভাবে কি ঘুমানো যায়?বজ্জা’ত লোক।ওকে এইভাবে ছুটতে দেখে মাথা নিচু করে ঠোঁট কামড়ে হাসল রুদ্রিক।ওকে এইভাবে হাসতে দেখে নীল বলে উঠল,
‘ কিরে হাসছিস কেন?’
রুদ্রিক বলে,
‘ এমনি।কিছু না।তা তোরা বল।কোথায় যেন ট্যুরে যেতে চাচ্ছিস?’
জেনি সবসময়ের মতো বলল,
‘ কক্সবাজার যাই?সেখানে অনেক মজা হবে।’
সিয়াও জেনির কথায় সহমত পোষণ করল,
‘ হ্যা জেনি ঠিক বলছে।আমরা কক্সবাজার যেতে পারি।’
অনিক বিরবির করে বলে,
‘ জেনির চামচি কোথাকার।জেনি যা বলে তার সাথে সাথে শুধু মাথা নাড়ায়।জাস্ট অসহ্য।’
সিয়া ভ্রু-কুচকালো অনিককে এইভাবে বিরবির করতে দেখে।প্রশ্ন করে,
‘ আপনি কি কিছু বলছেন আমায়?’
অনিক জোড়পূর্বক হেসে বলে,
‘ আরেহ কি বলেন এসব?আপনাদের কিছু বলার সাধ্য কি আমার আছে?আমার গর্দান না কে’টে ফেলবেন? ‘
সিয়া মুখ ভেংচি কাটলো।বাতাস বইছে সেই বাতাসের তালে উড়ছে মারিয়ার চুল।নীলের বেশ ভালো লাগছে।নীল বাইকে বসে আছে আর ওর সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মারিয়া।সেদিন মারিয়াকে নিয়ে ঘুরতে গিয়েছিলো ঠিকই নীল।তবে সুযোগ হাতছাড়া করেনি।রুদ্রিক,ইহান,অনিক,সাফাত ওরা মিলে সব সাঁজিয়ে গুছিয়ে রেখেছিল একটা রেস্টুরেন্ট।সেখানে নীল মারিয়াকে নিয়ে গিয়েই প্রপোজ করেছিলো।মারিয়াও এক্সেপ্ট করে নিয়েছিলো। কারন ও নিজেও তো নীলকে ভালোবাসে।তবে এর বিনিময়ে নীলের পকেট পুরো ফাঁকা করে দিয়েছিলো ওরা।ওদের প্রেম হয়ে যাওয়ার কারনে ট্রিট দিতে হয়েছিলো।নীল মারিয়ার দিকে মুচঁকি হেসে তাকিয়ে আছে।মারিয়াকে দেখছে মন ভরে।মেয়েটা ক্ষণে ক্ষণে বিরক্ত হচ্ছে।বাতাসে ওরা খোলা চুলগুলো বেশ বিরক্ত করছে ওকে।নীলের ভালোলাগে মারিয়াকে খোলা চুলে দেখতে।কিন্তু মেয়েটা বিরক্ত হচ্ছে।এইজন্যে নিজের হাতে পরে থাকা রাবার ব্যানটা দিয়ে মারিয়ার চুলগুলো খুব যত্ন সহকারে বেধে দেয়।মারিয়া প্রথমে অবাক হয়েছিলো।পরক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়ে লজ্জায় লাল হয়ে যায় মেয়েটা।আর ওর লজ্জারাঙা মুখটা নীল তৃপ্তি নিয়ে দেখে।এদিকে ওদের এমন রোমান্টিক মুহূর্ত দেখে অনিক হা হুতাশ করে উঠল,
‘ আজ সিংগেল বলে তোরা এইসব করে আমাকে এইভাবে হিংসার আগুনে ছা’রখার করে দিবি?এখানে যে আমরা কতোগুলো সিংগেল মানুষ আছি তোর চোখে পরে নাহ?’
সবাই হেসে দিল অনিকের এমন কথায়।নীল বলল,
‘ তোকে তো কেউ বলেনি হিংসের আগুনে জ্ব’লতে?তুই কেন একটা মেয়ে পটিয়ে ফেলছিস নাহ।’
‘ আরে তোর কপাল ভালো দেখে কি আমাদের কপালও এমন ভালো হবে তার গ্যারান্টি কি?আমাদের মারিয়া বেশ শান্তশিষ্ট একটা মেয়ে।শুধু চলাফেরা করে দুইটা অশান্ত মেয়ের সাথে।তাতে কি হয়েছে?ও ওই দুইটা থেকে আলাদা।তুই অনেক লাকি।আর সা’লা আমি প্রেম করতে গেলে আমার কপালে আসবে মেক-আপের ফ্যাক্টরি,ন্যাকার উপর পিএইচডি করা।যে কথায় কথায় খালি বলবে, বাবু খাইছ?বাবু খাইছ? জাস্ট অসহ্য,অসহ্য।আমার এমন ন্যাকা মেয়েদের একটুও পছন্দ না।তাই তো দেখিস নাই সিয়ার সাথে ব্রেক-আপ করে নিয়েছি।’
লাস্টের কথাটা বলে অনিক নিজেই হতভম্ব হয়ে যায়।কথার তালে তালে মুখ ফোসকে বলে ফেলেছে।নাহলে এভাবে ও বলতে চায়নি।এদিকে সিয়ার চোখে জল টইটুম্বুর করছে।শেষে নিজের কান্না লুকাতে না পেরে।বহু কষ্টে শুধু এটুকু বলল,
‘ জেনি,মারিয়া আমি ক্লাসে যাচ্ছি।তোরা চলে আসিস।’
সিয়া উল্টো ঘুরে দ্রুত পায়ে চোখ মুছতে মুছতে চলে গেল।সিয়াকে এইভাবে যেতে দেখে সবারই মন খারাপ হয়ে গিয়েছে।ইহান থমথমে মুখে বলল,
‘ ব্রেক-আপ করে ফেলেছিস ভালো কথা।তাহলে কথায় কথায় সেই বিষয় টেনে নিয়ে আসিস কেন?দেখলি তো মেয়েটা কিভাবে কাঁদতে কাঁদতে চলে গেল।’
অনিক মাথা নিচু করে আছে।রুদ্রিক গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
‘ তোর এভাবে বলা একদম ঠিক হয়নি।তুই ব্রেক-আপ করে নিয়েছিস।এইজন্যে আমরা কেউ কিছু বলিনি।কারন এটা তোর ব্যাক্তিগত বিষয়।যেখানে আমরা হস্তক্ষেপ করতে চায়নি।তবে একটা বিষয় আমরা সবাই জানি এমনকি তুইও জানিস যে সিয়া সত্যিই তোকে ভালোবেসেছিলো।ইনফেক্ট এখনো ভালোবাসে। তুই যেসব কারনে ওর সাথে ব্রেক-আপ করেছিলি। মেয়েটা হাজারবার বলেছিল ও নিজেকে বদলে নেবে।তাও যেন তুই ওকে ছেড়ে না যাস।আমরাও বুঝিয়ে ছিলাম।কিন্তু তুই মানিস নি।মেয়েটাকে কতোটা হার্ট করে তুই ব্রেক-আপ করে দিলি।’
সাফাত রুদ্রিকের কথায় সহমত পোষণ করে বলে,
‘ রুদ্রিক একদম ঠিক বলছে অনিক।আর তাছাড়া তুই যেসব কথা বলে আজ ওকে কষ্ট দিলি।ও কি এখন তা করে?ও সেদিনের পর থেকে নিজেকে বদলে নিয়েছে।ও এখন আর আগের সিয়া নেই।ওয়েস্টার্ন বাদ দিয়ে এখন শালীন পোষাক পরে।আগে যে মেয়ে সবসময় মেক-আপের আস্তরণ মুখে মেখে থাকত।সে এখন চোখে একটুখানি কাজল আর ঠোঁটে একটু লিপজেল ছাড়া কিছুই দেয়নাহ।নিজের কথাবার্তা, চালচলন সব বদলে ফেলেছে।আর তাকেই কিনা তুই এইভাবে কথায় কথায় পুরোনো কথা তুলে কষ্ট দিস।’
মারিয়া করুণ গলায় বলে,
‘ ও তোকে এখনও অনেক ভালোবাসে ভাইয়া।মেয়েটা রাতে ঠিকমতো ঘুমায় না।প্রতিটা রাত তোর জন্যে কেঁদে বালিশ ভিজায়।যার একমাত্র সাক্ষি আমি।’
অনিক সবার কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল।সবার বলা প্রতিটা কথা ভীষণভাবে ওর হৃদয় নাড়িয়ে দিয়েছে।ও যে কাকে কি বলে? কিভাবে জবাব দিবে ভেবে পাচ্ছে না।আসলে জনাব দেওয়ার মতো কোনো ভাষা নেই ওর কাছে।তবে কি ও সত্যিই অনেক বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলল সিয়াকে?মেয়েটার মন ভেঙে দিয়ে অনেক বড় অপরাধ করে ফেলেছে ও।অনুশোচনায় হৃদয় পু’ড়ে গেল অনিকের।সহ্য করতে না পেরে সেখান থেকে হনহন করে হেটে চলে যায়।ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে সবাই দীর্ঘশ্বাস ফেলে।যারা মন থেকে বুঝতে চায়না।তাদের হাজার বুঝিয়েও লাভ নেই।তাই বাকি কেউ আর ঘাটলো না।সবটা ভবিষ্যতের হাতে ছেড়ে দিল।
_____________
এদিকে মাঠের মাঝখানে গোল হয়ে বসে আছে অথৈ,রিধি,পিহু,প্রিয়ান আর আহিদ।অথৈ রাগি চোখে সবার দিকে তাকিয়ে।সবাই দাঁত কেলিয়ে তাকিয়ে আছে অথৈয়ের দিকে।অথৈ রাগি গলায় বলে উঠল,
‘ তোদের সবার মরা একসাথেই মরছিলো কালকে।আমি ফোন করে বললাম যে আমায় কাল দেখতে আসবে।আর তোদের সবগুলোর একসাথেই এক এক জায়গায় যেতে হোলো।’
পিহু কিছু বলতে নিবে অথৈ তার আগেই ওকে ধমকে উঠল,
‘ তুই তো কোনো কথাই বলবি না। তোকে কতোগুলো ফোন করেছি আমি।একটাও রিসিভ করেছিস?শেষে ফোনটা বন্ধ করে রেখে দিয়েছিলি।’
পিহু মাথা নিচু করে মিনমিন করে বলে,
‘ সে তো আমি প্রিয়ান আর আহিদের উপর রাগ করে এমন করেছি।শয়তানগুলো আমাকে না জানিয়ে ঘুরতে চলে গিয়েছে।’
‘ হ্যা তাই জন্যে তুই আমার কল পিক করবি নাহ।’
পিহু কোনো জবাব দিলো নাহ।
আহিদ বলে উঠল,
‘ আরে তুই এতো রেগে আছিস কেন?দেখতেই তো এসেছে জাস্ট তোকে।বিয়েতো আর হয়ে যায়নি তাই নাহ?তোর বিয়ের সময় দেখিস আমরা একমাস আগেই তোর বাড়িতে এসে হাজির হোবো।তাছাড়া আংকেল যে তোকে এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে দিবে না তা আমরা জানি।’
‘ হ্যা রিধি।আহিদ ঠিক বলছে।তুই এমন রাগ করছিস কেন?আর দেখতে তো আমাকেও এসেছিলো দু একবার।মেয়েরা বড়ো হলে এমন হয়ে থাকে।’ বলল রিধি।
ওদের কথায় যেন তড়তড়িয়ে অথৈয়ের রাগ বারছে।ওরা কেউ অথৈয়ের কথা সিরিয়াসলি নিচ্ছে না।অথৈ সবার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলল,
‘ কাল শুধু দেখতে আসলে আমি রাগ করতাম না।ব্যাপারটা তোরাও জানিস।’
‘ তাহলে কেন রেগে আছিস?’
আহিদের প্রশ্নে অথৈ কিছুক্ষণ চুপ থাকলো।তারপর দূরে মাঠের ওইপ্রান্তে আড্ডারত রুদ্রিকের দিকে একবার তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো।ঠান্ডা গলায় বলল,
‘ কারন কাল আমার বিয়ে হয়ে গিয়েছে।’
প্রিয়ান পানি খাচ্ছিলো।অথৈয়ের মুখে বিয়ের কথা শুনে ওর নাকে মুখে পানি উঠে যায়।ওর সামনে ছিলো পিহু ওর মুখের পানি সব গিয়ে পরে পিহুর উপর।এদিকে পিহু বেচার প্রিয়ানের এমন কান্ডে কোনো রিয়েকশনই দিলো নাহ।আসলে ও রিয়েকশন দিতে ভুলে গিয়েছে।সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। ওইভাবেই একে-অপরের মুখের দিকে চাওয়া-চাওয়ি করল।এরপর হুট করে সবাই একসাথে হেসে উঠল।ওদের হঠাৎ এমন হাসিতে অথৈ ভড়কে যায়।পিহুর হাসতে হাসতে চোখের কোণে জল জমে গিয়েছে।ও বহুকষ্টে হাসি থামিয়ে বলে,
‘ অথৈ দেখ এমন ফাউল মজা করিস না রে।হাসতে হাসতে আমার পেট ব্যাথা করছে।’
রিধিও হাসতে হাসতে বলে,
‘ তুই বিয়ে করে নিয়েছিস।অন্তত এটা নিয়ে আমাদের সাথে মজা করিস নাহ।আমরা আমাদের হাসি থামাতে পারছি না।’
‘ তুই আর বিয়ে। ভাই আমি শেষ।’ বলল আহিদ।
এদিকে প্রিয়ান হাসির কারনে কিছু বলতেও পারছে নাহ।
অথৈ ওদের অহেতুক হাসি দেখে উঠে দাঁড়ালো।রাগে ওর সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে।ও কি একটা সিরিয়াস কথা বলল আর বেয়া’দবগুলো কিভাবে হুটোপুটি করে হাসছে।অথৈ রাগে প্রায় চিৎকার করে বলে উঠল,
‘ আমি সত্যি বলছি আমার কাল বিয়ে হয়ে গিয়েছে।আল্লাহ্’র কসম করে বললাম।আমি মিথ্যে বলছি না।সত্যি আমার বিয়ে হয়ে গিয়েছে।’
বলতে বলতে অথৈয়ের চোখ জলে ভড়ে উঠল।বন্ধুদের ছাড়া এইভাবে হুট করে বিয়েটা হয়ে গিয়েছে।সেটা ভাবলেই ওর কষ্টে বুক ফে’টে যায়।
এদিকে এইবার যেন ওদের চারজনের টনক নড়ল।অথৈ যে সত্যি সত্যি মিথ্যে বলছে না সেটা বিশ্বাস করল ওরা।চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে ওরা।হঠাৎ ধরাম করে কিছু একটা পরার শব্দ হতেই ওদের হুশ আসে।কিসের শব্দ হোলো সেটা বোঝার জন্যে শব্দের উৎসের দিকে তাকিয়ে দেখে প্রিয়ান মাঠের মধ্যে অজ্ঞান হয়ে পরে গিয়েছে।অথৈয়ের মুখে এমন একটা কথা শুনে বেচারা সহ্য করতে পারিনি।তাই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে।রিধি শুকনো ঢোক গিলল।ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে আহিদের কাছে দিয়ে বলে,
‘ পানি ছিটিয়ে দে ওর চোখে মুখে।জ্ঞান ফেরা ওর।’
পিহু রাগে দুঃখে অজ্ঞান হয়ে পরে থাকা প্রিয়ানকে ধাক্কা মেরে বলল,
‘ এই বা*টারে মন চাইতাছে ঠাটাইয়া দুইডা থা’ব্রা মারি।এমন সিরিয়াস মুহূর্ত এইটা এমন অজ্ঞান হয় কিভাবে?’
আহিদ প্রিয়ানের চোখে মুখে পানির ছিটা দিয়ে বলল,
‘ ও এমন ড্যাঞ্জারাস সিরিয়াস কথা শুনেই জ্ঞান হারিয়েছে পিহু।’
পানি টানি খাইয়ে প্রিয়ানের জ্ঞান ফিরিয়ে আনা হোলো।ও জ্ঞান ফিরার পর ও এখনও হা করে তাকিয়ে আছে অথৈয়ের দিকে।বেচারার এখনও কষ্ট হচ্ছে অথৈয়ের কথাটা বিশ্বাস করতে।অতি কষ্টে বেচারা চুপ করে আছে।পিহু মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে।রিতিমতো সবাই প্রচন্ড শক পেয়েছে।
এদিকে রিধি উঠে গিয়ে ধরে অথৈকে ওদের পাশে বসালো।অথৈয়ের থমথমে মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘ কিভাবে কি হোলো অথৈ?আর বিয়েটা কার সাথে হোলো?ছেলের ছবি টবি আছে?থাকলে দেখা।’
অথৈ গম্ভীর মুখে জবাব দেয়,
‘ উনাকে তোরা চিনিস।খুব ভালোভাবেই চিনিস।’
অথৈয়ের কথায় সবাই আবার একে-অপরের দিকে তাকালো।আহিদ জিজ্ঞেস করল,
‘ কে সে অথৈ?কে সে যাকে আমরা চিনি?’
অথৈ সবার দিকে একপলক তাকালো।পর পর দু তিনটা ঢোক গিলল। প্রথম কথাটাই এদের হজম করতে এতো কষ্ট হচ্ছে।তাহলে রুদ্রিকই যে ওর স্বামী সেটা শুনলে না জানি কি করবে।অথৈ কে চুপ থাকতে দেখে পিহু অধৈর্য হয়ে বলে,
‘ কি হোলো বলছিস না কেন?কে সে।’
অথৈ দীর্ঘশ্বাস ফেলল।তারপর বলে উঠল,
‘ সে আর কেউ না।ইহান ভাইয়ার বেষ্টফ্রেন্ড আরিহান রুদ্রিক মির্জা।’
অথৈয়ের কথাটা বলতে দেরি।প্রিয়ানের আবার অজ্ঞান হতে দেরি নেই।বেচারা অজ্ঞান হয়ে চিটপটাং হয়ে পরে গিয়েছে।
#চলবে____________
ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।কেমন হয়েছে জানাবেন।কাল আপনাদের সবার এতো ভালো রেস্পন্স পেয়ে।খুশি হয়ে আজ আরেক পর্ব দিয়ে দিয়েছি।আজও সবাই সুন্দর সুন্দর মন্তব্য করবেন।