মন দিতে চাই পর্ব -১২

#মন_দিতে_চাই
#১২তম_পর্ব
#লেখনীতে_সুপ্রিয়া_চক্রবর্তী

মুক্তো যখন আমাকে বলল আমার পরিবারের সদস্যদের খুঁজে পাওয়া গেছে তখন আমার মনটা বিষন্নতার কালো অন্ধকারে নিমজ্জিত হলো। হয়তো আমার খুশি হওয়ার কথা ছিল কিন্তু আমি খুশি হতে পারলাম না। মুক্তোকে ছেড়ে যেতে হবে এই চরম সত্যটা মেনে নেওয়া সম্ভব নয়।

কিছুক্ষণের মধ্যেই মুক্তো দুজন ব্যক্তিকে নিয়ে ভেতরে চলে আসলেন। একজন মধ্যবয়সী লোক আরেকজন মহিলা। দুজনে আমাকে দেখে কাঁদছিল। মহিলাটি এগিয়ে এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে লাগল, কোথায় ছিলি তুই মা? জানিস আমরা তোকে কত খুঁজেছি। আল্লাহর কাছে কত চেয়েছি যেন তোকে খুঁজে পাওয়া যায়। আল্লাহর রহমতে তোকে পেয়েও গেলাম মিনা।

আমাকে ভদ্রমহিলা মিনা বলে ডাকায় আমি বেশ অবাক হলাম। ওনার থেকে দূরে সরে এসে বললাম, কে আপনি? আমাকে মিনা বলে ডাকছেন কেন? আমার নাম কি মিনা?

মধ্যবয়সী লোকটি বলল, হ্যাঁ তুই তো আমাদের মেয়ে মিনা। তোর কি কিছুই মনে নেই? শহরে কাম করতে আইসা কি যে ভেজাল করলি। এখন আমাদের মনেও নাই তোর।

আমি মুক্তোর পানে চাহিলাম। খুব নির্লিপ্তভাবে আমার পানে তাকিয়ে ছিলেন। আমি বললাম, ওনারা কি সত্য বলছেন?

মুক্তো বলল, হ্যাঁ ওনাদের কাছে তোমার বার্থ সার্টিফিকেট এবং ওনাদের সাথে ফ্যামিলি এলবামও দেখেছি। এসব দেখে আমি নিশ্চিত হয়েছি তুমি ওনাদের মেয়ে। এছাড়া ওনাদের কাছে তোমার ভোটার কার্ডও ছিল।

সব শুনে আমি আর কিছু বললাম না। মুক্তো যখন বলছেন তার মানে ওনারা হয়তো ঠিকই বলছেন। আমি তাই চুপ করে রইলাম। মুক্তো আমাকে ওনাদের সামনে নিয়ে বলল, আপনাকে আমি আপনার পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিলাম। আমার কারণেই আপনাকে নিজের সবকিছু হারাতে হয়েছিল। অবশেষে আমিই ফিরিয়ে দিলাম।

আমার বাবা বলে নিজেকে পরিচয় দেওয়া ব্যক্তিটি বলল, আমরা নিজে দের মেয়ে কে ফিরে পেয়েছি সেটাই অনেক। আমাদের আর কিছুই চাই না। তাই তো আমরা এখন আমাদের মেয়েকে নিয়ে যেতে চাই আমাদের সাথে।

মুক্তো বলল, আপনারা নিজেদের মেয়েকে নিয়ে যেতে পারেন। তবে আজ আপনারা এখানে একটু থাকুন। আপনাদের আতিথেয়তার সুযোগ দিন। দুপুরে নাহয় আমার ড্রাইভার আপনাদের পৌঁছে দিয়ে আসবে।

কেউ আর অমত করল না। সবাই রাজি থাকায় কোন বাধা ছাড়াই আমি পেয়ে গেলাম আরো কিছুক্ষণ মুক্তোর সাথে থাকার সুযোগ। আমি ঘরে এলাম। সাথে আমার মা-বাবা বলে পরিচয় দেওয়া দুজনও এলো। তারা আমায় বলল জরুরি কিছু নেওয়ার থাকলে নিতে পারি। কিন্তু আমি নিলাম না। এখানে কোন কিছুই তো আমার নয়৷ সব মুক্তোর দেওয়া। মানুষটাকেই যখন পাবো না। তখন এসব নিয়ে মিছে মায়া বাড়িয়ে লাভ কি? তাই আমি চুপটি করে বসে পড়লাম বিছানার মধ্যে। মুক্তোকে ছেড়ে যেতে চাই না আমি। কিন্তু ভাগ্যের কাছে যে আমি অসহায়। আমি বুঝতে পারছি আমাকে সবকিছু ছেড়ে যেতে হবে। একবার এখান থেকে গেলে হয়তো আর কখনো মুক্তোকে দেখতেও পাবো না। তাই নিজেকে মনস্থির করে নিলাম যে আমি হাল ছাড়বো না। শেষবার যখন সুযোগ আছে তখন মুক্তোকে জানাবো যে আমি তাকে নিজের মনে স্থান দিয়ে ফেলেছি। কারণ আমি চাই না জীবনে কোন আফসোস নিয়ে থাকতে।

আমি চলে এলাম নিচে। প্রথমে রহিমা খালার সাথে কথা বললাম। উনি খুব হা হুতাশ করছিলেন। এই কয়দিনেই আমাকে নিজের মেয়ের যায়গা দিয়েছিলেন উনি। তাই আমাকে হারানোর ব্যাপারে উনি খুব কষ্টে আছেন। আমি চলে যাবো এটা ভেবে ওনার কষ্ট হচ্ছিলো। আমি রহিমা খালার গলা জড়িয়ে অনেক কাঁদলাম। উনিও কাঁদলেন। আমাদের দেখে মনে হচ্ছিল যেন আমরা অনেকদিনের পরিচিত। কিন্তু আসলে সেটা নয়। আমাদের মাঝে পরিচয় কম দিনের হলেও আমাদের মাঝে মায়া নামক জিনিসটা আছে।

মায়া এমন একটা জিনিস যেটা কম দিনের মধ্যেও হতে পারে। আর এই অদৃশ্য মায়াই আমাদের কষ্ট দিচ্ছে। আমি এরপর গেলাম মুক্তোর কক্ষে। তিনি কম্পিউটারে কাজ করছিলাম। আমাকে ভাগিয়ে দিয়ে যেন খুব খুশি হবেন। তাকে একটুও দুখী লাগছিল না। আমার খুব রাগ হলো তার উপর। আমি সোজা গিয়ে দাঁড়ালাম ওনার সামনে। ওনার কাছে গিয়ে বললাম, আপনি কি আমাকে মিস করবেন?

আমার প্রশ্ন শুনে থমকালেন উনি। আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন। কিছু না বলায় আমি রেগে গিয়ে বললাম, চুপ করে আছেন কেন? এটার কি দরকার। কিছু তো বলুন।

আমি কি বলব। তোমাকে মিস করার কোন কারণ কি আছে।

আমায় খুব কষ্ট দিল তার কথা। মানুষ তো একটা কুকু*রের জন্যেও মায়া দেখায়। সেখানে এই লোক আমার মতো একজন মানুষের প্রতিও মায়া নেই বলছেন। আর আমি কিনা এতটাই বোকা যে এনাকে ভালোবেসেছি। নিজের উপর রাগ হলো প্রচুর। এত বোকা কেন হলাম আমি? এমন একজনকে নিজের মন দিতে চাইলাম যার মনে আমার জন্য কোন অনুভূতি নেই। এই মুহুর্তে ঐ ঝিনুক নামের মেয়েটার প্রতি হিংসা হলো আমার। মেয়েটা না চাইতেই মুক্তোর ভালোবাসা পেয়ে গেছে। যা হয়তো আমি চেয়েও পাবো না।

এই কারণেই আমি কিছু না বলে চুপচাপ বেড়িয়ে এলাম রুম থেকে। বিদায়ের সময় ঘনিয়ে এলো। আমাকে আজ এই বাড়ি থেকে এই ঘর থেকে চিরবিদায় নিতে হবে। যেখানে আমি ছিলাম দুইদিনের অতিথি। যাওয়ার আগে শেষবারের মতো মুক্তোর দিকে তাকিয়েছিলাম। মুক্তো আমাকে বলল, ভালো থাকবেন।

ব্যাস এটুকই। তারপর আর কিছু কথা এগোয় নি। আমি চলে এসেছি নিজের৷ বাবা মায়ের সাথে। তারা কেন জানি মুক্তোর গাড়ি নিল না। একটা অন্য গাড়িতে আমায় তুলল। আমার একটুখানি সন্দেহ হলো। কিন্তু এই ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলে আমার বাবা বলল এখানে আমাদের কোন এক আত্মীয় আছে। তাদের কাছেই যাব আমরা। তাই আমি এ বিষয়ে আর কথা বাড়ানোর প্রয়োজন মনে করলাম না। আমি নিজের ভাবনার জগতে ডুবে ছিলাম। মন ভালো নেই আমার।

সারা রাস্তায় আমি বিষন্ন ছিলাম। গাড়ির রেডিও যেন আমার বিষন্নতার কথা বুঝলো। তাই তো বেজে উঠল,
“কেন রোদের মতো হাসলে না
আমায় ভালোবাসলে না,
আমার কাছে দিন ফুরালেও আসলে না।
এই মন কেমনের জন্মদিন
চুপ করে থাকা কঠিন
তোমার কাছে খরস্রোতা ও গতিহীন
নতুন সকাল গুলো কপাল ছুলো তোমারই।
দূরে গেলেও এটা সত্যি তুমি আমারই শুধু আমারই”

গান শুনতে গিয়ে কখন যে চোখে জল চলে এসেছে সেটা টের টিও পাই নি। আমি নিজের সব ধ্যান জ্ঞান যে মুক্তো নামক পাষাণ ব্যক্তিটাকেই দিয়েছি। যে আমার মনের কথা বুঝল না।

একটু পর গাড়ি এসে থামলো একটা অদ্ভুত স্থানে। দেখে মনে হচ্ছে কোন পরিত্যক্ত স্থান। আমি আর চুপ থাকতে পারলাম না। আমি প্রশ্ন করলাম, এটা কোন যায়গা? আপনারা তো বলেছিলেন আমরা আমাদের কোন আত্মীয়ের বাড়িতে যাব। তাহলে এখানে কেন আনলেন?

নিজেকে আমার মা পরিচয় দেওয়া মহিলা বলল, একদম বেশি কথা বলবি না। চিড়িয়া যখন জালে এসে গেছিস তখন আমাদের কথা শুনে চল। আমরা তোর মা-বাবা টাবা কিছু নই। আমরা তো জালিয়াতি করেছি। এখন তোকে বিক্রি করে দেব। এটাই তো আমাদের কাজ।

আমি বুঝলাম অনেক বড় বিপদে ফেঁসে গেছি। পালিয়ে যাওয়ার বৃথা চেষ্টা করলাম আমি। কিন্তু তার আগেই আমার মুখের সামনে কিছু একটা ধরলেন ওনারা। আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন। কিছুই আর মনে নেই আমার। যে কি হয়েছিল পরে।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here