মন_ছুঁয়েছে_সে #পর্বসংখ্যা_২৬ #মৌরিন_আহমেদ

0
310

#মন_ছুঁয়েছে_সে
#পর্বসংখ্যা_২৬
#মৌরিন_আহমেদ

পরদিন কথা অনুযায়ী লতাকে বাসে তুলে দিলেন জোহরা। সাথে লেবু মামাকে পাঠানো হলো তার সঙ্গী হিসেবে। তাকে দেশ ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়ানোর গাইড হিসেবে। যদিও মামা নিজেই কিছু চেনেন না। তবুও বড় বোনের কথায় যেতে বাধ্য হলেন। অবশ্য ওখানে যাওয়ার জন্য যে তার মনে একেবারেই ইচ্ছে নেই, তা না। এই সুন্দরী বিদেশিনী কন্যার সহযাত্রী হয়ে খাগড়াছড়ি ভ্রমণ সত্যিই সৌভাগ্যের ব্যাপার!

লতা মেয়েটা খুব বেশি বাংলা জানেন না। বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত বলে যেটুকু জনে তা প্রয়োজনে কাজ চালানোর মতো, গল্প জমানোর মতো নয়! অনেক্ষণ ধরে চুপ করে বসে আছেন লেবু মামা। তার পাশের সিটে বসা লতাও চুপচাপ। তিনি তাকিয়ে আছেন বাহির পানে। ভীষণ বেগে চলমান বাহিরের নিসর্গ দেখছেন। মনের ভিতর উসখুস করছে মামার। ক’দিন আগেও উনি খাগড়াছড়ি গিয়েছিলেন। কিন্তু তখন ছিলেন একা। গিয়েছিলেন মার্কো পোলো সাজতে। ফিরে এসেছিলেন হাত-পায়ে অনেক অনেক ব্যান্ডেজ নিয়ে। আর আজ যাচ্ছেন এক সুন্দরী রমণীকে সাথে নিয়ে, সুন্দর ঐ খাগড়াছড়ির মোহময় দৃশ্য দেখাতে।

সাত দিনের ট্যুর। সঙ্গে যথেষ্ট পরিমাণে জামা-কাপড়, টাকা-পয়সা নিয়ে, শান্তি মতো ঘোরার জন্য যা কিছু দরকার সবকিছুই প্যাক করে দিয়েছেন জোহরা বেগম। এই বৃহৎ সফরে যাচ্ছেন অথচ পাশের রমণীর সাথে সেভাবে কথাই হয় নি তার! কথা বলা উচিত। অথচ কী বলবেন ভেবে পাচ্ছেন না। অনেক চিন্তা-ভাবনার পর বললেন,

– বাংলাদেশ কেমন লাগছে আপনার?

লতা হয় তো শুনতে পেলেন না। তাই কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আবারও ডাকলেন,

– মিস. লতা? মিস. লতা?

এতক্ষণে হুশ হলো তার। জানালা থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে মামার দিকে তাকালেন। হাসি হাসি চাহনি দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

– Yea….What did you say?

– মানে… আমি বলছিলাম বাংলাদেশ আপনার কেমন লাগে?.. দেশে এসেছেন, থাকছেন। অনুভূতি কেমন?

প্রশ্ন শুনে মিষ্টি করে হাসলেন লতা। বাঁ হাতে একপাশের চুলগুলো নেড়ে বললেন,

– Bangladesh is really beautiful… ভীষণ সুন্দর, তবে….

– তবে কী?

আগ্রহী চোখে তাকান মামা। উনি আবারও বললেন,

– এখানে একটু গরম। কেমন ভ্যাপসা গরম…

– তা আছে বটে, তবে আমাদের সাথে সেটা মানিয়ে যায়… আপনি বিদেশী আপনার তো স্যুট করবেই না!..

– ভুল বললেন। I’m not foreigner, I’m a Bangladeshi, Bengali..

মেয়েটার প্রতিবাদ দেখে হাসলেন মামা। কিছুটা ফোঁড়ন কাটার মতো করে বললেন,

– আপনি যে বাঙালি, ভাষা শুনলে মনে হবে না!..

– Are you insulting me?

সূক্ষ্ম চোখে তাকান লতা। মামা হঠাৎ কী বলবেন ভেবে পেলেন না। মাথা চুলকে বললেন,

– আমি আপনাকে অপমান বা ইনসাল্ট করছি না।… শুধু বলছিলাম আপনার ভাষার কথাটা। আপনার কন্ঠটা খুব সুন্দর, এ কন্ঠে ভাঙা ভাঙা বাংলা মানায় না!

নিজের প্রশংসা শুনে কেন যেন খুশি হয়ে উঠলেন লতা। এটা সুন্দরী মেয়েদের সহজাত বৈশিষ্ট্য। রূপ অথবা গুণের প্রশংসা শুনলে তারা লবণের মতো গলে যায়! লজ্জাবতী লতিকার মতোন নুইয়ে পড়ে! উনিও হালকা লজ্জা পাওয়া গলায় বললেন,

– তাহলে কি মানায়?

– শুদ্ধ ভাষায় মিষ্টি বাংলা। আপনি কিন্তু চাইলেই আপনার বাংলা বলাটা আরেকটু শিখে নিতে পারেন!..

– শিখে নেব? কিন্তু কে শেখাবে? আপনি?

– আমি?

কিছুটা অবাক হলেন মামা। বিস্ময়ে বললেন,

– আমি কী করে শেখাবো? আমি কি পারি?

– কেন পারবেন না? আপনি তো ভালোই বলতে পারেন, তাহলে শেখাতে সমস্যা কোথায়?

– কিন্তু… আমি..

– কোনো কিন্তু না!… আপনিই আমাকে শেখাবেন।

মামা দ্বিরুক্ত করতে চাইলেন। কিন্তু পারলেন না। লতা মেয়েটা এতো মিষ্টি করে অনুরোধ করলেন যে আর না করতে পারলেন না। এরপরও না করে দিলে সে মনে কষ্ট পেত। সুন্দরী মেয়েদের মনে কষ্ট দিতে নেই!
____________________

গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেল জোহরা বেগমের। চোখ মেলেই অনুভব করলেন তার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। শুকনো ঢোক গিলে গলা ভেজানোর চেষ্টা করলেন কিন্তু লাভ হলো না। প্রবল তৃষ্ণার্থ গলাটা তখন একটুখানি পানির আশায় ছটফট করে উঠলো। উনি পাশ ফিরে তাকালেন। পাশেই গম্ভীর মুখে ঘুমিয়ে আছেন জয়নাল আবেদীন। মানুষটা এতোটাই গম্ভীর যে ঘুমের মধ্যেও সরলমুখে থাকতে পারেন না। উনি খুব ধীরে ধীরে শ্বাস নিচ্ছেন, নাক ডাকা জাতীয় কোনো শব্দ নেই। গম্ভীর মুখো মানুষেরা নাক ডাকেন না। ড্রিম লাইটের আলোয় ঘরটা আলোকিত। পরিবেশটা কেমন নীরব, গা ছমছমে। দূর থেকে ভেসে এলো একটা কুকুরের ‘ঘেউ ঘেউ’ আওয়াজ। ভয়ে কেঁপে উঠলেন জোহরা বেগম। এইরকম পরিবেশে উনি একা একা বেরোবেন? কিন্তু না বেরোলেও তো চলবে না। গলা শুকিয়ে যে কাঠ! ভিজিয়ে না নিলে যে স্বস্তিই মিলবে না!

উঠবেন কী উঠবেন না এই নিয়ে মনের ভিতর যুদ্ধ চললো কিছুক্ষণ। উঠলে ভয়, না উঠলে তৃষ্ণা দু’টোই দ্বিধায় ফেলে রেখেছে তাকে! শেষ পর্যন্ত জয় হলো তৃষ্ণার। বুকে সাহস নিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসলেন। গায়ের পাতলা কাঁথাটা সরিয়ে ধীর পায়ে বিছানা থেকে নামলেন। ড্রিম লাইটের আলোয় হেঁটে ঘরের এসে দাড়ালেন। দরজা খোলাই আছে কিন্তু সামান্য ভিজিয়ে দেয়া। আলতো হাতে দরজা ধরে উনি ভীত চোখে মাথা বাড়িয়ে দিলেন। ড্রইং রুমটা অন্ধকার। একরত্তি আলোর ছিটে নেই ওখানে!

উনি ধীর পায়ে হেঁটে ডাইনিং স্পেসের দিকে এগিয়ে গেলেন। আলো-আঁধারীতে হাতড়ে গ্লাস খুঁজে নিলেন। জগ থেকে পানি ঢেলে নিয়ে চেয়ার টেনে বসলেন। এক ঢোকে সবটা পানি শেষ করে, ভীষণ শান্তি পেলেন। আহ্! গলাটা যেন রৌদ্র তপ্ত চৈত্রের দিনের ফেঁটে চৌচির হয়ে গিয়েছিল, পানি পেয়ে সবুজ হয়ে উঠলো!

উনি এবারে বেশ স্বাভাবিক চাহনিতে চারপাশে তাকালেন। আলো জ্বালেন নি, আশপাশে তাই এখনো অন্ধকার। তবে তাকে ভয় পেলেন না। এতো বছর এ বাড়িতে আছেন, অথচ এখনও কী না রাতের বেলা ঘর থেকে বেরোতে ভয়? লোকে জানলে কী বলবে? ভেবেই নিজেকে ধিক্কার জানালেন মনে মনে।

ধীরে ধীরে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। নিজের ঘরে ফিরে যাওয়ার সময় হঠাৎ কী যেন ভেবে অনন্যার ঘরের দিকে তাকালেন। অনু কখনো দরজা লাগিয়ে ঘুমোয় না, আজও সেটা খোলা। ও ঘরে ড্রিম লাইট জ্বালায় না তাই ওই ঘরের অবস্থা আরও ভুতুড়ে! বাইরে জ্বলতে থাকা ল্যাম্প পোস্টের আলোর ছিটেফোঁটা জানালা দিয়ে ঢুকছে। সেই আলোয় দেখতে পেলেন অনুর বিছানা খালি!

কৌতূহলী হয়ে কয়েক পা এগিয়ে দেখলেন সত্যিই সেখানে কেউ নেই! এলোমেলো কাঁথা বিছানায় ছড়ানো। ভীত চোখে ওয়াশরুমের দিকে তাকিয়ে দেখলেন, দরজা বাইরে থেকে লাগানো। মানে ও ওয়াসরুমে নেই!

উনি কেমন ভয় পেয়ে চারপাশে তাকালেন। ধীর পায়ে হেঁটে এগিয়ে গেলেন ব্যালকনির দিকে। ওখান থেকে কার যেন আওয়াজ আসছে! কথা বলছে কেউ!

খুবই সন্তর্পনে ব্যালকনির দরজায় এসে দাড়ালেন জোহরা। ভীত চোখে সামনে তাকাতেই চমকে উঠলেন উনি। ব্যালকনির রেলিং ধরে অনু দাড়িয়ে। উল্টো দিকে দাড়িয়ে, ডান পাশে মাথা ফিরিয়ে আছে। হাত নেড়ে কার সাথে যেন কথা বলছে! আশ্চর্য! কেউ নেই তো ওখানে! অনু একা একা কথা বলছে আর হাসছে। লজ্জায় মাথা নুয়াচ্ছে। কী অদ্ভুদ! ও আসলে করছে টা কি? জ্বিনে আসর করলো না কী? সর্বনাশ!

ভয়ার্ত মুখে কয়েকবার ঢোক গিললেন উনি। নিজের মেয়ের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলেন তার মতিগতি! কি হচ্ছে কিছু বুঝতে না পেরে আরও ভয় পেয়ে গেলেন। একবার ভাবলেন অনন্যাকে ডাক দেবেন। আরেকবার ভাবলেন না থাক। কাল সকাল হলে জিজ্ঞেস করে নেবেন। আপাদত আর কিছু করলেন না। যেমন পা টিপে টিপে ঘরে ঢুকেছিলেন তেমন করেই ফিরে গেলেন নিজ ঘরে।

ধীর কিন্তু ভয়ার্ত দৃষ্টিতে একবার ঘুমন্ত জয়নাল সাহেবকে দেখে নিলেন। আলতো করে বিছানায় উঠে গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়লেন। কাঁথা টেনে মাথা ঢেকে ‘ইয়া নফসি, ইয়া নফসি’ জপতে জপতে একসময় ঘুমিয়ে গেলেন।
___________________________

গাড়ি থেকে নেমেই রিসোর্টে ঢুকে পড়লো বর্ষণ। পরনে নীল পাঞ্জাবি আর সাদা প্যান্ট। হাতে বিশাল লাগেজ। ওর ঠিক পেছন পেছন আসছে প্রদোষ। ফর্মাল ড্রেসআপের সাথে তার হাতেও একটা লাগেজ। ওরা প্রথমেই রিসোর্টের ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা করে নিলো। তারপর একজন কর্মকর্তাকে সাথে নিয়ে এগিয়ে গেল তাদের জন্য বরাদ্দকৃত কটেজের দিকে।

রিসোর্টের শানে বাঁধানো লনে হেঁটে কটেজের দিকে যাচ্ছে ওরা। সামনে মারমা সেই কর্মচারীটি। তার পেছনে পেছনে বর্ষণ আর প্রদোষ। চারপাশ দেখতে দেখতে প্রদোষ হঠাৎ আপনমনেই বললো,

– ভীষণ সুন্দর এ জায়গাটা, তাই না?

– এখনও তো ভিতরেই গেলি না… তাতেই বলছিস, জায়গাটা সুন্দর?

জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে বর্ষণ। প্রদোষ বিরক্ত হয়ে বললো,

– একটা জায়গা সুন্দর বলার জন্য সেখানে দশ-বারো বছর থাকার প্রয়োজন হয় না। প্রয়োজন হয় সুন্দর একটা দৃষ্টি ভঙ্গির, বুঝেছিস?

– ও আচ্ছা। ও আচ্ছা। তুমি তাহলে খাওয়া ছাড়া অন্য কিছুও বোঝ?.. জানতাম না তো!

ব্যঙ্গ কণ্ঠে প্রদোষকে ক্ষেপানোর চেষ্টা করে বর্ষণ। ও সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

– এখানে এসেও শুরু করে দিলি? তুই আর…

– কী করবো, বল্? তোর দিকে তাকাতে গেলেই তো সর্বপ্রথম তোর ঐ বিশাল ভুঁড়িটাই নজরে আসে!…

বলতে বলতেই হেসে উঠলো। প্রদোষ ব্যাজার মুখ করে সামনে তাকিয়ে হাঁটতে থাকে। হঠাৎ খেয়াল হয় রাস্তার অপর পাশ থেকে হেঁটে আসছে দু’জন অল্পবয়সী তরুণী। রূপবতী তরুণী। তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যই নিজের বাঁ হাতটা মাথার কাছে তুলে নেয়। চুলগুলো ব্যাক ব্রাশ করতে করতেই সামান্য ভাব নেয়। মেয়ে দুটো এদিকে তাকায় ঠিকই কিন্তু ওকে না, বর্ষণকে দেখতে দেখতে চলে যায়। বর্ষণ অবশ্য সেদিকে পাত্তা দেয় না, দ্রুত হেঁটে প্রদোষের কাছে চলে আসলো। কনুই দিয়ে ওর পেটে একটা গুঁতা মেরে বললো,

– ওরা তোকে নয়, তোর ভুঁড়িটাকে দেখেছে… চল্, চল্… কটেজে যাই!..

#চলবে——-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here