#মন_পাথরে_হঠাৎ_ঝড়
#পর্ব_১৯
Tahrim Muntahana
সকাল গড়িয়ে দুপুর হওয়ার উপক্রম। সবাই হৃদানদের বাড়িতেই আছে। ড্রয়িং রুমে বসে আছে সবাই। কেউ কথা বলছে না। নিরাবতা পালন করছে। কিন্তু চার কুপোতকুপোতি নিজেদের মধ্যে চোখে চোখে কথা বলেই যাচ্ছে। চার জুটির মতিগতি লক্ষ্য করছে স্বয়ং পান্চু। তার মনে বহুত দুঃখ। মুখটা হুতুম পেঁচার মতো করে রেখে একবার এদিক তাকাচ্ছে তো আরেকবার ওদিক তাকাচ্ছে। বেশী চোখ যাচ্ছে তার বসের দিকে। একবার ঠোঁট চোখা করছে তো আরেকবার চোখ মারছে। আদর ও তো কম যায় না। সেও পাল্টা জবাবে কখনো চোখ মারছে অনবরত আবার কখনো তার বসের থেকে দ্বিগুন হারে ঠোঁট চোখা করছে। এসব দেখে টাক্কুর হাত তার টাক মাথায় এমনিই চলে যাচ্ছে। আফসোস ও তার তিনগুন হয়ে যাচ্ছে। আর ওই মেয়েটার দেখা পাইনি সে। এরপর একবার দেখা পাইলে সোজা কাজি অফিস চলে যাবে। আর কোনো ছাড় নেই।
পান্চুর এমন প্রেম প্রেম পরিবেশ ভালো লাগছে না। সে সিঙ্গেল থেকে দুঃখ পাবে আর তার বস মজা নিবে তা তো হয়না। দাড়া তোদের প্রেমে হাত ঢুকাচ্ছি। মনে মনে প্ল্যান করে সামনে এগোনোর আগেই থেমে গেলো। ভয় লাগছে। তার বস মানুষটা ভালা না। যদি ধুম করে কিল বসিয়ে দেয় টাক মাথায়!
নাহ পান্চু না। তোর যেতেই হবে। এটা তোর মতো ঝুলে থাকা সিঙ্গেলদের সংগ্রাম। মনে মনে বলে আস্তে করে এগিয়ে গেলো পান্চু। হৃদানের থেকে দুরুত্ব বজায় রেখে ভদ্রতার সহিত বলে উঠলো,
বস আর্জেন্ট দরকার ছিলো। আজকে মিটিং আছে সেই বিষয়ে।
হৃদান বিরক্ত হলো। শান্তিতে প্রেম ও করতে পারবে না নাকি। এই বিজনেস চুলোই যাক। কিন্তু ডিলটা খুব ইমপরটেন্ট ছিলো। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আজকে নিতে হবে। তাই অগত্যা উঠে হাটা ধরলো নিজের রুমে। পান্চু নিজেকে বাহুবা দিয়ে হৃদানের পিছু নিবে পাশ ফিরে দেখতে পেলো পিয়াস-রোহানি দুজনে বেশ গল্প করছে। হাসতে হাসতে একজনের উপর আরেকজন ঢুলে পড়ছে। তোদের হাসাহাসি করাচ্ছি দাড়া। ভেবেই পিয়াসের একদম কাছে গিয়ে বলে উঠলো,
বস ডাকছে স্যার চলুন।
পিয়াসের রাগ হলো। হাটুর উপরে রাখা ছোট বালিশ টা খামচে ধরলো। মনে হচ্ছে হৃদান কে চিবিয়ে খেতে পারলে শান্তি লাগতো। শালা নিজে প্রেম করবে অথচ তার প্রেমে বাঁধা দিবে। পান্চু তাড়া দিতেই অগত্যা তাকে উঠতে হলো। রোহানির মুখটাও মলিন হয়ে গেলো। আহা সময়টা কত ভালো যাচ্চিলো। এই জিজুটা যে কি করেনা। সবসময় কাজ আর কাজ। বিয়ের দিন শোধ তুলবে সে। ভেবেই মনে মনে হেসে মাথা ঝাঁকালো। যেন এখনি সে হৃদানের উপর শোধ নিয়ে নিয়েছে। পান্চু খুশি মনে উপরে চলে গেলো। আহা এখন কর প্রেম। কিছু সিড়ি ভেঙে নিচের দিকে তাকাতেই দেখলো আতইয়াব তারিমের হাত ধরে বসে আছে। মুখে হাসি টেনে আস্তে আস্তে কিসব বলছে আর তারিম লাল নীল হলুদ সবুজ বেগুনি হয়ে যাচ্ছে। তার পাশেই সোফায় ফালাহ-সুবাহ কিছুক্ষণ কথা বলছে তো কিছুক্ষণ এটা ওটা নিয়ে খুনসুটি ময় ঝগড়া করছে। টাকলা মাথাটাই হাত বুলালো পান্চু। নাহ এদের কেও ছাড় দেওয়া যাচ্ছে না। শাস্তি এদের কেউ পেতে হবে। ঝটপট নিচে নেমে এসে তারিমের সামনে মাথা নিচু করে দাড়ালো। আতইয়াব তখনো তারিমের হাত ধরে আছে। পান্চুর মনে হচ্ছে দিলটা ফেটে যাবে। মনে মনে আতইয়াব কে নির্লজ্জ বলেও ক্ষান্ত হলো না। তারিম কে উদ্দেশ্য করে বলল,
তারুআপু বস কফি দিতে বলল।
তারিম জোর করে আতইয়াবের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো। বসা থেকে উঠে বলে উঠলো,
আচ্ছা তুমি যাও পান্চুভাইয়া আমি বানিয়ে দিচ্ছি। সবার জন্য চা ও করতে হবে।
এই বলে হাটা ধরলো তারিম। আতইয়াব মুখটা পাংসুটে করে হিমেলের সাথে কথা বলতে লাগলো। হিমেল এতক্ষণ ফোন টিপছিলো। অন্যকিছু দেখার সময় নেই তার। পান্চু এবার সুবাহ’র দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
সুবু আপু তারুআপু কে সাহায্য করো একটু। একা একা কাজ করছে!
চমকে উঠলো ফালাহ-সুবাহ। এতক্ষণ নিজেদের প্রেমালাপে ব্যস্ত ছিলো। হুট করে দাড়িয়ে গেলো সুবাহ। লজ্জা পেয়েছে একটু। রান্না ঘরের দিকে ছুটলো। ফালাহ নিজের অবস্থান থেকে উঠে আতইয়াবের পাশে বসে আলাপ করতে লাগলো। পান্চু একগাল হাসলো। আহ এখন শান্তি লাগছে। আদর লক্ষ্য করছিলো পান্চুকে। পান্চু আদরের দিকে তাকিয়ে টাক মাথায় হাত দিয়ে ভ্রু নাচালো। আদর খিলখিল করে হেসে দিলো। সে সবটাই বুঝতে পেরেছ। তার এত হাসি পাচ্ছে যে বলার বাহিরে।
উপরে পান্চুর জন্য অপেক্ষা করছে হৃদান পিয়াস। সেই কাজের কথা বললো অথচ তার ই আসার নাম নেই। পান্চু আসতেই হৃদান ভাবলো একটা ঝারি দিবে পরে ভাবলো থাক আজ ঝারি দিয়ে কাজ নেই। বিশেষ একটা দিন আজ। পান্চু এসে আগের দিনের কাজ গুলোই বারবার রিপিট করছে দেখে হৃদান ভ্রু কুচকালো। পান্চু ভয় পেলো। আস্তে আস্তে সরে এসে দরজার কাছে দাড়িয়ে বলে উঠলো,
আপনাদের প্রেম দেখে আমার মতো ঝুলে থাকা সিঙ্গেলদের বুঝি কষ্ট হয়না। আজকে আর পাবেন না আমাকে!
লে দৌড়। হৃদান এবার বুঝতে পারলো পান্চুর কাজ কি। রাগ হলো না বরং প্রচন্ড হাসি পেলো তার। লাইক সিরিয়াসলি পান্চুর ও প্রেম করার শখ জেগেছে। দুজনে হাসলো। হেসে নিচে চলে গেলো। এসে দেখলো পান্চু নেই। বাড়ির বাইরে চলে গেছে ভয়ে। আরেকদফা হাসাহাসি করে নিলো সবাই।
আড্ডার মাঝেই উপস্থিত হলো রিয়া। এসেই হিমেল কে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে দিলো। মানুষটাকে কতদিন ধরে দেখে না। হিমেল আগলে নিলো নিজের প্রেয়সীকে। বাবা তার পেছনে লোক লাগিয়ে দিয়েছিলো তাই তো চাইলেও রিয়ার কাছে যেতে পারতো না সে। সবাই ভাবলো ওদের একটু সময় দেওয়া দরকার। কিন্তু হিমেল বাঁধা দিলো। তার হাতে সময় খুব কম। হিয়ান খান জানতে পারলে সমস্যা হয়ে যাবে। আদর নিজেই রিয়ার কাছে আসলো। রিয়া প্রথমে দেখেই চিনতে পারেনি। পরে খেয়াল করতেই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। আদর মাথা নেড়ে সায় দিতেই রিয়া আদরের হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নিলো। আদর মুচকি হাসলো। রিয়া বিচলিত হয়ে বলে উঠলো,
আমার ডায়েরী! ডায়েরীটা যত্নে রেখেছো তো।
আদর মাথা নাড়ালো। রিয়াকে নিয়ে সোফায় বসলো। হৃদান তারিমের দিকে ইশারা করে বলল,
তোমার ফুফাতো ভাই-বোন। হৃদান চৌধুরী ও হৃদযা চৌধুরী।
রিয়া অবাক হয়ে তাকালো ওদের দিকে। ওর যেন বিশ্বাস ই হচ্ছে না। তারিম এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরে রিয়ার পাশে বসলো। আদর আবার বলল,
তোমার রিদিমা ফুফুর ছেলে মেয়ে এই দুজন। আর তোমার ডায়েরী ঠিক আছে। এমন কি তোমার বাবাও বেঁচে আছে।
রিয়া আকস্মিক দাড়িয়ে গেলো। তার মাথা ঘুরছে। কি বলছে এসব। তার বাবা বেঁচে আছে। তারিম আবার বসিয়ে দিলো রিয়াকে। সবটা জানালো। রিয়া থম মেরে বসে রইলো কিছুক্ষণ। কান্নারা যেন উপচে পড়তে চাইছে। হিমেল মাথা নিচু করে বসে আছে। কেন জানি নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে তার। রিয়া বলে উঠলো,
আমাকে আমার বাড়িতে যেতে হবে হিমু। ওখানেই আছে এসবের পেছনের কারণ। কেন এতগুলো মানুষ কে হত্যা, বাবা কে আটক সব রহস্য ওই বাড়িতেই। আমি ডায়েরীর মধ্যের এক পাতা ছিড়ে ফেলেছিলাম। সেখানেই বাবা স্পষ্ট করে লিখে গেছে সব প্রমাণ, কারণ তার ঘরের সিক্রেট রুমে আছে। যেতে হবে আমাকে। হিমু নিয়ে চলো আমাকে।
রিয়া হিমেলের দিকে আকুতি ভরা নয়নে তাকিয়ে আছে। হিমেল উঠে দাড়ালো। হৃদান সামনে এসে বলল,
শুধু তোমরা না আমরাও যাবো। আমাদের ও সব রহস্য জানতে হবে। কেন আমার বাবাকে খুন করা হলো জানতে হবে!
আর কথা বাড়ালো না কেউ। দুটো গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। এখান থেকে অনেকটা পথ যেতে হবে। গাড়িতে কেউ কারো সাথে কথা বললো না। সবারই মনের মধ্যে উৎকণ্ঠা কাজ করছে। আজকেই কি রহস্য সব খোলাসা হবে নাকি আবার রহস্যের সন্ধান পাবে। যেতে যেতে প্রায় সন্ধ্যা লেগে গেছে। চারদিকে কেবল অন্ধকার হতে শুরু করেছে। ভালোই হলো। রাতের আঁধারে কেউ টের পাবে না। হৃদান সাথে গার্ড নিয়ে এসেছে। পুরো এরিয়াটা ঘেরাও করা। কোনো রিস্ক সে নিতে চায়না। চৌধুরী বাড়িটা এখনো মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে আছে। গেটের সামনে দুজন প্রহরী। সরকার কর্তৃক তাদের নিয়োগ করা হয়েছে। আহনাফ চৌধুরী একজন সৎ কমিশনার ছিলেন এইটুকু সার্ভিস তার পাওয়া উচিত। দুজন গার্ড এতো মানুষ দেখে এগিয়ে আসলো। ভেতর থেকে বেরিয়ে আসলো একজন বৃদ্ধ লোক। হৃদান ততক্ষণে গার্ড দ্বারা প্রহরী দুজনকে সরিয়ে দিয়েছে। বৃদ্ধ লোকটাকে দেখে দৌড়ে এগিয়ে গেলো রিয়া। চোখ থেকে টপটপ পানি পড়ছে। লোকটি বয়সের ভাড়ে খানিকটা নুইয়ে গেছে। পাওয়ারের চশমা টা হাত দিয়ে ঠিক করে রিয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। মুখটা কেমন চেনাচেনা লাগছে। মনে করতে পারছে না। বয়স হয়েছে; চোখে ছাউনি পড়েছে ; ওতসব কি মনে থাকে। রিয়া আবেগে উৎফুল্ল হয়ে বলে উঠলো,
মিও দাদু!
চমকে উঠলো বৃদ্ধটি। কে ডাকছে এই নামে? অনেকদিন পর এই ডাকটা শুনলো সে। কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছে তার। অনেকদিন হলো মুখে হাসি নেই তার। লাঠিতে ভর করে বিচলিত কন্ঠে বলে উঠলো,
কে ডাকলা, এই নামে কে ডাকলা এহন?
মিও দাদু আমি রিয়া। চিনতে পারছো আমাকে। আমি তোমার সেই ছোট বিড়াল ছানাটা!
লাঠির ভরটা ছেড়ে দিলেন বৃদ্ধটি। রিয়া খপ করে ধরে নিলো তাকে। সবাই অবাক হয়ে দেখছে। বৃদ্ধটি তাড়াতাড়ি ভেতরে চলে গেলো। রিয়াও ছুটলো তার পেছনে। মানুষটা বড্ড শকড পেয়েছে এই বয়সে। হৃদান রাও গেলো। সবকিছু শুনতে হবে।
রিয়া সরাসরি নিজের ঘরে ঢুকে পড়লো। এই বাড়ির প্রত্যেকটা কোণা তার চেনা। এই বাড়িই তার জগত ছিলো যে। বৃদ্ধটি একটা ছবি ফ্রেম আগলে রেখে নিচে বসে আছে। ঘরটা একদম ঝকঝক করছে। মনে হচ্ছে না এখানে কেউ থাকেনা। এতবড় বিছানা থাকা সত্ত্বেও বৃদ্ধটি নিচে বিছানা করে ঘুমাই। রিয়া বৃদ্ধটির পাশে বসে পড়লো। বৃদ্ধটির চোখে পানি। হয়তো পুরোনো কথা মনে পড়েছে। রিয়া শুনতে পেলো বৃদ্ধটি আধো আধো ভাঙা গলায় বলে চলছে,
আমার ছোড বিলাই ছানা একদিন আসবো। আসবো দেইখাই তো বাঁইচা আছি এহনো। না হইলে কবেই মইরা যাইতাম।
রিয়া আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না। বৃদ্ধকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। একটা মানুষ কতটা ভালোবাসলে এতটা বছর অপেক্ষা করতে পারে। বৃদ্ধটির হাত থেকে ছবিটা শক্ত তোশকটিতে পড়ে গেলো। আশ্চর্য হয়ে বুঝতে লাগলো ব্যাপারটা। হিমেল গিয়ে রিয়াকে সামাল দিলো। বৃদ্ধটি এত মানুষ দেখে আবার নিজেকে কঠোর করে নিলো। রিয়া বলল,
মিও দাদু আমিই তোমার ছোট বিড়াল ছানা। মনে আছে কত খেলতাম তোমার সাথে। আমার সবটা সময় তো কেটেছেই তোমার সাথে। আমাকে বাবা-মার মতো আগলে রেখেছিলে।
বৃদ্ধটি আলতো করে রিয়ার মুখটা ছুয়ে দিলো। দাঁত ছাড়া মুখটাতে হাসি ফুটে উঠলো। চোখের কোণে পানি এখনো চিকচিক করছে। এই বৃদ্ধটি আগে আহনাফ চৌধুরীর বাড়িতে কাজ করতো। মূলত গ্রাম থেকে রিয়ার দেখাশুনার জন্যই তাকে এনেছিলো আহনাফ চৌধুরী। এরপর থেকেই তিনি সবটা সময় ব্যয় করতো রিয়ার দেখাভালের পেছনে। খাওয়া থেকে ঘুমানো গোসল করানো সবটা সে খেয়াল রাখতো। রিয়ার জগতে মা-বাবা ও এই বৃদ্ধটাই ছিলো। ভালোবেসে মিও দাদু বলতো; আর বৃদ্ধটি বিলাই ছানা বলতো।
পরিবেশ এখন শান্ত। বৃদ্ধটি চোখ মুখ বিষণ্ন করে বলতে লাগলো,
হেইদিন সাহেব আমারে জোর কইরা অন্য জায়গাই না পাঠাইলে ওমন হইতো না। আমার বিলাই ছানাকে হারাইতে হইতো না। সাহেব রেও না। এত বছর অপেক্ষা করছি বিলাই ছানার জন্যে। বাড়িডায় একডা মানুষ ও ঢুকতে দেই নাই।
কাঁদতে শুরু করলেন। একটা রাত কতকিছু কেড়ে নিয়েছে। রিয়া ওরা বুঝালো। বৃদ্ধটি ওদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করতে গেলো। কতবছর পর বৃদ্ধটির মুখে হাসি ফুটেছে। ওরা না করলো না। বাবার রুমে ঢুকে পড়লো রিয়া। দেয়াল গুলো ভালো করে চেক করে আলমারি টা সরাতে বললো হৃদান দের। তাই করলো। আলমারি সরাতেই রিয়া হাত দিয়ে দেয়ালে তিন-চারটা টোকা দিলো সাথে সাথে নিশব্দে দরজা টা খুলে গেলো। ভেতরে ঢুকে পড়লো সবাই। ঘরটিতে অস্ত্রের অভাব নেই। জং ধরে গেছে। রিয়া সোজা টেবিলের দিকে ছুটলো। ময়লার আস্তরণ পড়ে আছে। ডয়ারটা খুলতেই চোখে পড়লো কয়েকটা পেনড্রাইভ। হাতে তুলে নিলো। কয়েকটা দলিল। সম্পত্তির দলিল। স্পষ্ট লিখা আছে তার সব সম্পত্তির অর্ধেক তার মেয়ে আর অর্ধেক তার বোন রিদিমা চৌধুরী। যা পাবে তার ছেলে মেয়ে। রিয়া হৃদানের হাতে দলিলটা দিলো। হৃদান দেখলো না রেখে দিলো। তার এসবে ইন্টারেস্ট নেই। তার কি কম আছে!
সারাঘর খুঁজলো। আর কিছু পেলো না। বের হয়ে আসলো ঘর থেকে। রাত দশটাই সবাই খেতে বসলো। নিজ হাতে রিয়াকে বেড়ে দিচ্ছে বৃদ্ধটি। রিয়া মায়াভরা চোখে দেখছে সবটা। খাওয়া দাওয়া শেষে চলে আসার প্রস্তুতি নিতেই বৃদ্ধটি মন খারাপ করলো। রিয়া বলল,
আমি একা যাচ্ছি না। তুমি যাবে আমার সাথে। একসাথে থাকবো। চিন্তা নেই তোমার সাহেব ও ফিরে আসবে। আবার প্রাণ ফিরে পাবে চৌধুরী বাড়ি।
বৃদ্ধটি ফোকলা দাঁতে হাসলো। তার মহা আনন্দ হচ্ছে। বেরিয়ে পড়লো সবাই। বাড়ি ফিরে পেনড্রাইভে কি আছে দেখতে হবে। কাল থেকেই তাদের আহনাফ চৌধুরীকে খুঁজার মিশন শুরু হবে।
আদ ও কি সে বেঁচে আছে?
#মন_পাথরে_হঠাৎ_ঝড়
#পর্ব_২০
Tahrim Muntahana
গভীর রাত। ঝলমলে শহর টা জনমানবহীন নিস্তব্ধ হয়ে আছে। দূর থেকে ভেসে আসছে কুকুর ঘেউ ঘেউ ডাক সাথে দু’একটা গাড়ির হালকা শব্দ। সবাই গভীর ঘুমে মগ্ন। আচ্ছা সবাই কি এই রাত কে আপন করে ঘুমে মগ্ন হতে পারে? প্রশ্নটা সহজ হলেও উত্তর জটিল। সবার মনোভাব, ভাবমূর্তি তো জানা হয়ে উঠে না। কেউ হয়তো এই গভীর রাতে কাউকে ভেবে চোখের পানি ফেলছে, কেউ হয়তো প্রিয়জনের সাথে প্রেমালাপে ব্যস্ত, কেউ হয়তো নিস্তব্ধ রাতের কোলাহলমুক্ত রাতে কারো অপেক্ষার প্রহর গুনছে, কেউ কেউ আবার নিঃসঙ্গতা কাটাতে ফোনটাকে সঙ্গী করে সামাজিক যোগাযোগ সাইটে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আবার কেউ কেউ হয়তো ভালোবাসার বেড়াজালে আটকে পড়ে ভালোবাসায় সিক্ত হচ্ছে; যার নিশ্বাসের শব্দ সারাঘরময় ঘুরে বেড়াচ্ছে। এক ভালোবাসাময় রাত। জীবন কত বিচিত্র ময়। কাউকে হাসায়; কাউকে কাঁদায়!
কিন্তু এই নিস্তব্ধ রাতে জনমানবহীন রাস্তায় ৫ টি গাড়ি সারিবদ্ধভাবে চলছে। গাড়ির ভেতর মানুষদের কারো চোখে নিদ্রা নামার প্রয়াস দেখা যাচ্ছে না। হয়তো উত্তেজনায় কারো চোখেই ঘুম ধরা দিচ্ছে না। রিয়ার হাতের মুঠোয় এখনো তিনটে পেনড্রাইভ। যার দিকে একধ্যানে তাকিয়ে আছে সে। হয়তো ভাবছে এর সাহায্যে তার জন্মদাতা কে খুঁজে পাবে কিনা!
হৃদানের কাঁধে মাথা রেখে রাতের নিস্তব্ধ পরিবেশটা উপভোগ করছে আদর। আজ যেন ঘুমরা ছুটে পালিয়েছে। হৃদান অপলক দেখছে তাকে। এ দেখার যেন শেষ না হয়। চোখে ফুটে উঠেছে নিদারুণ মুগ্ধতা। আদর একটু পর পর মাথা তুলে হৃদানের মুখশ্রী এবং চোখের চাহনী দেখে মুচকি হেসে মাথা নামিয়ে নিচ্ছে। কোন নারী চায় না তার ভালোবাসার মানুষটার চোখে শুধু তারজন্যই মুগ্ধতা ভরা থাকবে! একান্তই মানুষটি তার হবে। আদর ও ব্যতিক্রম নয়। ব্যতিক্রম একটাই সবাই পায়না কিন্তু আদর পেয়েছে। মানুষটিকে সে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতে পারে। যা সকল কিছুর ঊর্ধ্বে।
পেছনে তিনটা সিট দখল করে আতইয়াবের কোলে শুয়ে আছে তারিম। পরম যত্নে ধরে রেখেছে আতইয়াব। চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকলেও ঘুমাতে পারছে না তারিম। কারণ একটাই আতইয়াবের গভীর চাহনী। মুখের কাছে ঝুঁকে তাকিয়ে থাকলে ঘুম আসে? মেয়েদের সিক্স সেন্স একটু বেশীই প্রখর বলে কি! ধপ করে উঠে বসলো তারিম। মুখে বিরক্তির পাশাপাশি হালকা লজ্জাভাব। আতইয়াব ভ্রু কুচকালো। বউকেই তো দেখছে অন্যকোনো নারীকে দেখছে না তো! তারিম ফিসফিসিয়ে বলে উঠলো,
এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? অস্বস্তি হয়না আমার?
আমার বউকে দেখছি তোমার কি? অন্য মেয়েকে দেখলে তো জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যাবে! নাকি দেখবো?
আতইয়াবের কথায় ফুসে উঠলো তারিম। বলে কি এই ছেলে? অন্য মেয়েকে দেখবে মানে? লুচু হয়ে গেলো নাকি কয়েকদিন বউ ছাড়া থেকে। দ্বিগুন রেগে ধপ করে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়লো। হাত দিয়ে আতইয়াবের মাথাটা শক্ত করে ধরে নিজের দিকে ঘুরালো। চোখে চোখ পড়তেই আতইয়াব দিলো চোখ মেরে তারিম লাজুক লতার মতো নুইয়ে পড়লো। পরক্ষণেই অন্যমেয়ের কথা মনে হতেই বলে উঠলো,
চুপচাপ তাকিয়ে থাকুন। চোখের পলক ও যেন না পড়ে!
আতইয়াব হাসলো। নিঃশব্দে! বউ তার পাগলি! অন্যমেয়ের কথা শুনেই কেমন লজ্জা পালিয়ে গেলো। ভালোবাসা বুঝি এমনি!
সুবাহ-ফালাহ! সুবাহ নিজের ফোনে শাড়ি, লেহেঙ্গা, জুয়েলারি পিক সেইভ করে রেখেছে বিভিন্ন পেইজ থেকে। ওগুলোই ফালাহ কে দেখাচ্ছে আর বলছে সে এটা নিবে। পরের টা ভালো দেখে বলছে এটা নিবে। এইভাবে প্রায় ৩ টা ঘন্টায় ২০০+ পিক দেখিয়েছে ফালাহ কে। গবেষণাও করেছে কোনটা ভালো, কোনটা কিভাবে করলে বেশী ভালো হতো। ফালাহ নিশ্চুপ বিরক্তহীন ভাবে দেখে গেছে। গলাও মিলিয়েছে বউয়ের সাথে। যে শাড়ি জুয়েলারি দেখে বউয়ের চোখে মুগ্ধতা দেখেছে সেসব নিজ মাথায় সেট করে নিয়েছে। বিয়ের পর সেভাবে কখনো সারপ্রাইজ দেওয়া হয়নি। একটু চেষ্টা করলে কেমন হয়! হাসলো ফালাহ। মেয়েটি তেমন আবদার ও করে না। বায়না ধরেনা ঘুরতে যাওয়ার, ফুচকা খাওয়ার। সে নিজেই সময় বুঝে নিয়ে যায় তাও নিজের মায়ের কড়া হুকুমে। কোনো শাশুড়ি যে এমনও হয় ফালাহ’র মাকে না দেখলে ফালাহ বুঝতেই পারতো না। সে তো বিয়ের দিন ভয়ে ছিলো মা কিভাবে নিবে ব্যাপারটা। কিন্তু সুবাহ কে যখন বুকে টেনে নিলো ফালাহ চিন্তামুক্ত হয়েছিলো। সুবাহ’র হাতের ধাক্কায় ভাবনা থেকে বের হলো ফালাহ। আবার মনোযোগ দিলো বউয়ের কথায়!
পিয়াস-রোহানি হাত ধরে বসে আছে। রোহানির থেকে মনে হচ্ছে পিয়াস বেশী লজ্জা পাচ্ছে। রোহানি তো মনে মনে হেসে খুন হয়ে যাচ্ছে। তার লাজুক লতা বপ্পেন!
হিমেলের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে বৃদ্ধটি। বয়স হয়েছে ; বেশী রাত জাগতে পারে নাকি! বৃদ্ধটি যখন ঘুমে এদিক ওদিক ঢুলে পড়ছিলো হিমেল যত্ন নিয়ে নিজের কাঁধটা পেতে দেয়। নিচু হয়ে বসে ; যদিও তার কষ্ট হচ্ছিলো কিন্তু ভালোবাসার মানুষটাকে যে এতবছর লালন-পালন করেছে, এতবছর অপেক্ষায় প্রহর গুনেছে সে তো তার কাছে স্পেশাল হবেই। রিয়া একপলক দেখে। মুগ্ধ হয়! মাঝে মাঝে ভাবে হিমেল কেন পরিবারের আর সবার মতো হলো না! নিজের বাবার মতো হলো না। বাড়ির সবার থেকে আলাদা হয়েও মানুষটাকে ওদের মতোই থাকতে হচ্ছে শুধুমাত্র তার জন্য! কিছুটা দিন যাক ভালোবাসা দিয়ে সব কষ্ট পুষিয়ে দিবে!
রাত ২ টার মতো বেজে গেলো হৃদান দের বাড়ি আসতে। গেটের কাছে আসতেই পান্চু দৌড়ে এসে গেইট খুলে দিলো। মুখটা মলিন গম্ভীর করে রেখেছে। তার অভিমান হয়েছে কেন তাকে নিয়ে যাওয়া হলো না। সে ভয় পেয়ে বাইরে ছিলো ঠিকই ; বেশী দূরে তো ছিলো না। এতদিনের চাকরি জীবনে বস তাকে ছাড়া কোনো মিশনেই যায়নি। আঠার মতো লেগে থাকতো বসের সাথে আজ বস তাকে ভুলে গেলো! একাই চলে গেলো! বউ পেয়ে তাকে ভুলে গেলো! হাম সে ও কম না একবার বিয়ে হোক তার, সে ও বসকে ভুলে যাবে! সারাক্ষণ বউয়ের সাথে লেগে থাকবে! শোধ নিবে সে!
আদর পান্চুকে দেখেই একগাল হাসলো। পান্চু রেসপন্স করলো না। আদর ভ্রু কুচকালো। পান্চু তো তাকে দেখেই খুশিতে গদগদ থাকে, আজ কি হয়েছে? পান্চু গেইট খুলে বৃদ্ধকে নিয়ে ভেতরে চলে গেছে। আদর কথাও বলতে পারলো না। হালকা মন খারাপ হলো তার। ভাবুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো পান্চুর যাওয়ার দিকে। হৃদান তাড়া দিতেই সবাই ভেতরে চলে গেলো; আদর আর ভাবার সময় পেলো না!
আজ সবাই এখানেই থাকবে। এতরাতে হৃদান-তারিম কিছুতেই কাউকে যেতে দিবে না। যদিও আতইয়াব চাইছিলো না ; আদরের কষ্ট হবে ভেবে থেকে গেল। একদিনে এত দখল নিতে পারবে না। সবাই ভেতরে গিয়েই সোফায় বসে পড়লো। শরীর যেন চলে না! কফি বা চা হলে ভালো হতো। হৃদানের কথাটা মন হতেই সারভেন্টকে বলবে ; তার আগেই পান্চু কফি চা নিয়ে হাজির হলো। হৃদান হাসলো। এই পান্চুর সবদিকে খেয়াল থাকে। কফি, চা পেয়ে সবার মন খানিকটা ফ্রেশ হলো। পান্চু তখনো মুখটা গম্ভীর করে রেখেছে। আদর ডেকে উঠলো,
আধা টাকু পান্চু কাকু কি হয়েছে তোমার?
পান্চু চমকালো। আদর তাকে খেয়াল করেছে! পান্চু হাসার চেষ্টা করে বলে উঠলো,
কিছুই হয়নি ম্যাম!
সবাই ভ্রু কুচকে তাকালো। পান্চু ইতস্তত করে বলে উঠলো,
বস আমার ছুটি লাগবে ১০ দিনের!
হৃদান বিষ্ময়ে হতবাক। এই পযর্ন্ত পান্চু কোনো উৎসব ছাড়া ছুটি নেয়নি। এমন কি তার ভাইয়ের বিয়েতে তাকে নিয়ে গিয়ে আধাঘন্টার মতো থেকে চলে এসেছে। আজ কি এমন হলো ছুটি চাইছে। সিরিয়াস কিছু হলো না তো? চিন্তিত হয়ে হৃদান বলল,
ছুটি! পান্চু তুমি ঠিক আছো? কিছু হয়েছে? আন্টি-আংকেল ঠিক আছে?
বসের চিন্তিত ভঙ্গি দেখে পান্চুর মনে লাড্ডু ফুটতে লাগলো। আহা বস তাকে নিয়ে চিন্তিত মানে বস তাকেও ভালোবাসে। এই টুকু কথায় যেন পান্চু গলে একদম পানি হয়ে গেলো। হে হে করে হেসে বলে উঠলো,
বিয়ে করবো বস। ১০ দিন ছুটি দেন!
সবাই চোখ বড় বড় করে পান্চুর দিকে তাকালো। পান্চু ভড়কে গেলো। পরক্ষণেই তাকে না নিয়ে যাওয়ার কথা মনে হতেই পান্চু মলিন কন্ঠে বলে উঠলো,
বস ম্যাম কে পেয়ে আমাকে ভুলে গেছে। এই পযর্ন্ত কোনো মিশনেই আমাকে ছাড়া যায়নি অথচ আজ প্রেম করতে করতে চলে গেলো! মানে বস তার মেইন গার্ড পান্চুকে ভুলে গেছে বউ পেয়ে। তাই আমিও বিয়ে করবো। বিয়ে করে বউকে পেয়ে বস কে ভুলে যাবো। শোধবোধ! এটাই আমার প্রতিশোধ বসের বিরুদ্ধে!
শেষের কথাটা খানিক প্রতিবাদী কন্ঠে বলল পান্চু। যেন সে সংগ্রাম করতে এসেছে। হৃদান ভ্রু কুচকে পান্চুর দিকে তাকিয়ে আছে। আর সবাই হো হো করে হেসেই যাচ্ছে। হাসি যেন থামছেই না। এতক্ষণের মন খারাপ ভাবটা রিয়ার পান্চুর কথা শুনে কেটে গেছে। সেও মুখ চেপে হসছে। হিমেল ঠুস করে জড়িয়ে ধরলো পান্চুকে। পান্চু মেয়েদের মতো কাচুমাচু করে বলে উঠলো,
ছি ছি কি করছেন। আমাকে কি আপনার সন্দেহ হয়। আমি ওমন না। একটা মেয়েকে পছন্দ হয়েছে তাই দূরে সরে দাড়ান। আমার লজ্জা করে!
এবার আর রিয়া হাসি আটকাতে পারলো না। শব্দ করে হেসে উঠলো। আদর তো হাসি থামাতেই পারছে না। সোফায় বসে হাসির তালে কখনো পা নাড়াচ্ছে, কখনো হাত নাড়াচ্ছে, আবার কখনো হাত দিয়ে হৃদানের হাটুর উপর বারি দিচ্ছে; কারণ হৃদান তার পাশ ঘেসেই বসেছে। হৃদান তো আহম্মকের মতো আদরের আচরণ দেখছে। কেউ এভাবে হাসে। অন্যকেউ দেখলে তো নির্ঘাত পাগল বলবে! পান্চুর কথা হিমেল প্রথমে বুঝতে না পারলেও পরে যখন বুঝতে পারে, ছিটকে দূরে সরে আসে। এই ছেলে কি বলে! তার ইজ্জত মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছে। হিমেল ভ্রু কুচকে বলল,
হোপ ব্যাটা! তোমার কারণে রিয়ার মুখে হাসি ফুটেছে; কতদিন ওই হাসি মুখ দেখিনি তাই থ্যাংকস জানাতে জড়িয়ে ধরেছি। তুমি কি ভেবে বসলে!
পাশ থেকে আরেকজন গার্ড বলে উঠলো,
স্যার ওর কথা কিছু মনে করবেন না। ব্যাটা আস্ত পাগল! সেই বিকেল থেকে একা একাই কিসব বলে যাচ্ছে। সে বিয়ে করে বসকে দেখিয়ে দিবে। সেও প্রতিশোধ নিবে। বস তাকে ভুলে গেছে; সেও ভুলে যাবে আগে বিয়েটা করুক।
রাগে ফুসে উঠলো পান্চু! কিহ? তাকে পাগল বলা! সে পাগল! এই পান্চু কে পাগল বলা! গার্ডটির পিঠে কষিয়ে এক থাবা বসালো। গার্ডটি ব্যাথায় কুকড়ে উঠলো। পান্চু দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলো,
লাগাম টান মুখে। তোর সাহস কত বড় আমাকে পাগল বলিস। ব্যাটা তুই নিজেই তো একটা পাগল। তোর বস আমি ভুলে গেছিস। কাল সকাল টা আসতে দে কালকেই তোকে ছাটাই করবো। আমার বস হৃদান চৌধুরী ; তোদের বস পান্চু। মধ্যে পিয়াস স্যার হা-ডু-ডু!
কথাটা বলেই আর এক মুহূর্ত দেরী করে না পান্চু। এক দৌড়ে নিজের ঘরে চলে গেছে। সাথে গার্ডটাকেও নিয়ে গেছে। কয়েকটা না দিলে তার বসগিরী থাকবে না! পিয়াস হা-ডু-ডু কথাটা শুনলেই রাগ তার দ্বিগুন হয়ে যায়। খাবে না গিলবেই বলার বাহিরে। পাশে রোহানি আছে বলে পিয়াস পান্চুর কথাটা সহ্য করে নিলো। এই হা-ডু-ডু ডাকটা নিয়ে একটা দুঃখজনক ঘটনা আছে। ক্লাস সেভেনে থাকতে পিয়াসদের স্কুলের হা-ডু-ডু খেলায় অংশ নেয় সে। কিন্তু বিরোধী স্কুলের দলের মধ্যে তার পাশের বাসার মোটা কাইল্লা টা যে থাকবে সে একটুও টের পায়নি। সারাদিন ঝগড়া লেগেই থাকে ছেলেটার সাথে। কাইল্লাটা তো পিয়াস কে নিজের শক্তি দেখিয়ে যাচ্ছে আর শাসিয়ে যাচ্ছে। পিয়াস আর মাঠে যাওয়ার সাহস পায়নি, তার আগেই হিসু করে ক্লাস রুমেই প্যান্টের সাথে নিজের ইজ্জতের রফাদফা করিয়ে দিয়েছিলো। এরপর লজ্জায় ১০ দিন কেঁদেকেটে স্কুল পাল্টায়। এজন্যই হা-ডু-ডু শব্দটা সে শুনতে পারেনা। পান্চু ওই কাইল্লার কাছ থেকেই ঘটনাটা শুনেছিলো। সুযোগ পেলেই পিয়াস কে ক্ষেপায়! শোধ সে নিবে পান্চুর টাক মাথায় ঢোল বাজিয়ে!
হৃদান সে তো অবাক! প্রেমে পড়ে তার কি বুদ্ধিক্ষমতা লোপ পেয়েছে। আগের হৃদান থাকলে কেউ সাহস ই পেতো না তার সামনে কথা বলার আর আজ! কি দিন আসলো! মনক্ষুণ্ন হলো সে। মুটেও উচিত হয়নি এমন পাগল হওয়ার। ভাই প্রেম করবি ঠিকাছে তাই বলে পাগলদের খাতায় নাম দিবি যে তোর গার্ডরাও ভয় পাবে না তোকে! কাল থেকে ভয় পাওয়াতে হবে! না হলে তো হৃদান চৌধুরী বলে যে একজন ছিলো ভুলেই যাবে সবাই!
রিয়ার কথায় হাসাহাসি থামিয়ে সিরিয়াস হলো সবাই। পেনড্রাইভ দেখার কথা বলছে রিয়া। সবাই তাই ভাবলো। হাসি মজা করতে করতে কখন তিনটা বেজে গেজে টের ই পায়নি কেউ। ড্রয়িং রুমেই ল্যাপটপ ছিলো! হৃদান নিজের কাছে নিয়ে ল্যাপটপ টা ওপেন করে পেনড্রাইভ সেট করে নিলো। ল্যাপটপের সামনের গোল হয়ে বসলো সবাই। প্রথম পেনড্রাইভে হিয়ান খানের সব কালোকারবারি প্রমাণ! দ্বিতীয় প্রেনড্রাইভ সেট করতেই ভেসে আসলো কারো আর্তনাদ! চমকে উঠলো সবাই। জোরে ল্যাপটপটা বন্ধ করে নিলো হৃদান। হৃদানের হাত পা কাঁপছে। চোখের সামনে নিজের বাবাকে মৃত্য যন্ত্রণায় ছটফট করতে দেখলে কার না এমন হবে। আদর শক্ত করে হৃদানের হাত টি ধরলো। হৃদান একপলক আদরের চোখের দিকে তাকালো। ভরসা খুঁজে পেলো সে। দীর্ঘ একটা শ্বাস নিয়ে ল্যাপটপটা আবার ওপেন করলো,
নাবিল চৌধুরীকে বেঁধে মারছে হিয়ানের লোক। সম্পত্তি দিতে নারাজ সে। মেয়েকে মারার ভয় দেখাতেই সে বলে উঠলো সম্পত্তি সব তার ছেলে মেয়ের নামে ওদের মারলে কিছুই পাবে না তারা। সাথে সাথে গলায় ছুরি বসিয়ে দিলো হিয়ান খান। হৃদান ছিলো না, হৃদযা কে নিয়ে চলে গেলো হাসান শিকদার! হাত পা ছুড়োছুড়ি করে একসময় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলো নাবিল চৌধুরী।
চোখ বন্ধ করে নিলো হৃদান-তারিম। চোখের কার্নিশ বেয়ে দুফোটা পানি গড়িয়ে পড়লো হৃদানের! আদর ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। শক্ত মানুষটাও আজ কাঁদছে!
তৃতীয় পেনড্রাইভ! বিস্ফোরণ ছড়িয়ে গেলো সবার মনে। হৃদান সবচেয়ে বেশী অবাক হয়েছে। তৃতীয় পেনড্রাইভ ওপেন করতেই ভেসে আসলো নাসির চৌধুরীর ছবি। যে হৃদানের একমাত্র চাচা হয়। হৃদান বাবার কাছে শুনেছে সে গ্রামে থাকতো। ছবিটা চলে গেলো। ভেসে আসলো আহনাফ চৌধুরীর ছবি। বলছে,
ইনি হচ্ছে নাসির চৌধুরী। নাবিল চৌধুরীর ছোট ভাই। নাসির চৌধুরী ছিলেন একজন ধর্ষক। বহু মেয়েকে তার লালসার শিকার হতে হয়েছে। কিন্তু একদিন নিজের টোপে নিজেই ফেঁসে যায়। রেহানা নামক একজন মেয়েকে ধর্ষণ করতে গিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়ে এবং গ্রামের সবাই বিয়ে করিয়ে দেয় তাদের। সেটাই কাল ছিলো রেহানার। এরপর চরম অত্যাচার সহ্য করতে হয় রেহানাকে। এসব কিছু নাবিল চৌধুরী ও তার বাবা জেনে যায়। নিজের সম্পত্তি কিছু অংশ নাসির কে দিয়ে পুরো অংশ নাবিল কে দিয়ে দেয়। ক্ষোভ জন্মে মনে! কিন্তু নাবিল ভাইকে ঠকাতে চায়নি। যখন যা চায়তো সব দিতো। নাবিলের স্ত্রী রিদিমার দিকে নজর পড়ে নাসিরের। অত্যন্ত রূপবতী ছিলেন রিদিমা। একদিন নাবিলের কাছে রিদিমা ভাইয়ের নামে অসভ্যতার জন্য অভিযোগ করতেই নাবিল নাসির কে নিজ বাড়ি থেকে বের করে দেয়। নাসির আশ্রয় নেয় হিয়ানের বাড়িতে। নাবিল কে মারার প্ল্যান করতে থাকে। হিয়ানের প্ল্যান ছিলো চৌধুরীদের সরানো যেন সে নিজ ব্যবসায় ভালোভাবে চালাতে পারে। আর নাসিরের প্ল্যান ছিলো প্রতিশোধ আর সম্পত্তি। একদিন নিজেদের খায়েশ মিটিয়ে নিলো। হত্যা করলো নাবিল কে। হৃদযা চৌধুরীকে নিজেদের সাথে নিয়ে গেলো। কিন্তু হৃদান আমার সাথে থাকাই বেঁচে গেলো। নিজের বোন জামাইকে সারপ্রাইজ দিতে গিয়ে নিজেই সারপ্রাইজ হয়ে গেলাম। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে আজ সমস্ত প্রমাণ জোগাড় করেছি। আমার সাথে সাথে আমার পরিবারের জীবনের ঝুঁকি আছে। কালকেই হস্তান্তর করবো সকল প্রমাণ। জানিনা কাল পযর্ন্ত বেঁঁচে থাকতে পারবো কিনা তাই আজকের পেনড্রাইভ। আমি জানি আমাকে না পেলে আমার সুপারচ্যাম্প খুঁজবে আমাকে। তখন প্রমাণ গুলো কাজে লাগাবে। নিজের বাবার হত্যার প্রতিশোধ নিতে হবে সুপারচ্যাম্প।
সবার চোখেই পানি। রিয়া ল্যাপটপে নিজের হাত বুলিয়ে নিলো তার বাবার ছবি ভাসছে। হৃদান ল্যাপটপ বন্ধ করে মাথা নিচু করে বসে র ইলো। সুপারহিরো আগে থেকেই জানতো তার জীবনের রিস্ক আছে তাহলে কেন সুরক্ষায় থাকলো না! কেন এভাবে বন্দি হয়ে আছে! সে থাকলে তার জীবন টা আর সবার মতো স্বাভাবিক হতো সে কি জানেনা! ভাবছে হৃদান। আজ শক্ত হৃদান চৌধুরীর খোলশ ভেঙে একজন সাধারণ মানুষ বের হয়েছে। যে কাঁদতে পারে, মন খারাপ করতে পারে, হাসতে পারে। হিমেল রিয়ার কোলে মাথা দিয়ে ফ্লোরে বসে আছে। তার মনের মধ্যে কি পরিমাণ ঝড় বয়ে যাচ্ছে যদি কেউ বুঝতো! রিয়া নিজের হাত হিমেলের মাথার উপর রাখলো। হিমেলের চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো। নিজের বাবার কুকর্মের জন্য তাকে শাস্তি পেতে হয় নাকি সেটাই ভাবছিলো। রিয়া তাকে ছেড়ে যাবে না তো এটাই বার বার মনে হচ্ছিলো তার। এখন আর হচ্ছে না সে ভরসার হাতের ছোঁয়া পেয়ে গেছে! নিজেকে স্বাভাবিক করে হিমেল শক্ত কন্ঠে বলে উঠলো,
আমি জানি মি. চৌধুরী আপনার মনের ভেতর কি চলছে! আমি আইনের লোক হয়েও বলবো না হিয়ান খান কে আইনের হাতে তুলে দিতে। আপনার কোডেটেই তার শাস্তি হোক। কিন্তু অনুরোধ আমার পরিবার যেন এর শাস্তি না পায়!
হৃদান মাথা নাড়ালো। শাস্তি তো হিয়ান খান পাবে। সবচেয়ে নিকৃষ্ট মৃত্য পাবে হিয়ান খাও ও নাসির চৌধুরী। যা সে নিজের হাতে দিবে। ভয়াবহ হবে সেই দিনটা। যন্ত্রণায় ছটফট করবে, বাঁচার জন্য আকুতিমিনতি করবে। নাহ সেদিন সে আনন্দ পাবে না যত ছটফটানি দেখবে তত রাগ হবে তার! ভয়াবহ হবে রাতটা!
চলবে…?
(