মন বাড়িয়ে ছুঁই পর্ব -১৬+১৭

#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই
লিখা~ফারজানা ফাইরুজ তানিশা
পর্ব ১৬
.
নাতবউ, ও নাতবউ।”
বিকট কণ্ঠে ঘুম ভাঙে পৃথুলার। নিজেকে বিছানায় আবিষ্কার করে খানিকটা অবাক হয় সে। যতদূর মনে পড়ে, বারান্দায় চেয়ারে বসেছিল সে। তারপর কি হলো? ঘুমিয়ে পড়ল কখন? আর বিছানায় এলোই বা কি করে? তাহলে কি অভ্র এনেছে?

“কত বেইল হইছে খবর আছে? এহনো ঘুমাও ক্যান?”
দিলারা বেগমের কথায় সম্বিত ফিরে পেল পৃথুলা। ধাতস্ত হয়ে বলল,
“স্যরি দাদি। আসলেই অনেক বেলা হয়ে গেছে।”
“মাফ চাওন লাগবো না বইন। আমার নাতি বুঝি রাইত ঘুমাইতে দেয়নায়? মেলা আদর সোহাগ করছে, ক্যান? হেইল্লাইগ্যা ঘুম ভাঙতে দেরি হইছে।”
পৃথুলা মাথা নিচু করে রইল। লজ্জায় ওর মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে। দিলারা বেগম হেসে বললেন,
“আর শরম পাওন লাগবো না। যাও গোসল কইরা পবিত্র হয়া লও। আমি যাই।”

পৃথুলা আর কথা বাড়াল না। আলমারি খুলে আকাশি রঙের সুতোর কাজে কমলা রঙের একটা শাড়ি বের করল। গোসল করে শাড়ি পাল্টে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে মুছতে ড্রেসিংটেবিলের সামনে বসল।
এর মধ্যেই অর্থি ঢুকল রুমে। হাতে খাবারের ট্রে। অর্থি মিষ্টি হেসে বলল,
“শুভ সকাল ভাবি।”
“শুভ সকাল।”
তারপর একটু ইতস্তত করে বলল
“স্যরি। অনেক বেলা পর্যন্ত পড়ে পড়ে ঘুমিয়েছি! তোমরা কেউ ডাকলে না কেন আমাকে? সবাই কি মনে করেছে?”
অর্থি ট্রে টা সেন্টার টেবিলের উপর রেখে পৃথুলার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলল,
“কেউ কিছু মনে করেনি। ভাইয়া বলল, তোমার নাকি রাতে জ্বর এসেছে!”
“হুম। এখন ঠিক আছি। জ্বর নেই।”

অর্থি পৃথুলার কপালে হাত রেখে বলল,
“হ্যাঁ, এখন জ্বরটা নেই। তবে আবার জ্বর আসতে পারে। তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও। তোমার নাশতা এনেছি। ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নিও, কেমন?”
“এখানে কষ্ট করে আনার দরকার ছিল কি?”
“ভাইয়া বলল, তোমার শরীর দুর্বল। নিচে যেতে পারবে কীনা সেটা ভেবে আম্মু আমাকে দিয়ে নাশতা পাঠিয়ে দিয়েছে।”
“আমি একদম ঠিকাছি। কোনো অসুবিধে নেই।”
“তাহলে নিচে গিয়ে সবার সাথেই নাশতা করবে?”
“হ্যাঁ।”
“আচ্ছা চলো নীচে যাই।”
অর্থি ট্রে হাতে নিয়ে পৃথুলাকে নিয়ে ড্রইংরুমে গেল।
.
সারাদিনে পাড়া প্রতিবেশিসহ বিভিন্ন অতিথি এলো পৃথুলাকে দেখার জন্য। আর পৃথুলাকে সঙ সেজে তাদের সামনে হাসিমুখে বসে থাকতে হয়েছে। পৃথুলাকে দেখে কম বেশি সবাই প্রসংশা করেছে। বেশিরভাগ প্রসংশা ছিল ওর রূপের। অবশ্য তা হবে নাই বা কেন! চোখ ধাঁধানো আগুন সুন্দরী পৃথুলা।

মোটামুটি সারাদিনই এভাবে কেটে গেল। সন্ধ্যের পর আবার পাশের বাসাগুলো থেকে একগাঁদা মহিলা এসেছে নতুন বউকে দেখতে। তারা যেন পৃথুলাকে ছাড়ছেই না। তার বাপের বাড়ির সমস্ত বৃত্তান্ত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করছে।
আঞ্জুমান ভদ্রতার খাতিরে কিছু বলতেও পারছেন না। কিন্তু দিলারা বেগম চুপ থাকলেন না। দাঁত কটমট করে বললেন,
“তুমরা বউ দেখতে আইছো বউ দেখবা। হের বাপের বাড়ি সম্পর্কে জাইন্না তুমরা কি করবা? তুমরা খালি ঘন কতা কও মাতারি।”

পৃথুলা অস্বস্তিতে পড়ে গেল। একজন ভদ্রমহিলা বললেন,
“রেগে যাচ্ছেন কেন খালাম্মা? আপনারা বড় ঘরের মানুষ। আপনারা আত্মীয়তাও করবেন তেমন বড় ঘরের সাথে। তাই জিজ্ঞেস করছিলাম আরকি!”

এমন সময় অভ্র হাজির সেখানে। এসেই বলল,
“পৃথুলা, একটু রুমে আসো তো। দরকার আছে।”
অভ্র রুমে চলে গেল। দিলারা বেগম বললেন,
“এহনো বইয়া আছো ক্যান? তুমার এইহানে আর বইয়া থাইক্কা কাম নাই। স্বোয়ামি ডাকতাছে না? যাও, হের কাছে যাও।”
পৃথুলা নিঃশব্দে উঠে গেল। বড় একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। এতক্ষন খুব অস্বস্তি লেগেছিল। অভ্রকে মনে মনে একটা ধন্যবাদও দিল।

রুমে ঢুকে অভ্রকে কোথাও দেখা গেল না। ওয়াশরুমেও না।
“এদিকে এসো।”
বারান্দা থেকে অভ্রর আওয়াজ পাওয়া গেল। পৃথুলা বারান্দায় যেয়ে অভ্রর পেছনে দাঁড়াল।
“বলুন কি দরকার?”
অভ্র পৃথুলার দিকে ফিরল। বলল,
“কোনো দরকার নেই। তখন তোমার মুখ দেখেই বুঝলাম তোমার অস্বস্তি হচ্ছিল। ওনাদের মধ্যে থেকে বের করার জন্য দরকারের কথা বললাম। এনিওয়ে, বসো, কথা বলি।”

অভ্র একটা চেয়ার এগিয়ে দিল। পৃথুলা চুপচাপ বসে পড়ল। পাশের চেয়ারে অভ্র বসল। বলল,
“বাবা, মা, প্রত্যাশার সাথে কথা হয়েছে?”
“হুম।”
অভ্র একটু চুপ থেকে বলল,
“প্রত্যাশার কাছ থেকে শুনলাম, তোমার ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছা ছিল। মেডিকেলে চান্সও পেয়েছিলে। তাহলে পড়াশুনা ছাড়লে কেন?”
পৃথুলা ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
“ইচ্ছে ছিল। এখন আর নেই৷ এই অভিশপ্ত জীবনে আর কোনো ইচ্ছেই নেই।”

অভ্র কয়েক সেকেণ্ড নিরবে পৃথুলার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল,
“আচ্ছা পৃথা, ধর্ষণ বলতে আমরা কি বুঝি? সাধারণ কথায় জোর করে কারো সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করাকে ধর্ষণ বোঝালেও প্রকৃত অর্থে কারো ইচ্ছের বিরুদ্ধে তার উপর শারীরিক ও মানসিক জোর খাটিয়ে নিজ কার্য হাসিল করাকেই ধর্ষণ বলে। ধর্ষণ কেবল শারীরিক নয়, মানসিকও হয়। ধরো, তুমি ইলিশ মাছ খাও না৷ এখন কেউ যদি তোমাকে জোর করে ইলিশ মাছ খাওয়ায় তবে সেটাও একটা ধর্ষণ। এই আমার কথাই ধরো। আমার ইচ্ছা ছিল ‘ল’ পড়ব। কিন্তু আব্বুর জোরাজুরিতে তা হয়ে উঠল না। আব্বুর ইচ্ছের মান রাখতে গিয়ে আমাকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে হলো। আদতে এটাও একটা ধর্ষণ। মানছি তোমার সাথে একটা অনাকাঙ্খিত বাজে ঘটনা ঘটেছে। সেই ঘটনার প্রভাব তোমার উপর পড়তেই পারে। তার মানে তো এই না যে শুধুমাত্র একটি ঘটনার জন্য তোমার জীবন থেমে থাকবে! ওই ঘটনার পর চার চারটা বছর চলে গেছে পৃথা। ফোর ইয়ারস, দ্যাট’স লং টাইম। কিন্তু তুমি আজও আটকে আছো সেই চার বছর আগের ঘটনার মধ্যেই। অতীত থেকে শিক্ষা নিতে হয় পৃথা। কিন্তু অতীতকে আকড়ে ধরে বর্তমানকে হেয় করা নিতান্তই বোকামি। যেটা এতদিন ধরে তুমি করে এসেছো। সময় তার মত অতিবাহিত হয়ে গেছে, কিন্তু পিছিয়ে আছো তুমি। জীবনযুদ্ধে কখনো আমাদের হার হয়, আবার কখনো জিত হয়। হেরে গেছি বলে থেমে যাব কেন! তোমার সাথে দেখা হওয়ার পর থেকে ‘আমি ধর্ষিতা’ এই শব্দটা অনেকবার তোমার মুখে শুনেছি। কেন পৃথা? কেন বারবার নিজেকে ছোট করো তুমি? তুমি পড়াশুনা ছেড়েছো, নিজেকে ঘরবন্দী করে রেখেছো। এতে লাভ কি হয়েছে? বরং এগুলো করে তুমি নিজেকে শাস্তি দিয়েছো। তোমার সাথে যা ঘটেছে তাতে তো তোমার কোনো দোষ নেই। তাহলে বিনা দোষে তুমি নিজেই নিজেকে শাস্তি দিচ্ছো কেন? শাস্তি তো সেই সকল নরপশুরা পাবে যারা নিজেদের কামনা মেটাতে অসহায় মেয়েদের উপর হামলে পড়ে। তোমার জীবন অভিশপ্ত নয়। অভিশপ্ত তাদের জীবন, যারা মানুষ হয়ে জন্মেও ভেতরটা পশুর চেয়েও অধম।”

এই পর্যায়ে অভ্র একটু থামল। গলা খাঁকাড়ি দিয়ে আবার বলতে শুরু করল,
“পৃথা বি স্ট্রং। এতদিন যা করার করেছো। এখন থেকে নিজেকে শক্ত করবে। নিছক একটা দূর্ঘটনার জন্য কারো জীবন থেমে থাকে না৷ তোমারও থাকবে না৷ চলার পথে নানা প্রতিকূলতা আসবেই। সেই প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে সামনে এগিয়ে যেতে হবে পৃথা। ভেঙে পড়ার নাম জীবন নয়। জীবনে চলার পথে কখনো কখনো অন্ধকার নেমে আসে। সেই অন্ধকার হাঁতড়ে আলোর সন্ধান করে নিতে হয় পৃথা। তোমার জীবনের আঁধারগুলো এতদিনে কেটে যেত। কেন কাটেনি জানো? কারণ, তুমি কখনো আলোর পথই খোঁজোনি। গো ধরে অন্ধকারকে আঁকড়ে ধরেই এতগুলো দিন পার করেছো। জীবনের অনেকটা সময় নষ্ট করেছো তুমি। এবার সেই অন্ধকার পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে চলো। দেখবে আলোর সন্ধান তুমি পাবেই। এজন্য থাকতে হবে আত্মবিশ্বাস আর নির্দিষ্ট লক্ষ্য। তুমি আবারও পড়াশুনা করবে। তোমার সব স্বপ্ন, সব ইচ্ছে পূরণ করবে। আমি তোমার সঙ্গে আছি।”

পৃথুলার গাল বেয়ে নোনাজল গড়িয়ে পড়ছে। এই কথাগুলো সেদিন বিভোরের কাছ থেকে আশা করেছিল সে। কিন্তু…..
অভ্র পৃথুলার মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে ওর চোখ মুছে দিল৷ ভেজা দুচোখে আলতো করে চুমু খেল। বলল,
“দু মিনিট বসো। আমি আসছি।”
.#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই
লিখা~ফারজানা ফাইরুজ তানিশা
পর্ব ১৭
.
অভ্র উঠে বারান্দা থেকে বেরিয়ে গেল। পৃথুলা অভ্রর যাওয়ার পানে তাকিয়ে ভাবছে, সেদিন যদি এই অভ্র তার পাশে থাকত তাহলে কি তার জীবনটা এমন হতো? তার আকাশটা এমন ঘোলাটে, মেঘাচ্ছন্ন থাকতো? নাকি জীবন আকাশে উঁকি দিত এক রক্তিম সূর্য?

অভ্র রুম থেকে বেরিয়ে কিচেনে গেল৷ আঞ্জুমান কিচেনে রাতের রান্না করছেন। অভ্র বলল,
“হেল্প লাগবে আম্মু?”
আঞ্জুমান হেসে বললেন,
“তুই কি হেল্প করবি! পৃথুলা কোথায়?”
“রুমে।”
“ভালোই হইছে তখন ওকে ডেকে নিয়ে গেছিস। উফ্ মহিলাগুলো মেয়েটাকে প্রশ্ন করে করে পাগল বানিয়ে দিচ্ছিল।”
অভ্র কিছু না বলে কফিমেকারে কফি বানাতে নিল। আঞ্জুমান বললেন,
“কফি খাবি? দে আমি বানিয়ে দিচ্ছি।”
অভ্র বাধা দিয়ে বলল,
“তুমি তো এমনিতেই কাজ করছো। সমস্যা নেই৷ কফিটা আমিই বানাই। তুমি খাবে কফি?”
“নাহ।”

অভ্র দু মগ কফি বানিয়ে বারান্দায় এলো। পৃথুলা গালে হাত দিয়ে বসে আছে।
“পৃথা…”
“হু?”
“কফি নাও।”
“খাব না।”
“আমি বানিয়েছি। খেয়ে বলো কেমন হয়েছে?”

পৃথুলা মগটা নিল। ধোঁয়া ওঠা গরম কফিতে চুমুক দিয়ে বলল,
“দারুন কফি বানান তো আপনি।”
অভ্র পৃথুলার পাশে বসতে বসতে আহ্লাদি গলায় বলল,
“আহ্ জীবনটাই ধন্য আমার।”
বলেই হাসলো অভ্র। পৃথুলাও হালকা হাসল। অভ্র বলল,
“একটা কথা জিজ্ঞেস করব?”
“হুম।”
“বিভোর কে?”

পৃৃথুলা চমকে তাকাল অভ্রর দিকে। অভ্র বলল,
“আরে ঘাবড়ানোর কিছু নেই। আসলে কাল রাতে জ্বরের ঘোরে তুমি বিভোরের নাম নিয়েছিলে। তাই জানতে চাইছি।”
পৃথুলা কিছু বলল না। অভ্র বলল,
“স্যরি! ব্যক্তিগত ব্যাপারে প্রশ্ন করে ফেললাম বোধহয়।”
“স্যরি বলার কিছু নেই। আপনাকে বিভোরের কথা জানানো উচিত ছিল।”
একটু থেমে বলল,
“বিভোর আমার এক্স বয়ফ্রেণ্ড। আমি বিভোরকে ভালবাসতাম। বাসতাম বললে ভুল হবে। এখনো বাসি। চার বছরের রিলেশন ছিল আমাদের।”

পৃথুলা কাউকে ভালবাসে শুনে মনে মনে খানিকটা আহত হলো অভ্র। ছোট্ট করে বলল,
“ওহ।”
তারপর কৌতুহল নিয় জানতে চাইল,
“আচ্ছা বিভোর এখন কোথায়? তোমার সাথে ঘটা ঘটনার কথা সে জানে না?”
“জানবে না কেন? জানে বলেই তো সে আজ আমার সাথে নেই৷ আমার কাছ থেকে দূরে চলে গেছে।”
“মানে?”
“আমার রেপ হওয়ার পর আমার সাথে সম্পর্ক শেষ করে দেয়। ধর্ষিতা মেয়ের সাথে সম্পর্ক রাখতে যাবেই বা কেন!”

অভ্র হতবাক, বিষ্মিত। তার মুখ দিয়ে কেবল একটা কথাই বের হলো,
“এ কেমন ভালবাসা!”
“অবশ্য সে আমার কাছে সময় চেয়েছিল। প্রথমে একেবারেই না করে দিয়েছিল। পরে আবার কি যেন ভেবে সময় চেয়েছে। সময় নিয়ে সে তার ডিসিশান জানাবে, আমার সাথে সম্পর্ক রাখবে কি রাখবে না সেটা ভেবে জানাবে।”
“তুমি সময় দিয়েছো?”
“বিভোরকে আমি এই পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করতাম। আমার বিশ্বাস ছিল, সারা দুনিয়া আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেও বিভোর নেবে না। কিন্তু আমার ধারণা ভুল ছিল। সে জানালো, সময় নিয়ে ভেবে আমাকে তার ডিসিশন জানাবে। আমি কি করে তার জন্য অপেক্ষা করতাম বলুন তো? সে আমাকে ‘হ্যাঁ’ বলবে এই আশায়?”

অভ্র কিছু বলল না। পৃথুলা তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
“আসলে বিভোর খুবই বুদ্ধিমান। তাই সুযোগ বুঝে সটকে গেছে। রেপড হওয়া একটা মেয়েকে নিজের জীবনের সাথে জড়ানোর বোকামি সে করতে যাবে কেন? সবাই তো আপনার মত বোকা না।”
“আমি বোকা?”
“সন্দেহ আছে? যাকে আমি এত ভালবাসতাম সেই বিভোরই আমার হাত ছেড়ে দিয়েছে। আর আপনি….”
অভ্র পৃথুলার হাতের উপর হাত রেখে বলল,
“বিভোর ছেড়ে দিয়েছে। অভ্র ছাড়বে না কখনো। অন্তত প্রাণ থাকতে না।”

পৃথুলা চোখ তুলে তাকালো অভ্রর দিকে। অভ্র বলল,
“বিভোর এই চার বছরে তোমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেনি?”
“জানি না। হয়তো করেনি। আমিও চাই না ওর সাথে কখনো আমার দেখা হোক।”
অভ্র একটু ভেবে বলল,
“বিভোর যদি আবার তোমার জীবনে ফিরে আসে? তোমাকে তার কাছে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চায়, যাবে তার কাছে?”
পৃথুলার উত্তরটা যেন রেডিই ছিল। চট করে বলে ফেলল,
“নাহ।”

‘নাহ’ এই ছোট্ট একটা শব্দে কি মেশানো ছিল কে জানে! শব্দটা শুনে অভ্রর সমস্ত সত্ত্বা জুড়ে অদ্ভুত একটা প্রশান্তি ঢেউ খেলে গেল।
.
রিসেপশনের আয়োজন করা হয়েছে ‘বসুন্ধরা’ কমিউনিটি সেন্টারে। দুপুর বারোটা নাগাদ দুই পরিবারের প্রায় সব মেহমানই উপস্থিত হয়েছে কমিউনিটি সেন্টারে।
পৃথুলাকে সাদা স্টোনের কাজের সোনালী রঙের লেহাঙ্গা পরানো হয়েছে। লেহাঙ্গার ওড়নাটা গাঁঢ় খয়েরী। অভ্র পরেছে সাদা স্যুট। দুজনকে একসাথে মানিয়েছে বেশ। ফটোগ্রাফার বিভিন্ন এঙ্গেলে ওদের দুজনের কাপল ছবি তুলছে। অভ্র-পৃথুলাকে একসাথে দেখে অনেকের মুখেই একটা বাক্য শোনা গেল, ‘দে আর মেইড ফর ইচ আদার’।

উৎস ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলছিল। হঠাৎই তার চোখ আটকে যায় এক সবুজ পরীর উপর। প্রত্যাশা সবুজ রঙের একটা গাউন পরেছে। হাতে সবুজ কাচের চুড়ি। খোলা চুলে অপূর্ব লাগছে প্রত্যাশাকে। প্রশ্বস্ত হাসি ফুটে ওঠে উৎস’র ঠোঁটের কোণে। মুখ দিয়ে আপনাতেই বের হয়, ‘বিউটিফুল’।

প্রত্যাশার হাতের চুড়ির রিনিঝিনি শব্দ ঘায়েল করে নিচ্ছে উৎসকে। উৎস নিজের দিকে তাকাল। তার পরনে সবুজ পাঞ্জাবি। কাকতালীয়ভাবে দুজনেই আজ সেইম কালারের ড্রেস পরেছে। উৎস ক্যামেরাটা তুষারের কাছে দিয়ে এগিয়ে গেল৷ দাঁড়াল প্রত্যাশার মুখোমুখি।

“হেই বিউটি গার্ল!”
প্রত্যাশা মুখে বড় একটা হাসি টেনে বলল,
“হাই জল্লাদ ভাইয়া।”
উৎস মুখটা পাংশুবর্ণ করে অনুনয়ের সুরে বলল,
“প্লিজ আজকে আমরা ঝগড়া না করি। আমাদের মধ্যে আগে যা হয়েছে সেসব ভুলে যাব। আমরা বন্ধু হয়ে যাব! অনলি ফ্রেণ্ডস। প্লিজ প্লিজ!”
“ফ্রেণ্ডস? আমাদের এইজ পার্থক্য জানেন? আপনি বড় জোর আমার বড় ভাই হতে পারেন৷ তাতে অবশ্য আমার সমস্যা নেই। আমার তো ভাই নেই। আপনাকে ভাই বানানোই যায়।”
উৎস করুণ মুখে বলল,
“তাই বলে ভাই বানায় দিবা!”
প্রত্যাশা স্মিত হেসে সরে গিয়ে পৃথুলার পাশে দাঁড়াল।

আঞ্জুমান ফোন দিলেন তার বান্ধবী মনামীকে। ওপাশ থেকে কল রিসিভ হতেই আঞ্জুমান বললেন,
“কি রে কোথায় তুই? আর কতক্ষন লাগবে?”
“আমি এসে গেছি ডিয়ার। উপরে আসছি।”
আঞ্জুমান কল কাটার এক মিনিটের মাথায়ই তার সামনে হাজির হলেন মনামী মেহনাজ। তার পরনে একটা পাতলা জর্জেট শাড়ি। হাতাকাটা স্লিভলেস ব্লাউজ পরা। শাড়ির ভেতর দিয়ে শরীরের গঠন অনেকাংশই বোঝা যাচ্ছে মনামী মেহনাজের।

মনামী আর আঞ্জমানের বয়স কাছাকাছি। কিন্তু মনামীর ড্রেস-আপ, গেট-আপ দেখে তা বোঝার জোঁ নেই। পোষাক, সাজগোজের দিক দিয়ে অনুষ্ঠানে উপস্থিত সবার চেয়ে এগিয়েই আছেন।

মনামীকে দেখে দিলারা বেগমের কপালে সুক্ষ্ম ভাঁজ পরল। অতিমাত্রায় স্টাইলিশ এই ভদ্রমহিলাকে একদমই পছন্দ হয় না দিলারা বেগমের। হাজার হলেও আঞ্জুমানের বান্ধবী, তাই কিছু বলতেও পারেন না।

মনামী দিলারা বেগমকে দেখে হেসে বললেন,
“হ্যালো আন্টি। কেমন আছেন?”
দিলারা বেগম মনে মনে বললেন,
“খবিশ মাতারি। আদব কায়দা কিচ্ছুই জানে না। সালাম না দিয়া আইছে হিলু আন্টি কইতে।”
মুখে বললেন,
“বালাই আছি। তুমি কিমুন আছো?”
“জ্বি ভালো।”
আঞ্জুমান অভ্রকে ডেকে বললেন,
“অভ্র, দেখে যা কে এসেছে।”
অভ্র মনামীকে দেখে হাসিমুখে বলল,
“আসসালামু আলাইকুম আন্টি। কেমন আছেন?”
মনামী সালামের জবাব দেবার ধার ধারলেন না।
“আ’ম সো ফাইন বেটা। তোমার কি খবর?”
“আলহামদুলিল্লাহ। বিয়েতে আসেননি কেন আন্টি?”
“একটু ব্যস্ত ছিলাম। বাই দ্যা ওয়ে, নতুন বউ কোথায়?”
আঞ্জমান বললেন,
“আয় আমার সাথে। পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি।”

আঞ্জুমান মনামীকে নিয়ে স্টেজে গেলেন। পৃথুলাকে দেখিয়ে বললেন,
“এই হচ্ছে আমার পুত্রবধূ পৃথুলা ইসলাম।”
এরপর পৃথুলার দিকে তাকিয়ে বললেন,
“ও মনামী। আমার বাল্যকালের বান্ধবী। ব্যস্ততার কারণে বিয়েতে থাকতে পারেনি। আজ না আসলে তো ওর সাথে কথাই বলতাম না।”
বলেই হাসলেন আঞ্জুমান। পৃথুলা স্মিত হেসে সালাম দিল মনামীকে। মনামী সালামের উত্তর দিলেন না৷ তিনি বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছেন পৃথুলার দিকে। বজ্রাকণ্ঠে বললেন,
“তুমি! তুমি পৃথুলা না?”
.
চলবে___
চলবে____

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here