#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই
লিখা~ফারজানা ফাইরুজ তানিশা
পর্ব-২৫
.
“পৃথা!”
কয়েক কদম এগোনোর পর হঠাৎ পাশ থেকে বহুল পরিচিত একটা কণ্ঠ ভেসে এলো পৃথুলার কানে। পাশ ফিরে তার থেকে কয়েক হাত দূরে একটা লোককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে থমকে গেল পৃথুলা। লোকটা কয়েক কদম এগিয়ে পৃথুলার সামনে এসে দাঁড়াল, একদম মুখোমুখি।
“কেমন আছো পৃথা?”
পৃথুলা জবাব দিল না। বিষ্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইল আগন্তুকের দিকে। কয়েক সেকেণ্ড পর তার মুখ থেকে অস্ফুট স্বরে বের হল,
“বিভোর!”
হ্যাঁ, বিভোর দাঁড়িয়ে আছে তার সম্মুখে। কত বছর পর দেখল মানুষটাকে! দশ বছর? নাহ, আরো বেশি। বিভোরের চেহারায় এখন আগের মত জৌলস নেই। গায়ের সেই ধবধবে ফরসা রঙটা এখন অনেকটাই মলিন। চোখ দুটো দেবে গেছে। চোখের নিচে কালি জমে গেছে। হয়তো অনেক রাত নির্ঘুম কাটিয়েছে। শুকিয়ে গেছে অনেকটাই। আগের বিভোর আর এই বিভোরের মধ্যে এখন আকাশ-পাতাল তফাৎ৷
“আমি জানতাম আমি তোমাকে খুঁজে পাবই। আমার পৃথাকে আমি খুঁজে পাবই।”
বিভোরের কণ্ঠে উৎকণ্ঠা। পৃথুলা বিষ্ময় লুকিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্বাভাবিক গলায় বলল,
“তুমি এখানে?”
“হুম। বিয়েতে না এলে তো তোমাকে পেতাম ই না।”
“তুমি বরযাত্রীর সাথে এসেছো?”
“হ্যাঁ।”
“তুমি প্রহরের কী হও?”
“একচুয়ালি, আমি প্রহরের অফিসের বস। প্রহর আমার অফিসে চাকরি করে। মূলত ওর অনুরোধেই এসেছি বিয়েতে।”
“ওহ। তা তোমার স্ত্রী, সন্তান কেমন আছে?”
“স্ত্রী! সন্তান!”
“হ্যাঁ। মাঝখানে তো অনেকগুলো বছর কেটে গেল। এতদিনে বিয়ে করে বাচ্চার বাবাও হয়ে গেছো নিশ্চয়ই। বাচ্চা কয়টা তোমার?”
বিভোর কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে রইল। তারপর মাথা তুলে করুণ গলায় বলল,
“আমি ভুল করেছি পৃথা, অনেক বড় ভুল করেছি। তোমার কাছে ভাবার জন্য সময় চেয়েছিলাম আমি। কিন্তু অনেক ভাববার পরেও সেই আগের ডিসিশানই নিয়েছি, তোমার সাথে সম্পর্ক রাখব না। আমার মন তোমাকে চাইলেও পরিস্থিতি আমাকে তোমার কাছে আসতে দেয়নি। সমাজের চোখে ছোট হবার ভয়ে তোমার কাছে ফিরে যেতে পারিনি। তুমি হয়তো আমার অপেক্ষায় ছিলে। কিন্তু আমি আর তোমার খোঁজ নিইনি। একবারের জন্যও জানতে চাইনি তুমি কেমন আছো। বাট ট্রাস্ট মি পৃথা, আই ওয়াজ রিয়েলি মিসড ইউ। তোমাকে মিস করতাম ভীষণ। তোমার কথা, তোমার হাসি সব কিছু মিস করতাম।”
“আচ্ছা। তারপর?”
বিভোর ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
“তার কিছু মাস পরে আব্বুর বিজনেস পার্টনারের মেয়ে প্রিয়ার সাথে আমার পরিচয় হয়। এরপর এ্যাফেয়ার। মিথ্যে বলব না, তোমাকে আগে যেটুকুও মনে পড়ত, ওর সাথে প্রেম হবার পর মোটেও মনে পড়েনি। তিন বছর চুটিয়ে প্রেম করার পর প্রিয়া আর আমি ধুমধাম করে বিয়ে করেছিলাম। তোমাকে ভুলে প্রিয়াকে বিয়ে করায় ভীষণ খুশি হয়েছিল আব্বু।”
“ও আচ্ছা। প্রিয়া কেমন আছে?”
“জানি না।”
“জানো না মানে?”
“জানব কিভাবে! প্রিয়া তো আমার সাথে থাকে না।”
“থাকে না মানে? কোথায় থাকে?”
“প্রিয়া কোথায় আছে আমি সেটাও জানি না।”
“তুমি কি বলছো! আমি তোমার কথা কিছু বুঝতে পারছি না।”
“আল্লাহ আমাকে শাস্তি দিয়েছে পৃথা। তোমার সাথে করা অন্যায়ের শাস্তি পেয়েছি আমি।”
পৃথুলা চেয়েও নিজের উষ্মা লুকিয়ে রাখতে পারল না। বলল,
“আমি কিছু বুঝতে পারছি না বিভোর। কি হয়েছে বলবে?”
“বিয়ে করার পর ভালোই চলছিল আমাদের বিবাহিত জীবন। বিয়ের চার বছর পর প্রিয়া সন্তান নিতে চাচ্ছিল। আমি না করিনি। কিন্তু চেষ্টা করেও তা হয়নি। পরে ডাক্তারের কাছে গিয়ে যাবতীয় পরীক্ষা নীরিক্ষা করে জানা গেল প্রিয়া পুরোপুরি সুস্থ। যাবতীয় সমস্যা আমার মধ্যে। বাবা হওয়ার ক্ষমতা আমার মধ্যে নেই। ব্যাস, তারপর থেকেই আমাদের দুজনের ভালবাসায় থৈ থৈ করা সাগরে ধীরে ধীরে শুকিয়ে যাচ্ছিল। প্রিয়া আমার সাথে থাকতে চাচ্ছিল না। এরপর ছয় মাসের মাথায় প্রিয়া আমাকে ডিভোর্স দেয়। ওকে অনেক অনুরোধ করেছিলাম, বলেছিলাম দরকার হলে আমরা বাচ্চা এডপ্ট করব। কিন্তু প্রিয়া আমার কথা শোনেনি। ডিভোর্স দিয়ে চলে গেছে।”
একটু থেমে বিভোর বলল,
“ইউ নো হোয়াট? আশ্চর্যজনকভাবে প্রিয়া চলে যাওয়ার পর আমি প্রিয়ার নয় বরং তোমার উপস্থিতি মিস করেছি। বুঝতে পেরেছিলাম তোমাকে ছেড়ে আমি কত বড় ভুল করেছি। আমার মনে হয়েছিল, এমন পরিস্থিতিতে প্রিয়ার জায়গায় তুমি থাকলে কখনোই আমাকে ছেড়ে যেতে না। আমার সব দুঃসময়ে তুমি আমার পাশে ছিলে। আর আমি তোমার চরম দুঃসময়ে তোমার হাত ছেড়ে দিয়েছি। নিজের উপর রাগ হয়েছিল খুব। উদভ্রান্তের মত তোমাদের বাসায় গিয়েছি। কিন্তু সেখানে গিয়ে তোমাকে পাইনি। তোমরা নাকি বাসা পাল্টে ফেলেছো। তোমার বান্ধবীদের কাছে খোঁজ নিয়েছি। কিন্ত তারা কেউ তোমার খোঁজ দিতে পারেনি, হয়তো দিতে চায়নি। তুমি জানো না পৃথুলা, এতদিন তোমাকে আমি পাগলের মত খুঁজেছি। এতগুলো বছর কেবল তোমার দহনের অনলে পুড়েছি। তবে মনের কোথাও একটা আশা ছিল, তোমাকে আমি খুঁজে পাবই। আজ পেয়েছি দেখো। আমি আমার পৃথাকে পেয়েছি।”
বিভোরের চোখে জল, মুখে হাসি। আলতো করে পৃথুলার একটা হাত ধরে বলল,
“তুমি আবার আমার হয়ে যাও পৃথা। কথা দিচ্ছি, আর কোনো দিন তোমাকে কষ্ট দেব না। কখনো তোমায় কাছ ছাড়া করব না। সারাজীবন তোমায় ভালবাসার চাদরে মুড়িয়ে রাখব। আমার ভালবাসায় তোমাকে আজীবন বেঁধে রাখব।”
পৃথুলা তাচ্ছিল্য হেসে অবজ্ঞায় বিভোরের হাত থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিল। বিভোর অসহায় চোখে তাকিয়ে রইল পৃথুলার দিকে।
হঠাৎ লাল রঙের জামা পরা একটা ফুটফুটে মেয়ে ‘আম্মু’ বলে দৌড়ে এলো পৃথুলার কাছে। পৃথুলা পরম যত্নে মেয়েটিকে কোলে তুলে নিল। মেয়েটির তুলতুলে নরম গালে আলতো করে চুমু খেল। মেয়েটিও তার ছোট্ট হাত দুটি পৃথুলার দু গালে রেখে শব্দ করে পৃথুলার গালে চুমু খেল। তারপর হেসে উঠল খিলখিল শব্দে।
বিভোর একবার পৃথুলার দিকে তাকাচ্ছে আরেকবার তার কোলে থাকা মিষ্টি ফুটফুটে মেয়েটির দিকে তাকাচ্ছে। মেয়েটির চেহারার সাথে পৃথুলার চেহারার অনেকটাই মিল আছে। বিভোরের বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল। অজানা আশঙ্কায় তার বুক কাঁপছে। সে বিষ্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“মেয়েটি কে?”
পৃথুলা বিভোরের দিকে তাকালো। বলল,
“আমার মেয়ে। আমার আর অভ্রর মেয়ে পূর্ণতা।”
“অভ্র কে?”
“আমার হাজব্যান্ড।”
বিভোর প্রদীপের ন্যায় ধপ করে নিভে গেল। পৃথুলাকে ফিরে পাওয়ার সুক্ষ্ম আশার ঘর বুকে নিয়ে বেঁচেছিল এতদিন। আজ তা ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে।
কাঁপা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“তো..তোমার বিয়ে হয়েছে?”
“হুম। তুমি বিয়ে করে বৌকে নিয়ে সংসার করতে পারো, আমি পারব না? নাকি ভেবেছো ধর্ষিতা এই মেয়েটিকে কখনো কেউ বিয়েই করবে না। সেভাবেই সবাই ছুঁড়ে ফেলবে যেভাবে তুমি ফেলেছিলে!”
বিভোর মাথা নিচু করে রইল। পৃথুলা বলল,
“তুমি তখন ভুল বললে বিভোর। আমি তোমার অপেক্ষায় ছিলাম না। আমি জানতাম, তুমি ভেবে ঠিক একই সিদ্ধান্তেই আসবে। যে আমার চার বছরের ভালবাসাকে এক মুহূর্তেই আস্তাঁকুড়ে ফেলে দেয়, কিছুদিন ভেবেও যে তার সিদ্ধান্ত পাল্টবে না সেটা আমার বোঝা হয়ে গিয়েছিল। যে প্রথমে না করে দেয়, তার উত্তর শেষেও না-ই থাকে। তুমিই তো বললে প্রিয়ার সাথে রিলেশন হবার পর তুমি ভুলেই গেছ আমাকে। ভুলে গেছ পৃথুলা নামে তোমার জীবনে কেউ এসেছিল। এখন আমাকে এইটা বলো, প্রিয়া যদি তোমাকে ডিভোর্স না দিত, তাহলে তোমার মন আমার দিকে ফিরত?”
বিভোর কিছু বলল না। বলা ভালো, বিভোর বলার মত কিছু খুঁজেই পেল না।
.
চলবে____