#মন_পাড়ায়
#পর্ব_১৪
#নিলুফার_ইয়াসমিন_ঊষা
প্রভা নির্বিকারে জিজ্ঞেস করল, “আপনিও তো তুলেছিলেন। আপনি পারলে তারা পারবে না কেন?”
মুহূর্তে যেন অর্কের মুখের ভাব ভঙ্গি পরিবর্তন হলো। নম্র থেকে শক্ত হলো। মুখে রাগান্বিত ভাবের আগমন। সে শক্ত করে প্রভার হাতটা আঁকড়ে ধরলো। রাগান্বিত স্বরে বলল, “তুমিও তো তাহলে সে মানুষগুলোর মতো। তারা যেমন তোমাকে বলেছে তুমিও তো নূহাকে বলেছ।”
ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠে প্রভা। কাঁচের চুড়ি ভেঙে তার হাতে ঢুকে গেছে। সে বলল, “প্লিজ ছাড়ুন ভীষণ ব্যাথা করছে। প্লিজ।”
প্রভার ভেজা চোখ দুটো দেখে অর্কের হুশ ফিরল। সে প্রভার হাত ঢিল দিতেই তার হাতে চারটা রক্তে মাখা ভাঙা কাঁচের চুড়ি এসে পরলো।
অর্ক সাথে সাথে আতঙ্ক নিয়ে বলল, “সরি সরি আমি বুঝি নি যে—-” অর্ক প্রভার হাত ধরতে নিলেই প্রভা পিছিয়ে গেল। তার চোখে মুখে ভয়। সে কাঁপছে। ধরা গলায় বলল, “দয়া করে আমার কাছে আসবেন না।”
সেখানে দাঁড়িয়ে না থেকে গাড়ির দিকে এগোল প্রভা।
প্রভা আসলেই কাঁপছিল, ভয়ে কাঁপছিল। তার থেকে? অর্ক চোখ বন্ধ করে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলল। তার হাতের মুঠোয় ছিলো সে ভাঙা কাঁচের চুড়িগুলো। মুঠোবন্দী করে জোরে চাপ দিতেই চুড়িগুলো ভেঙে চুরমার হয়ে গেল।
মেকানিক এসে গাড়ি ঠিক করে দিচ্ছিলো। অর্ক বাহিরেই দাঁড়িয়ে ছিলো। জানালা দিয়ে ভিতরে দেখছিল, প্রভা মাথা নিচু করে বসে ছিলো। হাতের যে স্থানে কেটে গিয়েছিল সে স্থান অন্য হাত দিয়ে ঢেকে রেখেছিল।
গাড়ি ঠিক হবার পর মেকানিককে টাকা দিয়ে বিদায় করে গাড়িতে উঠে বসলো অর্ক৷ প্রভার দিকে তাকিয়ে দেখল প্রভা অন্যদিকে সরে যাচ্ছে। দরজাতে বাহু ঠেকে পড়া সত্ত্বেও সে সরেই যাচ্ছে। অর্কের তখন কার উপর রাগ উঠছিল সে নিজেও বুঝতে পারছিল না। প্রভার উপর না তার নিজের উপর?
প্রভা ভয়ে তখনো কাঁপছিল। সে বুঝতে পারছে অর্ক ইচ্ছে করে তখন এমনটা করে নি, হয়ে গেছে। কিন্তু মনকে একবার ভয় কাবু করে নিলে তাকে তো বুঝানো যায় না। আর তার ভয় তো অহেতুক নয়, অতীতে এমন অনেক মার খেয়েছে সে। বিনয় শান্ত মাথার মানুষ ছিলো কিন্তু রাগ ছিলো ভয়ানক। রাগ উঠলে মার দিতো। বিয়ের পরেরদিন যখন প্রথম বিনয় তার উপর হাত তুলে সারাটারাত কেঁদেছিল সে। আদরে পোষা পাখি যখন এমন কটু বাস্তবতার মুখোমুখি হয় সহ্য করতে পারে না। তার আজও মনে আছে একদিন মার দেওয়ার পর যখন আলমারিতে মাথা লেগে তার মাথা থেকে রক্ত বের হচ্ছিল তখনও বিনয় একটি ছোট টেবিল উঠিয়ে নিয়েছিলো তাকে মারার জন্য। সেদিন তার ননদ ফাতেমা এসে তার ভাইকে ধরেছিল। সেদিন পরিবারের সবাই উপস্থিত ছিলেন সেখানে আর কেউ এগিয়ে আসে নি।
এমনটা চলতে থাকে দশমাস। যখন সে দশমাসের গর্ভবতী তখন আস্তে আস্তে বিনয়ের আচরণ পাল্টাতে থাকে তার প্রতি। কিন্তু সে মার গুলো আজও সে ভুলতে পারে না। সে ভয় বুকে ঢুকে গেছে। আজও চোখ বন্ধ করে সে দিনগুলোতে মনে করতে বুক কাঁপে।
বিনয় তো ছিলো শান্ত স্বভাবের মানুষ তাতেই এত বড় কাজ করতে পারে আর অর্ক তো স্বভাবতই রাগী। তাকে দেখে সবাই ভাববে প্রচন্ড শান্তশিষ্ট অথচ তার রাগ উঠতে এক মুহূর্তও লাগে না। তার থেকে ভয় পাওয়াটা অস্বাভাবিকও কিছু না।
প্রভা ভয়ে ভয়ে একপলক অর্কের দিকে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলো। মুহূর্ত খানিকের পর আবার তাকালো চোখ দুটো বড় বড় করে। তার হাত দিয়ে সমানে রক্ত পড়ছে। হাতের রক্ত গড়িয়ে পড়ছে তার হাত দিয়ে, মিশে যাচ্ছে তার মেরুর রঙের পাঞ্জাবির সাথে। প্রভা আতঙ্কিত স্বরে বলল, “আপনার হাত দিয়ে রক্ত ঝরছে সমানে।”
অর্ক উওর দিলো না। প্রভা হাত ধরতে নিলেই সে বলল, “তুমি আমার স্পর্শ থেকেও ভয় পাও তাহলে এখন কী হলো?”
প্রভা ভেজা কন্ঠে বলল, “আপনার হাত থেকে সমানে রক্ত ঝরছে।”
“ঝরতে থাকুক। তোমাকে যতটা ব্যাথা দিয়েছি আমিও পেয়েছি। হিসাব বরাবর। তাতে কী?”
“আপনি ব্যাথার হিসাব রাখছেন?”
“ব্যবসায়ী আমি। হিসাব রাখাটা আমার কাজ।”
“টাকা পয়সার। অনুভূতি বা সুখ দুঃখের নয়। গাড়ি থামিয়ে হাত দিন আমার কাছে। আমি দেখব।”
প্রভা আবারও হাতটা ধরতে নিলে অর্ক গাড়িটা থামাল সাথে সাথে। প্রভার হাত সরিয়ে তার বাহু আঁকড়ে ধরে বলল, “কী সমস্যা এত জ্বালাচ্ছ কেন?”
প্রভা ভেজা চোখে অসহায়ের মতো তাকিয়ে রইলো তার দিকে। অর্ক একবার হাত হাতের দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ হয়ে স্টেরিং এ জোরে এক ঘুষি মারল। আর সেখানে মাথা রেখে বলল, “তুমি আমাকে খুব বেশি জ্বালাও।”
প্রভা অর্কের রাগ দেখে আবারও ভয় পেল কিন্তু তবুও অর্কের সে হাতটা নিজের হাত নিল। পুরো হাতে কাঁচ ঢুকে পরেছে। মুহূর্তে শিউরে উঠলো সে। অর্কের দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনি এই কী অবস্থা করলেন নিজের হাতের?”
অর্ক উওর দিলো না। প্রভা বলল, “জলদি হাস্পাতালে চলুন।”
“প্রয়োজন নেই।”
“আছে। এখনই চলুন, নাহয় আমি এখনই গাড়ি থেকে নেমে কাওকে ডেকে আনব।”
অর্ক মাথা তুলে তাকালো প্রভার দিকে। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলিল, “তুমি আমার এত চিন্তা করছ কেন? তুমিই তো বলেছিলে এই সম্পর্ক শুধুমাত্র লোক দেখানোই থাকবে। এইখানে তো কেউ নেই তাহলে এত চিন্তা কেন?”
“মানবিকতা বলেও একটা কথা আছে। ইশশ আমি আপনার সাথে কথা বাড়াচ্ছি কেন? দ্রুত চলুন।”
অর্ক গাড়ি চালানো শুরু করতে নিলেই প্রভা তার শাড়ির আঁচলটা তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “এইটা হাতের নিচে রেখে দিন। প্রচুর রক্ত পরছে।”
হাস্পাতালে থেকে ব্যান্ডেজ করিয়ে নিল অর্ক। আর প্রভার হাতের যে অংশ কেটেছে সে অংশে ওয়ান টাইম ব্যান্ডেস লাগিয়ে দিলো। অর্ক যখন ফেরার পথে গাড়ি চালাচ্ছিল তখন প্রভা চিন্তিত সুরে জিজ্ঞেস করল, “আপনার হাতের ভিতরে কাঁচ ঢুকে গিয়েছিল। যখন কাঁচ উঠাচ্ছিল আমিই ভয়ে শেষ আর আপনার মুখে একটা কষ্টের ছাপও দেখলাম না। আর এখন এত সহজে গাড়ি চালাচ্ছেন। আপনার ব্যাথা লাগে নি? আপনার জায়গায় আমি থাকলে কেঁদেই দিতাম।”
অর্ক তার চোখজোড়া সামনে রেখেই বলল, “তুমি একটু আগে বলেছিলে না আমি খুব ভাগ্যবান? জানো ছোট থেকে শুনে এসেছি ছেলেরা কাঁদে না। যত যাই হোক কাঁদে না। আমার মা’য়ের মৃত্যুতেও কাঁদতে পারি নি আমি। তুমি বলেছিলে বিনয়ের মৃত্যুতে তুমি কাঁদো নি বলে আশেপাশের লোকেরা অনেক কিছুই বলেছে। মা’য়ের মৃত্যুর পর যখন কাঁদছিলাম, বাবা আমাকে বলেছিল ছেলেরা কাঁদে না। কাঁদলে মানুষ দুর্বল হয়ে পড়ে। আর ছেলেদের দুর্বল হতে নেই। যখন কান্না বন্ধ করলাম তখন লোকেরা পাষাণ বলতে শুরু করলো। বাবার খুব স্বপ্ন ছিলো আমায় নিয়ে। তার স্বপ্নগুলো আমার উপর চাপিয়ে দিলো। আমার স্বপ্ন ছিলো আর্মিতে ভর্তি হওয়ার। দেশের সেবা করার। হলো না। বাবার চাইতেন তার ছোট ব্যবসাটা আমি বড় করি। অনেক বড় করি৷ সে হিসেবে পড়াশোনা করতে শুরু করলাম। ভাদ্র বাবার ইচ্ছা পূরণ করার জন্য সুস্থ ছিলো না আর সৈকতকে আমি আমার জীবন বাঁচতে দিতে চাই নি। দিন রাত ভুলে শুধু পড়তাম। কলেজে থাকতে যেখানে সব বন্ধুরা আড্ডা দিত আমি বাবাকে সাহায্য করতাম কাজে। এক সময় সে পরিশ্রমের ফলও এলো। আমাদের ব্যবসা অনেক বড় হলো। জানো সংগীত আমার ভীষণ পছন্দের ছিলো। সৈকত পিয়ানো বাজাতো ও আমি ভায়োলিন। আমার মা উপহার দিয়েছিলেন আমায়। মা নিজেই শিখাতেন। অনেক সুন্দর করে বাজাতেন তিনি। কিন্তু বাবার সে ধ্বনি শুনে বেশ কষ্ট হতো। মায়ের কথা মনে পড়তো। সে ভায়োলিন আজ কই জানি না।সৈকত আমাকে খুব মানতো ছোট বেলায়। আর আজ দুই চোখে সহ্য করতে পারে না। ওর দোষ দিব না। দোষ আমার ছিল। ওর ঢাল হয়ে কখনো ওর সামনে দাঁড়াতে পারি নি আমি। বাবার সামনে কিছু বলার কখনো সাহসই ছিলো না আমার। এমন না তাকে ভয় লাগতো শুধু তাকে কষ্ট দিতে চাইতাম না। আরেকটা কারণ ছিলো ওর দূর হওয়ায় ওর মা’কে কখনো মা’য়ের স্থান দেই নি আমি। এমন না দিতে চাইতাম না। যেদিন বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করে সেদিন আমার খালা বলেছিল, ‘কখনো উনাকে মা মানবি না আর ডাকবি না। তোর মা মারা গেছে। ও শুধু তোদের দেখাশোনা করার লোক। কখনো নরম হবি না ওর সামনে। তুই যেদিন নরম হয়ে পড়বি সেদিন থেকে ও তোদের মাথায় চড়ে নাচবে। এই ঘরে তোদের মূল্য থাকবে না আর। তোর উপর শুধু নিজের না ভাদ্রের দায়িত্বও আছে। সবসময় মনে রাখবি ও তোর সৎ মা আপন মা না।’ আমি তাই মনে রাখলাম। এমন না যে সৈকতের মা আমাদের ভালোবাসে নি। অনেক বেসেছে কিন্তু খালার কথাগুলো আমি ফেলতে পারি নি। যদি হঠাৎ সে পাল্টে যায়? আমার যাই হোক ভাদ্রের কী?
একটা মেয়েকে ভালোবাসতাম আমি। বেড়াতে গ্রামে গিয়েছিলাম। সে সকালে কুয়াশার চাদরে ঢেলে ছিলো চারপাশ। কিন্তু সে শীতের মাঝে বসন্তের হাওয়ার মতো ছিলো হাসি। ওর চোখদুটোয় ছিলো অজানা উষ্ণতা। ওর মাঝে এমন কী ছিলো আমি আজও বের করতে পারি নি। অতি সাধারণ ছিলো মেয়েটা, তবুও অসাধারণ। সে প্রথম প্রেম নামক পাখি মনের দরজায় টোকা দিয়েছিল অথচ সে পাখিটা কখনো রইলো না মন পাড়ায়। পি এইচ ডি করতে গিয়েছিলাম সেখানে যেয়ে শুনি ওর বিয়ে হয়ে গেছে। সেদিনও কাঁদি নি। নিজেকে দুর্বল করার মতো সাহস ছিলো না আমার। এরপর অনেক মেয়ে এলো গেল আমার জীবন থেকে কাউকেই ভালোবাসতে অয়ারি নি। না ভালোবেসে সম্পর্কেও জড়াই নি।
তারপর আমার জীবনে এলো নূহা। ও আমাকে পাল্টে দিলো। সে মেয়েটাকে ভুলাতে সাহায্য করলো। আবারও ভালোবাসতে সাহায্য করল কিন্তু ওকে ভালোবাসার পর ও নিজেও চলে গেল আমার জীবন থেকে।”
অর্ক কথাগুলো বলে তাকাল প্রভার দিকে। গাড়িতে ব্রেক কষলো। প্রভা কাঁদছে। সে প্রভার দিকে ঝুঁকে আলতো হাতে প্রভার গালের নোনাজল মুছে দিলো আর চোখে চোখ রেখে বলল, “সবারই গল্প থাকে। কারও জানা তো কারও অজানা। সবার জন্য তুমি কাঁদতে পারবে না তাই আমার জন্যও কেঁদোনা।”
অর্ক সরে এলো। সামনে তাকিয়ে আবারও গাড়ি চালু করে বলল, “একটা কথা বলি?”
প্রভা ভেজা কন্ঠে বলল, “বলুন।”
“তোমার চোখদুটো ভীষণ সুন্দর, মায়াময়।”
#মন_পাড়ায়
#পর্ব_১৫
#নিলুফার_ইয়াসমিন_ঊষা
প্রভা ভেজা কন্ঠে বলল, “বলুন।”
“তোমার চোখদুটো ভীষণ সুন্দর, মায়াময়।”
প্রভা আড়চোখে একবার অর্কের দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলো। চোখজোড়া নামাতেই তার চোখ আটকে গেল নিজের রক্তভেজা শাড়ির আঁচলে। সে মৃদু কন্ঠে বলল, “আপনার নিজের রাগ কমানো উচিত। রাগের মাথায় আমরা কখন কী করে ফেলি তা নিজেও বুঝতে পারি না।”
“তুমি কীভাবে জানো? তোমাকে আমি কখনো রাগে দেখি নি।” পরের মুহূর্তে আবার অর্ক বলল, “ওহ–দুইবার দেখেছি।”
প্রভা হেসে বলল, “ঝিনুকের রাগ প্রচুর। ও রাগের মাথায় কখন কী করে নিজেও জানে না। পরে অনুতাপ করে।”
” আমি কখনো ওকে রাগে দেখি নি।”
প্রভা হেসে দিলো। বলল, “ও রাগের মাথায় একবার আপনার উপর গরম চা ঢেলে দিয়েছিলো।”
অর্ক চোখ দুটো বড় বড় করে তাকালো প্রভার দিকে। বলল, “ওয়েট, তোমাদের বাসায় যখন আমি গিয়েছিলাম একটা বাচ্চা আমার উপর চা ঢেলে দিয়েছিল শুধুমাত্র আমি ওকে ‘বাচ্চা ছেলেটা দেখি অনেক কিউট’ বলে গাল টেনে দিয়েছিলাম এইজন্য। আমি বুঝেছিলাম ও কোনো ছেলে। ওই বাচ্চা—মানে মেয়েটা ঝিনুক ছিলো।”
প্রভা এবার খিলখিল করে হেসে দিলো। অর্ক প্রভার দিকে তাকালো। প্রভার হাসিটা অদ্ভুত দারুণ। ঠিক বসন্তের ভোরের মতোই মুগ্ধতার ছায়া সে হাসিতে। বসন্তের সকাল বেলা ঘুম ভাঙ্গে কোকিলের ‘কুহু’ ডাকে আর সকালের বাতাসের সাথে ভেসে আসে ফুলের মিষ্টি গন্ধ। তখন একরাশ মুগ্ধতা এসে যেমন কাবু করে মনকে তেমনি মোহমুগ্ধময় মেয়েটার হাসি।
.
.
ঝিনুক রুমে এসে দেখে সৈকত বিছানায় আধশোয়া হয়ে একটি ছবি দেখছে। সে পাত্তা না দিয়ে নিজের ফোন নিয়ে বারান্দায় যেতে নিলো। তখনই সৈকত বলে উঠলো, “তুমি যে আগে টম বয়ের মতো থাকতে কখনো বলো নি কেন?
ঝিনুক থেমে গেল। পিছনে তাকালো বড় বড় চোখ দুটো করে। সৈকত শব্দ হেসে বলল, “আমি ছবিটা দেখে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না এইটা তুমি। আমি তো আকাশ থেকে পড়েছিলাম যেন। আগে এসে আমি তোমার সাথে খেলতাম সম্ভবত। তখনও বুঝি নি। তোমাকে যখন জিজ্ঞেস করেছিলাম ছেলেটার কথা তুমিও কিছু বলোনি। আমিও তো বলি ছেলেটা কোথায় গেল আর হঠাৎ করে এই মেয়ে কীভাবে আসলো? এখন বুঝতে পারছি।”
ঝিনুক সৈকতের সামনে যেয়ে ছবিটা নিতে নিলেই সৈকত হাত পিছনে সরিয়ে ফেলল। সৈকত বলল, “আজকে খালামণি এলবাম না দেখালে তো জানতেই পারতাম না। বুঝার উপায় ছিলো না তুমি ছেলে না মেয়ে। শার্ট, প্যান্ট, চুলও ছেলেদের মতো। হঠাৎ করে কী জাদু ছড়ি ঘুরলো যে এমন পরী হয়ে গেলে।”
“বিরক্ত কর না তো। ছবি দেও।” ঝিনুক ছবি ফেরত নিতে নিলেই সৈকত ঝিনুকের পিঠে হাত রেখে তাকে কাছে টেনে নিলো। ঝিনুক দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “এখন কোনো লুইচ্চামি করলে মাথা ফাটায় দিব।”
“আমার প্রেমকে লুইচ্চামি বল কেন জান? বুকে লাগে তো।”
“তাই না? লাগাচ্ছি দাঁড়াও।” বলেই ঝিনুক কতগুলো ঘুষি মারতে শুরু করল সৈকতের বুকে।
“হ্যাঁ দেও দেও আরাম লাগছে। ম্যাসাজ হয়ে যাচ্ছে ফ্রীতে।”
ঝিনুক আরও জোরে মারতে শুরু করল। সৈকত ঝিনুকের এক হাত ধরে বলল, “এমন নরম তুলতুলে হাত দিয়ে মারলে আমি ব্যাথা পেতে পারি জান? আরও আরাম লাগে।”
ঝিনুক বিরক্তি নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। মুখ ফুলিয়ে বলল, “জাহান্নামে যাও।”
“যেখানেই যাই না কেন তোমাকে নিয়ে যাব।”
“বিরক্তিকর!”
ঝিনুক বিছানার অপর প্রান্তে যেয়ে বসলো। সৈকত আবারও জিজ্ঞেস করল, “না সিরিয়াসলি, হঠাৎ করে একবছরে এমন পরিবর্তন হলো কীভাবে?”
ঝিনুক ঝাঁজালো গলায় বলল, “জানি না। ক্লাস সেভেন পর্যন্ত সব ঠিক ছিলো হঠাৎ কী যেন হলো পরীশ ভাইয়া ছোট মা’কে বলল আমি যেন মেয়েদের মতো চলাফেরা করি। সাথে এলাকার সবার সাথে খেলাধুলাও বন্ধ করিয়ে দিলো। আমি আগে ক্রিকেট চ্যাম্পিয়ন ছিলাম বুঝলে? কিন্তু ভাইয়া পরে আর খেলতে যেতে দিত না।”
হঠাৎ করে সৈকতের মুখের ভাব ভঙ্গি পাল্টে গেল। সে ছবিটা ঝিনুকের পাশে রেখে উঠে দাঁড়ালো। বারান্দায় যেতে নিলো। আবার হঠাৎ দাঁড়ালো। ঝিনুকের দিকে না তাকিয়েই জিজ্ঞেস করল, “তোমার খবিশ ভাই কী জানে তোমার বিয়ের কথা?”
“ভাইয়ার নাম পরীশ। উল্টাপাল্টা কিছু বললে আগামীকাল খবরের কাগজের হেডলাইন থাকবে ‘স্ত্রী করল স্বামীকে হত্যা, কারণ স্বামী ছিলো বদমাশ, শয়তান, —–” সৈকত ঝিনুকের দিকে তাকিয়ে তার কথা কেটে বলল, “প্রথমত, এমন হেডলাইন শুনে মনে হচ্ছে জার্নালিজম পড়া ছেড়ে দেই৷ আর দ্বিতীয়ত, তুমি উওর দিতে পারবে কেন তোমার প্রিয় ভাই জানে না তোমার বিয়ের কথা?”
“খালু মানা করেছে তাই।”
সৈকত বুকের উপর তার হাত আড়াআড়ি ভাঁজ করে জিজ্ঞেস করল, “আর তা কেন?”
ঝিনুককে একটু বিভ্রান্ত দেখাল। কিন্তু সে নিজেকে সামলে অসংশয়িত ভাবে বলল, “সম্ভবত ভাইয়াকে টেনশন দিতে চাইছিল না। এমনিতে প্রভা আপুকে নিয়ে চিন্তায় ছিলো।”
“কিন্তু প্রভা ভাবির বিয়ের কথা তো সে জানে।”
“আমার বিয়ে হঠাৎ করে ডিসাইড হয়েছিল তাই।”
সৈকত দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “তোমার সমস্যা কী জানো? তুমি তাই বুঝো আর মেনে চলো যা তুমি বুঝতে চাও আর মানতে চাও। তোমার সামনে সব পরিষ্কার থাকলেও তুমি তাকে ঘোলাটে করে নেও নিজ থেকেই।”
ঝিনুকের রাগ উঠলো প্রচন্ড। সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “হ্যাঁ যেমন তোমার বিশ্বাস ঘাতকতা আমার চোখে পড়ে নি। তোমার মতো জঘন্য মানুষের প্রেমে পড়ে নিজের সময় নষ্ট করেছি যে একটা মেয়েকে প্রেগন্যান্ট করে তাকে ফালিয়ে রেখে চলে গেছে। আমার সাথেও তোমার এমনটাই করার ইচ্ছা ছিলো তাই না? আর পরীশ ভাইয়াকে তুমি দেখতে পারো না কারণ সে তোমার প্লান নষ্ট করে দিয়েছে।”
সৈকত কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো ঝিনুকের দিকে। তার দম বন্ধ হয়ে আসছিলো। সে চোখ বন্ধ করে এক ছোট নিশ্বাস ফেলে সেখান থেকে চলে গেল।
ঝিনুক সাথে সাথে বসে পরলো। দুই হাতের কনুই হাঁটুর উপর ভার দিয়ে কপালে হাত রাখলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলল। পরের মুহূর্তে পাশের টেবিলে থাকা কাঁচের গ্লাসটা ছুঁড়ে মারলো মেঝেতে।
.
.
প্রভা আসার পর থেকেই তার ছেলে মেয়ে নিয়ে ব্যস্ত। সারাটাদিন তাদের দেখে নি তাই এসেই তাদের কাছে চলে গেল। একদম রাতে তাদের ঘুম পারিয়ে এলো। এসে অর্কের সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, “আপনি না’কি মা’কে বলেছেন আপনি রাতে খাবেন না?”
অর্ক কাজ করছিল ফোনেই। চোখ তুলে তাকিয়ে দেখে প্রভা মুখটা ক্লান্তিতে ভরে গেছে। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে। সে জিজ্ঞেস করল, “তোমার এই অবস্থা কেন?”
“অনুষ্ঠানের বাহানা পেয়ে অদিন এই কয়দিনে কোনো পড়াশোনাই করে নি। ওকে পড়াশোনা করানো ও যুদ্ধ করা একই কথা। যেহেতু বাচ্চা তাই ধরে ধরে শিখাতে হয়।”
“ওহ।” অর্ক আবার কাজে মনোযোগ দিলো। প্রভা আবারও বলল, “খাবার খেয়ে নিন। আসুন।”
অর্ক এইবার রাগান্বিত স্বরে বলল, “মেজাজ খারাপ করবে না প্রভা। বলেছি তো খাব না। আর কাজ করছি দেখতেই পারছ তাও এসে তোমার মাঝখানে কথা বলতেই হবে। যাও তো এইখান থেকে।”
প্রভা কিছু বলল না। মাথা ঝুঁকিয়ে এগিয়ে এলো। আলমারি থেকে একটি শাড়ি নিয়ে বাথরুমে ঢুকতে নিলেই থেমে যায়। পিছনে ফিরে একপলক তাকিয়ে দেখে অর্ক শুধু বাম হাত দিয়ে মোবাইলে কাজ করছে। তার ডান হাতে আজ ব্যাথা পেয়েছে, ব্যান্ডেজ করা। তার মাথা থেকেই চলে গিয়েছিল ব্যাপারটা। সে ছোট এক নিশ্বাস ফেলে ভিতরে ঢুকলো। সারাদিনের ক্লান্তি দূর করার জন্য গোসল করে নিলো। বাহিরে এসে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলের পানি ঝাড়তে শুরু করল।
অর্কের মন তো কাজেই ছিলো কিন্তু প্রভা যখন খোলা চুলে বেরিয়ে এলো ওয়াশরুম থেকে তখন তাকে দেখেই তার সব মনোযোগ যেন মুহূর্তে উড়াল দেয়। এমনটা আগে কখনো হয় নি।
সে কাজ বাদ দিয়ে তাকিয়ে থাকে প্রভার দিকে। প্রভা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলের পানি ঝাড়ছিল। আর সে লুকিয়ে লুকিয়ে প্রভাকে দেখছি। সে তো চায় নি প্রভা যেন তাকে এমন বেহায়ার মতো তাকিয়ে থাকতে দেখুক। এতে তার ভাব হাওয়ায় মিশে যাবে না বুঝি?
তবুও তার চিন্তার বিপরীতটা ঘটল।
প্রভা চুল মুছতে মুছতে আয়নার দিকে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে গেল। আয়নায় দেখা যাচ্ছে অর্কের প্রতিচ্ছবি। অর্ক তার দিকে তাকিয়ে ছিলো। তার তাকানো দেখেই বোধহয় সে চোখ ফিরিয়ে নিলো বা হয়তো হঠাৎ করে এদিকে তাকিয়েছিলো আর তখনই প্রভাও তাকালো। প্রভা ভাবছে, হয়তো তারই ভুল অর্ক কেন তার দিকে তাকিয়ে থাকবে?
প্রভা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বারান্দায় তোয়ালে মেলে দিয়ে বাহিরে চলে গেল রুমে। ফিরে এলো এক প্লেটে খাবার নিয়ে। এসেই অর্কের পাশে বসে বলল, “আপনি একটু সোজা হয়ে বসুন। আমি খাইয়ে দিচ্ছি।”
অর্ক সে রাগান্বিত ভাব নিয়েই তাকালো প্রভার দিকে। বলল, “আমি তোমাকে বলেছি?”
“আপনার হাতে ব্যাথা পেয়েছেন।”
“চাইলে তো চামচ দিয়েই খেতে পারতাম তাই না? আমার খিদে নেই তাই খাই নি। যাও এইখান থেকে।”
অর্ক এমনটা বললেও প্রভা এক লোকমা বিরিয়ানি এগিয়ে দিলো তার দিকে। ঠোঁটের কোণে মিষ্টি একটি হাসি নিয়ে বলল, “তাও অল্প একটু খেয়ে নিন।”
অর্ক যদিও বকা দেওয়ার জন্য মুখ তুলেছিলো কিন্তু এমন মিষ্টি হাসি দেখে তার মন গলে গেল। সে এক ঢোক গিললো। মনের সাথে যুদ্ধ করতে লাগলো যে মোটেও সে এই মেয়ের হাসিতে নিজের নিয়ন্ত্রণ হারাবে না। সে পরাজিত হয়, জিতে যায় তার মন। আনমনেই উঠে বসে প্রভার হাত থেকে খেতে শুরু করল।
অদ্ভুত এক ব্যাপার আছে এই মেয়েটার মাঝে। যা তাকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে নিয়ে যায়। নিজের থেকে নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে সে। তার জীবনের সব প্রথম ভুলের কারণটি বোধহয় এই মেয়েটিই।
চলবে……
[আশা করি ভুল ক্রুটি ক্ষমা করবেন ও ভুল হলে দেখিয়ে দিবেন।]