#মন_পাথরে_হঠাৎ_ঝড়
#পর্ব_২১
Tahrim Muntahana
অন্তরীক্ষ ঘোর নিমজ্জিত। চারদিক আঁধারে ছেয়ে গেছে। প্রকৃতির আজ বেজায় রাগ হয়েছে। কিছুক্ষণ পর পর তীর্যক বেগে বিদুৎ চমকাচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে আকাশ যেন ফেটে দুভাগ হয়ে যাচ্ছে। এই বুঝি ধরণীর বুকে ধুম করে পড়ে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিবে ধরণীকে। নিস্ফলক চোখে প্রকৃতির রণমূর্তি দেখে চলছে হৃদান। আকাশের মতোই তার বুকেও ঝড় বয়ে যাচ্ছে। বুকটা চিরে যেন দুভাগ হয়ে যাচ্ছে। শিরা উপশিরায় টগবগে রক্ত দ্রুত প্রবাহিত হয়ে জানান দিচ্ছে মানুষটির হৃদয়ে বিষাদকে সঙ্গী দিয়ে একরাশ রাগ জায়গা করে নিয়েছে। যে রাগে ধ্বংস হতে পারে একটি পরিবার হয়তোবা স্বয়ং দুটো মানুষ!
ভোর পাঁচটা বেজে পনেরো মিনিট। যে যার ঘরে ঘুমোচ্ছে। হঠাৎ করেই স্বচ্ছ সুনীল আকাশটা কালো মেঘে ঢেকে গেছে রাতের অন্ধকারে একটুও টের পায়নি কেউ। যে যার ঘরে যাওয়ার মিনিট ষোল পরেই গর্জে উঠে আকাশ। আকাশ যেন হৃদানের মনকথা বুঝতে পেরেছে। সবাই ঘুমিয়ে পড়লেও ঘুমোতে পারিনি হৃদান। মনের মধ্যে আগ্নেয়গিরির উত্তাপে যেমন জ্বলে তেমন জ্বলছে। ভয়ংকর অতিতের সামনে এসেছে সে। যে অতিত পনেরো বছর বয়সে তাকে এতিম করে দিয়েছে। কেড়ে নিয়ে বাবা নামক ভরসার ছায়াটাকে। কেড়ে নিয়েছিলো পুতুল বোনটাকে। ভাগ্যের পরিক্রমায় বোনকে ফিরে পেলেও; ভাগ্যের পরিহাসে বাবাকে ফিরে পাবে না। হাজার চাইলেও না। মাটির নিচে দিব্যি ঘুমিয়ে আছে বাবা নামক মানুষটি। যার কবর খানা কোথায় আছে তাও জানে না সে। কতবড় হতভাগা সে!
বেলকনিতে দাড়িয়ে প্রকৃতির গর্জনের সাথে নিজের চিন্তাধারা বিলিয়ে দিচ্ছিলো হৃদান। বাতাসের দাপটে বারিধারা ছুয়ে দিচ্ছে তার হাত, মুখ, গলা, বুক! দেড় ঘন্টায় ভিজে একদম জুবুথুবু হয়ে গেছে। তাকে যে ভেতরে যেতে হবে, কাপড় পাল্টাতে হবে সে খেয়াল তার আছে! হঠাৎ ই আগমন হলো আদরের। সাড়ে তিনটাই বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ঘুমেরা এসে হানা দেয় তার চোখে। রোহানি কে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিয়ে গভীর ঘুমে তলিয়ে যায় আদর। আকাশের গর্জন ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছিলো; হঠাৎ করেই জেগে উঠে সে। জেগে উঠেই নিজেকে রোহানির বুকে দেখে হালকা হাসে। রোহানি তাকে সবসময় এভাবেই বুকে নিয়ে ঘুমায়। যেন মা তার মেয়েকে ঘুম পাড়াচ্ছে। নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে উঠে দাড়ালো। তার মনে হচ্ছে হৃদান জেগে আছে। এতবড় সত্যি জানার পরেও কি শান্তির ঘুম আসে! যাবে কি যাবে না ভেবেই পাঁচ মিনিট ব্যয় করলো। একসময় মনের সিদ্ধান্তটাকেই গাহ্য করে দরজা খুলে বেড়িয়ে গেলো। বুকের ভেতর কেমন টিপটিপ করছে। ড্রয়িং রুমে এখনো আলো জ্বালানো। তাই আদরের অসুবিধা হলো না হাটতে। আলোটা চারপাশ ছড়িয়ে ভালোভাবে হাটার সুযোগ করে দিয়েছে। সে জানে না ক’টা বাজে। নিজের ফোনটা কোথায় সে নিজেই জানেনা। হৃদানের রুমের সামনে এসেই থমকে গেলো আদর। বুকের টিপটিপানি টা দ্বিগুন বাড়ছে। এতরাতে একটা ছেলের ঘরে যাওয়া ঠিক হবে! হৃদান কি তাকে খারাপ ভাববে? যদি ভেবে বসে মেয়েটি কত অসভ্য হলে এত রাতে একা একটি ছেলের ঘরে আসতে পারে! মনটা বিষিয়ে গেলো তার। ভালো লাগছিলো না বলেই তো সে এসেছে! চাপা শ্বাস নিলো। ভয় হচ্ছে শ্বাসের শব্দে কেউ যদি জেগে যায়! হাস্যকর কথা; শ্বাসের শব্দ কি এতই তীক্ষ্ম!
দরজায় হাত লাগতেই ধড়াম করে দরজাটা খুলে গেলো। বাইরের বৃষ্টির শব্দে শব্দটা তেমন বিকট শোনালো না। হয়তো আজ বৃষ্টি না থাকলে কেউ তাকে চোর ভেবে বেঁধে বেধড়ক কেলানি দিতো! আর সে বিয়ের আগেই শশুড়বাড়িতে মিথ্যে চুরির দায়ে দন্ডপ্রাপ্ত হয়ে মুখ লুকাবে কোথায় চিন্তা করতো। ধুর কিসব ভাবছে সে। এই মাথাটাও না, কোন কাজের না। ফাঁক পেলেই উল্টাপাল্টা ভাবতে বসে যায়। মাথায় নিজের হাত দিয়েই গাট্টা দিয়ে আস্তে আস্তে পা ফেলে ভেতরে ঢুকে পড়লো। অন্ধকার ঘরটাতে শুনশান নিরাবতা। ভয় লাগছে আদরের। হাতড়ে হাতড়ে টেবিল ল্যাম্পের কাছে গিয়ে দাড়ালো। সেদিন ঘরের সবকিছুই ভালোভাবে খেয়াল করায় দরজার পাশেই টেবিল ল্যাম্পটা পেতে বেশী বেগ পেতে হয়নি তাকে। জ্বালাবে কি জ্বালাবে না ভেবেই ঠুস করে জ্বালিয়ে দিলো। নাহ বিছানায় কেউ নেই! আদর অবাক হলো। বিছানায় নেই, এই বৃষ্টির মধ্যে বেলকনিতে তো আর যাবে না ; তাহলে গেলো কোথায়? বাইরে যায় নি তো? ভয়ে আদরের হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসতে নিলো। মানুষটা কোনো ভুল করতে যায়নি তো? মাথা তো ঠিক নেই! কোনো বিপদ হয়নি তো? নাহ আগে খুঁজতে হবে। ঘরের লাইট সব জ্বালিয়ে দিলো। ঘরটা আলোময় হয়ে চকচক করতে লাগলো কালো টাইসের ফ্লোরটি। দৌড়ে গেলো বেলকনির দরজায়। দরজায় দাড়াতেই নজরে এলো পুরুষালি অবয়ব। শান্ত হলো আদর। আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলো।
সুঠাম দেহের অধিকারী পুরুষটি বেলকনির গ্রিলে দুহাত দিয়ে সটান হয়ে দাড়িয়ে আছে। নিজেও গিয়ে পাশে দাড়ালো। হৃদান তখনো আকাশের সেই দূর অজানায় তাকিয়ে আছে। হয়তো মেঘলা আকাশে তারা খুঁজছে। ছোটবেলায় যখন বাবা বলতো, তোমাদের মা আকাশের তারা হয়ে আছে। তখন সে প্রত্যেক সন্ধ্যায় তারা খুঁজে বেড়াতো। আজও খুঁজছে! আদরের বুকটা হাহাকারে বিষিয়ে গেলো। নিঃশব্দে নিজের ডান হাতটা হৃদানের বাম হাতের উপর রাখলো। কেঁপে উঠলো হৃদান। ভেতরটা একদম নড়ে উঠলো। অবাক চোখে পাশে তাকালো। আদর তখন হৃদানের দিকে মায়াময় চোখে তাকিয়ে আছে। চোখ বুজে নিলো হৃদান। স্বপ্ন দেখছে নাতো। চোখ খুলে আদর কে সেভাবেই তাকিয়ে তাকতে দেখে হৃদানের আর বুঝতে বাকি রইলো না সে ভ্রম দেখছে না। আদর সত্যি তার সামনে দাড়িয়ে আছে। মুহূর্তেই মনটা অজানা খুশিতে পুলকিত হয়ে গেলো। বিষাদ টা যেন আস্তে আস্তে কেটে যাচ্ছে। আদর আর দাড়ালো না। ভেতরের দিকে হাটা ধরলো হৃদানের হাত শক্ত করে ধরে। বিরতিহীন ভাবে বৃষ্টি পড়ছে। নিজেও কিছুটা ভিজে গেছে! আরো কিছুক্ষণ থাকলে নিশ্চিত জ্বরে ভোগান্তি দিবে!
ঘরে এসেই হৃদান কে ইশারা করলো পোশাক পাল্টে নিতে। হৃদান আদরের মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। বৃষ্টির পানি মুখটায় ছড়িয়ে আছে। ঘুমঘুম চোখটা হালকা ফোলা, রক্তিমবর্ণ ধারণ করেছে। অসম্ভব মায়াবতী লাগছে সামনের মেয়েটিকে। এক পা দু পা করে আদরের মুখোমুখি দাড়ালো হৃদান। আদরের চোখ মুখে গরম নিশ্বাস বারি খেতেই ঈষৎ কেঁপে উঠলো সে। বুকের ভেতর মনে হচ্ছে হাতুড়ি পিটাচ্ছে কেউ। আচ্ছা সামনের সুঠাম দেহের অত্যন্ত সুদর্শন পুরুষটি কি তার হৃদয়ের কম্পন শুনতে পাচ্ছে? তার হৃদয়েও কি একই কম্পন হচ্ছে! ভেবেই লজ্জায় নেতিয়ে গেলো আদর। একটু ছুয়ে দিলেই মনে হচ্ছে লাজুক লতার মতো একদম মিশে যাবে। হৃদান যেন ঘোরে চলে গেছে। চকচক করা রুমটি তার নজরে পড়ছে না; তার নজর সামনে দন্ডায়মান মেয়েটির মায়াবতী মুখটাই আটকে গেছে। একটু ছুঁয়ে দেখার ইচ্ছে মনের ভেতর প্রবল আলোড়ন শুরু করেছে। আরেকটু এগিয়ে গেলো হৃদান। মাঝখানে এক আঙুল পরিমান জায়গা অবশিষ্ট। আদরের শরীরের কম্পন হৃদানের নজর এড়ায়নি। আরো উতলা করে দিলো হৃদান কে। খপ করে গালে হাতটা চেপে ধরলো। ঠান্ডা হাতের ছোঁয়ায় আদরের রক্তিম গাল আরো রক্তিম হয়ে উঠলো, শরীরের কম্পন বৃদ্ধি পেলো দ্বিগুন হারে।
হঠাৎ করেই হৃদান পিছিয়ে গেলো। আদর ফট করে তাকালো হৃদানের মুখশ্রীতে। হৃদানের চোখ রক্তিম লাল। আদরের ভয় হলো। হৃদান কিছুক্ষণ একই ভাবে তাকিয়ে থেকে বলে উঠলো,
শুনো মেয়ে, তোমাকে ছোঁয়ার অধিকার পুরোপুরি অর্জন করে তবেই গভীর ভাবে ছুঁয়ে দিবো। একদম অতল গভীরে। সেদিন দুটি মনের সাথে দুটি দেহেও আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকবে। এই এক আঙুলের দুরুত্ব সেদিন গুচিয়ে দিবো ভালোবাসায়, বৈধ এক সম্পর্কের মায়ায়! পাথর হৃদয়ের ঝড়ের আলোড়নে তোমাকে ভাসিয়ে নিবো অন্য জগতে। যে জগতের রাজা আমি, রানী তুমি। আর কেউ থাকবে না। রাজ্য হবে দুজন দুজনার! ভালোবাসবো গভীর ভাবে!
লজ্জায় মরি মরি অবস্থা আদরের। হৃদয় টা এত জোরে লাফাচ্ছে মনে হচ্ছে চামড়া ভেদ করে এখনি বেরিয়ে আসবে। আর সামনের পুরুষটি হৃদয়ের সুপ্ত স্থানে নিজের নামটি খোদাই করা দেখে সুক্ষ হাসবে। যে হাসি নির্মল,পরিশুদ্ধ, ভেজালবিহীন!
হৃদান ঘোর থেকে বেরিয়ে এসেছে অনেক আগেই। আদরের লজ্জারাঙা মুখটা উপভোগ করছিলো। আর কতরূপ দেখাবে এই মেয়ে! তাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাক না করলে এই মেয়ের কি শান্তি হবে না! প্রতিজ্ঞা করেছে নাকি? আদর কে আরেকটু ভড়কে দিতে হৃদান হুট করেই এগিয়ে গেলো। আদর শক্ত হয়ে দাড়িয়ে রইলো। হৃদানের চোখ মুখ দুষ্টুমির ছাপ। আদর যেন একপলকেই ধরে ফেললো। এই পুরুষটির চোখ মুখ দেখেই পড়ে ফেলতে পারে তার মন। আদরের ঠোঁটর কোণেও বাঁকা হাসি ফুটে উঠলো। নিজেই এক পা এগিয়ে গিয়ে হৃদানের কাছ ঘেসে দাড়ালো। হৃদানের মাথা ঝিম মেরে গেলো; ঢোক গিললো বড়সড়। নাহ এই মেয়ে বড্ড চালাক! যতটা বোকা ভেবেছে ততটাও বোকা না! দিব্যি তার মন বুঝে নিয়ে তার চাল তাকেই ফিরিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু সে তো পারছে না। আদর কে কাছে টানার ইচ্ছেটা বারবার জেগে উঠছে মনকুঠিরে। আরেকবার ঢোক গিলে ভয় ভয়ে তাকালো হৃদান। হঠাৎ ই হৃদান কিছু বুঝার আগেই আদর হৃদানের কলার চেপে ধরলো। আকস্মিক টানে মাথাটা হালকা কাত হয়ে এলো। এই সুযোগটাকেই কাজে লাগিয়ে গালে ঠুস করে একটা কিসি দিয়ে; আদর দৌড়ে বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে। আর হৃদান! আপনাআপনি মুখ হা হয়ে এলো তার। হাতটি চলে গেলো একটু আগের মিষ্টি ঠোঁটের স্পর্শ করা স্থানে। সে যেন এই দুনিয়াতেই নেই এখন। মস্তিষ্ক একদম ফাঁকা হয়ে গেছে। বুকের বাম পাশে থাকা হৃদয়টা হালকা গতিতে স্পন্দন দিয়ে যাচ্ছে। নড়ার শক্তিও যেন তার মধ্যে নেই। সুঠাম দেহের মানুষটা একটা মেয়ের ঠোঁটের ছোঁয়ায় কুপোকাত হয়ে গেলো! প্রিয়জনের ছোঁয়ায় এতটা মাদকতা ছড়ানো! যার রেষ ঘন্টা চলে গেলেও কাটে না!
সকাল সাড়ে ছয়টা টা। এলার্মের টিং টিং শব্দে ধড়ফড় করে উঠে বসলো তারিম। পাশেই সুবাহ ঘুমাচ্ছে কাত হয়ে। কাল আতইয়াব আপ্রাণ চেষ্টা করেছে বউয়ের সাথে থাকার কিন্তু তারিম যে মনে মনে প্লেন করে রেখেছে। বড়সড় একটা সারপ্রাইজ দিবে মানুষটাকে। কষ্ট তো কম দেয়নি। ক্ষমাও চেয়ে নিবে সেদিন। তারিমের জেদের কাছে হার মেনে আতইয়াব ফালাহ’র সাথে ঘুমায়। দেরী করে ঘুমানোর জন্য তারিম অনেকটা আগেই এলার্ম দিয়ে রেখেছে। প্রথম, দ্বিতীয় এলার্ম মিস গেলেও তৃতীয় এলার্ম যেন মিস না যায়। এতগুলো মানুষকে তো সে না খাইয়ে রাখতে পারেনা। ভোর সকালে তার ভাইয়ের কফি চাই। যে কয়টা দিন আছে ভাইয়ের সেবা করতে একটুও কার্পণ্য করবে না সে। যদিও খুব ঘুম পাচ্ছিলো তবুও আরামের ঘুমটাকে পায়ে ঠেলে বিছানা ছাড়লো সে। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো চার্জ নেই। চার্জে বসিয়ে ফ্রেশ হতে চলে গেলো। জলদি ফ্রেশ হয়ে হাটা দিলো রান্না ঘরের দিকে। কালকে প্রচুর জার্নি গিয়েছে তাই নিজেরও খিদে পেয়েছে হালকা।
নিচে নামতেই চোখে পড়লো তিনজন মেয়ে ঘর গোছানোর কাজে লেগে পড়েছে। তারিম হালকা জোরে গুড মরনিং বলে উঠলো। তিনজনের মুখে হাসি ফুটে উঠলো। এই মেয়েটা আসার পর থেকে তাদের কাজ করতে ভালোয় লাগে। কতটা আপন করে নিয়েছে। ম্যাম বলে ডাকতেই দেয়না। তাই ওরা আপু বলে ডাকে। বয়সটা সমান ই হবে তবুও যাদের বাড়িতে কাজ করে তাদের তো নাম ধরে ডাকা যায় না! রান্নাঘরে ঢুকেই তারিম চা, কফির জন্য পানি বসালো। রান্নাঘর ও পরিষ্কার করে রেখেছে। অমলেট করার চিন্তা করলো তারিম। আদরের খুব পছন্দ খাবারটি। সাথে জুস, ডিম সিদ্ধ আর কিছু ফল। সকালে নাস্তা এতেই হবে। সবার জন্য চা, কফি ডাইনিংয়ে রেখে ভাইয়ের ঘরে হাটা দিলো সে। তার ভাই এতসকালে ঘর থেকে বের হয়না। আর কালকে এতকিছু হলো মন মেজাজ ও হয়তো ঠিক নেই। পথিমধ্যেই দেখা মিললো আতইয়াবের। তারিম কে দেখেই চোখ রাঙালো। তারিম হাসলো। আহারে বেচারা! হাতে কফি দেখেই হাত বাড়িয়ে নিতে যাবে তারিম পিছিয়ে গেলো একপা। আতইয়াব চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে বলে উঠলো,
কি সমস্যা। দিচ্ছিস না কেন? মাথাটা খুব ধরেছে ; আমার জন্যই তো নিয়ে যাচ্ছিলি!
তারিম ভেঙচি কাটলো। তার জন্য নিয়ে যাচ্ছে কে বলল? কচু নিয়ে যাচ্ছে! কপট রাগ দেখিয়ে বলল,
এটা আপনার নয়। ডাইনিংয়ে রাখা আছে নিয়ে খেয়ে নিন, যান। এটা আমার ভাইয়ার জন্য।
শেষের বাক্যটি বলতেই আতইয়াব খানিক আহ্লাদের সুর পেলো। হিংসে হচ্ছে একটু। বউ তার! আগে জামাইয়ের সেবা না করে ভাইয়ের সেবা করছে! যদিও ভাইয়ের অধিকার আছে ; তার ও তো আছে। সে কেন অধিকার ছাড়বে? বউ সকাল সকাল গোসল সেরে ভেজা চুলে স্নিগ্ধ মুখে মিষ্টি মিহি কন্ঠে ঘুম থেকে ডেকে তুলে কফি খেতে দিবে; এটা তার জামাইগত অধিকার! তা না করে বলছে নিয়ে খেতে! এ ঘোর অপমান। সে কিছুতেই মানবে না। এসব ভেবে আতইয়াব তারিমের অন্যমনস্কতার সুযোগ নিয়ে কফিটা নিজের হাতে লুফে নিলো। ফুসে উঠলো তারিম। আতইয়াব যেই না মুখে দিতে যাবে তারিম চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
এই কি করছেন? এটা খেতে পারবেন না আপনি। ব্ল্যাক কফি এটা, একদম চিনি ছাড়া।
আতইয়াবের হাত আপনাআপনি থেমে। মুখ একদম পাংশে মেরে গেলো। ভেবেছিলো বড় শালার কফিটা নিজে খেয়ে হালকা অপমানের শোধ নিবে তা আর হলো কই। নিজেই তারিমের হাতে কফিটা দিয়ে ডাইনিংয়ের দিকে হাটা ধরলো। তারিম হালকা শব্দ করে হেসে উঠলো। আতইয়াব কে শুনিয়ে বলে উঠলো,
এটা একদম চিনি ছাড়া না। দু’চামচ চিনি দেওয়া! যেমনটা আপনি খান!
বলেই তারিম দৌড়। আতইয়াব এভাবে বোকা হয়ে তারিমের যাওয়ার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। শেষমেষ ডক্টর আতইয়াব তাযিন ইততেয়াজ বউয়ের কাছে বোকা হলো। এ মুখ কোথায় দেখাবে। তখনই মনে পড়লো হৃদানের কথা। বিড়বিড় করে বলে উঠলো,
ভাইয়ের মতোই হইছে বোন। একদম ভাইয়ের নেওটা। ভাই যেমন ইবলিশ বোন ও তেমন ইবলিশ হচ্ছে। মি. ইবলিশ মডেল তোরে আমি দেইখা লমু খালি আমার বোন তোর বউ হোক। তখন আমিও তোদের মধ্যে ভাইগত অধিকার খাটাবো।
মাথায় এক বালতি রাগ নিয়ে চেয়ারে শব্দ করে বসে পড়লো আতইয়াব। মেজাজ তার তুঙ্গে উঠে গেছে। কই ভেবেছিলো সকাল সকাল বউয়ের গুড মরনিং কিস নিবে ; কপালে কি জুটলো!
এতসকালে ভাইয়ের রুমের দরজা শাট করে খোলা দেখে তারিম ভ্রু কুচকালো। ভাইয়া কি কোথাও গেছে নাকি? কিছুদিন ধরে তো জগিংয়ে বাইরে যায়না। বাগানেই দৌড়ায়। কিন্তু সেতো বাগানে দেখেছে করিডর থেকে। সেখানেও নেই। এত না ভেবে ঘরে ঢুকে পড়লো তারিম। ঘরে ঢুকেই বিষ্ময়ে হতবাক হয়ে গেলো সে। ভিজা টি-শার্টে বাম গালে হাত দিয়ে মুখ হা করে খাম্বার মতো দাড়িয়ে আছে হৃদান। তারিমের মাথায় কিছুই ঢুকলো না। আস্তে করে ডাক দিলো একবার। ড্রেসিং টেবিলের উপর কফির মগ টা রেখে হৃদানের দিকে এগিয়ে গেলো। না সাড়া শব্দ নেই। হা করে ভেবেই চলছে!
হৃদান ভাবছে একঘন্টা আগের কথা। এটা কি হলো? কিভাবে হলো? ভেবেই চলছে তো ভেবেই চলছে। মাথায় যেন অন্যকিছু ঢুকছেই না। তারিম গিয়ে হৃদানের হাত ধরে ধাক্কা দিলো। চমকে উঠলো হৃদান। তারিম বলে উঠলো,
ভাইয়া কি হয়েছে তোমার? ভেজা শরীরে হা করে গালে হাত দিয়ে দাড়িয়ে আছো কেন? এত কি ভাবছো?
হৃদানের মুখ থেকে অস্পষ্ট স্বরে বেরিয়ে আসলো, কিসসস..
তারিম কিছুই বুঝলো না। দিলো জোরে ধাক্কা। হৃদান এবার ধড়াস করে বিছানায় বসে পড়লো। আহ পায়ে ব্যাথা কেন এত! তিনঘন্টার মতো একটানা দাড়িয়ে থাকলে পায়ে ব্যাথা হবে না? তারিম কে নিজের দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে থাকতে দেখে থতমত খেয়ে ঝটপট হাত টা নামিয়ে নিলো হৃদান। আমতা আমতা করতে লাগলো সে। তারিম ভাইয়ার মতিগতি কিছুই বুঝলো না। কফিটা হাতে দিয়ে বের হয়ে আসলো চিন্তিত ভঙ্গিতে। হৃদান যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। পরক্ষণেই গালে হাত দিতেই ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠলো অতি সুক্ষ্ম হাসি। যে হাসিতে রয়েছে প্রাপ্তির ছোঁয়া।
সবাই ঘুম থেকে উঠে গেছে। উঠানোর দায়িত্বটা স্বয়ং পান্চু নিয়েছিলো। পান্চুর ডাকে সবাই ঘুম থেকে উঠলেও পিয়াস কানে বালিশ চেপে রেখেছে শক্ত করে; তবুও সে উঠবে না দশটার আগে। পান্চু তো তা হতে দিতে পারেনা। সবাই উঠে গেছে আর পিয়াস স্যার একাই আরামে কম্বল জড়িয়ে ঘুমাবে তা কি করে হয়। রোহানিকে বুঝিয়ে শুনিয়ে পিয়াসের ঘরের সামনে নিয়ে গেছে। রোহানি নিজেও ভেতরে ভেতরে বাকুম বাকুম। আহা মানুষটা ঘুম থেকে উঠেই তার মুখ দেখবে! সে লজ্জায় লাল নীল সবুজ হয়ে যাবে। আহা কি দৃশ্য! পান্চু প্রথমে ভালোভাবে ডাক দিলো কয়েকবার নাহ উঠার নাম নেই। সে ঠিক বুঝতে পারছে পিয়াস তার ডাক শুনেও ঘুমানোর ভান করছে। রোহানিকে দরজার ঠিক সামনে বরাবর রেখে নিজে দু’পা পেছনে সরে হাক ছেড়ে বলে উঠলো,
পিয়াস স্যার হা-ডু-ডুওওওওও
পান্চু কে আর পায় কে! একদৌড়ে ড্রয়িং রুম পাস করে রান্না ঘরে চলে গেছে। বাড়ির বাইরে এখন যাওয়া যাবে না। হা-ডু-ডু কথাটা শুনেই পিয়াস ধপ করে চোখ খুলে উঠে বসে। আজ একটা বিহীত করেই ছাড়বে সে। এই পান্চুর টাক মাথা যদি না ফাটিয়েছে সে আজ গোসল করবে না! কথাটা বলেই পিয়াস অবাক হলো! হোয়াটট গোসল করবে না! এটা কোনো কথা হলো। ওত ভাবার সময় আছে? এক দৌড়ে দরজার কাছে গিয়ে দরজাটা ধড়াম করে খুলে দিলো। সামনের দিকে তাকাতেই পিয়াসের চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেলো। দুহাত আপনা আপনি বুকের দিকে চলে গেলো। উন্মুক্ত বুক, পেট ঢাকার চেষ্টা আরকি। পিয়াস শুধু থ্রিকোয়াটার প্যান্ট পড়ে আছে। যতই শীত থাকুক না কেন পিয়াসের এক অভ্যাস হলো সে খালি গা ছাড়া ঘুমাতে পারেনা। এই অভ্যাস আজ তার কাল হলো। একটা মেয়ের সামনে তার তিল তিল করে গড়ে তোলা ইজ্জত টা এক নিমিষেই মাটিতে গড়াগড়ি খেতে লাগলো। শুধু গড়াগড়ি! এতো রীতিমতো ফুটবল খেলছে রোহানির চাহনী দেখে। এই মেয়ে তো আচ্ছা লুচি! চোখ দিয়ে কেমন গিলে খাচ্ছে। ধপ করে দরজা টা বন্ধ করে দিলো পিয়াস। রোহানি চোখ বড় বড় করে এখনো দরজার দিকে তাকিয়ে আছে। সে কি দেখলো! কি ভেবে এসেছিলো আর কি হলো! মুখ দেখাবে কি করে! লোকটা তাকে নিশ্চয়ই লুচি ভেবেছে।
এই তোকেও বলি রোহানি, লাজলজ্জা বলতে কিচ্ছু নাই। উন্মুক্ত সুঠাম বুক দেখে চোখ ফেরাতে পারলি না! আর তুই বা কি করবি সামনে থাকলে কেউ না দেখে ছাড়ে!
নিজেই নিজেকে গালি দিতে দিতে ড্রয়িং রুমে এসে বসলো। মাথা থেকে যেন ব্যাপারটা যাচ্ছেই না! অন্যদিকে তারিম চিন্তিত ভঙ্গিতে আতইয়াবের পাশের চেয়ারে বসলো। সুবাহ খেয়াল করতেই বলে উঠলো,
তারু কি হয়েছে? চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন?
সবার নজর এবার তারিমের দিকে গেলো। রিয়া হিমেলের পাশে বসে একটু একটু করে খাবার মুখ পুরছিলো। খেতে ইচ্ছে করছে না। হিমেলের ধমকাধমকিতেই খেতে হচ্ছে। সুবাহ’র কথায় সেও খাওয়া অফ করে তারিমের দিকে তাকিয়ে রইলো। তারিম সুবাহ’র দিকে একপলক তাকিয়ে একই ভাবে চিন্তিত ভঙ্গিতে বলে উঠলো,
কফি দিতে গিয়ে দেখি ভাইয়া ভেজা টিশার্টে গালে হাত দিয়ে হা করে দাড়িয়ে আছে। ডাকলাম শুনলো না। ধাক্কা দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আনমনা হয়ে বলে উঠলো কিসস। কিছুই বুঝলাম না আমি। কেমন আমতা আমতা করছিলো!
জুসের একাংশ খেয়ে আরেক চুমুক দিয়েছে কেবল আদর। তারিমের কথা কানে পৌঁছাতেই খকখক করে কেশে উঠলো সে। সবাই অবাক হয়ে তাকালো আদরের দিকে। ঠিক ই তো ছিলো। আতইয়াব তাড়াহুড়ো করে উঠে মাথা হালকা বারি দিলো হাত দিয়ে। কিছুক্ষণ আগের ঘটনা মনে হতেই আদরের গাল আবারো রক্তিম বর্ণ ধারণ করলো। তারিম হা করে তাকিয়ে রইলো আদরের দিকে। হঠাৎ লজ্জা পাচ্ছে কেন! অপরপাশ থেকে রোহানি বলে উঠলো,
সাড়ে ছয়টাই ঘুমথেকে উঠে দেখি আমার বোনটা ঘরে নেই। তার উপর জিজুর গালে হাত দিয়ে দাড়িয়ে থাকা। কিসস বলা। সামথিং ইস কিসি কিসি মনে হচ্ছে। উমম উমমম!
ভ্রু নাচালো আদরের দিক তাকিয়ে। আদর বিস্ফোরিত চোখে ভাইয়ার দিক তাকালো। আতইয়াব ও অবাক হয়ে শুনছে। আদর তো পারে না লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে। কোনদিক না তাকিয়েই খাবার টা রেখেই দিলো এক দৌড়। পথিমধ্যেই ধাক্কা খেলো সুঠাম এক বুকের সাথে। চোখ মুখ কুচকে নিলো আদর। বলিষ্ঠ এক হাত তার কোমর পেঁচিয়ে রেখেছে; আরেক হাত তার ডান হাত টা ধরে রেখেছে। ধক করে উঠলো বুকটা। পিটপিট করে চোখ খুললো আদর। সামনেই হৃদানের মুখশ্রী ভেসে আসতেই আবারো একরাশ লজ্জা এসে হানা দিলো আদরের রক্তিম মুখশ্রীতে। হৃদান কে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ঘরে চলে গেলো। হৃদান কিছুই বুঝলো না। সে এক ঘোরে চলে গিয়েছিলো। এই মেয়েটা কাছে থাকলে তার দিনদুনিয়া খেয়াল থাকে না। মেয়েটার ভালোবাসায় ভাসতে ইচ্ছে করে। নিজেকে স্বাভাবিক করে হেটে এসে চেয়ার টেনে বসতেই হৃদানের মনে হলো সবাই তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। ফট করে মাথা তুলে সবার দিকেই একনজর তাকালো। হ্যাঁ সবার মুখেই মুচকি হাসি। হৃদান একপলক আতইয়াবের দিকে তাকালো। সে গম্ভীর মুখে তাকিয়ে আছে। হৃদান এবার সমীকরণ মিলিয়ে টের পেলো আদরের লজ্জা পেয়ে দৌড়ে যাওয়ার কারণ, এখানে সবার হাসার কারণ, বড়শালার গম্ভীর চাহনীর কারণ! বিচলিত হলো না সে। পাত্তায় দিলো না কাউকে। অমলেটের কিছু অংশ মুখে দিয়ে বলে উঠলো,
আমারই হক আমার গালেই পড়েছে! যদিও এখন বৈধতা নেই। জোর করে নিইনি। আপনার বোন অবলা ছেলে পেয়ে বিয়ের আগেই আমার গালের ভার্জিনিটি নষ্ট করে দিয়েছে। আমার দিকে ওমন করে তাকিয়ে লাভ নেই মি. ডক্টর!
মনে মনে ইবলিশ শব্দটা আওড়ালো। সবার সামনে তো বলা যায় না। আতইয়াব থতমত খেয়ে গেছে। হৃদান যে লাগাম ছাড়া কথা বলবে সে ভাবতেই পারেনি। সে তো ভেবেছিলো কপট রাগ দেখিয়ে হৃদানের উপর সকালের শোধ টা তুলবে। এ ছেলে তো তার থেকেও এক ধাপ এগিয়ে। তাকে সুযোগ ই দিলো না। কিন্তু সেও বা কম যায় কি করে। তারিমের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে বলে উঠলো,
আমার কিন্তু বৈধতা আছে। খেয়ে ফেললেও কোনো দোষ নেই। আমি গাল না সোজা ঠোঁটের ভার্জিনিটির দিকে হামলা করবো। আজকের রাতের ওয়েদার ভালো ছিলো কিন্তু আপনার বোন অবলা পেয়ে ঠকালো। দিস ইস নট ফেয়ার মি. মডেল!
আতইয়াব ও মনে মনে ইবলিশ কথাটা আওড়ালো। দুজনের এই শত্রুতা যে কবে শেষ হবে কে জানে। আতইয়াবের কথায় তারিমের চোখ মুখ নাক লাল হয়ে এলো কেমন। কানের ভেতর গরম সিসা ঢালার মতো ছ্যাৎ করে উঠলো যেন। গরম ধোঁয়ায় চাল দিলে তা একটু পরেই ভাত হয়ে যাবে! আর থাকতে পারলো না সে। এক দৌড়ে স্থান ত্যাগ করলো। দুজনের লাগামহীন কথায় সুবাহ রিয়া রোহানিও থাকার সাহস পেলো না। তাড়াহুড়ো করে ড্রয়িংরুম থেকে আদরের ঘরে হাটা ধরলো। বর্তমানে ড্রয়িং রুমে আতইয়াব হৃদান ফালাহ হিমেল রয়েছে। কারো মুখেই কথা নেই। ফালাহ হিমেল মিটমিটিয়ে হেসে যাচ্ছে! পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমেল বলে উঠলো,
আজকের প্ল্যান কি মি. চৌধুরী? দেরী করা ঠিক হবে?
হৃদানের মুখের আধল টা সিয়িয়াস হয়ে গেলো। গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো,
নো, কোনো দেরী নয়। আজই সমাপ্তি হবে সকল লুকোচুরির। কিন্তু হৃদান চৌধুরী যে খেলতে ভালোবাসে! নিজের চাচার সাথেই যদি না খেলতে পারি কি করে হবে! আজ চাচার সাথে খেলবো। ভয়াবহ খেলা!
#মন_পাথরে_হঠাৎ_ঝড়
#পর্ব_২২
Tahrim Muntahana
অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশ। এখন যে দুপুর টিকটিক শব্দ করা যান্ত্রিক ঘড়ি নামক বস্তটা না থাকলে হয়তো বুঝাই যেতো না। ভোর সকালের প্রকৃতির রণমূর্তি রূপের রেষ এখনো কিছুটা রয়ে গেছে। আকাশ কালো মেঘকে আপন করে নিয়ে ঠাই দিয়েছে তার বুকে। কিছুক্ষণ পরপর ঝিরঝির বৃষ্টিতে রাস্তা আরো পিচ্ছিল করে দিচ্ছে। পরিবেশ টা সবার কাছে মনোমুগ্ধকর না হলেও দুটি প্রেমিকযুগলের কাছে অত্যন্ত মনোরম দৃশ্য ! যে দৃশ্যের মুগ্ধতা তাদের চোখে বিরাজ করছে। মনে হচ্ছে দুজোড়া চোখ হাসছে।
রাতে ঘুম না হওয়ায় ঠান্ডা এই পরিবেশে গরম কম্বল জড়িয়ে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলো আদর। দুদিন তারা এখানেই থাকবে; হৃদানের আদেশ! বউয়ের কাছাকাছি থাকতে পারবে বলে হৃদান প্রস্তাব দেওয়ার সাথে সাথেই রাজী হয়ে গেছে আতইয়াব। এই নিয়ে হাসির পাত্র হয়েছে সে। কিন্তু তার কি এসবে এখন লজ্জা আছে? সে তো এখন অষ্টাদশী প্রেমিকের মতো প্রেম কুড়াতে ব্যস্ত। প্রেমিকদের লজ্জা রাখতে নেই! আদর হু হা কিছুই করেনি। তার যে আনন্দ হচ্ছে না, তা না। ভালোবাসার মানুষটার কাছাকাছি সবাই থাকতে চায়। আদর ব্যতিক্রম নয়! শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দিবে ঠিক তখনি আরামের ব্যাঘাত ঘটিয়ে ফোন টিংটিং শব্দ করে বেজে উঠে। বিরক্তিতে কপাল কুচকে আসে তার। এই সময়েই ফোনটা বাজতে হলো। অপর পাশের ফোনের মালিকের উপর বেজায় রাগ নিয়ে ধুম করে বিছানা থেকে নেমে ফোনের কাছে গিয়ে দাড়ালো। ফোনের উপর জ্বলজ্বল করছে ‘আমার ক্যাবলাব্রিটিশ’ নামটি। কপালের ভাজ গাঢ় হলো। একই বাড়িতে থেকে ফোন দেওয়ার কারণ আদর বুঝলো না। কিছু হলো না তো? ভেবেই ঝটপট ফোনটা রিসিব করে কানে ধরলো। হৃদান অপর পাশ থেকে গম্ভীর গলায় বলে উঠলো,
তিনমিনিট সময় মেইন গেটের কাছে আসো। এর একটু দেরী হলেই হাওয়ায় মিঠাইয়ের মতো নরম ঠোঁট দুটো আমার ঠোঁটকে জড়িয়ে ধরতে বাধ্য হবে! দোষ কিন্তু আমার না, তোমার ঠোঁটের! আদর টা মিস না করতে চাইলে ১২:৪৬ শেষ হওয়ার পরেই এসো!
ধড়াস করে উঠলো হৃদপিন্ড। কান দিয়ে যেন উত্তপ্ত ধোঁয়া বের হচ্ছে। হৃদপিন্ডটা টিপটিপ করে না দ্রুত বেগে স্পন্দন দিচ্ছে। এভাবে কেউ বলে? ছি অশ্লীল! মনে মনে কথাটি বলে কিছু বলতে নিবে ঠুস করে ফোনটা কেটে দিলো হৃদান। ফুস করে নিশ্বাস ছাড়লো আদর। তিনমিনিট সময়ের কথা মনে হতেই ফোনটা নিয়ে দৌড় ছুটলো সে। ইতিমধ্যে নিজের ভাবনাতেই একমিনিট কাটিয়ে দিয়েছে । পড়নে তারিমের একটা ফ্রক। দৌড়ের গতির সাথে তাল মিলিয়ে হাটুর উপর ফ্রকের নিম্নাংশ বাড়ি খাচ্ছে। চুল গুলো কাঠি দিয়ে খোঁপা করা বলেই হয়তো রক্ষা। নাহলে দৌড়ের জন্য একটার সাথে আরেকটা জট পেঁকে যেতো। ড্রয়িং রুম পেরিয়ে সদর দরজায় এসে একটু থামলো সে। হাত ঘড়ির দিকে চোখ যেতেই দেখতে পেলো মাত্র ২৪ সেকেন্ড আছে। আত্মা কেঁপে উঠলো আদরের। কোনোদিক না তাকিয়ে ভো দৌড় দিলো। মেইন গেটে চোখ যেতেই দেখতে পেলো ড্রাইভিং সিটে বসে দরজা খুলে এক পা বাহিরে রেখে আয়েশি ভঙ্গিতে ফোন টিপছে হৃদান। দৌড় থামালো একদম হৃদানের সামনে এসে। এখনো চার সেকেন্ড সময় অবশিষ্ট রয়েছে। হাসি ফুটে উঠলো আদরের ঠোঁটে। সে তো কল্পনা করেই নিয়েছে হৃদানের ওত কাছাকাছি থেকে তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। হৃদান তাও ছাড়ছে না তাকে। একদম নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে! আর ভাবতে পারলো না আদর। খপ করে হাত টেনে নিজের পাশে বসিয়ে দিলো হৃদান। চমকে উঠলো সে। ভয় পেয়ে গেছে! জোরে নিশ্বাস নিয়ে ভ্রু কুচকে তাকালো পাশের মানুষটির দিকে। হৃদান বাঁকা হেসে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। আদরের ভয় হলো। চুমু টুমু দিয়ে বসবে নাতো! মাঝখানে হালকা দুরত্ব।হৃদানের মনে হয় দুরত্বটা পছন্দ হলো না। নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো আদরকে। ঠোঁটের কোণে দুষ্টুমি হাসি ঝুলিয়ে আদরের দিকে ঝুঁকে বলল,
বাহ! আন্ডাবাচ্চা দেখি খুব ফাস্ট! এবারের যাত্রায় বেঁচে গেলে। এরপরের সুযোগ মিস করবো না। চিকন রসালো ঠোঁটটা একদম লুফে নিবো।
আদর বিচলিত হলেও পরক্ষণেই হৃদানের ঠোঁটে দুষ্টু হাসি দেখে চোখ ছোট ছোট হয়ে গেলো তার। ফিচেল হাসলো সে। এবার ভড়কে গেলো হৃদান। সে আদরের ভয়ার্ত মুখশ্রী দেখার জন্য এমন করছিলো। মেয়ে পাগল হলো নাকি! হৃদান কে আরো একটু ভড়কে দিতে নিজের অবস্থান থেকে উঠে একদম হৃদানের কোলে বসে পড়লো আদর। হৃদান একদম শক্ত হয়ে গেলো। এই মেয়ে আশেপাশে থাকলেই নিজেকে পাগল পাগল লাগে; এতটা কাছে, দুটো শরীরের মধ্যে কোনো জায়গা অবশিষ্ট নেই, দুজন দুজনার নিশ্বাসের শব্দটাও শুনতে পাচ্ছে, হৃদান ঠিক থাকতে পারে? নিষিদ্ধ ইচ্ছারা যেন মাথায় কিলবিল করছে। একটু গভীর ভাবে ছুঁয়ে দেওয়ার জন্য মনটা আঁকুবাঁকু করছে। ফাঁকা ফাঁকা লাগছে মাথা। হৃদানের বিচলিত বিষ্ময়কর চাহনী দেখে আদর শব্দ করে হেসে উঠলো। হৃদান দুচোখ ভরে দেখলো প্রাণোচ্ছল হাসিটা, কান পেতে গভীর ভাবে উপভোগ করলো হাসির কলকল ধ্বনিটা! আহ হৃদয় যেন থমকে গেছে। প্রশান্তিতে ভরে গেলো বুক। কারো হাসিও এখন হৃদান চৌধুরী বুকে শান্তি দেয়! মিষ্টি হাসলো হৃদান। আদর ততক্ষণে হৃদানের কোল থেকে নেমে নিজের জায়গায় বসেছে। ভ্রু নাচিয়ে হৃদানকে বুঝালো কেমন দিলাম। হৃদান হালকা শব্দ করে হাসলো। ফিসফিসিয়ে বলে উঠলো,
হৃদান চৌধুরীর অর্ধাঙ্গীনী তো তার মতোই হওয়া চাই! যে হৃদান চৌধুরীকে টক্কর দিতে পারবে। সমান তালে ঘরে ও বাইরে দাপটের সাথে চলতে পারবে। নিজের সুদৃঢ় অবস্থান টা বজায় রেখে হয়ে উঠবে অনন্য। আমি নিজের জন্য পার্ফেক্ট আদর কে চাইনা, বাচ্চা বাচ্চা বোকা অতিরিক্ত কথা বলা আদরকেই আমার লাগবে; কিন্তু বাইরের দুনিয়ায় আমি পার্ফেক্ট আদর আহমেদ কে চাই। যাকে ভাঙতে পারবে না কেউ! শত কষ্টের মাঝেও নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করবে না অন্যের কাছে। তোমার দুর্বলতায় তুমি আমাকে হারাতে পারো! কারণ তুমি আমার দুর্বলতা আদর। যাকে হারানোর ভয় আমাকে কুড়ে কুড়ে খায়, যার একটু কষ্টে আমার হৃদয় জ্বলে, পুড়ে একদম খাক হয়ে যাই। যদি তুমি দুর্বল হও; শত্ররা হৃদান চৌধুরীকে টেনে হিঁচড়ে নিচে নামাতে বেশী সময় ও ব্যয় করবে না। তোমার মাঝেই হৃদান চৌধুরী প্রাণ নিহিত। পাথর হৃদয়ে যে ঝড় তুলেছো ; সেই ঝড়ের সমাপ্তি তোমাতেই!
মন্ত্রমুগ্ধের মতো শ্রুতিগুলো শ্রবণ করলো আদর। হৃদানের কথার মানে বুঝতে তার একটুও সময় লাগেনি। মানুষটা তাকে সামনের জন্য স্ট্রং করতে চায়ছে; সে ঢের বুঝতে পারছে। সে কি দুর্বল? মন কথাটা এক ফিকেই সরিয়ে দিলো। নাহ সে দুর্বল নয়। বরং আগের থেকে এখন নিজেকে শক্তিশালী মনে হচ্ছে। হৃদানের হাতের উপর হাত রেখে আশ্বস্ত সুরে বলে উঠলো,
আমি দুর্বল নয়। যারা আমার সরলতা কে দুর্বলতা ভেবে ভুল করে তাদের জন্য আমি সরল ই থাকতে চাই। যখন তাদের শেষ সময়টা আসবে তখন ঠিক আদর আহমেদের হিংস্র রূপটা দেখতে পাবে। কিন্তু বেশীক্ষণ নয়! যে একবার আদর আহমেদের হিংস্র রূপ দেখবে তার পৃথিবীর বুকে নিশ্বাস ফেলার সময় যে বড্ড কম হবে!
হৃদানের মুখে বাঁকা হাসি ফুটে উঠলো। সে মানুষ চিনতে ভুল করেনি। গাড়ি চলতে শুরু করলো। আদর জানালায় হাত রেখে মাথাটা এলিয়ে দিয়ে প্রকৃতির স্নিগ্ধতার সাক্ষী হচ্ছে। যার দরুন তার চোখে মুখেও মুগ্ধতা বিরাজ করছে। ড্রাইভিংয়ের ফাঁকে ফাঁকে তৃপ্ততার সহিত অবলোকন করছে হৃদান। দুজনের চোখেই মুগ্ধতা; একজন প্রকৃতির স্নিগ্ধতায় মুগ্ধ আরেকজন প্রেয়সীর মুগ্ধতায় ঘেরা মুখশ্রী দেখে মুগ্ধ!
বাগানের ঠিক মাঝখানে কৃষ্ণচূড়া গাছটি মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে আছে। পাশেই রঙ বেরঙের ফুল গাছ। বাগানের কিছু অংশ ঘেরাও করে রেখেছে। তার ঠিক মাঝখানটাই একটি দোলনা। অর্কিড ফুল দিয়ে সাজানো দোলনায় কিছু তাজা ফুল। আহা কি সুন্দর। দোলনায় দোল খাচ্ছে তারিম। ভাবনায় অনেককিছু। চারপাশ চোখ বুলাতেই তারিমের নজরে এলো আশেপাশের দৃশ্য। মিষ্টি হাসলো সে। ঠিক যেমনটা তার পছন্দ ; তেমন ভাবেই হৃদান জায়গা টা সাজিয়েছে। কিছুদিন আগে হারিয়ে গেলো সে,
হঠাৎ একদিন ঘুম থেকে উঠে বাগানে গিয়েই চোখে পড়ে দোলনাটি যা আগে ছিলো না। খুশিতে মন নেচে উঠে। কোনো দিক না তাকিয়েই দোল খেতে থাকে সে। ভালোভাবে চারপাশ খেয়াল করলে হয়তো দেখতো একজন মায়া মায়া চোখে তাকেই দেখে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ দোল খাওয়ার পর তার হঠাৎ করেই মনে হয় কেউ তাকে দেখছে। এই বিষয়টা মেয়েদের ক্ষেত্রে একটু প্রখর। পাশে তাকাতেই চোখে পড়ে হৃদান কে। যে গাছের সাথে হেলান দিয়ে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। তারিমের মুখে হাসি ফুটে ওঠে। এগিয়ে আসে হৃদান। একপাশে সরে বসার জায়গা করে দেয় তারিম। হৃদান বসে। মোলায়েম কন্ঠে বলে উঠে,
তুমি খুশি তো হৃদু?
তারিম অবাক হয়ে তাকায়। হৃদান মুচকি হাসে। একহাত দিয়ে তারিম কে জড়িয়ে ধরে বলে উঠে,
আমি তোমার একমাত্র ভাইয়া হৃদু। আমার সেই পুতুল বোন তুমি। যার একটা আবদার ও আমি কখনো ফেলি নি। তুচ্ছ কথাটাও মাথায় রেখে দিতাম।সেই ছোট্ট পুতুলটার দোলনা পছন্দ আর আমি সেই ইচ্ছেটা পূরণ করবো না?
তারিমের চোখ ছলছল করে উঠলো। বহুদিন পর কেউ এভাবে তার আবদার পূরণ করছে। যদিও তার দুই বেস্টু তার সব আবদার ই পূরণ করে কিন্তু তাদের টা তো আলাদা। তারিম বুঝলো সার্ভেন্ট কে দোলনার কথা জিজ্ঞেস করার সময় তার ভাই শুনে নিয়েছে। হৃদানের বুকে মাথা রাখলো তারিম। যত্ন সহকারে আগলে নিলো হৃদান। তার তো এখনো বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় সেই পুতুল বোন টা যে হারিয়ে গিয়েছিলো সে এখন তার বুকে! উপর ওয়ালা তাকে এত বড় প্রাপ্তি দিয়েছে! হৃদান হেসে বলে উঠলো,
তোমার সকল আবদার কিন্তু আমাতেই হৃদু। সেই ছোট বেলার মতো সব আবদার আমাকেই করবে। এখন দেখোতো চারপাশটা পছন্দ হয়েছে?
তারিম চারপাশটা ভালোভাবে দেখতেই তার মুখ হা হয়ে যায়। গোলাকৃতি করে চারপাশে ফুল গাছ লাগিয়েছে। ঠিক মাঝখানটাই দোলনা। আরেকটু ভালো করে খেয়াল করে দেখলো হৃদানের প্যান্টে মাটি লেগে আছে। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
তোমার শরীরে মাটি কেন ভাইয়া?
হৃদান হাসতে হাসতে বলল,
এই সবগুলো ফুল গাছ আমি রোপন করেছি হৃদু। খুব যত্ন করে! আমার পুতুল বোনের পছন্দের কাজ অন্যকেউ করবে কেন?
শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তারিম। আহা সুখ! কখনো সে ভেবেছিলো তার নিজের ভাইয়ার বুকে মাথা রেখে দোলনায় দোল খেতে পারবে! আজ তাই সম্ভব হচ্ছে। হৃদান তো তাকে নিজ হাতে খেতেই দেয় না। যতক্ষণ বাসায় থাকে নিজ হাতে খাইয়ে দেয়। একটু পর পর দেখে যায় কি করছে। প্রত্যেকদিন বাহির থেকে এটা ওটা নিয়ে আসে। যেন সে ছোট বাচ্চা!
দোলনায় কেউ বসতেই তারিম নিজের ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসলো। পাশ ফিরে তাকাতেই নজরে এলো আতইয়াব কে। বিরক্তি নিয়ে তার দিকেই তাকিয়ে আছে সে। তারিমের মুখের হাসি চওড়া হলো। আতইয়াব ভ্রু কুচকে বলে উঠলো,
কার ভাবনায় বসে থাকিস? কখন থেকে ডাকছি শুনতেই পাচ্ছিস না। খবরদার কাউকে নিয়ে কল্পনা সাজাস না; তোর কল্পনা সহ বাস্তবেও কাট কাট করে দিবো!
তারিমের মুখ থেকে যেন হাসি সরছেই না। আবেগি কন্ঠে বলে উঠলো,
জানেন এখানে আগে দোলনা ছিলো না। ফুল গাছ গুলোও ছিলো না।
তো?
আতইয়াবের কন্ঠে বিরক্ত। তারিম মনক্ষুণ্ন হলো না। তার মনটা আজ খুব ভালো। আবার বলে উঠলো,
এই দোলনা সহ চারপাশের ফুল গাছগুলো নিয়ে সুন্দর পরিবেশটা আমার ভাইয়া নিজের হাতে করেছে। প্রত্যেকদিন সকালে এসে ফুলগাছ গুলো দেখে যায়। নিজ হাতে যত্ন নেয়। শুধুমাত্র আমার জন্য! আপনার আর আদরের ভালোবাসা দেখে আমার খুব মনে হতো, নিজের একটা ভাই থাকলে আমাকে ঠিক এভাবেই আদর করতো! শাসন করতো! ভালোবাসতো! সব আবদার মুখ ফুটে বলার সাথে সাথেই পূরণ করতো! দেখেন উপর ওয়ালার লীলা; নিজের ভাইয়াকে ফিরে পেলাম আমি। নিজের আপনজন পেলাম। মুখ ফুটে বলার আগেই সব আবদার পূরণ হয়। পৃথিবীর সব থেকে সুখি মানুষ আমি! যার হৃদান চৌধুরীর মতো একটা ভাই আছে, আপনার মতো একজন স্বামী আছে, বোনের মতো দুজন বেস্টু আছে! খুব সুখী আমি। খুব খুব!
চোখ থেকে আনন্দঅশ্রু প্রবাহিত হচ্ছে। আতইয়াব চারপাশটা একপলক দেখে মুগ্ধ হলেন। হৃদান চৌধুরী নামক মানুষটা খারাপ না সে জানে; শুধু উপরের হিংস্র খোলসটার জন্য সবাই ভুল বুঝতো! তারিমের মাথাটা নিজের প্রশস্ত বুকে চেপে ধরলো। তারিম এই বুকটার অপেক্ষায় ছিলো যেন। আকড়ে ধরলো পিঠ! পেছন থেকে হাসির শব্দ আসতেই তারিম ছিটকে দূরে সরে গেলো। রোহানি সুবাহ ওদের দেখে হাসছে। আতইয়াব বিরক্ত হলো। বউয়ের সাথে একটু একান্তে প্রেম ও করতে পারবে না নাকি! এখন থেকে ঘরেই সব আদর পুষে নিতে হবে। বিরক্তি নিয়ে চলে যেতে নিবে রোহানি বলে উঠলো,
হৃদান জিজু আমাদের যেতে বলেছে ভাইয়া। গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে ফালাহ ভাইয়া আর পান্চু ভাইয়া!
আতইয়াবের মনে পড়ে গেলো সকালে বলা হৃদানের কথাটা। ঝিম মেরে গেলো মাথা। এখন কি তাকেও এসবের সাক্ষী হতে হবে! হাটা ধরলো গেটের দিকে। ওরা তিনজন ও পিছে পিছে যেতে লাগলো। ওরা নিজেরাও বুঝতে পারছে না কিসের জন্য যাচ্ছে তারা!
শুনশান রাস্তায় গাড়ি রেখে বসে আছে হৃদান-আদর। অপেক্ষা আতইয়াবদের! গ্রামের কাঁচা রাস্তা শুরুর মাথায় গাড়ি রাখা। বর্তমানে হৃদান রা অবস্থান করছে আনন্দমহল গ্রামের শেষপ্রান্তে। হৃদানের মুখটা যথেষ্ট গম্ভীর। আদর সাহস ই পাচ্ছে না কথা বলার। চুপ করেও থাকতে পারছে না। নিরব পরিবেশে নিরব সে থাকতে পারে না। দুপুর গড়িয়ে এখনো বিকেল হয়নি। ঝিরঝির বৃষ্টি পড়ছে। জানালা খুলতে দেয়নি হৃদান। কাঁচের উপর বৃষ্টি ফোঁটার দিকে তাকিয়ে ভাবছে আদর। হৃদান তাকে কোথায় নিয়ে এসেছে, কোথায় যাবে, কি করবে কিছুই জানে না সে! জানার ইচ্ছেও নেই। হৃদান তাকে জাহান্নামে নিয়ে গেলেও সে প্রস্তুত। ভালোবাসে তো! তবুও ভাবনা থেকেই যায়! আদরের উুসখুস হৃদান বুঝতে পারলো। আদরের গা ঘেসে বসতেই আদরের মাঝে কম্পন টের পেলো সে। হাসলো! কারো স্পর্শে এতটা কম্পন হয়! হয়তো হয়; যদি স্পর্শটা ভালোবাসার মানুষটার হয়। হৃদানের ও এমন নিরাবতা পছন্দ হলো না। ফিসফিসিয়ে বলে উঠলো,
আমার ভবিষ্যৎ তো অন্ধকার দেখছি। হালকা স্পর্শেই যেহারে কাঁপতে থাকো তুমি ; বাসর ঘরে কাঁপতে কাঁপতে তো অজ্ঞান হয়ে যাবে। না হবে আদরকে আদর, না আসবে আন্ডুবাচ্চা! আমি কিন্তু মুটেও সাধুসন্নাসী না। বিয়ের পর একদম ছাড় নেই। খেয়ে দেয়ে শক্তি বাড়াও শরীরে। জড়িয়ে ধরলেই তো খুঁজে পাওয়া যাবে না; রোমান্স তো অনেক দূর। হাইরে কপাল আমার!
হতাশার শ্বাস ফেললো হৃদান। হৃদানের কথায় আদরের বুকে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। ঠোঁট কাটা স্বভাবের লোকটা কি জানে তার এসব কথায় তার বুকে ঝড় হয়, হৃদয় অত্যাধিক কাঁপতে থাকে, কান গরম হয়ে যায়! অস্পষ্ট স্বরে আদর বলে উঠলো,
অসভ্য ক্যাবলাব্রিটিশ!
হৃদানের কানে পৌঁছালো। শব্দবিহীন হাসলো! পাশে থাকা রমনীর মুখে অসভ্য ডাকটাও যেন অত্যন্ত মিষ্টি শুনাচ্ছে। কি প্রেমে পড়লো হৃদান চৌধুরী; গালিও মধু মধু লাগে!
আতইয়াবদের গাড়ি দেখেই হৃদান আর কথা বাড়ালো না। ছুটে চলল গ্রামের পথ ধরে; পেছনে ফেলে সারি সারি গাছ, বিশাল এরিয়া জুড়ে ধান ক্ষেত, শাক-সবজি ক্ষেত; আহা কি দৃশ্য। প্রাণ জুড়িয়ে যায়। হৃদানের গাড়ি অনুসরন করে ছুটে চললো পেছনের গাড়ি। মাঝখানে বাঁক নিলো হৃদান। পনেরো মিনিট যেতেই চোখে পড়লো দুতালা বিশাল এক বাড়ি। যার গেটের উপর জ্বলজ্বল করছে ‘চৌধুরী মঞ্জিল’ নামটি! কারোর আর বুঝতে বাকি রইলো না তারা এখন হৃদান দের জমিদার বাড়ির সামনে দাড়িয়ে আছে। গাড়ি থেকে নেমেই হাটা ধরলো হৃদান। গেট খুলে দিলো দারোয়ান। ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়লো বিশাল বাগান। কিন্তু বাগানটাকে আদও বাগান বলা যায়! ফুল গাছ গুলো মরে শুকিয়ে গেছে। যত্ন নেয় না হয়তো। হৃদান সরাসরি সদর দরজায় চলে গেলো। ঠকঠক শব্দ করার মিনিট এক পরেই দরজা টা খুলে গেলো। হা হয়ে রইলো অপর প্রান্তের মানুষটি!
চলবে…?
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। শুকরিয়া!)
চলবে…?
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। শুকরিয়া!)